ফেসবুক বনাম সাহিত্যপত্রের কবিতা : তৈমুর খান



ফেসবুক বনাম সাহিত্যপত্রের কবিতা
তৈমুর খান

ফেসবুকে সাহিত্যচর্চা বর্তমানে যেভাবে বাড়ছে তাতে আনন্দিত এবং আশঙ্কিত হবার প্রবণতা দুই-ই দেখা দিচ্ছে । আনন্দিত এই কারণেই যে আমাদের মধ্যে সাহিত্যের জাগরণ ঘটছে । আশঙ্কার কারণ হল যে আমাদের মধ্যে প্রকৃত সাহিত্যের মর্যাদাহানি হচ্ছে । ফেসবুকের সাহিত্য এবং পত্র- পত্রিকায় প্রকাশিত সাহিত্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা যাচ্ছে ।

প্রথমত, ফেসবুকে যারা সাহিত্য বা কবিতা লিখে পোস্ট করছেন, তাদের অধিকাংশের কবিতাই বালখিল্য রচনা বলে মনে হচ্ছে । শিল্পরীতির দিক দিয়ে এগুলির বেশিরভাগই গতানুগতিক, চর্বিত চর্বণ, প্রাচীন ধারার সাহিত্য । যা খুবই নিম্নমানের  ও স্থূল রুচির পরিচয়বাহী । যেন কোনও কিশোর তার প্রেমিকার জন্য হাতের শিরা কেটে প্রেমের ব্যর্থ যন্ত্রণা প্রদর্শণ করছে । আবেগ আর মেধাহীন আদিমপ্রবৃত্তির করুণ সংরাগ সেগুলি । বক্তব্য বিবৃতির আড়ালহীন প্রকাশ । কবিতার অাধারে শূন্যতা বা নাথিংনেস-এর কোনও প্রয়োগ নেই । শব্দের ব্যঞ্জনাময় নিক্ষেপ ঘটে না । যা খুশি তাই লেখার স্বাধীনতার ক্ষেত্রটিই হল ফেসবুক ।

কিন্তু সাহিত্যের পাতায় এরকম কবিতা কয়টা প্রকাশ হতে দেখা যায়? সম্পাদকেরা সতর্কতার সঙ্গে লেখা প্রকাশ করেনঅবশ্য প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিকতা বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতা যদি না থাকে । তবু ফেসবুকের মত সাহিত্য সেখানে থাকে না। কিছু কবি ফেসবুকে দীর্ঘদিন গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা পোস্ট করছেন, আজ অবধি তার কোনও উত্তরণ চোখে পড়ে না । অথচ একদল তার পেটুয়া বন্ধু অযথা লাইক কমেন্ট করে চলেছেন দিনের পর দিন । এনারা যে কবিতার পাঠক, তা আমার বিশ্বাস হয় না । ইস’, ‘আহা’, দারুণ’, ‘সুন্দর’, কী লিখেছ গুরু’, ‘ফাটাফাটি’, ‘মাৎ করে দিলেইত্যাদি কমেন্টগুলো কবিতার বিচার নয় । সাময়িক পত্রিকায় এদের লেখার সাহস নেই । আলোচনা বা সমালোচনা কোনওটাই এরা করতে পারে না ।

দ্বিতিয়ত, কবিতা চর্চাতেই বাংলা ভাষা ও বানান যথাযথ প্রয়োগ হবে না, একথা আমি মানতে পারছি না । ফেসবুকে কবিতা লিখে ষোলোআনা কবি যশোপ্রার্থীর দল বিশুদ্ধভাবে ভাষাও প্রয়োগ করতে পারে না । এক্ষত্রে তারা একেবারে নাবালক । শব্দগঠন, বাক্যগঠন, বানানবিধি মানার ক্ষেত্রেও খুবই আনাড়ি । পড়াশুনা যেমন নেই, তেমনই নিষ্ঠাও নেই । ভাষাজ্ঞান আয়ত্ত করার সামর্থ্যও নেই । যা আছে তা হল, অল্প পরিশ্রমে সন্মান লাভের ও কবি হিসাবে পরিচিতি পাওয়ার লোভ । বৃহত্তর পাঠক সমাজে নিজেকে তুলে ধরার ব্যাকুলতা । সাহিত্য নিয়ে প্রগতিশীল ভাবনা কখনোই তাদের মধ্যে জেগে ওঠে না । পত্র-পত্রিকায় এই আবর্জনার স্তূপ যেমন সর্বদা সাহিত্য হয়ে ওঠে না, তেমনই পাঠকও হন না পরিশীলিত, মননসম্পন্ন এবং রুচিপুর্ণ । ফেসবুকে তাদের যাতায়াত নেই বা থাকলেও খুব কম । পত্রিকাই বর্তমানে সাহিত্যচর্চা ও পাঠকের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম । যেখানে দীর্ঘক্ষণ পাঠের সময় পাওয়া যায় ।ভাবারও অবকাশ থাকে ।ফেসবুকে অতটা সম্ভব হয় না । তবে অনলাইন ম্যাগাজিনগুলি ইতিমধ্যে একটা জায়গা করে নিতে পেরেছে । সেখানে কবিতা নিয়ে, গদ্য নিয়ে, অনুবাদ নিয়ে বহুমুখী এক্সপেরিমেন্ট শুরু হয়েছে । কয়েকজন দক্ষ সম্পাদকও হাল ধরেছেন।

তৃতীয়ত, ফেসবুকের সাহিত্যিক কবিদের আনাড়ি, উচ্ছৃঙ্খলজনতা বললে খুব একটা ভুল হবে না । তাই তাদের লেখার মধ্যে শিল্প থাকে না । ভাষাকে যথেচ্ছাচার ব্যবহারে একটা ভুল শিল্পচর্চার দৃষ্টান্ত থাকে । আসক্তি ও মোহের আবরণ থাকে । প্রকৃতই বুদ্ধিদীপ্ত মেধাবী অনুরণন থাকে না । একদল কবি যখন কবিতাকে নতুন পথে নিয়ে চলেছেন, পুনরাধুনিক কিংবা পোস্টমর্ডানিজম  যা-ই হবে হোক, কিংবা মেটাফিজিক্যাল ও মেটাফোর এর ব্যবহারে অসাধারন প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন, তখন ফেসবুকের সাহিত্য দেয়ালায় ভর্তি । নতুন ধারাগুলি সম্পর্কে এরা   কোনও ধারণাই অর্জন করতে পারে না । এদের কবিতা পাঠ করতে তাই বিরক্তি আসে । ফেসবুক যতই জনপ্রিয় হোক, এর কৌলিন্য নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় । ধরুন কেউ লিখল

তোমাকে ভালবাসি
হোক পরকীয়া প্রেম
চলো বসন্তের ছায়ায় বসি
জন্ম দিই তোমার পেটে ভ্রুণ
#
বসন্তের ছায়ায় আমাদের
লুটোপুটি দুটি মন ।

তখন এই অংশকে কি কবিতা বলা যাবে ? অনেকের কাছেই উত্তর হবে পজেটিভ । তখনই জানা যায় প্রকৃত অনুসন্ধিৎসু  পাঠকের অভাব ঘটেছে বাংলা কবিতার দুর্দিনে ।

তাহলে কবিতা কেমন হওয়া উচিত ?

যে কবিতা পূর্বে কখনও লেখা হয়নি, তেমনিই হওয়া উচিত । আর এই কবিতা সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় পাওয়া যায় । যেমন ধরুন কেউ লিখল

তোমার মৃত্যুর ওপরে বৃষ্টি ঝরে পড়ছে
আকাশে নীল সংখ্যার নীরবতা
এই পাথর কুচি বৃষ্টিতে আর দরকার নেই কান্নার

তখনই বোঝা যায়, কবিতার উপমা ও পরিস্থিতি কত পালটে গেল । জীবনকে দেখতে শেখার, জীবনের ভেতর বাহিরকে পর্যবেক্ষণ করার নিরন্তর ভাঙচুরের মধ্যেই শিল্প লুকিয়ে থাকে । সেই বোধ ও অনুভূতিকে শিল্প করে তুলতে হয় ব্যঞ্জনায়, শব্দের মহিমায় ও গতিময় প্রজ্ঞালোকের নিবিড় সংশ্লেষে । বিষয় না থাকুক । বক্তব্য না থাকুক, এক সময় ও সংকেত (Time & symbol) সেখানে থাকে । যা কবিকে চেনায় । এই কারণেই এজরা পাউন্ড দ্য সিরিয়াস আর্টিস্ট  প্রবন্ধে বলেছেন – ‘    
     
Poetry is a sort of inspired mathematics, which gives us equations, not for abstract figures, triangles, squares, and the like, but for the human emotions. If one has a mind which inclines to magic rather than science, one will prefer to speak of these equations as spells or incantations; it sounds more arcane, mysterious, recondite.’

Ezra Pound এর একথা সর্বদা সত্য হয়ে প্রতিফলিত হয় ।

তৈমুর খান


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন