বিজ্ঞাপনের সেকাল একাল
ফাল্গুনী
মুখোপাধ্যায়
একালে ‘বিজ্ঞাপন’এর কথা অমৃত
সমান –
শেষ হবার নয় । বিনোদনের জন্য টেলিভিষন খোলার জো নেই, রেডিওতে কান পাতার উপায় নেই, আর খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠাটাতেও পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন । ‘দুধে জল মেশানো না জলে দুধ মেশানো’ সেটা বোঝা যেমন মুস্কিল হয়, তেমনই বোঝা যায় না ‘খবরের সঙ্গে
বিজ্ঞাপন না বিজ্ঞাপনের সঙ্গে কিছু খবরের টুকরো’ । এখন তো গণিকা, কলগার্লরাও দেহ বিক্রির বিজ্ঞাপনেও আমাদের অভ্যস্ত করিয়ে দিয়েছে । নারী-সঙ্গ
ভোগের হাতছানি । যার নাম সাহসী সম্পর্ক স্থাপন বা ‘বোল্ড রিলেসন’ । একালের কথা থাক, সে কালের কথা বলি ।
সুপ্রাচীন
কালে মিশরে, যখন কাগজ আবিস্কার হয়নি, তখন গাছের ছালে লিখে পন্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হত ।
প্রাচীন ভারতে শিলালেখ’এ যে রাজনৈতিক
বা ধর্মীয় নির্দেশ লেখা হত তাও তো বিশেষ জ্ঞাপন বা বিজ্ঞাপন । তো, সেই শিলালিপিবার্তা থেকে এই আধুনিক যুগে দেওয়ালে সাঁটা
হাঁপানি কিংবা যৌনব্যাধি নিরামময়ের দাওয়াইএর বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দীর্ঘ পরিক্রমা ।
লন্ডনের
টমাস জে ব্যারাটকে আধুনিক বিজ্ঞাপনের
জনকের মান্যতা দেওয়া হয় । সেটা উনিশ শতকের কথা । ব্যারাট কাজ করতেন লন্ডনের পীয়ার্স
সাবান কোম্পানীতে । পীয়ার্স সাবানের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপনের স্লোগান লিখেছিলেন “সুপ্রভাত, তুমি কি পিয়ার্স সাবান
ব্যবহার করেছো” ? দীর্ঘকাল সেই সাবান
নির্মাতারা এই বিজ্ঞাপনটি দিতেন । বস্তুত ব্যারাট পীয়ার্স সাবানকে অভিজাত ও
মধ্যবিত্ত শহুরে মানুষের কাছে দারুণ জনপ্রিয় করে ছিল । আজও পীয়ার্স সাবানের কথা
প্রবীণেরা জানেন । শুধু কি বিজ্ঞাপনের স্লোগান রচনা যেনা, পিয়ার্স সাবানকে জনপ্রিয় করার জন্য বার্ষিক ‘মিস পিয়ার্স’প্রতিযোগিতাজেব্রান্ড এমব্যাসাডোর নিয়োগ করা, সেলিব্রিটিদের দিয়ে পণ্যের প্রচার এ সবই ব্যারাটের মাথা থেকেই বের হয়েছিল ।
লিটল ল্যাংট্রি নামে এক ব্রিটিশ হোটেল গায়িকাকে দিয়ে তাদের সাবানের বিজ্ঞাপন
করিয়েছিলেন ১৮৯১এ । ঐ ব্রিটিশ গায়িকাই প্রথম অর্থের বিনিময়ে পণ্যের বিজ্ঞাপন করা
সেলিব্রিটি যা ছিল ব্যারাটের অবদান ও মস্তিষ্ক প্রসুত ।
প্রায়
একই সময়ে,
১৯০০ নাগাদ ভারতে গ্রামফোন বা কলের গান চলে আসে । দম দেওয়া
আর চোং লাগানো গ্রামফোনে গালার চাকতিতে ধ্বনিবদ্ধ গান শোনা । সে এক বিস্ময় বটে !
সেই সময় গ্রামফোন কোম্পানীর একটা বিজ্ঞাপন খুব লোকপ্রিয় হয়েছিল এবং এখনও প্রবাদের
মত হয়ে আছে – “সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামফোন”। এমন রুচিসম্মত স্লোগান কে রচনা করেছিলেন তা জানা যায় না ।
১৮৩৬এ
ফরাসী সংবাদপত্র ‘লা প্রেসে’ প্রথম সংবাপত্রে বিজ্ঞাপনের প্রচলন শুরু করে । সংবাদপত্রে
বিজ্ঞাপন দেওয়ার পথ খুলে যাওয়ায় কয়েক বছরের মধ্যে মুদ্রিত বিজ্ঞাপনের অভূতপূর্ব
বাজার তৈরী হয়ে গেলো এবং একাধিক বিজ্ঞাপন এজেন্সি গঠিত হয়ে গেলো । পণ্য বিক্রয়ের
প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ের শুরু অতয়েব হয়ে গেলো । এদেশে তখন এ’সবের বালাই থাকার কথা নয়, ছিলোও না। দেশের পণ্যই নেই তো বিজ্ঞাপন কে দেবে !
কিন্তু
বিজ্ঞাপন ছিল । ১৮২৫-২৬এর মধ্যে এদেশে সংবাদপত্র এসে যায় । ১৭৬৫তে দেওয়ানী পাওয়ার
পর ইংরাজ শাসন জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে । নানান পেশায় ভাগ্যান্বেষি ইংরেজ মুচি, ধোপা, নাপিত, ফেরিওয়ালারাও ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় আস্তানা গাড়ে, লুটেপুটে খাওয়া শুরু হয়েছে যে ! সেই সময়ে ইংরাজি সংবাদ
পত্রে তাদের বিজ্ঞাপন থাকতো । গৃহভৃত্য চেয়ে, পুরাতন আসবাবপত্র বিক্রি করতে চেয়ে, কিংবা কর্মপ্রার্থি হয়ে সেসব বিজ্ঞাপন দেওয়া হত । এই বিজ্ঞাপনগুলি থেকে
সেকালের কলকাতার সমাজজীবনের একটা বিশ্বাসযোগ্য পরিচয় পাওয়া যায় । ১৭৮৪ সালের
ক্যালকাটা গেজেটের একটা বিজ্ঞাপন ছিল মেসার্স উইলিয়াম এন্ড লী একটি ঘোড়া বিক্রি
করবেন ৩০০ সিক্কা টাকায় । ১৮০১ সালে শ্রীরামপুরের জনৈক আব্রাহাম একটা বিজ্ঞাপন
দিয়েছিলেন যে তার স্ত্রী কাউকে না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন । তিনি যদি কোথাও
কোন ধার দেনা করেন, তার দায়
আব্রাহামের নয় । বোঝ কান্ড ! বৌ পালিয়েছে, তার খোঁজ পাওয়ার বিজ্ঞাপন নয়, সে যদি টাকা
ধার করে তার দায় ঐ ব্যক্তির নয় । ১৭৯১ সালের ২৮শে এপ্রিল এক সাহেব একটা অভিনব
বিজ্ঞাপন দিলেন এই মর্মে যে তিনি ‘কলকাতার রাস্তায় যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো ঘোড়াগুলির বংশবৃদ্ধি করাতে চান । ইচ্ছুক ঘোড়া-মালিকরা তার বিজ্ঞাপনের খরচটা
মিটিয়ে দিলেই তিনি কাজ শুরু করবেন’ । বোঝা গেল সেই আদি কলকাতার ইংরেজদের শুধু টাকা রোজগারের
ধান্দা ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসতো না । [সূত্রঃ ‘শহর কলকাতার ইতিবৃত্ত’ / বিনয় ঘোষ ]
সর্বকালেই
বিজ্ঞাপন সমাজের প্রতিচ্ছবি । ‘পাত্র-পাত্রী’র বিজ্ঞাপনের মধ্যদিয়ে সেই সমাজের সমস্যার একখন্ড ছবি পাই, কর্মপ্রার্থি, কর্মখালির বিজ্ঞাপনে সেই সময়ের বেকার সমস্যার ধরণ বুঝতে পারি । যেমন বুঝতে
পারি,
ইদানিং বিজ্ঞাপিত তরুণ-তরুণীর ‘সাহসী সম্পর্ক’ স্থাপনের বিজ্ঞাপনগুলি থেকে সেই সমাজের অধঃপতনের সর্বনাসা সংকেত । পঞ্চাশ বছর
আগের পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনের একটি বাক্য আমার আজও মনে আছে । বিজ্ঞাপনদাতা
পাত্রীর গুন জানিয়ে লিখছেন পাত্রী উচ্চমাধ্যমিক পাশ, “স্টেটসম্যান পড়িয়া ইংরাজি শিখিতেছে”।
বাংলায়
বিজ্ঞাপনের চল হল অনেক পরে । সেই আদিপর্বে কে কিসের বিজ্ঞাপনই বা দেবে! ধনী অভিজাত
বাবুদের ব্যবহার্য সব জিনিসই আসতো লন্ডন,ম্যাঞ্চাষ্টার,প্যারিশ থেকে
। ১৮১৮ থেকে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে । দুবছর আগে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য
ব্যবসায়িক ভিত্তিতে প্রথম সচিত্র বাংলা বই প্রকাশ করলেন – ভরতচন্দ্রের ‘অন্নদা মঙ্গল’। তিনিই প্রথম বাংলা বইএর দোকান করেন কলকাতায় । তখনও রেল
চলেনি,
টেলিগ্রাফ হয়নি, কল-কারখানার ধোঁয়া ওড়েনি, উন্নত
ডাকব্যবস্থার পত্তনও হয়নি। কিন্তু কলকাতার গ্রন্থনগরী হয়ে ওঠার সূত্রপাত ঘটে
গিয়েছিল চিৎপুর, শিয়ালদহ। গরাণহাটা, শাখারিটোলায় অনেক ছাপাখানা স্থাপন আর বই প্রকাশের মধ্য দিয়ে
। তাদের ক্যানভাসাররা বই ফেরি করতো সেটাই তাদের বইয়ের বিজ্ঞাপন হত। ১৮১৮ সালের
২৬শে ডিসেম্বর মার্সম্যান সম্পাদিত তখনকার ‘সমাচার দর্পণ’পত্রিকায়
প্রকাশিত একটা বিজ্ঞপ্তীতে জানা যায় “কলিকাতার শ্রীযুক্ত রামমোহন রায় সহমরণের বিষয়ে এক কেতাব করিয়া সর্বত্র প্রকাশ
করিয়াছেন । তাহাতে অনেক লিখিয়াছে কিন্তু স্থুল এই লিখিয়াছে যে, সহমরণের বিষয় যথার্থ বিচার করিলে শাস্ত্রে কিছু পাওয়া যায়
না”
। এটাই বাংলা ভাষায় প্রথম
বিজ্ঞাপন এমন তর্কে না গিয়েও নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এটা বাংলা ভাষার বিজ্ঞাপনের আদি
নমুনা । তখন বাংলা গদ্য হাটতে শেখেনি, সবে হামাগুড়ি দিচ্ছে । চিৎপুর-গরাণহাটা অঞ্চলের ছাপাখানার প্রকাশকরাই হাজার
হাজার বাঙালির ঘরেঘরে বই পৌছে দিতেন, আমাদের পরিশীলিত সাহিত্যবোধে যতই আমরা তাকে বটতলার সাহিত্য বলে বিদ্রুপ করিনা
কেন,
বাঙালির সঙ্গে বইএর পরিচয় ঘটিয়েছিল এই বটতলার সাহিত্যই ।
বাংলা বিজ্ঞাপন শিল্পের আঁতুড়ঘরও এই বটতলা্র পুস্তক প্রকাশকরা । ১৯শতকের মধ্যভাগ
থেকেই মুদ্রিত পঞ্জিকার প্রকাশ শুরু হবার ফলে বাংলা বিজ্ঞাপনশিল্পের বিপুল
বৈচিত্র্য এলো । বাংলার ঘরে ঘরে পঞ্জিকা আবশ্যিক ছিল । পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় তাই
রামায়ণ,
মহাভারত ইত্যাদি ভক্তিগ্রন্থের সঙ্গে সর্বদুঃখহরা আংটি, ফুলকপির বীজ, গুপ্তরোগ চিকিৎসার হদিস, নানান সব
বিচিত্র ও সচিত্র বিজ্ঞাপন মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে গেল ।
বৃটিশ
আমলে বাঙালির ব্যবসা ও তার প্রচারের একটা প্রবণতা বেশ কৌতুককর । ভারতীয় ব্যবসায়ীরা
ভাবতেন তাদের ব্যবসার নাম ইংরেজদের নামের মত হলে লোককে বেশি আকর্ষণ করা যাবে । তাই
দ্বারকানাথ ঘোষ (পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের দাদু) প্যাডেল বা বসে বাজানোর
হারমোনিয়াম প্রবর্তন করে কোম্পানীর নাম রাখলেন ডোয়ার্কিন । দ্বারকানাথ হয়ে গেল ‘ডোয়ার্কিন’ । আশুতোষ ঘোষের বিখ্যাত চা’এর ব্যবসা হল ‘এ টশ এন্ড
সন্স’
। আমূল মাখনের
পূর্বে খুব জনপ্রিয় ছিল পলসন বাটার আমরা ভুল করতাম বিদেশী কোম্পানী মনে করে । আদতে
এর মালিক ছিলেন আদুলজি দালাল নামে এক পার্শি ব্যবসায়ী, তাঁর ডাকনাম ছিল পলি । ব্যস কোম্পানীর নাম হয়ে গেল পলসন ।
পণ্যের
বিজ্ঞাপনে সেই পণ্যের টার্গেট ক্রেতাকে প্রলুব্ধ করার মনস্তত্ব পণ্য বিক্রেতার
থাকেই,
তা দোষের নয় । কিন্তু প্রলুব্ধ করার জন্য রুচিহীন ভাষা ও
অনৈতিকতার যে প্রাবল্য এখন দেখা যায় তা সহ্য করা মুস্কিল । পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকের
বিজ্ঞাপন নির্মাণে এই রুচিশীলতা ও নৈতিকতা বজায় ছিল । অনেক নামি লেখকরা পণ্যের
বিজ্ঞাপনের ভাষা রচনা করতেন । সত্যজিৎ রায় তাঁর কর্ম জীবন শুরু করেছিলেন বিজ্ঞাপন
রচনার কাজ করে । পূর্ব রেলওয়ে তাদের বিজ্ঞাপণে রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা ব্যবহার
করত –
“এ প্রাণ রাতের রেলগাড়ি, দিল পাড়ি......” । ১৯৪৭এ স্বাধীনতা লাভের পরের দিন ১৬ই অগস্ট ইংরাজি কাগজ ‘স্টেটসম্যানের প্রথম পৃষ্ঠায় একটা হাতঘড়ির বিজ্ঞাপন দেখছি, হাতঘড়ির ছবি দিয়ে তিনটি মাত্র শব্দ খরচ করা বিজ্ঞাপন ‘ইট’স অ্যান ওমেগা’ । অতি সংক্ষিপ্ত স্লোগান, কিন্তু অব্যর্থ । একালে এমন বিজ্ঞাপনে নির্ঘাত কোন সুবেশা তন্বির ছবি থাকতো !
৫৪/৫৫
সালের কথা মনে আছে কাঁচি মার্কা সিগারেটের একটা বিজ্ঞাপন – রেল প্ল্যাটফর্মে সঙ্গের মালপত্রের ওপর বসে একজন সিগারেটে
সুখটান দিচ্ছে আর ট্রেন তার সামনে দিয়ে হুশ করে চলে যাচ্ছে । বিজ্ঞাপনে এই রকম
বুদ্ধির ছাপ ছিল । বালক বয়সে বিজ্ঞাপনটায় বেশ মজা পেতাম, সিগারেটে সুখটান দেওয়ার জন্য লোকটি ট্রেনটা ধরতে পারলোনা
বলে । কাঁচিমার্কা সিগারেটের কি মাহাত্ম! ট্রেন যায় যাক, সিগারেটে সুখটানটা থাক !
বেশি
দিনের কথা নয় । পুরাতন পত্রিকা ঘাঁটতে গিয়ে পেলাম ১৯৭১এ ‘হিন্দুস্থান স্টীল’এর একটা বিজ্ঞাপন । বিজ্ঞাপনের ভাষা এই রকম - “ভাষা ও ভঙ্গিমায় জীবনের প্রতিভাস । শিল্পকৃতি মানবিকতার সম্পদ”। ১৯৬১তে হিন্দি সিনেমা ‘নজরানা’র বিজ্ঞাপনের ভাষা – “হৃদয়ের কষ্টিপাথরে যাচাই করা প্রেমের অর্ঘ্য”... । প্রখ্যাত পুস্ত প্রকাশক এ মুখার্জী কোম্পানী বিজ্ঞাপন দিত ‘আমরা বই ছাপি না, বিষয় ছাপি’ । বিজ্ঞাপন
রচনায় এই ভাষা এখন আর কোথায় ! এখনতো ভাষায় শৈল্পিক স্পর্শ তো দূরের কথা, এখন অদ্ভুত জগাখিচুড়ী ভাষায় পণ্যের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেছে – ‘ঠান্ডার নতুন ফান্ডা’ ‘ইন্ডিয়া কেয়ার করবে’ ‘নো ওয়েটিং যুগ
যুগ’
ইত্যাদি অদ্ভুতুড়ে ভাষা ।
বিজ্ঞাপন
শুধু নীরেট তথ্য নয় সামাজিক ইতিহাসের উপাদানও । বিজ্ঞাপন থেকে সমকালীন সমাজের
চেহারাটাও বোঝা যায়, সমাজ ও জীবনের
বিবর্তনের ইতিহাস রচনায় নানান উপাদান পাওয়া যায় বিজ্ঞাপন থেকে । ১৮৭৫এর ২৭শে
জানুয়ারির একটা বিজ্ঞাপন । ভ্রমণকারীদের থাকা-খাওয়া ও রাত্রিবাসের জন্য ।
‘হোম ফর ট্রাভেলার্স এন্ড আদার্স
রেটস – বোর্ড আন্ড লজিং পার ডে – ১টাকা
সিঙ্গল মিল -- ৮ আনা
এ বেড ফর দি নাইট -- ৮ আনা
এইচ মেন্ডেস, প্রোপ্রাইটার
নং – ৮, বৌ বাজার
এই
বিজ্ঞাপন থেকে আমরা বুঝতে পারি দেড়শো বছর আগে একজন সম্পন্ন ভ্রমণকারীর দৈনিক
জীবনধারণের মান কেমন ছিল ।
আরএকটি
বিজ্ঞাপন ১৯০৫এর । যা থেকে আমরা জানবো ১৯০৫ নাগাদ কলকাতায় মোটর গাড়ির চল হয়েছে ।
বিজ্ঞাপনটি এই রকম –
“রোভার কার, দি ভেরি লেটেস্ট ইন কার
৮ এইচ
পি সিঙ্গল সিলিন্ডার, আরটিলারি
হুইলস
প্রাইস ৩৬০০ টাকা নগদ”
জানলাম
ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা একটা মোটর গাড়ির দাম ১৯০৫ এ ছিল ৩৬০০ টাকা । (তথ্যসূত্র
–
‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’- বিনয় ঘোষ)
এই সব
বিজ্ঞাপন থেকে তৎকালীন সমাজের বিশ্বাসযোগ্য ছবি পাচ্ছি । আবার একুশ শতকের এই সময়ে
অভিজাত প্রভাতী সংবাদপত্রে যখন দেদার বিজ্ঞাপন ছাপা হয় “ সুন্দরী সেকসি নারীসঙ্গ উপভোগ করুন” তখন আজকের সমাজটা কোন পাঁকে তলাচ্ছে তার সংকেতও পেয়ে যাই ।
বিজ্ঞাপনের
মাধ্যমে টার্গেট উপভোক্তাদের মাথা চিবিয়ে খাবার প্রক্রিয়ার আঁতুড় ঘর যে আমেরিকা
এখন আর এতে কারো সংশয় নেই । প্রায় একশ’বছর আগে এই প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছিল আমেরিকায় । ‘মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ ও তার অবচেতনে থাকা উপভোগ ও ক্রয়ের
স্পৃহাকে লক্ষ্যবস্তু করার তত্ব’ প্রয়োগ করা
শুরু করলো ওখানকার বিজ্ঞাপন কোম্পানীগুলো । বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে উপভোক্তাকে
প্রলুব্ধ করার এই তত্বের উদ্গাতা যে সে লোক নয়, বিশ্বখ্যাত মনবিজ্ঞানি সিগমন্ড ফ্রয়েডের ভাইপো এডওয়ার্ড বেরনাভস,আমেরিকা যাকে বলে আধুনিক বিজ্ঞাপন শিল্পের উদ্ভাবক ।
বিজ্ঞাপনের
ক্ষেত্রে উপভোক্তাকে প্রলুব্ধ করার এই মডেলই সর্ব দেশে অনুসৃত হয়ে আসছে । ১৯৫০এর
দশক থেকে আমেরিকায় রেডিও ও টেলিভিষনে
বানিজ্যিক বিজ্ঞাপনের চল হওয়ার পর থেকে বড় বড় মনবিদরা নানান পদ্ধতি উদ্ভাবন
করে চলেছেন । আমাদের
দেশে রেডিওতে বানিজ্যিক বিজ্ঞাপন চালু হয় রেডিওর বিবিধ ভারতীর অনুষ্ঠানে ১লা
নভেম্বর ১৯৬৭ থেকে ।
এ
কালের বিজ্ঞাপনের কথা বলতে ইচ্ছা হয় না। এ দেশে নব্বইএর দশক থেকে বিশ্বায়নের
সর্বগ্রাসী থাবা আমাদের সংস্কৃতি, রুচি, ভাষা আর মূল্যবোধের সবটুকুই লুটে নিয়েছে । ‘রক্তকরবী’ নাটকে অধ্যাপক
ও নন্দিনীর কথোপকথনের অংশ মনে পড়ে । অধ্যাপক নন্দিনীকে বলছেন “আমরা যে মরা ধনের শবসাধনা করি । তার প্রেতকে বশ করতে চাই ।
সোনার তালের তাল-বেতালকে বাঁধতে পারলে পৃথিবীকে পাব মুঠোর মধ্যে” । পন্যায়ন আর ভোগবাদ পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার রাস্তা
বাৎলে দিয়েছে আমাদের । এখন আর ‘সেনকোর
অলঙ্কার আমার অহংকার’ নয় হীরা চাই ।
তাই হীরা কেনার লোভ দেখানো বিজ্ঞাপন । এখন দেহ ব্যবসার বিজ্ঞাপনও অভিজাত বাংলা
সংবাদ পত্রে বাধাহীন প্রকাশ হয়ে চলে ।
হাতের মুঠোয় পৃথিবীকে ধরা – মহা পূণ্যবান
একালের বিজ্ঞাপন-কথা অমৃত সমান ।
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
Very helpful
উত্তরমুছুন