আমরা সন্ত্রাসবাদের আঁতুরঘরে উঁকি দিই না কখনোই।
আমরা চোখবুঁজেই আবিশ্ব সন্ত্রাসবাদের জনক ও পরিচালিকা শক্তির উল্টো দিকে তাকিয়ে
থেকে সন্ত্রাসবাদের মুণ্ডপাত করতেই বেশি সচ্ছন্দ বোধ করি। আমাদের এই কপটতাই
প্রতিটি মৃত্যুমিছিলের পরবর্তীটির দিকে এগিয়ে দেয় আমাদেরই সহনাগরিকদের। আমরা একটি
বিস্ফোরণ থেকে পরবর্তীটির অপেক্ষায় দিন গুনি। আর এই ভাবেই আমাদেরই হাতে গড়ে তোলা
নিয়তির কোলে আমাদেরই কেউ কেউ হয়তো ঢলে
পড়বো কোন একদিন পরবর্তী কোন মৃত্যুমিছিলের রক্তস্নাত লগ্নে পা মিলিয়ে। তাই এই মৃত্যুমিছিল কিন্তু চলতেই থাকবে। আর আমরা
যারা বেঁচে যাবো এক একটা মৃত্যুমিছিল থেকে, তারা চোখবুঁজে কান বন্ধ করে নিজেদের
স্ব স্ব মৌলিক বিচারবুদ্ধির মুখাগ্নি করে মিডিয়ার প্রতিধ্বনীতে সরব হয়ে উঠবো।
বদ্ধমুষ্ঠি উত্তলন করে বলবো সন্ত্রাসবাদ নিপাত যাক।~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও
আমরা!
শ্রীশুভ্র
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ! আর সন্ত্রাসবাদী
হামলা। আবার মৃত্যু মিছিল। আবার সন্ত্রাসবাদ! আজ এখানে তো কাল ওখানে। এবং আবিশ্ব
মিডিয়া কভারেজ।। এবং টিভির এপারে আমরা। খবরের কাগজ মুখে আমরা। নেটের মাউস হাতে
অনেকে। প্রতিবাদের মাউস-ক্লিকে ঝড় তুলেছি
অনেকেই। কিন্তু কিসের প্রতিবাদ? কার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? কেনই বা শুধুমাত্র
মাউস-ক্লিকের চৌহদ্দীতেই আমাদের প্রতিবাদী মুখের বিক্ষিপ্ত ঝলকানি? প্রশ্নগুলি
অনেক। কিন্তু উত্তর? প্রশ্ন শুধুমাত্র উত্তরের অণ্বেষনও নয়। প্রশ্ন এইটিও, আমরা
সত্যিই কি উত্তরের খোঁজে আছি? সত্যিই কি আমরা পেতে চাই, জানতে চাই, জানাতে চাই
প্রকৃত রহস্যের আসল উত্তর? না কি আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ গোষ্ঠীর মনঃপুত উত্তর
তৈরী করে নিতেই অধিকতর তৎপর আসলেই।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের যে চেহারায় আমাদের
ধ্যানধারণা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে দিনে দিনে, তা কি মিডিয়া নিয়ন্ত্রীত নয়? কিংবা তার
কতটা মিডিয়া নিয়ন্ত্রীত আর কতটা আমাদের নিজস্ব, সেই পার্থক্যটিও কি খুব স্পষ্ট আজ
আমাদের কাছে? সন্ত্রাসবাদী হামলার মৃত্যুমিছিলে যে তাজা প্রাণগুলি অকারণে ঝরে যায়,
কিংবা যারা সারা জীবনের জন্যে বিকলাঙ্গ হয়ে বেঁচে থাকার ছাড়পত্র পায় তারাও কি
আমাদেরই মতোই নয়? তারাও কি এযাবত ঘটে চলা মৃত্যুমিছিলগুলিকে আমাদের মতো করেই দেখে
আসে নি? অর্থাৎ আমরা যারা সচেতন বিশ্বনাগরিক, তারা কি এই মৃত্যুমিছিলকে রুখে
দেওয়ার বিষয়ে আদৌ কোন সচেতন প্রয়াস গড়ে তোলার প্রয়জনের কথা উপলব্ধি করেছি কোনদিন?
কিংবা করি কি আদৌ? কতটা সচেতন আমরা? আদৌ সচেতন তো? না কি আমাদের এই মিডিয়া
নিয়ন্ত্রতীত মাউস-ক্লিকের প্রতিবাদী তৃপ্তির গুপ্ত সুড়ঙ্গ দিয়ে পরবর্তী
মৃত্যুমিছিলে পা মেলানোর জন্যে তৈরী করে রাখছি নিজেদেরই নিয়তি, নিজের অজান্তেই?
এই প্রশ্নগুলি কতটা ভাবায় আমাদের? আদৌ কি ভাবায়?
দুঃখের বিষয় এই প্রশ্নগুলির চর্চা করার পরিসর মিডিয়া নিয়ন্ত্রীত বিশ্বায়িত
জনচেতনায় আজ ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে উঠছে। আজ আমরা টিভির পর্দায়, নেটের পেজেই ফাস্ট
ফুডের মতোই বিশ্ব প্রতিক্রিয়ার রেডিমেড টেমপ্লেটর ফিক্সড লেআউটেই নিজেদের প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটিয়ে ফেলছি।
খেয়াল করছি না নিজের মৌলিক সত্ত্বার ক্রম অপস্রিয়মাণ ছায়াটি কিভাবে দিনে দিনে
বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আর সেই জায়গাটা জুড়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মিডিয়ার অমোঘ তর্জ্জনী। যে
তর্জ্জনীর দিকনির্দেশের পথরেখা ধরে আমরা চিনে নিচ্ছি কে আমাদের শত্রু আর কে আমাদের
মিত্র! যে তর্জ্জনীর নির্দিষ্ট অক্ষরে তৈরী হয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আমাদের
স্লোগানের রোলমডেল।
হ্যাঁ আমরা তো সবাই সন্ত্রাসবাদের, তা সে যে রঙেরই
হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধেই সরব সর্বদা। সর্বত্র। সর্বত্রই তো?
সর্বদাই তো? সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেই তো? তাই কি? যদি তাই হয়, তাহলে আমরা বোমারু
বিমানের ছোঁড়া মিসাইল আর আত্মঘাতী মানব বোমার বিস্ফোরণের মধ্যে পার্থক্য করি কেন?
গাজায় শিশুঘাতী নারীঘাতী মিসাইলকে সন্ত্রাসবাদের মারণাস্ত্র বলে চিহ্নিত করে নিজের
প্রোফাইল ফটোতে প্যালেস্টাইনের পতাকার ছবি লাগিয়ে গাজাবাসীর মৌলিক অধিকার রক্ষার
সাথে আমাদের সলিডারিটি প্রদর্শন করি না কেন? নিউইয়র্কে প্যারিসে লণ্ডনে তথাকথিত
সন্ত্রাসবাদের থাবা এক আধবার আছড়ে পড়লেই আমারা আমাদের যে মানবিক বোধকে জাগিয়ে
তুলি, সারা বছর ব্যাপি মধ্যপ্রাচ্যে বোমারু বিমান আর মিসাইল তাণ্ডবের নিরবচ্ছিন্ন
চলমান নাশকতায় আমাদের সেই মানবিক বোধকে অসাড় করে রাখি কেন তবে? তবে কি সর্ষের
মধ্যেই ভুত? অর্থাৎ সেই মিডিয়া নিয়ন্ত্রীত তর্জ্নীর অমোঘ নির্দেশেই আমরা কি ঠিক করে নিই না, মানবঘাতী কোন বিস্ফোরণটি
সন্ত্রাসবাদ, আর কোনটি নয়? হ্যাঁ আবিশ্ব সন্ত্রাসবাদের চালিকা শক্তির প্রাণভ্রমরা
আসলে আমাদের এই নিয়ন্ত্রীত মানবিকতার দ্বিচারীতাই।
ঠিক সেই কারণেই আমরা সন্ত্রাসবাদের আঁতুরঘরে
উঁকি দিই না কখনোই। আমরা চোখবুঁজেই আবিশ্ব সন্ত্রাসবাদের জনক ও পরিচালিকা শক্তির
উল্টো দিকে তাকিয়ে থেকে সন্ত্রাসবাদের মুণ্ডপাত করতেই বেশি সচ্ছন্দ বোধ করি। আমাদের
এই কপটতাই প্রতিটি মৃত্যুমিছিলের পরবর্তীটির দিকে এগিয়ে দেয় আমাদেরই সহনাগরিকদের।
আমরা একটি বিস্ফোরণ থেকে পরবর্তীটির অপেক্ষায় দিন গুনি। আর এই ভাবেই আমাদেরই হাতে
গড়ে তোলা নিয়তির কোলে আমাদেরই কেউ কেউ
হয়তো ঢলে পড়বো কোন একদিন পরবর্তী কোন মৃত্যুমিছিলের রক্তস্নাত লগ্নে পা
মিলিয়ে।
তাই এই মৃত্যুমিছিল কিন্তু চলতেই থাকবে। আর আমরা
যারা বেঁচে যাবো এক একটা মৃত্যুমিছিল থেকে, তারা চোখবুঁজে কান বন্ধ করে নিজেদের
স্ব স্ব মৌলিক বিচারবুদ্ধির মুখাগ্নি করে মিডিয়ার প্রতিধ্বনীতে সরব হয়ে উঠবো।
বদ্ধমুষ্ঠি উত্তলন করে বলবো সন্ত্রাসবাদ নিপাত যাক। অবশ্যই নিপাত যাক সন্ত্রাসবাদ।
কিন্তু এই কথা আমারা তো বহুবার বহুভাবেই বলছি বলেছি বলবোও। তাহলে? আমাদের বলার শক্তি এতটাই অকিঞ্চিৎকর, যে
তাতে সন্ত্রাসবাদ নিপাত যাওয়া তো দূরস্থান, দিনে দিনে আরও শক্তি অর্জন করে সে আরও
বিস্তৃত হয়ে উঠছে। গণ্ডগোলটা তাহলে কোথায়? আচ্ছা এই একমেরু-বিশ্বে আবিশ্ব বৃহৎ
সামরিক শক্তির দেশগুলির সবাই তো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রেসবিবৃতিতে সরব। তাহলে?
তাহলে কি ধরে নিতে হবে আন্তর্জাতিক এই সন্ত্রাসবাদের শক্তি আবিশ্ব বৃহৎ সামরিক
শক্তির দেশগুলির সম্মলিত সামরিক শক্তির থেকেও বেশী শক্তিশালী? আর সেইটি ধরে নিলে
অঙ্ক ঠিকঠিক মিলবে তো?
২০১৫’র নভেম্বরে প্যারিসে সন্ত্রাসবাদী হামলার
৪৮ ঘন্টার মধ্যেই ফরাসী বোমারু বিমানের মিসাইল হামলায় তছনছ হয়ে গিয়েছিল সিরিয়ার
একটি বড়ো অঞ্চল, ঠিক যে অঞ্চলটি আইএসাই-এর স্ট্রং হোল্ড বলে পরিচিত। আবার শুধুই
ফরাসী সামরিক বাহিনীরই মিসাইল আক্রমণ নয়, সাথে বড়োদাদা মার্কীণ বোমারু বাহিনীরও
তাণ্ডবে সিরিয়ার আইএসআই অধিকৃত বিস্তির্ণ অঞ্চলে চলেছিল অকাতর বোমার্ষণ।
সন্ত্রাসবাদ দমনে এই বোমারু দাওয়াই আর মিসাইল ইনজেকশান তো নতুন কিছু নয়! এতো আমরা
দেখে আসছি সেই রোনাল্ড রেগনের আমল থেকেই। লিবিয়ার রাষ্ট্রপতি গদ্দাফীর গৃহে মিসাইল
হামলায় গদ্দাফীর শিশুকন্যা হত্যার ঘটনা থেকেই। তারপর সাত সমুদ্র তেরো নদীর জল
কতবার কতভাবেই না ঘোলা হল। মিসাইল টেকনোলজীর ক্রমোন্নতি, বরাংবার মধ্যপ্রাচ্যে নীল
আকাশ বিদীর্ণ করে রকমারি মিসাইলের চোখঝলসানো মারণাস্ত্রের অব্যর্থ লক্ষভেদের লাইভ
টেলিকাস্টও তো আমরা কতই না দেখলাম। দেখেই চলেছি প্রায় আড়াই দশক ব্যাপি
একমেরু-বিশ্বের বিশ্বরাজনীতির রঙ্গমঞ্চে। তবুও দমন হল না সন্ত্রাসবাদ? হয়নি যে সে
তো আমরাই দেখতে পাচ্ছি। হলে দেশ বিদেশের যত্র তত্র নিরপরাধ নিরস্ত্র সুস্থসবল
নগরিকদের জীবনে যখন তখন এইভাবে দাঁড়ি কমা ফুলস্টপ পড়ে যেতে থাকতো না দিনের পর দিন।
মাসের পর মাস। বছরের পর বছর।
কিন্তু কেন? কেন এইভাবে অকাতরে প্রাণ দিতে হবে
আমাকে আপনাকে যখন তখন যেখানে সেখানে? কেন? কেন এই ‘কেন’-র প্রশ্নটা আমারা বারবার
এড়িয়ে যাবো? আর বারবার সেই মিডিয়ার অমোঘ তর্জ্জনীর নির্দেশেই স্কুলছাত্রর মতোই গলা
মেলাবো সবাই? আসুন, বরং গড্ডলিকা প্রবাহের এই মিছিলের বাইরে চোখ মেলে কতোগুলি কেনর
উত্তর খুঁজে দেখার প্রায়াসে সামিল হই অন্তত একবার। সবচেয়ে বড়ো যে প্রশ্নটা আমরা
সবার আগে এড়িয়ে যেতে অভ্যস্থ বরাবর, সেটি হল এই সব সন্ত্রাসবাদী হামলার থেকে নিট
লাভ কাদের হয়? কারা তাদের রাজনৈতিক মাইলেজ, সামরিক শক্তিবৃদ্ধির সুযোগ পেয়ে যায়?
কাদের কাদের ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে? এই মূল প্রশ্নটির উত্তরের মধ্যেই
অনেক বড়ো সত্যি লুকিয়ে থাকে। কিন্তু সত্যইকি আমরা অধিকাংশ বিশ্বনাগরিক সেই কথাটি
জানি না? বুঝতে পারি না? না কি জানতেই চাই না। বুঝতেই চাই না! কারণ আমরা তো কেউই
নির্বোধ নই। নই ক অক্ষর গো মাংস! আসলে আমরা হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর জানতে ভীত
ভেতরে ভেতরে। কিন্তু কেন? তবে কি আমরা উত্তরগুলি জানি? জেনেও না জানার ভান করি?
সবচেয়ে বড়ো প্রশ্নটি কিন্তু এইখানেই বন্ধু।
দ্বিতীয় যে বড়ো মূল প্রশ্নটি আমরা এড়িয়ে যেতে
স্বছ্বন্দ বোধ করি, সেটি হল এই সব সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির অর্থের ও অস্ত্রের
যোগানদার কে বা কারা? আচ্ছা ইরাকের মানুষকে গণতন্ত্রের স্বাদ দিতেই তো সৈরাচারী
সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন বিশ্ববিবেক মহাশক্তিধর মার্কিণ
রাষ্ট্রপতি বুশ সাহেব, তো এই দুই দশক ধরে ইরাকের বুকে মার্কীণ সৈন্যের দাপাদাপি
সত্বেও কি করে এই আইএসআইয়ের উত্থান হলো? মনে রাখতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃর্ণ
অঞ্চলব্যাপি সৌদী আরব থেকে, কুয়েত, কাতার, সংয়ুক্ত আরব আমীরশাহী, বাহারিন, জর্ডন,
লেবানন, ইরাক, আফগানিস্তান সহ এতগুলি দেশ কিন্তু ইঙ্গমার্কীন সামরিক শক্তির
তত্ত্বাবধানে ও নজরদারীতেই প্রতিদিন ওঠবোস করে। তাহলে এই মহাশক্তিধর সামরিক
বাহিনীর নজরদারী এরিয়ে যেখানে একটা মাছিরও গলার ক্ষমতা নেই, সেখানে আইএসাআই এত
সামরিক অস্ত্রের যোগান পাচ্ছে কোথা থেকে? কার কাছ থেকে? সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট
আসাদের কাছ থেকে? যাকে গদিচ্যুত করার চেষ্টায় মড়িয়া পেন্টাগন আজ দুই দশকের বেশি
সময় ধরে? যার বিরুদ্ধেই গোলাবর্ষণ করে হাতিয়ে নিচ্ছে এক একটি শহর এই আইএসআআই? সেই
আসাদ নিশ্চয়ই এই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর অস্ত্রের ও অর্থের যোগানদার নয়? তাহলে কি
সেই ছোটখাঠো মানুষটি, সেই পুতিন? যিনি ঘোষিত ভাবেই সিরিয়ার প্রসাশনের পক্ষে বরাবর?
এই প্রশ্নগুলি আমরা কি করি নিজেদেরকে। নিজেদের মুখ আয়নায় মুখ রেখে? প্রশ্ন কিন্তু
এইটিও!
এইসব ভয়াভয় সন্ত্রাসবাদী হামলা ও নিরীহ নিরপরাধ
নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যুমিছিলের পরপরই একএকটি রাষ্ট্রশক্তি তার সমস্ত সামরিক
শক্তির তাণ্ডবতা নিয়ে যখন ঝাঁপিয়ে পরে এক একটি অঞ্চলে; তখন সেই সেই অঞ্চলেরও যে
লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরপরাধ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ একটির পর একটি মৃত্যুমিছিলে পা
মেলায় আমরা কজন তাদের জন্যে চোখের জল ফেলি? ফেলি না, কারণ সেই অঞ্চলগুলির মানুষ
প্রথম বিশ্বের নাগরিক নয়। ফেলি না কারণ সেই সব প্রতিদিনের মৃত্যুমিছিলের ট্রিগার
যাদের হাতে থাকে, তারা প্রথম বিশ্বের নাগরিক। অনেকেই হয়তো আমাদেরিই সহনাগরিক। কারণ
আমরা অনেকেই আজ প্রথম বিশ্বে স্থান করে নিয়েছি আপন যোগ্যতাবলে। তাই তাদের হাতে
তৃতীয় বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মনুষের প্রাণ গেলেও সেটি আমাদেরই সাদা চোখে আর
সন্ত্রাসবাদ নয়। তাই ভিয়েতনাম আফগানিস্তান ইরাকে বোমারু বিমানের হানা, মিসাইল
বর্ষণ আমাদের পলিটিক্যাল সাইন্সে সন্ত্রাসবাদ নয়। সেই কোটি কোটি মৃত্যুর জন্যে
একমিনিট নিরবতা পালনের জন্যে দান-খয়ারত করার মতো অযথা সময়ও তাই আমাদের হাতে নেই।
আমাদের হাতে সেই সময়ও হয়তো নেই, যে সময়টুকু
থাকলে আমাদের মনে চতুর্থ যে মূল্যবান প্রশ্নটি জাগত, অর্থাৎ, নিউয়র্ক, লণ্ডন, প্যারিসের
মতো নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মোড়া মহানগরগুলিতে কি করে থেকে থেকে কড়া নিরাপত্তা
বেষ্টনীর নিশ্ছিদ্র বলয় ভেদ করে সন্ত্রাসবাদী হামলা সংগঠিত হয়। সেবার প্যারিসে বীভৎস
নরঘাতী নৃশংশ হামলার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই যে ভাবে ফরাসী সামরিক বাহিনী সিরিয়ায়
ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাতে তাদের কর্মতৎপরতা ও সামরিক ক্ষমতা নিয়ে তো কোন সংশয় থাকতেই পারে না। আর থাকে না বলেই
মূল সংশয়টা তাই তলায় তলায় গড়ে ওঠে, সেই সময় প্যারিসের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কিছুটা
ঢিলেঢালা করে রাখা হয়েছিল না তো? ঠিক যেমনটা ঘটে ছিল নিউয়র্কে ১১ই সেপটেম্বর
সকালে? ঠিক যেমন আফগানিস্তানের মাটিতে পা রেখে ইরাকের তৈলকূপগুলির দখল নেওয়ার খুব
তাড়া ছিল বুশ প্রসাশনের? তাই টুইনটাওয়ার ধ্বংসের দায়টা বিনা তদন্তেই আলকায়দার নামে
চালিয়ে দেওয়ার মতোই প্যারিসে সন্ত্রাসবাদী
নাশকতার মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই ফরাসী প্রশাসন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল প্যরিসের
সন্ত্রাসবাদী হামলার নেপথ্যের কারিগর কারা ছিল? বিনা তদন্তেই তারা নিশ্চিত হয়েছিল
কি করে ২০১৫’র নভেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার নেপথ্যে সিরিয়ার আইএসআই-ই? নাকি
পেন্টাগনের সাথে আলকায়দার আত্মীয়তার মতোই বিষয়টি তলায় তলায়? না এই অত্যন্ত
স্বাভাবিক প্রশ্নগুলি করার মতো সময় ও অধ্যাবসায় নেই আমাদের। সৎসাহসটাও আর বোধহয় অবশিষ্ট
নেই আমাদের। আমরা তো টিভির সতঃসিদ্ধ
পর্দায় দেখে নিয়েছি ঘটনার দায়ে কাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। অতএব তাদের নিধন করতে
যদি হাজার হাজার নিরীহ নিরপরাধ নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের প্রাণ যায় নৃশংস মিসাইল
হানায়, তো যাক না! তবুতো সোয়াশো মৃত আত্মা শান্তি পাবে, প্রতিশোধ নেওয়া গেছে ভেবে।
কিন্তু সত্যই কি প্রতিশোধ নেওয়া গেল? যায় কি এই
ভাবে? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির সম্মুখীন হতেও রাজি নই আমরা। আফগানিস্তান ইরাক তছনছ করে দুটি দেশের কোটি কোটি
নিরীহ নিরাপরাধ নিরস্ত্র মানুষের মৃতদেহ থেঁতলে দিয়ে গর্বিত মার্কীণ মেরিনের উদ্ধত
পদচারনায়েও অনেকেই শান্তি পেয়েছিল এই ভেবে যাক টুইন টাওয়ারের নিহত নিরপরাধ নিরীহ
নিরস্ত্র মানুষগুলির মৃত আত্মা শান্তি পাবে এবার। কিন্তু ঝুলি থেকে যখন আস্তে
আস্তে বিড়াল উঁকি মারতে শুরু করছে সম্প্রতি; যখন হাতের সামনে উঠে আসছে স্তম্ভিত
করে দেওয়ার মতো এক একটি প্রমাণিত তথ্য, যখন জানা যাচ্ছে টুইনটাওয়ারের ভিতরেই দিনে
দিনে মজুত করে রাখা ছিল ন্যানোথার্মাইট নামক অত্যাধুনিক একধরণের পারমাণবিক
ডিনামাইট জাতীয় বোমা, যার তেজস্ক্রিয় বিকীরন খুবই ক্ষণস্থায়ী কিন্তু স্টীল গলিয়ে
ধোঁযা করে দেওয়ার ক্ষমতা অত্যাধিক; যে টুইনটাওয়ারের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা
সংস্থার মালিক ছিলেন বিশ্ববিবেক মহাশক্তিধর তৎকালীন মার্কীণ রাষ্ট্রপতির ভাই জেব
বুশ নিজেই, তখন বোধহয় এই ভেবে আর শান্তি পাওয়া যায় না- যে যাক প্রতিশোধ নেওয়া
গিয়েছে টুইন টাওয়ারের শতশত জলন্ত মৃত্যুর। তাই না?
তাই খোদ মার্কীণ মুলুকেই অনেকেরই এই মিথ্যে
শান্তির ঘোর গিয়েছে কেটে। আর তাই তারা প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন, যে প্রশ্নগুলি করতে আমরা ভয় পাই। কারণ
শতাধিক বছরের পরাধীন মানসিকতার বীজ আমাদের অস্থিমজ্জায় আজ মহীরুহ হয়ে উটেছে। আমরা
একটা গ্রীণকার্ডের জন্যে নিজের মেধাকে শান দিতেই ব্যস্ত, তাই আমাদের ভয় থাকে
প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের। যার নুন খাবো, তার গাল পরি কি করে, বিবেক বলে তো একটা
পদার্থ আছে নাকি? কিন্তু যারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক, যাদের শৈশব থেকে
বিদেশী ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করতে হয় না, যাদেরকে মেরুদণ্ড বন্ধক রেখে দাঁড়াতে হয়
না গ্রীণকার্ডের লাইনে, তারা কিন্তু প্রশ্ন করতে শুরু করছেন, একটা যাত্রীবাহী
বিমান ঢুকে পড়ে শততলার বহুতলকে ঐরকম দর্শনীয় ভাবে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ধূলিস্যাৎ করা
বিজ্ঞানের নিয়মেই সম্ভব কি না আদৌ। তারা শতাধিক পদার্থ বিজ্ঞানী মিলে এই প্রশ্নের
উত্তর খুঁজতে গিয়েই আবিষ্কার করছেন ঠিক কিভাবে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করা হয়েছিল।
বিজ্ঞানের নিয়ম মেনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে কি ভাবে টুইনটাওয়ারকে একটি
জতুগৃহে পরিণত করা হয়েছিল মাসাধিক কালব্যাপি নিখুঁত কর্মতৎপরতায়, সেকথাই তারা
জানিয়েছেন বিশ্ববাসীকে। আর তখনই উঠে এসেছে এইসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। কিভাবে একটি
বিমানও ব্যবহার না করে শুধুমাত্র দূরনিয়ন্ত্রিত মিসাইল ব্যবহার করে ও তার সাথে
নিউজ চ্যানেলে তৈরী করা ভিডিওগ্রাফীর স্পেশাল এফেক্ট টেকনোলজী কাজে লাগিয়ে আবিশ্ব
মানুষকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছিল টুইনটাওয়ারে বিমান হানার মিথ্যে ছবি দেখিয়ে। এসব তথ্য
উঠে আসছে খোদ মার্কীণ মুলুকের পদার্থ বিজ্ঞানীদেরই তদন্তের হাত ধরে। আর তখনই
সেদিনের জলন্ত পুড়ে মড়া মার্কীণ নাগরিকদের পরিবারগুলির সদস্যরাও বুঝতে পারছেন, না
আফগানিস্তান ইরাককে গুঁরিয়ে শত বছরেরে মতো পিছিয়ে দিয়েও টুইনটাওয়ারের ঐ প্রায় চার
হাজার মানুষের নির্মম নৃশংস মৃত্যুর বদলা নেওয়া যায়নি এক ফোঁটাও। বরং কোটি কোটি
নিরীহ নিরস্ত্র নিরপরাধ মধ্যপ্রাচ্যবাসীর হত্যাকারী রূপে ইতিহাসে নাম লেখা হয়ে গেল
তাদেরই।
এটাই সন্ত্রাসবাদ! এইভাবেই সন্ত্রাসবাদের
অভিশপ্ত ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে আজ বিশ্ব বিবেক। বৃহৎ শক্তি তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে
সন্ত্রাসবাদকেই করে তুলেছে তার অস্ত্র তার ঢাল। এই সন্ত্রাসবাদের জুজু দেখিয়েই
আবিশ্ব মানুষকে বৃহন্নলায় পরিণত করে তোলার পদ্ধতিই আজকের আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের
নবতম অধ্যায়। না একথা সত্য নয়, যে আমরা এই সত্য সম্বন্ধে সচেতন নই। আমরা অধিকাংশই
এই সত্য জানি। আমরা কি জানি না, আলকায়দা কাদের সৃষ্টি? আমরা কি জানি না তালিবানী
জঙ্গীরা কাদের আর্থিক মদতে ও প্রশিক্ষণে, কাদের সরবরাহ করা গোলাবারুদে পুষ্ট হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ
উদারপন্থী সংস্কারমুখী আফগানিস্তানকে মৌলবাদের পীঠস্থানে পরিণত করেছিল? আমরা কি
জানি না আইএসআই কাদের সৃষ্টি? কি উদ্দেশ্যে সৃষ্ট? কাদের অর্থে কাদের প্রশিক্ষণে কাদের সরবরাহ করা
গোলা বারুদে বলিয়ান হয়ে এরা এত ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।? কাদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ সিরিয়ার
আসাদকে সড়িয়ে সেই দেশটিকেও আধুনিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মৌলবাদের পীঠস্থানে
পরিণত করার? কতদিনের চক্রান্ত? আমরা কি জানি না ইরাক আক্রমণের আসল লক্ষ কি ছিল?
কাদের কোষাগার ফুলে ফেঁপে উঠেছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিশ্বব্যাপি চর্চায়?
সন্ত্রাসবাদের এই চর্চা কি করে সামরিক অস্ত্র ব্যবসায়ের আন্তর্জাতিক বাজারকে
লাভজনক করে তোলে ও নিয়ন্ত্রণ করে সে কথাও আমাদের মধ্যে কজন জানে না? সন্ত্রাসবাদ
কি ভাবে বৃহৎ শক্তির দেশগুলির অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখে সে কথা বুঝতে গেলে কি
অর্থনীতিবিদ হতে হয়? আসলে আমরা সব জেনেও চোখবুঁজে না জানার ভান করি। কারণ য পলায়তি
স জীবতি। এটাই আমাদের শিক্ষা। এটাই আমাদের দীক্ষা। প্যারিসের নাগরিকরাও হয়তো সে
কথাই ভেবেছিল। তাই এই সন্ত্রাসবাদের চর্চার নেপথ্য শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার
প্রয়োজন কতটা বুঝতে পারে নি তারাও আমাদেরই মতো। আর সেই না বোঝারই মূল্য দিতে হল
অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে।
আমাদেরও দিতে হবে। আজ না হয় কাল! যদি না আমরা
মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি সন্ত্রাসবাদ একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার। যে হাতিয়ারটি ব্যবহার
করে ক্ষমতার মসনদে বসে ক্ষমতার বিস্তার ঘটায় রাষ্ট্রশক্তি নিজেই। আর সেই অশুভ
শক্তির সাথে হাত মেলায় শিল্পজগত আর অপরাধ জগৎ। যারা ধর্মের ধ্বজাটা সামনে টাঙিয়ে
মানুষকে বোকা বানানোর কৌশলকে শিল্পে পরিণত করে তুলেছে ঠাণ্ডাযুদ্ধ পরবর্তী একমেরু
বিশ্বব্যবস্থায়। আর এই কৌশলের বিরুদ্ধেই আজ যদি আবিশ্ব সচেতন নাগরিক গর্জ্জে না
ওঠে তবে কাল পরবর্তী মৃত্যুমিছিলের যাত্রী কে হবে আর হবে না কিচ্ছু বলা যায় না।
শ্রীশুভ্র