এক বিচ্ছিন্ন দূরত্বের অভিবাসী ~ তৈমুর খান


এক বিচ্ছিন্ন দূরত্বের অভিবাসী সত্যসাধন চট্টোপাধ্যায়
তৈমুর খান

যাঁকে আমার প্রথম যৌবনে পরিব্যাপ্ত এক আকাশ বলে দেখতে শিখেছিলাম, যাঁকে নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের মতো ভাবতে শিখেছিলাম, যাঁকে সূর্যের ভাষা বলে বোধ জেগেছিল তাঁর কাছেই ভাসমান হতে, নিস্তব্ধ হতে, রোদ্দুর কণা হতে চেয়েছিলাম। দীক্ষা নয়, শিক্ষাও; গ্রহণ নয়, সঞ্চারওপ্রসন্নতা নয়, প্রজ্ঞাপারমিতাও। এরকম মানুষ আর দ্বিতীয়টি পাইনি। পৃথিবীতে তিনি মহাপৃথিবীর দেবতা।

তিনিই সত্যসাধন চট্টোপাধ্যায় (১৯৩২ ২০০৮)  জন্মগ্রহণ করেছিলেন বীরভূম জেলার রামপুরহাট সংলগ্ন কাবিলপুর গ্রামে পিতা ছিলেন মণীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা ছিলেন বীণাপাণি চট্টোপাধ্যায়। বংশলতিকা অনুসারে এঁরা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বংশধর। পূর্বপুরুষের একটি অংশ বীরভূম জেলায় বসবাস করতেন। রামপুরহাট হাইস্কুল এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাশ করে শিক্ষক হিসেবেই যোগদান করেন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বীরভূমের লালমাটির রুক্ষ প্রান্তর শ্যামপাহাড়িতে এটি অবস্থিত  শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষাপীঠ নামে। বেশ নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানেও সগৌরবে তার সুনাম বজায় রেখে চলেছে। এখানেই তাঁর কবিজীবনের শূন্যদর্শনের নিঃসঙ্গ অভিমান জেগে ওঠে  ১৯৯৭ সালে অবসর গ্রহণের পর ডানা”  নামে একক প্রচেষ্টায় একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন। সেখানেই প্রতিফলিত হয় তাঁর সৃষ্টির নানা স্বাক্ষর। মালার্মে, র‌্যাবো, কাম্যু, টেনিসন প্রমুখ পাশ্চাত্য কবিদের কবিতা নিয়ে তিনি অনর্গল কথা বলতে পারতেন। তেমনি জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর প্রিয় কবি। তাঁর লেখা কবিতার মধ্যে সেইসব কবিরই প্রভাব দেখতে পেতাম।

নির্মোহ দৃষ্টিতে খোলা আকাশের দিকে চেয়ে থাকতেন। মানুষের ভিড়ে বা কোনও অনুষ্ঠানে সচরাচর তিনি যেতেন না। নিজের লেখা পড়েও শোনাতেন না। জোর করলে হয়তো দুএকটা পড়তেন। প্রায় কয়েকশো কবিতা লিখলেও কখনও বইপ্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। জীবনের শেষদিকে ২০০৭ সালে স্থানীয় প্রকাশনী কাঞ্চিদেশের উদ্যোগে শূন্যতার দরজানামে একমাত্র কাব্যটি প্রকাশিত হয়। প্রায় ৩২ টি কবিতা আছে এতে। কোনও কবিতারই নামকরণ করেননি।

আজীবন শূন্যতার ভেতর দিয়েই কবির নির্মোহ যাত্রা —  এই কাব্যটিতেই তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শূন্যতার দরজা”  যেন সৃষ্টির স্তব্ধতা বা নীরবতার ভেতরই আমাদের অনবরত ধাবিত করে। সেখানে Emptiness এবং Nothingness-র-ই প্রয়োগ ঘটেছে বারবার। আমেরিকান দার্শনিক তথা লেখক Wayne Dyer (১৯৪০ ২০১৫) একটি প্রবন্ধে লিখেছেন :  “Everything that's created comes out of silence. Your thoughts emerge from the nothingness of silence. Your words come out of this void. Your very essence emerged from emptiness. All creativity requires some stillness.”সমসাময়িক কবি সত্যসাধন চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যেও এই ভাবনা জারিত হতে দেখি। কবি লিখেছেন : 

অন্তহীন এই সৃজন শুধু শূন্যতার অলাতচক্র
          ভ্রান্তিময় মায়া?
সংশয়ের গূঢ়পাতাল সত্তা জুড়ে ফেলছে
এক গভীর থেকে গভীরতর ছায়া
এখন শুধু সর্বব্যাপী অপরিচয়
                   আঁধার গাঢ়তম
হে নির্বাক মহাপাতাল
হে সৃজনের অন্ধকার
হে অস্তিত্ব ভ্রান্তিময়
নমঃ নমঃ নমঃ

অন্ধকার আর ভ্রান্তিময় অস্তিত্বযাপনের শূন্যযাত্রায় ব্যর্থ ও নিঃসঙ্গতাকেই কবি বারবার খুঁজে পেয়েছেন। জীবন মোহের অনুষঙ্গ মাত্র। তাই বেঁচে থাকাও অর্থহীন। অশরীরী শূন্যতার ছায়া সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে। শূন্য সমাকলনের গর্ভে শুধু ধ্রুবকেরই জন্ম হয়। সে ধ্রুবক অনড়, নিথর। অস্তিত্ব শূন্যতাতেই বিলীন হয়ে যায়। চৈতন্য শূন্যতারই ধ্রুবক সুতরাং সবই যখন Nothingness এবং Emptiness দ্বারা নির্ণীত, সেখানে জীবনের অর্থই বা কী থাকতে পারে? অন্য একটি কবিতায় কবি লিখেছেন :

জীবনের মানে আমি খুঁজি না আর
কী হবে সে মানে জেনে?
বরং অনেক ভালো না জানার
বুকের গভীরে এই নিহিত আঁধার
কী হবে জ্ঞানের দেশলাই কাঠি জ্বেলে?”

এই অন্ধকার যেন চৈতন্যদহনেরও যা মৃত্যুরই নামান্তর। সংশয়বাদী কবিকে বারবার পীড়িত করেছে। বাইরের জগৎ সম্পর্কেও নিস্পৃহ হয়েছেন। সাংসারিক জীবনেও মিশতে চাননি। বাস্তবিক বৈভবে নিজেকে ডোবাতে চাননি। উঁকি মারতে চাননি প্রকৃতির রোমান্টিক হাতছানিতেও :

এই ঘরটায় মোটে একটা জানালা
আমার ভালো লাগে না, ভালো লাগে না

বিষাদের অন্ধকারে আত্মজীবী এই কবি জীবনানন্দ দাশের মতোই যুগযন্ত্রণা থেকে পলায়নবাদকেই গ্রহণ করেছেন। ষাট-সত্তর দশক থেকে কলম ধরলেও কখনও উচ্চকিত হননি। চোখের তারায় ক্লান্তি এবং বিষাদ লেগেগেছে কবিরও। আর নিজের দিকে নিজেই তাকিয়ে থেকেছেন। যা দেখেছেন, যা শুনেছেন, যা করেছেন সবই Emptiness-র সাবলীল প্রকাশ। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। ছায়ারা অন্ধকারে হাঁটছে। কবি বেঁচে থাকার অর্থহীনতা টের পাচ্ছেন। টি এস এলিয়টের ফাঁপা মানুষের মতো হয়ে গেছেন।

এই কবির কথা হয়তো আগামী প্রজন্ম জানবে না, কিন্তু তাঁর ছাত্ররা এখনও কেউ কেউ স্মরণ করতে পারে মানুষটি কতটা বিচ্ছিন্নতার দূরত্বে বসবাস করেছেন। আত্মমগ্ন পথে একাকী হেঁটেছেন। ধূসর পৃথিবীর রণ-রক্ত-সফলতা তাঁকে এক বিন্দুও স্পর্শ করতে পারেনি। অর্থ-কীর্তি-স্বচ্ছলতার দিকেও তিনি মুখ ফিরে তাকাননি। শুধু একটি না-বলা কথার বেদনা নিয়ে”  চলে গেছেন এই পৃথিবী থেকে।

শূন্যতা শুধু দর্শন নয়, কবির কাছে শূন্যতা এক ভাষাও। স্তব্ধতার নিরুক্ত আড়ালচারীর ঐশ্বর্যে তা নিষিক্ত। বিধৃত। তবু সীমাহীন একাত্মতায় তা নিগূঢ় পর্যটক করেছে কবিকে। কবিতার একটি অংশে লিখেছেন সেকথা :

আকাশে শুধুই মেঘ

মেঘে শুধু ছায়া লেগে

আমার মুখেও যেন ছায়া জেগে

শূন্যতারও ছায়া থাকে

শূন্যতাও ছায়া ফেলে

ছায়া নিয়ে, ভ্রান্তি নিয়ে

গহন আঁধার নিয়ে

সাপের দৃষ্টি নিয়ে

সমস্ত চৈতন্য

শুধু বিষ ঢেলে দেয়

এই ছায়া সাপের দৃষ্টির উপমায় কবির সমস্ত চৈতন্যে জেগে ওঠে ভ্রান্তিময় জগতের অভিবাসী করে তোলে কবিকে। ছায়ারও বিষ আছে। এই বিষ যাবতীয় পার্থিবতার ঊর্ধ্বে আত্মসংহারের নিরবধি প্রক্রিয়ায় অবিচল। মেটাফিজিকসের প্রকাশে দীপ্র অভিমান শুধু চক্র তৈরি করে দেয়। এর থেকে তিনি বের হতে পারেন না। প্রতিটি কবিতাতেই যে ভ্রমের ও দ্বন্দ্বের উত্থান ঘটে আর তা-ই নিয়তি হয়ে ওঠে। বলেই কবির মনেও প্রশ্ন জাগে :

সৃষ্টি জুড়ে বেজে যায় যাওয়ার বিষাদগীতি

তবে কি যাওয়া-ই নিয়তি?”

কেননা, জীবনের বাল্যকাল যা ভোরের অমল আলো”, জীবনের মধ্যকাল যা দুপুরের প্রখরতাপার হয়ে জীবনের সন্ধেবেলায় পৌঁছান কবি। সেখানে শুধুই অন্ধকার। রঙিন গোলাপেরও ঝরে পড়ার সংকেত পান। মানুষ তো নিজের প্রকৃতিকেও মেনে নিতে অস্বীকার করে। আলবার্ট কাম্যু (Albert Camus) এই কারণেই বলেছেন :“Man is the only creature who refuses to be what he is.” কিন্ত অনিবার্য সময়ের শাশ্বত চৈতন্যে তো শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই শেষ স্তব্ধতা নিয়ে উপস্থিত হয়। একে কে অস্বীকার করবে?

তবু জীবনবৃত্তে জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানে যে ভালো থাকা” “না-থাকার যে ক্রিয়াটি যাওয়া-আসা করে তার কি কোনও মূল্য নেই? কবি বলেছেন :

এ দুয়ের মাঝখানটিতে কিছুই থাকে না তাই

একেবারে ফাঁকা

ব্যক্তি এই ফাঁকা জায়গাটির মাঝখানে কিছুকাল অবস্থান করেন মাত্র। তাঁর প্রবৃত্তি নিয়ে, মোহ নিয়ে, সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্ব নিয়ে। শীত-গ্রীষ্ম উপভোগ করেন। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ভালো বা মন্দ-ই বা কী তা জানে না। সত্যিই তো সবই সাময়িক। জীবনে কোনওকিছুই যখন স্থায়ী নয়, তখন কিছু না-পাওয়ার জন্য কষ্টই বা কেন? এই দার্শনিক প্রত্যয়েই সমর্পিত কবি আর কিছু ভাবতে চাননি। নিজে থেকেই চোখ বুজেছেন। অন্ধকারকে আত্মগত পরিধির নির্মম নিয়তিরই আধার করে তুলেছেন। কোনও লেনদেন আর নেই যেন। কোনও কথা বলারও নেই। কোনও ঘরও নেই নিরিবিলি আশ্রয়ের। পাখিরা বাড়ি ফেরে সন্ধ্যায়, কিন্তু কবি কোথায় ফিরবেন?

জীবন সেই ভাসমান দুঃসহ বেদনার বৈভবেই নির্বাসিত। শূন্যতার ব্যাপ্তিতেই তার অন্তর্হিত হওয়া।

তৈমুর খান


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন