কবিতা আন্দোলন:
প্রতি -কবিতা ও সিগনেচার পোয়েম সম্পর্কে কিছু আলোচনা
নাসির ওয়াদেন
" স্বপ্নের ভিতরে বুঝি --ফাগুনের জনস্বার্থ ভিতরে
দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে
হরিণেরা;
রূপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়
আমরা দুইভাবে স্বপ্ন দেখি, এক অবচেতন মনে, দুই সচেতন
হয়ে -- কবি জীবনানন্দ দাশের হাত ধরে বাংলা কবিতার বিবর্তন --এক যুগের সমাপ্তি আর
এক নতুন যুগের সূচনা। আন্দোলন চির প্রবহমান continuous process --সে তো থেমে থাকার নয়, আজ যা আধুনিক কালের গতিতে
কালকেই তা পুরাতনী --অত্যাধুনিক -পুনরাধুনিক- উত্তরাধুনিক -শূন্য বাউন্ডারি-- যে
নাম হোক না কেন, সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটছে - উত্তর সভ্যতার
সোপানে পা ছুঁয়েছে পরিবর্তনশীলতা। কবি
স্বপ্নের টুকরো টুকরো ছবি সন্নিবেশিত করে নতুন কায়াবাদের সৃজন ঘটাতে চেয়েছেন, গভীর
অন্তর্লোকের অনুভব চিত্রকল্পের এক আবেগী বিন্যাসে আভাসিত হয়ে উজ্জ্বল
স্মৃতিমেদুরতা ছড়ায় -- স্মৃতির দোকানে চলে স্বপ্নের ফেরি --বিকিকিনি,আন্দোলন তো গতিশীল, গতিময়তার ইঙ্গিত --চাকা গতিবৎ,,,
কবি মালার্মে বলেছেন, " Poetry is the expression by means of human language
restored to its essential rhythm of the mysterious sense of the aspects of
existence; it endows our sojourn with authenticity and constitutes the sole
spritiual task. " আবেগে, উত্তেজনায়,
আভাসে -ইঙ্গিতে, প্রতীকীকরণ ও অভিভাবনের
দ্বারা মনের সূক্ষ্ম ও নিগূঢ় অনুভূতি ও প্রেরণাকে তুলে ধরা প্রতীকবাদী কবিলেখক,শিল্পীর কাজ। কবিতা
ভাব দিয়ে লেখা হয় না,
হয় শব্দ দিয়ে --শব্দের আদিতে সংগীত, সেই
সংগীতের পুনর্বাসন ঘটে কবিতার মধ্যে মননে ছন্দের প্রকাশে। শব্দের ব্যবহার,সময়ের চিহ্ন ইঙ্গিত আকারে শব্দ
দিয়ে ব্যবহার করে কবিতা মূর্ত রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাহিত্যের পরিভাষা আমাদের বুঝতে হবে, জানতে হবে সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি --
উদ্দেশ্য সার্থকতা ও পরিপূর্ণতা নির্ভর করে তারই উপর। বিশ্বসাহিত্যের বিচরণ ক্ষেত্রে অনুগল্প যুক্ত
হয়েছে, যা ছোটগল্পের সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশ।
'অবজেকটিভ কোররিলেটিভ '- শব্দ-বন্ধটি কবি টি,এস,এলিয়ট
ব্যবহার করেন। বিশেষত আধুনিক শিল্প সাহিত্যের আবেগ -অনুভূতির যথাযথ
প্রকাশের কথায় --মেলোড্রামা যা অতিনাটকীয়তা,অ্যান্টি-নভেল যাকে প্রতি-উপন্যাস বলে
যা চরিত্র বিশ্লেষণ ও কালানুক্রমিক কাহিনি -বিন্যাস বর্জিত হয়ে থাকে। পর্ণোগ্রাফি --যা সামাজিক ও নৈতিক আচরণ বিধি বহির্ভূত যৌন সংসর্গ বিকৃত বিচরণে
পরিবেশিত, সাইনেসথিয়া -যা কবিতায় সৃজনী
গদ্যে একধরনের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সংবেদনশীলতা থেকে অন্যধরণের ইন্দ্রিয় বেদ্য
শব্দচিত্রে প্রকাশ। ডিসকোর্স -উত্তর অবয়ববাদী,উত্তর
আধুনিকতাবাদের সূত্রে শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে, যা যুক্তিপূর্ণ,অনুসন্ধানী,বিশ্লেষণমূলক, লিখিত
বা বাচিক উপস্থাপনা। অ্যান্টি-পোয়েট্রি -প্রতি -কবিতা যা পাঠককে
নতুন ধারণা দিতে পারে। 'Best words in the best
order ' এই স্রোতে অবগাহন করতে না পারলে কবিতার মধ্যে প্রাণের
সঞ্চার ঘটে না। মৃতশরীরে
অস্ত্রচালনা করা,অথবা শুষ্ক মরুভূমিতে জলের অনুসন্ধান সমতুল্য। কেউ কেউ বলেন যে, কবিতা আর বিজ্ঞান পরস্পর
বিরোধী,কবিতা কল্পনার অভিব্যক্তি 'the expression of
the imagination ', কেউ বলেন, সৌন্দর্যের
ছন্দিত সৃজন -' the rhythmic creation of beauty, ' আর
বিজ্ঞান বাস্তবের কঠিন পরীক্ষা নিরীক্ষা দ্বারা বিশ্লেষিত --প্রমাণিত স্বতঃসিদ্ধ
সংজ্ঞায়িত। কিন্তু বাস্তবে কবিতাও বিজ্ঞানের পদাঙ্ক অনুসারী
--কবিতার মধ্যেও বিজ্ঞানের অনুপ্রবেশ ঘটছে।
যাইহোক,আজকের প্রসঙ্গ প্রতি-কবিতা অর্থাৎ
Anti-poetry, সেই বিষয়ে কিছু বলতে চাওয়া,আলোকপাত করতে চাওয়া। পাঠকের কাছে, তাদের সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে কতখানি
গ্রহণযোগ্য, কতটা বর্জনীয় তা পরিমাপ করা, সাথে 'Signature Poems' নিয়ে কিছু বলা। এবারে প্রতিকবিতা বিষয়ে আলোচনা করা যাক।
সাহিত্য আন্দোলনে বিভিন্ন মতবাদ, ধারণা, ভাবনা,
নতুন রূপরেখা প্রতিনিয়ত কাটাছেঁড়া চলছে, চলবেও। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম সাহিত্য হিসেবে আমরা
চর্যাপদকে গণ্য করে থাকি। দশম শতাব্দীর সময়কাল থেকেই চর্যাপদ প্রচলিত রীতিতে
নানান বাঁক ও খাতে বয়ে গেছে সাহিত্য সলিল। সেই
বাঙালিজীবন স্রোতধারাকে অবলম্বন করে জনজীবনে জনজাতির কৃষ্টি সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে
চর্যাপদের ভেতর শব্দতরঙ্গ ভাঙনের মধ্যে জন্ম লাভ করেছে আধুনিক সাহিত্যে। আমরা দেখি যে, চর্যাপদ রচিত হওয়ার পর
অনেকদিন সাহিত্যে মাৎস্যান্যায় চলেছে,নতুন সাহিত্য সৃষ্টির
কোনো সুলুক সন্ধান মেলেনি। সেই
অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের ব্যবচ্ছেদ ঘটে শর ও খাগের স্পর্শে --সাহিত্য নভোমণ্ডলে
জুনসূর্যের উদয় ঘটে--রচিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, বৈষ্ণব
সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, থেকে নাথসাহিত্য,
অনুবাদ সাহিত্য, আরাকান সাহিত্য ইত্যাদি। আমরা যদি লক্ষ করে থাকি তাহলে দেখতে পাবো যে, প্রতিটি
সাহিত্যের ধারা নিজ নিজ স্বতন্ত্রতা ও ভাবমূর্তিতে সমুজ্জ্বল। সাহিত্যকে যদি সমাজের দর্পণ ধরা যায়, তাহলে
অবলীলাক্রমে বলা যেতে পারে যে, সমাজে নিত্য ঘটে যাওয়া সুখ
দুঃখ, হতাশা উল্লাস, আনন্দ বেদনা
সন্নিত কাহিনিসমূহকে ভর করে সাহিত্যের বীজ প্রোত্থিত হয়ে আছে।
পৃথিবীর বুকে ঘটে যাওয়া দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ, যে যুদ্ধের পরিনতি যেমন ভয়ংকর
ছিল,তেমনি সম্ভাবনার বীজও লুকিয়ে ছিল, সেই
লুক্কায়িত বীজ থেকে চারার সৃজন ঘটেছে আধুনিকতার। ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ও ফরাসি দেশে ফরাসি
বিপ্লবের পর বিভিন্ন মতবাদ বা দর্শনের প্রভাবিত ফলস্বরূপ আধুনিক যুগের সূচনা
হয়েছে এবং সারাবিশ্বব্যাপী তরঙ্গিত হয়ে পড়েছে আধুনিকতার উত্তাল তরঙ্গ। জীবনসাহিত্য ও শিল্পকলার মধ্যেও ঘটে গেছে
আঙ্গিকের পরিবর্তন। আমরা যদি
লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাবো যে, ১৯১০ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত এই সময়কালে জার্মানি ও
ইউরোপের অন্যান্য চিত্রকলা, নাটক, কবিতা
ও চলচ্চিত্রে আবেগপ্রবণ শিল্পচেতনার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। তখনও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়নি, সেই সময়ে
জার্মানিতে অভিব্যক্তিবাদ শব্দটি ব্যবহার করেন ফরাসি চিত্রকর Julien
Auguste Harve চিত্রায়নধর্মী ছবিকে 'ইমপ্রেশনিস্ট'
নীতি থেকে সরিয়ে ' এক্সপ্রেশনিজম ' এর কথা বলতে চান।
সাহিত্যের বিচরণ ক্ষেত্র ক্রমাগত বিস্তার লাভ করতে থাকে, ধীরে ধীরে
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে বিপ্লব ঘটে --কবিতা, নাটক,
উপন্যাস, চিত্রকলা ইত্যাদির ক্ষেত্রে
বিভিন্নতা লক্ষ করা যায়, আধুনিকতার স্পর্শ লেগে এক একটা
অনুপম সৃজনশীল সম্পদ হয়ে প্রকৃষ্ট হয়ে পড়ে। যেকোনো কবিতার ভেতর শব্দের, আঙ্গিকের রূপের নিষ্কৃতি ঘটে চর্যাপদের পরবর্তী সময়ে
বাংলাভাষার ক্ষেত্রে আধুনিকতার আলোর উত্তাপে নতুন নতুন রূপ আঙ্গিকের উদ্ভব ঘটে
যাওয়ার ফলে কবিতার জগতেও অন্তঃবিপ্লব ঘটে যায়। আধুনিকতা যেহেতু আপেক্ষিক -কোনো নির্দিষ্ট
সময়কে বেঁধে রেখে দেওয়া যায় না, তেমনি নির্দিষ্ট সীমারেখা দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলাও
যায় না। কবি ও আলোচক সিসিল ডে লুইস এর কথায় -- " Modern poetry is every
poetry, whether written last year or five centuries ago, that has meaning for
us still. " বিশেষত এই কবিতার জগতে ১৯১৫ সালে টি,এস,এলিয়ট-এর "দ্য লাভ সং অব জে অ্যালফ্রেড
প্রুফক " কবিতার সূচনা দিয়েই আধুনিক কবিতার উদ্ভাবন বলে অভিহিত করতে দ্বিধা
নেই।
কবিতার রূপ আঙ্গিকের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যবচ্ছেদ ঘটছে, জাত হচ্ছে
নতুন নতুন আঙ্গিক,কলাকৌশল ও রূপশোভা। কেউ কেউ আবার আধুনিকতার পরবর্তীতে পুঁজিবাদ
কেন্দ্রিক উত্তর আধুনিকতা,
কেউ কেউ পুনরাধুনিকতার কথা বলেছেন; কিন্তু
এগুলো আধুনিকতার পুনরুক্তি, যেহেতু আধুনিকতা আপেক্ষিক,তাই নামের মাধ্যম যাই হোক আধুনিকতারই রূপভেদ ছাড়া কিছুই নয়, তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে ' Signature Poem 'বলে একটা
কথা প্রচলিত হয়ে আছে। ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাব যেহেতু বাংলা সাহিত্যকে
প্রভাবিত করে, সেই হিসেবে সিগনেচার পোয়েম কথাটির
বাংলা সাহিত্যেও প্রচলিত। অবশ্যই একটা চালু কথার রেওয়াজ আছে যে, যেকোনো ভাষার প্রথম সারির কবিদের সম্পর্কে, তাঁরা যে কবিতার সুবাদে তাঁদেরকে একবাক্যে সবাই চেনে। বলতে পারে সেই
" স্বাক্ষর চিহ্নিত কবিতা "ই হচ্ছে এই কবিতা। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে আধুনিকতার আবরণ মোড়কে
আচ্ছাদিত যেসব কবিতা সমাজজীবনে, বাঙালির চিন্তা চেতনার ভেতরে ঝড় তোলে, গড়ে তোলে উন্মাদনার সুবিশাল অট্টালিকা,চিত্তে
উৎকর্ষতা, ভালবাসার সুউচ্চ শিখর,সেই
কবিতার প্রাণ আবেগ তো কবিকে পরিশীলিত করে, উন্নত করে,
সমুন্নত করে। সেই
সুবাদে সেই কবিকে হৃদয়ের অভ্যন্তরে উচ্চ আসনে বসিয়ে শ্রদ্ধাবনত হয়ে যাই। যদি আমরা কবি "জীবনানন্দ "এর 'বনলতা সেন '
কিংবা ' আট বছর আগের একদিন ', নজরুলের ' বিদ্রোহী ',সুকান্তের
', আঠারো বছর ' বিষ্ণু দের ' ঘোড়সওয়ার ',অমিয় চক্রবর্তীর ' বিনিময়',বুদ্ধদেব বসুর ' শীত রাত্রির প্রার্থনা ',সুধীন্দ্র নাথ দত্তের ' শ্বাশতী',সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ' যত দূরেই যাই',নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ' কলকাতার যীশু 'অথবা' অমলকান্তি ',সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের ' কেউ কথা রাখেনি ',শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের ' অবনী বাড়ি আছো', অরবিন্দ গুহের ' পৌত্তলিক ',সুবোধ সরকারের ' অন্ধ
যখন দেখতে পায়, ইলিশ তখন দেগঙ্গায় ', জয়
গোস্বামী, শ্রীজাত, বিনায়ক
বন্দোপাধ্যায়,,,, ইত্যাদির কবিতা আমাদের চোখের সামনে ভেসে
ওঠে--সিগনেচার পোয়েম কবিকে চিনতে সাহায্য করে।
২
কবিতা খাঁচার মধ্যে ' অ্যান্টি পোয়েম ' বলে একটা
কথা ইদানিং চালু হয়েছে, নবীন প্রজন্মের কবিদের কবিতা লেখার
ক্ষেত্রে Anti Poetry বা প্রতি কবিতার কথাও জেনে রাখা দরকার। আজকের নবীন ও প্রবীণ কবিদের অধিকাংশের মধ্যে সময়
চেতনার বড় অভাব লক্ষিত হয়,ফলে অনেকেই রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত হতে পারছে না। কেউ কেউ অতি বিপ্লবীকবি হওয়ার লক্ষ্যে নজরুলকে
অনুসরণ না করে অনুকরণ করার ভেতর দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার কথা ভাবেন -- নেহাত মুর্খামি
- কবিতার ক্ষেত্রে সময় চেতনা ধারণা বা প্রসূত জ্ঞান খুবই কার্যকরী, ফলে
সময়ের পরিমিত রূপের সুকৌশলী ব্যবহার
শব্দের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়া কবিতা উৎরে যেতে পারে না,সিগনেচার
পোয়েম হতে পারে না। যতদিন
না কোনো কবির সিগনেচার পোয়েম (Signature Poem ) তৈরি হচ্ছে, ততদিন তিনি কবি হয়েও কবি হতে পারলেন না। যাই হোক, প্রতিকবিতাও আধুনিক কবিতার অঙ্গনে
নতুন ক্ষেত্র রচিত হচ্ছে।
নবীন কবিদের কাছে আমার বিনম্র বক্তব্য, কেউ কবি হতে পারবেন না, যদি না কবি সময়ের ধারণা আঙ্গিকের রূপান্তরের মধ্যে সেই কবির কবিতা রচিত হয়। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে,সব কবিরই
একটা Point of Departure থাকে। কবি সুবোধ সরকারের সত্তর দশকের যুবকের লাশই কবির
'পয়েন্ট অব ডিপারচার '। কবিদের জীবনে বাস্তব আর পরাবাস্তব মিলেমিশে
সময়ের সঙ্গে সাজুয্য ঘটিয়ে কবিতার সহাবস্থান ঘটে। এইভাবে কবিতার মধ্যদিয়ে পরবর্তী কবিতাজীবনের বীজ
বপিত হয়ে থাকে। কোন আড়ম্বর
নয়, কোন মেকি শব্দের বাতুলতা নয় - মেদবর্জিত, অলংকারবিহীন,প্রতীক অবয়ব থেকেই Anti Poetry র সৃষ্টি।
১৯৩৫ সালে ডেভিড গ্যাস কোয়েনের' এ শর্ট
সার্ভে অব সুররিয়ালিজম 'গ্রন্থে যে দুটো শব্দ ব্যবহৃত হয়েছিল,
" অ্যান্টি লিটেরেচার 'ও 'অ্যান্টি পোয়েট্রি "। অবশ্যই আমরা ইতিপূর্বে ১৯২৬ সালে কবি
বাস্তামেন্ত বালিভান '
অ্যান্টি পোয়েমস ' বলে বই লিখেছেন। কিন্তু ' অ্যান্টি পোয়েট্রি ' এই ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন
চিলির কবি নিকানোর পাররা। ১৯৫৪ সালে তার বিখ্যাত বই ' পোয়েমস
অ্যান্ড অ্যান্টি পোয়েমস ' প্রকাশিত হওয়ার পর গোটা পৃথিবীতে
বিশেষ করে ইউরোপে 'প্রতি কবিতার ' ধারণা
রীতিমতো বিস্তার লাভ করে। প্রতি
কবিতার বিষয়ে যে সংজ্ঞার্থ লিজ ওয়ার্নার বলেছেন, তা হচ্ছে; " much
of the critical literature on antibiotics poetry focuses on the Intertexuality
of the antipoem,that Is, its iconoclastic or even sacrilegious opposition to
traditional poetry."
বাস্তবজীবনের হাসিঠাট্টা, মজাকৌতুক, অ্যান্টি হিরোয়িক
কণ্ঠস্বর, সমাজের অবাঞ্ছিত,ফেলে দেওয়া
অখাদ্য তুল্য জৈবিক উপাদানকে সংগৃহীত করে মিক্সচার মেশিনে শোধিত করে কাব্যসাহিত্যে
পরিবেশন দ্বারা পাঠকের চিত্তে আনন্দোদায়ক সুখানুভূতি আমদানি করার ভেতর দিয়েই
অ্যান্টি পোয়েট্রি বা প্রতিকবিতার জীবন্ত-সত্ত্বা থাকে। কবিতার বহুল প্রচলিত ধ্রুপদী চলনকে সরাসরি
অস্বীকার, ভেতরে যে নিয়মশৃঙ্খলার আভিজাত্যকে
ছেদন করে,ভেঙেচুরে বেড়িয়ে আসতে চাওয়া। প্রতিকবিতার প্রচলিত ধারণাকে রীতিমতো ব্যবচ্ছেদ
করে আরও বহুদূর অগ্রসর হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। প্রতিকবিতার ভেতরে গাণিতিক ধারণা, পদার্থের
জ্ঞানপ্রসূত ভাবনা, পরিবেশ ভাবনা, আপেক্ষিকতাবাদ,
বীজগাণিতিক 'X' ধারণাকে মিলেমিশে অঙ্গীভূত হয়ে
ওঠে। পাররার মতে, এগুলোই হচ্ছে 'অ্যান্টি ম্যাটার ' বা ' প্রতিবস্তু'-র ব্যবহার, অর্থাৎ যা কিছু বর্জনীয়, অপাংক্তেয়,সেগুলো ফেলে দিয়ে বিষয়টিকে কবিতায় ঠাঁই
দেওয়া। বস্তু জগতের
ঠিক সমান্তরাল আর একটি প্রতিবস্তুর জগত রয়েছে, প্রত্যেকটি প্রতিবস্তু আমাদের চেনা
বস্তু জগতের উপাদানগুলোর মতোই দেখতে। এই
প্রতিবস্তুগুলির অভিমুখ ও অভিব্যক্তি সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী। এই অ্যান্টি ম্যাটারের দৃষ্টিকোণ থেকে
প্রতিকবিতাকে মনে হবে,চেনা কবিতার সামনে প্রতিচ্ছবি নয়, বরং কবিতার
পরিপূরক। প্রতিকবিতা
চরিত্রগতভাবে নঞর্থক নয়,
তবে যেখানে যেখানে কবিতা সদর্থক চিহ্ন বহন করে, সেক্ষেত্রে প্রতিকবিতা অনেকাংশে নঞর্থক। পাররা তার কবিতাকে বলেছেন, --' the articlal speeches' বিচিত্র উপাদান আর
উৎসকে তেরচা ভঙ্গিতে ব্যবহার করা।
কয়েকটা কবিতার মধ্যে সেই দৃষ্টিভঙ্গী ব্যবহার করা হয়েছে,তা একটু
আলোচনা করে নিতে চাই,
হিংসার চাষ করতে হয় না, আপনা আপনি ফলে
লাল জবার কদর কিন্তু এখনো কমে যায়নি,,,
বা,
হিংসার বাগান খুঁড়ে মাটিতে কারণকারণটা খুঁজে নিতে
একটুকরো ভালবাসার কোদাল এনে দেবে তুমি,,,,
কবি পাররা বলেছেন,
শবাধার আর ছাইদানের কোনও ব্যবসাদার?
এমন
সেনাপতি যে নিজের ক্ষমতায় দ্বিধাগ্রস্ত?
আমি
'নরমপন্থা' কবিতার কয়েকটি লাইন তুলে ধরেছি,--
মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে রাতকে ডাকছো কেন?
রাত
কী তোমার কেনা গোলাম,
কথা শুনবে?
কিংবা,
একটা সিংহাসন কিছুতেই অবিশ্বাসী লাগাম কষে
দৌড়াতে পারে না,
লাগাম অশ্বগ্যালপ নিয়ন্ত্রণ
করে
এবং,
জিজ্ঞেস করছো,
কোথায় ছিলাম, কোনদিকে চলেছি,
ধ্বজভঙ্গ শরীর নিয়ে কোনদিকে যেতে পারি? জাহান্নাম,,,,
পাররার বিখ্যাত লাইন :
খাদের পাশে নাচতে থাকা কোন নাচিয়ে?
সারা জগতের প্রেমে পড়েছে এমন কোনো নার্সিসাস?
শেষে বলি যে,
কোনো ছ্যাবলা?
কোনো ফিচেল? কোনো তোতা?
অপাপবিদ্ধ কেউ?
সামতিরাগো চিলের কোনো চাষী?
কবিতার লাইনগুলোর মধ্যে পরস্পর বিরোধীতা পরিস্ফুট ও একই সঙ্গে কিন্তু
পরিপূরক।
পরিশেষে,
বলা যায় যে, প্রতিকবিতার গড়ন, বিন্যাস,আঙ্গিক এক নতুনত্বের মোড়কে আবদ্ধ হয়ে পাঠকের
চোখে ধাঁধা সৃষ্টি করে, বিহ্বল হয়েত পড়ে, আপ্লুত করে, নিষ্ঠাবান করতে সহায়তা করে এমন কবিতার
চল সচরাচর দেখা যায়নি এখনও। তবে জিরো বাউন্ডারি দর্শনের ভেতর দেখেছি কবিতার
উন্মুক্তিকরণ -- বহুল বর্জনীয় শব্দের automatic eliminate হয়ে যাচ্ছে unedited
রূপটির zero boundary
তে সংযুক্ত হয়ে, সৃজন শিল্প-ক্ষমতাজনিত
বহিঃপ্রকাশ ঘটছে,একে unedited poetry বলা
যায়। যা নিয়ে পরবর্তীতে লিখতে প্রয়াসী।
প্রতিকবিতার অন্যতম দিক হচ্ছে মাস কমিউনিকেশন, জনগণের
সঙ্গে সংযুক্তিকরন,পাঠকের সঙ্গে সহবাস, কবিতার অভিব্যক্তির সঙ্গে সহমিলন, পুনর্মিলন ঘটানো। কবি নিকানো পাররা
বলেছেন যে, I
think that the poet should be a specialist in communications. Homour makes
contact with the reader easier. Remember that It's when you lose your sence of
homour that you begin to reach for your pistol. প্রতিকবিতার অন্যতম
বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ভাষা, চমক,স্বভাবে লিরিক্যাল হবে না, মিষ্টি মধুর ভাষা,
বাংলা কবিতার সচরাচর রূপের তীব্র বিরোধিতা গীতি কবিতার বিদায় ঘটানো। প্রতিকবিতার ভাষা, মুখের যেমন
ভাষা,তেমনি তৃণস্তরে জনগণের যে ভাষা সেই ভাষার অবলম্বন ঘটবে। কথা সাহিত্যের
মর্যাদা দান। Take off থেকে
বিকৃতিধর্মিতা নয়, সাংকেতিকতা,সুতীব্র
মেসেজ নিয়ে এক ঝলমলে উজ্জ্বল উৎকৃষ্ট আলোকমালা --যা, সমাজকে
আলোকিত করবে, সেটাই প্রতিকবিতা বা অ্যান্টি পোয়েট্রি।
নাসির ওয়াদেন
তথ্যে এবং বিষয়ভিত্তিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী একটি নিবন্ধ । প্রত্যেকেরই খুঁজে নিয়ে পড়া উচিত । পাঠক সমৃদ্ধ এবং উপকৃত হবেন-ই
উত্তরমুছুনআপনার মতামত খুব উৎসাহ ব্যঞ্জন । আমরা কবিতা অনেকেই,কেউ বুঝে, কেউ বা নিজের ভাবনা থেকে ।তবে যদি কবিতার বিবর্তন বিষয়ে বুঝতে না চান, সময় ধারণা না থাকলে কবিতা স্থায়ী হবে না ।কালের স্রোতে হারিয়ে যাবে । তাই কবিতা বিষয়ক গদ্য পড়া খুবই প্রয়োজন । তাতে লেখার মান বাড়ে, এটা আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ।সুন্দর মতামতের জন্য কৃতজ্ঞ ।
উত্তরমুছুনআপনার মতামত খুব উৎসাহ ব্যঞ্জন । আমরা কবিতা অনেকেই,কেউ বুঝে, কেউ বা নিজের ভাবনা থেকে ।তবে যদি কবিতার বিবর্তন বিষয়ে বুঝতে না চান, সময় ধারণা না থাকলে কবিতা স্থায়ী হবে না ।কালের স্রোতে হারিয়ে যাবে । তাই কবিতা বিষয়ক গদ্য পড়া খুবই প্রয়োজন । তাতে লেখার মান বাড়ে, এটা আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ।সুন্দর মতামতের জন্য কৃতজ্ঞ ।
উত্তরমুছুন