এ কথা প্রচলিত, রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলায় আসেন প্রৌঢ় বয়সে। পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি ঢেকে দেবার
জন্য উদ্দেশ্যহীন আঁকাআঁকি,
রেখায় রেখায় মেলবন্ধন, তার চিত্রকলার মূল জায়গা। শিল্পজগতে বিচরণ, ড্রয়িং এর সমালোচনামূলক মূল্যায়নে আগ্রহসৃষ্টি বেশ দেরিতে- জীবনের শেষ সতের
বছরে। রবীন্দ্রমানষে চিত্রকলার উন্মেষ কখন ঘটে এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া দুষ্কর।
একথা মনে রাখতে হবে জোড়াসাঁকোতে পারিবারিক আবহ ছিল শিল্পসাহিত্য বান্ধব এবং
সমকালীন অন্য যেকোনো পরিবারের চেয়ে অগ্রসর। তাই একথা জোর দিয়েই বলা চলে শৈশব থেকেই
চিত্রকলার সাথে তার পরিচয় ঘটে এবং তিনি তখনই চিত্রশিল্প চর্চায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন।
ক্ষিতীশ রায় উল্লেখ করেন,
তিনি রবি ঠাকুরের কিছু ড্রয়িং দেখেছেন। বুলবন ওসমান দাবি
করেন,
কবি ১৮৭৪-৮২ এই সময়কালে মালতি নামে একটি পুথির পাতায় ছবি
আঁকতেন। তবে সে ছবি প্রথাগত চিত্রশিল্পীর মত নয়, বরং নিজের খেয়ালখুশি মত, নিজের জন্যে। ~~~~~
রবীন্দ্র চিত্রকলা: রেখায় রঙে আধুনিকতা
রেজওয়ান
তানিম
উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং শিল্প জগতে আধুনিকায়নের সূচনাপর্বের পুরোধা
ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্যের
প্রতিটি শাখায় স্বচ্ছন্দ বিচরণকারী রবিঠাকুর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এনেছেন নতুন সুর, বাঙালীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ঘটিয়েছেন বিশ্বায়ন এবং
প্রতিষ্ঠা করেছেন শিল্পচর্চার নতুন মাত্রা। তার বিপুলায়তন সাহিত্যকর্ম ও
শিল্পচর্চার বিষয় বৈচিত্র্যের কারণেই এখনো এর মূল্যায়ন অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হয় নি, বরং প্রায়শই নতুন প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে উপস্থিত হয়, আমাদের ভাবতে শেখায়। তেমনি একটি বিষয় রবীন্দ্র চিত্রকলা।
তার চিত্রকর্ম এখনো প্রাসঙ্গিক এবং নানামাত্রিক প্রকাশভঙ্গী নিয়ে সমালোচকদের
আলোচনার টেবিলে উপাদেয় সার বিশ্লেষণের জন্ম দেয়। ভারতীয় চিত্রকলায় আধুনিকায়নের
সূচনা ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। সমাজ বাস্তবতার সচেতন প্রতিফলন চিরন্তন অবয়বকে
বদলে দেয়,
রেখায় ও রঙে আসে বৈচিত্র্য। একজন শিল্পবোদ্ধা ও উঁচু
মানের কবি রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলার জগতে চলমান আন্দোলনে নিজেকে শামিল করেন এবং
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এ কথা প্রচলিত, রবীন্দ্রনাথ চিত্রকলায় আসেন প্রৌঢ় বয়সে। পাণ্ডুলিপির কাটাকুটি ঢেকে দেবার
জন্য উদ্দেশ্যহীন আঁকাআঁকি,
রেখায় রেখায় মেলবন্ধন, তার চিত্রকলার মূল জায়গা। শিল্পজগতে বিচরণ, ড্রয়িং এর সমালোচনামূলক মূল্যায়নে আগ্রহসৃষ্টি বেশ দেরিতে- জীবনের শেষ সতের
বছরে। রবীন্দ্রমানষে চিত্রকলার উন্মেষ কখন ঘটে এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া দুষ্কর।
একথা মনে রাখতে হবে জোড়াসাঁকোতে পারিবারিক আবহ ছিল শিল্পসাহিত্য বান্ধব এবং
সমকালীন অন্য যেকোনো পরিবারের চেয়ে অগ্রসর। তাই একথা জোর দিয়েই বলা চলে শৈশব থেকেই
চিত্রকলার সাথে তার পরিচয় ঘটে এবং তিনি তখনই চিত্রশিল্প চর্চায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন।
ক্ষিতীশ রায় উল্লেখ করেন,
তিনি রবি ঠাকুরের কিছু ড্রয়িং দেখেছেন। বুলবন ওসমান দাবি
করেন,
কবি ১৮৭৪-৮২ এই সময়কালে মালতি নামে একটি পুথির পাতায় ছবি
আঁকতেন। তবে সে ছবি প্রথাগত চিত্রশিল্পীর মত নয়, বরং নিজের খেয়ালখুশি মত, নিজের জন্যে।
রবিঠাকুর নিজেই ‘আমার ছবি’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন,
“(ষোল বছর
বয়সে) ... ততদিনে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ প্রাচ্য ঐতিহ্য মেনে আধুনিক
শিল্প আন্দোলন শুরু করে দিয়েছেন। আমি ঈর্ষান্বিত হয়ে তার ক্রিয়াকর্ম পর্যবেক্ষণ
করে যাচ্ছি। ততদিনে আমার সম্পূর্ণ বোঝা হয়ে গিয়েছে যে শব্দের আঁটোসাঁটো চৌহদ্দির
বাইরে যাওয়ার ছাড়পত্র ভাগ্য আমাকে মঞ্জুর করেনি।“
পারিবারিক শিক্ষাসূত্রে আধুনিক চিত্রকলার বৈচিত্র্যময়তার
স্বাদ পেলেও রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি সেভাবে চর্চা করেননি। সর্বতোভাবে চিত্রশিল্পের
প্রতি ঝোঁক দেখা যায় বিশের দশকের শেষের দিকে। রবিচিত্রের পরিণয় এবং গন্তব্য বুঝতে
হলে দৃষ্টিপাত করতে হবে এই সময়টির দিকে। বিশ্ব যুদ্ধোত্তর সময়ে সাহিত্য এবং
চিত্রকলার বৈচিত্র্যময় যাত্রা এবং খোলস বদল, এটা কবি মানসে নতুন বোধেরই প্রতিফলন। তাই দেখা যায় পূর্ব পরিকল্পিত ধ্যান
ধারনা এবং শিক্ষাকে উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথ আঁকতে শুরু করেন। যেন অজানা সাগরে
পাড়ি দেবেন বলে মনস্থির করেছেন। শিল্প কীর্তির অন্যসব শাখায় আমরা দেখি, তার সৃষ্টিশীলতা বাস্তব থেকে প্রতিফলিত অর্থাৎ বাস্তবকে
বিশ্লেষণ,
পুনর্নির্মাণ বা পুন মূল্যায়নের মাধ্যমে সৃষ্টকে রূপ
দিতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চিত্রশিল্পে ঘটেছে উল্টোটা। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত
আঁকিবুঁকির মধ্যে থেকে দৈবক্রমে লব্ধ সৃষ্টকে বাস্তবতায় আনতে চেয়েছেন রেখায় রঙে।
প্রায় সময়েই বলেছেন,
ছবি তার কাছে আসে। এই উক্তির অর্থ তিনি ছবি আঁকতেন
ইনটিউশনের ভিত্তিতে,
রেখা ও রঙ যেখানে যেতে চায় সেখানে গিয়ে শেষ করতেন
সুস্পষ্ট কোন নির্ধারিত লক্ষ্য ছাড়াই। লক্ষ্য শুধু একটাই ছবি শেষ করা। এই আপাত
উদ্দেশ্যহীন যাত্রার মাঝেই লুকিয়ে আছে রবিচিত্রের গোঁড়ার কথা।
বিশের দশকের শেষ ভাগ রবীন্দ্রমানষের নতুন বোধনের উন্মেষ
পর্ব। অন্যান্য সৃষ্টি মাধ্যমে ইতোমধ্যেই তিনি স্ব মহিমায় উদ্ভাসিত। এ সময়টাতে বিশ্বসাহিত্য
এবং চিত্রকলার জগতে চলছিল ভাঙাগড়ার নিদারুণ খেলা। চিত্রশিল্পের প্রকৃতি কী-তার
প্রেরণা,
উদ্দেশ্য, ধ্যান ধারণা এমনকি তাকে হৃদয়ঙ্গম করার প্রক্রিয়া; সর্বক্ষেত্রেই প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে অস্বীকার করা
হচ্ছিল। বাস্তবতার প্রতি নিষ্ঠা আর আস্থায় চিড় ধরল। আবির্ভাব ঘটল নানাবিধ বিকল্প
কল্পরূপের,
যা শিল্পীর ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে উৎসারিত। সাহিত্যে
নান্দনিকতার যে ধ্যান ধারনা গড়ে তুলেছেন রবিঠাকুর, যে নান্দনিক রোম্যান্টিসিজমের নিসর্গ তিনি গড়েছেন তা ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক
হয়ে উঠছে বাস্তবতার কষাঘাতে। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির ভাঙনে দুর্বিষহ সময়ের সন্তানেরা।
আর এ সময়টাতেই তার আঁকাআঁকির সূচনা। তাই তিনি অস্বীকার করলেন অপরাপর মাধ্যমের
রবীন্দ্রনাথকে,
শিল্প ও সুন্দরের রবিঠাকুরকে। নির্ঝরের স্বপ্ন যেন ভঙ্গ
হল,
রুধিত আবেগ ঝরঝর ঝরতে শুরু করল। জীবনের শেষ সতের বছর
এঁকেছেন দু হাতে। এই সময়ে তার আঁকা ছবির সংখ্যা নিয়েও বিতর্ক আছে। অনেকের মতে তিনি
প্রায় ২০০০ এর অধিক ছবি আঁকেন। তবে রবীন্দ্র ভবনের অধ্যক্ষ শিবনারায়ন রায়ের
মন্তব্য তার আকা ছবির সংখ্যা তিন থেকে চার হাজার। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে তার ছবি
নিয়ে যে আলোচনাগুলো হয়েছে সেগুলো অনেকাংশেই পরিপূর্ণ নয়, কেননা তার চিত্রসম্ভার অনেকের পক্ষেই দেখা সম্ভব
হয়নি। তার চিত্রাঙ্কন প্রবণতাকে
ভ্রাতুষ্পুত্র শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ তুলনা করেছেন আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের সাথে।
প্রায়দিনেই চার পাঁচটি ছবি একে শেষ করতেন। হাতের কাছে যা পেতেন তাই ব্যবহার করতেন-
ভাঙা কলম,
পেন্সিল, ফেলনা কাগজ- সব। তিনি প্রধানত ব্যবহার করতেন পেলিক্যান কালি। নিজের ছবি
প্রসঙ্গে রানী চন্দকে করা উক্তি স্মরণ করা যাক,
“তুমি জান আমি চিত্রশিল্পী নই। যাই আঁকি না জেনেশুনেই
আঁকি। ভেবেচিন্তে আঁকা বা কোন সুনির্দিষ্ট রূপ দেবার অভিপ্রায়ে সচেতন ভাবে আঁকা, আমার পক্ষে অসম্ভব। আমার কাজে নানান ইতস্তত আঁকাআঁকি
থেকে কোন এক পর্যায়ে একটা অবয়ব রূপ ধারণ করে। এমন লোককে কি শিল্পী বলা চলে? নিশ্চয়ই বলা চলে, যদি এই কথা আমরা মনে রাখি যে এই শিল্পী কোন রকম খোঁজ ছাড়াই পাওয়ার আশায়
আঁকেন,
ফলে তাঁর প্রাপ্তিতে ভালমন্দের বেশ বড়ো হেরফের রয়েছে।“
রবীন্দ্র চিত্রকলার লক্ষণীয় বিষয়টি হল ভারতীয় চিত্রকলার
হাজার বছরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যবোধ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ধারার সৃষ্টি। এ কাজটি
তিনি করেছিলেন সচেতন সৃজনমানষ এবং শিল্পের আধুনিকায়নের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে। ১৯১৩
সালে নোবেল জয়ের পরে তিনি মোটামুটি সারা বিশ্বেই পরিচিতি লাভ করেন। এ সময়ের
বিশ্ব-ভ্রমণ এবং শিল্প সাহিত্যের অগ্রপথিক দেশগুলোর সাহিত্য ও শিল্প আন্দোলনের
ভাবধারা তাঁর মানসে গভীর রেখাপাত করে। ইউরোপের রেনেসাঁ প্রসূত বিজ্ঞান চেতনা, মানবতাবাদ, কিউবিজম,
ফভিজম, ফিউচারিজম, সুরিয়্যালিজমের চেতনা চিত্র জগতকে যে নাড়া দিয়েছিল এবং
সূচনা করেছিল পরাবাস্তবতার,
তার ফলশ্রুতি আমরা দেখতে পাই রবিচিত্রে। ভারতীয়
পুরাণভিত্তিক এবং মুঘল চিত্রকলার দীর্ঘ অচলায়তন ভেঙে নিজস্বতা সৃজন করেন। ভারতীয়
ঐতিহ্যের নামে শিল্পের গোঁড়ামির বিরোধিতা করেছেন তিনি সবসময়। তিনি এসময়েই বলেন,
“আমি আমাদের শিল্পীদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি তারা যেন
বিগত যুগের শিল্প সৃষ্টির অনুকরণে এমন কিছু করবার দায়িত্ব না নেন যা তথাকথিত
ভারতীয় আর্টের নামে ‘ছাপ মেরে’ জন সমাজে চলতে পারে। তারা যেন গর্বের সঙ্গে ছাপমারা পশুর মত পশুশালায় জড়ো
হতে অস্বীকার করেন“
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজনীন চেতনার জায়গাটিতে ছিল বিশ্ব
ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য অবদান। বিশ্বভ্রমণের গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যায় ছিল জাপান
ভ্রমণ। ১৯১৬ সালে গিয়ে সেখানে চলমান শিল্প আন্দোলন বিষয়ে অবহিত হন। তিনি সাথে করে
কিছু চিত্রকর্ম তৈরি করিয়ে আনেন যা এখন বিশ্বভারতীর সংগ্রহশালায় আছে। এ সময়েই
প্রতিষ্ঠা করেন শিল্পী সাহিত্যের গোষ্ঠী-বিচিত্রা ক্লাব। আশা ছিল এই গোষ্ঠী ভারতীয়
সাহিত্য এবং চিত্র কলার নবজাগরণের সূত্রপাত ঘটাবে। তবে এ আশা পূর্ণ না হলেও
পরবর্তীতে শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠে আধুনিক চিত্রকলা চর্চার পীঠস্থান। রবীন্দ্রনাথের
শিল্পভাবনা সম্পর্কে জানতে পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরিতে চোখ বোলানো যাক,
“ ...আর্টিস্ট আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আর্টের সাধনা কী? আর্টের একটা বাইরের দিক আছে সেটা হচ্ছে আঙ্গিক, টেকনিক, তার কথা বলতে
পারি নে। কিন্তু ভেতরের কথা জানি। সেখানে জায়গা পেতে চাও যদি তাহলে সমস্ত স্বত্বা
দিয়ে দিয়ে দেখো,
দেখো, দেখো।... দেখতে
পাওয়া মানে প্রকাশকে পাওয়া। বিশ্বের প্রকাশকে মন দিয়ে গ্রহণ করাই হচ্ছে আর্টিস্টের
সাধনা।“
আমাদের চোখ দিয়ে যা দেখছি তাকে আমরা কোন আঙ্গিকে, কোন প্রকাশভঙ্গীতে প্রকাশ করব, সেইটাই শিল্পীর মূল সাধনা কেননা শিল্প হল প্রকাশ। ভারতীয়
চিত্রকলার তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এটাই রবিকবির বিশিষ্টতা। বহুকালব্যাপী ভারতীয়
চিত্রকলা ছিল বর্ণনাত্মক,
চিত্রে ধর্মীয়, পৌরাণিক-ঐতিহাসিক আখ্যানের বর্ণনাই ছিল চিত্রকলার প্রধান কাজ। সে ছিল
ইলাস্ট্রেশন ধর্মী আর তার স্বাধীনতা ধর্ম, পুরাণ বা ইতিহাসের কাছে যেন বন্ধক রাখা ছিল। মজার ব্যাপার ইংল্যান্ড থেকে
আগত তৎকালীন ইউরোপীয় বা অ্যাংলো শিল্পীদের চর্চায় এর কোন বদল ঘটেনি যারা ভারতবর্ষে
এসে চর্চা করেছেন চিত্রকলা। তাদের চর্চাতে সামান্য রঙ বদল ঘটেছে মাত্র কিন্তু একদম
আনকোরা সুর ফুটে ওঠেনি চিত্রপটে। রবিঠাকুর স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিলেন এখানেই।
চিত্রকর্মে আমরা যে রবীন্দ্রনাথকে পাই সে রবীন্দ্রনাথ আমাদের চেনা, কবি মহর্ষি গুরুদের শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা, শুদ্ধ ও সুন্দরের সাধক নন বরং একান্তই বিপরীত। বিষয় ও
আঙ্গিকগত দিক থেকে তার ছবি আমাদের বিস্মিত করে, একটা আঘাত করে প্রচলিত অচলের বিরুদ্ধে।
রবিচিত্রের শ্রেণীকরণের দিকে যদি দৃষ্টি দেই তবে মোটা
দাগে রবীন্দ্র চিত্রকলাকে তিন শ্রেনীতে ভাগ করা যায়। প্রাকৃতিক দৃশ্যের চিত্র, মানব প্রতিচিত্র আর পাখি এবং জীবজন্তুর চিত্র। যদিও এ
শ্রেণীকরণ রবীন্দ্র চিত্রের ব্যাপকতা ধারণে ব্যর্থ, তথাপি মোটামুটি সরলীকরণের সুবিধার্থে করা। রবীন্দ্রনাথ নিজের প্রোট্রেট সহ
বহু প্রোট্রেট ধর্মী কাজ করেছেন। এসব চিত্রের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই চেনা মুখ
ছায়ার আড়ালে কেমন যেন আড়ষ্ট একটা অন্যরকম রূপ নিচ্ছে। তার অনেক কিছু বলবার আছে।
ভীষণ রকম এক্সপ্রেসিভ কিন্তু বিষণ্ণ কিছু মানব মানবীর ছবি এঁকেছেন রবিঠাকুর।
ক্রমাগত বিষণ্ণ এ মুখগুলো তিনি একে গেছেন বারবার। এসব ছবি নিয়ত ভাঙাগড়ার এক
আশ্চর্য উপলব্ধির মাঝে এনে দাড় করিয়ে দেয়। চিত্রাঙ্কনে রেখাচিত্রের প্রাধান্য দেখা
গেলেও সুস্পষ্ট নিয়ম বা রীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা দেখা যায় না। ফলশ্রুতিতে ছবিগুলো
হয়ে উঠেছে অনেক বেশি ধোঁয়াশা পূর্ণ। যেন অঙ্কিত মানবমূর্তি গুলি নীরব অথচ চঞ্চল, অংশ নিচ্ছে মূকাভিনয়ে। মানুষের মুখের পিছনকার মুখ বের
করতে উদ্ধত সেই মূর্তিগুলো।
তিনি জীবজন্তু এবং পাখি বিষয়ক চিত্রও এঁকেছেন প্রচুর।
শুরুর দিকে তাঁর জীবজন্তুরা যেন ছিল এক অন্ধলোকের বাসিন্দা। শরীরের নাড়াচাড়া ছিল
অবিন্যস্ত থাকলেও প্রানসঞ্চারী অনুভূতিটা ছিল অটুট। তার বাঘের ছবিতে দেখতে পাই
অদ্ভুত হিংস্র লিপ্সায় আক্রান্ত বাঘ যার বাস্তবতা বা আকার আকৃতিগত দিক মুখ্য না
হয়ে প্রকৃতি মুখ্য হয়ে ধরা দেয়। প্রাণীজ চিত্রকলায় গতিময়তার বিষয়টি বাঙ্ময় হয়ে
উঠেছে অতি সুচারুরূপে। তার বেশির ভাগ পশুপাখির ছবিতে আকার আকৃতিগত দিকটি চেনা জানা
জগতের সাথে মেলে না বরং মনে হয় অলীক এ জন্তু জানোয়ারের প্রতিচ্ছবি, নিসর্গের বদলে ধূসরতা, সময়ের কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ। এভাবেই চেষ্টা করেছেন তিনি প্রথাবদ্ধতা, চিত্রকলার তথাকথিত পরিবর্তনহীন ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসতে।
যারা প্রথাবদ্ধতার পথেই আস্থা রাখেন তাদের উদ্দেশ্য কবির বক্তব্য,
" লোকে প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার ছবির মানে কি। ছবির সাথে সাথে আমিও নীরব থাকি। ছবির
কাজ প্রকাশ করা,
ব্যাখ্যা করা নয়"
রবীন্দ্র চিত্রকলার উল্লেখ যোগ্য দিক ছিল রেখাচিত্র। তার
বহু চিত্রকর্ম কালি এবং কলমে আকা। রেখার আবেশে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন বহু অবয়ব। তিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে
লক্ষ্য করতেন কিভাবে রেখাগুলো একে অন্যের সাথে যুক্ত হয়ে নতুন নতুন ছবি ফুটিয়ে তুলছে
শাদা কাগজে। তার চিত্রকলার আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক রঙের ব্যবহার। একটু ভাল
ভাব খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন তার কাজে সবুজ এবং নীল রঙের লক্ষণীয় অনুপস্থিতি এবং
গাঢ় খয়েরী,
বা কালচে খয়েরী রঙের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। এর কারণ
হিসেবে কেউ কেউ তার দৃষ্টির অস্বাভাবিকতাকে দায়ী করেছেন। ব্রিটিশ জার্নাল অভ অ্যাস্থেটিক্স
এর ১৯৮৭ সালের এক সংখ্যায় লেখা হয় রবীন্দ্রনাথ প্রোটোন্যাপ ছিলেন। তিনি নীল আর
বেগুনি রং দেখার সময় লাল রঙের সাথে গাঢ় খয়েরি বা কালো রং এর সাথে গুলিয়ে ফেলতেন।
এই বিষয়টির সত্যতা তার রবি চিত্রকলার পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে পারা যায়।
শিল্পী রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাথে এসেছেন ব্যাপৃত
নি:সঙ্গতা নিয়ে,
সেই সঙ্গে প্রচলের প্রতি ঠাট্টার রেশ নিয়ে। এ কারণেই তার
পোট্রেটের দিকে তাকালে নিজেকে নি:সঙ্গ মনে হয়, নিজের জীবনকেও মনে হয় ক্ষুদ্র, অর্থহীন। অপরাপর কর্মযজ্ঞে নিজের ভাবনাকে প্রকাশের বেলায় নি;সঙ্কোচ রবীন্দ্রনাথ প্রথম দিকে চিত্রকর্ম নিয়ে এক ধরনের
শঙ্কায় ভুগতেন। অঙ্কণশিল্পে প্রথাগত দখল ছিল না বলেই হয়ত এ সঙ্কোচ। তিনি একথাও
বলেছেন যে,
নন্দলাল ও অবনীন্দ্রনাথের মত ছবি আঁকা শেখেননি বলেই এ
সঙ্কোচ। যা হোক,
তার চিত্রকর্ম ভারতবর্ষে প্রথম দিকে গৃহীত না হলেও
ইউরোপে বেশ গুরুত্ব পায়। সেখানে বেশ কয়েকটি দেশে তা প্রদর্শিত ও প্রশংসিত হয়। কোথাও কোথাও অবশ্য
সমালোচিতও হয়েছে।
১৯৩০ সালে ফ্রান্সের গ্যালারি পিগ্যাল (Gallarie pigalle
) প্রদর্শনীতে তার চিত্রকলা প্রশংসিত হয়। প্রখ্যাত ফরাসি
সাহিত্যিক এবং সমালোচক পল ভ্যালোরি, আদ্রে জিদ প্রমুখ বলেন,
"আমাদের সময়ের বিভিন্ন চিত্র আন্দোলনগুলো কী করতে চেষ্টা
করছে,
সে বিষয়ে আমরা সবেমাত্র যা উপলব্ধি করতে শুরু করেছি, আপনি এতটা অনায়াসে কি করে তা আমাদের দৃষ্টির সামনে নিয়ে
এলেন?"
পরবর্তীতে জার্মানি এবং লন্ডনে তাঁর চিত্রকলা প্রশংসা
এবং সমালোচকদের সুদৃষ্টি লাভ করতে সমর্থ হয়। লক্ষণীয় ফ্রান্সে তাঁর আঁকা জীবজন্তু
এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং জার্মানিতে মনুষ্য চেহারা চিত্র প্রশংসা লাভ করে। মস্কোতে
তাকে বড়ো মাপের চিত্রশিল্পী হিসেবে স্বাগত জানানো হয়। এতে চিত্রশিল্পী হিসেবে
আত্মবিশ্বাসের পারদটি বেশ উঁচুতে ওঠে এবং
যুক্তরাষ্ট্রে যখন চিত্র প্রদর্শনী হয় তখন সেখানে একথা বলতে দ্বিধা বোধ করেননি যে, দার্শনিক বা মহান কবি হিসেবে নয়, একজন চিত্র শিল্পী হিসেবেই এসেছেন। তথাপি মার্কিন মুলুকে
রবিকবির ছবি তেমন প্রশংসা পেতে সক্ষম হয়নি। ফলশ্রুতিতে ১৯৩৮ সালে লন্ডন ছাড়া
জীবদ্দশায় তার ছবির পাশ্চাত্যে আর কোন প্রদর্শনী হয় নি।
ইউরোপীয় চিত্রজগতে রবীন্দ্রনাথ আলোচিত হলেও এবং ইউরোপের
বাইরে পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশে রবীন্দ্র চিত্রাবলীর আবেদন ছিল মিশ্র। মূলত
পাশ্চাত্যের চিত্রকলায় রৈখিক অঙ্কন শৈলীর উপর অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে
যেদিকে রবীন্দ্রনাথের প্রথাগত শিক্ষার অভাবে জোর দেয়া সম্ভব ছিল না। আর এদিকটাতেই
সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন পাশ্চাত্যের সমালোচক গন। সমালোচক কেইন্স স্মিথ লেখেন,
‘রবীন্দ্রনাথের ড্রয়িং এর বিচারে চিত্রশিল্প সমালোচনার
স্বাভাবিক মানদণ্ড ব্যবহার করা অসম্ভব। এই ড্রয়িং গুচ্ছ দেখে ভারি আনন্দ হয়, তথাপি একথা সত্য রূপসৃষ্টির যে বীজ থেকে চিত্রশিল্পের
যাত্রা শুরু হয়েছে,
সেটা নেহায়েতই কাকতালীয় ভাবে লব্ধ।‘
রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর একশত পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে
১৯৮৬ সালে লন্ডনে বার্বিকান গ্যালারিতে রবীন্দ্র চিত্রকলার একটি বিশাল প্রদর্শনী
হয়। এ প্রদর্শনী উপলক্ষে পত্রিকায় সমালোচনা বের হয়।
* সানডে টাইমস পত্রিকায় তার কবিতাকে "মরমী সত্তা
সম্বন্ধে একধরণের বিবরণ" বলে প্রশংসা করা হলেও চিত্রকলা সম্বন্ধে বলা হয় অতি
সরল শিশুসুলভ ড্রয়িং।
* স্প্রেক্টেটর পত্রিকায় জাইলাস জাডি আবার এসকল কাজের বেশ
প্রশংসা করেন এবং তার কাজকে আলফ্রেড ওয়ালিশ, এ্যাডভার্ড মাঞ্চ,
স্যামুয়েল পামার এর সাথে তুলনা করেন।
* অক্সফোর্ডের মিউজিয়াম অভ মর্ডান আর্ট এর পক্ষ থেকে বলা
হয়,
“শিল্পী হিসেবে তিনি খুব গুণী নন-বড্ড বেশি ভাবলেশহীন মুখ, অবিন্যস্ত অবয়ব, অতি কারুকার্যময় কালির কাজ- কাজ দেখে আগ্রহ জাগে, কিছু কাজ অসাধারণ। কিন্তু অল্প কিছু শিল্পকর্ম প্রদর্শন
করেই যেখানে কাজ সারা যেত,
সেখানে ১২৪ টা শিল্পকর্ম প্রদর্শন অপ্রয়োজনীয়।“
* রবি চিত্রকর্মের কট্টর সমালোচনা করেছেন ব্রায়ান সুওয়েল।
তিনি স্টাটার্ন্ড পত্রিকায় লেখেন, "তার চিত্র
দুর্বোধ্য,
পরিশীলিত নয়। তার মতে রবীন্দ্রনাথ এক বিরক্তি উদ্রেককারী
বৃদ্ধ,
যিনি সারা বিশ্ব চষে বেড়িয়েছেন এবং নানা মানুষের চিত্র
আর ড্রয়িং থেকে ভাব চুরি করে বৃদ্ধ বয়সে চর্বিতচর্বণ পরিবেশন করেছেন। ছবিগুলো অতি
নিকৃষ্ট মানের।"
* চিত্র সমালোচক টিমোথি হাইমেন এবং অ্যান্ডু রবিনসন রবি
চিত্রকলা নিয়ে বিস্তারিত বই লেখেন এবং বেশ প্রশংসা করেন।
রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যে অল্প বিস্তর সমালোচিত হলেও তার
চিত্রকলার ভাষিক ও আঙ্গিকগত দিকগুলোর জন্যে নানা ধিক থেকে পাশ্চাত্যের প্রতি ঋণী।
প্রথাগত ভাবে একজন শিল্পী না হয়েও তিনি চিত্রশিল্পে আরো বেশি মনোযোগ দেবার রসদ
প্রথম দিকে পেয়েছেন পাশ্চাত্য থেকে কেননা তার চিত্রকর্ম ভারতবর্ষে শুরুর দিকে
একেবারেই গৃহীত হয়নি বরং পশ্চিমের ইতিবাচক
সমালোচনা লাভ করেছিল। এটাই তাঁকে চিত্রকর হিসেবে নিজেকে প্রকাশের পথ খুলে দিয়েছিল।
যা হোক রবীন্দ্র চিত্রকলা নিয়ে পাশ্চাত্যের এ মিশ্র প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও ভারতীয়
চিত্রশিল্পের জগতে এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। কারণ তখন অব্ধি তাঁর চিত্র কলার অগ্রসর ধারণা
ভারত বর্ষে গৃহীত হয় নি। পরবর্তীতে পাশ্চাত্যের সমালোচনা সত্ত্বেও এ চর্চা অব্যাহত
রাখেন।
আজকের সময়ে দাড়িয়ে যদি আমরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাই
যে রবীন্দ্র চিত্রকলা এই যে এত বিচিত্র সম্ভার নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে তা
কি একেবারেই আলাদা,
রবিঠাকুরের অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম থেকে, নাকি এটি তার সাহিত্যকর্মের পরিপূরক! কেননা আমরা লক্ষ্য
করি সাহিত্যে যে নান্দনিক সুন্দরের বয়ান তিনি সবসময় দিয়ে এসেছেন এখানে তার
ব্যতিক্রম ঘটেছে। এখানে মানুষগুলো বিষণ্ণ, জন্তুগুলো কিম্ভুত,
তাদের ভঙ্গিতে আছে ভয়ংকরের ছাপ, গতিময় এক জড়তায় তারা আক্রান্ত। বাঁকাচোরা ফর্মের
ছবিগুলোর স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ আসলে সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকেই পূর্ণ করেছেন। আর তাই
চিত্রকলায় আধুনিকতার যে আন্দোলন সে আন্দোলনে সাহিত্যের আর সব শাখার মতই সমান প্রভা
নিয়ে বার্তাবাহকের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। ভারতীয় চিত্রকলা বিশেষজ্ঞ ডাব্লিউ বি
আর্চার,
অমৃতা শেরগিল এবং যামিনী রায়ের সাথে রবীন্দ্রনাথকেও
আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার পথিকৃৎ বলে চিহিৃত করেছেন। প্রথাগত শিক্ষালাভের ব্যাপারটি
যে তার সাথে ঘটে নি এটাও একটি পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত। আর তাই তার ছবি প্রসঙ্গে এই
আলোচনা শেষ করছি সরসীলাল সরকারকে লিখিত পত্রের উদ্ধৃতি থেকে-
"ছবির কথা কিছুই বুঝিনে। ওগুলো স্বপ্নের ঝাঁক, ওদের ঝোঁক রঙিন নৃত্যে। এই রূপের জগত বিধাতার স্বপ্ন-
রঙে রেখায় নানাখানা হয়ে ফুলে উঠচে।... অজানার স্বপ্ন উৎসব থেকে বিচিত্র রূপে
উৎসারিত- এ সম্বন্ধে বিশ্বকর্মার কোন কৈফিয়ত নেই।"
উল্লেখপঞ্জি:
১) সার্ধশততম জন্মবর্ষে রবীন্দ্রনাথ, প্রকাশক : ছায়ানট
২) বাংলা একাডেমীর নিবেদন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রকাশক: বাংলা একাডেমী
৩) ভিঞ্চি, পিকাসো,
হুসেন, সুলতান ও
অন্যান্য: রফিউর রাব্বি
রেজওয়ান তানিম