সূচীপত্রে পৌঁছাতে ক্লিক করতে পারেন এই লিংকে
যুদ্ধটা কৃষকদের। সরকারের আনা আইনের বিরুদ্ধে।
সরকারের সাথে। যে দেশে ৭০% মানুষ কোন না কোনভাবে কৃষির সাথে জড়িত, সেদেশে কৃষকদের কে কে
সমর্থন করলো আর করলো না, তাতে কৃষক আন্দোলনের বিশেষ কিছু যাবে আসবে না। সমগ্র
কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হলে প্রয়োজনে সরকার পতনও ঘটে যেতে পারে। সমস্যা সেখানে নয়।
সমস্যা হল সমগ্র কৃষক সমাজের ঐক্যবদ্ধ হওয়া নিয়ে। এবং সেই ঐক্য মজবুত রাখা নিয়ে।
সরকারপক্ষ তার সমস্ত মেশিনারি দিয়ে কৃষক সমাজকে বিভক্ত রাখার চেষ্টা করবে। সেটাই
সরকারের কাজ। সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলও তার সকল শক্তি নিয়োগ করবে কৃষক
আন্দোলনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে। এবং রাজনৈতিক বল প্রয়োগ করে কৃষক আন্দোলনের
বিরুদ্ধে লাগাতার অপপ্রচার চালিয়ে যাবে। বিগত বছরের ২৬শে নভেম্বর থেকেই যা করা
হচ্ছে। এবং আরও জোরদার অপপ্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে ২৬শে জানুয়ারীর লালকেল্লা
ষড়যন্ত্রের পর থেকে। ফলে ছবিটা এখন পরিস্কার। একদিকে কৃষক সমাজের একটা বড়ো অংশের, রাজপথে দুর্বার কৃষক
আন্দোলন। অন্যদিকে সরকার তার সমস্ত শক্তি নিয়ে। এবং সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
রাজনৈতিক দল,
তার
রাজনৈতিক শক্তির দৌলতে লাগাতার অপপ্রচারের কার্যক্রম নিয়ে। এই দুই মুখোমুখি পক্ষের
মাঝে আমি আপনি কখন কোন পক্ষে, সেটা খুব একটা জরুরী বিষয় নয় বলেই মনে হয়।
যেটা জরুরী বিষয়। সেটি হলো। আমার আপনার এই কৃষক
আন্দোলন সম্বন্ধে ব্যক্তিগত অবস্থান কি, সেটি। তাতে কৃষক আন্দোলনের গতি প্রকৃতি পরিণতি কোন কিছুই
নির্ভর করছে না ঠিক। কিন্তু নির্ভর করছে আমার আপনার আত্মপরিচয়ের আসল ছবিটি। এই যে
আমি আপনি। কেউ অশিক্ষিত। কেউ স্বল্প শিক্ষিত। কেউ উচ্চ শিক্ষিত। এবং অনেকেই
অর্ধশিক্ষিত। আমরা এই আন্দোলনলকে কিভাবে দেখছি। বুঝছি। জানছি। এবং অনুধাবন করছি।
সেখানেই কিন্তু আমাদের আত্মপরিচয়ের স্বরূপ। অনেকেই মুখে কুলুপ এঁটে থাকায়
বিশ্বাসী। থাকবও। অনেকেই সরব হতে ভালোবাসি। হই্। কেউ একজনের পক্ষে তো কেউ আর
একজনের পক্ষে। কিন্তু যারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকায় পারদর্শী, তারাও অন্তরে কোন না
কোন একটি পক্ষের হয়ে ওকালতি করতে থাকি। ফলে খোলা আকাশের নীচে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায়
দিল্লীর সীমানায় ব্যারিকেডের ওপারে রাজপথে অবস্থানরত কৃষকদের আন্দোলনের পক্ষে
কিংবা বিপক্ষে আমরা সকলেই। কেউ ভোকাল। কেউ সাইলেন্ট।
এখন আন্দোলনের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে আমাদের এই
অবস্থান আমাদেরকে প্রথমেই যে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, সেটি হলো। আমরা কে কতটা
সৎ। একজন অসৎ মানুষ যে কখনোই চলমান কৃষক আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়াবেন না। সেটা কিন্তু
চোখ বুঁজেই বলে দেওয়া যায়। কিন্তু তাই বলে একথাও বলা যায় না যে কৃষক আন্দোলন
বিরোধী সকলেই অসৎ। তার একটা অন্যতম কারণ এই, আমাদের দেশে স্বাধীন ভাবে
চিন্তা করার মতো ক্ষমতা খুব বেশি মানুষের থাকে না। প্রায় অধিকাংশ মানুষই প্রচারের
দাসত্ব করে থাকে। কি অশিক্ষিত। কি অর্ধশিক্ষিত। কি শিক্ষিত। ফলে এই শ্রেণীর
মানুষের একটাই ভরসা। প্রচার যন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ। এবং তাঁরা সেটাই করে থাকেন।
কোন না কোন পক্ষের প্রতি অন্ধভক্তিই এই কাজে সহায়তা করে থাকে। এবং এই অন্ধভক্তি
এমনই সুদৃঢ় যে নিজের ঘাড়ে কোপ না পড়লে ভক্তি টলে না। বস্তুত চলমান কৃষক আন্দোলনে
অংশ নেওয়া প্রায় সকল কৃষকের ক্ষেত্রেই এই ঘটনাটিই ঘটে গিয়েছে। এই কৃষি আইন পাশ
হওয়ার আগে বিগত সাত বছরে সরকারের আনা একাধিক অন্যায্য আইন প্রয়োগের সময়েও এই
কৃষকদের সরকারের প্রতি অন্ধবিশ্বাসে টাল খায়নি। কারণ সেই আইনগুলি সরাসরি তাদের
জীবনজীবিকায় মারণ কোপ বসায় নি। তাই তাঁরা সরকারের প্রতি তাদের অন্ধবিশ্বাসের
ধারাটিকে মজবুত করেই ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু এইবার, নতুন এই কৃষি আইন চালু হতেই সেই
সুদৃঢ় অন্ধবিশ্বাসে এমন ফাটলই ধরলো যে, আজ অধিকাংশ কৃষকই সরকার বিরোধী অবস্থানে পৌঁছিয়ে
গিয়েছেন। কারণ এই আইন সরাসরি তাদের জীবনজীবিকাকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে
দিয়েছে। কথায় আছে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। ভারতবর্ষের কৃষকরা আজ সেটি হাড়ে হাড়ে টের
পাচ্ছেন। তাই রাজপথই আজ তাদের একমাত্র আশ্রয়। একমাত্র অস্ত্র।
অন্ধবিশ্বাস যখন ভাঙে তখন এইভাবেই বন্যার জলে
বাঁধ ভাঙার মতো করেই ভেঙে পড়ে। এখন কৃষক আন্দোলন আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের
স্বরূপ উন্মোচনেও একটা বড়ো ভুমিকা রেখেছে। এই আন্দোলন প্রমাণ করে দিচ্ছে, আমরা কে কতটা অন্ধভক্ত।
আর কে কতটা প্রকৃত শিক্ষিত। যাঁর স্বাধীন ভাবে চিন্তা করার সক্ষমতা রয়েছে। সমাজের
পক্ষে মাঝে মাঝে এই ঝাড়াঝাড়ির খুব দরকার। কুলোয় করে ঝাড়ার মতোন, আমরা দুই পক্ষে ভাগ হয়ে
যাচ্ছি। কে অন্ধভক্ত। আর কে চক্ষুষমান। এটার সত্যিই খুব দরকার ছিল। যাঁরা সমাজ ও
সমকাল নিয়ে পড়াশুনা করেন। গবেষণা করেন সমাজ ও রাজনীতির সমকালীন ইতিহাস ইত্যাদি
নিয়ে। তাঁদের পক্ষে এ এক মেঘ না চাইতেই জল। তাঁরা দেখতে পারছেন সমাজের সামগ্রিক
চিত্রটা। বুঝতে পারছেন সেই চিত্রের বাস্তবিক সত্যের স্বরূপ।
এখন প্রশ্ন, আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? আমাদের নিজেদেরকে? দিল্লীর সীমান্তে
অবস্থানরত এই কৃষক আন্দোলনের পরিণতি যাই হোক না কেন। এই আন্দোলন আমাদেরকে এক
যুগসন্ধিক্ষণের আগাম বার্তা দিচ্ছে। সেই যুগসন্ধিক্ষণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে
আমরা কি চিনে নিতে পারছি নিজেদের স্খলন পতন কিংবা অর্জন? উপলব্ধি করতে পারছি নিজেদের
ব্যক্তিস্বরূপের একান্ত উন্মোচনকে? আমাদের ব্যক্তিস্বরূপের একান্ত এক উন্মোচন তো হচ্ছেই।
কুয়াশা কেটে যেতে থাকা ভোরের মতো। হ্যাঁ, সেই ঘটনা স্বীকার করা না করা, প্রত্যেকের মৌলিক অধিকারের বিষয়
অবশ্যই। চলমান কৃষক আন্দোলনের এই এক বড়ো সাফল্যের দিক। আজ আর নিজের কাছে নিজেকে
লুকিয়ে রাখার উপায় থাকছে না। যে কাজটি আমরা বিশেষ দক্ষতার সাথে বছরের পর বছর ধরে
চালিয়ে এসেছি। আর এসেছি বলেই হয়তো আজ শুধু কৃষকরাই পথে বসে নি। বাকিরাও সময়ের সাথে
সাথে একে একে বসতে চলেছে। কেউ একটু আগে কেউ একটু পড়ে টের পাবে শুধু।
কৃষক আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষে থাকা নিয়ে আমরা
নিজেদের সাথে অন্যদেরকেও চিনে নিতে পারছি। কার দৌড় কত। কে কোন দরের। এবং তাই নিয়ে
সমাজে জল ঘোলাও কম হচ্ছে না। কে কি টুইট করলো। কে কার কোন টুইট রিটুইট করলো। কে কি
বাইট দিল। ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার কৃষক আন্দোলনের উপরে নেমে আসা রাষ্ট্রীয় দমন
পীড়নের পক্ষে বিপক্ষে থাকার ভিতর দিয়েও আত্মস্বরূপের উন্মোচন হচ্ছে। বেশ দ্রুতই।
এর ভিতর আবার অনেকে আছেন। যাঁদের সাহেব মেমদের কথার উপরে বিশ্বাস বেশি। ফলে ভারতীয়
কৃষক আন্দোলন ও সেই আন্দোলন দমনে কেন্দ্রীয় সরকারের ভুমিকা নিয়ে সাহেব মেমরা কে কি
বলছেন,
তার উপরেও
অনেকের গভীর বিশ্বাস। এবং সেই মতো নিজেদের চিন্তা ভাবনা সমর্থন বিরোধীতার ভুখণ্ড
সাজিয়ে নিচ্ছেন।
এই সব খণ্ড খণ্ড ছবিগুলি সামগ্রিক ভাবে একটা ছবি
সুস্পষ্ট করে তোলে। সেটি হলো আত্মনির্ভর মানসিকতার অভাব। অপুষ্টির মতো এই একান্ত
মানসিক পরনির্ভরতাও এক রোগ। এই রোগ সমাজের ভিতরে যত গভীরে শিকড় বিস্তার করবে এবং
যত ব্যাপক ছড়িয়ে পড়বে একটি দেশ একটি সমাজ ততই দুর্বল হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক শক্তিগুলি
এই মানসিক পরনির্ভতার ভিতের উপরেই তাদের রাজত্ব বিস্তার করে। এবং নিজেদর শক্তি ও
সম্পদ বৃদ্ধি করে নেয়। তাতে রাজনৈতিক শিবিরগুলি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে ঠিকই।
কিন্তু জাতি ও দেশ তত বেশিই দুর্বল হয়ে পড়ে। চলমান কৃষক আন্দোলনের দীপ্তিতেও যদি
আমাদের চেতনার রুদ্ধ দ্বার না খোলে, তবে সেটা হবে আত্মহত্যার সামিল। এই কৃষক আন্দোলন সফল হোক
বা ব্যর্থই হোক। জাতির পক্ষে একটা স্থায়ী ছাপ রেখে যাবে নিঃসন্দেহে। সেই ছাপ
আমাদেরকে নিজেদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আমাদেরকে আত্মনির্ভর করে তুলতে পারলে, সেটাই হবে এই কৃষক
আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভুমিকা।
সম্পর্ক
সুধাদেবীর কথা
খুব
সকালে উঠেই এক কাপ চিনি ছাড়া লিকার চা দিয়ে দুটো থিন এরারুট বিস্কুট খেয়েছেন
সুধাদেবী। সময় আজকাল আর যেন কাটতেই চায়না তাঁর। বারান্দায় শূন্য দৃষ্টি মেলে বসে
আছেন একখানা প্লাস্টিকের চেয়ারে। টবের
মধ্যে নিজের হাতে লাগানো পাম গাছের কেয়ারী করা একতলার এই ব্যালকনিটি তাঁর নিজস্বী।
কখনো হাঁটেন আপনমনে সামনের লনে। ছোট্ট ছোট্ট ঘাসে পা ফেলতে ফেলতে ভাবেন ফেলে আসা
কত যে কথা। বড়ই প্রিয় ভোরবেলার এই মুহুর্ত টি। সামনে পিছনে মিলিয়ে ছয় কাঠা জমির
উপরে বেশ খানিকটা জায়গা ছেড়ে বাড়িটা করেছিলেন তাঁর স্বামী। পিছনের দিকটায় খুব শখ
করে বানানো ফলের বাগান। আম জাম কাঁঠালের সবুজ ছায়াঘেরা কুঞ্জ যেন। কত পাখ- পাখালির
বাসা। বড়ই উপভোগ্য তাদের সাঁঝ সকালের মেলা। পায়চারি করেন আর ভাবেন...বয়স যেন ছুঁতে
পারেনি তাঁর সদা তরুন মন কে। সামনের বাগানের নানা রঙের রংগন আর বোগেনভিলিয়ার মতই
ঢেউ দিয়ে যায় ছোট্ট ছোট্ট ভাবনার তরংগ গুলো!
"
নাহ্, লনের চারধারে হেজের
সারি... বড্ড ঝাপলা হয়ে গেছে। আজই অনিল কে ডেকে একেবারে ছোট করে ছাঁটিয়ে দিতে
হবে।"
কর্তার আমলের মালি, বড্ড বাধ্য। মা অন্ত প্রাণ।
সুধাদেবীও ভালবাসেন ছেলের মত। নিজের ছেলেরা তো কবেই পর হয়ে গেছে। দিনান্তে একবার
মা ডাকার ও ফুরসৎ নেই। কর্তা চোখ বুজেছেন আজ বছর চারেক আগে। ভেঙে পড়েন নি তিনি।
একটু একটু করে সামলেছেন নিজেকে। টাকা পয়সা, স্বামীর অবর্তমানে উইডো পেনশন, এল.আই.সির পলিসি, মেডিক্লেম সবকিছু। তারপর আছে এই সুবিশাল বাড়ির রক্ষনা
বেক্ষনের দায়িত্ব। ষোল সতেরো বছরের কালো কুলো এক আদিবাসী মেয়ে বেলি তাঁর
সর্বক্ষনের সংগী। দিদা বলতে অজ্ঞান। ছাই
ফেলতে ভাঙা কুলো এই বেলিই দিদার সম্বল। আর আছে দোতলার ভাড়াটে উড়িষ্যার অধিবাসী এক
ডাক্তার পরিবার। কতদিন ভেবেছেন আর ভাড়াটে
রাখবেন না,
তুলে
দেবেন এইবার। কিন্তু ভাড়ার ওই ক'টা টাকা বড়ই সম্বল যে তাঁর। তারপর হঠাৎ অসুখ বিসুখ করলে
ডাক্তার বাবু বড় ভরসা। থাক না যেমন আছেন ওঁরা, কি লাভ তুলে দিয়ে? কথা বলার ও তো মানুষ জন
দরকার।
বড়
ছেলের তো বিশেষ রোজগারপাতি তেমন নেই। দু মাস হল বসে আছে। কিন্তু সে মস্ত বড়
কথাশিল্পী। কথাশিল্পের কোনদিনই তেমন দর ছিল না। আজও কই? সবাই সাবাসি দেবে, ফেস বুকে ফটো পোস্টাবে, এদিকে দক্ষিনার বেলায়, সে গুড়ে বালি! বড় ছেলের
এই এক স্বভাব, সে কোন চাকরীতেই আজ অবধি থিতু হয়ে বসতে পারল না! কখনো এ
ডাল... কখনো ও ডাল...। সেই দুঃখেই বোধ হয় বউ মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেছে...! কি জানি, তিনি তো আর ওদের
দাম্পত্য সম্পর্কে প্রবেশ করতে পারেন না। যদিও বড় বৌমা তাঁকেই দোষী সাব্যস্ত করে
বাড়ি ছেড়েছে।
ছোট
ছেলে, বৌমা ও তাদের একমাত্র
সন্তান... তাঁর নাতি ঋজু। তিনজন তিনটি শহরে থাকে। বাপ মা কর্পোরেট কেরিয়ার গড়তে
ব্যস্ত। আর ছেলে প্রায় ২০০০ কিমি দূরে অজানা অচেনা শহরে কম্পুটারের নতুন নতুন
প্রযুক্তির নেশায়... নাওয়া খাওয়া ভুলে আছে।
ছোট
বৌমার ঝাঁঝালো কথাবার্তায় এখন আর রাগ করেন না তিনি। স্বামী সংগ বিহীনা নারী একা
একা জীবনের এতগুলো বসন্ত পার করে দিল, তার কথায় অল্প বিস্তর ঝাঁঝ থাকবেই বৈ কি! এ হল অভিমান
পুষে রাখার অপারগতা! সুধাদেবী বোঝেন সবটুকুই। তাই আর সাহস করে ঘাঁটান না।
দূর
প্রবাসী নাতির জন্য মন টা থেকে থেকেই হুহু করে ওঠে। নাতি অন্ত প্রাণ মানুষ টা যে
কতদি..ন আদুরে ঠামু.... ডাক টা শোনেন নি! আজকাল আর ভাল করে ঘুম আসেনা। তাঁর
অবর্তমানে তাঁর এই বাড়ি, যৎসামান্য টাকাকড়ি, গয়নাগাটির কি হবে? তিনি তো উইল করতে পারেন
না। কারন বাড়িটা স্বামী তাঁর নামে লিখে যান নি। তাহলে... তিনি একটি ইচ্ছাপত্র তো
লিখতেই পারেন...তাঁর একমাত্র মেয়ে ও ছোট বৌমার উদ্দেশ্যে! তারা নিশ্চিত মান্যতা দেবে তাঁর এই পত্রটিকে।
সব্বাইকে সবকিছু সমান ভাগ করে দিয়ে যেতে চান তিনি। প্রত্যেকের ব্যথার সমব্যথী হতে
হতে তিনি নিজে যে কি অপরিসীম ব্যাথার ভার বয়ে চলেছেন...তার তল কোথায়?
ঋজুর
কথা
অনেকদিন
হয়ে গেল বাড়ি যাওয়া হয়নি ঋজুর। দিনের পর দিন, মাস, বছর... মনে হচ্ছে যেন কত দিন।
বাড়ির জন্য বড়ই মন খারাপ করে আজকাল... শরীরটা যে কি ভীষণ খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার! জানেনা কেন যে রাতে ঘুম আসেনা! জ্বর জ্বর
ভাব সবসময়। খেতে ইচ্ছে করেনা প্রায় কিছুই। খাবার দেখলেই কেন যে বমি পায়? চেন্নাই এর এক নামী
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র সে। পড়াশোনায় বরাবরই ভাল। কিন্তু বাড়ির থেকে, ঋজুর প্রিয় শহর থেকে, স্কুলের বন্ধুদের থেকে
বড্ড যে দূর। বড্ড দূর তার প্রিয় গাছপালা থেকে। অবাক মাঠ ও তার বিস্তার থেকে...!
মন কেমনের পাল্লা ভারী হয়ে আসে আজকাল...
মা'র জন্য...ঠামুর
জন্য...কান্না পায় ভারী! কিন্তু সে যে ছেলে, ম্যাচিওরড গায়...! কান্না পেলেও
কি দেখাতে আছে?
তাই সে
রোজই যায় কলেজ...হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে প্রজেক্ট করে, গরমে ঘেমে নেয়ে একসা হয়! এসি
ঘরে বসে থেকেও স্বস্তি নেই, গলা ব্যাথা...কাশি। কেন যে শরীরটা তার দিনকে দিন বিট্রে
করছে? সেমেস্টার শেষে দিন
গোনার পালা...শেষ হলেই প্লেনে চড়ে হুউউস করে নিজের শহরে! আহ্! কতদিন যে ফুটবল
পেটায়নি! বর্ষা নেমে গেছে। সেক্টর টু সি র মাঠে বেলা পর্য্যন্ত ফুটবল পেটাপেটি...।
বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং আর মেডিক্যাল কলেজ হস্টেল থেকে স্কুলের বন্ধুরাও এসে গেছে
নিশ্চয় এতদিনে। ভাবতেই মনটা ভাল হয়ে গেল ঋজুর। কিন্তু পরীক্ষাটা তো শেষ করতে হবে!
জ্বরটা যে কেবলই আসছে, এদিকে
বাড়ি থেকে রোজ রাত্রিবেলা মা-ঠামুর ফোন। "ওরে একটা এক্স রে করা বুকের"
অথবা " ওরে ডাক্তারের কাছে যা, কিছু তো একটা কর!"
"দূউউর ভাল্লাগেনা, এত গরমে....রোদ্দুরে রোদ্দুরে কে যে বাইরে বেরোয়!"
নিজের মনেই মায়ের ইচ্ছে ধামাচাপা দেয়। আসলে ও
নিজের প্রতি বড়ই উদাসীন। কেন যে এত
উদাসীনতা...জানেনা সে! এই যা...হচ্ছে হোক...এই ভাবটা মনের মধ্যে তাড়িয়ে বেড়ায়
সর্বক্ষন।
সুধাদেবী
কতদিন
হয়ে গেল...নাতি বাড়ি আসেনা! সেই গত ডিসেম্বর এ এসেছিল ফিফথ সেমেস্টার এর পরে।
জানুয়ারি মাস টা লম্বা থেকেই ফিরে গিয়েছে
কলেজে। এখন আর ও কলেজ হোস্টেলে থাকেনা। পাঁচ বন্ধু মিলে কুক সহ একটা বাড়ি ভাড়া
করেছে।
তাহলে?... কেন এমন কঠিন অসুখ হল ওর? আচ্ছা, ও কি কোন নেশা করে? নাহ্, তাহলে তো ও তার প্রিয় ঠামুর
কাছে লুকোতে পারত না! না না আর ভাবতে পারেন না সুধাদেবী। নিজের স্বামীর মৃত্যু কোনরকমে সয়েছেন! তার ও
বহু আগে বনিবনার অভাবে হঠাৎ ডিভোর্স হয়ে যাওয়া বড় ছেলের বউ ইন্দ্রাণী ও ফুলের মত
নাতনী রিনির সমস্ত জিনিষ পত্র নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটা তাঁর বুকের ভিতর খানা
একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে। আসবাবহীন খাঁ
খাঁ ঘরে একা দাঁড়িয়ে মনে হত বুকের পাঁজরখানা খসে পড়বে বুঝি! তখন তাঁর স্বামী
জীবিত। অবিনাশ বাবু সামলেছেন তাঁকে আর তিনি দুহাতে এই সংসার।
আবার
ঋজুর চিন্তা...,
এই তো মে
মাসের শেষেই বাড়ি ফেরে ছেলেটা। উৎকর্ণ হয়ে
আছেন তিনি,
এই বুঝি
ফোন এল...'ঠামু আমি বাড়ি আসছি।' গাছে গাছে কত আম হয়েছে।
নিজের হাতে আমসত্ত্ব বানিয়েছেন। ছেলেটা বড্ড ভালবাসে। বিলিও করেছেন পাড়ার
প্রত্যেকটি বাড়িতে। এত আম খাবে কে? কিছু পাঠিয়েছেন মেয়ের
বাড়ি। ঝড়ে পড়ে যাওয়া কাঁচা মিঠে আমগুলো দিয়ে বানিয়েছেন মিষ্টি আচার। আজকাল আর
খাবার মুখে রোচেনা আচার ছাড়া, বয়সের জিভ তো!
সন্ধ্যে
হয়ে এল,
ছোট বউমা
অফিস থেকে ফেরেনি এখনো। ঘরে সন্ধ্যে দেখিয়ে টিভির দু চারটে প্রিয় সিরিয়াল দেখতে
দেখতে মনে পড়ে যায় সেন্ট জেভিয়ার্সে ঋজুর ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ের কথা। বড্ড
সংবেদনশীল ছিল ও। সেই সময় তিনি ও অবিনাশ বাবু বেড়াতে গিয়েছিলেন মেয়ের বাড়ি
আসানসোলে। বউমাও ছোট ছেলের কাছে রাঁচিতে। বাড়িতে ঋজু একা। হঠাৎই সেই ফোনটি এল।
ধড়ফড় করে উঠেছিলেন তিনি। সেই মুহুর্তেই স্বামী কে বুঝিয়ে মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরত
আসলেন তাঁরা,
আকুল
কান্নায় ভেঙে পরা নাতিকে সামলাতে। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে, পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছে ঋজুর প্রিয়তম বন্ধু ও তার গোটা পরিবার। কলকাতা
থেকে ফেরার পথে হাইওয়ের ওপরে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়! খারাপ খবর পৌঁছয় বাতাসের
ও আগে। কিশোর বেলার সমস্ত বন্ধুকে ঋজুর পাশে দাঁড় করালেও মনের এত কাছাকাছি এমন
সাথির এমনভাবে অজানার দেশে হঠাৎ চলে যাওয়া কি সহজে মেনে নেওয়া যায়?
ছোট
বেলার খেলার সাথী কে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান এই অবোধ কিশোরের পাশে সত্তোরোর্দ্ধ
ঠাকুমা মানসিক ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন।
সেদিনের
সেই কিশোর আর ছোট্টটি নেই। সাবালক... তরুন। কিন্তু কোথায় যেন... কি যেন...নেই! ওর
চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকালেই বোঝা যায়। জীবনের প্রতি অবচেতন বিতৃষ্না খেলা করে
যেন সেখানে।
ফোনটা
এল গভীর রাতে। ল্যান্ড লাইনে কাজের মেয়েটি ফোনটা ধরেই দিদাকে ডেকেছে। অন্ধকারে সামলাতে না পেরে হোঁচট খেলেন তিনি।
কাঁপা হাতে কোনমতে রিসিভার হাতে নিয়েই বুঝতে পারলেন... অঘটন যা হবার হয়ে গেছে। ঋজু
অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি।
এ
কি শুনছেন তিনি! হা ঈশ্বর, এ ও কি সত্যি! কি হয়েছে
তাঁর নাতিসাহেবের ? তাঁর
প্রাণাধিক সত্ত্বা! এত অযত্ন করে শরীরের....! কতদিন যে ছেলেটা কে নিজের হাতে
খাওয়ান না! ঠিক যেমন করতেন ছোটবেলাটায়। ওর বাবা মায়ের এত সময়ই বা কোথায়? সব আদর আবদার গিয়ে পড়ত
ঠামুর ওপরে! আহা গো! কি হল ছেলেটার? কেন হল?
রিনির কথা
রিনি....রিনিইইইইই...., কলেজ থেকে বেরোতে গিয়ে
পা আটকে গেল রিনির। ঠিক যা ভেবেছে তাই। শিভম্ পথ আটকে দাঁড়িয়ে।
-
কি রে, কানে তুলো নাকি তোর? কখন থেকে ডাকছে ও, কানেই যাচ্ছেনা বল?
মেহুলির
কথায় সংবিত ফিরল রিনির।
-
আরে ছোড়
দে ইয়ার,
ইয়ে ত
মেরা আদত সা হো গ্যায়া! দেখ কর ভি ইয়ে দেখতি নেহি হ্যায় মুঝে আজকাল!
-
আরে নেই
ইয়ার, য়্যসা বাত ভী তো নেহি
হ্যায় রে কি তুঝে বিন দেখকে রিনি চলা যায়!
য়্যসা
কভি হুয়া হ্যায় বোল্?
-
হুয়া তো
নেই, লেকিন আজকাল তু বহোত
খোয়ি সি রহতি হ্যায়। কিঁউ রে, মুঝে বাতানা, বাত ক্যায়া?
-
চল কঁহি
ব্যঠকে বাত করতে হ্যায়। মেহুলি যাবি না চলবি??
-
নাহ্ রে, তোরা যা। কাবাব মে
হাড্ডি বননে কা শখ নেহি হ্যায় মুঝে।
-
চল ব্যঠ, কফি বোলুঁ?
-এক স্যান্ডউইচ ভি বোল
দেনা, কাশকে ভুখ লগি হ্যায়।
-
ঠিক হ্যায়, কফি পিতে পিতে আরামসে
বাত করতে,
হ্যায় না!
ভাইয়া
দো কফি জলদি সে।
হাঁ
বোল রিনি! ক্যায়া হুয়া তুঝে? কিঁউ ইতনি খোয়ি সি হো গয়ি রে?
-
নেই রে, শিভম, পাপা মাম্মি কে বারে মে
শোচ শোচকে ম্যায় পাগল হি বন যাউঙ্গা রে একদিন।
-
দ্যাখ, পাপাকে সাথ মাম্মির
ডিভোর্স খালি হয়েছে, লেকিন
কোই কিসিকো ভুল হি নেহি পায়ে!
-
সাচ বাত, ভুল না ভি নেহি চাইয়ে, হ্যায় না!
-
পাপা
আমাদের কুছ খরচাপাতি দেয়, লেকিন উসে ক্যায়া হোতা বোল্? মাম্মি গান শেখায় বাড়িতে, আর আমি দু চারটে টুইশনি
করি ব্যাস। এতে কি চলে বল তো? পাপার এত রোজগার ও নেই আর পাপা ইতনা শোচতে ভী নেই।
-
হুউম, ইয়ে বাত! আন্টি কা
তবিয়ৎ আভি ক্যাসা হ্যায় রে রিনি? উসদিন দেখা থা তুমহারে সাথ। রিক্সা মে ব্যাঠকে কঁহি যা
রহে থে তুমলোগ।
-
মাম্মি
ঠিক নহি রহতি আজকাল, হমলোগ উসদিন গয়ে থে গাইনি কে
পাস। বোলা কি মাম্মি কা এক সিস্ট হ্যায় ওভারি মে। দাওয়াই দিয়ে হ্যায়। ঠিক হো যায়গি
শায়দ।
-
আরে তু খা
লে, স্যান্ডউইচ তো ঠান্ড্
পর গয়ি তেরা।
-
তু মেরা
বচপন কা দোস্ত। সমঝতা তু মুঝে বহোৎ। য়্যাসা take care করোগে ক্যায়া জীবন ভর?
-
উও বাদ মে
দেখা যায়গা। আভি তো তু শান্তি সে কাম লে!
-
চলতে
হ্যায় রে শিভম্,
বাই ইয়ার।
মাম্মি একেলি বয়ঠি হ্যায় রে ঘরমে।
-
বাই...রিনিইইইইই। Take care dear!
-
Love you!
ঋজুর
কথা
চোখ
বন্ধ করে শুয়ে আছে ঋজু হাসপাতালের কেবিনে। মাথার দুইপাশে উদ্বিগ্ন মা বাবার মুখ।
মাসিরাও এসে গেছে, যে
যেমনভাবে পেরেছে। চিরকালের ফরোয়ার্ড প্লেয়ার ঋজু আজ ডিফেন্সে খেলছে! এ ও কি সম্ভব? পিসিমনি ও ছুটে এসেছে তাড়াতাড়ি। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ঋজু ওরফে অমৃতেশ বাসু।
ব্যাংগালুরুর এইচ সি জি হাসপাতালের সিস্টার এই নামেই ডাকছে ওকে, ওর পোষাকি নাম, এখানে ঋজু নাম অচল!
ডাক্তারবাবু
বলেছেন ছয় মাসের ধাক্কা। কলেজ, প্রজেক্ট, ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউ
সব সওব যেতে বসেছে প্রায়! ভেবেছিল, পরীক্ষা হয়ে গেলেই এম বি এর কোচিং জয়েন করবে! হায়
ভগবান... কি যে করে সে? নিরূপায় হয়ে
কেমোথেরাপির হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর তো কোন উপায় নেই! ভিতর থেকে কে যেন
বলে উঠল..." ফাইট ঋজু ফাইট, এ লড়াই তোকে জিততেই হবে।"
কতদিন
ভাল করে নাওয়া খাওয়া নেই। বড় দুর্বল শরীর, তার ওপরে কেমোর ধকল। সব মিলিয়ে
ঋজু নাজেহাল। একেকটা দিন যেন একেকটা বছর। কখনো পেটে অসহ্য যন্ত্রণা... কখনো বা ভয়ংকর শ্বাস কষ্ট... উফফফ গড তুমি কেন
এত শাস্তি দিচ্ছ আমায়? ভাবে
ঋজু... শুধুই ভাবে...শুয়ে শুয়ে... শুধু ভাবে। সংগে রয়েছে মা, আর বাবা সেই রাঁচিতে
তার চাকরির জায়গায়। কত গুরুত্ববহন করতে হয় তার বাবাকে। ঋজুর একেক সময় ভয়ানক গর্ব
হয় তার বাবাকে নিয়ে। আচ্ছা রিনিটা কি খবর পেয়েছে? আর জেম্মা?? রিনি রে... একটা ফোন
করিস আমায়..... তোদের সবার জন্য বড্ড মন কেমন করে যে!
পারবে
জিততে,
সে
পারবেই! হার সে কিছুতেই মানবেনা। ক্যান্সার কে হারিয়ে দিয়ে, জয়ীর মত ফিরবে আবার
২০০০ কিমি দূরে,
নিজের শহরে, ঠামুর কাছে, প্রাণপ্রিয় বন্ধুদের
কাছে। আবার কলেজের ছুটিতে বাড়ি এসে ফুটবল পেটাবে সে সেক্টর টু-সি র মাঠে! মাথার
কাছে তার মা আছে না! মা যে স....ব ঠিক করে দেবেন! আছে ঠামুর আশীর্বাদ... পিসিমনির
ভালবাসা আর বাবার উৎকন্ঠা!
নিজের
জন্য বাবাকে সে হারতে দেবেনা...না না কোত্থাও না...এ কিছুতেই হয়না যে! এখন থেকে মা'র সব কথা শুনবে, নিয়মিত ওষুধ
খাবে...ডাক্তারবাবুদের কথা মানবে। দুরারোগ্য ব্যাধি কে হারিয়ে বিজয়ী হয়ে ফিরবে সে!
সুধাদেবী
গতকাল
রাতে ঘুমের মধ্যে অবিনাশ বাবু এসেছিলেন। মাঝে মাঝেই আসেন আজকাল। বিশেষত ছোট দেওরের
মৃত্যুর পর যেন বেশি করেই স্বপ্নে দেখা দিচ্ছেন। ডাকছেন যেন..."গিন্নী ও
গিন্নী অনেককাল ত হল একা থাকার পালা"।
কিন্তু এই সংসার, এই মায়া বিশেষত তাঁর অসুস্থ নাতিসাহেব কে ছেড়ে তিনি যান
কি করে?
মেয়ের
ঘরের বড় নাতনির বিয়ে ঠিক হয়েছে, কত কেনাকাটা, কত আনন্দ, কত লোকজন, তাঁর জায়েরা, ননদেরা সবাই আসবে... দেখা সাক্ষাৎ এর বড় একটা সুযোগ তো
চট করে মেলেনা আজকাল। এখন শুধু ঋজুবাবুর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। নাতিসাহেব ফিরলেই
বিয়ের আনন্দে মেতে উঠবে সবাই। এমতাবস্থায় তাঁর থাকাটা বড়ই জরুরি, তিনি জীবন বিমুখ হবেন কি করে? অবিনাশ বাবু হেসে বলতেন, " মায়া কাটাও গিন্নী...
মায়া কাটাও...সংসার বড়ই অসার বস্তু"। বললেই বা শুনছে কে? সারাটা ক্ষন ই ফোনের
কাছে বসে থাকেন আজকাল... এই বুঝি ঋজুর কোন
খবর অথবা মেয়ের ফোনে বিয়েবাড়ির আপডেটস। একে একে দিন চলে যায়.... মাস গড়িয়ে বছর...
এদিকে আসন্ন বিয়েবাড়ির উত্তেজনা...অপরদিকে নাতিসাহেবের বাড়ি ফিরে আসা...সব মিলিয়ে
হুহু করে সময় কাটছে যেন।
অনুষ্ঠান
আসে যেন সময় মেপে। এল আবার হৈহৈ করে মিটেও গেল। নাতনি ও নাতজামাই এর বিদেশে
মধুচন্দ্রিমা যাপন আবার এদিকে ঋজুবাবুর চাকরি পাওয়া... সবই যেন নিয়মানুগ। চোখ বন্ধ করে মনে মনে তিনি
ভাবেন...ব্যাস সব দায় দায়িত্ব তো মিটেই গেল, আর কেন রেখে দেওয়া ভগবান?
লকডাউন
ও উপসংহার
কি
যে আজকাল হয়েছে না! কাগজে টিভি তে প্রায়ই কিসব দেখাচ্ছে টেখাচ্ছে। কি নাকি মস্ত এক
মহামারি আসতে চলেছে... চীন দেশ থেকে তার উৎপত্তি। এক মারণ ভাইরাস এসেছে নাকি, পৃথিবীর মানুষ আর তার
ব্যপ্তি ধ্বংস করতে! একি জ্বালা বলত বাপু, ঘর থেকে বাইরে বেরোনো
বন্ধ, হপ্তায় একদিন কোনমতে
বাজার হাট,
মুখে
একখানি কাপড় এর ঠুলি এঁটে রাখো সারাক্ষন। ছোট বউমা, ঋজুবাবু, ছোটছেলে সব্বাই ঘরে
বসেই কাজ কর্ম সারছে। ওই যাকে বলে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। মেয়ে আর নাতনিও বাড়ির থেকেই
অনলাইন ক্লাস নিচ্ছে তাদের ইন্সটিটিউট এর। মাগো একি পড়াশোনার ছিরিছাঁদ এল? এ তো তিনি জীবনে
শোনেননি। তার মধ্যেই শরীর এক্কেবারেই
জুতের নেই আজকাল।
চারিদিকে মৃত্যু মিছিল....শুধু চলে যাবার পালা।
কি জানি... বড় ভয় হয়... এভাবেই কি তাহলে....একদিন! নাহঃ আর ভাবতে পারেন না।
বেলাশেষে
শরীরটা ম্যাজম্যাজ করাতে... দূর ছাই বলে টিভির সামনে থেকে একপ্রকার জোর করে উঠেই পড়লেন তিনি। বেলিকে দিয়ে পায়ে
একটু তেল মালিশ করিয়ে সামান্য দুধ রুটি খেয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। বেলি রাত্রে
একবার খোঁজ নিতে গিয়ে দ্যাখে তার দিদা ঘুমিয়ে কাদা।
শেষ
রাত্রির দিকে অবিনাশ বাবুর অবয়ব যেন পরিস্ফুট হয়ে উঠল....একে একে তাঁর স্বর্গ গত
শাশুড়ি মাতা...শ্বশুরমশাই...দেওর... বড়
ননদ.. সবাইকে যেন দেখতে পেলেন। ঘর আলো করে বসে ...পুরোনো দিনের মত আড্ডার ছলে। শীত
শীত করে উঠল হঠাৎ, জৈষ্ঠ্যের মাঝামাঝি এত ঠান্ডা
হাওয়া আসে কোত্থেকে? ধীরেধীরে
পায়ের কাছে রাখা চাদরটা টেনে নিলেন।
অশ্রুত
শংখ ধ্বনির সাথে সাথে... ভেসে এল গুরুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ
অসতো
মা সদগোময়...
তমসো
মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যুঃ
মা অমৃতঙ্গময়...
ওঁ
শান্তি... শান্তি... শান্তি....হি...!
----------------------------------------------------------------------------সমাপ্ত।
কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত
নিদ্রা সঙ্কট
কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙল।
দরজা খুলে দেখি,
অ্যাকোয়াগার্ড
কোম্পানি থেকে দুজন ছেলে এসেছে। বলল, দেখুন পানীয় জল ভালো না হলে অনেক রকম পেটের রোগ হতে
পারে। ভালো অফার আছে, সস্তা
পড়বে, লাগিয়ে নিন। আমি বললাম, আমি জানি ভাই। তাই তো
জারের জল কিনে খাচ্ছি, আপাতত
বেশ ভালো আছি। হাতে এখন টাকাপয়সা সর্ট আছে। কার্ড দিয়ে যাও, যখন লাগাবো তোমাদের ফোন
করে ডেকে নেব। ওদের বিদায় করে দিয়ে এসে ঘড়িতে দেখি, বিকেল পাঁচটা। আমি ফ্ল্যাটে
একাই ছিলাম। ব্যাচেলর মানুষ। ল্যাপটপ খুলে ইউটিউবে ৯০’এর দশকের একটা উদ্ভট বাংলা
সিনেমা দেখতে লাগলাম। না আছে কোন গল্পের মাথামুণ্ডু, না কোন অভিনয়দক্ষতা। অতিরঞ্জিত
মারামারির দৃশ্যে নায়ক উড়ে এসে আটদশজন ভিলেনকে একএক করে লাথি বা ঘুষি মারছিল আর
তারা দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ছিল। মাধ্যাকর্ষণের কোন ধার ধারছিল না। নায়কনায়িকার উদ্দাম
নাচের দৃশ্যে দুজনের কেমিস্ট্রি দেখে হাসতে হাসতে পেট ফাটছিল। সন্দীপ মাহেশ্বরির
চ্যানেলে গিয়ে কিছুক্ষণ মোটিভেশনাল ভিডিও দেখলাম কিভাবে অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করা
যায়। বুঝলাম,
মনকে
নিয়ন্ত্রণ করাই সবথেকে কঠিন কাজ। আমাদের অজান্তেই মনের গভীরে কিছু চিন্তাভাবনা
চলতে থাকে যেগুলো আগাগোড়া ভ্রান্ত এবং ভিত্তিহীন। সেগুলোকে প্রশ্রয় দিলে ধীরে ধীরে
বিশ্বাসে পরিণত হয় এবং বিভিন্ন মানসিক বিকৃতি যেমন হীনমন্যতা, ভীতি, হতাশা ইত্যাদির জন্ম
দেয়। তাই থট সিলেকশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। আজেবাজে চিন্তাভাবনা যাতে মনে বাসা বাঁধতে
না পারে,
সে
ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
এত ভালো একটা বিষয় নিয়ে
ভাবছিলাম,
আবার কলিং
বেল। দরজা খুলে দেখি, রান্নার
মাসী। মাসী রান্নাঘরে ঢুকল আর আমি বিছানায় এসে বসে আরও কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা
করছিলাম। রাতের খাবার তৈরি করার পর মাসী এসে চা-বিস্কুট দিয়ে গেল আর টিভিটা অন করে
বাংলা সিরিয়াল চালিয়ে টিভির সামনে বসে পড়ল। আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আয়েস করে
চা-বিস্কুট খাচ্ছিলাম। আমি সাধারণত বাংলা সিরিয়াল দেখিনা, টাইম পাস করার জন্য আমিও দেখতে
লাগলাম। সিরিয়ালের ক্যারেক্টাররা ঝা চকচকে মেকআপ করে বাড়িতে বসে ছিল আর যেন তেন
ছুতোয় এ ওর পেছনে লাগছিল। ঝগড়া করার একটা বাহানা পেলেই হলো। সিরিয়ালের মেয়েরা এ
ব্যাপারে বিশেষ অগ্রণী। একটি মেয়ে খুন হবার পরেও আবার কিছুদিন পরে বেঁচে ফিরে
এসেছে। তাকে দেখতে পেয়ে যারা ষড়যন্ত্র করে খুন করেছিল, তাদের চক্ষু ছানাবড়া। এই মেয়েই
কি সেই মেয়ে,
নাকি তার
মত দেখতে অন্য একটি মেয়ে (মানে ডবল রোল) সেই নিয়ে বাড়ির লোকেদের মধ্যে মতানৈক্য
তৈরি হল। অনেকে মানতেই চাইছে না, এই মেয়েই সেই মেয়ে যে মারা গিয়েছিল কারণ তারা নিজেরা
উপস্থিত থেকে মেয়েটিকে দাহ করেছে। সুতরাং অন্য কোন মেয়ে সম্পত্তির লোভে প্লাস্টিক
সার্জারি করিয়ে ফিরে এসেছে। মৃত মেয়েটির স্বামী আবার আরেকজনকে বিয়ে করে বসে আছে।
একেবারে তালগোল পাকানো ব্যাপার। এইভাবে জট পাকিয়ে আর জট ছাড়িয়ে শয়ে শয়ে এপিসোড
চলছে। বুঝলাম,
আরো
কিছুক্ষণ কন্টিনিউ করলে আমার মাথার ভেতরেও সব তালগোল পাকিয়ে যাবে। তাই চ্যানেল
পাল্টে দিয়ে দেশদুনিয়ার খবর দেখতে লাগলাম। মাসীর আবার এ সব সিরিয়ালই পছন্দ। তাই
বিরক্ত হয়ে উঠে চলে গেল। অনেকক্ষণ টিভি দেখার পর মাথাটা কেমন করছিল, তাই টিভি বন্ধ করে উঠে
পড়লাম।
বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণ
হাঁটাহাঁটি করার পর পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে দেখি, ওখানে দু’তিনজন বন্ধুবান্ধব আগে
থেকেই উপস্থিত। ওদের সাথে ঘন্টাদুয়েক আড্ডা মেরে ও দু’কাপ চা সাবাড় করার পর বাড়ি
ফিরে এলাম। মাথায় একটা গল্পের আইডিয়া ঘোরাঘুরি করছিল। টেবিলে খাতাকলম নিয়ে বসে
গেলাম। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। এক নায়িকাকে নিয়ে দুই নায়কের টানাটানি। শেষমেশ নায়িকা
কোন নায়কের কপালে জুটবে,সেটা নিয়ে রীতিমত সাস্পেন্স ক্রিয়েট করে ফেলেছি কিন্তু
রেজোল্যুশনটা কিছুতেই টানতে পারছিলাম না। অনেকক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে উঠে পড়লাম।
রাত্রে খাওয়াদাওয়া সেরে মশারি
খাটিয়ে যখন বিছানায় শুতে গেলাম, তখন চোখে ঘুমের লেশমাত্র ছিল না। টেবিলের উপর রাখা একটা
ম্যাগাজিনের উপর চোখ গেল। ওটা নিয়ে এসে পাতা ওলটাতে থাকলাম। ওখানে স্টাইলিশ
মডেলদের ফটোগ্রাফির জন্য পোজ দেওয়া সে কী ছবি! মনমোহিনী হৃদয়হরণী। যেমন মেকাপ তেমন
তাদের অঙ্গভঙ্গী আর তেমনি চোখের চাউনি। এমন লাস্যময়ী ভঙ্গিমা, যে রাতের ঘুম কেড়ে নিতে
পারে। যদিও সত্যিকারের সুন্দরী না মেকআপ মারা সুন্দরী বলা কঠিন। আজকাল তো বিভিন্ন
ভিডিওতে দেখছি,
মেকআপ
মেরে পেত্নিকেও অপ্সরা বানিয়ে দিচ্ছে। না, এদের থেকে দূরে থাকাই ভালো।
নাহলে ঘুমের মধ্যে এসে ডিস্টার্ব করবে। তার চেয়ে বরং ভক্তিমূলক বা শ্যামাসংগীত
জাতীয় কিছু গান শোনা যাক। তাহলে মনে প্রশান্তি আসবে এবং ঘুমও এসে যাবে। ইয়ারফোনটা
খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ল ওটা তো আগেরদিন অফিসেই ফেলে এসেছি। ঘরের আলো নিভিয়ে মোবাইলের
ভলিউমটা কমিয়ে মাথার পাশে রেখে চোখ বুজে শ্যামাসংগীত শুনতে লাগলাম। আহা! “দোষ কারো
নয় গো মাআআআআআ...” শুনতে শুনতে কানের কাছে মশা এসে মশাসঙ্গীত আরম্ভ করল। এত হাই
ফ্রিকুয়েন্সি মিউজিক যে আর সহ্য করতে পারলাম না। বেড সুইচ জ্বেলে দেখি, মশারির একটা দিক একটু
খোলা ছিল,
সেই দিক
দিয়েই মশা ঢুকেছে। মশামারা অভিযান আরম্ভ করলাম। মারতে যাই, এমন সেয়ানা মশা, আগে থেকে আমার অ্যাকশন
প্রেডিক্ট করে সরে যায়। চারটে মশা মারতে অন্তত চব্বিশ বার হাততালি দিতে হল। আলো
নিভিয়ে আবার শুয়ে গান শুনতে লাগলাম। গান শুনেই যাচ্ছি কিন্তু ঘুম আর কিছুতেই আসে
না। এ তো মহা জ্বালা হল।
বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার কাছে
গিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকালাম। আমি ফ্ল্যাটের দোতলায় থাকতাম। রাস্তায়
হ্যালোজেনের আলো জ্বলছিল। রাত মোটামুটি সাড়ে ১১টা। রাস্তায় লোকজন ছিল না। রাস্তার
পাশেই একটা লম্বা দীঘি ছিল। বাইরের মৃদুমন্দ বাতাসে দীঘির জলে হাল্কা ঢেউ তুলছিল।
একজন লোক দেখলাম সাইকেল চালিয়ে গান গাইতে গাইতে আমার ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তার
দিকেই আসছে। হাঁক দিলাম, “এই যে দাদা শুনছেন?”
লোকটি সাইকেল থামিয়ে আমার দিকে
তাকিয়ে বলল,
“কি হয়েছে
ভাই?”
-“আপনি কি বাড়ি যাচ্ছেন?”
-“না, দিগ্বিজয় করতে যাচ্ছি।
কি বলবেন বলে ফেলুন”।
-“আমার না কিছুতেই ঘুম
আসছে না। কি করা যায় বলুন তো”।
-“একবার স্নান করে নিন।
দেখবেন শরীরটা ঠাণ্ডা হবে। ঘুমও আসবে”।
-“বাহ, খুব ভালো। থ্যাঙ্ক ইউ
দাদা”।
বাথরুমে গেলাম স্নান করতে। গিয়ে
কল ঘোরাতেই দেখি, জল
নেই। কি আপদ! এত রাতে আবার নীচতলায় নেমে পাম্প চালাতে হবে ভাবতেই বিরক্ত লাগছিল।
তবু যেতে হবে। নইলে স্নান করব কিভাবে? সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে যাচ্ছি, হুট করে লোডশেডিং হয়ে গেল। না, স্নানও করতে দেবে না
দেখছি। হুট করে মাথায় এলো, দীঘিতে গিয়ে ডুব দিয়ে আসলে কেমন হয়। লাস্ট কবে ওপেন
এনভায়রনমেন্টে স্নান করেছি, মনে পড়ে না। বেশ একটু অ্যাডভেঞ্চার টাইপ হবে মনে করে
গ্রাউন্ড ফ্লোরে গ্রিল শাটার খুলে রাস্তা পেরিয়ে দীঘিতে গিয়ে নামলাম। এদিকওদিক
তাকিয়ে কোমর জলে নেমে ঝপাঝপ কয়েকটা ডুব মেরে দিলাম। দীঘির জল বেশ ঠাণ্ডাই ছিল। ঘরে
এসে গা মুছে নতুন গেঞ্জি-পাজামা পরে চুল আঁচড়াচ্ছিলাম। দীঘির জলে ভাইরাস না
ব্যাক্টিরিয়া না প্রোটোজোয়া কি ছিল কে জানে, সারা গা কুটকুট করতে লাগল।
এতক্ষণে কারেন্ট এল। একটু আগে এলেই আমাকে আর পুকুরে গিয়ে নামতে হত না। আমি অত্যন্ত
ব্যস্ত হয়ে সারা ঘরে চুলকানির মলম খুঁজতে লাগলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পেলাম না।
পরে ভাবলাম একটু নারকেল তেল লাগাই সারা গায়ে, তাতে যদি চুলকুনি একটু কমে।
নারকেল তেলের কৌটো নিয়ে তেল ঢালতে গিয়ে দেখি, তেল একেবারে তলানিতে। তেলও
তখুনি শেষ হবার ছিল। অতি কষ্টে তিন-চার ফোঁটা তেল বের হল। সেই মহামূল্যবান তেল
সারা গায়ে ঘষে বিছানায় গিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। যদিও চুল্কাচ্ছিল, তবু সেই চুলকানি
গ্রাহ্য করলাম না। সংযমের পরীক্ষা দিয়ে ঘুম আনার দিকে কন্সেন্ট্রেট করলাম।
ঘুমানোর চেষ্টা করছি, কানে এল রাস্তায় একটা
কুকুর বিনা কারণে চিৎকার করতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ চুপ থাকে, মিনিটখানেক বিরতি দিয়ে
আবার শুরু করে। না,ঘুমাতে
দেবে না। ভাবি এইবার বুঝি ঘেউঘেউ বন্ধ হবে, কিন্তু আবার শুরু করে। মিনিট
বিশেক এইভাবে চলার পর বিরক্ত হয়ে উঠলাম। ব্যাল্কনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। কাঁঠালের
মরশুম ছিল। কিছু কাঁঠালের বিচি ব্যাল্কনিতে শুকোনোর জন্য দেওয়া ছিল। তারই কয়েকটা
তুলে নিয়ে কুকুরটার দিকে তাক করে মারলাম। একটা কাঁঠাল বিচি কুকুরটার মাথায় টাং করে
গিয়ে লাগল। সঙ্গেসঙ্গে ছুটে পালাল। যেতে যেতে কেঁউ কেঁউ সুরে নালিশ জানাতে লাগল।
তারপর অনেকটা দূরে গিয়ে কাঁদতে লাগল। সেই শব্দ ইগ্নোর করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।
এবার ঘুমবোই,
বদ্ধপরিকর
হলাম। তবু ঘুম আসতে চায়না।
আজ আমার কি যে হল, কিছুই বুঝতে পারছি না।
ঘুম আসতে এত তপস্যা কোনদিন করতে হয়নি। আবার বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। সাহস করে দরজা
খুলে সামনের ফ্ল্যাটের কলিং বেল টিপে দিলাম। এত রাতে লোককে বিরক্ত করতে খুব খারাপ
লাগছিল। কিন্তু কি করব! বয়স্ক ভদ্রলোক সদ্য কাঁচা ঘুম ভেঙে ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে
আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে?”
আমি বললাম, “কাকু, আপনার কাছে ঘুমের ওষুধ
আছে নাকি?”
উনি বিরক্তিভরে বললেন, “কেন? ঘুমের ওষুধ কি হবে? তোমার কিও কোন আক্কেল
জ্ঞান নেই,
এত রাতে
ঘুমের মানুষকে জাগিয়ে ঘুমের ওষুধ চাইছ?”
-“সরি কাকু। প্লিজ একটু
দিন। আমার খুব উপকার হয়”।
-“আচ্ছা দাঁড়াও, দেখছি” বলে ভদ্রলোক
ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে একটা স্ট্রিপ নিয়ে এসে আমার হাতে দিলেন।
একটি ট্যাবলেট গলাধঃকরণ করে
বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মনে মনে একটা আনন্দ হচ্ছিল, কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চয়ই ঘুম
চলে আসবে। টুং করে কলিং বেল বেজে উঠল। ধুর! একটু শান্তি নেই। আবার কে এল এত রাতে, ভেবে বিরক্তিভরে দরজা
খুলে দেখি বয়স্ক ভদ্রলোক মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।
-“সরি শুভ্র, তোমাকে না ঘুমের ওষুধের
জায়গায় জোলাপ দিয়ে দিয়েছি। ঘুমঘুম চোখে ঠিক দেখতে পাইনি। প্লিজ। এই নাও ঘুমের
ওষুধ”।
মাথা প্রচন্ড গরম হল।
“আমার আর ঘুমের ওষুধের
দরকার নেই। যান আপনি”। বলে দরজা বন্ধ করে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আজ আমাকে ঘুমোতে
দেবে না,
দেখছি।
সমস্ত পরিস্থিতি একত্রিত হয়ে ষড়যন্ত্র করেছে, আমাকে ঘুমোতে দেবে না। চোখ বন্ধ
করে শুয়ে এসব কথা ভাবছি, কিছুক্ষণ বাদে মনে হল পেটের মধ্যে গুড়্গুড় গুড়্গুড় করছে।
ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই
টয়লেটে গিয়ে বসে রইলাম। হঠাৎ মনে হল,দরজা-দেয়াল-ভেন্টিলেটার সমানে কাঁপছে আর ঝাঁকুনি দিচ্ছে।
আরে এ তো ভূমিকম্প। দশ-পনের সেকেন্ডের মত চলল। আশেপাশে চিৎকার চেঁচামেচি আরম্ভ হল।
ফ্ল্যাটের লোকজন সব ঘুম ভেঙে দৌড়ঝাঁপ করে সিঁড়ি দিয়ে নামার শব্দ শুনতে পেলাম।
তাড়াতাড়ি শৌচ কর্ম সেরে জানলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি সবাই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
আশেপাশের বাড়ি থেকে শঙ্খধ্বনি উঠতে থাকলো। এক কাকু আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন,“সঙের মত ওখানে দাঁড়িয়ে
আছিস কেন?
দেখছিস না
সবাই নীচে চলে এসেছে”।
আমার বিশ্বাস ছিল, ভূমিকম্পে আমার মরণ
নেই। হেলতে দুলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। এসে দেখি রাস্তায় লোকজনের ভিড় জমে গেছে।
বাড়ির মহিলারা অনেকে বাইরে বেরিয়ে এসে শঙ্খধ্বনি দিচ্ছিল। আমি এক কাকিমার কাছ থেকে
শঙ্খ নিয়ে ফুঁ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। দীর্ঘদিন অভ্যেস নেই। ফুঁ দিচ্ছি কিন্তু কোন
আওয়াজই বেরচ্ছে না। বড় নিঃশ্বাস নিয়ে প্রবল বেগে শঙ্খ ফুঁ দিতে গেলাম কিন্তু তাতে
এমন এক বিচিত্র শব্দের উৎপত্তি হল যে, সবাই হাসাহাসি করতে লাগল। লোকজনের সামনে অপদস্থ হয়ে শঙ্খ
ফুঁ দেওয়া থেকে বিরত হলাম। একটি স্বাস্থবতী মেয়ে এক নিঃশ্বাসে একটানা অনেকক্ষণ ধরে
শঙ্খ ফুঁ দিয়ে যাচ্ছিল। আমি মেয়েটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম। মেয়েটা আমি
লক্ষ্য করছি বুঝতে পেরে ভ্রু কুঞ্চিত করে আমার দিকে তাকাল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে ওর
দিকে আর তাকালাম না।
পাশ থেকে নবীনকাকা এসে বলল, “জানো ভায়া, ইস্পাতের মানই হল
বিল্ডিঙের জান। রিইনফোর্সমেন্ট যদি ঠিক থাকে, তাহলে জানবে বিল্ডিং চাপা পড়ে
মরার কোন সম্ভাবনা নেই। তোমাদের বিল্ডিং কোন টিএমটি দিয়ে তৈরি জানো তো। না জানলে
তোমাদের বিল্ডারকে একবার জিজ্ঞেস করে নিও”।
-“আচ্ছা, ঠিক আছে”। মনে মনে
বললাম,
যত সব
ফালতু লোকের কারবার। কাজকর্ম কিছু নেই, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।
ঘরে এসে সবে বিছানায় শুয়েছি, একটা আননোন নাম্বার
থেকে ফোনে এলো। তখন রাত মোটামুটি তিনটে। কল রিসিভ করার পর একজন ফিসফিস করে বলল, “হ্যালো”
আমি বিরক্তির স্বরে জোরগলায়
বললাম,
“হ্যালো!”
-“একি এত জোরে কথা বলছ
কেন? তোমার রুমমেট আছে না!”
নারীকন্ঠ শুনে একটু নড়েচড়ে
বসলাম। এত রাতে আবার কোন মেয়ে আমাকে ফোন করল। আমি ত সিঙ্গেল। নিশ্চয়ই কোন মেয়ে তার
বয়ফ্রেন্ডকে ফোন করতে গিয়ে ক্রস কানেকশন হয়ে আমার নম্বরে কল ঢুকে গেছে। বহুদিন কোন
মেয়ের সাথে আলাপ করার সুযোগ হয়নি। তাই আমি মৃদুস্বরে বার্তালাপ চালিয়ে গেলাম।
-“আচ্ছা আচ্ছা। ঠিক আছে”।
-“ইস কী ভূমিকম্প! তুমি
ওই সময় কি করছিলে জানু?”
-“কি আর করব। তোমার কথাই
ভাবছিলাম। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে!”
-“খুব ঢঙ না? হস্টেলের বাইরে বেরও নি?”
-“হস্টেল!!! হ্যাঁ হ্যাঁ।
বেরিয়েছিলাম তো”
-“আমার ঘরের জানলার
কাঁচটা কি কাঁপছিল! আমি তো ভয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছি”
-“এত ভয়ের কি আছে? শঙ্খ ফুঁ দিলেই পারতে”
-“শঙ্খ কোথায় পাব আমি
হস্টেলের মধ্যে?
তোমার কি
মাথা খারাপ হল নাকি”
-“ না, না এমনি বললাম আর কি”
-“তোমার কথাগুলো যেন কেমন
কেমন লাগছে”
-“কেমন লাগছে ডার্লিং?”
-“ ডার্লিং! কে আপনি বলুন
তো”
-“আমি আবার কে! আমি তোমার
জানু”
-“ফাজলামো মারছেন না!
রাখুন ফোন”
সাথে সাথে ফোন কেটে দিল। আমার
মনে হল এভাবে একটা অপিরিচিত মেয়ের সাথে কথা বলে ফাজলামি মারা উচিত হয়নি। যাক, একটা আত্মগ্লানি নিয়ে
মনে মনে মেয়েটির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। সারারাত অজস্র যন্ত্রণার পর অবশেষে ভোরের
দিকে ঘুম এলো। সকাল সাড়ে ছ’টায় আবার কলিং বেল। অনেক কষ্টে দরজা খুলে দেখি
প্রতিবেশি বন্ধু অয়ন।
-“কিরে আজকে মর্নিং ওয়াকে
যাবি না?”।
-“আজ আমি যাব না ভাই, আজ তুই একাই যা”।
কপিরাইট
লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত