সকাল দশটা থেকে দুপুর পর্যন্ত এক কিস্তি লেখা, দুপুরে একটা-দুইটা ক্লাস, বিকেলে আড্ডা, সন্ধ্যায়
বাসা’র সামনে পার্কে যাওয়া, বুড়োদের দেখা কিংবা বাসা’র পাশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের একঘেয়ে রসায়ন দেখা আর সিগারেট
ধরানো। রাতে খাবার পরে আরেক কিস্তি লেখা। আমাদের এই সিরিয়াস লেখক-এর জীবনে আসলেই
কোন কিছু ঘটার নেই। আমরা বা আপনারা মনে করতে পারেন যে সে বাসা’র বুয়া’র চোখে
একজন দেবতুল্য মানুষ। সেটাও সত্যি না, আমাদের এই লেখকের বিপক্ষে অভিযোগ আছে, আরেকটু সতর্ক হয়ে বললে, গুজব
আছে যে তাঁর “খারাপ চোখ” আছে মেয়েদের শরীরের দিকে। এইটা অবশ্য ভাবতে ভালই লাগছে
আপনাদের শেষপর্যন্ত হয়তো,কারণ
লেখক তো কাজের বুয়া’র প্রতি ভায়োলেন্ট না;বরং প্রেমময়ী,মানবিক। দুর্ভাগ্যবশত এই লেখকের একটা কেইস আছে থানায় সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের, সে যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিল তখন এক নার্সের সাথেও সে সম্পর্কে
জড়ায় পড়ে এবং নার্সের অভিযোগ শেষপর্যন্ত গুরুতর ছিল।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
অসময়
সৌহার্দ্য ইকবাল
"যেখানে আকাশ শেষ হয়,সেখানে পাখিরা পালায় যায় না। লাইন’টা কেমন?"
"তেমন কিছু না।"
"তাহলে এইটা শোন,যেখানে তার হাসি’তে,পাতলা ঠোঁটের বাঁক হয়ে যায় আকাশের নৌকা,সেখানে আকাশের শেষ সীমানা"
"এইটাও জোড়াতালি দেয়া মনে হচ্ছে ভাইয়া, সর্যি টু সে, তোমার
এইসব ডায়লগ এই সংলাপে একাবারেই যাচ্ছে না।আজ কি হয়েছে বল তো?"
"কিছু হবার মত কি হবে?"
"সেটাও ঠিক। তোমার জীবনে তো কিছু হবারও নেই।..."
"আহা, সেটাও
একটু বাড়িয়ে ফেললে অনন্যা, আই মিন
আমি সিঙ্গেল এখন, বউ চলে
গ্যাছে কিন্ত আমার লাইফ আছে... এই যে মনে করে আমার কবি বন্ধু কবি শেলী’র একটা বই হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, শুভ জন্মদিন, এইটা
কেমন হল?"
"অ্যাঁ?"
"ওইরকম মুখ বাকাচ্ছিস কেন, কবি’রা এমন হতেই পারে।"
"মামুন ভাইয়া, তোমার
জন্মদিন আর আমরা কিছুই জানি না...তুমি বুড়ো হলেও ফাঁকিবাজ প্রথম স্তরের।"
"ব্যস, কবি’র কথা বিশ্বাস হচ্ছে আর আমি’টা জলজ্যান্ত মিথ্যে?"
"বয়স লুকিয়ে লাভ নাই, আমরা রাতে আসছি। বাসায় থেকো দয়া করে।"
অনন্যা হুট করে যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই
চলে গেল। ড্রয়িং রুমে হাত-পা ছড়িয়ে থাকা,আমাদের লেখক মামুন সাহেব পাংশু মুখেই বসে থাকলেন। আজ তার ৫২, সেটা সে প্রাণপণ চেষ্টা করেও চেপে রাখতে পারেন নি। নিজের
মুখেই বলে দিতে হল। মানুষ কি চায় যে তাকে সবাই গুরুত্ব দিক?অবশ্যই চায় এবং আমাদের এই লেখক, যে ড্রয়িং রুমে দীর্ঘসময় প্রতিদিন পা ছড়িয়ে বসে থাকে এবং লিখে,সেও চায়।
এটা’কে ড্রয়িং রুম বলতে আমাদের বা
আপনাদের আপত্তি থাকার কথা।কারণ – (১)
প্রচলিতভাবে এখানে কেউ চা পানে আসে না,কিছু ছেলেপেলে এবং তরুণ প্রকাশক আসে নাটকের কিংবা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি নিতে।
শ্বেতপাথরের মেঝের রুমের এক কোণে একটা স্টোভ আছে,যাদের দরকার পাশে থাকা চা-চিনি দিয়ে চা বানিয়ে খেতে পারে। মোড়া রাখা আছে চায়ের
অপেক্ষায় বসে থাকা’র জন্যে। (২) এই রুমে
সোফা কার্পেটের পাশাপাশি একটা খাটিয়াও আছে যেখানে আমাদের লেখক, মামুন সাহেব ঘুমিয়ে থাকেন।
এরপরেও এইটা ড্রয়িং রুম কারণ এইটা’কে লেখক সাহেব ড্রয়িং রুমই বলে থাকেন। অবশ্য অন্যভাবেও বলা যায় এইটাকে ড্রয়িং
রুম – আর সেভাবে দেখলে দেখা যাবে যে
লেখকের এই চিহ্নিতকরণে অসঙ্গতি নেই বরং...বাসায় আরও দুটো ঘর আছে। একটা সত্যিকারের
বেডরুম, যাকে নিয়ে কেউ সংশয় প্রকাশ করবে
না এবং আরেকটা রুম হল সত্যিকারের ডাইনিং রুম যেখানে ডাইনিং টেবিল আছে এবং বুয়া
সেখানেই মামুন সাহেব’কে ভাত বেড়ে দেন।
এখন বিকেল সাড়ে ছ’টা এবং আমাদের লেখক,যাকে নিয়ে আমরা লিখছি,সে পা ছড়িয়েই আছেন। তাঁর এইসময় উদ্দেশ্যহীনভাবে সিগাড়েট টানার কথা রাস্তায়
হাঁটতে হাঁটতে। উদ্দেশ্যহীন যাপন লেখক’দের অনুপ্রেরণা। যাই হোক,আমাদের
লেখক এখানেই পা ছড়িয়ে আছেন এবং সম্ভবত জন্মদিনের নামে যা হবে তা নিয়ে তিনি
বিড়ম্বনায় ভুগছেন। এমন’টা মনে
করার কারণ আপনারা যৌক্তিক এবং গতানুগতিক মনে করছেন। আমি আপনাদের মত সাধারণ, আমিও গতানুগতিকভাবেই তাই দেখছি।এই বেরসিক, হতাশ, চামড়া
ঝুলে পড়া, কড়া চায়ে আর গোল্ড লিফের আঙুল
নিয়ে গতানুগতিক কিছুই লেখা সম্ভব। আপনারা অসাধারণ কিছু আশা করলে তা নেহায়েতই
বোকামী।
আমাদের ধারণা হয়তো ভুল, কারণ
লেখক আড়মোড়া ভাঙছেন,এমনকি ব্রাশ করার
উদ্দেশ্যে ওয়াশরুমের দিকেও পা বাড়ালেন। আমাদের লেখক কলেজে চাকরি করেন, পড়ান কেমেস্ট্রি। কলেজে তাঁর ক্লাস থাকে সাধারণত দুপুরে, সরকারী কলেজ। সকাল দশটা থেকে দুপুর পর্যন্ত এক কিস্তি লেখা, দুপুরে একটা-দুইটা ক্লাস, বিকেলে আড্ডা, সন্ধ্যায়
বাসা’র সামনে পার্কে যাওয়া, বুড়োদের দেখা কিংবা বাসা’র পাশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের একঘেয়ে রসায়ন দেখা আর সিগারেট
ধরানো। রাতে খাবার পরে আরেক কিস্তি লেখা। আমাদের এই সিরিয়াস লেখক-এর জীবনে আসলেই
কোন কিছু ঘটার নেই। আমরা বা আপনারা মনে করতে পারেন যে সে বাসা’র বুয়া’র চোখে
একজন দেবতুল্য মানুষ।সেটাও সত্যি না, আমাদের এই লেখকের বিপক্ষে অভিযোগ আছে, আরেকটু সতর্ক হয়ে বললে, গুজব
আছে যে তাঁর “খারাপ চোখ” আছে মেয়েদের শরীরের দিকে। এইটা অবশ্য ভাবতে ভালই লাগছে
আপনাদের শেষপর্যন্ত হয়তো,কারণ
লেখক তো কাজের বুয়া’র প্রতি ভায়োলেন্ট না;বরং প্রেমময়ী,মানবিক। দুর্ভাগ্যবশত এই লেখকের একটা কেইস আছে থানায় সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের, সে যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিল তখন এক নার্সের সাথেও সে
সম্পর্কে জড়ায় পড়ে এবং নার্সের অভিযোগ শেষপর্যন্ত গুরুতর ছিল। আরও ভয়ংকর ব্যাপার
হল অভিযোগ’টা করা হয়েছিল তাঁর বউ’কেই যে আসলে পেশায় একজন চিকিৎসক। ঘটনাগুলো বছর পাঁচেক আগের,তারপরেও আমরা নিশ্চিত নই যে আমাদের লেখক,মামুন সাহেব,এই
সামাজিক অন্যায়ে (সামাজিক বিধি অনুসারে অন্যায়,যদিও কেউ লিমিট সেট করে নি কিংবা বলা যায় লিমিট নেই) বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত।
আমাদের লেখক তাঁর বেডরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কফি কালারের প্রিয় শার্ট’টা পড়লেন। ফুলহাতা। বাইরে সামান্য শীত পড়া শুরু হয়েছে বলেই
হয়তো এই বাড়তি সতর্কতা! লেখক একটা ফোন করলেন।গলা নামিয়ে কথা বলতে থাকলেন,কার সাথে বুঝা গেল না,শোনাও গেল না,ফোন কনভারসেশন শোনার
অনুমতি নেই!
এবার তিনি সত্যি বাসা থেকে বের হলেন। এটা পাঁচতলা পুরনো জীর্ণ বাসাগুলো’র একটি।বাসা’র
সামনে থাকা একটা সাদা গাড়ি’তে উঠে
পড়লেন। চিন্তার কারণ নেই, আমি
নরক থেকে অনুমতি পেয়েছি লেখক’কে
গাড়ির ভেতরেও দেখতে পাবার। হ্যাঁ, সে বসে
আছে একটা কুড়ি থেকে বাইশ – এমন
বয়সের এক মেয়ের সাথে। মনে হয় সে খুব দুশ্চিন্তা করছে কারণ লেখকের পাশে সে গালে হাত
দিয়ে কপাল কুঁচকে চোখ তীক্ষ্ণ রেখে গাড়ির গ্লাসের বাইরে তাকাচ্ছে।লেখক নির্বিকার – তাকে এই মুহূর্তে লাগছে ফরাসি রোমান্টিক ছবি’র নায়কের মত।
ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ল। লেখক কি বলবে সেটা শুনতে পারার জন্যে ঈশ্বরের অনুমতি
লাগে। আমার কাছে আজ সৌভাগ্যবশত অনুমতিপত্র আছে, তবে ফোন কনভারসেশন শুনতে পারব না।আপনারা একটু আগেই দেখেছেন যে ফোনের কথা শুনতে
পারা যায় নি। যাই হোক, আমরা
মেয়েটার দিকেও দেখি। একটু ভালভাবেই দেখি, কারণ আমাদের পাশে বসা ফরাসী ছবি’র নায়ক’কে দেখতে পাব আরও অনেকবার। এই
সুন্দরী মেয়েটা’কে কিন্ত বাঙালি’দের মতই লাগছে। তবে বলতেই হচ্ছে যে অসম্ভব সুন্দরী।লেখকের
সাথে তাকে বেশ মানিয়েছে – তবে
খানিকটা বাবা-মেয়ের মতই লাগছে দুজন’কে
একাসাথে।মেয়েটা কি আমাদের লেখকের’ই মেয়ে?কিন্ত তা কি করে হয় বলুন,আমরা আগে থেকেই জানি যে লেখক নিঃসন্তান!
যা বলছিলাম, মেয়েটার দিকেই আমরা আবার ফিরে
যাই। মেয়েটার চুল ঘন কাল, তবে
বাঁধা,তাই আছড়ে পড়ে নি মুখে।তাঁর চোখ
সবচে আকর্ষণীয়। এটা অনেক বেশি বহন করে দেয় ওর চিন্তা। ও যখন কথা বলছিল,ওর চোখের দ্যুতি ফ্লাকচুয়েট করছিল অনেক বেশি। যেন বায়োনিক
রোবট , কিন্ত সত্যিটা হচ্ছে যে সে
অসম্ভব সুন্দরী এক মানবী। প্রাইভেট কার’টা চলতে শুরু করেছে এর মধ্যেই, দুঃখিত
– আপনাদের নোটিশ করানো হয় নি।
লেখক নিজেই গাড়ি চালাচ্ছেন,মেয়েটাও
এখন আগের মত মোটেও মুখ গোমড়া করে নি, সে এখন খুব হাসছে। তাদের কথোপকথনে এটা জানা গেল যে মেয়েটা ইংরেজি বিভাগে পড়ে, তৃতীয় বর্ষে। নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। মেয়েটা’র ঠোঁট দুটো চমৎকার,আসলেই আকাশে ঝুলে থাকা,পরস্পরের
দিকে উল্টো হয়ে থাকা দুটো নৌকার হালকা গোলাপী অবয়ব। দাঁত নিখুঁত... নাহ, এক কোণে একটা দাঁত মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে। মুখের এক কোণের এই
দাঁতটা বাঁকানো। সামান্য উপরে উঠে আসা। মেয়েটার আর সব দাঁত ছোট, ওর মুখের সাথে মানানসই।এই উঁচু হয়ে থাকা দাঁতটা আমাকে বেশ
আলোড়িত করছে, কিংবা আমাদের। আপনাদেরও কি? মনে হয় না।আমাদের লেখক টুকটাক কথা বলে যাচ্ছেন। বাহ, তাঁরা হাসছেনও। বলা হচ্ছে না আপনাদের ওদের কনভারসেশন কারণ
আমি অথবা আমরা আটকে আছি মেয়েটার ওই কোণের দিকের উঁচু হয়ে থাকা দাঁতের ব্যাপারেই...
কেন এমন হবে?...
এইটা জানা দরকার আমাদের। মানে আমরা তিনজন, যাদের নাম মামুন, আমরাও
লেখক ছিলাম এবং আমরাও ঠিক এইসময় প্রাইভেট কারেই ছিলাম। তাকাচ্ছিলাম ওই উঁচু হয়ে
থাকা,বিচ্যুত হয়ে থাকা এককোণের একটা
দাঁতের দিকে যা ওকে আরও বাচ্চাদের মত সরলতা এনে দিয়েছে মুখে। এই মেয়েটার দাঁত কি
জন্ম থেকেই এমন নাকি পরে কোন এক্সিডেন্টে এমন হয়েছে ? দাঁত বের করে হাসলেই এটা কেবল চোখে পড়ে এবং এটা ওকে আমাদের চোখে আরও সুন্দরী
করে তুলেছে কোনভাবে, কিংবা
বলা যায় আগ্রহী করে তুলেছে আমাদের। আমাদের লেখক,আমাদের তিনজনের মতই বারবার আটকে ফেলছে তাঁর চোখ ওই দাঁতের দিকেই। মেয়েটা’কে কি সেও আমাদের মতই চকলেট কিনে দিতে হুট করে রাস্তার মাঝ
থেকেই পার্কিং করতে যাবে? লেখক
তার হাতঘড়িতে সময় দেখছেন, ঠিক
আমাদের মতই। মনে হয় তাকে আটকানোর কোন সুযোগ নেই…। কেন এত তাড়া ? মানুষ
কেবল সময় নিয়ে ভাবে; এই যে
কাক কিংবা কুকুর, এরা
কেউ সময় জানে না। আমরা মানুষ কেন সময়’কে অনুভব করতে চাই ?
গাড়িটা সিগনাল না দিয়েই হুট করে বাঁক নেয় রাস্তার পাশে পার্ক করতে, পিছনের বাস’টা
কিছু বোঝার আগেই দুমড়ে মুচড়ে দিল কার’টাকে।
২১.১০.২০১৭
হ্যালিফাক্স, ক্যানাডা।
সৌহার্দ্য
ইকবাল