ইংরেজির আশীর্বাদ
শ্রীশুভ্র
হই হই রই রই করে এসে গেল
২০১৯। নতুন বছর। নতুন ভাবনা। নতুন কার্যক্রম। সরকারী বেসরকারী। সমাজিক রাজনৈতিক
নানাবিধ নতুন প্রকল্প দেখতে পাবে রাজ্যবাসী। নতুন বছর তাদের অনেক চাহিদাই নিশ্চয়
পুরণ করবে। কারণ মানুষ মাত্রেই মূলত আশাবাদী। কাঁটাতারের এই পারে অধিকাংশ মানুষেরই
বহু দিনের একটি চাহিদা ছিল। অনেকেই চাইতেন নিজ সন্তানকে সরকারী শিক্ষাব্যবস্থায়
ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া শেখাতে। কিন্তু অধিকাংশ সরকারী স্কুলগুলির শিক্ষাদানের
মাধ্যম বাংলা হওয়ায় সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন লাখো লাখো ইংরেজি প্রেমী
অভিভাবক। যাঁদের অনেককেই সাধ্যের বাইরে গিয়েও বেসরকারী স্কুলে কচিকাঁচাদের ভর্ত্তি
করতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হতো। উপার্জনের বাইরেও আরও উপার্জন করে হাজার হাজার টাকা
ব্যায় করতে হয় বেসরকারী স্কুলগুলির মুনাফার খিদে মেটাতে। সন্তানকে ইংরেজ করে তোলার
সাধ মেটানোর জন্য। আর্থিক সঙ্গতি যাঁদের শক্তিশালী, তাঁদের অবশ্য যত দামী ইংরেজি
স্কুল, যত বেশি ব্যায়ভার ততই মানসিক তৃপ্তি। ততই বুক ভরা গর্ব। গ্রীন কার্ডের
স্বপ্নও তাঁদের কাছে তত বেশি মোহময়। সে কথা থাক। কিন্তু সন্তানকে ইংরেজ করতে
যাঁদের নাভিশ্বাস উঠে যায়, সন্তানের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির দিককে অবহেলা করেও যাঁদেরকে
ইংরেজি স্কুলগুলির অতিরিক্ত মুনাফার সর্বগ্রাসী খিদে মেটাতে হয়; তাঁদেরও বহুদিনের
আক্ষেপ রাজ্যে সরকারী স্কুলগুলিতে যদি ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা থাকতো,
তবে অনেক দুর্গতি থেকেই রক্ষা পাওয়া যেত। আর যাঁদেরকে, কোন ভাবেই সাধ ও সাধ্যের
ভিতর সামঞ্জস্য করতে না পেরে নেহাতই বাধ্য হয়ে সন্তানকে বাংলা মাধ্যমের
স্কুলগুলিতে ভর্ত্তি করতে হয় কপালে কড়াঘাত করে, তাঁদেরও বহুদিনের দাবি একটাই রাজ্য
সরকারের স্কুলগুলিতে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা করার।
সমাজদেহের অভ্যন্তর থেকে
উঠে আসা দাবিগুলিকে বেশিদিন অস্বীকার করার ক্ষমতা কোন সরকারেরই প্রায় থাকে না।
রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষত দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন থাকলে অনেকটা পরিমাণে সেই দাবিগুলির
অভিমুখ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও একেবারে যে ধামাচাপা দিতে পারে তেমনটাও নয়। এখানেই
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিশেষ ভুমিকা। আবার রাজনৈতিক দলগুলিও নিজ নিজ
স্বার্থে জনমানসে নানাবিধ দাবি গড়ে তোলার কাজও করে চলে তলায় তলায়। সবটাই রাজনীতি।
তবুও সেই রাজনীতির সমান্তরালে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও জনমানসের দাবিকে রূপ দিতে থাকে
অধিকাংশ সময়েই। আর সেখান থেকেই সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানোর দাবি উঠে
এসেছে প্রবলভাবেই। ইংরেজি জানা ও না জানা এই দুই শ্রেণীর ভিতর অর্থনৈতিক শ্রেণী
বৈষম্যই সাধারণ ভাবে জনমানসকে প্রভাবিত করবে, সেটাই স্বাভাবিক। সেই ভিত্তিতেই
অধিকাংশ অভিভাবকেরই স্বপ্ন থাকে সন্তানকে ইংরেজিতেই লেখাপড়া শেখানোর। আমাদের সমাজে
ধরেই নেওয়া হয়েছে, ইংরেজি জানাটাই অর্থনৈতিক ভাবে সামাজিক স্তরের উঁচুতলায় ওঠার
একমাত্র সিঁড়ি। এর বাইরে আর কোন পথ নাই। এই ধারণার পেছনে পরাধীন দেশের শতাধিক
বছরের প্রত্যক্ষ ইতিহাস জড়িয়ে আছে। স্বাধীনতার পরেও যে বাস্তবতা প্রবল থেকে
প্রবলতর হয়ে উঠেছে। আর বিশ্বায়নের ঢক্কানিনাদে যে বিশ্বাসের বাইরে আর কোন স্বাধীন
পরিসরই আজ আর অবশিষ্ট নাই। সকলের মনেই একটি বদ্ধমূল বিশ্বাস জন্মিয়ে গিয়েছে,
লেখাপড়ার মাধ্যমটাই যদি না ইংরেজিতে সূচিত হয়, তবে কেউ আর ইংরেজি শিখতে পারে না।
বা ইংরেজিতে পারদর্শী হতে গেলে ইংরেজি মাধ্যমেই লেখাপড়া একমাত্র বিকল্পহীন পথ।
এঁদের অনেকেই জানেন না যে, খোদ ইংল্যাণ্ড আমেরিকাতেও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়া লক্ষ লক্ষ ইংরেজ
থাকে, যাঁরা ইংরেজিতে কোনভাবেই পারদর্শী নয়। তাদের পারদর্শীতা কোন না কোন অন্য
বিষয়ে বা কারিগরী শিক্ষাদীক্ষায়। কিন্তু সাগরপারের সমাজবাস্তবতার কটা খবরই বা
আমাদের জানা থাকে ঠিকমতো? প্রচারের ঢক্কানিনাদের বাইরে। ফলত বাঙালি অভিভাবক
মাত্রেই মনে করেন সন্তানের দুধেভাতে থাকা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন লেখাপড়ার
মাধ্যমটাই হয়ে ওঠে ইংরেজি। এরই সাথে যুক্ত হয়েছে একদিকে সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায়
সফল হয়ে ওঠার বিষয়টি। আর অন্যদিকে বিশ্বায়নের দৌলতে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার সুস্পষ্ট
এবং তীব্র বাসনা।
সকলকেই হয়ে উঠতে হবে ইংরেজিতে
পারদর্শী। তাহলেই চিচিংফাঁক হয়ে খুলে যাবে আলিবাবার গুপ্তধনের দরজা। এমনটাই সুদৃঢ়
বিশ্বাস আজ আমাদের সকল অভিভাবকদের। আর সেখান থেকেই সন্তানের জন্য সরকারী স্কুলে ইংরেজি
মাধ্যমে লেখাপড়া করানোর সুযোগ পেতে আগ্রহী অধিকাংশ বাবা মায়েরাই। বিশেষ করে যাঁদের
আর্থিক সঙ্গতি যত কম। সত্যি করে বলতে গেলে সাধ তো আর সাধ্য মানে না। তাই আজকের
বাঙালি অভিভাবক মাত্রেই সকলের প্রধান চাহিদাই ইংরেজি মাধ্যমের সরকারী স্কুল। এটাই
এই সময়ের দাবি। সমাজ বাস্তবতার দাবিকে উপেক্ষা না করতে পেরেই হয়তো রাজ্য সরকার এই
বছর থেকে ধাপে ধাপে সরকারী ও সরকার অনুমোদিত বাংলা মাধ্যমের স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে
শিক্ষাদানের নীতি গ্রহণ করেছে। কোন সন্দেহ নাই এটি একটি যুগান্তকারী
সিদ্ধান্ত। পলাশীর যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে
মীরজাফরের বিদেশী বণিক ক্লাইভের পাশে থাকার সিদ্ধান্তের মতোই যুকান্তকারী। সেই
একটি সিদ্ধান্তেই গোটা বাংলার ইতিহাসটাই ওলোটপালোট হয়ে গিয়েছিল। যার প্রভাব আমাদের
সবকিছুর মূলেই আজও সমান ভাবে বহমান। না রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে
বিশ্বাসঘতকতার সমগোত্রীয় বলার চেষ্টা করা হচ্ছে না কোনভাবেই। আমরা আগেই দেখিয়েছি
কিভাবে সমাজদেহের ভিতর থেকেই উঠে আসা দাবিকে অস্বীকার করতে না পেরে, বরং মান্যতা
দিতেই সরকারকে এমন একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। মীরজাফরের সেদিনের সিদ্ধান্তের
সাথে প্রতিতুলনার কারণ একটিই। সেটি হলো দুটি সিদ্ধান্তই যুগান্তকারী। একটি
সিদ্ধান্ত কিভাবে যুগান্তর ঘটিয়ে দিয়েছিল এই বাংলার মাঠ ঘাট প্রান্তর জীবন জীবিকা
সংস্কৃতির সেটা আমরা কম বেশি সকলেই অবগত। ঠিক সেইরকম ভাবেই এই সিদ্ধান্তও যদি
সত্যই কার্যকার হয় এবং পরিচালন করে বাঙালির সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে, তবে আগামী
শতকে এর যুগান্তকারী প্রভাব সকলেরই বোধগম্য হয়ে উঠবে সন্দেহ নাই। আজ অধিকাংশ জনের
কাছেই যা স্পষ্ট হবে না। হয় না। সম্ভব নয়। ঠিক যেমন সিরাজের রাজত্বের অবসানকালেও
সেদিনের বাঙালি যুগান্তরের কোন লক্ষ্মণই টের পায় নি। বুঝতেই পারেনি, কতবড়ো ওলোট
পালোট ঘটে গিয়েছে পলাশীর প্রান্তরে।
ভাবা যাক ফ্রান্সের
প্রেসিডেন্ট ঠিক এই রকমই একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলেন। বিশ্বায়নের ভাষা ইংরেজি।
ইন্টেল মাইক্রোসফ্ট গুগল ফেসবুক সব কয়টিই মার্কিণ কোম্পানি। যেদেশের ভাষা ইংরেজি।
ডলারের ভাষা ইংরেজি। আন্তর্জাতিক ব্যাবসা বাণিজ্যের ভাষা ইংরেজি। (অন্তত শিক্ষিত
বাঙালি মাত্রেই এমন ধারণা পোষন করেন)। একমেরু বিশ্বে ইংরেজিই প্রভুত্ব করে চলেছে,
সামরিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিগন্তে। ফলে ফরাসি সরকারও ভাবতে পারতেন কি হবে গেঁয়ো
ফরাসির পিছনে অর্থবরাদ্দ করে। বড়জোর কবিতা গান আর নাটক লিখে সিনেমা করে তো আর
উন্নতি করা সম্ভব নয়। তাই উন্নয়নের ভাষাকেই অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিটি ফরাসিকেই ইংরেজিতে
পারদর্শী হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে। তাই ফ্রান্সের সরকারী স্কুলগুলিতে এখন থেকে
ইংরেজি মাধ্যমেই শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হবে। কল্পনাকে আরও একটু প্রসারিত করে
ভাবা যেতে পারে ক্রমে ক্রমে জার্মান ইতালী রাশিয়া গ্রীস ইত্যাদি দেশের সরকারও এমনই
সমপর্যায়ের নীতি গ্রহণ করে ফেলতে লাগলো। কি হতে পারতো তাহলে? অন্তত ইংরেজিতে
পারদর্শী বাঙালি থেকে শুরু করে ইংরেজি প্রেমী সকল বাঙালিই যে আল্হাদে আটখানা হয়
বিজয় মিছিল বার করতো শহীদ মিনার থেকে শুরু করে জেলায় জেলায়, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু
কি ঘটতো ফ্রান্সে? কি ঘটতো জার্মানীতে? ইতালি, রাশিয়া কিংবা গ্রীসে? সে কথাও বলাই
বাহুল্য। সেখানে জনগণই তাদের সরকারকে টেনে নামিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিত ভুমধ্যসাগরে। এই
দেশগুলির প্রত্যেকটিতেই সবকিছু পরিচালিত হয় মাতৃভাষায়। সব কয়টি দেশেই বিশ্বের
অধিকাংশ ভাষা শেখারও সুবন্দোবস্ত রয়েছে। সব কয়টি দেশেই বহু ভাষাবিদ মানুষ ছাড়াও
একাধিক ভাষায় সড়গড় মানুষও রয়েছেন। কিন্তু শিক্ষার মাধ্যমকে মাতৃভাষার বদলে বিদেশী ভাষায় পরিচালিত করার মতো
উদ্ভট কষ্টকল্পনা এই দেশগুলির নিতান্ত অজ্ঞ মূর্খ নিরক্ষর মানুষের মনেও উদয় হয় নি
আজও। না বিশ্বায়নের শত সহস্র ঢক্কানিনাদেও।
আর ঠিক এইখানেই স্বাধীন
দেশের জনমানসের মনোবৃত্তির সাথে পরাধীন দেশের জনমানসের মনোবৃত্তির আকাশ পাতাল
তফাৎ। একটি দেশের মাতৃভাষা তার জীবন জীবিকা ব্যবসাবাণিজ্য সমাজ সংস্কৃতির এবং
ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের প্রধান শিকড়। সেই শিকড়টাকেই কেটে ফেলে দিয়ে সেখানে বিদেশী
ভাষাকে শিকড় করার প্রয়াস, না উন্নত বিশ্বের কোন দেশই আজ পর্য্যন্ত স্বীকার করে নি।
এটি অনেকটাই নিজের পায়ের উপর ভরসা না করে সোনার ক্র্যাচে ভর করে দৌড় দেবার
প্রয়াসের মতোই। কিন্তু সেই সত্য উপলব্ধির ক্ষমতা আজ আর বাঙালির নাই। নাই কারণ
আমাদের পরাধীন মানসিকতার ঐতিহ্য ইতিহাস ও উত্তরাধিকার। সেই ঐতিহ্যে বাঙালি মাত্রেই
জানে ইংরেজি না শিখলে গতি নাই। বাঙালি মাত্রেই ধারণা ইতিহাস ভুগোল বিজ্ঞান বাণিজ্য
কি জানি কতটা জানি সেটি বড়ো কথা নয়, ইংরেজিতে না জানলে সমাজে কল্কে পাওয়া যাবে না।
জীবন জীবিকার সুরাহা হবে না। আমাদের সমাজটা সেইরকম উদ্ভট ভাবেই গড়ে উঠেছে। আমরা
বিশ্বাস করি বিজ্ঞানের ভাষা ইংরেজি। প্রযুক্তির ভাষা ইংরেজি। অর্থনীতির ভাষা ইংরেজি।
বাণিজ্যের ভাষা ইংরেজি। উন্নতির ভাষা ইংরেজি। কৌলিন্যের ভাষা ইংরেজি। আইন আদালতের
ভাষা ইংরেজি। প্রশাসনের ভাষা ইংরেজি। তাই প্রভুত্বের ভাষাও ইংরেজি। তাই সমাজে
প্রভুত্ব করতে গেলেই ইংরেজি ছাড়া চলবে না। হ্যাঁ সেই সঙ্গে আমরা এও জনতাম আমাদের
শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্যর ভাষাটুকু শুধু বাংলা। কিন্তু সরকারী বিদ্যালয়ের
শিক্ষাদানের মাধ্যমও যদি ইংরেজি হয়ে যায়, তাহলেও কি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ভাষা
হিসাবে টিকে থাকতে পারবে মুমূর্ষ বাংলা ভাষা?
অনেকেই বলবেন, অত ভয়
পাওয়ারও কিছু নাই। নাই অত কিছু চিন্তা করারও। ঐতিহাসিক ভাবেই বাঙালির উচ্চশিক্ষার
ভাষা ইংরেজি ছিল এবং আছে। থাকবেও। তার কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে বই কমেনি। এখন সেই সাথে
যুক্ত হবে শুধু প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাদানের
মাধ্যমটুকু। স্নাতক স্তরেও বাংলা মাধ্যমে পঠন পাঠনের ব্যবস্থা থাকলেও উচ্চশিক্ষার
স্তরে পৌঁছানোর জন্যে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই স্নাতকস্তর থকেই ইংরেজিকেই লেখাপড়ার
মাধ্যম করে নেয় আপন গরজেই। ফলে সরকারী মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার
মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহুদিন ধরেই। এছাড়াও কারিগরী শিক্ষার
একমাত্র মাধ্যম ইংরেজিই। চাকুরীর পরীক্ষাগুলিতে সফল হতে গেলেও ইংরাজীই একমাত্র
বলভরসা আমাদের। ব্যাবসা বাণিজ্যে তো কথাই নাই। ফলে সরকারী ব্যবস্থায় শিক্ষার
মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি নতুন কিছুও নয়। নতুন যেটুকু তা হলো, সেটিকে প্রাথমিক স্তর
থেকে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক স্তর অব্দি সম্প্রসারিত করে তোলা। যদিও বহু সরকারী
স্কুলেই অনেক আগে থাকেই উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পঠন পাঠনের জন্য মাধ্যম হিসাবে ইংরেজির
চল আছেই। সেটি এখন সার্বিক হবে এইমাত্র। তাই যাঁরা মনে করছেন এই নীতি বাংলায়
যুগান্তর ঘটিয়ে দেবে, তাঁরা ভয় পাচ্ছেন অযথাই। এমনটাই ভাববেন অধিকাংশ বাঙালিই।
সেটিই স্বাভাবিক।
বাঙালি হিসাবে আমাদের মূল
প্রকৃতিই হলো পরধর্ম পরভাষা পর সংস্কৃতিকে অনুকরণ করে আপন করে নেওয়ার এক উদগ্র
বাসনা। আপন মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আমাদের টানটা তাই বিশ্বের উন্নত দেশগুলির
মতো নয় আদৌ। বহু মানুষ প্রতিবাদ করে উঠবেন। বহুজন দৃষ্টান্ত দেবেন আজকের স্বাধীন
বাংলাদেশের। মাতৃভাষা রক্ষার জন্যেই যে দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করেছে। করেছে বহু
লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে। কথাটি সত্য। কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। ঠিক যে
পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধরীনতা অর্জন তার পেছনে ভাষার যত বড়োই ভুমিকা থাকুক
না কেন, মূল ভুমিকা ছিল জীবন জীবিকা হারানোর আতঙ্কই। পাকিস্তানী প্রশাসনের উর্দ্দু
আরবী চাপিয়ে দেওয়ার ফরমানই জীবন জীবিকা হারানোর আতঙ্কসরূপ হয়ে উঠেছিল জনমানসে।
তারই প্রেক্ষিতে মাতৃভাষাকে আঁকড়ে ধরে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল ওপারের
বাঙালি। সেখান থেকেই স্বাধীনতার লড়াই ও স্বাধীনতা লাভ। যদিও সেটি এই
আলোচনার মূল প্রসঙ্গ নয় আমাদের। মূল প্রসঙ্গ হলো, যে ভাষা ও সংস্কৃতির অর্থনৈতিক
জৌলুস ও চাকচিক্য যত বেশি, সোজা কথায় আমাদের থেকে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন জাতির ভাষা
ও সংস্কৃতিকে অনুকরণ করার লোভ আমাদের মজ্জাগত। সেই লোভেই ইংরেজি ভাষার উপর
নির্ভরতা ছাড়া আমরা নিশ্চিন্তে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। সেই লোভেই গোটা বাংলায়
কাঁটাতারের দুইপারেই একদিকে ইংরেজি ভাষার
উপর নির্ভরতা ও সেই সাথে হিন্দিভাষা ও হিন্দুস্তানী সংস্কৃতির উপর আসক্তি আজকে কম
বেশি দুই পারেই বাঙালির প্রধান প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান আলোচনার প্রসঙ্গে
বাঙালির এই মজ্জাগত প্রকৃতি অন্যতম নির্ণায়ক একটি বিষয় বলেই বুঝতে হবে। এই
প্রকৃতিগত কারণেই উন্নত জীবন আর ইংরেজিতে লেখাপড়া করার চাহিদা এক ও একাকার আজকের
সমাজবাস্তবতায়। মানুষের স্বপ্ন সাধ সাধনায়। ফলে আমাদের কাছে কি শিখব সেটা আর
কোনভাবেই বড়ো বিষয় নয়। অন্তত প্রধান বিষয়ও নয়। কোন ভাষায় শিখবো সেটাই প্রধানতম
চিন্তা। লেখাপড়া করে আমার সন্তান কোন বিষয়ে পারদর্শী হবে সেটা পরের বিষয়। সবার আগে
তাকে ইংরেজিতে পারদর্শী হয়ে উঠতে হবে। তা সে যেভাবেই হোক না কেন। নাহলে সে
কোনভাবেই করেকম্মে খেতে পারবে না। সেটাই দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন অধিকাংশ অভিভাবকই।
এখন দেখা যাক, এই বাংলায় সমস্ত সরকারী ও সরকার অনুমোদিত স্কুলের শিক্ষাদানের
মাধ্যম যদি ইংরেজি হয়ে যায় তাহলে কি সুবিধা হতে পারে আপামর জনসাধারণের। ধরা যাক সকল
স্কুলেই এই সুবিধা চালু হয়ে গেল। শিক্ষিত আধাশিক্ষিত অশিক্ষিত অভিভাবক মাত্রেই
আহ্লাদে আটখানা। আর কোন চিন্তা নাই। অর্থের অভাবে দামি ইংরাজী স্কুলে সন্তানকে
ভর্ত্তি করতে না পারার কাপাল থাবড়ানো যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। ফলে প্রাথমিক ভাবেই
ঘরে ঘরে সরকারের উপর মানুষের আস্থা দ্বিগুন থেকে চতুর্গুন বৃদ্ধি পাব সন্দেহ নাই।
বহুদিনের চাহিদা পূরণে সরকারের জনদরদী মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। মানুষের আশীর্বাদ
প্রতিফলিত হবে ভোটবাক্সেই। মানুষ সরাসরি যেটা হাতে পায়, সেই ভিত্তিতেই চমৎকৃত হয়।
মানুষ খোঁজ নিতে যাবে না, এই যে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ ডিগ্রীধারী বেকারের জন্ম
হচ্ছে, তাদেরই চাকুরীর ব্যবস্থা নাই যেখানে, সেখানে ঠিক কোন মন্ত্র বা জাদুবলে ইংরেজি
মাধম্যে লেখাপড়া করলেই আপামর সকলের চাকুরীর দরজা খুলে যাবে? আজকের অধিকাংশ
ডিগ্রীধারী বেকার যুবক যুবতীর চাকুরীর দরজা কি ইংরাজী না জানা বা কম জানার জন্যেই
খুলছে না, না কি উপযুক্ত চাকুরীর ব্যবস্থাই নাই আমাদের অর্থনীতিতে। আমরা কিন্তু সে
প্রশ্নের দিকে যাবো না চট করেই। বরং ধরেই নেবো নার্সারি থেকেই আগাগোড়া ইংরেজি
মাধ্যমে লেখাপড়া না করতে পারাটাই উপযুক্ত চাকুরী না পাওয়ার প্রধানতম কারণ। ফলে আশা
করতে আর অসুবিধা কি, বাংলা মাধ্যমের সব স্কুলগুলি রাতারাতি ইংরেজি মাধ্যমে উন্নিত
হয়ে গেলেই আসল সমস্যার সমাধান। কিন্তু যেদিন সারা বাংলার সব কয়টি সরকারী স্কুল
থেকেই বাংলা মাধম্যের পঠনপাঠন উঠে গিয়ে প্রতিবছর এ বি সি ডি তে ডিগ্রীধারীরা
চাকুরীর দরজায় কড়া নাড়বে সেদিন যে প্রতিটি ইংরেজি বলিয়ে কয়িয়ে লিখিয়েদেরই উপযুক্ত
চাকুরী হবে, সেই নিশ্চয়তা দেবে কোন সরকার?
বিশ্বায়নের যুগে যেখানে
প্রতিনিয়ত সরকারী চাকুরীর সুযোগ ও সুবিধা সীমিত হয়ে যাচ্ছে, সেখানে অনেক বিজ্ঞ
ব্যাক্তিই মাথা নেড়ে বলবেন সরকারী চাকুরীর প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতাই বাঙালির
অধঃপতনের আরও একটি প্রধান কারণ। বেশ ভালো কথা। তাহলে স্কুলে স্কুলে ইংরেজিতে
ইতিহাস ভুগোল অঙ্ক বিজ্ঞান শিখে শিক্ষার্থীরা সরকারী চাকুরীর প্রত্যাশায় বসে না
থেকে বেসরকারী চাকুরীর দিকেই না হয় ঝুঁকলো। কিন্তু আজকের এই প্রযুক্তি নির্ভর
যান্ত্রিক পরিকাঠামোর দুনিয়ায় বেসরকারী ক্ষেত্রেও কি দেখা যাচ্ছে যে চাকুরীর কোন
অভাব নাই? অভাব শুধু ইংরেজি জানা ছেলে মেয়ের? এমনটি দেখেছেন কি কেউ কোন ক্ষেত্রে? আসুন
অন্তত এইটুকু সত্য স্বীকার করে নিই আমরা সকলেই যে, না তেমনটি ঘটে নি এখনো। চাকুরী
আছে ইংরেজি জানা যুবক যুবতী নাই। বরং এখনই আসল পরিস্থিতি ঠিক এর বিপরীত। ইংরেজি
জানা যুবক যুবতী কর্মপ্রার্থীর কোন অভাব নাই। কিন্তু অভাব আছে চাকুরীর। কি সরকারী
ক্ষেত্রে কি বেসরকারী ক্ষেত্রে। আসুন এবার যোগ করে নিন ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা আরও কয়েক কোটি ডিগ্রীধারী
বেকারের মোট সংখ্যাকে। তাহলে অবস্থাটা গিয়ে কোথায় দাঁড়াবে? না, তাই বলে ছেলে
মেয়েরা ইংরেজিতে পড়াশোনা করবে না, এটা নিশ্চয় কোন যুক্তি হতে পারে না। এমন কথাই
বলবেন সকলে। সেটাই স্বাভাবিক। অনেকে এও বলবেন, কেন সকলকেই চাকুরীর করতে হবেই না কেন?
এটাও তো সেই ঔপনিবেশিক মানসিকতারই উত্তরাধিকার। বিভিন্ন স্বনিযুক্তি প্রকল্পেও তো
হতে পারে কর্মসংস্থান। খুব ভালে কথা। অনেকেই বলবেন নানান ধরণের স্বাধীন পেশা থেকে
ব্যবসা বাভিজ্যমুখি হয়ে উঠতে হবে বাঙালিকে। সেও ভালো কথা। অর্থনৈতিক নানান কর্মে
ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেমনটি হয়। ভালো কথা। কিন্তু এইসবের সাথে
সরকারী বিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে ইংরেজির
প্রবর্তনের সম্পর্ক কোথায়? উন্নত বিশ্বে কোন দেশেই তো আজ অব্দি দেখা যায়নি এহেন
উল্টোপূরাণের দৃষ্টান্ত। তাহলে? তাহলে মনে হচ্ছে না কি, বাংলার মাটিতে শিক্ষার
মাধ্যম বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি হওয়াটাই শেষ কথা নয়। বা কোনভাবেই প্রধান কথাও নয়।
প্রধান কথাই হলো, যে ভাবেই হোক না কেন সকলের জন্য কর্মসংস্থানের কথা। আর তখনই বোঝা
যাবে, বিষয়টি ভাষাগত সমস্যা নয়। অর্থনৈতিক সমস্যার বিষয়।
দুঃখের বিষয় অধিকাংশ বাঙালি
অভিভাবকেরই বস্তববোধ অতটা গভীর নয়। একটি জাতির সার্বিক উন্নতির প্রধানতম কারণগুলি
কি কি, উন্নতির বাস্তবসম্মত পথ বা উপায়গুলি কি কি, অর্থনৈতিক পরিকাঠামোগুলিকে
কিভাবে মজবুত করে তোলা যায় ও মজবুত করে তোলার দরকার, প্রভৃতি বিষয়গুলি সম্বন্ধে
সাধারণ জনগণ ততটা পরিচিত থাকে না। বিষয়গুলি ঠিক করে সমাজ ও রাষ্ট্র। দেশের
বুদ্ধিজীবীরা যার প্রধান ভাগে থেকে সঠিক পথনির্দেশ দেন। যে পথনির্দেশের পরিসরেই
দেশের শিল্প বাণিজ্য পরিচালিত হলে, তবেই তার সামগ্রিক সুফল গিয়ে পৌঁছাতে পারে
জনসাধারণের ঘরে ঘরে। তখন কোন মাধ্যমে লেখাপড়া করলে চাকুরি মিলবে, বা অর্থ উপার্জনে
সক্ষম হবে ঘরের ছেলে মেয়েরা, সেটি মাথাব্যাথার কোন বিষয় হয়ে ওঠে না। মাথাব্যথার
মূল বিষয় হয়, কোন বিষয়ে পারদর্শী হওয়ার মতো যোগ্যতা আছে আমার সন্তানের। সকলেরই সকল
বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠার ক্ষমতা থাকে না। ব্যক্তি বিশেষে মানুষের পারদর্শীতার বিষয়
বিভিন্ন হবে। সেটাই স্বাবাবিক। তাই আসল বিষয়টি হলো ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়ার নয়।
আসল বিষয়টিই হলো সঠিক ভাবে লেখাপড়া করার উপযুক্ত পরিবেশের ও পরিকাঠামোর। সারাদেশের
সর্বত্র একই মানের শিক্ষাদীক্ষার পরিকাঠামো গড়ে তোলা। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রণালী
তৈরী করা। শিক্ষাক্ষেত্রকে দলীয় রাজনীতির মল্লযুদ্ধ থেকে দূরে রাখা। শিক্ষার্থীদের
মধ্যে মৌলিক চিন্তা ও চেতনার বিকাশ গড়ে তোলা। তাদের ভিতর স্বাধীন ব্যক্তিত্বের
বিকাশ ঘটানো। যাতে পরিস্থিতি পরিবেশ অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা অর্জিত
হয়। যে কোন কাজই হোক না কেন, প্রতিটি কাজেই সুদক্ষ কর্মীর যোগান বজায় রাখা। এবং
নিরন্তর মৌলিক গবেষণা ও জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার পরিসরটিকে মজবুত করে তোলা। যে কোন
দেশে যে কোন জাতির জন্যেই এই বিষয়গুলির কোন বিকল্প হয় না হতে পারে না। কোন বিদেশী
ভাষারই হাতে এমন কোন অলৌকিক ক্ষমতা নাই, যে শুধু সেই ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠলেই
মাতৃভাষাকে জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে বিতারিত করে একটি জাতি মাথা তুলে দাঁড়াতে
পারবে। ঘরে ঘরে ছেলে মেয়েরা সোনর থালায় দুধে ভাতে সুখে থাকবে।
আমাদের মূল সমস্যা ঠিক
এইখানেই। আমাদের সকল অধ্যাবসায় শুধু ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে ওঠার লক্ষ্যেই সীমাবদ্ধ।
সকলেরই ধারণা, এই একটি ভাষাই পারে সব পেয়েছির দেশে পৌঁছিয়ে দিতে। আমরা ভুলে যাই,
প্রতিটি বাঙালির সন্তান সন্ততিও যদি ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে ওঠে, তবুও সকলেই ইংল্যাণ্ড
আমেরিকায় গিয়ে পৌঁছাতে পারবে না। যতই না কেন ইংরেজিতে পারদর্শী হয়ে উঠুক। সারা
ভারতেও শুধুমাত্র ইংরেজি জানলেই ভবিষ্যৎ যে সুখের হবে এমন কোন নিশ্চয়তাও নাই।
তাহলে কি হবে ইংরেজি জানা কোটি কোটি বাঙালি যুবক যুবতীর? তারা কি শেক্সপীয়র মিলটন
আবৃত্তি করে উপার্জন করবে মঞ্চ কাঁপিয়ে? না কি মাইকেল জ্যাকসন ম্যাডোনা কণ্ঠী হয়ে
দর্শক শ্রোতাকে মোহিত করবে? না কি সেদিনও বেকার জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে ট্রেনে
বাসে হকারি করবে ইংরেজিতে গলা ফাটিয়ে। নাকি দুনম্বরী পথে পা বাড়াবে নির্ভুল ইংরেজিতে
গালাগলি হুমকি দিতে দিতে? দুঃখের বিষয় আজ যাঁরা ইংরেজির হয়ে গলা ফাটাতে থাকেন,
তাঁদের এতসব ভাবার কিন্তু কোন অবসরও নাই। ক্ষমতাও নাই। হয়তো দরকারও নাই।
যদি ধরেও নিই সারা পৃথিবীই
চলছে এই একটি ভাষারই নিয়ন্ত্রণে। যদিও আসল সত্য তাও নয়। তবু তর্কের খাতিরে না হয়
মেনে নেওয়াই গেল, ইংরেজি ছাড়া আর কোন গতিই নাই। তাহলেও কি মাতৃভাষাকে বিতারিত করে
শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসাবে ইংরেজিকে নিয়ে আসার কোন বিকল্পই নাই? যদি নাই থাকে,
তাহলে উন্নত বিশ্বের দেশগুলিও সেই পথে হাঁটছে না কেন? নাকি এখানে, বাঙালি আজ যা
ভাবে বিশ্ব পড়শু সেই কথাই ভাববে বলে বুক বাজাতে থাকবো আমরা? বেশ এটাও নাহয় মেনে
নেওয়া গেল, বাঙালিই একমাত্র ইংরেজির প্রকৃত মাহাত্ম উপলব্ধি করতে পেরেছে। বিশ্বের
প্রথম জাতি হিসাবেই। তাহলেও কি ইংরেজিতে পারদর্শী করতে গেলে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার
মূল মাধ্যমটাকেই বদলিয়ে দিতে হবে ইংরেজিতে? বাংলার পরিবর্তে। মাতৃভাষার কণ্ঠরোধ
করে? নাকি বাস্তবসম্মত ভাবে সারা দেশের শিক্ষার পরিকাঠামোকে আগে ঢেলে সাজাতে হবে?
উন্নত বিশ্বের আন্তর্জাতিক মানের মতো একটি পরিকাঠামো গড়ে তোলার দিকে দৃষ্টি না
দিয়ে, এবং সেই পরিকাঠামোর আওতায় দেশের প্রতিটি বালক বালিকাকে না নিয়ে এসে
শুধুমাত্র ইংরেজিতে ইতিহাস ভুগোল বিজ্ঞান প্রযুক্তি মুখস্ত করিয়ে নম্বর তোলানোর
প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? যেতে পারে কখনো? প্রত্যেক
অভিভাবককে নিজের কাছেই রাখতে হবে এই প্রশ্ন। সকলের আগে। দেখতে হবে আন্তর্জাতিক
মানের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তির স্বরূপটা কি। বুঝতে হবে উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থার
পরিকাঠামো ও পরিচালন পদ্ধতির গুনগত বৈশিষ্টগুলি কি কি, ও কিরকম। না, সেগুলির অন্ধ
অনুকরণ করেও কিছু হবে না। সেগুলির থেকে শিক্ষা নিয়ে, বাংলার সমাজ বাস্তবতার
ভিত্তিতে, বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সাথে সঙ্গতি রেখে, আমাদের
আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সাথে সঠিক সামঞ্জস্য বিধান করেই গড়ে তুলতে হবে নতুন একটি
শিক্ষা ব্যবস্থা। সম্পূর্ণ নতুন একটি পরিকাঠামো। যেখানে ছেলেমেয়েদের মৌলিক
চিন্তাশক্তির বিকাশ সাধন সম্ভব। গড়ে ওঠে স্বাধীন ব্যক্তিত্ব। তৈরী হয় প্রগতিশীল
চেতনা। দৃঢ় হয় বিজ্ঞান মনস্কতা। সম্পূর্ণ হয় ইতিহাস বোধ। এবং সর্বপরি মানবিক
মূল্যবোধে দীক্ষিত হয়ে ওঠে দেশের প্রতিটি ছেলে মেয়ে। যে শিক্ষা ব্যবস্থা এই
বিষয়গুলির কোনটিই নিশ্চিত করতে পারে না, সেই শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাদানের মাধ্যম ইংরেজি
করলেও কাজের কাজ কিছুই হবে না। উল্টে, দেশ জাতি সমাজ সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কহীন
ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সাথে পারম্পর্যহীন কেবলমাত্র সুযোগসন্ধানী স্বার্থপর মৌলিক
চিৎশক্তিহীন কিছু মুখস্তবিদ ও ব্যক্তিত্বহীন ইংরাজনবিশ প্রজাতির সৃষ্টি হবে। যাদের
থাকবে না নিজস্ব কোন শিকড়। এবং প্রকৃত পক্ষে এদের দিয়ে দেশ জাতি সমাজ ও সংস্কৃতির
কোন ধরণেরই উন্নতি সম্ভব হবে না। ঠিক যেমন বিগত কয়েকদশক ব্যাপি ইংরেজি মাধ্যমের
স্কুলের বাড়বাড়ন্ত সত্বেও সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট হচ্ছে
সার্বিক এক অবক্ষয়। ফলে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধার করে আর আমদানী করে চালাতে
হচ্ছে বাঙালিকে। বাঙালি আজ উদ্ভাবনী শক্তিহীন নকলনবিশ মুখস্তবিদ একটি জাতিতে পরিণত
হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু তাহলে কি হবে ইংরেজি
ভাষায় পারদর্শী হওয়ার? অনেকেই বলতে পারেন এই ইচ্ছাও তো যেকোন নাগরিকের মৌলিক
অধিকারের মধ্যেই পড়ে। এখানে মনে রাখতে হবে কোন উন্নত দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা থেকে
শুরু করে উচ্চশিক্ষাও মাতৃভাষাকে বিতারিত করে কোন বিদেশী ভাষায় দেওয়া হয় না। সকল
দেশেই শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম সেই দেশের মাতৃভাষাই। কিন্তু তা সত্বেও প্রতিটি
উন্নত দেশেই মাতৃভাষায় শিক্ষার পাশাপাশি কোন না কোন বিদেশী ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠারও
সুযোগ ও সুবিধাও থাকে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপর্বের বিশেষ একটি পর্বে এসে নিজেদের
স্বাধীন ইচ্ছায় যে কোন বিদেশী ভাষা শিখে নিতে পারে। কিন্তু সেই বিদেশী ভাষাকে
হামাগুড়ি দেওয়া শৈশব থেকে গেলাতে হয় না বাবা মায়ের কোলে বসিয়ে। অর্থাৎ শিক্ষার
একটি নির্দিষ্ট পর্বে পৌঁছিয়েও যে কোন শিক্ষার্থীর পক্ষে যে কোন বিদেশী ভাষায়
দক্ষতা অর্জন কোন কষ্টকর বিষয় নয়। যদি সঠিক শিক্ষণ পদ্ধতি অনুসৃত হয়। আসল কথা এই
সঠিক শিক্ষণ পদ্ধতির প্রচলনটাই। আমাদের দেশে সেটি কোন কালেই হয় নি। প্রকৃতপক্ষে
যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি ভাষা শিখে নিতে খুব বেশি হলে ছত্রিশ মাসের অধিক
লাগার কথা নয়। ব্যবসাবাণিজ্য, চাকুরির ক্ষেত্রেই হোক আর বিদেশে গিয়ে ইংরেজি ভাষায় উচ্চশিক্ষা
লাভের মতো বিষয়ই হোক সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় ইংরেজি শিখে নিতে দুই থেকে তিন বছরই
যথেষ্ট। তাও মূল শিক্ষার্জনের পাশাপাশি। এর বেশি সময় লাগার কথাই নয়। কিন্তু শর্ত
একটিই সঠিক শিক্ষণ পদ্ধতির। বাঙালির যেটি আজও করায়ত্ত নয়। আসল মুশকিল এইখানেই। সেই
যে ব্রিটিশ এসে ইংরেজি স্কুল খুলে বাঙালির শৈশব থেকে মাতৃভাষাকে কেড়ে নিয়েছিল, সেই
থেকেই বাঙালির বোধ বুদ্ধি সবই অসাড় ও অপ্রাপ্তবয়স্ক হয়ে পড়ে রয়েছে।
বাঙালির ঘরে ঘরে নিশ্চয়
শেক্সপীয়র মিল্টন ওয়ার্ডসওয়ার্থ বায়রন তৈরী করার প্রয়োজন নাই। যদি ধরেও নেওয়া যায়,
আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে পেশাগত ক্ষেত্রে ইংরাজীর অপরিহার্যতার কোন
বিকল্প নাই, তবুও যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে, কার্য সম্পাদনার ভাষা হিসাবে প্রয়োজনীয়
ইংরেজি ভাষাজ্ঞান অর্জন করতে তিন বছর যথেষ্ট সময়। যাঁরা বলেন শৈশব থেকে ইংরেজি না
শিখলে এই ভাষায় কাজ চালানো যায় না, বা দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়, তাঁরা ইংরেজিও জানেন
না, জানেন না কোন কাজের দক্ষতা ইংরেজির উপরও নির্ভর করে না। ফলে মুশকিল হয়ে গিয়েছে
আমাদের ধ্যানধারণার অভাবজনিত কারণে সঠিক বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকাটাই। সারা বিশ্ব
চলেছে সামনের দিকে। আর আমরা এগিয়ে চলেছি পেছনের দিকে। সেটাকেই আমরা সময়ের দাবি বলে
মনে করছি।
সেই সময়ের দাবি থেকেই
সরকারী ও সরকার অনুমোদিত স্কুলে স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদানের নীতি গ্রহণ।
ধরা যাক আগামী একশত বছর এটাই বাংলার সমাজবাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। শিক্ষাদান ও
গ্রহণের মাধ্যম হিসাবে বাতিল হয়ে গেল বাংলা। যদি ধরে নেওয়া যায়, এই ব্যবস্থায়
সকলকেই শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে, এবং কেউই আর নিরক্ষর থাকবে না এবং
বাঙালি মাত্রেই ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে উঠবে। শেলী কিটস এলিয়ট ফকনার পড়তে পারবে, তাহলেই
কি বাংলায় বেকার সমস্যা দূর হয়ে যাবে? বাংলার অর্থনীতি ইংল্যাণ্ড আমেরিকার
অর্থনীতির মতো সমান শক্তিশালী হয়ে উঠবে? জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির সকল শাখাতেই
বাঙালি নিত্য নতুন গবেষণা ও আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দিতে পারবে আবিশ্ব সকলকেই?
দেখ আমরা শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে নিজের মাতৃভাষাকে তাড়িয়ে দিয়ে ইংরেজিকে ব্যবহার
করে কেমন যুগান্তকারী উন্নতি করেছি! নাকি নিজের ভাষা সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত বাংলার
ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার থেকে বিচ্যুত বাংলার মাটির সাথে সম্পর্কহীন একটি নকলনবিশ প্রজাতির
সৃষ্টি হবে। যারা মৌলিক চিন্তা ভাবনা করার সামার্থ্য হারিয়ে কেবল মাত্র মিডিয়া
নিয়ন্ত্রীত তথ্যে ঠাসা হয়ে দম দেওয়া পুতুলের মতো ওঠবোস করতে থাকবে বহুজাতিক
কর্পোরেট স্বার্থে। যারা রবীন্দ্রনাথ পড়বে ইংরেজি তর্জমায়। বাংলা নাটকে সিনেমায়
সংলাপ আউড়াবে বানানো ইংরেজিতে। গানের সুরে কথা বাসতে ব্যবহার করবে শুধুমাত্র এ বি
সি ডি। আর বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থার অর্থনীতির মুনাফা তৈরীতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে
উপার্জন করবে ভোগ্যপণ্যে ব্যয় করার জন্য। বাকিরা কলা চুষবে ইংরেজিতে বিলাপ করতে
করতে। একটা জাতি তার নিজের ভাষা হারিয়ে প্রতিবাদ প্রতিরোধ ও প্রতিকার করার মতো
মৌলিক চিন্তা করার শক্তিও খুঁজে পাবে না। এই জন্যেই বলছিলাম মীরজাফরের সেদিনের
সিদ্ধান্তের মতোই এও এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। অবশ্য তা যদি সার্বিক ভাবেই
কার্যকারি করা হয়।
অনেকেই সেই যুগান্তরকে
সদর্থক হিসাবেই দেখতে চাইবেন সন্দেহ নাই। কারণ গজদন্ত মিনারবাসী বাঙালির অভাব পড়ে
নি কোন কালেই। এখানে সিদ্ধান্তকে দায়ী করারও কথা হচ্ছে না। কারণ হিসাবে আগেই
দেখানো হয়েছে, সিদ্ধান্ত নেওয়াই হয়েছে সময়ের দাবিকে মান্যতা দিয়েই। ভোট বড়ো বালাই।
আর সময়ের দাবি গড়ে উঠেছে সমাজদেহের অভ্যন্তরিন চাহিদা থেকেই। মূল অভিশাপটা সেই
চাহিদাতেই। সার্বিক শিক্ষার অভাবই আবার সেই চাহিদার পশ্চাতে কাজ করে চলেছে। এখানে
শিক্ষা বলতে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী নয়। এখানে শিক্ষা বলতে মানুষ হয়ে ওঠার
শিক্ষা। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার শিক্ষা। বিজ্ঞান মনস্ক হয়ে ওঠার শিক্ষা। বাস্তবাদী
হয়ে ওঠার শিক্ষা। মৌলিক চিন্তা চেতনার অধিকারী হওয়ার শিক্ষা। স্বাধীন ব্যক্তিত্ব
গড়ে তোলার শিক্ষা। আত্মবিকাশের শিক্ষা। না, জাতি হিসাবে বাঙালির এইগুলির কোনটাই
আজও অর্জিত হয় নি। আর হয় নি বলেই কবি কত আক্ষেপ করেই না বলে গিয়েছিলেন, “রেখেছো
বাঙালি করে মানুষ কর নি”। বাঙালি আজ তাই সানন্দে জাতির শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসাবে ইংরেজিকেই
সত্বঃসিদ্ধ মেনে নিয়ে গর্বিত ও নিশ্চিন্ত। আনন্দিত ও তৃপ্ত। আশা করা যাক বাঙালির
সব সমস্যা দূর করতে এহেন ইংরেজিই কল্পতরু হয়ে দুধে ভাতে সুখে রাখবে বাঙালিকে। আর
কি চাই?
১৮ই পৌষ ১৪২৫
শ্রীশুভ্র
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন