এই রংরুটই আমাদের কাছে
সহজ রুট হয়ে উঠেছে স্বাধীনতার সাত দশকে। সমাজবাস্তবতা ও আইন; মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার যে পারেই যে থাকি না
কেন। তাই অমরা জেনে গিয়েছি অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই পস্তাতে হবে। চোরকে ধরতে গেলেই
আইন আমাকে ছিবড়ে করে দেবে। ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ালেই নিজের মৃত্যু পরোয়ানায় নিজেরই
দস্তখত পড়ে যাবে। আর প্রতিরোধ করতে গেলেই রাজনীতি আপনাকে হাইজ্যাক করে নেবে।
স্বাধীনতার সাত দশকে এটাই ভারতীয় উপমহাদেশের অর্জন। আজকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়ো
সমস্যা রামমন্দির না বাবরি মসজিদ। গোরক্ষকক না গোভক্ষক। আজকে বাংলাদেশের সমস্যা
ইসলামী সংস্কৃতি না বাঙালি সংস্কৃতি। আজকে পাকিস্তানের সমস্যা মৌলিক অধিকার না মৌলবাদ।
একদিকে বাইশে শ্রাবণের স্মরণ সভা আর আরেক দিকে স্বাধীনতার সাত দশকের উদযাপনের
মাঝখানে তাই আজও সেই দ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ যেন ঝুলতে থাকেন নিরালম্ব
হয়ে।~~~~~~~~~~~~~~~
কন্ঠ আমার রুদ্ধ
আজিকে বাঁশি সঙ্গীতহারা
কন্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে
বাঁশি সঙ্গীতহারা, লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ অন্তিম বাইশে শ্রাবণের প্রায় দশ বছর আগে।
প্রশ্ন তুলেছিলেন সভ্যতার আলো নিভিয়ে যারা বেঁচে থাকার পরিবেশকেই বিষাক্ত করে তোলে
তাদেরকেও কি ক্ষমা করা সম্ভব কোনভাবে? অর্থাৎ মানুষের সমাজ সংসার যে সত্যই ঠিক পথে
না এগিয়ে রংরুট ধরে চলছে, পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলেন সেই মানুষটিই যিনি বিশ্বাস
করতে চেয়েছিলেন, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। সেই পাপ থেকে নিজেকেই উদ্ধারের
কাতর আর্তিতে তাঁকেও বলতে হয়েছিল সত্য বড়ো কঠিন। সেই কঠিনকেই ভালোবাসার অঙ্গীকার
করতে হয়ছিল জীবনের শেষপর্বে পৌঁছিয়ে। কিন্তু ঠিক কোন সত্যের
কথা বলতে চেয়েছিলেন কবি? প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণীর নীরবে নিভৃতে
কাঁদার সত্যর কথা? তিনি তো জানতেন ঈশ্বরপ্রেরিত দূতেরা বার বার ক্ষমা করার কথাই
বলে গিয়েছিলেন সবাই এই দয়াহীন সংসারে এসে এসে। তাই সংসার যে দয়াহীন একথা তো তাঁর
অজানা থাকার কথা নয়। এমনকি পাথরে নিস্ফল মাথা কুটে মরার যন্ত্রণার স্বরূপও তাঁর
অজানা ছিল না। এসব কিছুর মধ্যেও কি তিনি দিন বদলের স্বপ্নের আশায় গুণটানছিলেন?
মানুষের অন্তিম শুভবোধের উপর আস্থার নোঙর রাখা রবীন্দ্রনাথ তবে কোন সত্যকে শেষ
অব্দি কঠিন বলে স্বীকার করতে উদ্যত হয়েছিলনে শেষ পর্বের জীবনে?
জানতে হলে একটু পিছিয়ে
যেতে হবে আমাদের। তর্ক হচ্ছিল অধ্যাপকের সাথে নন্দিনীর। নন্দিনীর মত ছিল ‘মানুষ
হয়ে থাকবার জন্যে যদি মরতেই হয়। তাতেই বা দোষ কী’। কিন্তু অধ্যাপক মানতে রাজী নন
সে কথা। তাঁর মতে থাকবার জন্যে মরতে হবে মনে না করে, মারতে হবে যারা বলতে পারে,
একমাত্র তারাই টিকে থাকে। সেই ডারুইনের ‘সার্ভাইভাল অফ ফিটেস্ট’ তত্ব। কিন্তু
রক্তকরবীতে কবি আরও একটু এগিয়ে গিয়ে সত্যের আরও গভীরে ডুব দিয়ে ফেলেছিলেন।
অধ্যাপকের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিলেন এক অমোঘ বাণী; “তোমরা বল এতে মনুষ্যত্বের
ত্রুটি হয়, রাগের মাথায় ভুলে যাও এইটেই মনুষ্যত্ব। বাঘকে খেয়ে বাঘ বড়ো হয় না। কেবল
মানুষই মানুষকে খেয়ে ফুলে ওঠে”। ঠিক তাই। সভ্যতার এই মূল ইতিহাসটুকুই আমরা ধারণ
করতে পারিনা আমাদের শুভবোধের মানবিক আঙিনায়। পারি বা না পারি, ইতিহাসের তাতে কিছুই
যায় আস না। সত্য সত্যই থাকে। যতটা কঠিন ততটাই নির্মম। মানুষই মানুষকে খেয়ে বড়ো হয়ে
ওঠে। আর ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলেও সেটাই মনুষত্য। সেই সত্য তো কঠিন হবেই।
কিন্তু এই সত্যকে স্বীকার করলেও কি করে ভালোবাসবেন রবীন্দ্রনাথ? আজীবন সত্যের
পুজারী কবি তখন সত্যের একেবারে মুখোমুখি। আজীবন বিশ্বাসের পটে যে সত্যকে আর
মেলানোর উপায় নেই কোনভাবেই। সেই সত্যকে সহ্য করতে হলে, হজম করতে হলে কোন না কোন
ভাবে আপোষ তো করতেই হব। কবিকেও করতে হয়েছিল। সেই হল সত্যকে কঠিন হলেও স্বীকার করে
নেওয়া। কারণ সে সত্য। তাই স্বীকার করে নেওয়ার যন্ত্রণাতে উপশম দিতেই ভালোবাসার কথা
বলতে হয়েছিল কবিকে। অনেকটাই ছেলেভুলানো ছড়ার মতো করে।
কিন্তু সত্যই কি
ভালোবাসা সম্ভব? পেরেছিলেন কবি নিজে? মনে রাখতে হবে সত্যকে স্বীকার করে নেওয়া এক
বিষয়। আর তাকে ভালোবাসা আর এক বিষয়। মানবতার আমরণ পুজারীর পক্ষে কি সম্ভব এই
সত্যকে ভালোবাসা? মানুষের মনুষ্যত্ব
মানুষকে খেয়েই ফুলে ওঠায়? না নিশ্চয়ই নয়। অন্তত কবির সারা জীবনের সাধনাকে নিবিড়
ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে তো নয়ই। জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছিয়ে ‘সভ্যতার সংকট”-এ
তাই লিখছেন কবি: “জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম যুরোপের
অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে
দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই
দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকবো, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে
আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই”।
কবির সেই পূর্ব দিগন্ত
স্বাধীন হয়েছে সেও আজ সত্তর বছর। কিন্তু কবির সেই আশা কি পুরণ হয়েছে কোনভাবে?
সত্যদ্রষ্টাদের এই আর এক বিপদ। তাঁরা সত্যকে দেখতে পান স্পষ্ট করে। কিন্তু মেনে
নিতে পারেন না প্রাণ ভরে। কারণ সেই একই। ‘সত্য যে কঠিন’। তাই সেই সভ্যতার সংকটেই
স্পষ্ট উচ্চারণ করে গিয়েছিলেন কবি, “ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন
ইংরাজকে এই ভারতসাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন ভারতবর্ষকে সে
পিছনে ত্যাগ করে যাবে? কী লক্ষ্মীছাড়া
দীনতার আবর্জনাকে”। আজকে স্বাধীনতার সাত দশক পরে সেই আবর্জনার স্তুপ যে হিমালয়সম
ব্যপ্তিকেও ছাড়িয়ে বেড়ে উঠছে সে ঘটনা তো আমাদের সকলের চোখের সামনেই ঘটছে। ভাবতে
আবাক লাগে কত বড়ো সত্যদ্রষ্টা ছিলেন এই মানুষটি। সেই পূর্বদিগন্ত থেকে উচ্চারিত
হবে সভ্যতার দৈববাণী? এ কি নেহাতই কষ্টকল্পনা নয়?
কষ্টকল্পনা তো বটেই। না
হলে সত্তরটা বছর কিন্তু খুব একটা কম সময়ও নয়। আজ এই বাইশে শ্রাবণেও যদি চোখ মেলে
তাকাতেন কবি, কি দেখতে পেতেন? দেখতে পেতেন তাই যাকে অধ্যাপক মনুষ্যত্ব বলে স্বীকার
করে নিয়েছিলেন সেই কবেই। যাকে আমরা সমাজ বাস্তবতা বলে জীবনের অভিজ্ঞতায় মেনে নিই
প্রতিদিন নিয়ম করে। দেখতে পেতেন কত সহজভাবেই না আমরা অভ্যস্থ হয়ে উঠেছি
মনুষ্যত্বের সেই সঙ্গায়। আর তাই এই রংরুটই আমাদের কাছে সহজ রুট হয়ে উঠেছে
স্বাধীনতার সাত দশকে। সমাজবাস্তবতা ও আইন;
মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার যে পারেই যে থাকি না কেন। তাই অমরা জেনে গিয়েছি
অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই পস্তাতে হবে। চোরকে ধরতে গেলেই আইন আমাকে ছিবড়ে করে দেবে।
ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ালেই নিজের মৃত্যু পরোয়ানায় নিজেরই দস্তখত পড়ে যাবে। আর
প্রতিরোধ করতে গেলেই রাজনীতি আপনাকে হাইজ্যাক করে নেবে। স্বাধীনতার সাত দশকে এটাই
ভারতীয় উপমহাদেশের অর্জন। আজকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা রামমন্দির না বাবরি
মসজিদ। গোরক্ষকক না গোভক্ষক। আজকে বাংলাদেশের সমস্যা ইসলামী সংস্কৃতি না বাঙালি
সংস্কৃতি। আজকে পাকিস্তানের সমস্যা মৌলিক অধিকার না মৌলবাদ। একদিকে বাইশে শ্রাবণের
স্মরণ সভা আর আরেক দিকে স্বাধীনতার সাত দশকের উদযাপনের মাঝখানে তাই আজও সেই
দ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ যেন ঝুলতে থাকেন নিরালম্ব হয়ে।
কিন্তু কি করতে পারি
আমরা? আমরা কি তবে সব কিছুই অদৃষ্টের উপর সঁপে দিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকব এই মনে
করে যে- ‘মানুষের মনুষ্যত্বই যখন মানুষকে খেয়ে ফুলে ওঠায়’; তখন আমরা তো নিমিত্ত
মাত্র! না। মানুষের ধর্ম সে কথা বলে না কখনোই। পরিব্যাপ্ত অন্ধকারের মধ্যেও চেতনার
আলো জ্বালিয়ে ধরার প্রয়াস করে যেতেই হবে। সেটাই মানুষের কাজ। যে কাজে সিদ্ধিলাভ
করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে স্বয়ং কবিগুরু নিজেই। আমরা কেউই তাঁদের সমগোত্র
না হতে পারি; কিন্তু তাঁদের দেখিয়ে দেওয়া পথরেখায় নিজেদের সাধ্যমত কিছুটা হলেও তো
এগিয়ে চলতে পারি। অন্তর থেকে চেষ্টা করলে। পঁচিশে বৈশাখ কিংবা বাইশে শ্রাবণ তো সেই
সংকল্পেরই দিন। তাই এই বছরই পঁচিশে বৈশাখে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল রংরুটের, আজ
বাইশে শ্রাবণে তার পরবর্তী পদক্ষেপে রংরুটের নবতম সংখ্যা প্রকাশিত হল। পূর্ববর্তী সংখ্যাটির মতোই এবারেও ভারে হালকা
হলেও ধারে অনেকটাই ক্ষুরধার করে তোলার প্রয়াস রয়ে গিয়েছে সংখ্যাটির নির্বাচিত
লেখাগুলির প্রকাশের মধ্য দিয়ে। পাঠকের পরিতৃপ্তিতেই আমাদের আনন্দ।
এবারের সংখ্যার বিশেষ
আকর্ষণ উত্তরবঙ্গের কবি সুবীর সরকার ও দক্ষিণবঙ্গের কবি সৌমিত্র চক্রবর্তীর দুটি
সাক্ষাৎকার। রংরুটের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তাঁদের একান্ত নিজস্ব
চিন্তা চেতনার নানা দিগন্ত। সমাজ সংস্কৃতি সমকাল নিয়ে তাঁদের আজকের ভাবনাচিন্তার
সাথে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াসেই আমাদের এই আয়োজন। এবারের সংখ্যায় বাংলা
চলচিত্রের তিন দিকপাল সত্যজিৎ ঋত্বিক ও মৃণাল সেনকে নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন
বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব শ্রী ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। যৌনতা নিয়ে বাঙালির মননে
চিরকালই নানবিধ দোটানা চলতে থাকে। যৌনতার বিস্তৃত পরিসরে সেই দোটানার বিষয়েও
আলোকপাত করেছেন শাখা নির্ভানা তাঁর বিস্তৃত আলোচনায়। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও প্রকাশক
শামসুজ্জোহা মানিক তাঁর ‘বাঙ্গালীর সমাজ ও জাতি গঠনের গতিধারা’ প্রবন্ধে ইতিহাসের
আলোকে বিশ্লেষণে ব্রতী হয়ছেন বাঙালির জাতিগত অস্তিত্বের মূলস্বরূপ সম্বন্ধে।
শিক্ষা ও সমকাল নিয়ে লিখেছেন হাসিদা মুন। রওশন আরা বেগমের লেখায় উঠে এসেছে
বাংলাদেশের শিক্ষার পরিকাঠামো ও কানাডার শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে তুলনামূলক আলোচনা।
এছাড়াও রয়েছে অলভ্য ঘোষের ধারাবাহিক নিবেদন: ‘বিভাজন ও ভারতের ইতিহাস’। রয়েছে
অমলেন্দু চন্দের তীক্ষ্ণধী বিশ্লেষণে একটি চমৎকর লেখা, ‘নীতি স্বার্থ ও তত্ব’। সাম্প্রতিক
বাংলাদেশের রাজনীতি উঠে এসেছে সাংবাদিক বিপ্লব রহমান ও প্রাবন্ধিক রাহাত
মুস্তাফিজের দৃপ্ত লেখনীতে। রবীন্দ্রচিত্রকলার উপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন জার্মান প্রবাসী তরুণ কবি রেজওয়ান তানিম।
এই সংখ্যায় পাঠকের
প্রাপ্তি চারটি অনুপম ছোটগল্প। লিখছেন মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী, সোনালি পুপু,
সোমস্নিগ্ধ মুখোপাধ্যায় এবং ওপার বাংলার বিশিষ্ট কবি শাকিলা তুবা। সঙ্গে রয়েছে
শিমুল শুভব্রত ও সঙ্গীতার সুরম্য কলমের তিনটি রম্যরচনা। গ্রন্থসমালোচনায় রয়েছেন
বিশিষ্ট কবি সৈয়দ ওয়ালী। বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে খুব দরদী আলোচনা করেছেন পারমিতা
চক্রবর্তী। আমাদের আশা রংরুটে যারা ঘুরে যাবেন, তাঁদের পরিশ্রম বৃথা যাবে না।