সম্পাদকের কলমে
পঁচিশে বৈশাখ আর আমরা
বাঙালি, অনেকেই মনে করেন এক অবিচ্ছেদ্দ সম্পর্ক। শরৎ আসলেই যেমন শিউলি ফুটবে তেমনই
বৈশাখ মানেই যেন রবীন্দ্রনাথ। অনায়াসলব্ধ এক উত্তরাধিকার। আমরা নিশ্চিত যতদূর বাঙালি
ততদূর রবিঠাকুর। যতদিন জীবন ততদিন রবীন্দ্রনাথ। এমনটা ভাবতেই অভ্যস্ত আমরা অনেকেই।
বিশেষত বাঙালির সাংস্কৃতির কর্মকাণ্ডের পরতে পরতে রবীন্দ্রনাথ। সেই রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে
অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতেও আমাদের ভরসা রবীন্দ্রনাথই। তাঁকে অস্বীকার করে তাঁকে
অতিক্রম করা সম্ভব নয়। আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর এমনই অমোঘ প্রভাব। আর এই
প্রভাব নিয়ে আমরাও নিশ্চিত আমরা আজও কবিকে নিয়েই রয়েছি। আমাদের সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের
ভিতরেই আমাদের এই নিশ্চয়তার ছাপ রয়ে যায়। ফলে বৈশাখ আসলেই আমরা আরও বেশি করে উজ্জীবিত
হয়ে উঠি রবীন্দ্রচর্চায়। দিকে দিকে পত্রপত্রিকায় বিশেষ রবীন্দ্রসংখ্যা প্রকাশের ধুম।
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রজয়ন্তীর উদযাপন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে
সেমিনার ইত্যাদি ইত্যাদি।
দিনের শেষে আমাদের পরিতৃপ্তির
বিশ্রাম। রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারকে বহন করার গর্বে। না, আমরা কেউই প্রদীপের নীচের
বিস্তৃত অন্ধকারের দিকে লক্ষ্য করি না। দেখার চেষ্টা করি না, আমাদের রবীন্দ্রচর্চার
প্রদীপ কতটুকু আলো দিতে পারছে। দেখার চেষ্টা করি না, সেই আলোর দিগন্ত কতটা প্রাসারিত
হচ্ছে দিনে দিনে। বোঝার চেষ্টা করি না, চারদিকের পরিব্যাপ্ত অন্ধকার থেকে সময়কে মুক্ত
করার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথকে আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারছি। আদৌ লাগাতে পারছি তো? আমাদের
যাবতীয় রবীন্দ্রচর্চার হয়তো একটিই মাত্র অভিমুখ। আমরা কে কতটা বেশি কবির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।
আমাদের রবীন্দ্রচর্চার মূল ভরকেন্দ্র যেন সেখানেই।
রবীন্দ্রনাথ মানেই যেন
সঙ্গীত আবৃত্তি চারুকলা সাহিত্য সিনেমা নৃত্যনাট্য নাটক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা
পত্র! আয়োজিত সভায় রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সৃষ্টির উপর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা কিংবা ভাষণ।
মূলত পঁচিশে বৈশাখ ও বাইশে শ্রাবণে। এর বাইরে রবীন্দ্রনাথ! না স্কুল পাঠ্য সিলেবাসের
রবীন্দ্রনাথ নয়। আমাদের নিত্যদিনের জীবনের বেঁচে থাকার আনন্দ ও সংগ্রামে। আমাদের সমৃদ্ধির
সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতায়। আমাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে। আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত
জীবন দর্শন এবং নিভৃত আকাঙ্খায়। আছেন কি আমাদের ভালোবাসার রবীন্দ্রনাথ? অর্থনৈতিক শ্রেণী
বিভক্ত বাঙালির সমাজ বাস্তবতায় কতদূর প্রসারিত জাগ্রত রবীন্দ্রনাথ? আমি জানি না, আমরা
বাঙালিরা আদৌ পরিচিত কিনা এই প্রশ্নের সাথে।
বছর বছর পঁচিশে বৈশাখ
আর বাইশে শ্রাবণ আসে যায়। আমাদের রবীন্দ্রচর্চার পরিসর যেন একই অবস্থানে নোঙর করে থাকে।
অন্তত বিভিন্ন পত্রপত্রিকার রবীন্দ্রসংখ্যার পাতা উল্টালে তেমটিই দেখা যায়। রবীন্দ্রজয়ন্তীর
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলিও হয়তো তার ব্যতিক্রম নয়। এর বাইরে পড়ে থাকা বাংলার বৃহত্তর
সমাজ ও জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব নিয়ে আমরা আদৌ কি চিন্তিত? আদৌ কি জানি কেমন সেই
প্রভাব? আদৌ কি খুঁজে দেখার ও জেনে বোঝার চেষ্টা করেছি এই বিষয়ে?
আমি জানি না। আমার সত্যিই
জানা নাই, আমরা কতজন এইসব প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি? বা আদৌ কোনদিন দাঁড়িয়েছি কিনা।
না দাঁড়ালে আদৌ কি কোনদিন দাঁড়াবো? অনেকেই ভাবতে পারেন হঠাৎ করে এতসব ভাবতেই বা যাবো
কেন? রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রাণের ঠাকুর। প্রাণেই আছেন। থাকবেন। আমার আপনার ব্যক্তিগত
অনুভবেই তো তাঁর মাধুর্য্য। একান্ত সার্থকতা। তাঁকে সেখান থেকে উপরিয়ে ফেলে হাটের মাঝে
আনার দরকারই বা কি? দুঃখের বিষয় হলেও এটাই বাংলার বাস্তবতা। আমরা ধরেই নিয়েছি রবীন্দ্রনাথ
অনেকটাই ঈশ্বরপ্রেমের মতো একান্ত ব্যক্তিগত অনুভবের দিগন্ত। আমার একান্তে আমার রবীন্দ্রনাথকে
আমি কিভাবে উদযাপন করবো সেটি একান্তই আমার ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়। তার সাথে বৃহত্তর
সমাজে রবীন্দ্রনাথ আছেন না নাই, সে জেনে আমার কি লাভ? সমাজের সকল মানুষকেই রবীন্দ্রনাথকে
নিয়ে নাচানাচি করতেই বা হবে কেন? সকলেই কি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ও সাধনাকে উপলব্ধি
করতে পারবে না কি? তাহলে তো সকলেই শিক্ষিত হয়ে যেত। একটা সমাজ বিভিন্ন ধরণের মানুষকে
নিয়েই গড়ে ওঠে। আমাদের রবীন্দ্রনাথ আমাদের। কিন্তু তাই বলে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের
কাছেই রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণযোগ্য হতে হবে, এমনটা ভাবা ঠিক নয়। তাই বৃহত্তর সমাজে রবীন্দ্রনাথ
থাকলেন কি থাকলেন না সেটা কোন বড়ো বিষয় নয়।
অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালিই
হয়তো এভাবেই ভেবে থাকেন। অন্তত শিক্ষিত শ্রেণীর সম্বচ্ছর রবীন্দ্রচর্চায় সেই ছবিই ফুটে
ওঠে। তাই রামা কৈবর্ত আর রহিম শেখদের নিত্যদিনের জীবনযাপনে রবীন্দ্রনাথের কোন প্রাসঙ্গিকতা
আছে না নাই। থাকার দরকার আছে কিনা আদৌ, সেসব বিষয়ে আমাদের আগ্রহ নাই। আমাদের যাবতীয়
আগ্রহ রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে একধরণের সাংস্কৃতিক বিনোদনের পরিমণ্ডল। আমরা তার ভিতরেই
সচ্ছন্দ। কিন্তু এই সংখ্যালঘু শ্রেণী নিয়েই তো আর গোটা সমাজ নয়। সামগ্রিক ভাবে সমাজের
সার্বিক অবস্থানের পরিমণ্ডলে এই সময়ের বাংলা ও বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব
বিষয়ে আলোচনার কি কোন দরকার নাই? রবীন্দ্রনাথ কি শুধুই কয়টি কবিতা আর গান? নাটক আর
নৃত্যনাট্য? গল্প আর উপন্যাস? নোবেল পুরস্কার আর খ্যাতি? বিশ্বমানবতার অভিমুখে মানুষের
সার্বিক উন্নতির বিষয়ে যে রবীন্দ্রদর্শন, সেই দর্শনই তো হতে পারতো বাংলা ও বাঙালির
জীবন ও যাপনের একটি প্রশস্ত রাজপথ। তিনি তো শুধুই কবিতা ও গান লেখেন নি। মানবজীবনের
অনন্ত সম্ভাবনা ও একান্ত সীমাবদ্ধতার মাঝখানের যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা অতিক্রমের যে সাধনা,
সেই সাধনাও তো রবীন্দ্রদর্শন। যে সাধনায় ক্ষুদ্র আমি’র ব্যক্তিসত্তার থেকে মুক্ত হয়ে
বৃহৎ আমির বিশ্বসত্তায় পৌঁছানোর হদিশ দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছেম মানুষটি। তার আজীবন
সাধনায়।
না। আমরা আমাদের রবীন্দ্রনাথকে
হয়তো সঠিক অর্থে আজও অনুধাবন করতে পারি নি। কিংবা পারার চেষ্টাই করি নি। তাঁকে আমরা
সাংস্কৃতিক বিনোদন ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের সীমাবদ্ধ পরিসরেই আটকিয়ে রেখে দিয়েছি।
না রাখলে আজ এই ২০২০’তে এসে বাংলার সমাজ ও জীবনে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এমন বীভৎস ভাবে
মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো না। যে মানুষটি এক শতাব্দী আগে রাখীবন্ধনের ভিতর দিয়ে সম্প্রীতির
বন্ধনে সমগ্র সমাজটিকে একসূত্রে বাঁধতে প্রয়াসী হয়েছিলেন, আজ তাঁর হাত ধরে থাকলে, আমরা
অন্তত পোশাক দেখে মানুষ চেনার দাওয়াই গ্রহণ করতাম না। আজকের বাংলার রাজনীতির দিকে তাকালে
সমাজের যে অবক্ষয়ের চেহাড়াটা বিকট ভাবে বেআব্রু হয়ে পড়ে, সেটা হয়তো দেখতে হতো না। যদি
বৃহত্তর সমাজ বাস্তবতায় আমরা রবীন্দ্রনাথকে সার্থক করে তোলবার চেষ্টা করতাম। একটি জাতির
সামগ্রিক উন্নতির জন্য ন্যূনতম প্রাথমিক যে শর্তগুলি পুরণের প্রয়োজন, কবি বহু আগেই
সেই দিকগুলরি বিষয়ে আমদের সচেতন করে দিয়েছিলেন। একটি সমাজের সার্বিক সমৃদ্ধির পিছনে
যে যে ক্ষেত্রগুলিতে নজর দেওয়ার দরকার, কবি সেগুলির বিষয়েও আমাদের সচেতন করে দিয়ে গিয়েছিলেন।
স্বাধীনতা লাভের পর আট দশকের মত সময় অতিক্রম করে এসে, আমরা আজ কি দেখতে পাচ্ছি? আমাদের
সমাজ অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অপুষ্টি, সাম্প্রদায়িক বিভেদ বিদ্বেষ, দুর্বলের উপর প্রবলের
শোষণ ও অবিচার, প্রভৃতি যাবতীয় অন্ধকারে তলিয়ে যেতে বসেছে। আর আমাদের রাজনীতি আমাদেরকে
আরও বেশি করে তলিয়ে যাওয়ার জন্য ক্রমাগত উদবুদ্ধ করে চলেছে। আর আমরা, সেই দিকে না তাকিয়ে
সম্পূর্ণ চোখ বুঁজে নিজের চরকায় তেল দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের রবীন্দ্রচর্চাও সেই নিজের
চরকায় তেল দেওয়ারই রকমফের।
তাই রংরুটের আয়োজনে আমাদের
এই বিশেষ রবীন্দ্রজয়ন্তী সংখ্যাটিকে আমরা একটু অন্যরকম করে সাজিয়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছি।
প্রথাগত রবীন্দ্রসংখ্যার মতো করে আমরা সংখ্যাটি প্রকাশ করতে চাইনি। তাই এই সংখ্যায়
আমরা শুধুমাত্র প্রবন্ধই প্রকাশ করছি। আর এই সংখ্যায় আমরা মূলত দেখতে চেয়েছি, এই সময়ের
বাংলার সমাজ ও জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের সেই অতি গুরত্বপূর্ণ ও অনালোচিত বিষয়টি।
আমাদের ফোকাস রবীন্দ্রনাথ নয়। রবীন্দ্রনাথের প্রভাব। আমরা রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ বিদগ্ধজনেদের
দৃষ্টি থেকেও বিষয়টি দেখতে চাই নি। আমরা চেয়েছি সাধারণ শিক্ষিত জনমানস এই সময়ে বাংলার
সমাজ ও জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বিষয়টি ঠিক কিভাবে দেখছেন। বা আদৌ দেখছেন কিনা।
সেটাই আমাদের এই বিশেষ রবীন্দ্রজয়ন্তী সংখ্যা প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য। এই সংখ্যায় যাঁরা
লেখা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, আমরা তাঁদের সকলের কাছেই কৃতজ্ঞ। সকলেই হয়তো আলোচনার মূল
ভরকেন্দ্রের অভিমুখে এগোতে চাননি। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের উপরেই মূল ফোকাসটা ধরে রেখেছেন।
অনেকেই মূল বিষয়টিকে তাঁদের নিজস্ব বিশ্বাস ও ভালোবাসার জায়গা থেকে পর্যালোচনা করেছেন।
কেউ কেউ বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার পরিসরে মূল বিষয়টিকে অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। ফলে এই সংখ্যার
পাঠক নানান দিক থেকেই ভাবনা চিন্তার খোরাক পাবেন বলেই আমাদের আশা। রংরুটের অত্যন্ত
সীমিত সাধ্যে এমন গুরুতর বিষয়ে প্রামাণ্য একটি সংখ্যা উপহার দেওয়া নিশ্চয় সম্ভব নয়।
তবু আমাদের প্রয়াসের ঘাটতি ছিল না। বরং আমাদের আশা, রংরুটের এই প্রয়াসের হাত ধরেই দিকে
দিকে এই ধরণের চেষ্টা আরও বেশি করে পল্লবিত হয়ে উঠুক। সেটি হলেই আমাদের প্রয়াসের সার্থকতা।
কপিরাইট রংরুট কর্তৃক সংরক্ষিত
রবীন্দ্র চর্চার জন্যে এ সংখ্যাটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয় বৈচিত্র্য সহ এ সংখ্যার আয়োজন ভালো হয়েছে!
উত্তরমুছুন