জাতি ও সমাজ গঠনে
রবীন্দ্রচেতনা
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই দেশে দেশজ শিক্ষা
ব্যবস্থা নির্মাণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কারণ ইংরেজদের প্রচলিত
শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনি কখনও আদর্শ বা সঠিক শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিতে
পারেননি। সেই কারণেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরভূমের এক শান্ত পরিবেশে কেনা জমিতেই
(পরে যার নামকরণ করা হয় শান্তিনিকেতন) ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন এক অনন্য
ধারার দর্শন ও পরীক্ষামূলক শিক্ষাকেন্দ্র
রবীন্দ্রনাথ এই পরীক্ষা মূলক শিক্ষাব্যবস্থাকে কবির স্বপ্ন হিসেবে উল্লেখ
করেন। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কবির স্বপ্ন, যত ছোট আকারেই হোক না কেন, তার ভিতরে নিহিত ছিল
স্বাদেশিকতার মৌলিক ও মুক্ত চিন্তার সমন্বয়। তাঁর ভাবনায়, পড়াশোনা শিশুমনকে
যেন কোনভাবেই ভারাক্রান্ত না করে। তিনি বিশ্বাস করতেন শিশুমনকে গড়ে তুলতে হবে
জানার আনন্দ ও প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃতিকে চেনা, জানার মাধ্যমে।
১৯১৮
সালে, প্রায় দুই দশক পরে, এই ছোট্ট
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে কবি বিশ্বভারতী
বিদ্যালয় নামে সূচিত করেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে। তাঁর অসামান্য
ভাষণে তিনি বলছিলেন: 'বিদ্যালয়ের
মূল কাজ চিন্তা,মনন, বিদ্যার উৎপাদন, গৌণ কাজ সেই বিদ্যা
দান করা। বিদেশি বিদ্যালয়ের নকল করা নয়
। এইরূপ বিদ্যালয়ের নাম বিশ্বভারতী রাখার প্রস্তাব করিয়াছি।' রবীন্দ্রনাথ মনে
করতেন প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আছে এক সহজাত সৃজনশীলতা ও এক অন্তর্নিহিত শক্তি, যা শৈল্পিক
অনুপ্রেরণার কাজ করে । এটি একটি অনুশীলন। আন্তরিক উষ্ণতাকে সজীব করে বেঁচে থাকার
আগ্রহকে নিবিড়তর করে। ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে সৃজনশীল কোন কিছু লক্ষ্য করলে তাকে
নানাভাবে কবি উৎসাহিত করতেন । ছবি আঁকা, লেখা, গান, নৃত্য,অভিনয় এবং সৃষ্টিশীল মাধ্যমগুলিকেও তাঁর কাজকর্মের
সঙ্গে যুক্ত করেন। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন শিল্পকলা ছাড়া কোন শিক্ষাই সম্পূর্ণ নয়। তাই
শিল্পকলা চর্চার জন্য দ্রুতই কলাভবনের প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
এইরকম
প্রগতিশীল,
আধুনিক
বিজ্ঞান মনস্ক একজন মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই বিংশ শতাব্দির দোরগোড়াতেই, শুধু ভাষণে নয়, তিনি হাতেকলমে করে দেখিয়েছেন
সবকিছু। ভাবতে অবাক লাগে, তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, নাট্যকার, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, চিত্রশিল্পী । সারা
জীবন তিনি সংস্কারমুক্ত উন্নত জীবনের
সাধনা করেছেন,
অগনিত
সৃষ্টিতে ভরিয়ে দিয়েছেন সমাজকে। অথচ আবেগতাড়িত বাঙালি শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষা,
গান, কবিতা আর
নৃত্যানুষ্ঠানের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথকে সীমাবদ্ধ রাখতে যেন বদ্ধপরিকর। রবীন্দ্রনাথ
যে উন্নততর মানবজীবনের কথা বলেছেন তার চর্চা নিরন্তর হওয়া জরুরি । সেই সঙ্গে কবির
জীবনদর্শনের বাস্তব প্রয়োগ ঘটানোর প্রচেষ্টাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কবি
তাঁর 'শিক্ষার হেরফের' প্রবন্ধে বলেছেন: 'আমাদের
বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের জাতীয় জীবনের মূল প্রতিষ্ঠা করিতে পারে নাই।' আজ এই কথার সত্যতা
সূর্যালোকের মত স্পষ্ট। যে ভারতবর্ষে সর্বপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল
এবং যে ভারতবর্ষের উদার মানবতার শিক্ষারূপে উদ্ভাসিত হয়েছিল সারা বিশ্ব, আজ তার সম্পূর্ণ
বিপরীত দৃশ্যই আমাদের সামনে উপস্থিত। সে প্রেক্ষাপট ভারতবর্ষ হোক কিংবা বাংলা, চিত্রটা কমবেশি একই
। বিভেদ,
হিংসা, দুর্নীতি, ব্যভিচার, ঔদ্ধত্য সব রকম সীমা
ছাড়িয়েছে সমাজ। এমন একটা সময়ে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষানীতি এবং জীবনদর্শন আমাদের
মুক্তির পথ দেখাতে পারে । আলো দেখাতে পারে। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন প্রকৃত শিক্ষাই
শক্তি লাভের সেরা উপায়। তার দেখানো পথে শিক্ষিত সমাজ গঠনের লড়াই যেমন জারি রাখতে
হবে, তেমনি কুসংস্কার
মুক্ত সম্প্রীতির সমাজ গঠনের প্রক্রিয়াও
চালিয়ে যেতে হবে। রবীন্দ্রনাথ তো সেই কবেই বলেছেন, 'আজকাল শিক্ষার বিষয়
বৈচিত্র্যলাভ করিয়াছে --একমাত্র পুরাণকথার ভিতর দিয়া সকল প্রকার উপদেশ চালানো
যায় না।'
অথচ
পরিতাপের বিষয় অগ্রগতির চাকাকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, গানে, গল্পে, নাটকে সর্বত্রই উচ্চারিত হয়েছে মানবতার বাণী । উঠে
এসেছে এক বিভেদহীন সমাজের কথা । সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথকে সঠিকভাবে বুঝতে গেলে তার
জীবন দর্শনের কথা আন্তরিকভাবে বুঝতে হবে ।
বাংলা
তথা ভারতের ছবি ঐক্যের, সংহতির, সম্প্রীতির । কিন্তু আজ বিশ্বব্যাপী মানবতা আক্রান্ত।
কিছু সংখ্যক মানুষের কৃতকর্মের জন্য মানবতা অপমানিত হয়ে চলেছে। সঙ্কটাপন্ন এই
সময়ে,
সমস্ত
ক্ষুদ্রতাকে,
সংকীর্ণতাকে, ব্যক্তিস্বার্থকে
উপেক্ষা করে এগিয়ে আসতে হবে মানুষকে, বিশ্বের, দেশের, বাংলার হিত সাধনের জন্য ।
সর্বোপরী মানুষের কল্যাণের জন্য। আজ একের পর এক আঘাত সমাজের ঐক্যের, সংহতির, ঐতিহ্যের, মানবতার মূলে আঘাত
হানছে । শিক্ষিত সমাজেও অনৈতিকতার শাখাপ্রশাখা অক্টোপাসের মতো পিষে মারছে সমাজ
বিস্তারের সুন্দর সম্ভাবনাগুলোকে। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ তাই
উৎসবের দেবতায় পর্যবেসিত কিন্তু তাঁর
আদর্শের তেমন বাস্তবায়ন ঘটেনি কোথাও । ফলত: যারা রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, নাটক পরিবেশন করছেন
তারা সবাই উচ্চমানের শিল্পী হবার জন্য প্রাণপাত করছেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় অধিকাংশ
ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন বাস্তবায়িত হতে দেখা যায় না। সভ্যতার অগ্রগতি
আজও সচেতনতার আলোয় আলোকিত করতে পারেনি মানুষকে। মানবতার এই ক্রমাবনতি সভ্যতাকে
সবচেয়ে বড় প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
আজ বাংলা
সহ সারা দেশে সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধি সভ্য সমাজের উপর যেভাবে থাবা বসাতে উদগ্রীব, তা খুবই উদ্বেগের।
রবীন্দ্রনাথের উদার, মানবিক সত্তাকেও হয়তো কোনদিন আক্রমণের সম্মুখীন হতে হবে এইসব
অন্ধ-ভেদবুদ্ধির দ্বারা। সেই প্রবণতা খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশঃ। রবীন্দ্রনাথের
জীবনাদর্শকে আন্তরিকভাবে গ্রহন করে একটি সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য আমাদের
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে । রবীন্দ্রপুজা নয় । তাঁর মত ও আদর্শকে গ্রহন করতে হবে
মনেপ্রাণে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কিছুতেই ভুললে চলবে না যে রবীন্দ্রনাথ বাঙালির সবচেয়ে
বড় পরিচয়।
দ্ব্যর্থহীনভাবে
আমাদের আজ বলতে হবে: 'ব্যক্ত
হোক জীবনের জয়।' নতুন আলোর শিখায় মুছে যাক যাবতীয় গ্লানি।'সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান
সঙ্কটের কল্পনাতে হয়ো না ম্রিয়মান, আর মুক্ত করো ভয়' যে ভয় মানবতার পরিপন্থী, ভালোবাসার
বাধাস্বরূপ । কবির গানের কথা, কবিতার ভাষা কিংবা নাটকের বার্তা যেন আমাদের বোধ্যগম্য
হয় । নান্দনিক উৎকর্ষতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে যেন সমাজ কল্যাণে পরিপূর্ণ করতে
পারে। শুধু অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি নয়, অন্তরের শিক্ষাকে যেন জাগাতে পারি। নিছক উৎসব নয় সমাজ
চেতনা ও মানবতার দীক্ষায় যেন নিজেকে দীক্ষিত করতে পারি।
আগেই
বলেছি শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করার জন্য
দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বভারতীর মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে আজ যারা ছাত্র, ছাত্রী, শিক্ষক, তাদের মধ্যে ভীষণভাবে কমছে সচেতনতা, আচার আচরণে ফুটে
উঠছে বোহেমিয়ান মানসিকতা । ফলে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বমানের এই অনন্য
শিক্ষাকেন্দ্রে অবনতি ঘটছে মানবতার, দৃষ্টিভঙ্গির এবং দূষিত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ ও উৎকর্ষতা
। শুধু বিশ্বভারতী কেন অন্যান্য সমস্ত শিক্ষা অঙ্গনের পরিবেশও একইরকমভাবে দূষণ, সচেতনতার অভাব এবং
শিক্ষার অবনমন চোখে পড়ার মতো। আজ কলেজে কলেজে ছাত্রে ছাত্রে হানাহানি, রক্তক্ষরণ । ছাত্র
শিক্ষক,
শিক্ষক
শিক্ষকের বিরুদ্ধে যে অত্যন্ত ঘৃণ্য, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে
রয়েছে অশিক্ষা,কুশিক্ষার প্রভাব।
প্রথাগত এই শিক্ষায় ডিগ্রি লাভ হয় ঠিকই কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা কিছুই হয় না। যে
শিক্ষা সমাজকে জানতে শেখায় না, মানুষকে সম্মান করতে শেখায় না, বিজ্ঞান মনস্কতা শেখায় না, সৃজনশীল হতে সাহায্য
করে না,
অর্থাৎ
প্রকৃত মানুষ হতে শেখায় না, সে শিক্ষার পরিনতি এই রকম ভয়াবহ হওয়াটাই স্বাভাবিক ।
তার কুফল ভোগ করতে হয় সমাজকে এবং জাতিকে নানা ভাবে ।
আজ
প্রশ্ন উঠছে প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষায় রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শকে
বাস্তবায়িত করবার কোন প্রকৃত উদ্যোগ কি গ্রহণ করা হয়েছে এই দেশে কিংবা বাংলায় ? এই প্রশ্নের উত্তর
কারো জানা নেই। অথবা জেনেও না জানার ভান করে আছেন সেইসব ক্ষমতাবান শিক্ষাবিদরা ।
যারা চাইলেই অনেককিছু করতে পারতেন। বদলে দিতে পারতেন শিক্ষার মানচিত্র। আঁকতে
পারতেন মানবিক মূল্যবোধের এক জরুরি পরিবেশ। কিন্তু তারা সেটা করেননি। তাঁর দায় আজ
সমাজকে বহন করতে হচ্ছে । খেসারত দিতে হচ্ছে নানাভাবে। শিক্ষার পরিপূর্ণ বিকাশ, অখণ্ডতা কিংবা সম্প্রীতির
প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের প্রদর্শিত পথই আমাদের আশ্রয় দিতে পারে । নতুন আলো দেখাতে
পারে। চারুকলা চর্চায় মনের যে ব্যাপ্তি ঘটে সে কথা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই, মনুষ্যত্বের
পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য সঙ্গীত,নাটক নৃত্য, অঙ্কনের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন বিশ্বভারতীতে ।
বাঙালির চেতনার স্তরকে উন্নিত করেছেন তো তিনিই । কিন্তু সেটা মুষ্টিমেয় শিক্ষিত
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সীমায়িত রয়ে গেছে আজও । রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন একজন
মানুষের শিক্ষার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতাও যেন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে
সমাজ কল্যাণের জন্য। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তিনি সারা জীবন অপমানিত, পীড়িত মানুষের পাশে
দাঁড়িয়েছেন সহমর্মিতার বার্তা নিয়ে, কিংবা তীব্র প্রতিবাদে। এই শিক্ষায় শিক্ষিত করতে
চেয়েছিলেন সমগ্র বাঙালি জাতিকে । কিন্তু বাঙালি তাঁকে পুজা বেদিতলে বসিয়ে তাঁর
জীবনদর্শনকে ঢেকে দিতে তৎপর । তিনি যেন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতীকমাত্র । তাঁকে
সামনে রেখে যে বিদ্যাচর্চায় ঢল নেমেছে অলিতে গলিতে, তা ব্যবসার নামান্তর । সেখানে
রবীন্দ্রনাথকে খোঁজা বাতুলতা মাত্র। তাঁর গান, কবিতা ও নাট্যচর্চা নিয়ে একই
কথা বলা চলে। আসলে বর্তমান সমাজজীবন যাপনে কোথাও একটা ফাঁক থেকে গেছে । ভাবের ঘরে
চুরি করতে করতে মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছি আমরা। কী মানবতায়, কী বিশ্বাসে আমরা
দিনকে দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি একে অপরের থেকে। মূল্যবোধ, আদর্শ, নীতি এই শব্দগুলো হারিয়ে ফেলছে
তাদের প্রকৃত ব্যঞ্জনা এবং গ্রহনযোগ্যতা। ফলে কুসংস্কার, অশিক্ষা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে
ধরছে আমাদের, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও।
আমাদের
সমাজের সমস্যা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ওয়াকেবহাল ছিলেন। এইজন্য এই সব সমস্যার উৎসে
গিয়ে সমাধানের প্রচেষ্টা ছিল তাঁর সঙ্গীতে, গল্পে, কবিতায়, নাটকের জীবনযোগের
দার্শনিক ব্যাখ্যায়। সেই জীবনবোধের কথা, জীবন-সাধনার কথা আবার আমাদের ভাবতে হবে, ভাবার অনুশীলন করতে
হবে, রবীন্দ্রনাথের
প্রদর্শিত পথে হেঁটে ।
রবীন্দ্রনাথ
নিজে প্রথাগত শিক্ষার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে, শিক্ষায় যুক্ত করেছিলেন
স্বাস্থ্য সচেতনতা, কৃষিভাবনা, পল্লী উন্নয়ন, সমবায় ইত্যাদি । বহুমুখী সৃজনশীলতার মধ্যেও
প্রতি পদক্ষেপে বিজ্ঞান মনস্কতা, সমাজ ভাবনার এমন নজির বিশ্বের ইতিহাসে সত্যিই বিরল। সমাজে
আত্মবিচ্ছেদ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অশিক্ষা, কুশিক্ষার মেঘে ঢাকা পড়ে গেছে
প্রকৃত শিক্ষার রূপ । রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসায় দিশা
হারাচ্ছে বাংলা । অবিশ্বাস আর সম্পর্কহীনতার অন্ধকারে কেউ কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না।
এ এক দমবন্ধকরা অবস্থা। এই ভয়ংকর পরিবেশ থেকে রেহাই দিতে পারে রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা, গান, নাটকের অন্তর্নিহিত
ভাব হৃদয়ঙ্গম করার মাধ্যমে । তাঁর দর্শনই আমাদের উত্তরণের পথ দেখাতে পারে ।
বৃহত্তর
বাঙালি সমাজ বছরভর পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ,বাইশে শ্রাবণ সহ নানারকম রবীন্দ্র আরাধনায় ব্যস্ত থাকে।
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য থেকে উপলক্ষ্যকেই বড় হয়ে উঠতে দেখা যায় ।
আমাদের সমাজে মনীষীদের দেবতায় আসনে বসিয়ে পুজা করার প্রবণতা খুবই প্রকট । এই রোগ
যতদিন সমাজ থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে ততদিন আমাদের মুক্তি নেই। আমাদের সজাগ থাকতে হবে
যাতে আধুনিক মনের রক্তমাংসের সেরা এই যুগপুরুষকে ভালো করে না বুঝেই, ভুলভাবে তাঁকে
উপস্থাপনা না করি। তাঁর জীবনদর্শনকে ভুল ব্যাখ্যা না করি।
আজ
ভাষাগতভাবে,
অর্থনৈতিকভাবে, সাম্প্রদায়িক
হানাহানি এবং ধর্মীয় উন্মাদনায় বাঙালি জাতি ও সমাজকে কোনঠাসা করবার একটা গভীর
চক্রান্ত চলছে । ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্দ্ধে উঠে ঐক্যবদ্ধভাবে উদাসীন বাঙালি সমাজ এই চক্রান্তকে যুঝতে পারছে
না। ফলত ক্রমশঃ তারা পিছিয়ে পড়ছে। ভুলে যাচ্ছে তার ঐতিহ্য। ভুলে যাচ্ছে এ বাংলা
রবীন্দ্রনাথ,
নজরুল, জগদীশচন্দ্র বসু, নেতাজি, সূর্য সেন, অরবিন্দ আচার্য্য
প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বাংলা । এ বাংলা সংকীর্ণতার অন্ধকূপে আত্মবলিদান দিতে জানে
না। বরং সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়ে । কিছুতেই আত্মসম্মান বিসর্জন দেয় না। ছাত্র, যুবসমাজ আবার জেগে
উঠবে, সমস্ত খুদ্রতা, উদাসীনতা ঝেড়ে
ফেলে। এই আমার বিশ্বাস ।
'দিবে আর নেবে মিলাবে
মিলিবে'
রবীন্দ্রনাথ
এই বাণীকে চলার পথের মন্ত্র করেছিলেন । বারেবারে বলেছেন, বিচ্ছিন্নতা নয়, অখণ্ডতার কথা। তাঁর
কাব্যে,
নাটকে,গল্পে মানব চরিত্রের
নানা দিক প্রস্ফুটিত হয়েছে । তাঁর সেই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে হবে
আমাদের এবং সচেতনভাবে প্রয়োগ করতে হবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। আমাদের চোখে যে
বাংলার ছবি ধরা আছে, তার বাইরেও এক বৃহত্তর বাংলা আছে, সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানেও
শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে হবে, এই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রয়াস । কিন্তু উচ্চবিত্ত কিছু
বাঙালি বিদেশি জীবনের অন্ধ অনুকরণ করে চলেছে। এমন সামাজিক প্রেক্ষাপটে
রবীন্দ্রনাথই আমাদের সামনে আলোকবর্তিকা। সেই আলোয় আমাদের জীবনের দিশা খুঁজে নিতে
হবে। বাংলা ভাষা রবীন্দ্রনাথের দানে পুষ্ট হয়েছে, এটা বলার কোন অপেক্ষাই রাখে না
। আজ তাঁর সঙ্গীত কোটি কোটি বাঙালির চেতনার, অনুভূতির সর্বস্তরকে স্পর্শ
করতে পেরেছে। তাঁর বাণী আমাদের হৃদয়ের না বলা বাণীকে যেন জাগ্রত করে। আমাদের দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, প্রেম,বিরহ, আনন্দ, উল্লাসে সর্বক্ষণের
সঙ্গী তো তিনিই। বাংলা ভাষার প্রথম এবং একমাত্র নোবেল পুরস্কার,সেও তো তাঁরই
কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করে আজও । বাঙালি জাতি হিসেবে এ বড় কম গৌরবের কথা নয় ।
এই
আলোচনা শেষ করবো রবীন্দ্রনাথের কবিতার দুটি পঙক্তির উল্লেখ করে :
'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান
যেথা মুক্ত,
যেথা
গৃহের প্রাচীর'
রবীন্দ্রনাথের
এই শাশ্বত বাণীর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে প্রকৃত শক্তির উৎস। মন যদি ভয়শূন্য না হয়
তাহলে কোন জয়ই সম্ভব নয়। আজকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে ভয়। এই ভয়ই তাকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে অসত্য ।
ভয় থেকেই সৃষ্ট হচ্ছে অবিশ্বাস, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা । ভয়শূন্য মনই শেখায় মাথা উঁচু করে চলতে ।
শেখায় শিরদাঁড়া সোজা রেখে দাঁড়াতে। ইন্ধন জোগায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে ।
রবীন্দ্রনাথের প্রদর্শিত পথে চলেই আমাদের সমাজ থেকে আমরা যমুছে দিতে পারি
সব ধরনের হানাহানি, অবিশ্বাস, বিদ্বেষ, মিথ্যার ছলাকলা। বাঙালির জীবন ও সমাজে রবীন্দ্রনাথের
প্রভাব,
এতো
বিচ্যুতির পরও সবচেয়ে বেশি। একথা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় । মন থেকে ভয় মুছে
ফেলতে পারলেই ছাত্র, যুব সমাজও আবার ফিরে পাবে তাদের হারানো ঐতিহ্য । আবার জিতে নিতে
পারবে সারা বিশ্ব, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ যুব সমাজই হচ্ছে যে কোন জাতির আশা ভরসার
মূল ভরকেন্দ্রস্থল । মানবতাবাদী, সৃজনশীল, বিজ্ঞান ও সমাজ সচেতন রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে যদি
নতুনভাবে মনের অন্তঃস্থলে প্রতিস্থাপন
করতে পারে এই সময়ের বাঙালি ও বাংলার সমাজ, তাহলেই ফুলে ফলে ভরে উঠবে
বাংলার বাগান । কলেজে কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ফিরে আসবে
সম্প্রীতির,
বন্ধুত্বের, ভ্রাতৃত্বের, ভালোবাসার,সহাবস্থানের এক
স্বপ্নের পরিবেশ। ফিরে আসবে ছাত্র - ছাত্র, ছাত্র - শিক্ষক, শিক্ষক - শিক্ষকের
পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস ও আত্মত্যাগের প্রত্যাশিত পূর্ণভূমি । তাহলেই নতুন ভারত তথা
নতুন বাংলা গড়ার যে স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন তা সার্থকতার পথে এক উজ্জ্বল
পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হবে । একথা দ্বিধাহীনভাবেই বলা যায় ।
কপিরাইট সুধাংশুরঞ্জন সাহা কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন