রবীন্দ্রনাথ
ও বাঙালি মনোজগৎ
বাঙালির
সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশে এক আলাদা ঔজ্জ্বল্য নিয়ে অবস্থান করছেন
রবীন্দ্রনাথ৷ ‘ভারতে সমাজ রূপায়নে
সাহিত্যের শক্তি’ হলেন এই বিদগ্ধ পুরুষ। কবির কবিতার মধ্যে এক অপার্থিব ভাবসম্পদের
সন্ধান পেয়েছিল বাঙালি৷ রবীন্দ্র সাহিত্যের মধ্যেই পাওয়া যায় বস্তুবাদী জীবনের
আড়ালে এক গভীর প্রশান্তি৷ ভুলে গেলে। তা চলবে কেন?
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনের প্রেক্ষাপটেই তাঁর কবিমানস ও
সাহিত্যকর্মের স্বরূপ অনুধাবন সম্ভব। জীবনের পর্বে পর্বে তাঁর জীবনজিজ্ঞাসা ও
সাহিত্যাদর্শের পরিবর্তন ঘটেছে। যুগে যুগে পৃথিবীতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের
ক্ষেত্রে যে রূপান্তর ঘটেছে, রবীন্দ্রনাথ সবকিছুকেই
আত্মস্থ করেছেন গভীর অনুশীলন, ক্রমাগত নিরীক্ষা এবং
বিশ্বপরিক্রমার মধ্য দিয়ে। তাই তাঁর সাহিত্যজীবনের নানা পর্যায়ে বিষয় ও
আঙ্গিকের নিরন্তর পালাবদল লক্ষণীয়। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল তাঁর অসংখ্য কবিতা,
গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক,
গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনী, চিঠিপত্র এবং দেশে বিদেশে প্রদত্ত বক্তৃতামালা। রবীন্দ্রনাথের
অন্তর্নিহিত জীবনবোধ ছিল স্থির এবং বহু পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিয়েও আপন আদর্শে
প্রতিষ্ঠিত; অন্যদিকে তাঁর সৃজনশীল রূপটি ছিল চলিষ্ণু ও
পরিবর্তনশীল। রবীন্দ্রনাথ কেবল তাঁর কালের কবি নন, তিনি
কালজয়ী। বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর আবির্ভাব ছিল এক যুগান্তর। লেখালেখির
মধ্য দিয়ে দেড়শ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কতটা আমাদের? এবং
আমরাই বা সেই অধিকারকে কতটা এবং কিভাবে কাজে লাগাাচ্ছি।
রবীন্দ্রনাথ
তার ছোটগল্পে পদ্মাপাড়ের মানুষের কথা বলেছেন, বাঙালি নর-নারীর হৃদয়ের সুখ-দুঃখ
প্রকাশ করেছেন। গান তার অপরিসীম দান। বাঙালি রবীন্দ্রনাথের সব ভুলতে পারে, প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে হেলায় তুলে রাখতে পারে; কিন্তু
তার গান গাইতেই হবে বাঙালিকে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলেছেন একথা এবং বর্তমান নতুন
প্রজন্মের একটা শ্রেণি গোপনে হাত মিলিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে-সুরের সঙ্গে।
এটাই বা কম কীসে! আমাদের লোকউৎসব (যেমন পয়লা বৈশাখ) তার গান ছাড়া জমে না। প্রবন্ধে
ভিন্নমাত্রায় যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাচ্ছি, যে সাহস
উদ্দীপনা প্রত্যক্ষভাবে পাঠককে তিনি দেন সে প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরোয়নি।
বিশেষত, প্রমথ
চৌধুরী তার ‘বর্তমান বঙ্গসাহিত্য’ এ সাহিত্যের যে ‘আবিষ্কার’ ও ‘নির্মাণ’র প্রসঙ্গ
নির্দেশ করেছেন সেই আবিস্কারের জন্য তো অবশ্যই, নির্মাণের
জন্য রবীন্দ্রনাথের চিন্তা এখনো বিরাট ঋণ।
তবে
এসব নিয়ে বাংলা সাহিত্যে ভুরিভুরি আলোচনা হয়েছে। লেখালেখিতে রবীন্দ্রনাথ কতটা
আমাদের তারও বহু সমালোচনা বেরিয়েছে। সেসব নিয়ে নতুন করে বলার ভান করে এ আলোচনাকে
‘চর্বিতচর্বণ’ করার মানে হয় না।
রবীন্দ্রনাথ
বাঙালির মননে চিন্তনে। রবীন্দ্রভাবনায় পেরিয়ে আসি আমাদের ভাবনঘর মাইলের পর মাইল।
ঠাকুর কে কেন্দ্র করেই বাঙালি গড়ে তোলে তার যাপনের পরিভাষা। কিশোর বেলায় দেখেছিলাম, তাঁর
অতুলনীয় ব্রাহ্মসংগীতের মুর্চ্ছনায় পালিত হচ্ছে দৈনন্দিন উৎসব। মধ্যবয়সে পৌঁছে এই
অনুভব প্রায় তলানিতে। রবীন্দ্রজয়ন্তী আর বাঙালির নববর্ষে এর ভগ্নাংশ পরিলক্ষিত হয়।
এর কারন কি অনেকটাই ইংরেজী মাধ্যম ও হিন্দী বলয়ের উপদ্রব? হয়তো খানিকটা তাই! অথবা বাঙালির অনুকরণ প্রিয়তাও অনেকটা দায়ী।
বাঙালির
সাহিত্যাকাশে রবীন্দ্রনাথ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
ঠাকুরের দেখানো পথ লক্ষ্য করেই বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার আবির্ভাব। " আচ্ছা, প্রেম কে তাহলে এভাবেও ভাবা যায়"... শেষের কবিতা পড়ে মননশীল
পাঠকের ধারনা হতেই পারে। বঙ্কিমোত্তর যুগে বাংলায় শব্দজটিলতার হাত থেকে বাঙালিকে
মুক্তি দিলেন রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র। ভাষার রেঁনেসার কালে একে একে তারাশংকর,
বিভূতিভূষন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়...
বাঙালি জনমানসে কথা সাহিত্যের যেন জোয়ার এল।
বাংলা
উপন্যাসের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অন্য সকল সাহিত্য কর্মের মতই
শ্রেষ্ঠত্ব্যের আবহ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা বার। তিনি ১৮৮৩ তে ‘বউ
ঠাকুরাণীর হাট’ এবং ১৮৮৭ তে ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসদ্বয় লেখার পর দীর্ঘদিন কোন উপন্যাসে
হাত দেননি। ১৯০৬ তে বাস্তব নাগরিক জীবনের পটভূমি অবলম্বন করে, সামগ্রিক
পালাবদল ঘটিয়েছেন ‘তাঁর চোখের বালি’ উপন্যাসের মাধ্যমে। তারপর পর্যায়ক্রমে ‘নৌকাডুবি’
(১৯০৬), ‘গোরা’ (১৯০৯), ‘ঘরে
বাইরে’ (১৯২৬), ‘যোগাযোগ’ (১৯২৯), ‘শেষের কবিতা' (১৯২৯), ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৩), ‘দুই বোন’ (১৯৩৩), ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪) লিখে ব্যাপক সমালোচিত হন।
বাংলা
সাহিত্যে ছোটগল্প কনিষ্ঠতম সন্তান হিসাবে পরিচিত। পৃথিবীর অপরাপর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যে
ছোটগল্পের ইতিহাসের সূত্রপাত বহু পূর্বেই হয়েছিলো। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে
পাশ্চাত্য প্রভাবে যে আধুনিকতার সৃষ্টি হয় তার পরেই ছোটগল্পের জয়যাত্রা সূচিত
হয়েছে এবং তাতে উৎকর্ষের নিয়ম শৃঙ্খলা সুস্পষ্ট ছিলনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাতে
উৎকর্ষের নিদর্শন সুস্পষ্ট করেন আপন মহিমায় মহিয়ান হয়ে বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পকার
হিসেবে পরিচিতি গড়ে তোলেন। তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ ভারতী পত্রিকায় ১৯৭৪
খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৮৮৪-৮৫ তে ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের
কথা’ ও ‘মুকুট’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯০ সালে ‘দেনাপাওনা’ গল্পটি ‘হিতবাদী’ পত্রিকায়
প্রকাশিত হলে ব্যাপক পাঠক সমালোচিত হয় এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বার্থক ছোটগল্প
হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
বাংলার
মানুষ আর প্রকৃতিতে তিনি বিমুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর ছোটগল্পে সে সব ছোট খাট মানুষের
সুখদুঃখের কথাকেই নিতান্ত সহজ সরল ভাষায় আপন মনের সৌন্দর্য মিশিয়ে তুলে ধরেছেন।
রবীন্দ্রনাথ তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, ‘পোষ্টমাষ্টারটি
আমার বজরায় এসে বসে থাকতো। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। শ্রীদাসদের দেখেছি আমাদের
কাছারিতে। ওই যারা কাছে এসেছে তাদের কতকটা দেখেছি, কতকটা
বানিয়ে নিয়েছি।’ তাঁর লিখিত গল্পগুলোর মধ্যে- ‘একরাত্রি’, ‘মহামায়া’, ‘সমাপ্তি’, ‘দৃষ্টিদান’, ‘মাল্যদান’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘শাস্তি’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘মানভঞ্জন’, ‘দুরাশা’, ‘অধ্যাপক’, ‘নষ্টনীড়’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘পাত্র ও পাত্রী ',' রবিবার,', ‘ব্যাবধান’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘পণরক্ষা’, ‘দিদি, ‘কর্মফল’,
‘দান প্রতিদান’, ‘দেনা পাওনা’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘হৈমন্তী’, ‘ছুটি’, ‘পুত্র যজ্ঞ’, ‘পোষ্ট মাষ্টার’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘শুভা’, ‘অতিথি’, ‘আপদ’,
‘গুপ্তধন’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘নিশীথে’, ‘মণিহার’, ‘ক্ষুধিত
পাষাণ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
উপন্যাস
এবং ছোট গল্পের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠক নন্দিত হলেও সবচেয়ে বেশি সম্মানিত
হয়েছেন কবিতার মাধ্যমে। তিনি ‘ছিন্নপত্রাবলী'তে লিখেছেন, ‘আমার বুদ্ধিতে যতটা আসে তাতে তো বোধহয় কবিতাতেই আমার সকলের চেয়ে বেশি
অধিকার।’ মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ্য ‘বনফুল’ প্রকাশিত হলে তখনকার
সাহিত্য সমাজ রবীন্দ্রনাথকে সাদরে গ্রহণ করে। তারপর তিনি অনেক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ
করেছেন এবং সমান সম্মান পেয়েছেন। ১৯১০-এর আগষ্টের মাঝামাঝি তার কালজয়ী
কাব্যগ্রন্থ্ ‘গীতাঞ্জলি (বাংলা) প্রকাশিত হয়। অন্য সকল গ্রন্থের মত এটিও ব্যাপক সাড়া
আনে। কিন্তু ১৯১২ সালে ১ নভেম্বর ইংরেজী গীতাঞ্জলি বা সং আফারিংস লিখে বিশ্ব
সাহিত্যের আকাশে বিশ্বকবি হিসাবে জ্বলে উঠেন এবং ১৯৩০ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে
সাহিত্যে প্রথম নোবেল প্রাইজ আনেন। এটি আমাদের জন্য অতন্ত গৌরবের ব্যাপার। তাইতো
কবি নির্ভয়ে নিজ কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন, ‘আমার একটি মাত্র
পরিচয় আছে, সে আমি কবি মাত্র।’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে
আধুনিক গীতকবিতার ধারাটি প্রবর্তন করেন বিহারী লাল চক্রবর্তি। তিনি ছিলেন
গীতকবিতার বেলায় ভোরের পাখির মত। তাঁর অস্ফুট বাণীতে গীতকবিতার সূচনার ইঙ্গিত ফুটে
উঠেছিলো সত্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতেই বাংলা সাহিত্যের এই ধারাটি
বিশেষভাবে সমৃদ্ধি লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ব্যাক্তিগত আবেগ-অনুভূতিগুলোকে সর্বকালের
সর্ব মানবের মর্মস্পর্শি করে অনবদ্য কাব্যরূপ পরিগ্রহ করেছেন। তাঁর জীবন এবং
সাহিত্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রমথ বিশী বলেন, ‘আভিজাত্য নিংসঙ্গ
বাল্যকাল ও মহর্ষিভবনের inhibition আরও একটা কারণ থাকা
সম্ভব। ঠাকুর বংশ পীরালী, মহর্ষির সন্তানগণ ব্রাহ্ম;
এই দুই কারণ মিলে বৃহৎ হিন্দু সমাজ থেকে আলাদা করে রেখেছিলো। এই
নিংসঙ্গতার কারনে তার না-বলা কথা, সাহিত্যে অপূর্ব মূর্তি
লাভ করেছে।’
বাংলা
নাটকের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টের অধিকারী।
রবীন্দ্রনাথের পূর্বেই বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে রীতিনীতির বন্ধন সঠিক ও মজবুত ছিলো।
তবুও তিনি পূর্ববর্তী ধারার বৈশিষ্ট্য উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে নাট্য
সৃষ্টিতে সফলতা অর্জন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-
‘বাল্মীকির প্রতিভা’,
‘কালমৃগয়া’, ‘মায়ার খেলা’, ‘রুদ্রচন্দ্র’, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, ‘বিসর্জন’, ‘চিত্রঙ্গদা’, ‘মালিনী’, ‘ডাকঘর’, ‘কালেও
যাত্রা’, ‘,মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’,
‘ফাল্গুনী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বাংলা
সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালজয়ী একটি নাম, বিশ্ব
সাহিত্যের জগতে একটি বিরাট বিস্ময়। তাঁর একক প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্য সকল দিক
দিয়ে নবযৌবনা হয়ে বিশ্বের দরবারে সুবিশাল কলেবরে সমাদৃত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা
নিয়ে অনেক ভেবেছেন। তার বয়স যখন ৩১ বছর, তখন তিনি
‘শিক্ষার হেরফের’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। যাতে তিনি বলেন, ‘বাল্যকাল হইতে যদি ভাষাশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ভাবশিক্ষা হয় এবং ভাবের
সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জীবনযাত্রা নিয়মিত হইতে থাকে, তবেই
আমাদের সমস্ত জীবনের মধ্যে একটা যথার্থ সামঞ্জস্য হইতে পারে- আমরা বেশ সহজ মানুষের
মতো হইতে পারি এবং সকল বিষয়ের একটা যথাযথ পরিমাণ ধরিতে পারি’। তিনি তার এই
প্রবন্ধে কিছু আগে আরও বলেন যে, ‘চিন্তাশক্তি এবং
কল্পনাশক্তি জীবনযাত্রা-নির্বাহের পক্ষে দুইটি অত্যাবশ্যক শক্তি তাহাতে আর সন্দেহ
নাই। অর্থাৎ যদি মানুষের মতো মানুষ হইতে হয় তবে ওই দুটো পদার্থ জীবন হইতে বাদ দিলে
চলে না। অতএব বাল্যকাল হইতে চিন্তা ও কল্পনার চর্চা না করিলে কাজের সময় যে তাহাকে
হাতের কাছে পাওয়া যাবে না এ কথা অতি পুরাতন।’
রবীন্দ্রনাথের
মতে তার সময়ে যে শিক্ষাব্যবস্থা দেশে চলেছিল, তাতে হতে পারত না চিন্তা ও
কল্পনাশক্তির বিকাশ। তাই তিনি তার পরবর্তী জীবনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন
একটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চান যে, তাতে
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হতে পারবে চিন্তা ও কল্পনাশক্তির বিকাশ। তার কাছে
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় ছাত্রদের কেবলই কিছু তথ্য প্রদান করা নয়; তথ্য নিয়ে ভাবতে শেখানো। যুক্তি বলতে বোঝায় বিভিন্ন ঘটনাবলির মধ্যে
সম্বন্ধ নির্ণয়কে। শিক্ষার লক্ষ্য হতে হবে বিভিন্ন ঘটনাবলির মধ্যে সম্বন্ধ
নির্ণয়ের ক্ষমতা বাড়ানো। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি ভাষার পরিবর্তে শিক্ষার হেরফের
প্রবন্ধে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের প্রস্তাব রাখেন। কারণ, এর ফলে জ্ঞান সহজেই তাদের চেতনার অংশ হয়ে উঠবে। ফলে অনেক সহজেই পারবে
তার প্রয়োগ ঘটাতে।
রবীন্দ্রনাথ
তার ‘শিক্ষার হেরফের’ লেখেন রাজশাহী শহরে বসে (রামপুর বোয়ালিয়া)। তিনি প্রবন্ধটি
পাঠ করেছিলেন তদানীন্তন রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের এক সভায়। যা অনুষ্ঠিত হয় রাজশাহী
সরকারি কলেজের একটি কক্ষে। রাজশাহী সরকারি কলেজ তখন বিবেচিত ছিল একটি উৎকৃষ্ট
শিক্ষপ্রতিষ্ঠান হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ রাজশাহী শহরে এসেছেন অনেকবার। এসেছেন প্রধানত
তার জমিদারির কাজে। রাজশাহী জেলা ছিল তখন রাজশাহী, নাটোর ও নওগাঁ মিলিয়ে।
রাজশাহী শহর ছিল রাজশাহী জেলার সদর।
রবীন্দ্রনাথের
জমিদারি ছিল নওগাঁর কালীগ্রাম মৌজায়। কালীগ্রাম মৌজার একটি গ্রামের নাম হল পতিসর।
যেখানে অবস্থিত ছিল কালীগ্রাম মৌজার জমিদারির তহশিল। কালীগ্রামের জমিদারি ছিল
রবীন্দ্রনাথের প্রধান জমিদারি। যা তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে।
রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর কালীগ্রামের জমিদারি ক্রয় করেন ১৮৩০ সালে।
রবীন্দ্রনাথ রাজশাহী শহরে বসেই কেবল যে শিক্ষার আলো জ্বেলে ছিলেন, তা কিন্তু
নয়।
ঠাকুর ১৮৬৩ সালে কলকাতা থেকে ১০০ মাইল দূরে
বিরভুম জেলার বোলপুর স্টেশনের কাছে কিছু জমি কিনে স্থাপন করেন শান্তিনিকেতন আশ্রম।
পরে রবীন্দ্রনাথ সেখানে স্থাপন করেন ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নামের একটি বিদ্যালয়। এরপর
১৯২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি ওই জায়গায় স্থাপন করেন বিশ্বভারতী নামে বিশ্ববিদ্যালয়।
রবীন্দ্রনাথের স্থাপিত ব্রহ্মচর্যাশ্রমে কেবল মাত্র পড়তে পারত ব্রাহ্ম ও উচ্চ
বর্ণের হিন্দু ছাত্ররা। মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু ছাত্ররাও নয়। উচ্চ বণের্র
হিন্দু বলতে বোঝাত,
ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং বৈদ্য বর্ণের
হিন্দুদের। রবীন্দ্রনাথ এ সময় বর্ণাশ্রম জাতিভেদ প্রথায় আস্থাবান ছিলেন। কিন্তু
যখন তিনি বিশ্বভারতী স্থাপন করেন, তখন তিনি এর দ্বার
উন্মোচিত করেন সবার জন্যই।
রবীন্দ্রনাথ
মনে করতেন লেখাপড়ার উদ্দেশ্য হলো মননশক্তি বাড়ানো। কিন্তু তিনি বিশ্বভারতীর সাথে
যুক্ত করেন শ্রীনিকেতন নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে। এর লক্ষ্য হয় কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমে
পল্লীর উন্নয়ন। এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগৃহীত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
এর প্রথম পরিচালক ছিলেন লেনার্ড কে এল্মহার্স্ট। রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতন স্থাপন
করেছিলেন ১৯২২ সালে। এটাকে ঠিক বিশ্বভারতীর অংশ বলা যায় না। কারণ, এখানে
বিদ্যাদানের ব্যাপারে অনুসরণ করা হতো এবং এখনও হয় পাশ্চাত্য পদ্ধতিকে; বিশ্বভারতীর মতো তপবনের পরিবেশে নয়। অবশ্য বিশ্বভারতীর সেই আদি তপবনের
পরিবেশ এখন আর নেই। বিশ্বভারতী চলেছে প্রধানত রবীন্দ্রনাথের কালীগ্রামের জমিদারির
আয় থেকে। কিন্তু কালীগ্রামের কৃষক প্রজারা এর দ্বারা কোনোভাবেই উপকৃত হতে পারেনি।
রবীন্দ্রনাথ ১১ বার বিশ্বভ্রমণ করেছেন। তারও অর্থ জুগিয়েছে প্রধানত কালীগ্রাম।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার এই জমিদারিতে মনে রাখারা মতো কিছু করেননি। তিনি তার
প্রজাদের শিক্ষিত করে তুলতে চাননি। ভেবেছেন কৃষক প্রজারা শিক্ষিত হলে বাড়বে কৃষক
প্রজার অসন্তোষ। কঠিন হবে জমিদারি রক্ষা। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল জমিদার
হিসেবে খুবই প্রজা-পীড়ক। এদের প্রজা-পীড়নের খবর ছাপান কাঙ্গাল হরিনাথ, তার ‘গ্রামবার্তা’ পত্রিকায়। যা পড়ে ক্ষুব্ধ হন রবীন্দ্রনাথের পিতা
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ভাড়াটে গুণ্ডা নিযুক্ত করেন কাঙ্গাল হরিনাথকে খুন করার
জন্য। কিন্তু সফল হতে পারেন না।
বাংলাভাষী
মুসলমানের মধ্যে সর্ব প্রথম খুব উন্নতমানের বাংলা গদ্য লেখেন মীর মশাররফ হোসেন
(১৮৪৮-১৯১২)। তিনি বাংলা গদ্য লিখতে শেখেন কাঙ্গাল হরিনাথের কাছ থেকে। অর্থাৎ
বাংলাভাষী মুসলমানের সাহিত্য সাধনার আছে একটা পৃথক ইতিহাস। কিন্তু আজ প্রমাণ করার
চেষ্টা হচ্ছে, বাংলাভাষী মুসলমানের সাহিত্য সাধনার পেছনে আছে রবীন্দ্রনাথের অশেষ দান।
যেটা ঐতিহাসিক সত্য নয়। যেমন সত্য নয়, বাংলাভাষী
মুসলমানের ওপর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব। ১৯১১ সালে ৪ সেপ্টেম্বর স্থাপিত
হয় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’। এই সমিতি বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে ১৯১৩ সালে।
সমিতির অফিস স্থাপিত হয় কলকাতায় ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে ৪৯
নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। করাচি থেকে হাবিলদার কবি কাজী নজরুল ইসলাম
এসে ওঠেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে। কেননা, তার
কলকাতায় থাকার কোনো জায়গা ছিল না। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিকে নির্ভর করে
অগ্রসর হয়েছে বাংলাভাষী মুসলমানের সাহিত্য চর্চা। এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো
যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু এখন প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ
নাকি ছিলেন আমাদের সাহিত্য চর্চার মূল অনুপ্রেরণা। যা আদৌ সত্য নয়। রবীন্দ্রনাথকে
ঘিরে এখন শুরু হয়েছে এমন এক রাজনীতি, যা হতে পারে
বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট অমঙ্গলজনক।
জোড়াসাঁকোর
ঠাকুর পরিবারে কেবল যে মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে লেখাপড়া হয়েছে, তা নয়।
রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ তার বড় ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিলাতে
পাঠিয়েছিলেন আইসিএস হবার জন্য। তিনি ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম আইসিএস। তিনি
রবীন্দ্রনাথকেও বিলাতে পাঠিয়েছিলেন আইসিএস হবার জন্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তা হতে
পারেননি। ঠাকুর পরিবার একদিকে বলেছেন, ব্রিটিশ বিরোধী কথা,
আবার অন্যদিকে হতে চেয়েছেন তার শাসনযন্ত্রের অংশ। রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বভারতী স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু নিজের ছেলে রথিন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রে ইলিনয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিজ্ঞান পড়তে। রথিন্দ্রনাথ সেখান থেকে
জীববিজ্ঞানে বিএস ডিগ্রি নেন। রবীন্দ্রনাথ একদিকে বলেছেন, পাশ্চাত্য শিক্ষা বিভ্রান্তিকর। কিন্তু সেই সাথে আবার নিজ পুত্রকে
পাঠিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষালাভ করতে। ভরসা করেননি বিশ্বভারতীতে তার
উচ্চশিক্ষা লাভ হতে পারবে বলে। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অনেক ব্যাপারেই থাকতে দেখা যায়
আত্মসঙ্গতির অভাব।
কি
রসে কি ভাবে রবীন্দ্র কাব্যে সার্বজনীন সুর প্রত্যক্ষ ভাবে বর্তমান। এ কথা সর্বজন
বিদিত। কিন্তু সে সুরের প্রকাশ হয়েছে স্বদেশের ই আবহাওয়ায়। রবীন্দ্র কাব্যে যে
বাংলাদেশের দৃশ্যের ছাপ এত স্পষ্ট ও মূর্ত, তার একটা বড় কারন হল যে কবি কিশোর ও
তরুন কালের অধিকাংশ দিন কাটিয়েছেন বাংলাদেশে ও পূর্ব বংগে।
রবীন্দ্রনাথকে
বহুভাবে আবিষ্কার করবার কলা-কৌশল বাঙালি বহুদিন থেকে কখনো এককভাবে কখনো
সামগ্রিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ অব্যাহত প্রচেষ্টা ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে আরো
মহিমান্বিত ও ঔজ্জ্বল্য দান করেছে। রবীন্দ্রনাথের সকল কীর্তি সকল গৌরব সব আজ
আমাদের। জ্ঞানবৃক্ষ রবীন্দ্রনাথ আমাদের হৃদয় ও আত্মার গভীরে প্রশান্তি এনে দেয়।
নিমগ্ন থাকতে চাই রবীন্দ্রনাথের সকল কীর্তির সাথে। রবীন্দ্র প্রতিভার ভাব-রহস্য
উন্মোচন করতে তাঁর কবিতা,
নাটক, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ ও অঙ্কনশিল্প গভীরভাবে বিশ্লেষণ করাটা খুউব প্রয়োজন। মনোজাগতিক
চিন্তার উৎকর্ষতা সাধনে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনকে ইতিবাচক অর্থে বদলে দেয়।
মহাসমুদ্রজলের ঢেউয়ের সাথে নেচে ওঠে মন। সকলের জন্য রবীন্দ্রনাথ বিশাল পৃথিবী
নির্মাণ করেছেন যার ছাউনিতলায় আমরা আমাদেরকে নতুন নতুনভাবে আবিষ্কার করি। তাঁর
সঙ্গীতের মহিমা চিত্তের গভীরে মর্মলোকে পেঁৗছে যায়। এভাবেই ক্রমান্বয়ে তাঁর গানের
নান্দনিকতা আমরা উপলব্ধি করি।
রবীন্দ্রনাথকে চিনতে এবং জানতে তাঁর ভাবনালোকে
পেঁৗছাতে তাঁর অন্তরজগতকে খোলা চোখে দেখার মানসিকতা আগে তৈরি করতে হবে। যদি বলি
রবীন্দ্র প্রতিভার বিরল বৈশিষ্ট্য আজ অবধি বাংলা সাহিত্যের কোন লেখক সৃষ্টি করতে
পারেননি; সে বিষয়ে কারো দ্বিমত থাকলেও আমার অন্তত নেই। রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা
নতুন নতুনভাবে আমাদের সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় গভীর ও
তীব্রভাবে ব্যক্তিস্বতন্ত্র, মৌলিকত্ব, আবেগানুভূতি, কল্পনা প্রতিভা, রোমান্টিকতা এবং চিরনবীন একটি মন সবসময় লক্ষ্য করা যায়। সুদীর্ঘ সময়
ধরে তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর আমরা বহন করছি।
বিসর্জন, রক্তকরবী
এবং শেষের কবিতার যে ভাবনা তা এ সমাজ সংস্কার ও রাষ্ট্র থেকে একটুও আলাদা নয়।
স্বপ্ন, কল্পনা, আবেগ সুর আর
পুজোর আরাধনা তাঁর সমগ্র সাধনাজুড়ে। তাঁকে মহাকবি বললে একটুও অত্যুক্তি হবে না।
রবীন্দ্রনাথের যথার্থ মূল্যায়নের পক্ষে যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না এমন নয়।
ভক্তি থেকে যেমন (অ) ভক্তির সৃষ্টি হয় ঠিক তেমনি রবীন্দ্রচর্চার মধ্য দিয়ে
রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা যায় একথা ঠিক। জীবনের ক্রান্তিকাল পর্যন্ত
রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন। সকল মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে চেয়েছিলেন তিনি। আর হতে
চেয়েছিলেন সকলের হৃদয়ের কবি।
রবীন্দ্রনাথ সর্বকালে সবসময়ই আধুনিক। স্মৃতিকে
জীবন্ত করে তুলেছিলেন তিনি। বিশ্বপ্রকৃতির মাঝে আমরা বারবার রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে
পাই। সর্বপ্রাণবাদের দ্যোতনা তাঁর চিন্তা ও সাধনার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন বাউল
সাধকের যে জীবনযাত্রা এবং তাঁদের চিন্তার যে রূপক তা রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিত্ব
শক্তি দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন।
জীবনের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ চৌকোনা ঘরের মধ্য
দিয়ে জানালার ফাঁক গলিয়ে বিশ্বপ্রকৃতির লীলাভূমি গভীরভাবে অবলোকন করতেন; আর একটু
একটু করে মুক্তির স্বাদ অবগাহন করতে চাইতেন। প্রকৃতি থেকে শিশুচিত্তের যে আনন্দ জয়
করা যায় সেদিকে রবীন্দ্রনাথ বারবার তাঁর দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছেন। শান্তিনিকেতনের
শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও এরকম প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালবাসা লক্ষ্য করা যায়। পুনশ্চ
কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আত্মভোলা শিশুও যে প্রকৃতির মায়ায় ঘর থেকে বের হয়ে এসে আর
গৃহে ফিরতে চায়না তার মনের ভাবকে বেশ মুন্সিয়ানার সঙ্গে তিনি উপস্থাপন করেছেন। 'ছেলেটা' এবং 'বালক'-এ দু'টি কবিতা ১৩৯৯ সালের ভাদ্র মাসে রচিত এবং
'অপরাধী' নামের কবিতাটিও একই
বছরে একই সঙ্গে রচিত।
শিশুদের
মনের জগতকে তিনি যেন নিজের মানসচক্ষু দিয়ে দেখতেন_
তুমি বলো তিনু প্রশ্রয় পায় আমার কাছে
তাই রাগ কর তুমি।
ওকে ভালবাসি,
তাই ওকে দুষ্টু বলে দেখি,
দোষী বলে দেখি নে।
রাগও করি ওর 'পরে
ভালোও লাগে ওকে
এ কথাটা মিছে নয় হয়তো।
২.
তিনু
অপকার করে কিছু না ভেবে
উপকার করে অনায়াসে,
কোনটাই মনে রাখে না।
ও ধার নেয়, খেয়াল নেই শোধ করবার;
যারা ধার নেয় ওর কাছে
পাওনার তলব নেই তাদের দরজায়।
মোটের উপর ওরই লোকশান হয় বেশি।
এই
যে ভালো মন্দের মাপকাঠি বলতে বিজ্ঞজনেরা যা বোঝেন আর কি_ এই 'অপরাধী' কবিতাটি আদ্যপান্ত পাঠ করলে একটি
আদর্শবাদী মানুষের চরিত্র এখানে দৃশ্যমান। বয়স যাই হোক না কেন, শিশুর অবচেতন মনই আমাদের জীবনের প্রথম পাঠ-এর মতো বিবেচ্য। ন্যায়-অন্যায়ের
হিসাব তাকে স্পর্শ না করলেও একটি মনুষ্যত্ববোধ এই কবিতার 'তিনু' চরিত্রের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। জগতের
সব শিশুর প্রতীক যেন রবীন্দ্রনাথের শিশু চরিত্রগুলো।
'বালক' কবিতার ভেতরে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব মর্মলোক আর ভাবনার যে ঐতিহ্য তা
গ্রামবাংলার দৃশ্যপট এবং আমাদের বাঙলার পরিচিত জগতকে মূর্ত করে তুলেছেন।
রবীন্দ্রনাথের নিজস্বতা বলতে এই বাঙলার জনপদ মানুষ আর প্রকৃতির বিশাল সাম্রাজ্যকে
প্রতীক হিসেবে তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন। তাই তিনি আমাদের বাঙলারও বাঙালির কবি
হিসেবে আমাদের কাছে চিরনমস্য। সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে আমাদের চোখের সামনে উদ্ভাসিত
করতে হলে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার মনের যে দীর্ঘস্থায়ী রূপ সে রূপের
সৌন্দর্য যথাযথভাবে গ্রহণ করবার ক্ষমতা থাকতে হবে। আপন মহিমায় তিনি বিশ্বজগতকে
উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন।
১.
পৃথিবীতে ছেলেরা যে খোলা জগতের যুবরাজ
২. আমার খেলা ছিল মনের ক্ষুধায়
চোখের দেখায়
পুকুরের জলে, বটের শিকড় জড়ানো ছায়ায়
৩. ইমারত-ঘেরা ক্লিষ্ট যে
আকাশটুকু
তাকিয়ে থাকত এক দৃষ্টি আমার মুখে-
বাদলের দিনে গুরু গুরু করে তার বুক উঠতো দুলে
মেঘ জুটত ডানাওয়ালা কালো সিংহের মতো
৪. যে চাঞ্চল্য শিশুর জীবনে
রূদ্ধ ছিল
সেই চাঞ্চল্য বাতাসে বাতাসে, বনে বনে
তাঁর
চোখে দেখা এবং উপলব্ধিজাত শিশুর মনের ওপর যে ছায়া পড়ে এবং চিত্তের যে চাঞ্চল্য তা
গভীরভাবে এ কবিতায় উপলব্ধি করা যায়। শিশু-কিশোর জীবনের যে ছবি তা যেন রবিঠাকুর নিজ
হাতে অঙ্কন করেছেন। শিশুর কল্পনাকে বরাবর কবি গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রকৃতির
রূপ-রহস্যের অসামান্য সব বর্ণনা তাঁর প্রতিটি লেখার মধ্যে দৃশ্যায়িত। মানব
চরিত্রের ভেতরের রূপটি যেন কবি দেখতে পেতেন এবং উন্মোচন করতে চাইতেন এর গূঢ় রহস্য।
এবং পৃথিবীকে দেখতে চেয়েছেন তাঁর যেন চির চেনা শিশু-কিশোরদের চোখ দিয়ে। তাদের
চোখের স্বপ্ন আর অজানাকে জানতে চেয়েছেন তিনি। এভাবে রবীন্দ্রনাথ পথ হেঁটেছেন আর
অপার মমতায় এ জগৎ সংসার আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে তাঁর কাছে_
১. মরা নদীর বাঁকে জমেছে
বিস্তর
বক দাঁড়িয়ে থাকে ধারে
দাঁড় কাক বসেছে বৈঁচিগাছের ডালে
আকাশে উড়ে বেড়ায় শঙ্খচিল
২. ছেলেটার খেয়াল গেল এইখানে
ডুব দিতে
ওই সবুজ স্বচ্ছ জল
সাপের চিকন দেহের মতো।
এভাবে
ক্রমাগত রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করলে তাঁর জীবনের একটি বৈচিত্র্যময় ছবি ও তাঁর
রঙের বৈভব আমাদের হৃদয়ে অঙ্কিত হবে। উপমা প্রয়োগে রবিঠাকুরের জুড়ি মেলা ভার।
পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহ পাঠ করলে রবীন্দ্রনাথের জীবনের শুরু থেকে যৌবনের
যে জয়গান এবং কবিতার রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের অবিচ্ছিন্ন
চিন্তা ও ভাবের খোরাক যুগিয়েছেন। প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক প্রত্যক্ষ বাস্তবতার আলোকে
তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে প্রতিটি কবিতার সারমর্ম আপন মহিমায় পাঠকের জন্য
উপস্থাপন করেছেন। বিকশিত করেছে পত্র পল্লবের মতো। তিনি প্রকৃতিকে নিয়ে অসংখ্য গান
কবিতা এবং ছোটগল্প লিখেছেন। তারপরও প্রকৃতির সাথে পুজো ও প্রেম তার লেখার উপজিব্য
বিষয়। মানুষের মনের জগতকে তিনি যেন দেখতে পেতেন। তাঁর দেখার দৃষ্টির ভেতর মানুষের
জীবনের স্বচ্ছ পথ চিত্তের দর্শন পরিপূর্ণভাবে উঠে এসেছে। 'সহযাত্রী'
কবিতাটির কয়েকটি চরণ এখানে তুলে ধরা হলো:
১. সুশ্রী নয় এমন লোকের অভাব
নেই জগতে
এ মানুষটি তার চেয়েও বেশি, এ অদ্ভুত।
সারমর্ম ব্যাখ্যা করলে কবিতাটি বেশ অর্থবোধক।
২. বিবিধ রচনায় ফাঁক থাকে
থাকে কোথাও অস্ফুটতা
৩. সবাই ওকে পাশ কাটিয়ে চলে
সেটা ওর সহে গেছে আগে থেকেই
পুনশ্চ গ্রন্থে 'বাঁশি' একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা।
১. কিনু গোয়ালার গলি/দোতলা
বাড়ির/ লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর/ পথের ধারেই
২. বেতন পঁচিশ টাকা/ সদাগরি
আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি/ খেতে পাই দত্তদের বাড়ি/ ছেলেদের পড়িয়ে/
শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই/সন্ধেটা কাটিয়ে আসি/ আলো
জ্বালাবার দায় বাঁচে।
৩. এঞ্জিনের ধস্ ধস্/-বাঁশির
আওয়াজ/যাত্রীর ব্যস্ততা/কুলির হাঁকাহাঁকি/ সাড়ে দশ বেজে যায়/তার পরে ঘরে এসে
নিরালা নিঝুম অন্ধকার
একজন
মানুষের জীবনের চালচিত্র এ কবিতায় পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কেরানির জীবনের
যে টানাপোড়েন আর অসহায়ত্ব সেটি এ কবিতায় সুনিপুণভাবে উঠে এসেছে। অনুভূতি, বিবেক,
অন্তরযন্ত্রণা ও জীবনচিত্রের বর্ণনা কবি পারিপাশ্বর্তা অবলোকনের
পর একজন নিঃসঙ্গ ও ছোট চাকুরে মানুষের জীবনের চাওয়া-পাওয়া কীভাবে দুমড়ে মুচড়ে
প্রবলভাবে হৃদয়ে কষ্ট বাসা বাধে তারই একটি চিত্রায়ন এ কবিতায় উঠে এসেছে। যেন একটি
ভিন্ন জগতে বাস করে পাঁচশ' টাকা মাইনের সদাগরি অফিসের
কনিষ্ঠ কেরানি।
'বাঁশি' কবিতা পাঁচ স্তবকের বিষয়টিতে একেবারে
জীবনঘনিষ্ঠ। ধলেশ্বরী নদী তীরে পিসিদের গ্রাম/তাঁর দেওরের মেয়ে/অভাগার সাথে তার
বিবাহের ছিল ঠিকঠাক/লগ্নশুভ, নিশ্চিত প্রমান পাওয়া
গেল/সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে/মেয়েটা তো রক্ষে পেলে/আমি তথৈবচ।
সাহসহীনতার
কারণে এবং মনের দৈন্যের কারণেই হোক নায়ক চরিত্রের ভেতর পলায়নবৃত্তি মনোভাব বারবার
উঠে এসেছে। দৃঢ়তা নেই। তারপর সময় ও ছাপ এখানে পরিস্ফুট। জগতের সকল পূর্ণতা থেকে
যেন সে বহুদূরে। এই যে একজন মানুষের মনের দৈন্য ও সবকিছু না পাওয়ার যে বেদনা তা এ
কবিতায় ধ্রুপদী ঢংয়ে এগিয়েছে পাঠকের হৃদয়ের ভেতরে। মন যেন ঢেউ তোলা স্পন্দন।
আকাঙ্ক্ষার যেন কোন শেষ নেই।
বাঙালিকে
আধুনিক করে তোলার সকল প্রতিকূল দিককে তিনি জয় করবার চেষ্টা করেছেন বারবার। বাংলা
কবিতার মূল যে পটভূমি আবহমান বাংলার প্রকৃতি, মানুষ আর বরষার জয়গান বারবার তাঁর কবিতায়
চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। চেতনায় রবিঠাকুরের মেঘবর্ণ আকাশ বৃষ্টির জন্য বন্দনা,
এসব বহুমাত্রিকতায় বিভিন্ন রূপে তাঁর কবিতায় পাওয়া যায়। অভিন্ন
মূল্যবোধের ধারক রবিঠাকুর। তাঁর চিন্তা চেতনা এবং ভাবনার ভেতরে বাঙালির
রবীন্দ্রনাথের দেখার ধরন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর মানসলোকে সর্বক্ষণ গভীর অনুরাগ
ছিল বিরাজমান। সেটি এই 'ক্যামেলিয়া' কবিতার মধ্যে পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে। বিষয় ও বক্তব্যের দিক থেকে এ
কবিতাটি একটি চমক সৃষ্টি করেছে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। যা একজন পাঠককে টেনে নিয়ে
যায় কবিতার ভেতরবাড়ি। কালানুক্রমে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিশ্লেষণ করলে জীবনবোধ
সূক্ষ্ম চিন্তন ও পরিপূর্ণ জীবন চিত্র উঠে আসে। সে সময়ের নিপাট সৌন্দর্য ছড়িয়ে
পড়ে চারদিকে।
কালের
অমোঘ নিয়মে বুদ্ধিবাদের বিস্তার ও জীবন সংগ্রামের এক নিখুঁত চিত্র রবীন্দ্রনাথের
কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। 'ক্যামেলিয়া' একটা ফুলের গাছ। কবির বিস্ময় বলে
কথা! প্রেম ও অপ্রেমের ঘূর্ণিপাকে একজন কবিরও যে বিপর্যস্ত অবস্থা মনের ওপর ভর করে
'ক্যামেলিয়া' কবিতা পাঠ করলে আর
বিতর্কের অবকাশ থাকে না। একটা অসুখী ছায়া যেন সমগ্র জীবনবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
সত্য সাধনা ও বিশ্বাসকে সঙ্গে করে রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন।
মূল্যবোধের
ওপর ভোগবাদের আধিপত্যকে বারবার ঘৃণা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি জীবনবোধকে প্রতিষ্ঠা
করতে সংগ্রাম করেছেন আমৃত্যু। অস্তিত্বের সংকট আর অস্তিত্বের যন্ত্রণা থেকে
মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছেন বারবার। জ্ঞানের মহিমা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন মানুষের
ভেতরে। সীমাবদ্ধ জীবন ভেঙ্গে সামাজিকভাবে মানুষকে বাঁচতে শিখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
বিচিত্র ছলনার জাল থেকে রক্ষা করতে চেয়েছেন বারবার দেশ ও মানুষকে:
প্রাঙ্গণে
নামল অকালসন্ধ্যার ছায়া
সূর্যগ্রহণের কালিমার মতো!
উঠল ধ্বনি : খোলো দ্বার!
... ... ...
মেঘমন্দ্র ধ্বনি এলো : আমি মাটি রাজত্বের দূত,
সময় হয়েছে এসেছি মাটির দেনা আদায় করতে।
ঝন্ঝন্ বেজে উঠল দ্বারের শিকল,
থরথর কাঁপল প্রাচীর,
... ... ...
আশীর্বাদ
এই আমার সার্থক হবে মনের সাধনা
জীর্ণকণ্ঠে মিশবে মাটিতে, চিরজীবী
কণ্ঠস্বর বহন করবে বাণী
'চিররূপের বাণী'
এভাবে
ক্রমাগত তাঁর কবিতা পাঠ করলে ব্যক্তি ও তাঁর সত্তাকে পৃথক করা যায় অনায়েসে।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে রবীন্দ্রনাথ একটা ভাবনার জগৎ তৈরি করে
গেছেন। তাঁর মানস-শক্তি (ওহঃবষষবপঃ) ছিল প্রখর । রবীন্দ্রনাথ মানুষকে মানুষ হিসেবে
দেখতে চেয়েছেন বারবার। মানবহৃদয় অন্তরচক্ষু দিয়ে তিনি অবলোকন করেছেন। আধুনিক বাংলা
কবিতার মূল ক্ষেত্রটি রবীন্দ্রনাথ করায়ত্ব করেছিলেন। প্রকৃতি ও মানুষ সম্পর্কে
তাঁর ছিল গভীর প্রেমবোধ। রবীন্দ্রনাথ 'শুভত্বের ও সৌন্দর্য তৃষ্ণার কবি'। জীবন ও কবিতা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু একই ধারণা লালন করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ
শিশুর অন্তরজগতকে যেন দেখতে পেতেন। তাঁর সকল ভালবাসা যেন শিশুকে কেন্দ্র করে
আবর্তিত হয়েছে :
দীঘিটা আছে তার দলিলে, নেই তার
জগতে
আর ছেলেটার দরকার নেই কিছুতেই
তাই
সমস্ত বন বাদাড় খাল বিল তারই-
নদীর ধার পোড়া জমি, ডুবো নৌকা,
ভাঙা মন্দির
রবীন্দ্রনাথ
এভাবেই শিশুদের রূপায়ন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতাই বিবেচ্য। মানবমনের আলোক শিখা
জ্বালিয়ে দিয়েছেন তিনি। যেন বাঙালি সংস্কৃতির অমোঘ দর্পণ রবীন্দ্রনাথ।
পুনশ্চ
১৩৩৯ সালের আশ্বিন মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের 'শিশুতীর্থ'
কবিতাটি ১-১০টি স্তবকে গ্রন্থবদ্ধ হয়েছে। 'শিশুতীর্থ' কবিতার প্রতিটি স্তবকই চমকপ্রদ ও
বক্তব্যধর্মী।
(ক) সেখানে মানুষগুলো সব ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার
মতো
ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে-
মশালের আলোয় ছায়ায় তাদের মুখে
বিভীষিকার উল্কি পরানো।
কোনো এক সময়ে অকারণ সন্দেহে কোনো এক পাগল
তার প্রতিবেশিকে হঠাৎ মারে;
(খ) কোনো নারী আর্তস্বরে বিলাপ
করে;
বলে 'হায়, হায়,
আমাদের দিশাহারা সন্তান উচ্ছন্ন গেল।
কোনো কামিনী যৌবন মদ বিলসিত নগ্ন দেহে
অট্টহাস্য করে;
বলে, কিছুতে কিছু যায় আসে না।
শিশুরা
করতালি দিয়ে হেসে উঠলো
প্রভাতের প্রথম আলো ভক্তের মাথায় সোনার রঙের
চন্দন পরালে;
সবাই বলে উঠল, ভাই আমরা তোমার বন্দনা করি।
দিগন্তের
পর দিগন্ত আসে/ অজ্ঞান্তের আমন্ত্রণ অদৃশ্য সংকেত ইঙ্গিত করে/ ওদের মুখের ভাব
ক্রমেই কঠিন/ আর দের গঞ্জনা উগ্রতর হাতে থাকে।
যেন সম্পূর্ণ সামাজিক দায় এসে পড়ে একজন কবির
স্কন্ধে। এ থেকে যেন তাঁর মুক্তি নেই। মানুষের মনের ভুবন নির্মাণে রবীন্দ্রনাথ
একটি অভিন্ন স্রোতধারা নিঃসংশয়ভাবে নির্মাণ করেছেন। শক্তি হচ্ছে একটি বিশ্বাস
দৃঢ়তা। প্রাণপন চেষ্টায় একজন প্রকৃত মানুষ তাঁর বিশ্বাসকেই অাঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়।
সব অপঘাত থেকে মানুষ মুক্তি পেতে চায়। পুনশ্চ'র কবিতাসমূহে এক ধরনের মায়া ও
পথ-নিদের্শনা হিসেবে অন্তরে গ্রথিত হতে থাকে :
ক্রোধে
তাকে আমরা হনন করেছি
প্রেমে এখন আমরা তাকে গ্রহণ করবো
কেননা, মৃত্যুর দ্বারা সে আমাদের সকলের
জীবনের মধ্যে সঞ্জীবিত
সেই
মহা মৃত্যুঞ্জয়।
তরুণের
দল ডাক দিল, চলো যাত্রা করি প্রেমের তীর্থে, শক্তির
তীর্থে।
হাজার
কণ্ঠের ধ্বনি নির্ঝরে ঘোষিত হলো
আমরা ইহলোক জয় করবো এবং লোকান্তর।
জ্ঞানে
এবং কর্মে মানুষের কল্যাণ প্রত্যক্ষ করা এবং গভীরভাবে অনুধাবন করাটাও একটি মহৎ
কাজ। মনুষত্বকে জাগিয়ে তোলার মত দুঃসাধ্য কাজ আর কী হতে পারে? রবীন্দ্রনাথ
আমৃত্যু মানুষের কল্যাণে জয়গান করেছেন।
'শিশুতীর্থ' কবিতাটি যথার্থ গদ্যছন্দে লিখিত। এ কবিতায় কবি তাঁর পারিপাশ্বর্িক
কাহিনী, অত্যন্ত সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। স্বাধীনভাবে
কবি তাঁর বক্তব্য এ কবিতায় প্রকাশ করেছেন। এ কবিতার মধ্যে একটি আধুনিক চিন্তন
লক্ষ্য করা যায়।
পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ছন্দোবদ্ধ কবিতা আছে
বেশ কয়েকটি। কোমলগান্ধার,
ছুটি, ঘরছাড়া, অস্থানে,
গানের বাসা উল্লেখযোগ্য। 'মৃত্যু'
কবিতাটি কলামাত্রিক সাধু রীতিতে লেখা :
মরণের ছবি মনে আনি।
ভেবে দেখি শেষ দিন ঠেকেছে শেষের শীর্ণক্ষণে_
আছে বলে যত কিছু
রয়েছে দেশ কালে_
যত বস্তু, যত জীব, যত
ইচ্ছা, যত চেষ্টা
যত আশা নৈরাশ্যের ঘাতপ্রতিঘাত_
দেশে দেশে ঘরে ঘরে চিত্তে চিত্তে
যত গ্রহ নক্ষত্রের
দূর হতে দূরত্বের ঘূর্ণ্যমান স্তরে স্তরে
উলি্লখিত 'মৃত্যু' কবিতার
বক্তব্য গভীর জীবন ভাবনাও তৈরি করে_
১. মৃত্যু যদি শূন্য হতো
যদি হত মহাসমগ্রর
রূঢ় প্রতিবাদ_
২. অসীমের অসংখ্য যা কিছু
সত্তায় সত্তায় গাঁথা
প্রসারিত অতীতেও অনাগতে।
আমাদের
চিন্তাজগৎ ক্রমাগত অগ্রসরমান হয় তাঁর কবিতা নিবিড়ভাবে পাঠ করলে। 'মৃত্যু'
অনিবার্য। যা থেকে কারো মুক্তি নেই। উলি্লখিত ১ ও ২ অনুচ্ছেদের
কবিতা দু'টির বক্তব্য মৃত্যুকে নিয়েই। মৃত্যুর একটা
অন্তর্নিহিত শক্তি থাকে। অনন্তকে প্রকাশ করবার এক অদম্য শক্তি কখনো কখনো আমাদের
অন্তরের ভেতর ভর করে। পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
'পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থে আধি ভৌতিককে সমাদর করে ভোজে বসানো হয়েছে।
যেন জামাইষষ্ঠী। এ মানুষটা পুরুষ। একে সোনার ঘড়ির চেন পরালেও অলংকৃত করা হয় না। তা
হোক, পাশেই আছেন কাঁকন-পরা অর্ধাবগুণ্ঠিতা মাধুরী,
তিনি তার শিল্পসমৃদ্ধ ব্যজনিকার আন্দোলনে এই ভোজের মধ্যে
অমরাবতীর মৃদুমন্দ হাওয়ার আভাস এনে দিচ্ছেন। নিজের রচনা নিয়ে অহংকার করছি মনে করে
আমাকে হঠাৎ সুদুপদেশ দিতে বসো না। আমি যে কীর্তিটা করেছি তার মূল্য নিয়ে কথা হচ্ছে
না; তার যেটি আদর্শ এই চিঠিতে তারই আলোচনা চলছে। বক্ষমান
কাব্যে গদ্যটি মাংসপেশল পুরুষ বলেই কিছু প্রাধান্য যদি নিয়ে থাকে তবু তাঁর কলাবতী
বধু দরজার আধখোলা অবকাশ দিয়ে উঁকি মারছে, তার সেই ছায়াবৃত
কটাক্ষ-সহযোগে সমস্ত দৃশ্যটি রসিকদের উপভোগ্য হবে বলে ভরসা করেছিলুম। এর মধ্যে
ছন্দ নেই বললে অত্যুক্তি হবে, ছন্দ আছে বললেও সেটাকে বলব
স্পর্ধা। তবে কী বললে ঠিক হবে ব্যাখ্যা করি। ব্যাখ্যা করবো কাব্যরস দিয়েই।'
২.
আমার বক্তব্য ছিল এই,
কাব্যকে বেড়াভাঙ্গা গদ্যের ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বাধীনতা দেওয়া যায়
যদি তা হলে সাহিত্যসংসারের আলংকরিক অংশটা হাল্কা হয়ে তার বৈচিত্র্যের দিক, তার চরিত্রের দিক, অনেকটা খোলা জায়গা পায়
কাব্য জোরে পা ফেলে চলতে পারে। সেটা সযত্নে নেচে চলার চেয়ে সব সময়ে যে নিন্দনীয় তা
নয়। নাচের আসরের বাইরে আছে এই উঁচু-নিচু বিচিত্র বৃহৎ জগৎ রূঢ় অথচ মনোহর; সেখানে জোরে চলাটাই মানায় ভালো, কখনো ঘাসের
উপর, কখনো কাঁকরের উপর দিয়ে।'
রবীন্দ্রনাথ
তার সামগ্রিকতা দিয়ে বাঙালি জনজাতির ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছেন, এটুকু বলতে
পারি।
কপিরাইট অনিন্দিতা সেন কর্তৃক সংরক্ষিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন