যেও নাকো তুমি বলো নাকো কথা...
শৌনক দত্ত
এক
গোধূলির
গন্ধ মেখে পাখিরা ফিরছে।আশপাশের দোকানগুলোয় আলো জ্বলে উঠছে টুপটাপ।বাস্তুসাপের মতো
পরে থাকা ট্রামলাইন ধরে সাদা ধূতি পাঞ্জাবী পড়া একজন বিকালবেলার মুগ্ধতা পকেটে ভরে
আনমনে হেঁটে আসছে।পেছনের ট্রাম থেকে চিৎকার,ও দাদা,সরে যান,দাদা শুনছেন...সরে পড়ুন। মানুষটির সেদিকে কোন খেয়াল নেই।যেন
আত্মমগ্ন কোন নদী মোহানার দিকে সরলরেখায় এগোচ্ছে।একটা ঘাম দিয়ে সোনালীর ঘুমটা
ভেঙ্গে গেলো।কয়েকপলক ধাতস্থ হতে সময় নিলো সোনালী।সাইড টেবিলে রাখা ঘড়িটার দিকে
তাকাতে গিয়ে দেখলো জীবনানন্দ দাশের কবিতা সমগ্র।জীবনানন্দ দাশের চিরচেনা মুখটির
উপর টেবিল ঘড়িটা মুখ উল্টে পড়ে আছে।
-গুড মনিং,এত তাড়াতাড়ি জেগে গেলি!
ব্যালকনিতে
বসে প্রাণায়াম শেষ করা সকাল দত্তের গলার স্বর ভেসে এলো।সোনালী আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে
উত্তর দেয়।
-একটা অদ্ভুত স্বপ্নে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।
সোনালী
যতটুকু মনে করতে পারলো,গুছিয়ে বললো।
-সে কি রে,তুই তো দেখছি জীবনানন্দ দাশের
মৃত্যুবেলা দেখে ফেলেছিস।
সোনালী
বসু দত্ত।পেশায় চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন।ছোট্টবেলা থেকেই দিল্লিতে মানুষ।জন্মসূত্রে
বাঙালি কিন্তু পড়ালেখা ইংলিশ মিডিয়ামে।ফলে বাংলা কিছুটা বলতে পারলেও পড়া কিংবা
লেখার ব্যাপারে বাংলাটা একেবারেই নেই।কয়েকমাস হলো সকাল মিত্রের সাথে বিয়ে
হয়েছে।যদিও প্রেম ছিলো নয় বছর।সকাল
কলকাতার ছেলে।বাংলা সাহিত্যে এই সময়ে যাদের নাম খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে
সকাল দত্ত তাদের অন্যতম।
-জীবনানন্দ দাশ!বিস্ময়ে উচ্চারণ করে সোনালী।তার লেখা তো তুই খুব পড়িস তাই না?
-হ্যাঁ।পড়ি কি আর সাধে রে। জীবনানন্দ দাশ। বাংলা ভাষায় অলংকার সাজানো এক মহাপুরুষের
নাম। বাংলাকে, এর প্রকৃতিকে এমন গভীর
মমতায় ভালোবেসে তার নিপুণ ছবি এঁকেছেন। তিনি কবিতায় প্রকৃতিকে মূর্ত করেছেন।
আলোকিত চেতনার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন অনুপম বাংলাকে। এই বাংলা তাকে ভালোবাসার
বিনিসুতার বাঁধনে জড়িয়েছে আর তিনিও প্রাণ মেলে সঁপে দিয়েছেন নিজেকে। কলমের ডগায়
নিঃসরিত হয়েছে তার আজন্মের সাধ-
তোমরা
যেখানে সাধ চলে যাও
আমি
বাংলার পাড়ে রয়ে যাব।
আজ
অফিস ছুটি।কথা শুনতে শুনতে সোনালী কফির মগ নিয়ে সকালের পাশে বসলো।
-জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন,"তোমার কবিতা চিত্ররুপময়;সেখানে তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।"বুদ্ধদেব বসু লিখলেন,"ছবি আকঁতে তার অসাধারণ নিপুণতা,তার ছবিগুলো শুধু দৃশ্যের নয়,বিশেষভাবে গন্ধের ও স্পর্শের।"আব্দুল মান্নান সৈ্যদের মতে,"শুধু উত্তররৈখিক আধুনিক বাংলা কবিতার নয়__বৃহত্তর যে বাংলা কবিতার কাল (ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দী),সেই কালেরও একজন প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ।"বাংলা
কবিতার একটি সার্বভৌম অধ্যায়__ জীবনানন্দ
দাশ।হাজার বছরের বাংলা কবিতাকে তিনি দিয়েছেন এক মহাকালিক ব্যঞ্জনা’__বলেচ্ছেন আবু হাসান শাহরিয়ার।
বাংলা
সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দ দাশকে নিয়েই লেখালিখি ও গবেষণার পরিমাণ
সর্বাধিক।বাংলা কবিতার ইতিহাস জীবনানন্দ দাশ ছাড়া লেখা যাবে না।বাংলা কবিতায়
জীবনানন্দ দাশ একটি মজবুত স্তম্ভ। জীবনানন্দ তাঁর কাব্য-সাহিত্যকে সাজিয়ছেন
রোদ্দুরের দিকচিহ্নের মতোন।তাঁর অস্তিত্ব বাংলা কবিতায় দিগন্তরেখার মতোন সূচনা আছে,কিন্তু শেষ নেই। তাঁর কবিতায় ধীর,গভীরময়তা পাঠককে নিয়ে যায় অনেক দূরে ( হয়তোবা........আরো
দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরেঃবনলতা সেন)।তাঁর কবিতায় রেখে যাওয়া গভীর আবেগ বাংলা
কবিতার ইতিহাসে বিরল।আবেগের তীব্র তীর আর হৃদয় খুঁড়ে জেগে ওঠা বেদনা প্রকাশের ভাব
ও ভাষা বাংলা কবিতায় তুলনারহিত
(পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার
তাহারে কেন ডেকে আনো?
কে হায়
হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! হায়
চিল............................................)।
কোনো
এক গবেষক বলেছিলেন,’ জীবনানন্দ দাশ
শুধু নির্জনতা আর ধূসরতার কবি নন,তিনি স্তিতধী
সময়-সচেতন কবিপ্রাণ,তিমিরহন্তা
আলোকরশ্মিমালা।’
অনেকগুলো
শব্দই ঠিকঠাক বুঝলো না সোনালী।সেগুলোর মানে বুঝে নিতে নিতে ব্রেকফাস্ট বানালো
সোনালী।আচ্ছা,জীবনানন্দ দাশ কবিতা লিখতে শুরু
করেন কবে?
-জীবনানন্দ ঠিক কখন থেকে কবিতা লিখতে শুধু করেছিলেন তা নিরূপিত করা যায়নি। তবে
তাঁর আত্মপ্রকাশ কল্লোলের কালে। কল্লোল প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। জীবনানন্দ এক
চিঠিতে লিখেছেন কল্লোলের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ না-ঘটলেও কল্লোলে কবিতা ছাপিয়েই তিনি
সুখী হয়েছিলেন।
জীবনানন্দের
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালক লেখা হয় ১৯২৩ সালে। তাতে জীবনানন্দীয় কবিত্বের
উঁকি-ঝুঁকি থাকলেও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও কাজী নজরুল ইসলামের স্পষ্ট প্রভাবই প্রথমত
দৃষ্টিগোচর হয়। এ রকম প্রভাব থাকা অস্বাভাবিক নয়; বরং রবীন্দ্রনাথের প্রভাব না থাকার বিষয়টিই ভাবিয়ে তোলার মত। মনে রাখা দরকার, যে সময়ে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার উন্মেষ, সে সময়েই কবি হিসেবে জীবনানন্দের আবির্ভাব। কিন্তু এ
পর্যায়ে প্রাক-আধুনিকতা কালের স্রোত অবসিত হয়ে ওঠেনি; তিরিশের আধুনিকতার শিলান্যাস হলেও যতীন্দ্রমোহন বাগচী বা
জসীম উদ্দীনও লিখছেন, অব্যাহত
রয়েছেন অবিশ্রান্ত রবীন্দ্রনাথ। এমন সময় আধুনিক কবিদের চোখে অনাধুনিকদের কবিতা ‘পদ্য’ হিসেবে চিহ্নিত
হতে লাগল।
জীবনানন্দ
ঠিক কখন পুরোপুরি আধুনিক হয়ে উঠেছিলেন তার দিন-ক্ষণের হিসেব মেলানো দুরূহ। কিন্তু
তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল কখন কী করে তিনি জীবনানন্দীয় হয়ে উঠেছিলেন।
ঝরাপালকের তৃতীয় গাহি মানবের জয়!
কোটি
কোটি বুকে কোটি ভগবান আঁখি মেলে জেগে রয়!
সবার
প্রাণের অশ্রু-বেদনা মোদের বক্ষে লাগে,
কোটি
বুকে কোটি দেউটি জ্বলিছে,- কোটি কোটি
শিখা জাগে,
প্রদীপ
নিভায়ে মানবদেবের দেউল যাহারা ভাঙে,
আমরা
তাদের শস্ত্র, শাসন আসন করিব ক্ষয়!
জয়
মানবের জয়!
’ঝরাপালক’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। এর
কবিতাগুলো আগের কয়েক বৎসরে লেখা। এ সময়ে জীবনানন্দের বয়স বেশি নয়, কুড়ির কোঠায়। বিষয়বস্তু, শব্দ চয়ন, ছন্দ বা কাব্য দর্শন তখনও ‘জীবনানন্দীয়’ হয়ে ওঠেনি। তবে একটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয়; নিপাট অন্তঃমিলের পরিবর্তে আন্তঃমিলের প্রতি ঝোঁক। তবে আরেকটু মনোনিবেশ করলে
দেখা যায় চূড়ান্ত কাব্যরীতিটি খুঁজে না-পেলেও কবি জীবনানন্দ তাঁর কবি ভুবনের দেখা
পেতে শুরু করছেন। “অস্তচাঁদে” কবিতাটির প্রথম স্তবকটি দেখলে মনে হয় কেউ যেন কাঁচা হাতে
জীবনানন্দেরই ভঙ্গীতে লেখার চেষ্টা করেছে:
ভাল
বাসিয়াছি আমি অস্তচাঁদ, -ক্লান্ত শেষ
প্রহরের শশী!
অঘোর
ঘুমের ঘোরে ঢলে কালো নদী, ঢেউয়ের কলসী,
নিঝঝুম
বিছানার’
পরে
মেঘ-
বৌর খোঁপাখসা জ্যোৎস্নাফুল চুপে চুপে ঝরে,
কলিংবেলের
শব্দে গল্প থামিয়ে সকাল উঠে যায়।দরজা খুলতেই দেখে ইতি আর বৈভব।
-তোদের আজ ছুটি তাই ইতিকে নিয়ে চলে এলাম।
-বেশ করেছিস।
ইতি
দৌঁড়ে গিয়ে সোনালীকে জড়িয়ে ধরলো।কি রে তোদের লাঞ্চ বুঝি শেষ।সোনালী স্মিত হাসে,
-না রে,ব্রেকফাস্টে বসে জীবনানন্দ দাশ
কে জানছিলাম।কথায় এত ডুবে গেছি যে উঠতেই ভুলে গেছি,তাছাড়া বাজে কয়টা?
বৈভব
ঘড়ি দেখে উত্তর দেয়,এই তো এগারটা
চল্লিশ।তা তুই হঠাৎ জীবনানন্দ নিয়ে পড়লি কেন?
-সে কিছু না,একটা স্বপ্ন দেখলাম,সকাল বললো স্বপ্নটা নাকি জীবনানন্দের মৃত্যুবেলার ঘটনা তাই
জানতে ইচ্ছে করলো।
-তা কি নিয়ে কথা হচ্ছিলো,বনলতা সেন?
-না,আমি জীবনানন্দের লেখা নিয়ে বলছিলাম সোনালী কে।
-ও,আচ্ছা।
দুই.
দুই
প্রস্ত কফি আর তুমুল আড্ডার মাঝে ইতি এই প্রথম মুখ খুললো।তুমি যাই বলো সকাল দা,জীবনানন্দের বনলতা সেন কে কিন্তু আমার মানস চরিত্র মনে হয়
না!
বৈভব
উচ্চস্বরে হেসে উঠলো,এ যাবতকাল ধরে
সবাই এটিকে প্রেমের কবিতা বিবেচনা করে খুঁজেছেন বনলতা নামক নারীর জন্ম-পরিচয়, পারিবারিক বৃত্তান্ত, কবির সাথে পরিচয়-সম্পর্ক আর মিলন-বিরহের ব্যাপারাদি। কেউ বলেছেন বনলতা কবির
কাব্যলক্ষী, কেউ বলেছেন নাটোরের অপরূপ
সুন্দরী বনলতার সাথে কবির সাক্ষাৎ হয়েছিল নাটোরে বনলতাদের বাড়িতেই, কারো মতে বা কবি তাকে দেখেছিলেন কলকাতা যাবার পথে ট্রেনের
কামরায়। নাটোর থেকে এক পরিবার একসময় বরিশালে এসে জীবনানন্দদের বাড়ির পাশে স্থায়ী
বসতি স্থাপন করে, সে পরিবারের
যুবতীকন্যা বনলতার চোখে দৃষ্টি রেখে অভিভূত হয়েছিলেন কবি- এমন ধারণাও প্রচলিত।
গবেষক-সমালোচক ছাড়াও সাধারণ জনমনেও বনলতা-বিষয়ক বোধ-আগ্রহের কমতি নেই।
-তা হয়ত আছে,কিন্তু আমাদের উচিত ইতির কথাটা
শোনা।বনলতা সেন নিয়ে ও কি ভাবছে।বলো,ইতি তোমার কি মনে হয়।
বৈভবের
সাথে বিয়ের আগে ইতি কোন এক কলেজে বাংলা পড়াতো বলে সকাল শুনেছিলো।কখনো এ বিষয়টা
জিজ্ঞাসা করা হয়নি।তবে তার লেখালেখি নিয়ে ইতি প্রায়ই খুব সুচিন্তিত মতামত দেয়।তাই
ইতির মুখে বনলতা সেন মানস চরিত্র নয় শুনেই সকালের আগ্রহ চরমে।
-বাস্তবিকঅর্থে, কবিতাটিতে জীবনানন্দ
অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বয় ঘটিয়েছেন চিত্রশিল্পীর রঙ-প্রয়োগের চাতুর্যে। একটি সমতল
ক্যানভাসে তিনি এঁকেছেন সভ্যতা আর জীবনের বিচিত্রসব প্রান্ত। হাজার বছরের
ইতিহাস-ঐতিহ্যের ডানায় ভর দিয়ে কবি অগ্রসর হয়েছেন মানুষের প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, বিস্ময়-বিভ্রান্তি আর জীবন-অবসানের আহ্বানের দিকে। পথে
স্পর্শ করেছেন রহস্যময়তা, অতিশব্দের
মাহাত্ম্য, স্বস্তি এবং আনন্দের
হাতছানি। বহুদিনের পরিক্রমায় অনেক গলি-বাঁক পেরিয়ে পথশেষের মোড়ে দাঁড়িয়ে জীবনানন্দ
উপলব্ধি করেছেন মানবিক শূন্যতাবোধের গভীর-অবস্থান। পৃথিবীর নানান প্রান্ত আর পাহাড়-সমুদ্রের
উচ্ছ্বাস অতিক্রম করে, ঐতিহ্যের সকল
শক্তি ও সৌন্দর্য বিলীন হবার ইতিহাস কপালে এঁকে পথিককবি সন্ধান পেয়েছেন এক
অনাবিষ্কৃত সত্যের; জাগতিক
কৃত্রিম-কাঠামো শোভার অন্তরালে প্রকৃতির অকৃত্রিমতায়, তার ছায়াতলে রয়েছে ক্লান্তিমোচনের মহৌষধ। বনের লতা-পাতায়
খুঁজে পেয়েছেন স্বস্তির সঠিক ঠিকানা। আর এই উপলব্ধি প্রকাশের জন্য তিনি নির্ভর
করেছেন প্রতীক-প্রয়োগের ওপর। লতা-পাতার সঙ্গে জাগতিক বংশ-পদবি যুক্ত করে তার
সৌন্দর্যকে দান করেছেন মানবীয় পরিচিতির প্রলেপ। স্থানের নাম জুড়ে দিয়ে আমাদের-
পাঠকের,
সংশয় কিংবা বিশ্বাসকে বাড়িয়ে দিয়েছেন বহুগুণ। সম্ভবত তাঁর
সৃষ্ট স্বপ্নময়তার ভুবনে পাঠকের বিশ্বাসি বিচরণকে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন তিনি এই
কৌশল আরোপের মধ্য দিয়ে। কবিতাকে কিংবা শিল্প-সাহিত্যকে যদি আমরা বাজারের অন্যসব
পণ্যের মতো বিবেচনা করি, তাহলে দেখবো নিজের উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণের জন্য
জীবনানন্দের মার্কেটিং পলিসির কী দারুণ প্রয়োগ। আর তাইতো, “বনলতা সেন” শেষপর্যন্ত
বাজারে অবিক্রিত আইটেম হয়ে পড়ে থাকে না; বিকোচ্ছে সন্তোষজনক মূল্যে- দাম পাচ্ছে বিচিত্র ও ইতিবাচক বহুতর মূল্যায়নের পধ
ধরে। কবি জীবনানন্দের বর্ণনা-চতুরতায় সাধারণ দৃশ্যবস্তু ধারণ করেছে মানবীয়
অস্তিত্ব। আর তখনই, তাঁর বিবরণ
ইতিহাস না হয়ে হলো কবিতা আর পাঠকের জন্য তৈরি হয়ে গেল পাঠ-বিভ্রান্তির
পূর্ব-অনির্ধারিত পরিপ্রেক্ষিত। জীবনানন্দের বিমুগ্ধ পাঠক বনলতারূপি রমনীর
অন্বেষায় আজও কেবল দোল খেতে থাকে কবির সভ্যতাক্লান্তি-বিবৃতির নাগরদোলায়।
বৈভব
আবৃত্তি করতে শুরু করে-
হাজার
বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল
সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক
ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর
জগতে
সেখানে
ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ
নগরে;
আমি
ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে
জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে
দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
- এখানে তুমি মানস চরিত্র দেখছো না?কি দেখছো ম্যাডাম?হাসতে হাসতে বৈভব বলে।
-
- -আমার তো মনে হয়, দূর ‘সিংহল সমুদ্র’, ‘মালয় সাগর’, ভারতবর্ষের প্রাচীন রাজা
অশোক আর বিম্বিসার এবং এ অঞ্চলের অতি-প্রাচীন নগরী ‘বিদর্ভ নগর’ পারি দিয়ে কবি প্রবেশ
করেছেন বিশ শতকের প্রথমার্ধে বিশ্বব্যাপি বাণিজ্যিক ধস, ফলত চাকরিবাজারে অনিশ্চয়তাঘেরা জীবনযন্ত্রণায়। ব্যক্তিগত
জীবনের অর্থনৈতিক টানাপড়েন আর সমাজ-রাষ্ট্রের সমূহ বিপদ তাঁকে বিচলিত-বিভ্রান্ত
করে তুলেছিল। বিশ্ব আর্থ-রাজনৈতিক আবহ তখন জীবনানন্দের কবিতার শরীরে ঢুকে পড়ে
স্বাভাবিক উপাদান ও শক্তি হিসেবে।
অতঃপর
কবি যাপিতজীবনে চলার পথে মোহাচ্ছন্নতা আর বিভ্রান্তির কথা লিখেছেন ঐতিহ্যের নিবিড়
পতনের ধ্বনি-মাধুর্যে। কবিতাটির দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে গিয়ে পুরুষপাঠক পড়ে দারুণ
মুশকিলে। হারিয়ে-যাওয়া সভ্যতার গভীর অন্ধকার আর প্রিয়তমার চুলের কালোর অতলতার
বিভ্রমে আটকে যায় তার চিন্তন-বিলোড়ন। প্রাচীন নগরী ‘বিদিশা’ তখন তার বস্তু-পরিচয় ঝেড়ে
ফেলে নারীর কোমলকান্তির মোড়ক পরিধান করে নেয়;পথভোলা পথিককে দিক-নিশানা বাতলে দিতে-আসা অভিভাবকের দায় ও দায়িত্ব গ্রহণ করে।
প্রেমকাতর কবিতা-পাগল হৃদয়ের জন্য কবি নির্মাণ করেন ভালোবাসা আর আশ্বাসের বিরাট
ভূমি।
বেশ
মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো সোনালী আর সকাল।সকাল ইতি কে থামিয়ে দিয়ে বললো-তুমি কি বলতে
চাইছো তৃতীয় দশকের কবিদের বড়ো সাফল্য
তাঁরা প্রেম ও প্রেমিকাকে কল্পনার রঙিন আকাশের ধোঁয়াশা থেকে বাস্তবে নামিয়ে আনতে
পারতেন যেভাবে; জীবনানন্দ দাশও তার
ব্যতিক্রম নয়?
-তা নয় কিন্তু জীবনানন্দের বনলতাকে নিয়ে আমাদের যেমন রয়েছে হাজারো প্রশ্ন ও
সংশয়;
জীবনানন্দের মনেও বারবার ছায়া ফেলেছে বনলতার মুখ (না-কি
ছায়া কিংবা মায়া!)। একটি উপন্যাসে এবং পরে পাঁচটি কবিতায় তিনি বনলতাকে হাজির
করেছের নানানভাবে ও ভঙ্গিতে।জীবনানন্দ তাঁর দয়িতাদের সবচেয়ে শরীরি কিংবা অশরীরি
করে তুলেছিলেন নাম ধরে ডেকে ডেকে; বনলতা সেন, অরুণিমা সান্যাল, সুদর্শনা, সুরঞ্জনা প্রভৃতি নাম তাঁর
দয়িতাদের নারী (শরীরি) নয়, নিসর্গের
(অশরীরি) গোত্রভুক্ত করেছে। বনলতা সেনের সৌন্দর্য: “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা/ মুখ তার শ্রাবস্তরি কারুকার্য।”- এ বিবরণে বনলতা হয়ে উঠেছে প্রাচীন ধূসর ভারতীয় ইতিহাসের মতো
বিমূর্ত,
আর প্রাচীন ভাস্কর্যের মতো নিষ্প্রাণ। বনলতা এমন এক নারী, যাকে নাটোরের পিচঢালা বা ধূলোমাখা রাস্তায় দেখা যায় না; শয্যায় পাওয়া যায় না- শুধু সন্ধ্যার নির্জন অন্ধকারে
নির্বাক মুখোমুখি বসে থাকে অদৃশ্য-অধরা নারীর অস্পষ্ট ছবি হয়ে।সত্যিকার অর্থে কবির
কল্পনায়,
সংসার ও পৃথিবীর যাবতীয় যাতনা থেকে মুক্তির কিংবা পলায়নের
অভিপ্রায়ে, এক মোহনীয় নারীর রূপকল্প
জেগে থাকতে দেখা যায় নানানভাবে। জন্ম-জন্মান্তরে যার সাথে পথ চলা যায়, এমন এক স্বপ্নমানবীর রূপ তিনি বারবার ভেবেছেন; হয়তো পৃথিবীর আলো-বাতাসে খুঁজেছেনও তাকে। মাঝে মাঝে তাঁর
কল্পনায় সাজানো নায়িকার মতো দেখতে কাউকে দেখে চমকে উঠেছেনও বোধহয়; কিন্তু শরীরি বনলতাকে তিনি দেখেননি কখনো; ছুঁয়ে দেখাতো স্বপ্ন মাত্র। বাস্তবে এই অদেখা কোনো এক
বনলতাকে নিয়ে কবির অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে “একটি পুরনো কবিতা”য়। জীবনানন্দ
লিখেছেন:
আমরা
মৃত্যুর থেকে জেগে উঠে দেখি
চারিদিকে
ছায়া ভরা ভিড়
কুলোর
বাতাসে উড়ে ক্ষুদের মতন
পেয়ে
যায়- পেয়ে যায়- অণুপরমাণুর শরীর।
একটি
কি দুটো মুখ- তাদের ভিতরে
যদিও
দেখিনি আমি কোনো দিন- তবুও বাতাসে
প্রথম
জানকীর মতো হয়ে ক্রমে
অবশেষে
বনলতা সেন হয়ে আসে।
যদিও
জীবনানন্দ তাঁর “দু’জন” কবিতায়
লিখেছেন: পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়/ প্রেম ধীরে মুছে যায়।” কিন্তু বনলতার প্রসঙ্গে তিনি প্রেমের অমরতাকে এক রকম
প্রশ্রয়ই দিয়েছেন বলা চলে। দুনিয়ার তাবৎ সভ্যতা আর বিস্ময় কিংবা অধরা আনন্দের
আড়ালে কবি দেখেছেন না-পাওয়া কোনো এক শুভবোধের ছোঁয়া। আর সে আদরের মৃদু প্রলেপে
জুড়ে দিয়েছেন বনলতার কোমল হাত। পথে পথে যেন জীবনানন্দ বিজ্ঞাপনের বোর্ডে লাগিয়ে
দিয়েছেন বনলতার মুখ কিংবা মুখের আদলে গড়ে-ওঠা অবিবরণীয় ছবি। ক্লান্তিহীন পথ চলার
আর অন্তহীন আনন্দের সাথী হিসেবে যে মানুষকে (অবশ্যই বিপরীত লিঙ্গের) পাওয়া যায় বা
মনে মনে ভাবা যায়, সে নারীর
মোহময়তা যেন এই নিবিড় প্রেমলগ্ন কবির জীবনে বারবার বনলতার মুখ হয়ে ভেসে ওঠে। অন্য
একটি কবিতায় জীবনানন্দ বনলতাকে তুলে ধরছেন এভাবে:-
বনলতা
সেন,
তুমি যখন নদীর ঘাটে ম্লান করে ফিরে এলে
মাথার
উপরে জ্বলন্ত সূর্য তোমার,
অসংখ্য
চিল,
বেগুনের ফুলের মতো রঙিন আকাশের পর আকাশ
তখন
থেকেই বুঝেছি আমরা মরি না কোনো দিন
কোনো
প্রেম কোনো স্বপ্ন কোনো দিন মৃত হয় না
আমরা
পথ থেকে পথ চলি শুধু- ধূসর বছর থেকে ধূসর বছরে-
আমরা
পাশাপাশি হাঁটতে থাকি শুধু, মুখোমুখি
দাঁড়াই:
তুমি
আর আমি।
কখনো
বা বেবিলনের সিংহের মূর্তির কাছে
কখনো
বা পিরামিডের নিস্তব্ধতায়
কাঁখে
তোমার মাদকতাময় মিসরীয় কলসি
নীল
জলের গহন রহস্যে ভয়াবহ…
(বাঙালি পাঞ্জাবি মারাঠি গুজরাটি)
-“শেষ হ’ল জীবনের সব লেনদেন” এই কবিতায় আমরা জীবনানন্দের বনলতাকে দেখি গভীর রাতের
অনুপস্থিতি-উপস্থিতির দোলাচলের রঙিন মোড়কে,তাতে কি মনে হয় না বনলতা মানস চরিত্র?বৈভব বলে।
সোনালী
উঠে দাঁড়ায়।এটা শুনবো তার আগে খাবারটা অর্ডার করি।কে কি খাবে বলো।সবার পছন্দ মতো
খাবার অর্ডার করে সেলফোনটা টেবিলে রেখে এসে বসে সোনালী।এবার বলো ইতি,খুব মজা লাগছে শুনতে।জীবনানন্দ দাশের মাঝে এত কিছু আছে
ভাবতেও পারিনি।আজ তোমাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে বাংলা সাহিত্যটা পড়া খুব জরুরী।
টুকরো
টুকরো হাসির গুঞ্জরণ থামলে ইতি বলতে শুরু করে-কবির জীবনে বনলতার
উপস্থিতি-অনুপস্থিতি বিষয়ে সকল প্রশ্নের মধ্যে জড়িয়ে আছে প্রেম কিংবা স্বপ্নভঙ্গের
অথবা বিরহের ব্যাপারাদি; স্ত্রী
লাবণ্যের সাথে কবির সাংসারিক সাফল্য-ব্যর্থতার কতোসব গল্প। আবার পাশাপাশি আছে
পৃথিবীর তাবৎ মানুষের স্বপ্নভঙ্গের না-বলা কাহিনি। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের কবি
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর যখন লিখেছিলেন: “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”, তখন নিশ্চয় তিনি নিজের সন্তানাদির জন্য নয়- দেবীর কাছে জগতের সকল মানুষের
কল্যাণ কামনা করেছিলেন। তাহলে জীবনানন্দও কি বনলতার অস্পষ্ট মুখচ্ছবি আাঁকতে গিয়ে
পৃথিবীর সব প্রেমবঞ্চিত বা বিরহকাতর প্রেমিক-পুরুষের মনোযন্ত্রণাকে রূপ দিতে
চেয়েছেন?
কে জানে সে কথা! না-কি হাজার হাজার বছরের সভ্যতার পথে
প্রকৃত অর্থে আমাদের মানসিকভাবে না-এগোবার গল্পই গেঁথে তুলেছেন তিনি। আর সে কারণেই
বোধকরি,
আবারো জীবনানন্দের কবিতায় সভ্যতার বিবরণে ভেসে ওঠে বনলতার
মুখ;
তার ছবি।কবি লিখছেন:
হাজার
বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো:
চারিদিকে
চিরদিন রাত্রির নিধান;
বালির উপরে
জ্যোৎস্না- দেবদারু ছায়া ইতস্তত
বিচূর্ণ
থামের মতো: দ্বারকাক;- দাঁড়ায়ে রয়েছে
মৃত,
ম্লান।
শরীরে
ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের- ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন;
“মনে আছে?” শুধাল সে- শুধালাম আমি
শুধু “বনলতা সেন?”
(হাজার বছর শুধু খেলা করে)
প্রবল
ধ্বনিসচেতন কবি জীবনানন্দ বর্তমান কবিতায় অতিশব্দ শ্রবণের প্রাসঙ্গিকতা আর তাৎপর্য
বিবৃত করতে চেয়েছেন মানুষের চেতন-অনুভূতিতে নাড়া দেবার প্রত্যাশায়। সাধারণের
অশ্রবণীয় শিশির-পতনের শব্দ আর মৃত্যুর নিঃশব্দ আগমন-বার্তা কবিকে এক নীরব-অন্ধকারে
নিয়ে হাজির করে যেন; কবি অনুভব
করেন প্রকৃতির নিয়মতান্ত্রিক চালচিত্র, জীবজন্তুর নিয়তিতাড়িত জীবনযন্ত্রণা (না-কি মরণযন্ত্রণা!)। আমাদের
বাধ্যবৃত্তিজনিত অসহায়তার আড়ালে এই কবিতায় নির্মিতি পেয়েছে আশ্বাস-বারতা, আশ্রয়-ইঙ্গিত আর সবশেষের শেষে নিথর পৃথিবীর ভয়াবহ নির্জনতা; অন্ধকারে মুখোমুখি নিরালাপ দাঁড়িয়ে-থাকার নিষ্প্রয়োজনীয়তা।
কবিতা কথকের অভিমত:
সমস্ত
দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা
আসে;
ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর
সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন
গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব
পাখি ঘরে আসে- সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে
শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা
সেন।
(বনলতা সেন)
মানুষ
যখন বিভ্রান্ত-দিকভ্রান্ত কিংবা আশ্রয়-হারা হয়ে পড়ে, তখন তার একটি নিশ্চিত ঠিকানা টিকে থাকে আপন মহিমায়- পৃথিবীর অপ্রতিরোধ্য
নিয়মে- প্রকৃতির এই উদার জমিন তাকে দাঁড়াবার, দম নেবার স্থান টুকু করে দেয় নিঃশঙ্কোচে, গিভ অ্যান্ড টেক-এর শর্ত ছাড়াই। সভ্যতার অগ্রগমণ আর চালচিত্রে ‘বনলতা সেন’ কবিতায়
পরিবেশিত হয়েছে অন্ধকারের চিরন্তনতা, পৃথিবীর আসন্ন স্থিরতা, সৌন্দর্য-বিষ্ময়
আর মানবিক অনুভূতির জটিল সব বিষয়াদি।
শৌনক দত্ত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন