শক্তি হাত তূলে বলল -
থাক। তারপর আমার হাত থেকে লেখাগুলো নিয়ে নাকের কাছে ধরে বললঃ কোন গন্ধ নেই। এগুলো
কবিতা নয়,
ছন্দোবদ্ধ শব্দ। কাঠামোতে প্রাণ আনো, প্রাণ এলেই ঘ্রাণ আসবে। চেষ্টা করে যাও, ধীরে
ধীরে হবে। আমার নাকে একটা স্নিগ্ধ গন্ধ আসছিল, যদিও
খুব মৃদু,
কোথা থেকে বুঝতে পারলাম না। এমন সময় মেঘ সরে গেল। খাঁদের
পাশে চাঁদ ডাকল আয়, আয়, আয়! – শক্তি চাঁদের মধ্যে চলে গেল। একাই গেল। বিজলি নেই। বারান্দার টবে রজনীগন্ধা
গন্ধ সুধা ঢালছে। শান বাঁধান মেঝেতে ঠিকরে পড়ছে বাঁধ ভাঙ্গা চাঁদের হাসি। চেয়ারের
উপর উন্মুক্ত গীতাঞ্জলি। কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা, শুধু
অনুভব করছি,
চাঁদের আলোয় আর বর্ষার মেঘে মিলেমিশে একাকার হয়ে গীতাঞ্জলির
সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছে দিকময়।~~~~~~~~~~~~~~~~~
একটি
আষাঢ়ে কাহিনী
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য্য
বর্ষা ঋতু বড় বিচিত্র।
দুয়ার ভাঙ্গা ঝড়ের রাতে রবির উদয় হয়, নিরানন্দ জীবনে ঝড়ে পড়ে
জীবনানন্দের ধারা। দুর্বল চিত্তে শক্তি আসে। এদের জন্যে আমি বারান্দায় রকিং
চেয়ারের ব্যবস্থা রেখেছি। ঢাকা বারান্দায় বৄষ্টির ছাট আসেনা। নিশ্চিন্ত মনে বর্ষা
উপভোগ করা যায়।
শক্তি রকিং চেয়ারে বসে
আমাকে বলল –
তুমিও এসোনা। আমি একটা মোড়া নিয়ে পাশে গিয়ে বসলাম।
শক্তি দুলতে দুলতে বলেঃ
- দেখেছ,
কেমন গাভীর মত মেঘ চড়ছে।
আমি বলি, - সবুজ নালিঘাসও গজিয়েছে প্রচুর!
-আজকাল
আর কেউ কড়া নাড়ে না হে, বেল বাজায়। নাঃ, অবনীর পদ্যটা নতুন করে লিখতে হবে। তোমার বাসায় কবিতার বই আছে?
কি লজ্জা, কি লজ্জা! আমি কোনদিন কবিতার বই কিনিনি। মোড়া ছেড়ে উঠলাম।
শক্তি বললঃ – ওই টেবিলের দিক থেকে কেমন যেন গন্ধ আসছে। যাও দেখ দিকি -
টেবিলের কাছে গিয়ে দেখি, সত্যিই একটা পাতলা বই। মলাট দেওয়া। কোন গন্ধ টন্ধ পেলাম না। মলাট ওলটালাম, বাংলায় লেখা ‘গীতাঞ্জলি’। জীবনে এই দ্বিতীয় বার
গীতাঞ্জলি স্পর্শ করলাম। প্রথম করেছিলাম
ছেলেবেলায় পাড়ার ক্লাবে, গীতাঞ্জলির আদলে প্যান্ডেল
হয়েছিল যে বার। হলুদ কাপড়ের প্যান্ডেল, লাল অক্ষরে মাথায় লেখা ‘গীতাঞ্জলি’,
নীচে প্যাঁচ মেরে ‘রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর’
আর পেটের মধ্যে মা সরস্বতী।
-কি
পেলে?
শক্তি বলল।
-গীতাঞ্জলি।
-তাই
ভাবি,
এত গন্ধ আসে কোথা থেকে। পড়েছ?
-না।
- নোবেল
পাওয়া বই,
বাংলায় লেখা, পড়নি?
- ইয়ে--মানে, আমাদের কোর্সে ছিল না।
মুখ দেখে বুঝলাম শক্তি
দুঃখ পেয়েছে। অধোবদনে বই নিয়ে ফিরে এলাম। শক্তি গীতাঞ্জলি হাতে ধরে গভীর ভাবে তার
ঘ্রান নিয়ে বলল – আহ্! কবিতা হ’ল
ফুলের গন্ধের মত বুঝলে, বুঝবার চাইতেও বেশি অনুভব
করবার। বিশেষ করে গীতাঞ্জলির কবিতাগুলির অসাধারন ফেব্রিক। যেমন থিম, তেমন শব্দ,
তেমন ছন্দ, সব মাপে-মাপ। দারুন মজবুত
ফ্রেম। শুধু কাঠামোর মধ্যে মানানসই শব্দ বসাও, আপনি
আপ কবিতা হয়ে যাবে। দেখবে নাকি চেষ্টা করে?
বর্ষা ঋতু বড় বিচিত্র। প্রানে
কেমন সাহস এসে গেল। দুম করে একটা কবিতা বের করে ফেললাম। - বহু বাসনায় প্রাণপণে
চাই--। এবার শুধু কাঠামোতে শব্দ স্থাপন, ব্যাস্! শক্তি রকিং
চেয়ারে আধেক লীন হ্রদয় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল, আমি লিখে চললাম।
বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই
প্রাণটাকে ধরে রাখতে ধড়ে
এই পৄথিবীতে, প্রতি সংঘাতে
জয়ের তরে।
মনে মনে গাইতে চেষ্টা
করলাম,
জমল না। ভাবনার গভীরতা নেই। তা-ছাড়া সুরের সাথে শব্দ গুলো
খাপ খাচ্ছে না।–
যাকগে, গীতাঞ্জলিতে কি আর কবিতার অভাব।
একটা কোমল কবিতার খোঁজ করলাম পেয়েও গেলাম, - ‘ফুল
বলে ধন্য আমি’।
এর পিছনে বিশেষ মেহনত
করতে হ’ল না। শুধু একটা অক্ষরের অদল বদল করে দিলাম। ‘ফুল
বলে পণ্য আমি’-
আহা! ভাবের বৈশিষ্টে চমৎকৃত হলাম। নিরীহ নিষ্পাপ ফুলের
নিলাম হওয়া এবং মনুষ্য সমাজে তার নানা এ্যানালজি চোখের সামনে ভাসতে লাগল। ভাবনায়
বুঁদ হয়ে রইলাম অনেক্ষন, কিন্তু অনেক ভেবেও দ্বিতীয় কোন
লাইন মাথায় এল না। পাতা ওলটাতেই আর একটা কবিতা বেড়িয়ে পড়ল ‘অন্তর মম বিকশিত কর’ এবার আর ফুল টুলের দোহাই দেওয়া
চলবে না। কবিতা সামনে রেখে আমি কন্টেম্পোরারি থিম খুঁজতে লাগলাম, পেয়েও গেলাম।
যন্তর আরো উপযোগী কর, যন্তরধারী হে,
নিখুঁত কর, নির্ভুল কর,
নিপুণ কর হে।
চায়নার সাথে পাল্লা দিতে
গেলে এঁর চেয়ে কনটেম্পোরারি আর কিছু হয় না। কিন্তু শুনতে কেমন যেন স্লোগান স্লোগান
লাগছে। তা হোক,
শক্তি বলেছিল কাঠামোতে শব্দ বসিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে!
বর্ষা ঋতুতে বজ্রপাত
বিচিত্র নয়। বিচিত্র নয় তার সাথে ট্রান্সফরমার বিকল হওয়া। মাথার উপর পাখাটা বন্ধ
হতেই শক্তি জেগে উঠে, চোখ খুলে বলল – দেখি
কি লিখেছ?
-অন্ধকারে
দেখবেন কি করে,
মোমবাতি জ্বালাই।
শক্তি হাত তূলে বলল -
থাক। তারপর আমার হাত থেকে লেখাগুলো নিয়ে নাকের কাছে ধরে বললঃ কোন গন্ধ নেই। এগুলো
কবিতা নয়,
ছন্দোবদ্ধ শব্দ। কাঠামোতে প্রাণ আনো, প্রাণ এলেই ঘ্রাণ আসবে। চেষ্টা করে যাও, ধীরে
ধীরে হবে।
আমার নাকে একটা স্নিগ্ধ
গন্ধ আসছিল,
যদিও খুব মৃদু, কোথা থেকে বুঝতে পারলাম
না।
এমন সময় মেঘ সরে গেল।
খাঁদের পাশে চাঁদ ডাকল আয়, আয়, আয়! – শক্তি চাঁদের মধ্যে চলে গেল। একাই গেল।
বিজলি নেই। বারান্দার
টবে রজনীগন্ধা গন্ধ সুধা ঢালছে। শান বাঁধান মেঝেতে ঠিকরে পড়ছে বাঁধ ভাঙ্গা চাঁদের
হাসি। চেয়ারের উপর উন্মুক্ত গীতাঞ্জলি। কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা, শুধু অনুভব করছি, চাঁদের আলোয় আর বর্ষার মেঘে মিলেমিশে একাকার
হয়ে গীতাঞ্জলির সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছে দিকময়।
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য্য