“মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,
আমি তোমাদেরই
লোক...”
বিশ্বকবির
জান্মের প্রায় ১৫৯ বছরের পরেও সামগ্রিক জীবন বোধে বাঙালী জীবনের সাথে আত্মিক
সম্পর্কে,
চিরকালীন
আত্মিক বন্ধনে এখনো প্রাসঙ্গিক থাকবেনও পরবর্তি কালের সাথে সমান ভাবে স্মরনীয় হয়ে থাকবেন। মানবিক জীবনে যাই
ঘটুক সে জীবন থেকে মৃত্যু, আনন্দ, শোক, বিরহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো ভাবে তাঁর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস, হাস্যকৌতুক সহ যা
কিছু যে ভাবেই লিখতে যাই না কেন তা রবীন্দ্র নাথের অজস্র লেখার মধ্যে সম্পৃক্ত হয়ে
যায়। তাই কোন নিবদ্ধ প্রবন্ধ আলোচনা সে তো সেই পুরনো কথা
গঙ্গা জলে গঙ্গা পূজো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ২৫ শে বৈশাখ ১২৬৮, ৭ ই মে ১৮৬১ আর তাঁর
চলে যাওয়া ২২ শে শ্রাবণ ১৩৪৮, ১৯৪১ সালের ৬ ই আগস্ট, বর্ষামুখর একটি প্রকৃতির অঝোর
কান্নার দিনে।
“কড়ি ও কোমল”
কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘প্রান’, সেখানে তিনিই বলেছেন –
“মরিতে চাহি না আমি
এই সুন্দর ভূবনে
মানবের
মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই,
এই
সূর্য করে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত
হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।”
তার জীবন
ও কর্ম দেশে কিংবা বিদেশে মানবিক হার্দিক অনুরণণ শোনার একটি দার্শনিক শাক্তি চিরকালই
ক্রিয়াশীল ছিল বলেই তিনিই পারেন লিখতে –
“মৃত্যু দিয়ে যে
প্রাণের
মূল্য
দিতে হয়
সে
প্রাণ অমৃত লোক
মৃত্যুকে
করে জয়।
তাঁর
জীবন দর্শণে বহুতর পারিবারিক আত্মজনের মৃত্যু দেখেছেন, তাই জীবন থেকে শুরু করে মৃত্যুর
দিন পর্যন্ত তাঁর লেখনির দর্শণ তত্ত্ব বারে বারে মানব জীবনও সমকালীন সমাজের পরতে
পরতে জড়িয়ে আছে তাঁর সাহিত্য সমৃদ্ধি, তাঁর চিরকালীন অন্বিষ্ট উপলব্ধির কথকতা, যিনি যেভাবেই
কবিগুরুকে বিশ্লেষণ করুন না কেন - কবির অনুধ্যানে তিনি আবর্তিত হয়েছেন মুক্তগদ্যের
বাতাবরনে কবি লেখনীর মায়াজালে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন। অসীম সীমায় তাঁর
শারীরিক দর্শণ মেলেনা কিন্তু তাঁর সাহিত্যের দুত্যিতে মানব সমাজ আলোকিত হয়েছে তাঁর
মোহন রূপের দ্যুতিতে। সীমার মাঝে অসীমের চিরকালীন বার্তাবহ কবি সকলের
কাছে আত্মজন হলেও তাঁর অসীম সাহিত্য সীমার গণ্ডী ছুঁয়েছেন সকলেই একথা সকল মানুষের
কাছে প্রত্যাশা করার সাহসও সাধ্য কোনটাই প্রত্যাশা করা কঠিন, কিন্তু সকলেই সে হোক
দেশে কিংবা বিদেশে তিনি মৌণ ও গম্ভীর সদাই তিনি অসীম স্রষ্টার অভিজ্ঞানে বিরাজমান। পারিবারিক ঘেরা
টোপে থেকে তার মন সবসময় মুক্ত মনা বিহঙ্গ হতে চেয়েছে। তাই তিনি তাঁর চেতন
মার্গে ঘরের ভেতরে থেকেই লেখেন –
খাঁচার পাখি ছিল সোনার
খাঁচাটিতে
বনের
পাখি ছিল বনে।
একদা
কি করিয়া মিলন হয় দোঁহে
কি
ছিল বিধাতার মনে।
এখানেও
সেই মানুষের মনোজগতের সাথে তাঁর মিলনের অন্তরআর্তি বিরাজমান। ‘প্রজাপতি
নির্বব্ধ’ নাটকের তাঁর ইচ্ছাটি কিন্তু মূর্ত হয়ে ওঠে, এ বিরাট ধরিত্রী আর কী বিশাল
সমুদ্র উত্তাল,
এই
দুয়ের মহান ব্যাপ্তি থেকে কবি তাঁর মনের আগল খুলে বেরিয়েছেন।
কেন
সারাদিন ধীরে ধীরে
বালু
নিয়ে শুধু খেল তীরে।
চলে
গেল বেলা,
রেখে
মিছে খেলা
ঝাঁপ
দিয়ে পড়ো কালো নীরে।
এতো
চিরকালীন সমুদ্রকুলের বালির ঘর যা ধুয়ে যাবে সমুদ্রের ঢেউয়ে, যা কিনা আত্মবিনিময়ে
সাবলীল মুক্ত মনা মানুষের কাছ এক অমূল্য দিক দর্শণ। বিশাল
প্রতিবন্ধকতায় সামনে দাঁড়িয়েও মানুষের
মনোজগতে তাঁরই কবি কথন চিরায়ত সত্যি টুকুর সামনে সকলকেই একই সূত্রে বেঁধে ফেলেন। বিশাল প্রকৃতির
কাছে যে মানুষের আশা প্রত্যাশা সমুদ্র তীরের বালুকা রাশির অন্য বিবর্তনে ক্রিয়া
বিক্রিয়ার কথাই চলে আসে সমকালীন সময়েও, তাঁর ১৪ ই চৈত্র ১৩০২ সালে লেখা “দেবতার বিদায়”
কবিতাটিও সকল মানবাত্মার কাছে ‘প্রনিধান যোগ্য’।
“দেবতা মন্দির মাঝে
ভকত প্রবীণ
জপিতেছে
জপমালা বসি নিশিদিন
হেনকালে
সন্ধ্যাবেলা ধূলিমাখা দেহে
বস্ত্রহীন
জীর্ণ দীন পশিল সে গেহে।”
কিন্তু
তার ঠাঁই তো হোল না বরং উল্টে তাকে তাড়াতে গিয়ে বললো ব্রাহ্মণ – “আরে আরে অপবিত্র
দূর হয়ে যা রে।” পরে সে দরিদ্রটি দেবতার রূপ পরিগ্রহ করে, দেবতা বল্লেন
“গৃহহীনে গৃহ দিলে আমি থাকি ঘরে।” এই সময়ের গৃহহীন মানুষের
আর্তি তো সেই একই রকমের। আবার একটু থেমে যদি চোখ ফেরাই তাহলে দেখবো চির
শাশ্বত লুন্ঠন বৃত্তির উদ্দেশ্যে কবির দিগদর্শন –
“শুধু বিঘে দুই ছিল
মোর ভুঁই,
আর সব
গেছে ঋনে
বাবু
বলিলেন ‘বুঝেছো উপেন এ জমি লইব কিনে’।”
পরিশেষে
উপেনের মুখে উচ্চারিত হয় –
“রাজার হস্ত করে
সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।”
অবশেষে
চোখের জলে ভাসতে ভাসতে উপেনের শেষ কথা “তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।” কবির নিভৃতে হয়তো
কোন দ্বান্দ্বিক অনুভুতি ক্রিয়াশীল ছিল যা এ অধমের বোধগম্য নয়। সে কারণে শুধু “আশিস গ্রহণ” কবিতার দু’টি লাইন
আগলে ধরি বুকে –
“চলিয়াছি রণক্ষেত্রে
সংগ্রামের পথে –
সংসার
বিপ্লব ধ্বনি আসে দূর হতে।”
এখানে ব্যক্তি
কবির বিশাল ব্যাপ্তি অন্য কোন নিগূঢ় দর্শনে আমাদেরকে আবর্তিত করেন। প্রকৃতি প্রেমিক
মানব সত্ত্বার অন্তর্নিহিত সমূহ সত্যি তাঁর সকল সাহিত্য কর্মের সাথে আত্মিক ভাবে
নিজেকে মিলিয়ে মিশিয়ে নেয়। নবর্বষ মানেই তো ‘বৈশাখ’-আর
তাঁর কবিতায় বৈশাখের রুদ্র রূপ প্রতিভাত হয়ে ওঠে –
হে
ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ।
ধূলায়
ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল
কারে
দাও ডাক
হে
ভৈরব হে রুদ্র বৈশাখ।
মূলত
গ্রাম ভারতে অকাল বৈশাখী ঝড়ে মানুষের জীবন বারে বারে অবিন্যস্ত হয়ে যায়। সেখানেও তাঁর
বিনম্র উচ্চারন শান্তির স্বপক্ষে “হে বৈরাগী, করো শান্তি পাঠ।”
সমকালীন
বহুভাবনার অধিষ্ঠিত কবি চিরকালই মানবাত্মার যা কিছু ছিল অবগুন্ঠনে তিনি সেই ভাবনায়
তাড়িত হয়েছেন,
তাঁর
কাব্য বিভার আলোয় তা বিচ্ছুরিত, অনন্য একটি ভাবের উৎসারন –
“সর্বদাই হু হু করে
মন
বিশ্ব
যেন মরুর মতন।
চার
দিকে ঝালা পালা।
উঃ
কি জ্বলন্ত জ্বালা,
অগ্নিকুণ্ডে
পতঙ্গ পতন ”
এই
চিরসত্যটুকু অসীম যন্ত্রণার দিকে কবির অবলোকন, মনোজগতের সুক্ষ্ম অনুভূতির
প্রকৃতির দ্বান্দ্বিক রূপটি দেশকাল সমাজের বিভিন্নতা এবং তাঁকে সমাকীর্ন করেন তার
লেখনীর বানী বন্ধনে। তিনি চিরকাল একান্তে দেশে বিদেশে ভ্রমণকারী
কিন্তু দেশকাল সমাজ জীবন সরনীর পথ বেয়ে তাঁর সৃষ্টি ছুঁয়ে যায় পৃথিবীর সব কোণ। তবুও কবি নিজেকে
কখনোই কোন কিছুর ঊর্দ্ধে এটা বলেন নি – তাঁর সে চেষ্টা ছিল না। বরং বিনম্রচিত্তে
উচ্চারিত কবিতায় গানে –
“এই করেছো ভালো, নিঠুর হে –
এই
করেছে ভালো
এমনি
করে হৃদয়ে মোর
তীব্র
দহন জ্বালো।
আমার
এ ধূপ না পোড়ালে
গন্ধ
কিছুই নাহি ঢালে,
আমার
এ দীপ না জ্বালালে
দেয়
না কিছুই আলো।”
তাঁর
আত্মোপলব্ধির চেতনে অন্তর্মুখিন ভাবনাকে আরও একবার নিজেকে নিজের জ্বলনে তাঁর
প্রেমময়তার লৌকিক সুন্দরের কাছে তাঁর আত্ম নিবেদন। সমসাময়িক সময়ের যে
রাজ শক্তির হুংকার ধ্বনি আমরা প্রতি নিয়ত শুনছি, জানিনা তাঁরা এতটা স্বার্থান্ধ
সেখানে রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসার কথা অকৃপণে ভাসিয়ে দিলেও কর্ত্তব্যের বীভৎসতা
আমাদেরকে বিমোহিত করে। জীবনও সমাজের প্রতিক্ষণে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু
সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁর আত্মমগ্ন অনিশ্চিত স্বরূপে। তিনি বিলোকনে বলেন-
“চারিদিকে বিরাট গাথা
বাজে হাজার সুরে –
সেথায়
সে যে পায় না অধিকার,
রাজার
মতো বেশে সাজাও যে শিশুরে
পরাও
যারে মনিরতন হার।”
তাই
‘অরূপ রতন’ নাটকে তাঁর মানবাত্মার বিশ্ব পথিক বৃত্তে ঘুরে বেড়ানো একজন বিনম্র
পরিব্রাজক,
তাঁর
স্বদেশ ভাবনা,
শান্তি
নিকেতন গড়ে ওঠা,
সমকালীন
রাজনৈতিক ব্যক্তি বর্গের বহু আলাপ চারিতায় তার নিবিড় মানব প্রেম, দেশ প্রেম বারে বারে
উঠে এসেছে তার গল্প কবিতা নাটকে। এপার বাংলা ওপার বাংলা কে
বেঁধেছেন একই অন্তর ডোরে। কখনো ভাবেননি দুই বাংলা বিচ্ছেদ যন্ত্রণা তার না
থাকার সময়ে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। ‘অরূপ রতন’ নাটকে বোধয় তার
গানে তাঁরই আত্ম বিমোচন –
“বাহিরে ভুল হানবে
যখন
অন্তরে
ভুল ভাঙবে কি ?
বিষাদ-বিষে
জ্বলে শেষে
তোমায়
প্রসাদ মাঙবে কি ?”
একদম
নাটকের শেষে এসে মানব মনের অত্মকথার মতো গীতি ভাষ্য –
“অরূপ বীণা রূপের
আড়ালে লুকিয়ে বাজে,
সে
বীণা আজি উঠিল বাজি হৃদয় মাঝে।”
যাঁরা
এখানে ধর্মের বেড়াজালে মানুষে মানুষে বিভেদের অদৃশ্য সীমা রেখা তৈরি করেছেন তাঁদের
জানা উচিত যখন পাঞ্জাবের জালিয়ান-ওয়ালাবাগের শাসক ইংরেজের নিষ্ঠুর বর্বরতা প্রত্যক্ষ
করেও গান্ধীজী-সহ সমস্ত ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা শাস্তির ভয়ে বোবা হয়ে নির্বাক ভুমিকা
পালন করছিলেন,
তখন
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ প্রচণ্ড ঘৃণায় ইংল্যান্ডের তথা ভারতের সম্রাট পঞ্চম জর্জের
দেওয়া ‘স্যার’ উপাধি পরিত্যাগ করলেন। এমনই দৃঢ় চেতা কবিই পারেন
মানুষের ধর্মা ধর্মের ভেদ রেখার বিরুদ্ধে “ধর্মমোহ” কবিতা লিখতে, সেখানে উচ্চিরিত
হয়েছে –
“ধর্মের বেশে মোহ
যারে এসে ধরে –
অন্ধ
যে জন মারে আর শুধু মরে।
... ...
... ... ...
... ...
যে
পূজার বেদী রক্তে গিয়েছে ভেসে
ভাঙ্গো
ভাঙ্গো,
আজি
ভাঙ্গো তারে নিঃশেষে –
ধর্মকারার
প্রাচীরে বজ্র হানো –
এ
অভাগা দেশের জ্ঞানের আলোক আনো।”
এটা
বাস্তব বিশ্বভারতীর জন্য আর্থিক সংগ্রহের প্রয়োজনে প্রায় বিশ্বভ্রমণ করে বেড়িয়েছে
চিন, জাপান, দক্ষিণ আমেরিকা, পেরু সহ কয়েকটি দেশে। আর্জেন্টিনায়
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, এক বিদগ্ধা নারীর বাড়ীতে ছিলেন অসুস্থতার কারণে। তিনি ভেবেছিলেন বসে
থাকা মানে মরে যাওয়া, তাঁর জীবনের মন্ত্রই ছিল চরৈবেতি। জানিনা বিশ্বকবি
বোধহয় সে কারণে ‘শেষরক্ষা’ নাটকে আবিশ্ব ভ্রমণের পরেও তাঁর উচ্চারন –
“জয় করে তবু ভয় কেন
তোর যায় না,
হায়
ভীরু প্রেম হায়রে !
আশায়
আলো তবুও ভরসা পায় না
মুখে
হাসি তবু চোখে জল না শুকায় রে !”
সে সময়
কালে দেশে বিদেশে একটা অসাম্য বাতাবরন, বিশ্বকবি তাঁর লেখার গণ্ডি ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশে
বিদেশে,
তিনি
যেন বলেছেন “দেশে দেশে মোর ঘর আছে আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া”। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের
সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ বিশ্বকবিকে প্রাণীত করতে পারে নি। তাই তিনি চেয়েছিলেন
গ্রামোন্নয়নের মাধ্যমে প্রত্যেককে সক্রিয় করে তোলা। নানা কারণে তৎকালীন
রাজনৈতিক পরিকাঠামো থেকে নিজেকে অবসৃত করেন। ‘প্রান্তিক’ দীর্ঘ কবিতায় ১৮
তম স্তবকে লিখলেন –
নাগিনীরা
চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস
শান্তির
ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস –
বিদায়
নেবার আগেই তাই
ডাক
দিয়ে যাই
দানবের
সাথে যারা সংগ্রাম করে
প্রস্তুত
হতেছে ঘরে ঘরে।
১৯১২-১৩
বিংশ শতাব্দীতে বিদেশ ভ্রমণে ইংল্যান্ড ও আমেরিকাতে গিয়ে কিছু প্রগতিশীল মানুষের
সাথে, কবি ও চিন্তাবিদ
মানুষের সাথে এবং ঐ দেশে উন্নয়নের সাথে দেশে ফিরে এসে সংকীর্ণ জীবন যাত্রার মধ্যে
তার কোন প্রতিফলন দেখতে পাননি। একদিকে উপনিবেশবাদের বীভৎসতা
অন্যদিক ইউরোপীয় সভ্যতার অনেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। নোবেল পুরস্কার
দেওয়ার ঔদার্য ইউরোপীয় সভ্যতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে তাঁর মনে হয়েছে। সময় এগিয়েছে কখনো
ভালো আবার কখনো দৃষ্টিকটু বহু ঘটনা প্রবাহ তাঁকে বিমোহিত করেছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণের
অপ্রাকৃত বিন্যাস তাঁকে বিচলিত করেছে। তারই অনেক বিষয় উঠে এসেছে তাঁর
‘চণ্ডালিকা’ নাটকে।
চক্ষে আমার তৃষ্ণা, ওগো
তৃষ্ণা আমার বক্ষ
জুড়ে।
আমি বৃষ্টি বিহীন
বৈশাখী দিন
সন্তাপে প্রাণ যায়
যে পুড়ে।
সদা
স্পষ্টবাদী বিশ্বকবি তার সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা নিবন্ধে তাঁর আত্মকথন হয়তো অভিমান বা
বিষাদ ক্লিষ্ট – “আমরা
যে ইতিহাসের দ্বারাই একান্ত চালিত, একথা বার বার শুনেছি এবং বার বার ভিতরে খুব জোরের সঙ্গে
মাথা নেড়েছি। এ তর্কের মীমাংসা আমার নিজের অন্তেরই আছে, সেখানে আমি আর –
কিছু নই,
কেবলমাত্র
কবি।” কবি হয়তো উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর কবিত্ব শক্তির
স্বকীয়তায় তাঁর অন্তরের কথাগুলো কবিতা গল্প উপন্যাসে বহুভাবে উচ্চারিত হয়েছে। সম্ভবত “ভগ্ন হৃদয়”
কাব্য নাট্যের প্রস্তাবনায় “উপহার” লেখনীতে উল্লেখ করেছেন –
“স্নেহের অরুনালোকে
খুলিয়া হৃদয় প্রাণ
এপারে
দাঁড়ায়ে দেখি,
গাহিনু
যে শেষ গান
তোমারই
মনের ছায় সে গান আশ্রয় চায় –
একটু
নয়ন জল তাহারে করিও দান।
চিরকালীন
মানবাত্মার স্পর্শাতুর কবি প্রতিছত্রে তার বিমোহিত সমূহ রচনা পর্বে এসে যেন বলেছেন
–
আজিকে
বিদায় তবে,
আবার
কি দেখা হবে –
পাইয়া
স্নেহের আলো হৃদয় গাহিবে গান ?
স্বভাবতই
কবি প্রাণ উদ্বেলিত হয় গানের সুর মূর্চ্ছনায়, আবার অন্যদিকে বিবিধ প্রসঙ্গে
এসে বলেছেন “ভালোবাসার অর্থ আত্ম সমর্পন নহে, ভালোবাসা অর্থে নিজের যাহা কিছু
ভালো তাহাই সমর্পণ করা। হৃদয়ের প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা নহে; হৃদয়ের যেখানে
দেবত্রভূমি,
যেখানে
মন্দির,
সেখানে
প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করা।” এমন আত্মঅবলোকন কেবলমাত্র কবিগুরুর পক্ষেই
সম্ভব। এই স্বচ্ছ জীবন চর্যা প্রতিটি মানব মনকে বিমোহিত করে
তোলে। কবিগুরুর চিন্তা জগতে বহুতর ভাবনা নিরন্তর জাগ্রত হতো, আলোড়িত করেছে তাঁর
লেখনীকে। বাইরে থেকে যখন দেশে ফিরেছেন – তিনি বিদেশের সাহিত্য
সংস্কৃতির চর্চাকে বহুবার এদেশের চর্চার সঙ্গে মেলাবার চেষ্টা করেছেন। কখনও নিজের ভেতরের
অনুভূতি আর বাইরের মনো জগতের তাঁর অবস্থান কেমন ও কীভাবে বিরাজমান তা মেলাবার
চেষ্টা করেছেন। তাঁর লেখনীতে কখনো সখনো বিষ্ময়, কখনো জিজ্ঞাসায় আবার আতান্তরে
তার বহিঃপ্রকাশ আমাদের চমকিত করে এ-কারণে তাঁর সমূহ সাহিত্য চিরকালীন সত্য। সমকালীন শিক্ষা
ব্যবস্থায় কবিগুরুর লেখা যেভাবে সমাদৃত হয়ে আসছিল, এখন যেন বিষয়টি কেতাবি ঘরানায়
পর্যবসিত হচ্ছে। “একজন অমৃত পুত্রকে আমরা তখনই আবার সহজভাবে তাঁর
মূর্ত্যরূপে ভাবতে পারি, যখন সময়ের ব্যবধানে অনেক অবান্তর সমস্ত তথ্য প্রকাশিত
হবার ও বাধা থাকে না। রবীন্দ্রনাথকে তাই অপেক্ষা করতে হবে হয়তো
দীর্ঘকাল – অন্তত যতদিন না রবীন্দ্র জীবনী পরিবর্ধিত হবার পরেও নতুনতর তথ্য নিয়ে
অনূরূপ গ্রন্থ আরও বেরোয়” – চল্লিশ বছর আগে সেই যে লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু সেই
প্রবাহমানতা এখনো আন্তরিকতার সাথে আবহমান।
এখনো যেন সেই বার্তা বয়ে যায় – “ওই মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ
লাগে মর্ত্য ধূলির ঘাসে ঘাসে।” এখনো
প্রতি বৈশাখে “চির নতুনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ।” রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন
করা হচ্ছে বহুকাল ধরে। রবীন্দ্রনাথ যখন জীবিত তখন থেকে শান্তিনিকেতনে
তাঁর জন্মদিন উদ্যাপন করা হতো। ধীরে ধীরে অবিভক্ত বাংলায় পরে বাংলাদেশে কবির
জন্মদিন পালিত হয়ে আসছে। ১৯৬১ সালে আসে রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষ, এপার বাংলায়, আবার ওপার বাংলায়
শাসক শ্রেণির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই জন্মশতবর্ষ পালিত হয় এবং এখনো হয়ে আসছে যেন
একদিন পঁচিশে বৈশাখের বিনম্র আবেদন তেমনই ২২শে শ্রাবণের আন্তরিক শ্রদ্ধায় অন্তরে
অশ্রু বিমোচন। কবিগুরুর লেখা “পরিচয়” কবিতার নিজস্ব সহজ প্রত্যাশা
রেখে গেছেন যা আজো আমাদেরকে একাত্ম করে –
“সেতারেতে বাঁধিলাম
তার
গাহিলাম
আর বার –
মোর
নাম এই বলে খ্যাত হোক,
আমি
তোমাদেরই লোক –
আর
কিছু নয় –
এই
হোক শেষ পরিচয়।”
কপিরাইট বিকাশ চন্দ কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন