শব্দ ~ শুক্লা মালাকার



শব্দ
শুক্লা মালাকার


-     বেরোলাম! দরজাটা বন্ধ করে দাও।

-     আজ একটু আগে ফিরো না গো। মার্কেটে যেতে হবে।

-     বস কে কি বলব! আমার বউ সপিং এ যাবে তাই ছুটি দিন! যত্তসব!

-     বাবার চাদর গুলো একদম খারাপ হয়ে গেছে। একা রেখে তো যেতেও পারিনা, তাই তোমায় বলি।

-     দেখব চেষ্টা করে।

তন্ময় চলে গেল। রত্না জানে প্রয়োজন যখন বাবার, ছেলে আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে।  অনেকগুলো স্পেশাল কস্মেটিক্সের অর্ডার পড়েছে।  কোম্পানি থেকে গিয়ে আনতে হবে। এমনিতে বাড়িতে বসেই ব্যাবসাটা চালায় রত্না, একটা ডেলিভারি বয় রেখে দিয়েছে। পেমেন্ট তো অনলাইনেই হয়।  বেরোনোটা আজ খুব জরুরী তাই বাবাকে কাজে লাগালো। খারাপ লাগে, কিন্তু কি করবে সে!

দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরে গেল। টোস্ট অমলেট আর জুস বানাবে। টক টক, টক টক- ওই শুরু হল। মানুষটা কি করে যেন টের পায় ছেলে চলে গেছে। ছেলে থাকতে কোনো ফরমায়েশ করে না।

-     আসছি বাবা! এক মিনিট!

গলা চড়িয়ে বলল। খাবার নিয়ে যেতেই শুয়ে থাকা শরীরটা চনমনে হল। ঠোঁট হাসিতে মুচড়ে গেল। পিছনে বালিশ দিয়ে বসিয়ে ফোল্ডিং টেবিলটা পেতে দিল। নিজের হাতেই খায়, তবুও রোজকার মতো জিজ্ঞেসা করল- খাইয়ে দেব বাবা? জানা উত্তর, না! খাবার দিয়ে ফিরছে, টক টক, টক টক-

-     বল! কিছু লাগবে? ইশারায় জল দেখালেন।

-     ও হো! ভুলেই গেছিলাম।

জল দিয়ে বেরিয়ে এল। নিজের জন্য চা আর দুটো টোস্ট নিয়ে বসল। এখন আধঘন্টা নিজের। অন্যদিন এসময়ে পেপারে চোখ বোলায়। আজ খেতে খেতে মনে পড়ল বিয়ের পর পর ওই শুয়ে থাকা মানুষটা তাকে কত সাহায্য করতো।  সঙ্গে করে নিয়ে বাজার করা, ব্যাঙ্কের কাজ শেখানো, রাস্তাঘাট চিনিয়ে দেওয়া। নাহলে দক্ষিণ থেকে এসে এই উত্তর কলকাতার অলিগলিতে চলা বেরিয়ে যেত।

বিয়ের আগে মাতৃহারা তন্ময়কে ভালোবেসে আস্কারা দিত। বিয়ের পর দেখল চব্বিশঘন্টা ওর মেজাজ সহ্য করা বেশ দুরুহ ব্যাপার। পরিত্রাতা সেই বাবা। ওকে জোরে বকাবকি করলে কাছে এসে পিটপিট তাকাতো আর বলতো এটা আমার বাড়ি। এখানে আমার মেয়েকে কেউ অপমান করলে খুব খারাপ হবে। পুরোটা না কমলেও বাবার আপত্তিতে তন্ময়ের মেজাজ অনেকটাই কমেছে।  মেয়ের মতোই ভালোবাসে বাবা। তাইতো যত আবদার তার কাছে। ছেলেকে পাত্তাই দেয় না। এই বাবার জন্যই আজ সে স্বাবলম্বী। তিনলাখ টাকা দিয়ে রত্নার নামে বিদেশী কস্মেটিক্স কোম্পানির এজেন্সি নিলেন। ছেলে তো রেগে কাই। তাকে বোঝালেন- দেখিস তোর সুবিধেই হবে। মাসের শেষে টানাটানি হবে না। ওর হাতখরচ তোকে দিতে হবে না। তুই চিন্তা করিস না। বাড়ির কাজ, ব্যাবসা সব আমরা বাবা মেয়ে মিলে সামলে নেব। তোর যা মেজাজ! আমি না থাকলে মেয়েটাকে হয়তো তাড়িয়েই দিবি। তখন বাঁচবে কি করে?   

রাতে তন্ময় জানতে চেয়েছিল- কি দিয়ে বশ করলে বলোতো বাবাকে?

রত্না গর্বের সঙ্গে বলেছিল- ভালোবাসা দিয়ে।

সেই গর্ব রইল কই! আজকাল প্রায়ই মেজাজ হারিয়ে ফেলে। তন্ময়কে কিছু বলতে পারে না তাই যত চোটপাট বাবার ওপর। সম্পর্কটা আগের মতোই  অথচ কোথায় যেন একটা ফাটল। সেখান থেকে প্রাণরস চুঁইয়ে চুঁইয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। রুটিন মাফিক সবই করে রত্না, অবহেলা করে না। শুধু বিরক্তি এসে অনেকটা থাবা বসিয়েছে। কারন খুঁজতে গিয়ে প্রতিবারই কানাগলির দেয়ালে ধাক্কা খায়। তন্ময় কিছুতেই ওর অবস্থাটা বোঝে না, বুঝতে চায় না। কিছু বলতে গেলে রুঢ় ভাবে থামিয়ে দেয়। বাবা কিন্তু আজও বোঝে। তাই বেশী খিটখিট করলে জোড়হাত করে ক্ষমা চায়। কখনো কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সেই সময়গুলোতে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না রত্না, কেঁদে ফেলে। সারাটা দিন ঝিম মেরে থাকে,নিজেকে বকে। ঘুমন্ত বাবার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। প্রতিজ্ঞা করে আগের মতো হয়ে যাবে। রাখতে পারে না।    

 

মার্চের সেভেনটিন্থ, বাবার জন্মদিন। আগের বছর রত্না সবে সবে এসেছে। চারমাসের সম্পর্কে ভালোবাসার প্রথমধাপ পেরোচ্ছিল। সন্ধ্যের সময় যখন জানলো সিমাই করে দিয়েছিল। ভীষণ খুশী। বারে বারে বলছে- তোর মা চলে যাবার পর এমন করে কেউ যত্ন করেনি রে! মাথায় হাত বুলোচ্ছেন, চোখ ছলছল। তন্ময়ের ব্যাপারটা ভালো লাগেনি, তাই স্বর চড়াল-

-     ঘ্যান ঘ্যান কোরো না তো! তেল মারছে বুঝতে পারছো না?

-     চুপ কর তনু! আবেগ ভালোবাসার তুই কি বুঝিস! খালি মেজাজ করতেই শিখেছিস। চোখের দিকে তাকিয়ে দেখবি ফারাক ধরতে পারবি। তোর মতো ছেলেকে ও কি করে যে ভালবাসল আমার কাছে সেটাই রহস্য।

-     থাক! আর মাথায় চড়িয়ো না। দুমদুম করে শুতে গেল তন্ময়।

এ বছর কানেকশনটা বন্ধুত্ব প্লাস ভালোবাসায় পূর্ণ। যত্ন আত্তি বেশী হবে জানা কথা। স্নান করে বেরোতেই কপালে চন্দনের ফোঁটা দিল রত্না। নতুন জামা পড়াল, তারপর এক বাটি পায়েস। চকচকে চোখে পুরোটা সাবার করে একমুখ হাসি।

-     এরপর কী?

-     দুপুরে তোমার প্রিয় ভাপা ইলিশ, রাতে খাসির মাংস।

-     দারুণ! তার আগে চল একটু ঘুরে আসি।

-     আমার রান্না হয়নি তো!

-     ছাড় তো! সে বেটা তো আর খাচ্ছে না। একটু দেরী করে খেলে কিছু হবে না।

-     বেশ! মাংসটা নাহয় রাতেই করব। চল!

দুজনে বেরিয়ে ব্যাঙ্কে গেল। লকার রত্নার নামে ট্রান্সফার করে দিল বাবা। তীব্র আপত্তি করেও কোনো ফল হল না।

-     তোমার ছেলে এমনিতেই বলে তোমাকে কায়দা করে হাত করেছি। এরপর তো আরো বলবে!

-     ওর কথা ধরিস কেন? আমি যতদিন আছি তোরা দুজনই আমার সব। ওকে ওর জিনিস আগেই দিয়েছি। তোকে তোরটা দিয়ে দিলাম। এরপর যে বা যারা আসবে তাদের দায়িত্ব তো তোদের। আমি শুধু মজা করব। এখন সেই দিনটার অপেক্ষা। দেখ! দেখ! মেয়ে আমার মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে লজ্জায়।

-     কি যে বল না তুমি? আচ্ছা চল এখন অনেক বেলা হয়েছে।

রাতে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া। অনেকদিন পর আজ তন্ময়ের মুড বেশ ভালো। লকারের কথা শুনে কোনো মন্তব্য করে নি। খেতে খেতে পুরোনো কথা উঠল। রত্না হা করে শুনছে বাবা ছেলের কথা। ছেলেবেলায় তন্ময় ভালোই দুষ্টু ছিল। মা মারা যাবার পর এমন মেজাজী হয়ে গেছে। বহুদিন পর বাড়ির পরিবেশ খোলতাই হয়েছে তাই শুতে যেতে অনেক রাত হল ।

ছোট ছোট হাত-পা নেড়ে এক খুদে সারা গা চষছে আর বাবা তাকে নিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে দিতে খিলখিল করে হাসছে। হঠাৎ তন্ময় এসে রত্নাকে ধাক্কা দিল। সামলাতে পারছে না সে। পড়তে পড়তে বিছানার চাদর খামচে ধরেছে। শুনতে পেল অনেকদূর থেকে কেউ ডাকছে। চোখ খুলে গেল- ও হরি! স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু সত্যিই তন্ময় ডাকছে।

-     আরে ওঠো না! কি ঘুম রে বাবা! ওঠ ওঠ, দেখ বাবা বোধহয় ডাকছে।

-     হুম যাচ্ছি।

ঘুম ভাঙা আলস্য নিয়ে বাবার ঘরে যেতেই চিৎকার। তন্ময় ছুটে গেল। বিছানা থেকে বাবা ঝুলছে।  ঘাম চুইয়ে পড়ছে,পা বেঁকে আছে।

প্রায় সাতঘন্টা পর আইসিইউ রুমের কাঁচের ঘুলঘুলি দিয়ে বাবাকে দেখতে পেল ওরা। নীল ডোরাকাটা একটা নিথর দেহ। নাকে মুখে গাদাগুচ্ছের নল গোঁজা। চারদিকে নানারকমের মেশিন। রত্নার বুকের মধ্যে বাতাস আটকে গেল। মাথার ওপর বাবা না থাকলে তার কি হবে!

প্রায় ষোল ঘন্টা উদ্বেগ আর ভয় পেরিয়ে জানা গেল বাবার অবস্থা স্থিতিশীল। তবে আরো বাহাত্তর ঘন্টা না গেলে ফাইনাল কিছু বলা যাবে না। এটাই আজকালকার রেওয়াজ। ওদিকে নার্সিং হোমের বিল লাফিয়ে লাফিয়ে ছলাখ ছুঁয়ে ফেলেছে। তন্ময়ের কপালের ভাঁজ গোনা যাচ্ছে। দুজনের চোখাচোখি হলেই মনের কথা পড়তে পারছে। আর কতদিন এভাবে চালাতে পারবে জানে না।  জমানোর জন্য বাবা ব্যাঙ্ক একাউন্ট খুলে দিয়েছিল রত্নাকে। সেখানে যা ছিল তুলে নিল। বাবার দেওয়া সব টাকা শেষ তন্ময়ের।

চার দিন পর বাবার সামনে যাবার অনুমতি পেল। চোখ খোলা, মৃত্যুর সঙ্গে দেখা হওয়ার বিস্ময় ছড়িয়ে আছে মণিতে। ওদের দেখে হাসি খেলে গেল মুখে। ঠোঁট বিকৃত হচ্ছে। ডাক্তার বলেছে ফিরলো ঠিকই, তবে এবার বিছানার জীবন। কোমর থেকে পা আর নাড়াতে পারবে না, গলার স্বর ও খেয়ে ফেলেছে হার্ট অ্যাটাক।     


প্রথম সপ্তাহে দুবেলা আয়া ছিল। নাহলে রত্নার পক্ষে নতুন অবস্থায় সামলানো মুশকিল হোতো। নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেতে ষোল দিন লেগে গেল। ততদিনে প্রভিডেন্ট ফান্ডের লোন, গোল্ড লোন, পার্সোনাল লোন নেয়া হয়ে গেছে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও হাত পাততে হয়েছে। মানুষটা ফিরেছে তাতেই খুশী দুজন।

আয়া রাখার খরচ সামলানো যাবে না তাই দায়িত্ব এল রত্নার কাছে। একশ শতাংশ দিয়েছিল সে । অনেকদিন ব্যাবসার কাজ বন্ধ ছিল সেটাও শুরু করতে হলএবার তন্ময়ই চাইছিল রত্না রোজগার করুক। ডেলিভারি দেবার লোক সেই ঠিক করে দিল। দিনের বেলা সব কাজের মাঝেও রত্নার সজাগ মন থাকতো বাবার দিকেই। রাতেও দু-তিনবার উঠে দেখে আসে। গায়ের চাদর টেনে দেয়। বাবার অসুবিধে হবে ভেবে হাতের চুড়ি খুলে রেখেছিল। পা টিপে টিপে যাওয়া আসা করতো। সম্পূর্ন সুস্থ হতে মাস দুয়েক লেগে গেল। ততদিনে রত্না নতুন পরিস্থিতিতে নিজেকে ভালোভাবেই গুছিয়ে নিয়েছে।

যতদিন বাবা নির্জীব ছিল কোনো সমস্যা ছিল না। উঠতে না পারলেও একসময় শরীরের বাকি অংশ আর মন চাঙ্গা হল। নতুন পরিস্থিতিতে তার মানিয়ে নেয়া কষ্টের হল। সারাদিন চরকি কাটা মানুষ একভাবে শুয়ে থাকে কি করে? আগে রত্না যখন কাজ করতো বাড়িতে থাকলে পাশে বসে গল্প করতেন। এখন চারদেয়াল ছাড়া কিছুই নেই। কথারাও হারিয়েছে। মাথার মধ্যে চিন্তার বুরবুরি সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন। রত্না যখন তাকে স্পঞ্জ করায়, বেডপ্যান পরিস্কার করে, লজ্জায় মিশে যান বিছানায়। মনের কথা, ইচ্ছের কথা বোঝানোটাও মহা ঝকমারি হয়ে দেখা দিল।

রত্নাই স্বভাবিক করে দিল অনেক কিছু। ইশারা চটপট বুঝতে পারে। হাতের কাছে বই এনে দেয় তাতে খানিকটা সময় কাটে। স্পঞ্জ করার সময় মুখ ঘুরিয়ে রাখে। সামনে বসে ব্যাবসার কথা আলোচনা করে। একদিন হাতে একটা চামচ ধরিয়ে দিল। টেবিলে আওয়াজ করলে রত্না বুঝতে পারবে বাবার কিছু দরকার।  এটাই কাল হল। যখন তখন ডাকতে লাগলেন। কাজ ফেলে ছুটে এসে রত্না দেখে বাবা হাসছে। দৃষ্টি জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে কাছে থাকার মিনতি।

টাকার প্রয়োজন। বাবার জন্য মাসে আট-নহাজার টাকার অসুধ লাগে। লোনের টাকা শোধ করতে হচ্ছে। রত্না কাস্টোমার ধরতে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঢুকল। কাজ পেল প্রচুর, সঙ্গে বন্ধুও জুটে গেল। তাদের লাইফস্টাইল দেখে আর হীনমন্যতায় ভোগে। তাদের কাছে শোনে শ্বশুর কখনো নিজের হয় না। রত্নার এই স্যাক্রিফাইসের কোনো দাম নেই। নিজের জন্যও একটু ভাবতে হয়। মনে মনে হাসে। তার তো আর শ্বশুর না, তার যে বাবা। হাল্কা হলেও এসব কথার ছাপ থেকে যায়।

কাজের চাপ বেড়ছে। আগে বাবার সাহায্য পেত। এখন সবটাই নিজেকে করতে হয়। অর্ডার অনুযায়ী জিনিস, নাম ঠিকানা লেখা কাগজ আর বিল পলিপ্যাকে রেডি করে রাখে। ছেলেটি গিয়ে দিয়ে আসে। হিসেব আপডেট রাখতে হয়। কাস্টমারদের সঙ্গে ফোনে বা নেটে কথা বলতে হয়। কোম্পানিতে আগে চেক দিয়ে আসতো, এখন অনলাইন পেমেন্ট করে। তার জন্য আলাদা হিসেব রাখা। সারা দুপুর ধরে এইসব করে। এর মাঝে বাবার আবদার সামলানো। সবটাই ঘরে বসে। বাইরের জগতের সঙ্গে রত্নার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল একেবারে। নতুন বন্ধুরা দলবেঁধে সিনেমায় যায়, রেস্টুরেন্টে খাবার ছবি পোস্ট করে। ওকে যেতে বললে এড়িয়ে  যেতে হয়। ঘর ব্যাবসা আর বাবা, এর বাইরে সবকিছু ওর জীবন থেকে মুছে গেল।

প্রথম প্রথম বাবার ছেলেমানুষিতে হেসে ফেলতো। যখন তখন ডাকছে-টকটক, টকটক। একটু কথা বলবে। যতক্ষন রত্না ওঘরে, সারাক্ষণ মুখের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে। আস্তে আস্তে ফরমায়েশ বাড়ল। এটা খাবো ওটা খাবো বায়না। হয়ত কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলছে, টকটক, টকটক। গিয়ে দেখে পেট ব্যাথা। অসুধ দিয়ে এলো তো একটু পরেই বেডপ্যানের দরকার।

রোজগার একটু বাড়তে তন্ময়কে বলেছিল

-     এবার দিনের বেলায় একটা আয়া  রাখলে ভালো হয়।

-     তুমি আছো কি করতে? বাবাতো শুয়েই থাকে। কোনো ঝামেলা করে না।

-     আচ্ছা! একদিন থেকে দেখ না সারাদিন কেমন চুপচাপ শুয়ে থাকে।

-     এই তুমি বাবাকে ভালোবাসার কথা বলতে! এর মধ্যেই সব শেষ?

-     তুমি আমার কথা একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লীজ!

-     কি বুঝবো? বাবা এখন তোমার বোঝা হয়ে গেছে?

-     আমার কাজ অনেক বেড়েছে। সময় বেশী দিতে হয়।

-     ভুলে যেওনা এই কাজ কিন্তু বাবার দৌলতেই করতে পারছো।

-     তোমাকে বলাটাই আমার ভুল। আর কিছু বলব না।

সময় চলছে নিজের গতিতে। রত্নার যত্ন করার আকুতিও হারাচ্ছে তার গতিতে। একসময় কুয়াশা সরে যাবার মতো আবছা হতে হতে একেবারেই সরে গেল। সেই জায়গায় উঠে এল চরম বিরক্তি। প্রায় দুবছর বাড়ির বাইরে বেরোয় না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাশের ভাড়াটে মাসিমার সঙ্গে দুটো কথা বলছে অমনি ডাক পড়বে- টকটক, টকটক। সন্ধ্যেবেলা টিভি খুলে সবজি কাটছে, ডাক পড়ছে-টকটক, টকটক।

তন্ময়ের কাছে অনুযোগ করলে উত্তর দেয়, কিন্তু স্বরে কোন সমবেদনা থাকে না। রত্নার মুখের দিকে তাকিয়েও অভাবী ধরনের কিছু দেখতে পায় না, যাতনা কষ্ট কিচ্ছু না। বাবার চিকিৎসার লোন শোধ করতে ব্যাস্ত। ওটাই পাখির চোখ।

এক ছুটির দুপুরে খেতে বসে রত্না বলল

-     অনেকদিন কোথাও যাই না। চল না আজ একটা ফিল্ম দেখে আসি।

-     বেশ কথা! বাবার কি হবে?

-     মাসিমাকে রেখে যাব। ভালো গল্প করেন।

-     তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। খালি বাইরে বাইরে মন। ওই বুড়ো মানুষটাকে আর সহ্য হচ্ছে না, তাই তো?

-     কি বলছ তুমি! সবকিছু তো করি! আমারও তো ইচ্ছে করে একটু ঘুরি মজা করি,একটু ভালো সময় কাটাই। তুমি তো বাইরে যাও, আমায় যে সারাদিন এই ঘরটার মধ্যে থাকতে হয়।

-     মানে? কি বলতে চাইছ তুমি? আমি বেড়াতে যাই। অফিসে সারাদিন গাধার মতো খাটতে হয় বুঝলে! আর কি বললে? বাবার কাছে থাকো বলে বাজে সময় কাটাচ্ছো?

-     সব কিছুতে বাবাকে নিয়ে আসো কেন?

নুন নিতে গিয়ে টেবিলে ছড়িয়ে গেল। মাথার আগুনে ঘি পরল।

-     এগুলো কি? এই সব ব্যাবসার জিনিস টেবিল জুড়ে, ঘর জুড়ে ছড়িয়ে রেখেছ। গুছিয়ে রাখতে পারো না।

-     কোথায় রাখবো? দুটোতো মোটে ঘর। আমাদের ঘরে জায়গা আছে রাখার! বড় ঘরটাতো তোমার বাবার দখলে।

-     বাহ! দারুন! বাবা এখন আমার হয়ে গেল। ওই বাবাই তোমাকে মেয়ে মেয়ে করতো। বলেছিলাম ছেলের বউ কোনদিন মেয়ে হয় না।

ভাতের থালা ছুঁড়ে উঠে গেল তন্ময়। রত্না কেঁদে ফেলল। ছুটে বাবার কাছে গেল। জল চোখে তাকিয়ে দেখল লম্বা কাঠামোটা ছোট হয়ে এসেছে। কোমড় থেকে পা অব্দি একভাবে পরে থেকে থেকে প্যাকাটি হয়ে গেছে। নিপাট ঘুমোচ্ছে, হাতের মুঠোয় চামচটা ধরা। হেসে ফেলল রত্না। মাথায় হাত বুলিয়ে চলে এল। বাইরে বেরিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়েছে। মেঘ জমেছে আকাশে। কতদিন সেভাবে বৃষ্টি দেখেনি। টকটক, টকটক। বিরক্তি দ্বিগুন হয়ে ফিরল।


সেদিন বাবাকে স্পঞ্জ করে খাইয়ে ব্যাবসার হিসেব মেলাচ্ছে। কয়েকদিন ধরে একজন কাস্টমার খুব ঝামেলা করছে। স্টক রেজিস্টার বলছে ওর জিনিস ডেলিভারি হয়েছে, উনি বলছেন পান নি। ওদিকে কোম্পানি ফোন করেছে ওদের পেমেন্ট হয়নি তাই মাল দিতে পারবে না। অনেকগুলো অর্ডার জমে আছে। মাল না এলে কাস্টমারদের কি বলবে? নেট কানেকশন ভীষণ স্লো। অনেকবার চেষ্টা করেও পেমেন্ট করতে পারছে না। এই যখন অবস্থা, ডাক পড়ল- টকটক, টকটক। উফ! কি  জ্বালা! বিল, রেজিস্টার, ফোন, অর্ডার বুক নিয়ে হিমসিম খেতে খেতে বিরক্তিতে ফেটে পড়ল রত্না। ওদিকে ক্রমাগত ডাক পরছে-টকটক, টকটক। কাস্টমারের সঙ্গে সবে গলা চড়িয়ে প্রমাণ দিচ্ছে তার জিনিস কবে কীভাবে পাঠানো হয়েছে, পাওয়ার কাট। চারদিক বন্ধ খাবার ঘরে অন্ধকার নামল। অন্ধকার নামল রত্নার মনে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেল। ফোন ফেলে ছুটে গেল ক্রমাগত বেজে চলা শব্দের দিকে। একটা ছেলেমানুষি ভরা হাসিমুখ ইশারায় দেখালো তার কোলের বালিশটা পরে গেছে। উন্মত্তের মতো বালিশটা তুলে মুখে চেপে ধরল- নাও! নাও! বালিশ নাও! অসহায় মানুষটা প্রানপনে কিছু বলার চেষ্টায় দুহাত নাড়িয়ে যাচ্ছে। থরথর করে কাঁপছে রত্না রাগে,বিরক্তিতে, শেষ না হওয়া শব্দের আতঙ্কে। প্রতিরোধের সবটুকু ক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে হাত ঝুলে গেল। রত্না বাক্যহারা পলকহীন। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে এল সে। মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে ফিরল।  খাবার ঘর পেরিয়ে মেন দরজা খুলে বারান্দা থেকে নেমে উঠোনে দাঁড়াল। আকাশের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে লম্বা শ্বাস নিল।  তার পা চলছে।  কোথায় যাচ্ছে সেদিকে মন নেই, যাচ্ছে। বহুদিন পর খোলা আকাশ তাকে টানছে। মুক্তির বাতাসে একটা আলাদা সুগন্ধ থাকে। পার্কে বসে অনেকক্ষণ ধরে গন্ধটা চুষে নিয়ে জমা করে নিচ্ছিল বুকের মধ্যে।

 

আত্মীয়স্বজন সবাই মোটামুটি এসে গেছে। অন্য ভাড়টেরা তো আগে থেকেই রয়েছে।  চারপাশে এত লোক এত শব্দ তবু কিছুই শুনতে পাচ্ছে না রত্না।  দরজার গা ঘেঁষে লোহার মতো দাঁড়িয়ে।  মরচে ধরা কৌটোর মতো মুখ।  চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে অপরাধবোধ, নিরাপত্তা, ভালোবাসা।  পার্কে অনেকক্ষণ পর হুশ ফেরে। হনহনিয়ে বাড়িতে ঢুকে বাবার কাছে যায়। ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে চোখ দুটি, হাতে শক্ত করে ধরা একমাত্র যোগাযোগের অস্ত্র সেই চামচ।  পা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে সে। জানে এ পাপের হাত থেকে নিস্তার নেই। কাউকে বলতেও পারবে না। সেই সাংঘাতিক মুহুর্ত তাকে জীবনভর কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে। তার কান্নার আওয়াজে পাশের ভাড়াটে মাসীমা চলে আসেন। তিনিই তন্ময়কে খবরটা দেন। রত্নার শরীর মন ঠান্ডা, নিঝুম। মাথায় একঝলক অন্ধকার, তার মধ্যে সে একা। 

অনবরত কেঁদে চলেছে রত্না। মাঝরাতে ঘুমের মাঝেও তন্ময় শুনতে পায় টানা বৃষ্টির মতো কান্নার শব্দ। একে অশৌচ চলছে তার ওপর অবিশ্রান্ত ধারাপাত, ভেঙে পড়ছে রত্না। মুখেচোখে ভীষণ মানসিক বিধস্ততার ছাপ। আত্মীয়স্বজন, আশেপাশের লোক বোঝে রত্না আঘাত পেয়েছে। বোঝেনা শুধু তন্ময়। মুখোমুখি হলেই তার চোয়াল শক্ত হচ্ছে।

ভালোভাবেই সব কাজ মিটে গেল। লোকজন একে একে বিদায় নিল। রত্নার চোখের জল শুকোনোর নাম নেই। ফাঁকা বাড়িতে তন্ময়ের এতদিনের বিরক্তি ফেটে পড়ল।

-     বাবা থাকতে তো কত অভিযোগ ছিল তোমার। এখন ন্যাকামো করছ কেন?

চোখে জল নিয়ে নিঃশ্বব্দে কাজ করে যায় রত্না। উত্তর না পেয়ে তন্ময় অবাক।

-     তোমার পথের কাঁটা নেই। এবার গিয়ে বড় ঘরটা দখল কর!

-     খবরদার! ওই কথা মুখেও আনবে না। এ বাড়িতে যতদিন থাকবো ওই ঘর বাবার।

থতমত খায় তন্ময়। এ কোন রত্নাকে দেখছে! বাবার সঙ্গে ওর বন্ডিং খুব ভালো ছিল আগে। ইদানিংকালে বাবাকে নিয়ে বিরক্ত হতেই দেখেছে।  রত্না সত্যিই বাবাকে এতো ভালবাসত!

 

সময়ের আস্তরণ মনের শোক কিংবা অন্ধকার সবই ফ্যাকাশে করে দেয়। রত্নার কান্নাই  হোক বা অন্যকিছু, তন্ময়কে নাড়া দিয়েছিল। মাস দুয়েকের মাথায় নিজে থেকেই বাড়িটা বদলাবার কথা বলল। রত্না এককথায় রাজি। বাবার ঘরের দিকে তাকালে দুটো চোখ তাড়া করে। এখনো কাজের ফাকে মনে হয় শব্দ ভাসছে, টক টক, টক টক।

নতুন বাড়িতে গুছিয়ে নিতে সপ্তাহখানেক লেগে গেল। এখানে ছোট ঘরটাতে রত্না ব্যাবসার জিনিস, কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতে পেরেছে। নতুন পরিবেশে স্মৃতির তাড়া অনেক কম। জীবন ছাঁচ বদলে ফেলেছে।

ঢিলেঢালা ছুটির সকাল। ব্রেকফাস্ট আর দ্বিতীয় রাউন্ডের চা করছে রত্না। হুবহু সেই আওয়াজ।  জ্বালা করে উঠল কান, মন।  ছিটকে বেড়িয়ে এল রান্নাঘর থেকে।  ডাইনিং টেবিলে তাজা কাগজে ডুবে আছে তন্ময়। তার একটা হাত চামচ দিয়ে ফাঁকা চায়ের কাপে আওয়াজ তুলছে।  টক টক, টক টক-

শুক্লা মালাকার


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন