খাজাঞ্চির একদিন ~ আইভি চট্টোপাধ্যায়


                                                     

খাজাঞ্চির একদিন
আইভি চট্টোপাধ্যায়

~এক~

কুড়িজনের নামের তালিকা নাম এবং ঠিকানা শনিবার বিশেষ লোক-আদালতে যাতে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে পারে, সেটা দেখা বিশেষ কাজ খাজাঞ্চি আজ মহাজনের ভূমিকায় মিমি সকালে মজা করছিল, ‘সো বাবা... অল সেট ফর ব্যাঙ্কারস ডে-আউট?’
ব্যাঙ্কারস ডে-আউট! এক্সেলেন্ট কয়েনেজমজা করেছে সুহাসও
শোনো, ব্যাঙ্কের কাজ ব্যাঙ্কের দায়িত্ব তুমি একজন এমপ্লয়ী,ব্যস বেশি ইনভলভমেন্ট রেখো না আজকাল গ্রামে ঘোরা খুব রিস্কিসারদা টেনশন করছে শুনে থেকেই
তা বললে কি হয়? ব্যাঙ্কের কাজ, ব্যাঙ্কের দায়িত্ব আমাদেরই মাস গেলে এই দায়িত্বপালনের জন্যেই মাইনে পাই এই কাজগুলো আমাদের মতো এমপ্লয়ীদেরই কাজ
এমনিই টেনশনে মুখ গম্ভীর, বাদলা আকাশের মেঘটা পলকে নেমে এসেছিল সারদার মুখে তাড়াতাড়ি সামলে নিয়েছে সুহাস, ‘তুমি যা বলেছ, আমি মাথায় রাখব চিন্তা কোরো না ব্যাঙ্কের একটা ফরম্যাট আছে, সেইমতো কথা বলব আমি তো ঋণখেলাপি নিয়ে চাপাচাপি করতে যাচ্ছি না তাছাড়া সঙ্গে নির্মলও আছে
নির্মল তো আর ওদের সঙ্গে কথা বলতে যাবে না! গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে, নিয়ে আসবে
কথা বাড়ায় নি সুহাস আরো তিনজন ড্রাইভার থাকা সত্ত্বেও নির্মলকে কেন সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে, অত কথা সারদা বুঝবে না বেশি বুঝিয়ে বলতে গেলে ভয় পাবে

এপ্রিল মাসের সকাল দশটাও বাজে নি অথচ এখনই কেমন গরম দ্যাখো তালিকা অনুসারে গ্রামগুলোর রুট ঠিক করে নিয়েছে নির্মলই নির্মল সরদার আমাদের ওঁরাও গাঁ নিয়ে ভাবনা নাই, উটায় সব শেষে যাব আসল হল হাইবুরু গাঁ উটা দিয়ে শুরু করুন স্যার
হাইবুরু সোমায়া হাইবুরু, সুমিত্রা হাইবুরু, ঘনশ্যাম হাইবুরু তিনটে নাম
সব হাইবুরু একই জায়গায় পাব বলছ?’
পাবেন কিনা জানি না, তবে হাইবুরু গাঁ একটাই সব সিখানেই থাকে উয়ারা শান্ত মানুষ, ভয় নাই তবে....
তবে?’
চলেন না স্যার, দেখি কি হয় শহরের লক দেখলে উয়ারা বার হবেক কিনা
আর শহরে ব্যাঙ্কে গিয়ে লোন নিয়ে এসেছে যখন?’
সি তো মুখিয়ার সঙ্গ সঙ্গ যাইছিল চলেন না স্যার আগেও এসেছি তো এই কাজে, এমন লিস্টি নিয়ে, চৌধুরী স্যারের সঙ্গে আমাকে উয়ারা চিনবেক

গ্রামের মুখে মস্ত একটা অশ্বত্থ গাছ অন্তত দশ বারোটা মোটা মোটা ঝুরি নেমেছে কোনটা আসল কান্ড বোঝাই দায় মোটা ঝুরি লম্বা লম্বা শিকড় হয়ে আরো অনেকখানি ছড়িয়ে পড়েছে সাত আটজন গ্রাম্য মানুষ শিকড়ের ওপর বসে গাড়ি দেখে কৌতূহলী চোখে চেয়ে আছে
নির্মল এগিয়ে গেল, ‘সোমায়া হাইবুরু, সুমিত্রা হাইবুরু, ঘনশ্যাম হাইবুরু কুন দিকে ঘর? ব্যাঙ্কের সাহেব এসেছেন
নির্বাক ভাবলেশহীন মুখ যেন শুনতেই পেল না কেউ
গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেল সুহাস, ‘নমস্কার ভয় নেই আমি শুধু কথা বলব আর এই যে দেখুন, এই কাগজগুলো দিয়ে চলে যাব
জনতা নির্বাক নিস্পন্দও নড়াচড়া নেই কারো অসংখ্য বলিরেখা মুখে, বটগাছের শিকড়ের মতই মোটা শিরা ওঠা হাত, এক বৃদ্ধ চোখের ওপর হাত রেখে জরিপ করছেন বহিরাগতদের নির্মল এগিয়ে গেল বৃদ্ধের দিকে, ‘জোহার ব্যাঙ্কের খুব বড় অফসর ইনি তুমার গাঁয়ে তিন লকের সঙ্গে দেখা করবেক
কি একটা বলে উঠলেন বৃদ্ধ মানুষটা
না, না সঙ্গে আর কেউ নাই ব্যাঙ্কে একটা মেলা লাগবে, সি জন্যে বড়সাহেব উয়াদের নৌতা দিতে এসেছে
জানি লোন মেলা উয়ারা মেলায় ব্যাঙ্ক থেকে লোন দেয়নির্বাক শ্রোতাদের একজন বলে উঠল
ইয়াদের নাম নিই আসছে কেন অফসারবাবু? আবার লোন দিবেক উয়াদের? নাকি আগের সেই দাড়িবাবুটার মত বদ পুলিশ দিই মারবে?’
না না, কেউ মারবেক নাইনির্মল বলে উঠল
আপনারাও সঙ্গে চলুন না’, সুহাস বলে উঠল, ‘কি কথা হয় দেখবেন কোনো ভয় নেই, আমি বলছি তো
গলা নামিয়ে বলল নির্মল, ‘চৌধুরীসাহেবের কথা বলছে বিনোদ আর রাকেশকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন, লোন শোধ করার জন্যে ভয় দেখিয়েছিলেন সেই কথা বলছে ওরা
বিনোদ আর রাকেশ? ওই রিকভারি এজেন্সির মাস্তান দুজন? ওদের সঙ্গে চৌধুরী সাহেবের কিসের মেলামেশা?’ বলতে বলতে থেমে গেল সুহাস কিসের মেলামেশা তা আর ড্রাইভারের মুখ থেকে শুনে লাভ কি সবাই সব বোঝে এখন তাছাড়া দীপক চৌধুরীর এগেনস্টে এইসব নিয়েই তো অনেকগুলো কমপ্লেন ভিজিলেন্স সেল এনকোয়ারি শুরু করার পরই তো সুহাসকে এখানে ট্রান্সফার করা হল
তুমি ওদের বুঝিয়ে বলো নির্মল বলো যে, ঋণখেলাপি হলেও কি কি অধিকার আছে বলো যে গুণ্ডা বা পুলিশ কেউই ওদের ভয় দেখানোর অধিকার রাখে না
বলতে বলতে আবার চুপ করে গেল সুহাস এই প্রান্তিক মানুষরা নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন নয় বলেই তো এত সমস্যা কতরকম সরকারী সুযোগ, কতরকম সুরক্ষা আইন, কত বেসরকারী উদ্যোগ কিন্তু কই, কারো উপকারে তো লাগছে বলে মনে হচ্ছে না 

নির্মল ততক্ষণে খানিকটা বরফ গলিয়ে ফেলেছে হাত তুলে তুলে এবার লোকজন দূরের ঘর বাড়ির দিকে দেখাচ্ছে বৃদ্ধ লোকটির সঙ্গে কি নিয়ে একটা বোঝাবুঝি চলছে স্যার, ইনি বলছেন সুমিত্রা হাইবুরু নামে এ গাঁয়ে কেউ থাকে না সোমায়া হাইবুরু তিনজন আছে, আর ঘনশ্যাম হাইবুরুর বাবার নাম বললে লোকটাকে চেনা যাবে ঘনশ্যাম নামে কেউ চিনতে পারছে না
অল্পবয়সী একটি যুবক, সাইকেলে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, এগিয়ে এল, ‘জোহার স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন?’
চেনা চেনা লাগছিল, নির্মল একমুখ হেসে এগিয়ে এল, ‘বিষ্ণু সরদার স্যার, ওই যে কেসিসি দেবার জন্যে লোক এনেছিল অনেক সেল্ফ-হেল্প গ্রুপের মেয়েদের এনেও অনেকগুলো খাতা খুলিয়ে দিয়েছিল তু ইখানে?’ পরের প্রশ্নটা বিষ্ণুকে
ইশকুলে যাচ্ছি দেখলেন স্যার আমাদের ইশকুল?’

হ্যাঁ, হাইওয়ের ওপর ছিল একটা স্কুল সরকারী স্কুল স্কুলের সামনে দিয়েই মেঠো রাস্তায় নেমেছিল গাড়ি বিষ্ণু সরদারকেও চিনতে পেরেছে সুহাস ওর বাবা মুখিয়া, নিজের গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের দশ বারোটা গ্রামে প্রভাব আছে
ঘনশ্যামকে খুঁজছেন স্যার? ওকে ও নামে কেউ চেনে না গাঁয়ে সবাই ওকে ইলেকশন নামে চেনে।জমায়েতের দিকে তাকিয়ে স্থানীয ভাষায় কিছু বলে উঠল তারপর ইলেকশনশব্দটা কেবল বুঝতে পারল সুহাস
ইলেকশন! একটা লোকের এমন নাম হতে পারে!
প্রবল উত্সাহে দুজন ইলেকশনের বাড়ি দেখাতে চলল এবার বিষ্ণুও সঙ্গ নিল নির্মলের কাছ থেকে নাম-লেখা লিস্টটা নিয়ে দেখছে সোমায়া হাইবুরুকে চিনে ফেলল সহজেই, লোনমেলায় এ গাঁয়ের কে কে গেছিল বিষ্ণু সব জানে কিন্তু সোমায়া গাঁ ছেড়ে চলে গেছে অনেকদিন ঝারিয়া না কি একটা জায়গায় গিট্টিকলে কাজ নিয়ে চলে গেছে গ্রামে আসে না আর হাত তুলে দূরের একটা বাড়ি, সোমায়ার ছেড়ে-যাওয়া বাড়ি দেখাল ছেলেগুলো বাড়ির কঙ্কাল ছাদ নেই, মাটির দেয়াল ভেঙে পড়েছে
তবে সুমিত্রা হাইবুরুর খোঁজও পাওয়া গেল বিপিন হাইবুরুর বউ
যাক টু স্পটেড আউট অফ থ্রী দিনের শুরুটা ভালই বলতে হবে

এই তো কাছেই ইলেকশনের বাড়িবলে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে ফাঁকা জমি অন্তত দুকিলোমিটার হাঁটা জমিতে ধান কাটা হয়ে গেছে, একটাই ফসল হয় এদিকে, এখন ধু ধু করছে শুকনো শিকড়ে হোঁচট খেতে হচ্ছে মাঝে মাঝেই যেমন গরম, তেমন ধূলোবালি
আর কতদূর?
ইলেকশনের বাড়িটা অবশ্য বেশ ঠান্ডা ব্যাঙ্কবাবু এসেছে শুনে বাড়িসুদ্ধ লোক উঠোনে নেমে এসেছে। খাটিয়া পেতে বসতে দিয়েছে লোক-আদালত ব্যাপারটা বোঝাতে খানিক সময় গেল এবার আসল কাজ যা হোক, দুশো পাঁচশটাকা রিকভারি নিতে হবে লোন অ্যাকাউন্টে জমার জন্যে কারণ এতদূর এসে বলে যাবার পরও কেউ লোক-আদালতে না যেতেও পারে যতই লোক-আদালত নোটিশের কপিতে রিসিভ করিয়ে নিয়ে যাও
এইসব নোটিশ জারি হয়, কিন্তু কতজনের হাতে গিয়ে পৌঁছয় কে জানে সেইজন্যেই আজকের অভিযান নোটিশটা দেওয়া হোক অন্তত নিজের রিপোর্টে দেখানো যাবে, লোক-আদালতে কত লোক এসেছিল কেউ তো আর দেখতে আসছে না এই রিপোর্টই ভরসা
সামান্য হলেও কিছু টাকা জমা নেওয়া সুহাসের নিজস্ব আইডিয়া এই লোনটা শোধ হলেই একটা ট্রাক্টর-লোন দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেই প্ল্যানমাফিক

তারপরই ধাক্কা শস্য-লোন বাবদ লোন নিয়েছিল ইলেকশন ওরফে ঘনশ্যাম কিন্তু ঘনশ্যাম পেশায় জেলে জমি নেই নিজের, চাষও হয় না লোনের পঁচিশ হাজার টাকার মাত্র তিনহাজার পেয়েছিল সে, তা দিয়ে মাছ ধরার জাল কিনেছিল বাকি টাকা মুখিয়া জানে
পঁচিশ হাজার টাকার কথা শুনে পুরো পরিবারের মুখ শুকিয়েছে
ওই যে গাঁয়ের মুখে গাছের নিচে বুড়াবাবা ছিল না? উ বুড়াই মুখিয়া তবে উ কিছু করে না এখন উয়ার ব্যাটা আছে, ইশকুলের মাষ্টার, উ সব দেখে যাবেন উয়ার কাছে?’
না ওখানে গিয়ে লাভ হবে না ঘনশ্যামকেই যা বলার বলতে পারে ব্যাঙ্ক মুখিয়ার কোনো দায় নেই সে বলতেই পারে, ‘আমি তো গ্যারান্টী দিই নিগ্রামের লোক এখন আর বোকা সরল নেই, সব বোঝে

মানুষের অন্যতম আদিম রিপু লোভ মহাজনের কাজ এই লোভ জাগিয়ে তোলা ট্রাক্টর-লোন না নিতে পারুক, আরো লোন নেই? সেবার সিজিএম এসে একলাখ শস্য-লোন কিষান-ক্রেডিট-কার্ড দিতে বলে গেলেন যখন, জেলেদের মত্স্যচাষী হিসেবে কেসিসি দিয়েছিল না ব্যাঙ্ক? এই লোভটুকুই ভরসা লোভ জাগাতে পারলেই সত্তর পারসেন্ট কাজ শেষ আর এখানে তো একা ঘনশ্যাম নেই, গোটা পরিবারটা উত্সুক
স্বপ্ন দেখানোর কাজটা শুরু করলেই হয়
অভাব, অসুখ, বিপন্নতা ঘরে ঘরে, মানুষের মনে মনে এখন আকাল কি করে কতটুকু ফাঁকি দেওয়া যায়, কোন অলিগলি পথ ধরে চললে বিনা মেহনতে লাভের মুখ দেখা যায়, মানুষ এখন সেইসব সুযোগ খোঁজে নির্মল উজ্জ্বল মন, সততা বিশ্বস্ততা এখন কই! মনের ঘরে আলো নেই, আঁধার নেমেছে দুর্ভিক্ষ লেগেছে তাই লোভ পরম অস্ত্র আজ

ঘনশ্যাম হাইবুরু পাঁচশ’, সুমিত্রা হাইবুরু তিনশ বউনি খারাপ হয় নি লোক-আদালতের দিনের কালেকশান হিসেবে দেখানো হবে সুমিত্রা হাইবুরু আসবে না সেদিন, নিশ্চিতভাবেই বলতে পারে সুহাস তবে ঘনশ্যাম আসবে, সঙ্গে বউ আর ভাইও আসবে ভাইকে মুদ্রা-লোনের টোপ দেওয়া হয়ে গেছে


~দুই~

এবার কোনদিকে, নির্মল?’ মনটা ভাল হয়ে গেছে
এবার রগরগি যাব স্যার হেমব্রমদের গাঁ রগরগির পাশেই কিস্কুদের বড় বস্তী আর একটু এগোলেই পাহাড়পুর গাঁয়ের গাইচাদা মন্দির আজ রবিবার, ওখানে অনেক লোক আসবে এই যে আপনার লিস্টের কিস্কুরা, সব্বাইকে ওখানে পেয়ে যাব আজ
রগরগি! বাব্বা, নামটার মানে কি? কি ভাষার শব্দ?’
শব্দের মানে? তা তো জানি না স্যার হো ভাষার শব্দ হতে পারে কিংবা মুণ্ডারী বা সানথালি। এরা নিজেরাও বলতে পারবে না মুখে মুখে চলে আসছে
নানা দেশজ শব্দ, নানা আঞ্চলিক শব্দ মৌখিক পরম্পরায় চলে আসছে ঝাড়খণ্ডের জনজাতীয় ভাষা
             
ভাষা নিয়ে সুহাসের তেমন পড়াশোনা নেই বিজ্ঞানের ছাত্র কিন্তু বদলি হয়ে আসার পর আলাপ হয়েছে যদুপতি মাহাতোর সঙ্গে শহরের কলেজে বাংলা ভাষার অধ্যাপক অনেকগুলো গবেষণামূলক প্রবন্ধ নিয়ে একটা বই লিখেছেন দিয়েছিলেন আগ্রহ হয়েছিল
গবেষকদের মতে, প্রাক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষরাই বাংলার প্রকৃত অধিবাসী বাংলার প্রাচীন যে জনপদগুলো, পুণ্ড্র পৌণ্ড্র তাম্রলিপ্তি দামলিপ্তি এবং গঙ্গা ও বঙ্গ সব নামগুলোই নাকি অষ্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীর দান সোজা কথায়, ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে এই অষ্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীই আজকের বাঙালির পূর্বপুরুষ 
এই মতের পেছনে যথেষ্ট যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যাও আছে
প্রোটো-অষ্ট্রালয়েড যুগে ভাষার দুই প্রধান ভাগ অস্ট্রোনেশিয়ান এবং অস্ট্রো-এশিয়াটিক অস্ট্রো-এশিয়াটিক বা ইন্দো-ইরানী ভাষাবর্গের পাঁচটি ধারা চাম বা চাম্পা, খাসিয়া, মনখেমর, নিকোবরী, মুণ্ডারী বা খেরোয়ালী খেরোয়ালী ভাষার মধ্যের পরিচিত ভাষা যেগুলো এখনো এদিকে চলে আসছে, সেগুলো কোরওয়া, অসুর, তুরি, হো, কোড়া, বিরহর, ভূমিজ, মুণ্ডারী, মাহালি, করমালি, সাঁওতালি
বেশ কিছু প্রামাণ্য গ্রন্থ দেখিয়েছেন যদুপতি মাহাতো এই মূহুর্তে দুটো নাম মনে পড়ছে সুহাসের রামদাস টুডু রেস্কা, আর খেরোয়াল বংশা ধর্ম পুঁথি লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র মতে সাঁওতালি যে প্রাচীন ভাষা এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই এমনকি সংস্কৃত ভাষার মধ্যেও প্রচুর সাঁওতালি শব্দের অনুপ্রবেশ হয়েছে
সিংভূম, মানভূম, ধলভূম, ধানবাদ, হাজারিবাগ এখন আর বঙ্গভূম নয়, কিন্তু এ অঞ্চলের আদি ভাষা বাংলা-ই পাশাপাশি মাগহী, সাদরি, পাঁচপরগনিয়া এবং কুড়মি ভাষার ব্যবহার চলে আসছে আজও প্রাচীন বাংলা চর্যাপদের ভাষা
খুব ইণ্টারেস্টিং বিষয় সারদার এসব নিয়ে আগ্রহ নেই, মিমিকে একদিন বলতে হবে ব্যাপারটা
যে সাহিত্যকীর্তি লিখিত নয় তা মৌখিক পরম্পরায় কিছুদিন বাঁচে, তারপর হারিয়ে যায় ছড়া, গীত, ধাঁধা, প্রবাদ, প্রবচন, পুরাতনী গান গ্রামের মানুষের লৌকিক সংস্কার, পাহাড় পর্বত বৃক্ষ জীবজন্তু এইগুলোই শব্দ মূলত কে জানে বিশেষ অর্থ আছে কিনা
কি হবে এত খোঁজ করে? স্থানীয ও কালিক বিকৃতি থেকে এই শব্দগুলোই হয়ত অন্য চেহারা নেবে কিছুদিন পরে

স্যার’, গাড়ি দাঁড় করিয়েছে নির্মল রগরগি এসে গেল!
না স্যার, এই যে বাড়িটা জ্যোত্স্না মুর্মুর বাড়ি ওই যে সেল্ফ-হেল্প গ্রুপে খাতা খুলিয়েছিল সাতজন মেয়ে-বউ মিলে
হ্যাঁ, গণেশ মুর্মুর পরিবার
গণেশ মুর্মুর ধানকল আছে, যা কিনা এদিকে খুবই দুর্লভ হেডঅফিস থেকে টার্গেট দিয়েছিল, একদিনের মধ্যে তিনটে এস-এইচ-জি অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে সেল্ফ-হেল্প-গ্রুপ অ্যাকাউন্ট হেডঅফিস তো টার্গেট দিয়েই খালাস গ্রামের মানুষকে বুঝিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলানোর ঝক্কি কত তারা জানে না একদিনের মধ্যে অতগুলো মানুষ জোগাড় হবে কি করে?
ধু ধু মাঠ, মাইলের পর মাইল পার হয়ে গিয়ে একটা দুটো গ্রাম বিডিও অফিসে যোগাযোগ করে একটা স্বনির্ভর গোষ্ঠী জোগাড় হয়েছিল গণেশ মুর্মু নিজে থেকেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘আমার ঘরে পাঁচ সাতজন বহু বিটি মিলবে একটা এস-এইচ-জি আমি ব্যবস্থা করছি
লোন দেওয়া হয়েছে পাঁচ লাখ সুদে আসলে সেটা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ বারবার বলা সত্ত্বেও একটা টাকাও জমা পড়ে নি
ভাল করেছ গাড়ি দাঁড় করিয়ে চলো, দেখা করে আসি

আরে আরে মানজার সাহেব যে আসেন আসেন এদিকে এসেছিলেন বুঝি ?’ গণেশ মুর্মু বিগলিত, ‘আমি এখুনি বেরোচ্ছিলাম আরেকটু পরে এলে আর... এ সুবল, যা যা জলদি মিঠাই নিয়ে আয়.. আর ভাবীকে বল চায় নাস্তা পাঠাতে
না না, কিছু খাবার লাগবে না আমরা এখনি উঠব তবে ভাবীজিকে একবার ডাকতে হবে, মানে আপনার ভাবীজি জ্যোত্স্না মুর্মু
কেন বলুন তো? ওহ আচ্ছা, ওই লোন নিয়ে? ব্যাঙ্ক থেকে লোক-আদালতের চিঠি এসেছে তো আমি ওদের নিয়ে যাব চিন্তা করবেন না সাহেব আমার ওপর ভরসা আছে তো?’ হা হা করে হাসলেন
সে তো জানি আপনি আমাদের বিশেষ কাস্টমার নিজেদের লোক তবু...
নির্মল বলে উঠল, ‘আসলে মানজার সাহেব একটা নতুন লোনের কথা বলতে এসেছেন এস-এইচ-জি গ্রুপের নতুন স্কিম তাই নিজে কথা বলতে এসেছেন জ্যোত্স্না মুর্মুকেই বলতে হবে, কাগজে সাইন করতেও হবে আসলে ব্যাঙ্কের নিয়ম, আপনি তো সবই বোঝেন
এই লোনের ওপর আরো লোন?’ উত্সাহে চকচক করে উঠল গণেশ মুর্মুর দুচোখ, ‘আসলে ভাবীজি তো এ বাড়িতে থাকে না আমি খবর পাঠাচ্ছি ততক্ষণ আপনারা চায় নাস্তা করুন, আমার বাড়ি এসে শুধু মুখে চলে যাবেন? কিরকম লোন, আমাকে বলা যায়?’
হ্যাঁ হ্যাঁ, বলাই যায় আপনি যদি আরো দুএকটা এস-এইচ-জি করিয়ে...
দেব তো, সেজন্যেই বলছি’, মুখের কথা কেড়ে নিলেন একটু সংশয় তারপর, ‘আগের লোন শোধ না দিলেও হবে?’

টোপ গিলেছে গরমের কষ্ট মুছে গেল, হেসে উঠল সুহাসও হবে, শুধু আগের লোনের সুদ জমা দিতে হবে টপ-আপ লোন হবে তারপর আরো তিনলাখ কিছু ফর্মালিটি আছে, ব্যস ওদের রেডিমেড কাপড়ের স্টকটাও একটু দেখে নেব
কাপড়ের স্টক?’ পলকে গম্ভীর গণেশ মুর্মুর মুখ, ‘তাহলে একদিন আগে থেকে খবর দিয়ে আসতে  হবে মানজার সাব ওগুলো আমার ভাবী দেখে না, ও এতসব কিছু বোঝেও না আমার বড়ভাই দেখাবে আপনাকে
আপনার বড় ভাই? কিন্তু ব্যাঙ্ক তো আপনার ভাইয়ের কাছে কিছু শুনবে না ব্যাঙ্ক জ্যোত্স্না মুর্মু আর এই মেয়েদের চেনে, যারা এস-এইচ-জির মেম্বার
ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে নির্মল, একটু উসখুস করে উঠল ওর চোখ দুটো কি কিছু বলতে চাইছে? গণেশ মুর্মু, শক্ত চোয়াল, জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে
জ্যোত্স্না মুর্মুর বাড়িটা কত দূরে? আমার কাছে গাড়ি আছে, আমিই চলে যাব একবার?’ গম্ভীর হল সুহাসও
আসছে, আসছে খবর পাঠিয়েছি এত তাড়া কিসের মানজার সাব?’ অপরিচিত অদ্ভুত একটা চাউনি, ‘এ নির্মল, সাহবকে আমাদের গাঁয়ের খবর বলিস নাই? ইখানে আসাটা নিজের ইচ্ছায়, যাওয়াটা আমাদের ইচ্ছা?’
আসলে আমরা তো রগরগি যাচ্ছিলাম, ইদিক পানে আসার প্ল্যান ছিল নাইনির্মল হঠাত্ এমন মোলায়েম হাত-কচলানো ভাষায় কথা বলছে কেন? ‘চলুন স্যার, ভাবীজির সঙ্গে আরেকদিন আসে দেখা করব খবর দিই আসব
হাওয়াটা ভালো বুঝছে না সুহাসও কাপড়ের স্টক দেখার কথা বলতেই হাওয়া ঘুরে গেল কেন? তাহলে কি সেই নিশ্চিন্তা গ্রামের মতো কেস?

মিনিস্টারের সামনে বাহবা নেবার জন্যে সাতদিনে অসম্ভব সব টার্গেট দেওয়া হয়েছিল না কোনো গ্রাহকের ঠিক করে স্ক্রুটিনি হয়েছিল, না অ্যাসেট কোয়ালিটি যাচাই নিশ্চিন্তা গ্রামে সরকারি আমলারা এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাক্টরকে না দেখে যা ইচ্ছে তাই অ্যাক্টিভিটি ঠিক করেছিলেন কেউ হয়ত মাটির পুতুল তৈরী করে, তাকে দুধেল গাই দেওয়া হয়েছে ভাতুয়ার কাজ করে ক্ষেতে, তাকে দেওয়া হয়েছে মুদি দোকানের চেক দুধেল গাই-মোষ, সাইকেল, রেডিমেড কাপড়ের স্টক, মুদি দোকানের সাপ্লায়ারকে চেক
ইন্সপেকশনে গিয়ে ব্যাপারটা ধরেছিল পল্লব, সুহাসের দীর্ঘদিনের সহকর্মী অত্যন্ত বুদ্ধিমান, সত, নির্লোভ অফিসার আর বাড়ি ফেরা হয় নি পল্লবের পল্লব-মৌসুমীর বিয়েতে বরযাত্রী গিয়ে উপহার তুলে দিয়েছিল সুহাস, কম্পেনসেটরি গ্রাউণ্ডে চাকরির চিঠিও মৌসুমীর হাতে তুলে দিয়েছিল সুহাসই
ফিল্ড-অফিসার হবার ট্রেনিং-এ লোন-রিকভারি করার নানা টেকনিক, নানা পরিস্থিতির কথা শেখানো হয়েছে নানা অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছে অনেকেই ঋণ-খেলাপি মানুষজন সবাই ব্যাঙ্কের ভয়ে মাথা নিচু করে থাকবে না আর অনেক ক্ষেত্রেই আগুপিছু চিন্তা না করে গায়ে হাত তুলে দেয় তারা

কে আসছে? কই দেখি কত বড় সাহাব আসছে?’ গমগমে গলায় জোরে জোরে কথা বলতে বলতে উঠে এল একজন দরজার কাছ থেকে নির্মল সরে গেল, লোকটা এসে দাঁড়িয়েছে দরজা জুড়ে বাইরে প্রখর রোদ, লোকটার মুখ দেখতে গিয়ে চোখ ঝলসে এল একটা খাটো লুঙ্গি, খালি গা, গলায় একগোছা মালা মুখ দিয়ে ভকভক করে গন্ধ বেরোচ্ছে, সাত সকালে নেশা নিয়ে বসে গেছিল নাকি? এখনও তো বেলা এগারোটা বাজে নি
কি চাই সাহাব? আমাদের ঘরের বউ বিটি দিকুদের সঙ্গ সঙ্গ দেখা করবে নাই
দিকু, অর্থাত্ বাইরের লোক
উয়ারা ব্যাঙ্কের লক আমার চিনা লক’, গণেশ মুর্মু বলে উঠল, ‘তু ঘরকে যা আমি দেখে লিছি
ব্যাঙ্কের চিনা লক! তালে তো কুনো ভাবনা নাই তবে আয় কিনা, তুদের একটুক খাতিরদারি করি’, বেড়ালের মুরগীর ছানা ধরার মতো নির্মলের ঘাড় ধরে উঠোনে নেমে গেল লোকটা উঠোনে পাঁচ সাতজন তাগড়া সা-জোয়ান হাতে তীর-ধনুক দা, কাটারি, বল্লম
আয় কিনা সাহাব, আয় ই গাঁয়ের মজার খেলাটা দেখবি নাই? তুদের ভাগ খুব ভাল, পীরসরদার আজ খেলা দেখাইতে আসছে
আসুন সাহেব কোনো ভয় নাই’, গণেশ মুর্মু হাসছে
ভয় করে আর কি হবে? যা হবার, তাই হবে রিকভারি, লোক-আদালত মাথায় থাক, মানে মানে এখান থেকে বেরোতে পারলে হয় নির্মল কোথায় গেল?
ওই তো, গাছের নিচে গোল একটা ভিড় দশ বারোটা ঝাঁপি নিয়ে বসে আছে একটা লোক নীল চেক লুঙ্গি, গায়ে একটা হলুদ চাদর, মাথায় চৌকো টুপি, হাতে মোটা কালো বালা, গলায় তাবিজ নির্মল এগিয়ে আসতে চাইল, পারল না ওকে ঘিরে রয়েছে তিনটে লোক
আসুন পীরসরদার দারুণ সাপের খেলা দেখায় আসুন মানজার সাহেব, ভয় নেই
যতবার ভয় নেইকথাটা উচ্চারণ করছে গণেশ মুর্মু, চোখদুটো অদ্ভুত হাসছে

এই অচেনা গাঁয়ে শেষ হয়ে যাবে সব? আর বাড়ি ফেরা হবে না? সারদা কি সব সামলাতে পারবে একা? মিমিটা যে এখনও খুব ছোট
ভয় পেলেও দেখানো চলবে না নার্ভ ঠান্ডা রাখতে হবে বড় করে শ্বাস নিল সুহাস
একটু হাসার চেষ্টা করল তারপর, ‘আমাদের হাতে কিন্তু সত্যিই সময় নেই আরো সাত আটটা জায়গায় যাবার কথা
ততক্ষণে ঝাঁপি খুলে সাপ বের করে ফেলেছে পীরসরদার শঙ্খচুড় হাত দিয়ে গলার কাছটা ধরে আছে উল্লাসে চিত্কার করে উঠল ভিড়টা, ‘আর টুকু ছাড়ি দে সরদার
গলার কাছে আলগা করতেই অনেকটা এগিয়ে গেল সাপ পেটের কাছে ধরে আছে এখন, লেজ পাকিয়ে নিয়েছে লোকটার হাতের কব্জি থেকে কনুই মস্ত বড় সাপ তবে খেলা দেখাচ্ছে যখন, নিশ্চয় বিষদাঁত ভাঙা আছে
না-বলা কথাটা বুঝে ফেলল গণেশ মুর্মু, ‘পীরসরদারের কোনো সাপের বিষদাঁত ভাঙা থাকে না ওটাই আসল মজা

এক হাতে শঙ্খচুড়, অন্য হাতে অদ্ভুত কায়দায় একটা ছোট ঝাঁপি খুলে ফেলল পীরসরদার সরু ছোট্ট একটা সাপ লাফ মেরে উঠে পড়ল গাছের ডালে হাতখানেক লম্বা সরু সাপ, গাছের ডালের রঙে মিশে আছে ভয়ের চাপা চিত্কার, ভিড়টা পিছিয়ে গেল খানিক মিটিমিটি হাসি, পীরসরদার হাতের কায়দায় সাপটাকে আবার ঝাঁপিতে ভরে ফেলল ভিড়ের হাততালি
সাংঘাতিক বিষ ওর, চোখের পলক ফেলার আগে ছোবল দিয়ে দেয়’, গণেশ মুর্মু বলল, ‘এ সাপ কোনোদিন দেখেন নি বোধহয়
শঙ্খচুড় ফনা তুলে দুলছে নির্মলের পায়ের ঠিক সামনে আজ জুতো পরে আসে নি নির্মল, ভয়ে ওর মুখ শুকনো সম্মোহিতের মত চেয়ে আছে সাপের দিকে
সাপটা সরাতে বলুন’, সুহাসের গলা গম্ভীর গণেশ মুর্মুর চোখের দিকে স্থির দৃষ্টি নার্ভের লড়াইটা জিততে হবে চোখে চোখে চেয়ে রইল গণেশ মুর্মুও
হাতের কায়দায় আরেকটা ঝাঁপি খুলে একসঙ্গে তিন চারটে কালো কালো সাপ বের করে ফেলেছে পীরসরদার শঙ্খচুড় ফণা তুলে স্থির, অল্প অল্প দুলছে
কালনাগ কালনাগভিড়টা ফিসফিস করছে, ‘কালনাগ আর গোখর সাপ লড়বে

মোবাইল ফোন বের করল সুহাস দুটো তাগড়া লোক এসে পাশে দাঁড়িয়েছে, ‘ফোনে কথা বললি সাপ রাগ করে এখন ফোন করা চলবেক নাই
বিষাক্ত সাপ, আমরা রিস্ক নিই না ওরা কিভাবে রিয়াক্ট করবে আমরাও জানি না প্রতি বারই খেলা দেখতে এসে দুচারজন সাপের ছোবল খায়গণেশ মুর্মু বলে উঠল
কথা বলছি না, আমি ছবি তুলছি
নির্মল ডাকল চাপা গলায়, ‘স্যারওকে ঘিরে থাকা লোকগুলো হাসছে প্রাণ ভরে, ‘ডর লাগছে? তু তো গাঁয়ের ছেল্যা এত ডরিস নাই
না না নির্মল, ভয় কিসের? সাপকে তো ধরেই রেখেছে সরদার এই দ্যাখো, ছবি তুলে পাঠিয়ে দিলাম হেড-অফিসে সবাই দেখবে তো, মজা পাবে কেমন...সুহাসও হাসছে এখন

ছবি তুলে? ওই ওয়াটসাপ না কি বলে, সেইটা ?’ গণেশ মুর্মু নব্বই ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়িয়েছে
হ্যাঁ এ গ্রামে এমন একটা মজার খেলা দেখলাম, শহরের লোকও জানুক তাই
কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা যাকে বলে, গণেশ মুর্মুর সেই অবস্থা এখন নেশায় চুর দাদাও কিছু একটা বুঝেছে, জোরে হাঁক দিল, ‘কি হইছে? কি বুলছিস উয়াকে?’
ছবি পাঠিয়ে দিয়েছেন? কি করে পাঠালেন? আমাদের গ্রামে তো ইন্টারনেট কানেকশনের কোনো ব্যবস্থা নেইগণেশ মুর্মুর সাবধানী প্রশ্ন
জিও জিও’, এতক্ষণ পরে নির্মলের গলা খুলেছে, ‘জিও ফোন ডেটা কার্ড গাঁয়ের ছেল্যাগুলানকে সুধাও ক্যানে
যাকগে চল নির্মল মুর্মুসাহেব, আপনার ভাবীজির সঙ্গে দেখা হল না লোক-আদালতের কাগজটা দিয়ে যাচ্ছি ব্যাঙ্কে দেখা করতে বলবেন এসো নির্মল, দেরি হয়ে যাচ্ছে
লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল নির্মল,‘চলেন সাহব আসি গ ভালা খেলা দেখলি তুদের গাঁয়

সার, কাগজটা আমায় দিনঅল্পবয়সী একটি ছেলে হাত তুলে ভিড়টা দেখালো, ‘আমার মা নাজ করছে আসছে নাই খুড়াবাবার সঙ্গ সঙ্গ আমি মাকে লোক-আদালত নিই যাব
ঠিক আছে, তোমার মাকে আসতে হবে না কিন্তু এই গ্রুপের অন্য কেউ? এই যে বাতাসী মারডি, রুক্মিণী মারানডি এরা কেউ? কিংবা এই যে ইনি বাসন্তী মুর্মু, বয়স্ক মানুষ তো, আমার মাযের বয়সী ওঁকে ডাকতে পারবে? আসলে এই কাগজে আমরা একটা টিপ-ছাপ নেব
আমাকে দিন স্যার আমি বলছি’, নির্মল এতক্ষণে ফর্মে ফিরেছে, ‘টিপ্পা ছাপ লাগবে কেউ একজন দাও আর বলছিলাম কি, সেইসঙ্গে একশদুইশযা হয় একটা কিছু কি বলেন বড় ভাই?’
গণেশ মুর্মু এত নাকাল বোধহয় কোনোদিন হয় নি কথা বলতেই পারছে না
আমার মা এই পাঁচশটাকা দিয়েছে, তুমরা ব্যাঙ্কের কাগজে লিখে নাও’, ছেলেটা বলল
বাহ এই তো বুঝেছেন সবাই’, মেয়েদের ভিড়টার দিকে চেয়ে জোরে জোরে বলল সুহাস, ‘লোক-আদালতে মুর্মুসাহেব নিয়ে যাবেন আপনাদের কাউকে সব বুঝিয়ে বলেও দেবেন ওয়েল মিস্টার মুর্মু, আমরা তাহলে এগোই?’


~তিন~

গাড়িতে উঠে ঘাম মুছছে নির্মল আর খুব হাসছে
দারুণ স্যার দারুণ বহুত মজা লেগেছে আমার মোবাইল তো আজকাল সবার হাতে নিজে করুক না করুক, ফেসবুক হোয়াটসআপ সবাই নাম জানে মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলা, সেলফি তোলা সব শিখেছে
আচ্ছা, এখন এসব কথা থাক জোর ঝামেলা থেকে বেঁচেছি শোনো নির্মল, হুটহাট যে কোনো জায়গায় গাড়ি দাঁড় করাবে না দ্যাখো, ইতিমধ্যেই কত গ্রামে খবর চলে গেল আমরা আসছি তাড়াতাড়ি রগরগি চলো
হ্যাঁ স্যার, মাত্র দুজন আমরা বেঁধে রেখে দিলে যে কি হত!
বেঁধে রাখার সাহস হয়ত হত না কিন্তু ভয় দেখিয়ে দিতে পারলেই ওদের লাভ
না স্যার, আপনি জানেন না, এরা যে কি করতে পারে মাথায় রোখ চাপলেই হল আগুপিছু ভাবে না তো কি থেকে কি শাস্তি হয়, সেসব এদের মাথায় থাকে না আগে তো মেরে ফেলি, তারপর জঙ্গলে পালিয়ে থাকব এই মনের ভাব খুব বেঁচে গেছি স্যার
ঠিক আছে, ঠিক আছে আমার বাড়ি গিয়ে যেন এসব গল্প কোরো না যাকগে, একটা কথা বলো তো রগরগি যাবার রাস্তায় পাহাড়পুর পড়বে না? এই যে ম্যাপে দেখাচ্ছে? মোহন টুডু, আর শঙ্কর টুডু দুটো লোনই সদ্য এনপিএ হচ্ছে যাবে নাকি?‘
শঙ্কর টুডু তো সেদিন ব্যাঙ্কে এসেছিল স্যার কেসিসি চাইছিল মুখার্জিস্যার বলেছেন, আগের লোনটা শোধ হলে কেসিসি দেবেন আমি জানি স্যার, ও টাকা দেবে না দুটা সংসার, দুটা বউ টাকা দেবে কথা থেকে? তারপর শুনে নিয়েছে, লোন এনপিএ হয়েছে সব জানে এখন, বলছে লোন রাইট-অফ করে দিতে

হ্যাঁ, আজকাল তথ্য গোপন রাখার উপায় নেই সবাই সব জানে
লোন নেবার সময় হম্বিতম্বি, ‘গরমেণ্ট লোন দেবে, তুমি ব্যাঙ্কের লোক লোন দেব না বলার কে?’ রাজনীতির লোক নিয়ে আসবে সঙ্গে, নেতা টেবিল চাপড়ে বলবেন, ‘আমার ছেলেদের লোন দিতেই হবে ওসব কে-ওয়াই-সি ডকুমেন্ট ফকুমেণ্ট আমাকে দেখাবেন না চাকরি করতে এসেছেন তো, নাকি?‘
তারপর লোন শোধ দেবার সময় ফাঁকি দেবার নানা ফিকির, যে কোনো অছিলায় যদি ঋণ-মুকুব করানো যায় সে সময় মুরুব্বি নেতা মহাশয়ের খোঁজ পাওয়া যায় না

মোহনতো বাড়ি নাই সাহেব, কামে গেছে’, খাটো ধুতি পরা বয়স্ক লোকটি দরজা ধরে দাঁড়িয়ে, ‘আমি তার বাপ কি বলতে হবে বলে যান
পাঁচ সাতটা কুচোকাঁচা তখন গাড়ি নিয়ে পড়েছে কেউ বনেটে উঠে বসেছে, কেউ ওয়াইপার টেনে খেলা করছে, কেউ মিরর খুলে মুখ দেখার চেষ্টায় একজন গাড়ির চাকার কাছে বসে কি যেন করছে একজন পাতলা একটা শুকনো গাছের ডাল নিয়ে গাড়ির জানলায় জানলায় মারছে
হেই হেই, কি করছিস রে তুরা?’ নির্মল দৌড় লাগিয়েছে গাড়িটা ওর প্রাণ

আজ তো রবিবার কাজে গেছে মানে? আর আপনাদের তো ঘানি নিজের বাড়িতে, সেখানেই তো কাজএই ঘানি দেখিয়েই লোন নিয়েছিল মোহন টুডু
না না, ঘানি বন্ধ রোজগার নাই, ঘানি চালাই কি হবে? মোহন এখন গাড়ি চালায়, মুখিয়ার গাড়ি বাড়ি নাই
আচ্ছা কিন্তু ঘানি বন্ধ, সে খবর তো ব্যাঙ্কে দেয় নি আপনার ছেলে বলবেন, একবার ব্যাঙ্কে যেতে কেমন? আর... এই কাগজটা রেখে গেলাম লোক-আদালত বসবে আগামী রবিবার, আসতে বলবেন মোহন তো ফোনও ধরেন না, তাই আসতে হল
মোহন টুডু বাড়ি নেই, দুপাঁচশরিকভারির আশাও নেই

গাড়ির কাছেই ফিরছিল আশেপাশের সব বাড়ি থেকে লোকজন বেরিয়ে এসেছে, ব্যাঙ্কের দ্রষ্টব্য মানজার সাহেবকে দেখতে
'শঙ্কর টুডুর বাড়িটা কোন দিকে?'
একটা ছোট ছেলে, নোংরা একটা হাতকাটা জামা গায়ে কৌতুহলী চোখে এই শোনো, শঙ্কর টুডুর বাড়ি দেখিয়ে দেবে?’ ছেলেটা ভাষাহীন চোখে চেয়ে রইল
চেনো? শঙ্কর টুডুর বাড়ি?’ আবার জিজ্ঞেস করল সুহাস
উ পুকুর ধার দিই যেতে লাগবে’, দর্শক ভিড়ের কেউ একজন বলল
কোন শঙ্কর টুডু? সোমায়া টুডুর ছেল্যাটা?’ বয়স্ক একজন
উ তো গাঁয়ে নাই শ্বশুরঘর গেছে বেটা হইছে উয়ার
ধুস পাহাড়পুর গ্রামে কোনো কাজই হল না শুধু শুধু সময় নষ্ট আনমনে পুকুরটার দিকেই চেয়ে ছিল সুহাস টলটলে জল, গাছের ছায়া পড়ে মায়াবী সবুজ ভারি সুন্দর রুক্ষ রুদ্র মায়াহীন গ্রামে প্রকৃতির দান
ও কি? একটু চমকে উঠল তারপর জলের মধ্যে অমন ভুরভুরি দিয়ে উঠল কেন?
দুষ্টু ছেলেদের হাত থেকে গাড়ি উদ্ধার করে নির্মল বীর সৈনিকের মতো নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে ওকে আর ডাক দিল না সুহাস পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল পুকুরের দিকে
তারপর হেসে ফেলল
বীরভুমের বড়মাসির বাড়ি, বাড়ির লাগোয়া পুকুর এক লহমায় ভেসে উঠল বহুযুগ পার হয়ে ভাইয়েরা মিলে এমন করেই জলের নিচে লুকিয়ে থাকত, কার কত দাম দেখার জন্যে কিংবা মা-মাসিদের হাতের তাড়না থেকে বাঁচার জন্যে
উঠে আসুনগম্ভীর হল একটু জোর করেই
মাথা নিচু, পায়ে পায়ে পুকুর থেকে উঠে আসছে মোহন টুডু আর শঙ্কর টুডু হাহ ভিড়ের মধ্যে থেকে আফসোসের দীর্ঘশ্বাস
ভিতরে আসেন সাহাববয়স্ক মানুষটি এগিয়ে এসেছেন, ‘আগেই বলতেছিলাম আমি, খাজাঞ্চীবাবুর চোখ হল বাজপাখির চোখ ইসব মতলব করিস নাই

লোক-আদালতের নোটিশ, দুশদুশচারশটাকা রিকভারি ছাড়াও লোনের রিভাইভাল ফর্মটাও সই করিয়ে নিল সুহাস
আজ ভালই রিকভারি হল, না স্যার?’ রগরগি দেখা যাচ্ছে দূরে
অনেকদিন পর এমন জঙ্গলের পথে চলা জারুল কুর্চি শিমুল পলাশ জঙ্গলের গন্ধ ছায়া ছায়া পথ মায়া মায়া শান্তি কিন্তু সুহাস জানে, সবটাই এমন নিবিড় শান্ত নয়

ভালো বলা যায় না তবে হ্যাঁ, লোকগুলোকে ধরা গেছে, লোক-আদালত নোটিশ সই করে ধরানো গেছে, লোন-অ্যাকাউন্টে সামান্য হলেও টাকা জমা পড়ছে অন্তত শুধু হাতে ফিরেছি বলতে হবে না চলো,দেখি এ গ্রামে কি পাওয়া যায় লিস্টটা দাও তো, নামগুলো একবার দেখে রাখি
স্যার, অলিনকে ডেকে নিই? ও এদিকের গাঁ, গাঁয়ের রাস্তা সব চেনে অলিন সঙ্গে থাকলে মানুষজন কথা বলতেও আসবে ও উয়াদের ভাষায় কথা বলবে
অলিন কে? আমি চিনি?’
ওই যে স্যার, অলিন বাস্কে, সহায় স্যারের সঙ্গে আসে রেমিটেন্স নিতে বকপুর বাজার ব্রাঞ্চ
ও আচ্ছা, দেখলে চিনতে পারব হয়ত অলিন আবার কেমন নাম?’
অলিন, অলিন আপনাদের বাঙ্গালিদেরও তো অলিন নাম হয় স্যার
অলিন! বাঙালি নাম! ওহ, অনিল! নিজের মানেই হেসে ফেলল সুহাস তিন বছর হয়ে গেল, এখনও এদিকের ডায়লেক্ট চেনা হয় নি
ততক্ষণে ফোনে যোগাযোগ করে অনিল থুড়ি অলিনকে ডেকে নিয়েছে নির্মল
জোহার সার দেখি লিষ্টিটা... রাজারাম বাস্কে, পাওয়া মুসকিল সার, সারাক্ষণ লিশা করে আউট থাকে সুনাদা বাস্কে, হ চিনি বটে, পাওয়া যাবেক মনোহর সোরেন, ই তো উ গাঁয়ের জামাই বটে, সিখানে কি পাওয়া যাবেক? দেখি চলেন আর ইট কে বটেক? সুখ... সুখ... সুখরা বাস্কে? ই নামে তো... ইয়ার বাপের নামটো লিখা নাই? সুখরা... সুখরা... দীঘরা নামে একজন আছে,‘ নিজের মনেই বলে চলেছে অনিল, ব্যাঙ্কের একটা এমন কাজ পেয়ে বেশ উত্তেজিত
বেশ মিশন রিকভারিধরণের উত্তেজনা না, ‘মিশন রিকভারিনয়, ‘মিশন অনুসন্ধান মানুষগুলোকে খুঁজে পেলে তবে তো রিকভারি

জঙ্গল শুরু হয়েছে সারি দিয়ে গাছ বুনোখেজুরের ঝোপ এপ্রিলমাসের জঙ্গল, ঝোপঝাড় শুকিয়ে গিয়ে পাতা ঝরে গিয়ে মাঝে মাঝেই জঙ্গলে অনেকখানি করে খোলা জায়গা বুনো পাখি, মেঠো
ইঁদুর বুনো পেঁপে, কুঁদ্রু, ঝিঙে, নেনুয়া অল্প ধান চাষ হয় যখন, ব্যাঙ্কের কিছু বিজনেস তো আছেই এদিকের গ্রামে এখনো শহুরে মানুষের পা তেমন করে পড়ে নি
কিন্তু শুধু ব্যাঙ্কের বিজনেস বাড়ানো নয়, মনের কোণে তো লুকোনো নেই, কেমন এক চোরাটান
পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘন সবুজ জঙ্গল কালচে পাথুরে জমিতে সবুজের মেলা ধানক্ষেত, তাল গাছ, বুনো খেজুরের ঝোপ, মহুয়া, অশ্বত্থগাছ একে একে পার গাঁয়ের দেখা নেই এত গাছ, তবু মাঝে মাঝেই গরম হাওয়ার ঝোঁক
রাখ, রাখ, ইখানেই রাখ ক্যানে’, অনিলের ডাকে ঘোর কাটল
গায়ে গায়ে লাগানো পাঁচটা কুঁড়েঘর মাথায় খড়ের চাল
'মহেশ মারান্ডি নাম ছিল না লিষ্টিটায়? ইটা উয়ার বাড়ি মহেশ জর্জ মারান্ডি হইছে ইখন কিরিশ্চান বস্তী পড়ালিখা মানুষ আছে, লোক-আদালত নোটিশ বললেক বুঝবে

মহেশের কুঁড়ের একদিকের দেওয়াল জুড়ে কিরাত-কিরাতী, ধনুর্ধর অর্জুন শঙ্খের ছবিও আছে আরেকদিকের দেওয়াল জুড়ে শুয়োরের ছবি একটা লাঙল, দুটো গরুর গাড়ির চাকা দরজায় কড়া নেড়ে মহেশ মারান্ডির স্ত্রীকে বুঝিয়ে ফেলল অনিল নিজেই রিকভারির টাকা দিতে পারল না মহিলা, কিন্তু বেশ ইংরেজিতে সই করে নোটিশ নিল কথা দিল, স্বামীকে সঙ্গে করে ব্যাঙ্কে আসবে ঠিক সময়
এই এদিকের জঙ্গল পেরিয়ে বাসরাস্তা পার হলেই যে মাধোপুর গ্রাম, ওই গ্রামেই একটা জিশুবাবার মন্দির হইছে লাল লাল টালি দিয়ে কেমন চমত্কার সোন্দর মন্দির দাড়িবাবা একজন সাদা আলখাল্লা পরনে পাহান আছে তাকে সবাই ফাদার বলে ডাকে  অনিল বেশ বুঝিয়ে সব খবর দিল, ‘ইয়াকে নিয়ে ভাবনা নাই সার, ইয়ারা আজ বৈকালেই ফাদারের কাছে যাই করি ব্যাঙ্কের কাগজ সব বুঝি আসবে ফাদার উয়াদের ব্যাঙ্কে যেতেই বলবেক, চিন্তা নাই আসল চিন্তা মুখিয়া....বলতে বলতে হঠাত্ থেমে গেল অনিল
বলার দরকার নেই, সুহাস নিজেই জানে এসব ব্যাপার
রাস্তা পেরিয়ে তিনটে বাঁশবন পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আরো অনেকখানি তারপর একটা ডুলুং পড়বে আর একটা ছোট পাহাড় তারপর একটা ছোট বস্তী বারো ঘরের বস্তী রগরগি গ্রাম এত দূর থেকে ব্যাঙ্কে গিয়ে লোন নেবার কথা ভেবেছিল এরা? ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক-লোন এমন সব খবর জানবেই বা কি করে?

রগরগি ছাড়াও দশ গাঁয়ের থেকে মানুষজনকে লাইন করে নিয়ে গেছিল মুখিয়া আর পঞ্চায়েতের সর্দাররা সরকার সকল মানুষকে পঁচিশ পঁচিশ হাজার টাকা লোন দিবে কেসিসি দিবেকেসিসি মানে কী, লোন মানে কী, কেউ বুঝিয়ে বলে দেয় নি
মুখিয়া নয়, ব্যাঙ্কের লোকও নয় মুখিয়া বলেছিল, ‘সরকার টাকা দিছে বীজা কেনো, খাদ কেনো, জমিনের কাজ করো
খাতা খোলার কাগজে টিপ ছাপ আর দুটো করে ছবি মাধোপুর জায়গাটা একটু গঞ্জ মতো, সেখানে গিয়ে লাইন দিয়ে ছবি তুলে আসা ব্যাঙ্কে লাইন দিয়ে খাতা খোলা তারপর নগদ নগদ টাকা ব্যাঙ্কের দরজার সামনে ধুলো মাটিতে আশপাশের দশ বিশটা গাঁয়ের মানুষ ঠিক যেন পরবের মেলা
কেউ মুখে কিছু না বললেও সুহাস জানে, পঁচিশ হাজার টাকা থেকে এই অশিক্ষিত অজ্ঞান মানুষরা হাতে পেয়েছিল হয়ত পাঁচ হাজার মুখিয়া আর পঞ্চায়েত কিছু নিয়েছিল অবশ্যই বাকি টাকা জমা রেখেছিল মুখিয়া গাঁয়ে ধানের গোলা হবে, পুকুর কাটা হবে, সেচের জন্যে নদী থেকে খাল কাটা হবে এইসব বুঝিয়ে
এই গ্রামের ফাদার নাকি সবাইকে বুঝিয়েছিলেন, ‘সরকার লোন দিয়েছে টাকাটা দিয়ে দেয় নি লোন মানে ব্যাঙ্কে শোধ দিতে লাগবে
মুখিয়া বুলেছিল, ‘কুনো ডর নাই আমি আছি তুদের লোন শোধ করতে হব্যাক নাই ই লোনটা ইমনই বঠে মানজার সাহেবের সঙ্গে আমার সকল কথা হয়ে গেছে তুরা নিশ্চিন্তে আপন আপন কামকাজ কর
নিশ্চিন্তেই ছিল গাঁয়ের লোক সরকারের ওপর খুশি ব্যাঙ্কের ওপর খুশি খাবার নিয়ে, কাজকাম নিয়ে, বেঁচে থাকা নিয়ে কারো ভাবনা নেই হা সিংবোঙ্গা, বুঝি সুদিন ফিরা এল


~চার~

পাহাড়, জঙ্গল, আকাশ আর সিংবোঙ্গা এই নিয়ে জগত সমস্ত পরব জঙ্গল নিয়ে নাচগান, মাদল, ধামসা, কেন্দ্রি, রুতু সব  জঙ্গল নিয়ে করমপুজার জন্যে করমডাল, সরহুলের সময় শালফুল, ঘর ছাইবার জন্যে দুচারটে কাঠ-পাতা রান্না করার জন্যে মেয়েরা আনে দুচারটে কাঠকুটো রান্নাই বা কি! নুন আর ভুট্টা সেদ্ধ বুনো আলু, মেটে আলু খেতি হয় মেটেআলুর ধান যব বাজরা, আর আলু কেউ কেউ তার মধ্যেই ফুটিয়ে তোলে দুচারটে লাউ, ঝিঙে, নেনুয়া, বেগুন দশ মাইল দূরের হাটে গিয়ে বেচে আসে মেয়েরা
ছেলেগুলো হাঁড়িয়া খেয়ে পড়ে থাকে হাঁড়িয়া খেলে বেশ ঘুম-ঘুম ঝিমুনি, কাজের ইচ্ছে হয় না সঙ্গে কাঁচা ছোলা, ভিজিয়ে ফুলো ফুলো, নুন লেবু মাখিয়ে অমৃতের স্বাদ দুতিন মাটু হাঁড়িয়া আর ছোলা সিদ্ধ বেশ পেট ভরে থাকে এর বেশি দরকার পড়ে না
মাঝে মাঝে মনে বেশি ফুর্তি হলে চালভাজা, মহুলভাজা আর কালোই কালোই, শহরের মানুষ যাকে বাদলাপোকা বলে পরব এলে কুর্কুটের ডিম কুর্কুট, মানে পিঁপড়ে কুর্কুটের ডিমের বড্ড ভালো স্বাদ কুর্কুটের ডিমের জন্যে জান লড়িয়ে দেয় গাঁয়ের আদিবাসি
হয় আধপেটা, নয় খালি পেট নাচ গান মেলা নিয়ে বিভোর ভাল্লা শড়কি টাঙ্গি তীর-ধনুক নিয়ে শিকারখেলা চাষের জমি নেই বললেই চলে যেটুকু আছে, তাতেও টাঁড় মাটি একটা মাত্র ফসল কাঁকড়ভরা পাথুরে মাটিতে সামান্য ধান লাগায় বছরে
অভাব কি আর এক রকম?

এখানের ব্রাঞ্চে বদলি হয়ে এসে আশেপাশে গ্রাম প্রায় চষে বেরিয়েছে সুহাস কত মানুষ, কতগুলো গ্রাম, হিন্দু ইসলাম সরনা কতগুলো ধর্ম, চাষি কাঠুরে কাহার দোসাধ জেলে কতগুলো বৃত্তি, তবু দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এখানের লোকজন বিচ্ছিন্ন নিজেদের মধ্যেও বৈচিত্র্যময় জীবন, উদার বিশাল অরণ্যভূমি কিন্তু দারিদ্র্যের অভিশাপে বিপর্যস্ত মানুষ কৃষির ফলনও ভালো নয় অভাবের তাড়নায় খুদ কুঁড়ো খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি মেটাতে হয়
সরকারের নতুন সুবিধে, জনধন.. প্রধানমন্ত্রী বীমা.. মুদ্রা লোন..
এনপিএ, নতুন সরল লোন, নতুন নতুন অ্যাকাউন্ট...
ক্রস-সেলিং বিজনেস, এটিএম কার্ড, ইনসিওরেন্স বা মোবাইল-ব্যাঙ্কিং
ব্যাঙ্ক, টাকা, লোন, ডিপোজিট টাকা দিয়ে কি সব সুরক্ষার ব্যবস্থা হয় ? বিচ্ছিন্ন অশিক্ষিত এই সরল মানুষদের সুরক্ষার ব্যবস্থা ? দেশের কর্মকান্ডে এ দেশের কত মানুষই যে ব্রাত্য হয়ে রইল ! 
উন্মুক্ত প্রকৃতিতে বুঝি হৃদয়ের প্রসার ঘটে? আগে তো এসব নিয়ে কোনো ভাবনা আসে নি!

লোন রিকভারি লোক আদালত কি করে যে বোঝানো যাবে সব! 
একে তো বছর ঘুরতেই ব্যাঙ্ক থেকে চিঠি দলে দলে মুখিয়ার কাছে চিঠি পড়াতে গেছিল সকলে মিলে মুখিয়া বলেছে, ‘আমি কি কইরব? তুরা লোন লিয়েছিস ব্যাঙ্ক ধইরবে না? আমি তো কেবল গ্যারেন্টার হইছি
ব্যাঙ্কের অস্থায়ী কর্মচারী, বুধন হিমেশ দেওগম, এদিকেরই সব গাঁয়ের ছেলে, খবর এনে দিয়েছিল
লোন মানে তো কেবল পঁচিশ হাজার না সুদে আসলে আরো অনেক সরকারের টাকা, শোধ না দিলে ব্যাঙ্কের কিছু করার থাকবে না
ঋণ-খেলাপি মানেই ঘর, ঘরের সকল জিনিস, খেত, জমিন সকল ব্যাঙ্ক দখল নিবে না হলে জেল, ঘানি সরকার মানে জানিস তো? পুলিশ
পুলিশ! পুলিশকে গাঁয়ের লোক খুব ভয় পায়  যখন তখন ডান্ডা কিছু না পেলে কাঠচুরি বলে থানার লক-আপ, জেল গাঁয়ের লোক আর ব্যাঙ্কমুখো হয় না
সুহাসের মতো ম্যানেজার, ফিল্ড-অফিসারদের কাজ বেড়েছে
গাঁয়ের লোক আসছে না? তোমরা যাও মিটিং করো মুখিয়াকে সঙ্গে নাও, মুখিয়াদের সঙ্গে ব্যাঙ্কের সমঝোতা আছে গ্রামসভা বসানোর ব্যবস্থা করো, পঞ্চায়েতের লোকের সঙ্গে কি আর এমনি এমনি দহরম মহরম রাখা? দরকার হলে পলিটিকাল পার্টির লোক ধরো, কিছু খাইয়ে দাও... সব কি ব্যাঙ্ক বলে দেবে নাকি ? ইটস ইয়োর শো, দেখিয়ে দাও নিজের যোগ্যতা প্রোমোশন, অ্যাওয়ার্ড, অ্যাপ্রিসিয়েশন.. সব কি এমনি এমনি?

গাঁয়ে গাঁয়ে মিটিং করেছে সুহাস বুঝিয়েছে, ঋণ-খেলাপি মানে কি? বুঝিয়েছে, ঋণ-খেলাপি হলে গাঁয়ের মানুষের যেমন বিপদ, ব্যাঙ্কেরও তাই গাঁ মানে কি, দেশ মানে কি, সরকার মানে কি, কেসিসি কি, লোন কি ঋণ-খেলাপি হলেও অনেক অধিকার আছে ঘর সম্পত্তি বাজোয়াপ্ত করারও নিয়ম আছে এমনি এমনি সব ব্যাঙ্কের হাতে চলে যাবে, এই ভয়টা ঠিক নয় ব্যাঙ্ক সময় দেবে, টাকা দেবে, জমির অবস্থা দেখে বেশি টাকাও দিতে পারে আর ব্যাঙ্কের শর্ত না মানতে চাইলে আপত্তি করার অধিকারও আছে
আর সবচেয়ে বড় কথা, কোনভাবেই ঋণ-খেলাপি বা তার ঘরের জনকে হেনস্থা বা অপমান করার নিয়ম নেই কোনো ভয় নেই
গাঁয়ের লোক সত্যি সত্যি ভরসা পেয়েছে কিনা কে জানে, শিক্ষার অভাব যে মানুষের কত বড় অক্ষমতা! তবে সবাই ব্যাঙ্কের লোক দেখলেই পালিয়ে থাকে নি কেউ কেউ গিয়ে টাকা জমা দিয়েছে পুরনো লোন শোধ না করেও লোন পেয়েছে কেউ কেউ, সেই টাকা দিয়েই পুরনো লোনের কিছু শোধ নতুন হাল লাঙল, গরু কিনেছে
দেখেশুনে ভরসা হচ্ছিল তাই আজ লোক-আদালত নোটিশ দিতে বেরোনো

কিন্তু আধ বেলা যেতে না যেতেই জোরালো ধাক্কা মনের মধ্যে সত্যিই কি কিছু কাজ হচ্ছে ? শহরের কোলাহল, হেড-অফিস রিজিওনাল-অফিসের কর্পোরেট রাজনীতি, ব্যাঙ্কের বিজনেস, প্রোমোশন, অ্যাওয়ার্ড, অ্যাপ্রিসিয়েশন.. বড্ড অলীক ভাবনা এখানে এলে অনেকখানি আলাদা, নিজেকে যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে এখন
সকালে যখন বেরিয়েছিল, মনটা অন্যরকম ছিল মাত্র আধবেলা আধবেলায় একেবারে শক্তিহীন, অসহায় মনে হচ্ছে

আদিবাসীরা মাদল আর নাচ গান নিয়েই আছে নিজেদের চেনে না নিজেদের অধিকারের কথা বোঝে না এই জঙ্গল নিয়েই যে কতখানি অধিকার, আদিবাসী জানে না ভাবনার দুর্ভিক্ষ
স্কুল আছে, শিক্ষক নেই টিউবওয়েল আছে, তাতে জল নেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, ডাক্তার নেই কলেরা টাইফয়েডের ইনজেকশন আছে, স্বাস্থ্যরক্ষার শিক্ষা নেই অশিক্ষা আর দারিদ্র্য
এই যে রগরগির রবিবারের হাটে দল বেঁধে বেঁধে চলছে লোক, রাস্তায় এমন অনেকগুলো দলের সঙ্গে দেখা হয়েছে, একবারও কি জঙ্গলের পানে চোখ তুলে তাকাচ্ছে মানুষগুলো? মাঝে মাঝেই জঙ্গল ফাঁকা, কোথায় গেল কচি কচি করম গাছ? খোকা শাল? একটুও কি ভাবে কেউ?


~পাঁচ~

দূরে রেলের ব্রীজ, তার নিচে আলোছায়া বনশিউলির মাঠ পেরিয়ে ময়নাপাহাড় তারপর লাকড়াডুংড়ি, ফুলডুংড়ি তারও পরে মন্দির গাইচাদা মন্দির মন্দিরে দেবী খুব জাগ্রত দেবীর থানের মাঠেই রবিবারের হাট
জোরে ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়েছে নির্মল কি হল?
সামনে হঠাত্ করেই এসে পড়েছে একঝাঁক মুরগী ছানা একটা বড় ঝুঁটিওয়ালা মোরগও আছে
ইকটা মোরগার গায়ে লাগলে গাঁ-সুদ্ধ লক গাড়ি ঘিরবে টাকা চাইবে পাঁচশথেকে দুহাজার, যা ইচ্ছা আর দিতেই লাগবে নইলে মুদের ছাড়বেক নাইঅনিল বলল
প্রকৃতির রাজ্যে সভ্যতার পদক্ষেপ শুরু হতেই মানুষের প্রকৃতির কত বদল টাকা চিনেছে মানুষ সেটা ভালো কি মন্দ, তা নিয়ে ভাবনা আসে আজকাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে প্রকৃতির বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রকৃতিও কি বদলে যাচ্ছে? পণ্যসংস্কৃতি দখল নিচ্ছে আদিম সারল্যের সংস্কৃতির? সত্যিই কি সারল্য শব্দটা মূল্যহীন? নাকি সরলতার দুর্ভিক্ষ এখন?

গাড়ির আওয়াজে এগিয়ে এসেছে একজন মহিলা
হাতে একটা গামলা, সামনে পেছনে তিন চারটে ছাগলছানা একটা ছোট্ট কুঁড়ে একটাই ঘর, সামনে অনেকখানি উঠোন পরিষ্কার করে নিকোনো মাটির দেয়ালে শঙ্খ, সূর্য, ফুলের ছবি সাদা আলপনা ঘরের পাশে একটা লম্বা ছায়া ছায়া সজনে গাছ
সার, ভালা হইছে’, অনিল উল্লসিত হঠাত্, ‘রাজারাম বাস্কের বহু বটে ইদিকপানে ঘর বানাইছে, সি ধারে ইয়াকে পেতাম নাই
অচেনা মানুষ দেখে সঙ্কোচে সরে দাঁড়াল মহিলা মহিলা কোথায়, নেহাত কচি একটা বউ রাজারাম বাস্কে, কাগজের হিসেবে ছাপ্পান্ন বছর বয়স, দ্বিতীয় পক্ষ বুঝি আদিবাসী ছেলেমেয়েদের তো অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় নিজের ভাষায় মহিলাকে বুঝিয়ে চলেছে অনিল, পায়ে পায়ে উঠোনে নেমে দাঁড়াল সুহাস ছোট একটা ছেলে ছুটে পালাল পাশ দিয়ে
এ সুদাম, খাড়া খাড়াপলকে নরমসরম বউটির তীক্ষ্ণ কর্কশ কণ্ঠ, ‘বাপ কুথা গেল, ছুট করি ধরি আন দিকু আসছে, বুল কেনে যা যা, ছুট করি যা
গাছের একটা কাটা গুঁড়ির দিকে হাত দেখালো, ‘বসুন সাহাব
দেখতে নরমসরম হলেও বউটি বেশ সপ্রতিভ, তেমন গাঁয়ের বধূসুলভ লাজুক নয় নির্মল আর অনিল সব বুঝিয়ে বলতে লাগল বউটি সমানেই ঘাড় নাড়ছে, ‘উ কুথায় টাকা পাবেক? আমাদের কেরোসিন ধান্ধা তো আর নাই

আগে ছিল কেরোসিনের ধান্ধা রগরগি টেন্টোপুষি জরাইকেলা ষাঁড়বোয়া পিপড়বোয়া... গাঁয়ে গাঁয়ে মাথায় কেরোসিনের টিন নিয়ে ফেরি করত রাজারাম তারপর লাগু হল সরকারি কানুন ডিলার ছাড়া কেউ কেরোসিন বেচতে পারবে না ডিলারশিপ নিয়ে বিডিও অফিসে অফিসে মারামারি, হুজ্জোত মুখিয়ার বাড়ির লোক, মুখিয়ার দালালরা, পঞ্চায়েতের লোকেদের আত্মীয়স্বজন... ডিলার হয়ে গেল তারাই সেই থেকে রাজারামের উঞ্ছবৃত্তি

সাইকেলের স্ট্যান্ড নেই গাছে হেলান দিয়ে সাবধানে সাইকেল রেখে এসে দাঁড়াল একজন রাজারাম?
না, উয়ার সারুভাই বটেঅনিল বলে দিল
উ আসতে পারবেক নাই বহুত লিশা করেছে থানের কোনায় পিপল গাছের নিচে পড়ি আছে, কি কাম হামাকে বুল
নির্মল আর অনিল মিলে লোন, লোক-আদালত সব বুঝিয়ে বলতে লাগল আবার
কুথা থেকে দিব?’ বউটি কর্কশ স্বরে চিত্কার করে উঠল, ‘এ রামুখুড়া বুড়াবাবা সুধীর-ঠাউরপ’, ইখানে আয় কেনে
দুতিনজন মহিলা, চার পাঁচজন পুরুষ, একপাল কিশোর কিশোরীর ছোট একটা ভিড় জমে উঠল
ঠকঠক লাঠির আওয়াজ, লাঠিতে ভর করে খালি গা হাফপ্যান্ট এক যুবক ডান পা অপুষ্ট, একটু ছোট পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল, ‘এরা লোন শোধ করতে পারবে না কোনোরকম ইনকামই নেই এর ওর খেতে ভাতুয়া খেটে যেটুকু রোজগার
আপনি?’
সেনাবাহিনীতে ছিলামডান পায়ের দিকে ইশারা করল যুবকটি, ‘পা কাটা গেল বর্ডারে গিয়ে পেনশন পাই চাকরির ব্যবস্থাও হয়েছিল নিলাম না আর এখানের স্কুলে পড়াই এখন
এই গ্রামেই আপনার জন্ম? লেখাপড়া? তাই ফিরে এসেছেন? কিন্তু... এখানে তো কিছু নেই.. থাকতে পারছেন?’
না না, আমার জন্মস্থান নয় এ গ্রাম এই ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছি তারপর এখানের মায়ায় আটকে পড়েছি
ই মাস্টরবাবু আসি ইখানে ইশকুল খুলিছে আংরেজি পড়া ইশকুলকেউ একজন বলে উঠল
চেষ্টা করছি একটু...সঙ্কোচে হাসল যুবক

পূর্ণ গর্ভিনী একটি ছাগল ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল এইসময় রাজারামের স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে উঠল, আদরের ডাক দিয়ে হাতের গামলা এগিয়ে দিল মুখে, ‘যা কেনে তুরা, ইয়ার খাবার খাতি দেরি হই গেল তুদের জন্যি আয় মা সুবালা, আয় খাতি আয় মা
আহা নিজেদের খাবার নেই, অথচ পোষ্যপ্রাণীর জন্যে মায়া কত কষ্টে, কত শারীরিক শ্রমে যত্নে এ খাবারটুকু জোগাড় হয়েছে কে জানে এই অপরূপ দেখার নামই জীবন
ওর নাম সুবালা ?’ গলার স্বর নরম হয়ে এল সুহাসেরও হয়ত এই পশুপালন এই বধূটির সংসার চালানোর উপায় ছাগলের দুধ কিন্তু এই দরিদ্র গ্রামে সে দুধ বিক্রী হয় তো?
অকারণেই কৌতুহলী হল সুহাস, ‘সুবালা একাই? নাকি আরো পুষ্যি আছে আপনার?’
না না, আরো আছে ওই যে ঘুরছেযুবক বলল
হ্যাঁ, তাই তো প্রথম দর্শনেই স-অজ দর্শন হয়েছিল

উগুলা সব বেকার ইকটু পাঁচ সাত কিলো হই গেলেই ভাগাই দিব এই ইকটাই...বউ মানুষটির স্বরে বিরক্তি, ‘ই মাসেই হবেক ইটার সাত থেকে নয়টা হবেক দেখি ইবার যদি ভাগ ভালা হয় আমার ইমনিও ইবার ইটাকে বেচতেই হবেক বুড়া হলে আর বিকবে নাই
কি যে বলল, কিছুই বোঝা গেল না
প্রাক্তন-সেনানী যুবকটি হাসল, ‘কিচ্ছু বুঝতে পারলেন না, না? ওই যে ছানাগুলো, এই ছাগল-মায়েরই সন্তান কিন্তু বউয়ের ওদের পছন্দ নয় একটাও মেয়ে-ছাগল নয় যে কেউ বিযোবে না তাই পাঁচ সাত কিলো ওজন হলেই বেচে দেবে সুবালার কপাল ভালো, বছর বছর বিয়োতে পারে তাই ওর খুব আদর কিন্তু এত বছরেও আরেকটা মেয়ে-সন্তান হয় নি ওর এবার শেষ আশা, যদি একটা মেয়ে হয় ওরও বয়স হয়ে গেছে তাই এবার প্রসবের পরই ওকে বেচে দেবে বউ বুড়ো হলে আর দাম পাওয়া যাবে না যে

চোখ বন্ধ করে প্রবল নিশ্চয়তায় গামলায় মুখ ডুবিয়ে খাবার খাচ্ছে গর্ভিনী মা ও কি সব বুঝতে পারছে? ও কি জানে ওর ভবিতব্য? অবশ্য এই নিরাবেগ, এই মায়াহীনতা, এই ভালোবাসার দুর্ভিক্ষ আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে চেনা অনুভূতি 
বুকের মধ্যে কেমন একটা গুমোট চোখ দিয়ে এক পশলা বৃষ্টি নেমে এলে বেশ হত মাথার ভেতরের তালগোল পাকানো ভাবনাগুলো ধুয়ে মুছে যেত আশেপাশে কতগুলো সজনেফুল ঝরে পড়ল টুপটাপ তারপর ফুল ঝরার সঙ্গেই সুর মিলিয়ে ঝিরঝিরে একটু বৃষ্টি
অদ্ভুত একটা আলস্য কি হবে এত হিসেব করে? আরো ইনক্রিমেণ্ট, ইনসেনটিভ, অ্যাওয়ার্ড, প্রোমোশন? জীবন মানে সত্যিই এই? নাকি এই সহজ মানুষগুলোর জীবন! অপরিসীম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে হারিয়ে গেছে কোমল অনুভূতিগুলো বেঁচে থাকার তাগিদে অবলা পোষ্য প্রাণীকেও রক্ষা করার মানবিকতা নেই আর ওদের পৃথিবীতে সব সোজা হিসেব দুটি মাত্র অনুভূতি তীব্রক্ষুধা আর দারিদ্র্য ভালোবাসা, স্নেহ, সম্পর্কের উত্তাপ সব এই দুই অনুভবের কাছে চাপা পড়ে আছে অন্তত বাহ্যিক প্রকাশ নেই

এই সহজ মানুষগুলোর সঙ্গে মহাজনী কারবার? বিজনেস বাড়ানো, আর টার্গেট পূরণের লক্ষ্য? কিসের নেশায়, কিসের আশায় এত ছোটাছুটি ? এমন দৌড় ? শুধু তো এই মানুষগুলো নয়, বিচ্ছিন্ন প্রতিটি মানুষ প্রতিযোগিতায় বিচ্ছিন্ন
সব নষ্ট করে দিল মানুষ শহরের অসভ্য মানুষ ! সভ্যতার অভিশাপ কি একেই বলে ! কেমন বদলে গেছে গ্রামটা শান্ত সুনিবিড় গ্রাম, জঙ্গলের ছায়ায় মায়া বড্ড টান আজ সব অচেনা লাগছে ধিকিধিকি জ্বলছে অশান্তির আগুন, শহরের মতই কোথায় হারিয়ে গেল গ্রাম ?
নাহ, আজ আর কাজ হবে না এবার ফিরলেই হয় কাজ যদি করতেই হয়, এই লড়াকু ছেলেটির মতো কাজ নিয়ে গ্রামে ফিরতে হবে কাজ নয়, প্যাশন


~ছয়~

বাড়ি ফিরতেইমিমি এসো বাবা সব গল্প শুনব কি দেখলে? কেমন দেখলে?’
গভীর আগ্রহে খুঁটিনাটি সব শোনার জন্যে বসে আছে মিমি জীবনের আলো আলো দিকগুলোই দেখা হয়েছে ওর, এখন পর্যন্ত তাই কৌতূহল আর বিস্ময়, দুই অনুভবে এখনো ভরপুর দুর্ভিক্ষের স্বাদ পেতে হয় নি ওকে
কোথা থেকে শুরু করবে সুহাস? জরাজীর্ণ শ্রীহীন গ্রাম নিদারুণ দারিদ্র্য পাথুরে জমিতে ফলন নেই বাথানে গোবর নেই, গরুগুলোর হাড়-পাঁজর বেরিয়ে আছে বাড়িগুলোয় পাতার চাল, কাঁকড় আর মাটি মিশিয়ে দেয়াল সভ্যতার জটিলতায় গ্রাম নি:স্ব অশিক্ষা, কুসংস্কারে মনে জটিল অন্ধকার নিঝুম গা-ছমছম রহস্যময় সুদূর হাত বাড়ালেও ছোঁয়া যায় না 

তবু মানুষ বেঁচে আছে নদী পাহাড়, মায়াবী আদিম পৃথিবী নির্জন নি:শব্দ এদিক ওদিক থেকে বুনো শেয়ালের পলায়মান ডাক মৌটুসি, টিয়া, চন্দনা, শালিখ, বুলবুল চেনা অচেনা কতরকম শিস ঘন গাছের ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশটা ধূসর বাতাসের শব্দে সমুদ্রের তরঙ্গ কেমন ঘোর লেগে যায়
কেমন অবলীলায় বিচ্ছিন্ন মানুষগুলো একসঙ্গে পা চালিয়ে হেঁটে চলে জীবনের দিকে একটু আশ্বাস, একটু আশ্রয়ের আশ্বাস... সাড়া দেয় মানুষগুলো বিশ্বাসে হাতে তুলে দেয় দশ কুড়ি পঞ্চাশ, যার যেটুকু সামর্থ্য বাইরে দুর্ভিক্ষ, তবু ভেতরে কিসের রসদে এমন উদ্দীপনা সবার? সহজ সরল আদিম জীবন বাইরে থেকে কিছু লাগে না আদিবাসির  শাল আকন্দ মহুল সিংবোঙ্গা পাহাড় ডুলুং আকাশ পাহাড়ি ফুল পাহাড়ি নারী পুরুষ পুরুষ মাদল বাজায়, নারী তখন বুনোফুলে কালোয় আলো নাচের তালে চিতল হরিণ আহ!

মিমি চেয়ে আছে উত্সুক চোখে একটি শব্দে উত্তর দিল সুহাস, ‘ভারতবর্ষ
মানে?’ সারদাও অবাক
অল্প হেসে মুখ ফেরালো সুহাস, ‘আজ সারাদিন আমি ভারতবর্ষকে দেখলাম

আইভি চট্টোপাধ্যায়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন