সমাধান কোন পথে
মানুষের সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে,ডারউইনের বিবর্তনবাদের
থিওরিতে দেখতে পাবো যে,প্রতিনিয়ত সংগ্রাম এর মাধ্যমে মানুষ আজকের সমাজ বা
রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হয়েছে। বিজ্ঞানের এই যে চরম উন্নতি
সম্ভব হয়েছে, তা কিন্তু মানুষের প্রতিটা মুহূর্ত অক্লান্ত পরিশ্রম এবং
মেধার সমন্বয়ে। যেদিন সমাজবদ্ধ মানুষ
জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ আরাম-আয়েসের স্বাদ গ্রহণ করতে শিখেছে , সেই দিন থেকে শুরু
হয়েছে সমস্যা। প্রকৃতির প্রত্যেকটি জীবই বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছে। সমস্যাজর্জরিত
পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শিখেছে নিজস্ব তাগিদেই। গোষ্ঠী জীবন থেকেই সমাজ জীবনে উন্নীত হয়েছে।যত বেশি সভ্যতার চূড়ান্ত
পর্যায়ে পৌঁছেছে মানুষ, তত বেশি সমস্যা জর্জরিত
হয়ে পড়েছে সমাজ বা রাষ্ট্র। বর্তমান পৃথিবীতে
যন্ত্র সভ্যতার চরমতম বিকাশের মুহূর্তে,রাষ্ট্রের সমস্যা ঠিক বলে শেষ করা যাবে না। তবু রাষ্ট্র বা সমাজ
সচেতন মানুষ সর্বদাই ভাবিত এবং সেই জটিল সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি, বা যথার্থ মীমাংসা কোন পথে তা
নিয়েও ভাবিত।অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা সমাধানের উপায় নির্ধারণ করে থাকেন
সমাজতত্ত্ববিদগণ। তাই নিয়ে মত পার্থক্য আছে,কিন্তু সংবেদন শীল সমাজ সচেতন মানুষ একটি বিষয়ে একমত
বিশ্বায়নের যুগে সমগ্র পৃথিবী আর্থসামাজিক, প্রাকৃতিক, রাষ্ট্রিক এবং ব্যক্তিক
ভাবে ভয়ঙ্কর সংকটের মুখোমুখি।
এই সংকটের কড়াল গ্রাস কিভাবে ব্যক্তি মানুষকে ভয়ঙ্কর সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল,তার সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি আমরা দেখেছি কাফকার মেটামরফসিস গল্পে, কামুর আউটসাইডার,টি এস, এলিইয় টের ,দি ওয়েস্ট ল্যান্ড,প্রভৃতি লেখায়। পরপর দুটো বিশ্বযুদ্ধে মানুষের রাষ্ট্রিক সংকটের ভয়াবহতা দেখে আমরা শঙ্কিত।এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লিখলেন রক্তকরবী।, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমকালে লিখলেন সভ্যতার সংকট। যন্ত্র সভ্যতার ভয়ংকর পরিণতি দেখেছি তাঁর রক্তকরবী,মুক্তধারা নাটকে। উপনিবেশিক সংকট মুক্তির পর তৃতীয় বিশ্বের মানুষের সংকট কি অসীম দুর্দশা গ্রস্থ হয়েছে তার প্রতিচ্ছবি বাংলা উপন্যাসে খুব সুন্দর ভাবে চিত্রিত হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম, দেশ ভাগ,উদ্বাস্তু সমস্যা, সাম্প্রদায়িক সংকট,নিয়ে রচিত হয়েছে অমিয়ভুষণ মজুমদারের গড়শ্রীখণ্ড,সমরেশ বসুর আদাব এছাড়াও আরো অনেকের লেখায় দেশ জাতি এবং বিশ্ব চরাচরের নানান সংকট ব্যাক্ত হয়েছে। জীবনানন্দের কবিতায় পেয়েছি যুগ যন্ত্রণার নিখুঁত চালচিত্র। তাঁর আট বছর আগের একদিন, লাস কাটা ঘরে, শিকার, প্রভৃতি কবিতায় অদ্ভুত ভাবে ব্যাক্তিক রাষ্ট্রিক সামাজিক সংকট একি চিত্রকল্পে মহাকাব্যিক আধারে ব্যঞ্জিত করতে সক্ষম হয়েছেন কবি। যা একেবারেই দেশ কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বমানবতার সংকট কে প্রতিফলিত করেছে। যেমন ভাবে রবীন্দ্রনাথের আফ্রিকা কবিতায় আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভয়ঙ্কর করাল গ্রাসের ছবি। উপরে উল্লেখিত রবীন্দ্রনাথের সমস্ত লেখা তেই বিশ্ব মানবতার সংকট চিত্রিত হয়েছে। বাংলা উপন্যাসে সেই অর্থে বিশ্বমানবতার সংকট চিত্রিত হতে দেখি নি।সলমন রুশদির লেখা, দি মিড নাইটস চিলড্রেনস বা স্যাটানিস ভার্সেস সেই সংকটের ছায়া আমরা দেখেছি।
এখন একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পৌঁছে, বিশ্বায়নের এক অভিনব অধ্যায়ে পা রেখেছে আজকের সভ্যতা। তেমন এক সন্ধি লগ্নে শুরু হয়েছে সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী এক ভয়ঙ্কর মহামারী।এই মহামারীর কি ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক পরিণতি তা পর্যালোচনা করার পূর্বে,সমকালীন পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যথাযথ সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন আছে বলেই আমি মনে করি। বিশ্বায়নের যুগে ভোগবাদী চরম স্বার্থপর জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষ কিভাবে আজকের এই সংকটে উপনীত হল তা অল্প বিস্তর সকলেরই জানা। উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ। কিন্তু উপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারে নি তারা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তরে বিপুল সংখ্যক মানুষ,গৃহহারা, দেশ মাটি জন্ম ভিটে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিকড় হীন ভাসা শ্যাওলার মত ভাসতে ভাসতে চলেছে। এই ছিন্নমূল মানুষের না থাকল দেশ, না থাকল দেশাত্মবোধ। এই দিশাহীন স্বপ্ন হারা মানুষ,এই কঠিন আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে পড়ে চরম স্বার্থপরতায় ক্রমশ নিমজ্জিত হল।নৈতিকতাহীন সস্তার রাজনীতির দিকে ধাবিত হল দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ। রাজনীতি দেশের মানুষের কাছে হয়ে উঠলো অর্থ উপার্জনের একটা বড় কেন্দ্র। দেশ পরিচালনার জন্য মানুষের যে মূল্যবোধ প্রয়োজন,দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা প্রয়োজন,তা আর থাকলো না,কোনো রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে। শুরু হলো মানুষে মানুষে হানাহানি। প্রতিটা মুহূর্ত পরস্পর পরস্পরের প্রতি সন্দিহান হয়ে উঠল। ক্ষমতার লড়াইয়ে কে কাকে পরাজিত করে, তারা আসনকে সুদৃঢ় করবে এই কেবল লক্ষ্য। যেন তেনপ্রকারেন গদি দখল। পাইয়ে দেয়ার রাজনীতি মানুষের স্বপ্নকে মানুষের মূল্যবোধ এবং বেঁচে থাকার প্যাসন কে বিকৃত একটা স্থূল সংস্কৃতির দিকে ঠেলে দিল। আজকের প্রজন্মকে ক্রমশ একটা যন্ত্রমন্ত্র ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে মগজ ধোলাই চলছে।একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পৌঁছে যেখানে বিজ্ঞানের চরম বিকাশ ঘটে গেছে,সোশ্যাল মিডিয়ার এই চূড়ান্ত রমরমা,এখনো পর্যন্ত মানুষ দুটো জিনিসের উপরে দাঁড়িয়ে তার জীবনের অভিমুখ পরিবর্তন করে। একটা জায়গায় চরমভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে গভীর ধর্ম বিশ্বাস। জন্মসূত্রে মানুষ যে ধর্মে বিশ্বাসী যে ধর্মীয় পরিবেশে পরিবারে সে জন্মগ্রহণ করেছে তাকেই আঁকরে ধরে থাকে এক শ্রেণির মানুষ।, সেই সমস্ত অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ কখনোই আর তার গণ্ডিবদ্ধ ধর্মীয় জীবন থেকে বেরিয়ে এসে মানবিকতার সঙ্গে মানবতাবাদের বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে মানুষকে বিচার করে না। ধর্মের মড়কে মুড়ে নেয় তার চেতনা।তার ফলে সংগ্রিক ভাবে হানাহানি, লাঠালাঠি, খুনোখুনি চলতেই থাকে। যার পরিণতি মানব সভ্যতার চরম সংকট।
আর দ্বিতীয়টি হল পরিবর্তমান পরিস্থিতিতে আর্থসামাজিক পরিকাঠামোয়, রাজনীতির রমরমা।রাজনীতি
যেখানে একটা বিশেষ ব্যবসা। ধর্মক্ষেত্রে ধর্মব্যবসায়ীরা
তাদের মুনাফা লুটে থাকে ধর্মের মাধ্যমে,কিন্তু সাধারণ মানুষ যারা ধর্ম ব্যবসায়ীদের দ্বারা
পরিচালিত হয় তারা জন্মগত সূত্রেই ধর্মকে রক্তে-মাংসে বরণ করে নেয়, তার যাবতীয় বৃদ্ধির সঙ্গে
সঙ্গে ধর্মবোধ ও সম্প্রসারিত হতে থাকে, তার নিজস্ব ধর্ম ভাবনায় ভাবনার সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে।
রাজনীতি নিয়ে যে ব্যবসা সেটা সম্পর্কে মানুষের প্রচন্ড রক্ষণশীলতা কিছু নেই। জন্মসূত্রে রাজনীতি
বিশ্বাস বহন করা ট্র্যাডিশন কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ করা গেলেও, সে সমস্ত দৃষ্টান্ত
ব্যতিক্রমী বলেই মনে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনীতি সচেতন মানুষ, যারা রাজনীতি করতে আসে, ব্যক্তিস্বার্থ
চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে, মূলত অর্থনৈতিক মুনাফা অর্জন এবং খ্যাতি অর্জন ক্ষমতা
আধিপত্য এইগুলি ভোগ করার জন্য রাজনীতির প্ল্যাটফর্ম। যখন যেখানে বেশি
সুযোগ-সুবিধা পাবার প্রতিশ্রুতি পায় মানুষ তখন সক্রিয় রাজনীতির কর্মীরা তাদের
পূর্ববর্তী মতাদর্শকে পিছনে ফেলে রেখে
ভিন্নতর রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে খুব বেশি দেরি করেননা।অর্থাৎ রাজনীতি কোন
আদর্শ নয় বা কোন দেশ নীতি বা দেশাত্মবোধ থেকে যে রাজনীতির উদ্ভব সেই নীতি এখানে
কার্যকরী থাকে না।
এইরকম একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সামগ্রিকভাবে বর্তমান সময়ে সাধারণ মানুষ দিশাহারা। তারা সত্যি সত্যি তাদের সন্তান সন্ততির জন্য কি আদর্শ তৈরি করবেন, কিভাবে তারা বেঁচে থাকবে, কিভাবে তারা সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন এ পথ দেখানোর কোন দিশারী তাদের কাছে নেই। সেই কারণে দেশাত্মবোধহীন মূল্যবোধহীন মানুষের প্রতি ভালোবাসা হীন যে প্রজন্ম আমরা আমাদের স্বার্থ কায়েমি রাজনীতি দিয়ে সৃষ্টি করে যাচ্ছি,তার চূড়ান্ত অবক্ষয় বা ভয়াবহ পরিণতি আমরা একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে উপনীত হয়ে উপলব্ধি করতে পারছি সকলেই।বিশ্বায়নের এই চরম মুহুর্তে করোনাকালীন যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, এর জন্য মানবসভ্যতা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। বিজ্ঞানের চরম উন্নতির দোরগোড়ায পৌঁছেও একটা অদৃশ্য অনুজীব কিভাবে একটা সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখোমুখি ঠেলে দিতে পারে,তা আজকের প্রজন্ম দেখল। আজকের মানুষ উপলব্ধি করলো শিক্ষিত মূর্খ ধনী-দরিদ্র সমস্ত রকমের গোত্রীয় মানুষের এবং সারা পৃথিবীর মানুষের অসহায়তা।এই উপলব্ধি মানুষকে তার অতীত জীবনের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। এখন এই রাজনৈতিক সামাজিক রাষ্ট্রীক এবং প্রাকৃতিক চরম সংকট কালীন মুহূর্তে উপনীত হয়ে,মানুষ কিভাবে তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সমাজ এবং সভ্যতা কে এবং পৃথিবীর পরিবেশকে বিশুদ্ধ রাখার চেষ্টা করবে,তা আজকের মানুষের কাছে বড় প্রশ্ন। বিশেষ করে সংবেদনশীল মানুষের কাছে শিক্ষিত রুচিশীল সংস্কৃতিবান বলে যারা নিজেদেরকে জাহির করে থাকেন, তাদের কাছে এই প্রশ্ন অত্যন্ত সংগত বলেই আমি মনে করি। প্রত্যেকটা সংবেদনশীল মানুষ আজকে তার বিবেকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার সমস্ত কর্মকান্ডের সঙ্গে কোন না কোনভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করার বীজ রোপিত হয়,একথা আজ তাকে স্বীকার করতেই হবে। কিছু নিলে কিছু দিতেও জানতে হয়, এই শিক্ষা প্রকৃতির প্রতিও সমান ভাবে তাৎপর্য পূর্ণ। প্রকৃতির উপর যেমন মানুষের জীবন সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভরশীল। তেমনি প্রকৃতিও তো পরিবর্তে আমাদের কাছে কিছু চায়।মানুষকেও ফিরিয়ে দিতে হয় কিছু। গ্রহণ এবং দান তা নিয়েই তো একটা জীবনের পূর্ণতা। কিন্তু আজকের মানুষ শুধু গ্রহণ করতে চায়। ছিনিয়ে নিতে চায় নিজের প্রয়োজনে। প্রতিটা মুহূর্ত প্রকৃতিকে নিজের কাজে ব্যবহার করছে সে। প্রকৃতিকে ব্যবহার করার উপায় পদ্ধতি এবং পরিণতি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন হয়েও,আমরা কিন্তু প্রকৃতির (সে সামাজিক প্রকৃতি হোক বা প্রাকৃতিক পরিবেশ যাই হোক না কেন )প্রতি যে আমাদের একটা দায়বদ্ধতা আছে, আমরা সে কথা ভুলে গেছি কবেই।
মনুষের সভ্যতার এই ক্রমবিকাশ সম্ভব হয়েছে যে দুটি প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ কে অবলম্বন করে কয়লা এবং খনিজ তৈল, মানুষ তাকে নির্বিবাদে যথেচ্ছাচার করে ব্যবহার করেছেন নিজেদের গতিময় জীবনকে আরো বেশি বৈচিত্র্যময় গতিবান করে তোলার জন্য। কয়লা খনি থেকে কয়লা তুলে নিয়েছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত। কিন্তুa কয়লা তুলে নেবার পর যে খাদ তৈরি হয় তা বালি দিয়ে ভরাট করতে হবে, এমনটাই নিয়ম। এই নিয়ম সুরক্ষিত না হলে, সেই এলাকা ধ্বংস হয়ে যায়। তেমনি পাহাড় থেকে পাথর কেটে নিয়ে কাজে লাগাচ্ছি প্রতিনিয়ত। দিনের পর দিন ধরে গভীর গিরিখাত এর মধ্যে ডুবে যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়া। নদীতে কলকারখানা র আবর্জনা ফেলে ফেলে, নদীর জল দূষিত হচ্ছে, নদীগর্ভ বুঝে যাচ্ছে,নদীর প্রবাহমানতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, নদীকে যেভাবে পরিচর্যা করা দরকার তা হচ্ছে না।গ্রামেগঞ্জে যত পুকুর ছিল দিনের পর দিন তা বুঝতে বুঝতে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। পুকুরের জল ব্যবহার করার মত পুকুর এখন খুব কমই আছে। কিন্তু পূর্বে এই পুকুর নদী নালার জলই মানুষের ব্যবহারের উৎস ছিল।চাষের কাজে পাতাল থেকে তুলে তুলে এমন একটা পরিস্থিতিতে আমরা উপনীত হয়েছি যে, এখন একটু পানীয় জলের জন্য মানুষের হাহাকার চলছে কোথাও কোথাও। এইভাবে আমরা চরম একটা ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। সেই রকম একটা পরিস্থিতিতেই আরো ধ্বংসাত্মক মূর্তিতে এসে হাজির হলো একটি অদৃশ্য অণুজীব।
করোনাকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা যদি সঠিকভাবে মানবসভ্যতা করতে পারে। যদি সত্যিই আমরা করোনা থেকে মুক্ত হয়ে আবার নতুন করে আগামী দিনের পৃথিবীতে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতে চাই, তাহলে আর এই ভোগবাদী দর্শন দিয়ে সেটা সম্ভব হবে না। মানুষের জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ভোগ সর্বস্ব স্বার্থপর মানুষের বেঁচে,থাকা শুধুমাত্র প্রকৃতি এবং প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান কে নিজের কাজে ব্যবহার করা,তাকে কোনো কিছু ফিরিয়ে না দেওয়ার মানসিকতা,এরকম ভাবে চলতে থাকলে ধ্বংস অনিবার্য। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে সভ্যতার নানান সংকট তৈরি হবে। অর্থনৈতিকভাবে দারুণভাবে পৃথিবীর মুখ থুবড়ে পড়বে। দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য সীমা চরম পরিস্থিতিতে পৌছবে। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দারিদ্র্যের ভয়াবহতা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষা স্বাস্থ্য সমস্ত দিক থেকেই দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। আমাদেরকে কিন্তু নিজেদের স্বভাব বৈশিষ্ট্য পাল্টাতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধ ন্যায়নীতিবোধ সমস্ত কিছু শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্য,মানুষের জন্য এসব সদর্থক পরার্থ পর ভাবনায় অভ্যস্থ হতে হবে। জীবনাচরণে তা সুপ্রয়োগ করতে হবে। তখনই আমাদের ব্যক্তি আমির সীমারেখা অতিক্রম করে ব্যষ্ঠি আমির প্রতি ভালোবাসা জাগবে। মানুষ যদি মানুষের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণতা পরশ্রীকাতরতা এবং চূড়ান্ত স্বার্থপরতার জায়গা থেকে না সরে আসে, তাহলে কিন্তু কোনদিনই আমাদের এই সঙ্কট থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব না। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশ্ব প্রকৃতির প্রতি মানুষের সহমর্মিতার অবদান প্রয়োজন। আকাশ বাতাস, রোদ মাটি, নদী সমুদ্র, গাছ পালা, পশু পাখি সবার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায় যদি না সেই দায়বদ্ধতা তৈরি হয়, তাহলে কিন্তু কিছুতেই এই সমস্যা থেকে মানুষ কোনো দিন বেরিয়ে আসতে পারবে না।
সুতরাং করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে
জাগ্রত করতে হবে তার ঘুমিয়ে থাকা স্বার্থের অন্ধকারের চাদর মুড়ি দেওয়া বিবেককে।
দীর্ঘ অনভ্যাসের ফলে মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় যেভাবে প্রতিটা মুহূর্ত শুধু
চরম স্বার্থপরতার অনুশীলন চলেছে,তার থেকে মুক্ত হতে হলে মানুষের শিক্ষা সংস্কৃতির গতি
প্রকৃতির আমুল পরিবর্তন প্রয়োজন। শিক্ষা বহন করে অনে সংস্কৃতির ঘরানা। কাজেই আগে মনোযোগ দিতে
হবে শিক্ষার বিষয় এবং শিক্ষণ পদ্ধতির উপর। সঠিক শিক্ষা মানুষের চরিত্র
গঠন করে। সু শিক্ষা মানুষকে সু নাগরিক
হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যাবস্থায় যা পরিলক্ষিত হয়
না, বলেই আমি মনে হয়। তাই
অচিরেই মানুষের ব্যক্তি চরিত্রের পরিবর্তন দরকার। এই পরিবর্তন তো মানুষের
একার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য রাষ্ট্রকে তৎপর হতে
হবে। রাষ্ট্র যদি শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে, আগামী দিনের জন্যে
আগামী প্রজন্মকে প্রস্তুত হতে বাধ্যতামূলক কতগুলি সু অভ্যাসের অনুশীলনী পঠন পাঠনের
সিলেবাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না করেন , তাহলে এই সংকট দিনে দিনে আরো
ধ্বংসাত্ক হয়ে উঠবে বলেই আমার ধারণা। এই সু অভ্যাস গুলি কিরকম হতে
পারে বলে আমি মনে করি তা এখানে উল্লেখ করার চেষ্টা করছি।
প্রথমত : আজকের শিক্ষা ব্যবস্থায় শেখার চেয়ে
যে নম্বর পাবার ঘোড়দৌড়, সেই ভূত আগে ছাড়াতে হবে সবার মাথা থেকে। পিতামাতা শিক্ষক এবং
ছাত্রের এই তিন সম্প্রদায়ের মাথা থেকেই এটা আগে মুক্ত করতে হবে।তার জন্যে রাষ্ট্র
কে স্ট্রিক্ট হতে হবে। শিক্ষার
বেসরকারি বাজারকেও আগে বিনষ্ট করতে হবে। না হলে এই সমস্যা কিছুতেই সমাধানের রাস্তা
খুঁজে পাবে না।
দ্বিতীয়ত : পঠন পাঠনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
নৈতিক শিক্ষা,
সামাজিক
মূল্যবোধ,
দেশাত্মোবোধ,মানবিক গুণাবলির
বিকাশের সহায়ক শিক্ষা আর চাই পরস্পরের প্রতি সৌভ্রাতৃত্ব বোধ, এমন শিক্ষায় আগে
প্রতিটি শিশু শিক্ষিত হোক।প্রাথমিক পর্যায়ে একটি শিশুর শুধু অক্ষর জ্ঞান
অর্জন আর এই চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করার
শিক্ষা টুকু গ্রহণ করলেই যথেষ্ঠ।
তৃতীয়ত :
আবশ্যিক ভাবে শরীর শিক্ষার
ক্লাস রাখতেই হবে। বাংলা, ইংরেজি, অংক, ভূগোলের মত শরীর শিক্ষা
জোর দিয়ে পঠন পাঠন, শরীর
চর্চা,
প্র্যাকটিক্যাল
এবং থিওরি এসবের গুরুত্ব যে মানসিক শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য অপরিসীম এটা সব শ্রেণির স্টুডেন্ড দের, বাবা মাদের এবং শিক্ষক
শিক্ষিকাদের উপলব্ধি করতে হবে।
সুতরাং করোনা পরবর্তী কালে সমগ্র পৃথিবীর যে সংকট
উপস্থিত হবে তা মানব সভ্যতার কাছে একটা বড়ো রকমের চ্যালেঞ্জ। পূর্ববতী পর্যায়ের
সভ্যতার সংকট ছিল আর্টিফিসিয়াল।অর্থাৎ কৃত্রিম। সেখানে ধনী দরিদ্রের সংকট আলাদা
মাত্রায় চিহ্নিত হয়েছিল। যুদ্ধ পরবর্তী সভ্যতার সংকট বেশি করে প্রভাব ফেলেছিল, দরিদ্র দেশ ও দরিদ্র
মানুষের উপর বেশি। ধন্তন্ত্ররের রমরমা বাজার তৈরি হল।তারপর দেশ জাতি, প্রেম প্রীতি বিসর্জন
দিয়ে,
অমানবিক
হয়ে ওঠার দুধর্ষ লড়াই। ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কায়েমি
স্বার্থ চরিতার্থ করার লড়াইয়ে গোটা
পৃথিবী সামিল হল। যার অনিবার্য ফলশ্রুতি
বিশ্বায়ন। আর এই বিশ্বায়নের পর করোনার
সংকট। করোনা পরবর্তী বিশ্বের বাজার কোন দিকে অভিমুখী হবে তা সঠিক ভাবে অনুভূত না
হলেও অনুমান করতে অসুবিধে হয় না। যেহেতু এটা প্রাকৃতিক সংকট তাই
অর্থনীতির চরম সংকট বেশি করে প্রভাব ফেলবে শিল্প প্রধান ধনতান্ত্রিক দেশ গুলির উপর।কৃষি নির্ভর দেশের
অর্থনীতি তুলনা। মূলক ভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত
হবে বলেই মনে হয়। সেক্ষেত্রে দরিদ্র গ্রাম্য কৃষক মজুর সম্প্রদায়ের মানুষ সেই ভাবে ক্ষতি গ্রস্থ হবে
না বলেই অনুমান করা যায়।কিন্তু সামগ্রিক
ভাবে বিশ্বের অর্থনীতি, রাষ্ট্রিয় পরিস্থিতি এবং সামাজিক অবস্থান যে আমুল
পরিবর্তিত হবে তা বলাই বাহুল্য। সময় বলে দেবে সেই সংকট মোচনের
সঠিক পথ কী?
বা কোন
পদ্ধতিতে মানুষ এই সংকট থেকে মুক্তি লাভ করবে?
কপিরাইট ড.শ্যামলী রক্ষিত কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন