পালামৌ এর জঙ্গলে ~ নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী


                  
পালামৌ এর জঙ্গলে
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী

''এমন সময় আসিবে হয়তো দেশে, যখন মানুষে অরণ্য দেখিতে পাইবে না। ___শুধুই চাষের ক্ষেত আর পাটের কল, কাপড়ের কলের চিমনি চোখে পড়িবে, তখন তাহারা আসিবে এই নিভৃত অরণ্যপ্রদেশে, যেমন লোকে তীর্থে আসে। সেই সব অনাগত দিনের মানুষের জন্য এ বন অক্ষুণ্ণ থাকুক।''
       - আরণ্যক, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

পুজোয় এবার একটা ছোট্ট অবকাশ পাওয়া গেল। কোনও হোটেলেই বুকিং করিনি, কারণ যাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। হাতে সময় খুব কম এবং ছুটি মাত্র চারদিন। কোথায় যাওয়া যায়? কাছাকাছি প্রকৃতির বুকে একটু নির্জনতায় কোথায় সজীব করে নেওয়া যায় মন? হ্যাঁ অরণ্য। ওখানেই তো বড় বড় মহীরুহের ছায়ায় আছে নিভৃত অবসর যাপনের অসাধারণ আয়োজন। তবে অরণ্য এখন এই নাগরীক জীবনের কোনওখানে আর অবশিষ্ট নেই।

অথচ প্রাচীন ভারতবর্ষ, জম্বুদ্বীপে নগর আর অরণ্য ছিল পাশাপাশি। অরণ্যের প্রান্ত থেকে শুরু হতো গ্রামের সীমানা। বুদ্ধদেবের সময়কালে মজ্ঝিমনিকায় গ্রন্থে আমরা বেশ কয়েকটি এমন অভয়ারণ্যের উল্লেখ পাই। যেমন সারনাথের মিগদাব, মগধের বেণুবন, কুশীনগরের শালবন ইত্যাদি। এছাড়া একাধিক সূত্রে আমরা আরও এমন বহু বনের নাম পাই, এর মধ্যে একটি হলো শুভগ্ বন। গাছগাছালি ঘেরা এই বনটি অভয়ারণ্য নয়। এই বনটি কোশলরাজ প্রসেনজিত ব্রাহ্মণ পোক্করসাতিকে দান করেছিলেন।

সেইসময় সাধারণতঃ তিন ধরণের বন ছিল। একটি হলো অভয়ারণ্য যেখানে শিকার করা, গাছকাটা ইত্যাদি নিষিদ্ধ ছিল, যেমন ভেষজবন, মৃগদাব প্রভৃতি। অপর একধরণের বন ছিল যেখানে কাঠ সংগ্রহ করা, মধু সংগ্রহ ইত্যাদি অবাধে করা যেত, যেমন অন্ধবন মহাবন ইত্যাদি। আর ছিল রক্ষিত বন। এগুলি একরকম তৈরি করা উদ্যান। এইখানে বিভিন্ন ধরণের বৃক্ষরোপন করা হতো। প্রাণীদের জলকষ্ট দূর করতে কূপও খনন করা হতো এখানে। বনরক্ষীরা সবসময় এই সব বন পাহারা দিত। এখানে বিভিন্ন ধরণের পাখি থাকলেও হিংস্র জন্তু প্রায় থাকতো না। একটি কাহিনীতে আমরা এমন একটি বনের উল্লেখ পাই, যার নাম গোশিঙ্গ। এই বনাঞ্চলের আকৃতি ছিল গরুর শিং এর মতো, তাই এমন নাম। এই বনের রক্ষীরা একবার স্বয়ং বুদ্ধকে সেই বনে প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছিল, ভিক্ষু অনিরুদ্ধ দূর থেকে তার প্রভুকে দেখতে পেয়ে রক্ষীদের বলেন, হে মিত্র! ইনি আমার শাস্তা (প্রভু) আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, প্রভু বুদ্ধ আজ এই বনে স্বয়ং এসেছেন। তুমি ওঁকে আসতে বাধা দিও না। একথা শুনে সেই রক্ষী বুদ্ধকে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দেন। আরও একটি উদাহরণ দিতে ইচ্ছে করছে, তা হলো বাৎস্য রাজ্যের ঘোষিতারাম ভিক্ষুসংঘের কাছে পারিলেয় বন। এই বনে একবার বুদ্ধ যখন একাকী বাস করতেন, তখন তার সেবা করেছিল একটি বন্য হাতি। সে বুদ্ধের জন্য গভীর অরণ্য থেকে ফল মূল সংগ্রহ করে আনতো। বুদ্ধ রাজপুত্র থাকাকালীন হস্তিবিদ্যা চর্চা করেছিলেন। তিনি হাতিদের ভাষা বুঝতে পারতেন। এ কথা অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ, তবে যাইহোক এই কাহিনীগুলি থেকে আমরা জানতে পারি, প্রাচীন যুগের মানুষ অরণ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন এবং তা কঠোরভাবেই পালন করা হতো।  

নাগরীকগণ মাঝে মাঝে এইসব অরণ্যে ছুটে আসতেন সজীব হতে, বিশ্রাম নিতে। অরণ্যের মাঝে থাকতো বিভিন্ন ঋষি ও মহাত্মাদের আশ্রম, সেখানে আতিথ্য নেওয়া যেত। তবে সেই সবদিন এখন সুদূর অতীত। জনসংখ্যার প্রবল চাপে অরণ্য ক্রমে সংকুচিত হতে হতে একেবারে তলানিতে নেমে গেছে। এখন নগর জীবনের গ্লানি দূর করতে অরণ্য বা জঙ্গল দেখতে হলে, গাড়ি ভাড়া করে ছুটে যেতে হয় বহুদূরে।

ঝাড়খণ্ড রাজ্যে এখন ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অরণ্য আছে। কৃত্রিম জাতীয় উদ্যানগুলির তুলনায় এখানকার বনেই এখনও আছে কিছুটা প্রিমিটিভনেস। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। দেখা গেল, কলকাতা রাঁচির প্লেন ফেয়ারও এখন বেশ কম। টিকিট তুলে নেওয়া হলো। থাকার ব্যবস্থায় এবার প্রকৃতিদেবী আমাদের সহায়ক হলেন। পেলাম বেতলার বন বিহারে দু রাত্রি থাকার জন্য দুটি ঘর। ব্যস আর চিন্তা কীসের! এরপর আমাদের যাত্রা শুরু হলো। একটি গাড়িও ঠিক করে নেওয়া হলো। যা আমাদের রাঁচি থেকে বেতলা বনবিহারে নিয়ে যাবে এবং পুরো সময় আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমরা রাঁচি এয়ারপোর্টে নামলাম। দিব্যি ঝকঝকে তকতকে ছোট একটি এয়ারপোর্ট। লাউঞ্জের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গাড়ির চালক। নাম বৈজনাথ পাণ্ডে। বসা মাত্র গাড়ি তীব্র গতিতে ছুটতে লাগলো। ক্রমে শহর ছাড়ালাম।

কয়েক জায়গায় রাস্তা তৈরি হচ্ছে। কিছুটা রাস্তা একটু খারাপ পেলাম। যেতে যেতে কোনও অঞ্চলের নামের শেষে টাঁড় শব্দটা দেখে, ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, টাঁড় মানে বন্ধ্যা বা অনুর্বর স্থান। আরণ্যকের কার্মাটাঁড়ের কথা মনে পড়ে গেল। একজায়গায় গাড়ি থামিয়ে সবুজ শালপাতায় করে আমরা কাচা লঙ্কা আর নুন দিয়ে পোড়া ভুট্টা খেলাম। কলকাতায় যেমন ভুট্টা পাওয়া যায়, তার প্রায় দ্বিগুণ আকার এবং ভুট্টার স্বাদও বেশ ভালো। দুপুরে কচুরী আর গোলাপ জামুন দিয়ে লাঞ্চ সারা হলো রাস্তার পাশের এক ধাবা থেকে। এবার একটানা পথ চলা।

তীব্র চড়া রোদ না হলেও রোদের তেজ এখানে বেশ কড়া। বেতলা যেতে আমাদের রাঁচি থেকে প্রায় একশো সত্তর কিলোমিটার রাস্তা যেতে হবে। রাস্তা বড় সুন্দর, দুপাশে বড় বড় বৃক্ষশ্রেনীর মাঝখান দিয়ে পথ চলেছি। একটা তোরণের পর থেকে বেতলা অরণ্যের বাফার অঞ্চল শুরু হলো। সমস্ত পথটাই এখানে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত বনাঞ্চল। রাস্তার দুধারে সারিবদ্ধ বৃক্ষের সারি। এখানে কয়েকটা গেস্ট হাউসও দেখতে পেলাম। এখানে বড় গাছ ছাড়াও পথের দুধারে সহদেবী গাছের ঝোপ। শেষ বিকেলের আলোয় দেখলাম সেই ঝোপে ছোট ছোট বেগুনি রঙের ফুল ফুটেছে। এই গাছ কম্পোসিটি বা অ্যাস্টারেসী ফ্যামিলীর। এই প্রজাতির গাছেদের গায়ে একধরণের বিশেষ গন্ধ থাকে। সূর্যমুখী গাছের ফুলে ও পাতায় যে গন্ধ থাকে খানিকটা তেমন, কারণ সেটিও ওই একই গোত্রের গাছ। এই গাছের পরিচিতির জন্য বলছি, এদের শেকড়ে আছে গোলাপ আর চন্দন মেশানো একধরণের অপূর্ব সুবাস। শিবকালী ভট্টাচার্য তার 'চিরঞ্জীব বনৌষধি'তেও এই কথার উল্লেখ করেছেন। এই গাছ খুব দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তার দু পাশে এই গাছের ঝোপ ঘন হয়ে বিস্তার লাভ করেছে। গাড়ির চাকার চাপেই হয়তো দলিত ঝোপগুলো থেকে একধরণের উগ্র বনজ ঘ্রাণ পেলাম। মুহূর্তে প্রাণ মন পবিত্র হয়ে গেল। এ যেন অরণ্যের ঘ্রাণ, প্রকৃতির গন্ধ। আমি আত্মবিস্মৃতের মতো চেয়ে থাকি। এই প্রায়ান্ধকার পথ, দুপাশে বড় বৃক্ষরাজি আর ঘন বুনোঝোপ। একপাশে পালামৌ পাহাড়ের বুকে সূর্যাস্ত হচ্ছে। মন পরম পবিত্র তো হবেই। এই অরণ্য দর্শন করা তো তীর্থ দর্শনেরই সামিল।

বনবিহার গেস্ট হাউসে পৌঁছালাম। ঢোকার মুখে এক বিশাল মহুয়া গাছ যেন নীরবে বিষণ্ণ মুখে রাস্তার ওপারের বনের ভেতর ঢোকার ফটকের দিকে চেয়ে আছে। রাস্তার ওপারে গেটের ভেতর বন দফতরের ট্রি হাউস আছে। ওখানেও আছে আরও একটা মহুয়া গাছ আছে। সে গাছ বিশাল ছাতার মতো ঘিরে রেখেছে সামনের রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পথটুকু। আছে আরও কত যে গাছ, তাদের একটু পরিচয় দেব, তবে একটু পরে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গেস্টহাউসটাতে আমরা বুকিং পাইনি। ওখানকার ট্রি হাউস ঠিক প্রকৃত ট্রি হাউস নয়। একটু উঁচু করে সিঁড়ির উপর বানানো হয়েছে সিমেন্টের ঘর। বনের ভেতর নাকি প্রচুর বুনোহাতি আছে। তাদের আটকাতেই উঁচু করে সিঁড়ির উপর ঘর করা হয়েছে। বনবাংলোতে আছে মোটে চারটে ঘর, এবং বুকিং পাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য।

আমরা উঠেছি যেখানে, সেই বনবিহার গেস্টহাউস ঝাড়খণ্ড পর্যটন দফতরের। সেখানে প্রচুর ঘর, আর লোকজন গিসগিস করছে। প্রচুর বাঙালিদেরও দেখা গেল। কলকাতার ভীড় থেকে পলাতক মানুষের দল। তার মধ্যে আছি আমরাও। একটু দূরে দুটি ঘর। একটু ফ্রেশ হয়ে ফরেস্ট সাফারির কথা বলতে এবং জীপ বুক করতে বন-বাংলোর দিকে এগোলাম। কারণ, আগামীকাল ভোরে আমাদের বেতলায় ফরেস্ট সাফারি করার কথা।  চারিদিকে এখন ঘন অন্ধকার। বেশ ঠাণ্ডা। গায়ে যেন সূঁচ ফোটাচ্ছে। এখানে হাওয়ায় জলীয় বাষ্প বেশ কম। শীতকালের মতো চামড়ায় টান ধরছে। কথা বলে, টাকা অ্যাডভান্স করে ফেরার পথে রেস্টুরেন্টের পাশে বেশ কয়েক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ দেখালাম। শুনলাম এখানে একটা সল্ট পিট আছে। রাতে বন্য জন্তুরা আসে প্রায়ই। এখানে অরণ্য একদম বাধন ছাড়া। একটা জালের ব্যবধানও নেই। রাতে এখানকার বড় গেটটা তাই বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঠাণ্ডার আমেজ এবং অন্ধকারে দু'দিকে বিরাট বিরাট গাছের আবছা সিল্যুয়েট মনে কেমন এক ধরণের রোমাঞ্চ জাগায়। বেতলা নামটি এসেছে এখানকার আদিবাসীদের গ্রামের নাম থেকে। আগে এই সমস্ত অঞ্চলটা ছিল জঙ্গালাকীর্ণ, আর তা পালামৌ এর জঙ্গল নামেই পরিচিত ছিল।

বেতলা অভয়ারণ্য ভারতের প্রাচীণ নয়টি প্রধান অভয়ারণ্যের মধ্যে অন্যতম। এটি ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর সর্বপ্রথম অন্যান্য নয়টি অরণ্যের সঙ্গে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৭৪ সালে। এই বনে প্রায় প্রায় ৩০টি বাঘ এবং প্রায় ৪৭টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। এছাড়া প্রায় ১৪৭টি প্রজাতির পাখিও দেখা যায় এখানে। এই বনে বন্য প্রাণীদের জন্য জলের সুব্যবস্থা আছে। প্রায় ৩২২টি স্থানে পশুপাখিদের জল খাওয়ার জন্য আলাদা আলাদা জায়গায় পুকুর, খাল এবং বর্ষার জলে পুষ্ট পাহাড়ি জলধারা আছে। আমরাও বনের ভেতর ঢুকে অনেক জলাভূমি, খাল ও জলধারা দেখতে পেয়েছি। দেখেছি, গভীর বনের মধ্যে সাদা শালুক ফুটে আলো হয়ে আছে কিছু কিছু খাল বিল। 

রাতটুকু কাটিয়ে ভোর ছটা বাজার আগেই চলে এসেছি বেতলা জাতীয় উদ্যানের গেটের সামনে। গেটের সামনে দুখানা পাথরের ফলকে চোখ রাখলাম।
    
জেলা লাতেহার। থানা বড়বাডিহা, পুলিশ চৌকি বেতলা। ফরেস্ট বেতলা। জঙ্গলের ভেতর ঢোকার আগে একটা ছোট ফলকে লেখা ছিল এই কথাগুলি। তারপাশে আরও একটি ছোট ফলক, সেখানে যা লেখা ছিল তা হলো----''বন এবং পর্যটন বিভাগবন্য প্রাণিয়োঁ কা শিকার করনা, মানবতা কে প্রতি অপরাধ হ্যায়। বন্য প্রাণিয়োঁ সে প্রেম করেঁ এবং ইনকে সংরক্ষণ মে সহয়োগ করেঁ। কোর এরিয়া, বেতলা রাষ্ট্রীয় উদ্যান''

আমাদের জীপ সাফারি শুরু হলো। গাড়ি নিয়ে অরণ্যে প্রবেশের মূল্য ঘন্টায় তিনশো। এ ছাড়া জীপের ভাড়া ঘন্টায় সাড়ে পাঁচশো। সঙ্গে একজন গাইড যাবে, তার মূল্য ঘন্টায় একশো। আমরা দু-ঘন্টার অনুমতি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। বাতাসে হিমেল ঠাণ্ডা। জীপ ধীরে ধীরে বনের ভেতর প্রবেশ করছে। বিশাল বড় অরণ্য। বাফার ও কোর এরিয়া নিয়ে দু-ঘন্টায় দেখা সম্ভব নয়। আগে হাতি সাফারি হতো। হাতি নাকি গভীর বনের ভেতর ঢুকতো। হাতি ট্যুরিস্টদের পাহাড়ের ভেতর একটা গুহার কাছে নিয়ে যেত, সেখানে গেলে নাকি বাঘ দেখা যেত। আজ পশুপাখি যদি কিছুই না দেখি, আমার কোনও দুঃখ নেই। বনের রূপ দেখতে এসেছি। বনদেবীর কৃপা হলে, যদি কিছু দেখতে পাই, তা-ও মন্দ নয়। মন এক উদার মুক্ত জগতে প্রবেশ করেছে। কোথাও এখানে এতটুকু ক্ষুদ্রতা নেই। চারদিকে কেবল পাতার মর্মর ধ্বনি, অরণ্যের মাথায় ব্যাপ্ত দীর্ঘ মহীরুহের পত্রসজ্জা সূর্যের আলোয়, আলোছায়ার এক অপূর্ব মোহজাল বিস্তার করেছে। কেউ আমরা একটাও কথা বলছি না। কেবল জীপের চলার একটানা একধরণের যান্ত্রিক শব্দ আর মাঝে মাঝে পাখির ডাক।

দেখতে পাচ্ছি কতরকমের যে গাছ তার ইয়ত্তা নেই। একদল চিতল হরিণকে পাশ কাটিয়ে জীপ বাঁক নিল। হরিণগুলো এমন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে! কুয়াশামাখা ভোরে, ওদের উপস্থিতি এমনই সহজ আর স্বাভাবিক, যে প্রথমে দেখতেই পাইনি। দেখলাম ওদের গায়ের রঙের সঙ্গে গাছের বড় বড় কাণ্ডের রঙের ভীষণ মিল, তাই ওদের নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে থাকা আমি বুঝতেই পারিনি। ক্রমশঃ এগিয়ে চলেছি অরণ্যের পথে। বনের মধ্যে লাল ল্যাটেরাইট মাটির সরু সরু রাস্তা। জীপের চালকের নাম কুতুবুদ্দীন আনসারী। গাইড আমাদের কিছু জন্তু জানোয়ার না দেখিয়ে, একেবারেই শান্তি পাচ্ছে না। তাকে যত বলা হয়, ''ঠিক আছে। আমরা ব্যস্ত নই, নাই বা দেখলাম পশু পাখি! অরণ্যের আসল অধিবাসী গাছেরা তো রয়েছে, তারাও কি কম সুন্দর?'' এই যে সাদা ফুলে ভরা দুধিয়া লতা দুলছে গাছের গায়ে গায়ে, উদার নীল আকাশের পটভূমিতে এর রূপ মনকে উদার আর বিষণ্ণ করে তোলে, বড়লোকের বাড়ির ড্রয়িংরুমের সাজানো সুন্দর গাছ নয় এ। তাই বলে অসুন্দর নয় মোটেই। গোলগোল পাতার লতাগুলো কি আরণ্যকের সেই গোলগোলি লতা? কাছে যেতে দেখলাম না, এ হলো বন্য গজপিপুল লতা। পাতার রঙ ভারী সুন্দর! অদ্ভুত ফিকে একরকম সবুজ! তেজপাতার মতো সমান্তরাল তার শিরাবিন্যাস। বহুদূর থেকে এই লতা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পাতার কিনারা গোলটে, এবং আকৃতি কিছুটা হৃৎপিণ্ডের মতো। দেখতে দেখতে বিভূতিভূষণের আরণ্যক বারবার মনে পড়ছে। সেই একই পালামৌ রেঞ্জের জঙ্গল এটা। গাছপালার প্রকৃতিও একইরকম হওয়ার সম্ভবনা প্রবল।

আমি দেখছিলাম বড় বড় গাছগুলোকে, আর চেনার চেষ্টা করছিলাম। দেখলাম সিধা, চিলবিল, মহুয়া, কেওঞ্জ, কাঠহুল, করম, বেল, রিঠা, রতনগুড়, শিশু, শিরীষ (সাদা ও কালো), খয়ের, ফলসা, গামার, বরুণ, নাটা করঞ্জ, অমলতাস বা ধনরাজ, আর কেঁন্দ বা কেন্দু পাতার গাছ। এমন সময় বাঁদিকের বাঁশ ঝোপটা দুলছে মনে হলো। জীপ দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। এখানে প্রচুর বাঁশ ঝাড় আছে। সকলেই এবার দেখতে পেলাম তাদের! একপাল হাতি। পালে তিন চারটে শিশু হাতিও আছে। বাঁদিকের কালো কালো টিলা পাহাড় থেকে দলে দলে নেমে আসছে তারা। জীপের চালক জীপের স্টার্ট বন্ধ করেনি, এই শব্দে হাতি আমাদের কাছে আসবে না। হাতিদের আকার যে কী দারুণ হৃষ্টপুষ্ট, না দেখলে বোঝা যাবে না। শহরের সার্কাসের তাবুতে দেখা ঝোলা চামড়ার, রোগা হাতি নয় এরা। এদের চলাফেরা স্বাধীন এখানে, তারা মড়মড় শব্দে বাঁশের ডাল ভাঙছে। মা হাতি নির্ভয়ে খাইয়ে দিচ্ছে তার বাচ্চাকে। দেখে দেখে বিস্ময় কাটতে চায় না। এরপর জীপ এগোতেই একটা ঘাসের জমিতে বাইসন দেখলাম। মুঞ্জ ঘাসে ভরা চারণভূমির মতো এখানে অরণ্যের রূপ। সেখানে গাড়ির চলার রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে ঘাস খেতে ব্যস্ত বাইসনদের প্রমিলাবাহিনী। ফেরার পথে দেখলাম গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে একঝাঁক সবুজ টিয়া!

আমাদের জীপ সাফারী শেষ প্রায়। একটা পাথরের শুকনো চৌবাচ্চার কাছে এসে থামলো জীপ। এর মাথায় পাথরের ঢাকা লাগানো। সেই ঢাকা সরিয়ে আমাদের নীচে নামার সিঁড়িও দেখালো গাইড। তার পাশেই একটা ছোট জলধারা। আমাদের চৌবাচ্চার সামনে নিয়ে এল আনসারী। চৌবাচ্চার নিচে কয়েকটি চৌকো গর্ত করা। ইংরেজরা এই পাথরের চৌবাচ্চার ভেতর নেমে, গর্ততে চোখ রেখে, নিশানা ঠিক করে গুলি করে বাঘ আর হরিণ শিকার করতো। এতে নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে শিকার চলতো। আমি যেন মানস চোখে দেখতে পেলাম, আবছা আলোয় গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ছে অসহায় জলপানরত হরিণ। নিজেকে সম্পূর্ণ লুকিয়ে শিকারের এই কৌশলে এতটুকু বীরত্ব নেই।

এবার আমরা ফিরে চলেছি। জীপ এখন উল্টো পথে চলেছে। মনে মনে বললাম বিদায় অরণ্য, তোমার সকালের রূপ দেখলাম, বিকেলে আবার আসবো! এবার এখানকার অরণ্যের কিছু গাছের একটু পরিচয় দেব। পাঠক এই অংশ ভালোলাগলে পড়বেন, নাহলে অবশ্যই এড়িয়ে যেতে পারেন।

সিধা- সিধা গাছের অপর নাম হলো জারুল। কলকাতার রাস্তার পাশেও এই গাছ যথেষ্ট দেখা যায়। বনের গাছের মতো শহরে অত বড় না হলেও যথেষ্ট বড় বৃক্ষ। শীতের শেষে, বা বসন্তে গাছে অপূর্ব সুন্দর বেগুনি রঙের গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল ফোটে। ফল শুকনো অবস্থায় ড্রাই ফ্লাওয়ার হিসেবে হস্তশিল্প মেলায় বিক্রি হয়। এর বিজ্ঞান সম্মত নাম হলো Lagerostroemia parviflora ভিয়েতনামে এই গাছের কচিপাতা সব্জি হিসেবে খাওয়া হয়। ফিলিপাইনে এই গাছের বেশি মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ থাকায় সেখানকার স্বাস্থ্য দফতর গাছটির ব্যাপক প্রচার করেছে। ফিলিপাইন, জাপান এবং তাইওয়ানে কচি জারুল পাতা দিয়ে সবুজ চা বানিয়ে খাওয়া হয়। বৌদ্ধধর্মেও এই গাছকে পরম পবিত্র মানা হয়, কারণ এই বৃক্ষের নীচে দ্বাদশ বোধিসত্বের অবতার সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, শ্রীলঙ্কায় এইজন্য এই গাছকে শুভ বলা হয়।

চিলবিল-  এটি একটি সুবিশাল বৃক্ষ। টানটান ঋজু এর কাণ্ড। আমরা এই গাছের ফল দেখতে পেয়েছি। পাতা গাঢ় সবুজ এবং লেদারি, ফল পাতলা এবং আকারে দেখতে অবিকল পাতার মতোই চ্যাপ্টা এবং ফিকে সবুজ রঙের, গায়ে পাতার মতো শিরা বিন্যাসও আছে। এই গাছের বিজ্ঞান সম্মত নাম হলো, Holoplelea intigrifolia এই গাছ একটি পর্ণমোচী বৃক্ষ। প্রায় আঠেরো মিটার উচ্চতার হয় এই সুবিশাল গাছ। এর কাণ্ডের ছাল থেকে বাতজ বেদনার ওষুধ তৈরি হয়। কাণ্ড এবং পাতা থেকে কুষ্ঠ, মধুমেহ, শোথ, পেটের গোলযোগের ওষুধ তৈরি হয়। বীজচূর্ণ গোলকৃমির চিকিৎসায় খাওয়া হয়। এই গাছের বিভিন্ন অংশ বহুদিন ধরে সাঁওতাল ও আদিবাসীরা তাদের রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করে আসছে।

মহুয়া- এই গাছ আদিবাসীদের কাছে প্রধান অর্থকরী একটি বৃক্ষ। এ যেন তাদের প্রতি প্রকৃতিদেবীর এক পরম আশীর্বাদ। এর ফুল শুকিয়ে চিনির পরিবর্তে খাওয়া হয়, কারণ ফল অতিরিক্ত মাত্রায় মিষ্টি স্বাদের। বীজের তেল থেকে সাবান, ডিটারজেন্ট ভেজিটেবিল অয়েল, বনস্পতি প্রভৃতি তৈরি করা হয়। এছাড়া তেল থেকে জ্বালানিও তৈরি হয়। মহুয়াখোল তেল নিস্কাশনের পরে জমির সার হিসেবে ব্যবহার হয়। মহুয়ার পাতা খেয়ে তসর মথ গুটি তৈরি করে, এবং তসর সুতো তৈরি হয়, এই পাতায় তসর মথ পালন করা হয়, যা আদিবাসীদের লাভের পথ দেখায়। একটি পূর্ণ বয়স্ক মহুয়া গাছ থেকে কুড়ি থেকে দুশো কেজি পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। শুকনো ফল একটি বল বর্ধক খাদ্য এবং অপুষ্টি দূর করে। আমরা এইসময় পাকা মহুয়া দেখতে পাইনি, কারণ এটিও বসন্তকালে পাওয়া যায়। এই ফল মধ্যপ্রদেশের কানহা ফরেস্টে যাওয়ার সময় প্রচুর পাওয়া গেছিল। তখন দেখেছি, এর ফল মাটিতে ঝরে পড়ে এবং গাছের তলায় বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে। সবুজাভ হলুদ এই ফলের সসসসসবেদার মতো এক ধরণের উগ্র গন্ধ আছে। এর বিজ্ঞান সম্মত নাম হলো Madhuca latifolia

কেওঞ্জ-  এটি একটি অদ্ভুত দেখতে গাছ। বৃক্ষ জাতীয় এই গাছটির পাতা ঝরে যায়, অর্থাৎ পর্ণমোচী। এর কাণ্ডের ছালে অসংখ্য খাঁজ, ভাঁজ ও গর্ত থাকে। আগার ডাল খুবই সরু আকৃতির। পত্রশূন্য এই গাছের অদ্ভুত আকৃতির জন্য মারাঠিতে এই গাছকে বলে ভূত্যা অর্থাৎ ঘোস্ট ট্রি। পত্র শূন্য এই গাছ অনেকটা আফ্রিকার বাওবাব গাছের মতো দেখতে, তবে আকৃতিতে কিছুটা ছোট। ভারতবর্ষে বাওবাব দেখেছিলাম, মধ্যপ্রদেশের মাণ্ডুতে বেড়াতে গিয়ে। বাওবাবের ফলও ভারী অদ্ভুত দেখতে। সেটা বিক্রি হচ্ছিল মাণ্ডুর লোকাল মার্কেটে। যাইহোক, তা অন্য প্রসঙ্গ। হিন্দিতে অনেকে একে ভূতনী গাছও বলে। এর কাণ্ড থেকে এক ধরণের আঁঠা পাওয়া যায়, যাকে বলা হয় গঁদ। এর বিজ্ঞান সম্মত নাম হলো Sterculia urens ল্যাটিন এই ইউরেন্স কথাটি ব্যবহার হয়েছে, কারণ এর ফুলের গায়ে এক ধরণের বিষাক্ত হুল থাকে। ফুল গোলাপি এবং এর উপরটা লাল রঙের হুল জাতীয় রোমে ভরা থাকে। ফল ভেঙে বীজ মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। ফল বাদামী, বীজের রঙ কালো।

এই গাছের আঁঠা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। আঁঠা কাণ্ডের ছালে আঘাত লাগলে বের হয়। এই আঁঠা বের করার জন্য এই গাছকে যথেচ্ছ আঘাত করা হলে, সংক্রমণের কারণে অকালে গাছের মৃত্যু হয়। তবে অবাণিজ্যিক এই পদ্ধতি ছাড়া, যদি সাবধানতার সঙ্গে গাছ থেকে অল্প অল্প করে আঁঠা বের করা হয়, তাহলে গাছ থেকে অনেকটা পরিমাণে আঁঠা পাওয়া যেতে পারে এবং গাছও বেঁচে থাকে। এই আঁঠা জল পেলে ফুলে ওঠে, তাই এটি একটি ল্যাক্সেটিভ হিসেবেও ব্যবহার হয়, এছাড়া প্রসাধনী শিল্পে ও ওষুধ তৈরিতে এই আঁঠার প্রচুর চাহিদা আছে। এছাড়া রঙ তৈরিতে, দ্রবণ হিসেবে এবং বাইন্ডার হিসেবে গঁদ ব্যবহার করা হয়। বীজকে বালিতে ভেজে বাদামের মতো খাওয়া হয়।

কাঠহুল- এই গাছ আমাদের বাগানের পরিচিত কাঞ্চন গাছের প্রজাতির। বেতলার জঙ্গলে এর অপূর্ব ফুল মুগ্ধ করেছিল। যেন সমস্ত বন এর হলদেটে সাদা ফুলে আলো হয়ে আছে। পাতা অনেকটা কাঞ্চন পাতারই মতো, তবে মাঝখানের খাঁজ কিছুটা কম। বিরাট আকৃতির বৃক্ষ। এর বিজ্ঞান সম্মত নাম হলো Bauhinia retusa পরে নেতারহাট যাওয়ার পথে দেখেছি, বেগুনি রঙের কাঞ্চন ফুলের বিশাল বিশাল গাছ, অপূর্ব রঙিন ফুলে ভরে আছে। তার বিজ্ঞান সম্মত নাম হলো বাউহিনিয়া পারপিউরিয়া। এর পাতাও কাঠহুলের পাতার মতোই দেখতে।

করম- এই গাছ চিনিয়ে দিল, আমাদের ফরেস্ট গাইড। এই গাছ একটি অত্যন্ত বিখ্যাত গাছ, কারণ এই গাছ আদিবাসীদের করম পরবের জন্য সর্বত্র প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই গাছকে নিয়ে আছে বহু উপকথা ও গল্প। এই করম পরব পালন করে ভারতবর্ষের বহু উপজাতির মানুষ। যেমন কোর্থা, ছত্রিশগড়ি, বাঘেলি, নাগপুরী, কুরমালি, সম্বলপুরী, ওঁরাও, মুণ্ডা, খারিয়া, এবং সাঁওতালি জনজাতির মানুষ। এই উৎসব পালিত হয়, যখন ফসল পাকে। অর্থাৎ করম পরব একটি সমৃদ্ধির উৎসব। এই উৎসব পালন করা হয় ভাদ্রমাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে (ভাদো একাদশী)। পুজোর দিন ঢাক ঢোল বাজিয়ে পবিত্র করম গাছের ফুল ও ফলসহ ডাল ভেঙে আনা হয় এবং তা আনে গ্রামের কোনও কুমারী মেয়ে। তারপর তা একটি মাটির বেদী গোবর দিয়ে নিকিয়ে পরিস্কার করে, সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

করম পরবের উপকথায় আছে একবার এক গ্রামে সাত ভাই থাকতো। তাদের শরীর ছিল খুব শক্তিশালী। কোনও রোগ বালাই ছিল না তাদের। তারা বন্ধ্যা মাটি গায়ের জোরে কুপিয়ে তাতে প্রচুর ফসল ফলাতো। তাদের বউয়েরাও ছিল ভারী লক্ষ্মী। তারা ঘরের সব কাজ মন দিয়ে করতো এবং রোজ মাঠ থেকে তাদের মরদেরা ঘরে ফিরে এলে, তারা তাদের সামনে নানা রকমের খাবার সাজিয়ে দিত। একদিন বনে কাঠ কাটতে গিয়ে বউয়েরা দেখলো, এক কুমারী অপূর্ব সুন্দর কন্যা। তার সারা গায়ে অনেক গয়না। সে তাদের সামনে থেকে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। সাত বউ এদিকে খোঁজে ও দিকে খোঁজে, কোথাও আর দেখতে পেল না সেই মেয়েকে। তারপর তারা বাড়ি ফিরে এল। বাড়িতে ফিরে তারা রান্নার কাঠ কাটতে উঠোনের সামনে করম গাছে যেই কোপ মারতে গেছে, ওমনি কোথা থেকে সেই মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। করম গাছকে দেখিয়ে তাদের বললো, এই গাছকে পুজো করবে, তাহলেই তোমরা সকলে ভালো থাকবে। কোনও জিনিসের আর অভাব হবে না। তারপর মেয়েটা আবার করম গাছের ভেতরে মিলিয়ে গেল। কী আশ্চর্য ঘটনা! বড় বউ সবাইকে ডেকে বললো, আয়, সবাই মিলে এই আনন্দে আমরা নাচি গাই। আমাদের করম দেবীর আশীর্বাদে আর কোনও দুঃখ হবে না। কেবল এই গাছকে রক্ষা করতে হবে। ভালোবাসতে হবে।

তারপর তারা সাতজন গাছের চারদিকে ঢোল বাজিয়ে গান করতে আর নাচতে লাগলো সারাদিন ধরে। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেল, রান্না করতেই সকলে ভুলে গেল। সাত ভাই বাড়িতে ফিরে এলো। এসে দেখলো, হাঁড়িতে ভাত নেই। কোথাও এতটুকু খাবার রাখেনি কেউ। সাত বউ কেবল একটা গাছ ঘিরে আনন্দে নাচছে। রাগে গাছটা কুড়ুল দিয়ে কেটে ফেললো তারা। বউয়েরা হায় হায় করতে লাগলো। তারপর? তারপর নেমে এল দেবীর অভিশাপ। তাদের জমির সব ফসল রোগ ধরে শেষ হয়ে গেল। ভাইয়ে ভাইয়ে শুরু হলো শত্রুতা আর বিবাদ। অভাবের তাড়নায় ঘরের বাসন পর্যন্ত বিক্রি হয়ে গেল। তাদের সন্তানগুলো না খেয়ে কেঁদে কেঁদে ফিরতে লাগলো। তখন সব বউয়েরা বললো, চলো বোন, আমরা করমদেবীকে আবার প্রতিষ্ঠা করি এসো। তাহলেই আমাদের দুঃখ ঘুচবে। সাত বউ বনের মধ্যে নদীর কাছে খুঁজতে খুঁজতে পেল সেই করমের গাছ। তখন তারা আনন্দে নাচতে নাচতে সেই গাছের ডাল এনে উঠোনে যত্ন করে লাগালো। সেই গাছে জল দিতে লাগলো নিষ্ঠাভরে। দেবীর কৃপায় করম গাছ যেমন যেমন বড় হতে লাগলো, তাদের দুঃখও তেমন কমতে লাগলো। স্বামীরা কঠোর পরিশ্রমে আবার ক্ষেতভরা ফসল ফিরে পেল। আবার তাদের সংসারে শান্তি ফিরে এল। করমগাছে ফুল এল। দেবীর কৃপায় তাদেরও ঘরভর্তি ছেলে মেয়ে হলো। তারা সকলে তারপর করম দেবীর কৃপায় সুখে শান্তিতে থাকতে লাগলো।

করম গাছ হলো সুখ ও সমৃদ্ধির প্রতীক এবং বোন ও ভাইদের সুসম্পর্কের প্রতীক। এই গাছ সাঁওতাল পরিবারের অসুখে বদ্যির কাজ করে। কুসুম ফলের রস যেমন সাঁওতাল রমনীর বুকের দুধ বাড়ায়, করমের পাতাও সেই কাজ করে। এ ছাড়া ছাল থেকে জন্ডিসের ওষুধ হয়, কৃমি দূর করে। কাঠ জ্বলানী হিসেবে কাজে লাগে। সাঁওতালী মেয়েরা পুজোর দিনে সকালে উপোস করে করমের ডাল ভেঙে আনে। তারপর মেয়েরা পরস্পরকে বন্ধুত্বের প্রতীক স্বরূপ ওইদিনে একটা করে জবাফুল দেয়। করম পরব এই সকল উপজাতিদের অন্তরের উৎসব। করমগাছের বিজ্ঞান সম্মত নাম হলো Adina cordifolia এর ফুল অনেকটা কদমফুলের মতো দেখতে হয়। তবে ফিকে হলুদ রঙের এই ফুল কদম ফুলের থেকে অনেক ছোট আকারের হয়।

বেশি গাছের কথা লিখে এই লেখা আর ভারী করবো না। কেবল দুটে গাছের কথা না বলে থাকতে পারছি না। প্রথমটির নাম করঞ্জ। খুবই পরিচিত গাছ। কলকাতা এয়ারপোর্টের গেটের কাছে ছাতিম গাছের পাশেও এই গাছ একটা আছে দেখেছি। এর ফুলের রঙ সাদা আর বেগুনি মিলিয়ে। এমন চমৎকার ফুল খুব কম দেখেছি। ফুল ফুটলে সমস্ত গাছটা মনে হয় হাসছে। এর ফুল ফোটে এপ্রিলে। মে মাসের দিকে ফল হয়। এই করঞ্জের বীজের তেল এখন বায়োডিজেল হিসেবে ব্যবহার হয়। পাতলা বীজের ভেতর শাঁসের অংশই বেশি। এই গাছের জন্য কোনও যত্ন প্রয়োজন হয় না। অনুর্বর বন্ধ্যা মাটিতে এ গাছ দিব্যি তরতরিয়ে বাড়ে। ফল থেকে করঞ্জের তেল বা কড়ুয়া তেল পাওয়া যায়। আগে এই তেলের প্রদীপ জ্বালানো হতো। এখন বন সৃজনেও এই গাছ ব্যবহার করা হচ্ছে। এর তেল পারগেটিভ হিসেবে ওষুধে ব্যবহার হয়। এই গাছের পাতা তেলতেল আর পাতলা। কাচা পাতা ফিকে সবুজ রঙের। পর্ণমোচী বৃক্ষ। তবে উচ্চতায় খুব বড় গাছ নয়। বিজ্ঞানসম্মত নাম হলো Pongamia glabra

দ্বিতীয় গাছটি কেন্দু। এর পাতা দিয়ে বিড়ি তৈরি হয়। বিড়ি তৈরির জন্য কেন্দু গাছের নতুন বের হওয়া পাতা ব্যবহার করা হয়। কেন্দুগাছ একটি বিশাল বৃক্ষ জাতীয় গাছ। এর পাকা ফল স্নিগ্ধ ও রুচিকর। স্বাদ টক-মিষ্টি। কচি পাতা ফিকে সবুজ, উজ্জ্বল এবং কিনারা গোলটে। গাছের কাঠ থেকে আসবাব তৈরি হয়। কাঠ লালচে ধরণের এবং খুব টেকসই। পাতায় ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। ছাল থেকে ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট দমনকারী ফাইটোক্যামিক্যাল পাওয়া যায়। বিজ্ঞানসম্মত নাম Diospyros melanoxylon.

আর একটি গাছ আমি চিনতে পারিনি। শুনলাম এই গাছটির বীজ নাকি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা হয়েছে। স্থানীয় মানুষ এর নাম বলেছে চৌকণ্ডী। খুব আনন্দ সহকারে গাইড আমাদের বললো, এমন ভালো জ্বালানি আর হয় না! এই গাছের হলুদ ফুল বেশ মুগ্ধ করেছে। পাতা অনেকটা শিরীষ পাতার মতো। কালচে সবুজ রঙের পাতা এবং ফুল বাসন্তী হলুদ। ফুল গুচ্ছাকারে ফুটে গাছ একেবারে ভরিয়ে দেয়। প্রথমে এই অপূর্ব ফুল দেখেই প্রশ্ন করেছিলাম, 'এটা কী গাছ?' এই গাছের কাঠ কাচা অবস্থায়ও ভালো জ্বালানি, কারণ এর কাঠে একধরণের তৈলাক্ত পদার্থ থাকে। ভয় হলো জ্বালানির লোভে এই বিদেশি গাছের মনোকালচার শুরু হলে, আমাদের স্থানীয় বনের অপূর্ব সব গাছের প্রজাতি ও জীব বৈচিত্র না হারিয়ে যায়!

আরও অনেক গাছের গল্প করতে মন চাইলেও, একঘেয়ে হয়ে যাওয়ার ভয়ে আর লিখছি না। আমার এই লেখা কি আদৌ কোনও ভ্রমণ কাহিনী হয়েছে? এ সংশয় আমার প্রবলভাবে আছে। কারণ একজন এমন মানুষ এই লেখা লিখছে, যে রাস্তায় বের হলে কেবল আগাছা আর গাছের দিকেই মনোযোগী হয়ে তাকিয়ে থাকে, অন্য কিছু দেখে না। পাঠক পড়তে গিয়ে ধৈর্যচ্যুত হলে নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন। সাফারীর পর সকালের জলখাবার খেলাম বেতলা বনবাংলোর রেস্টুরেন্টে। ছোট ছোট বাঁদর ও চেরীদের উৎপাত খুব এখানে। তারা এতটুকু সুযোগ পেলেই ট্যুরিস্টেদের পাত থেকে খাবার নিয়ে চোখের নিমেষে পালাচ্ছে। খাওয়া শেষ হওয়ার পর একজন গাইড নিয়ে আমরা পালামৌ ফোর্ট দেখতে গেলাম। এই দুর্গ বেতলার বাফার অঞ্চলের মধ্যেই পড়ে। দুর্গের দুটি অংশ। একটি পাহাড়ের একেবারে চূঁড়ায় অপরটি সমতলে জঙ্গলের মধ্যে।

দুর্গদুটি একটি মেদিনী রায়ের এবং অপরটি তার ছেলে প্রতাপ রায়ের। এই পাহাড় ও জঙ্গলের আদিবাসী উপজাতিদের রাজা ছিলেন তারা। দীর্ঘ রাজত্বকালের শেষে আওরঙজেবের সুবেদার দাউদ খান বাংলা দখল করতে আসেন। তখন এই অঞ্চল সহ উড়িষ্যাও বাংলার অন্তর্গত ছিল। যুদ্ধে জঙ্গলমহালের রাজার মৃত্যু হয়। দাউদ খান দুর্গ দখল করে, সেখানে দুর্গের এক অংশ ভেঙে তাতে মসজিদ নির্মাণ করেন। দুর্গের ভেতর ঢোকার প্রাচীন তোরণখানা এখনও আছে। চারিদিকে জঙ্গল ও বুনো ছোপে ছেয়ে আছে। পরাজিত সেই মৃত রাজার জন্য অদ্ভুত এক ধরণের কষ্ট হলো মনে। দুর্গের সামনে থেকেই শুরু হয়ে গেছে মসজিদ। এই দুর্গ এখন পরিত্যক্ত। ঝাড়খণ্ড পর্যটন এই দুর্গের সংস্কার করলে একটি হেরিটেজ স্পট হতে পারে। পাহাড়ের উপর প্রতাপ রায়ের দুর্গ বেশ ভালো অবস্থায় আছে, তবে পথ কিছুটা দুর্গম। 

দুর্গের পরিখার ভেতর ঢুকে পড়লাম। দেখার কিছুই নেই, সবই ভগ্ন দশায় আছে। এবড়ো খেবড়ো পাহাড়ি পথের পাশ দিয়ে গাড়ি চলাচলের পিচ রাস্তা চলে গেছে, তবুও অরণ্য এখান থেকে একেবারে সরে যায়নি। চারিদিকে ঘন ঝোপ, লতা আর বড় বড় গাছ সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে। দুর্গের ভেতর ঢোকার জন্য কয়েকটা ইঁট আর পাথরের সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা এগিয়ে যেতেই বিরাট জোরে একটা জান্তব গর্জন শুনলাম। আমরা কয়েকজন জোর করে দুর্গের ভেতর ঢুকেছি। গাইড আমাদের নিরুৎসাহ করলেও, তার কথা শুনিনি। কিন্তু, হঠাৎ ও কীসের গর্জন? সত্যি বলছি একটু যেন ভয়ই পেয়েছিলাম। পরক্ষণেই মাহুতকে দেখতে পেলাম, তার সঙ্গে এক সুবিশাল দাঁতাল হাতি। হাতিটিই অচেনা মানুষের গায়ের গন্ধ পেয়ে, গর্জন করেছিল, যাকে বলে একেবারে বৃংহন! ওখান থেকে রাজবাড়ির কমলদহ তালাও দেখতে গেলাম। এত সুন্দর ঝিল এখানে যে আছে, কল্পনাই করিনি। এত সাদা পদ্মও কোনওদিন একসঙ্গে কোথাও ফুটে থাকতে দেখিনি। একসঙ্গে প্রায় একহাজার পদ্ম বা তার বেশি ফুল ফুটে আছে এখানে। উদার নীল আকাশের তলায় চারিদিকে বড় বড় গাছ, আর তার একপাশে পদ্মবিল। এই তালাও এ নাকি রাণিরা আগে স্নান করতে আসতেন। এই অঞ্চলের মানুষে কেউ পদ্মফুল তোলে না, শুধু পদ্মফল বা চাক তুলে নিয়ে গিয়ে খায়। পাহাড়ের উপর এমন একটা জলপূর্ণ অপূর্ব দহ আছে, এখানে না এলে কল্পনাও করতে পারতাম না।

আমরা বাঙালি। আজকের দিনটা দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী। ভাবছিলাম কলকাতায় এখন পদ্মের বড় আকাল। দেবীর পূজায় মানুষ পদ্ম নিবেদন করে। ভাবছিলাম এই ফুলও তো সেই মহান দেবতার উদ্দেশ্যে, তাঁর নির্দেশেই ফুটেছে। নাহলে এত রূপ এরা পেল কোথা থেকে! নাই বা হলো পুরোহিতের মন্ত্র উচ্চারণ, নাই বা হলো আনুষ্ঠানিকভাবে দেবীর পায়ে নিবেদন, এই বিরাট বিশ্বের অধীশ্বর জগৎপিতার জন্যই তো তাদের এমন অপূর্ব বিকশিত রূপ! সেই শক্তির রূপ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন। কখনও তিনি দুর্গা, কখনও কালী, কখনও বা নারায়ন। বিরাট আকাশের নীচে সেই আদি অনন্ত সর্বময় শক্তির উদ্দেশ্যে সব প্রস্ফুটিত ফুল নিত্য নিবেদিত হচ্ছে। এই বিরাট বিলই যেন এক বিরাট পুষ্পপাত্র, যেখানে তিনি নিজে এই সুন্দর ফুল সাজিয়ে রেখেছেন। মধুগন্ধী বাতাস এসে তাঁকেই ব্যজন করছে, চারিদিকে বড় বড় মহীরুহ সকল তাঁরই স্তবগান করছে, অনাহত নাদে তাঁরই উদ্দেশ্যে ধ্বনিত হচ্ছে শঙ্খ আর ঘন্টা ধ্বনি। এ যেন সৃষ্টির আদি থেকে চলে আসছে, তুচ্ছ মানুষের অস্তিত্ব তখন কোথায়? আর কোথায় বা তার পূজার পদ্ধতি? পরমপিতার অপরূপ এই জগৎ সৃষ্টি করেই আনন্দ। আপন সৃষ্টিসুখে তিনি আপনি মগ্ন।

এরপর চলেছি, কেচকি ও কোয়েল নদীর সঙ্গম দেখতে। পুরো অঞ্চলটাই বেশ ঘন জঙ্গল। মাঝে মাঝে আদিবাসীদের গ্রাম। এখানে সামনেই একটা হাট বসে, সোম আর বৃহস্পতিবার দিন। কোয়েল আর কেচকির সঙ্গমস্থলে একটা লজ আছে, তবে এখানে বিজলীবাতি না থাকায়, খুব একটা ট্যুরিস্ট এখানে আসে না। নদীর কাছে আছে কিছু বড় বড় গাছ। বালির উপর বড় বড় পাথর পড়ে আছে। স্বচ্ছ জলের পাহাড়ি নদী, তিরতির করে বয়ে চলেছে। জলে বেশ ভালো স্রোতের টান, মনে হলো। পাড়টি যেতে যেতে বেঁকে গেছে ধনুকের মতো, যেন কোনও যুবতী আড়মোড়া ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে। জলের গভীরতা এখানে বেশি নয়। দু'একজন দেহাতি নদী পারাপার করছে। এলোমেলো ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেল। নদীর ধারে ছায়া দিচ্ছে বড় বড় অর্জুন, ছাতিম আর কালোজামের গাছ। জায়গাটা এত সুন্দর, দেখে মনে হয় আর কোথাও না গিয়ে, এখানেই সারাটাদিন কাটিয়ে দিলে মন্দ হয় না!

বেশ কিছু ট্যুরিস্ট দেখলাম পিকনিকের মেজাজে নদীর ধারে বসে খাওয়াদাওয়া সারছে। আমরা ওখান থেকে তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়লাম, কারণ আরও কয়েকটা জায়গায় যেতে হবে এবং ফিরে দুপুরের খাওয়াদাওয়াও করতে হবে। অবশ্য দুপুরে ফিরতে যদি দেরি হয়, তাতেও কারুর আপত্তি নেই, যতটুকু এই জায়গাটাকে এক্সপ্লোর করা যায়, ততই ভালো, তাছাড়া হাতে সময়ও অল্প।

খানিকটা দূরে আছে একটা উষ্ণ জলের কুণ্ড। রাস্তা বেশ খারাপ, এবং চারিদিকে ঘন জঙ্গল। আমরা খানিকদূর পর্যন্ত গাড়িতে যেতে পারলাম। জলের কুণ্ডের নাম তথাগত। ঘনবনের ভেতর একটা জলধারা, তার উপর থেকে বাষ্পের মতো সাদা ধোয়া উঠছে ক্রমাগত। এর নামই তপ্তপানি কুণ্ড। দুপুর গড়িয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ফিরে চললাম, কারণ বিকেলে আরও একবার অরণ্যে ঘুরে বেড়াতে চাই। আমার ইচ্ছেতে আমার সঙ্গীরা কেউ বাধা দেয় না। এরা সবাই নীরবে বেশ আমাকে সমর্থন করে, কারণ এরা এতদিনে আমার আগ্রহের আতিশয্যে খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

আজকের পর হাতে আর একটা দিন। সকালটা নেতারহাটে ঘুরে বিকেলে রাঁচি ফিরে যাব। রাঁচি শহরের উপর একটি হোটেলে রাতটুকু কাটিয়ে, পরেরদিন কলকাতায় ফেরার কথা। সেই মতো ফেরার বিমানের টিকিটও করা হয়েছে। বেতলা ছেড়ে যাওয়ার আগে তাই আরও একবার বনের ভেতর ঢুকে ঘুরে ফিরে নিতে চাই। এবার আমাদের গাড়িতেই বিকেলে জঙ্গল সাফারী করছি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে কি অরণ্যের আনন্দ পাওয়া যায়? আমি এসি বন্ধ করে দিতে বলি, নামিয়ে দেওয়া হলো জানলার কাচ। অপূর্ব ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে! ঘড়িতে চারটে বাজে। রোদের আভাসটুকু বুঝতে পারছি, কিন্তু তার তাপ হরণ করেছে বনচ্ছায়া। বড় সুন্দর বিকেলের মুহূর্ত! বড় বড় গাছের মাথা বিকেলের হলুদ আলো মেখে কেমন মায়াময় সুন্দর হয়ে উঠেছে।

বনের একধারে কালো কালো বহু পাথর যেন কেউ সাজিয়ে রেখেছে। আমার আরণ্যকের দোবরু পান্নার কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল ভানুমতীর কথা। সেই অরণ্যের সর্বহারা প্রাচীন রাজা দোবরু পান্না, আর তার আত্মীয়া ভানুমতী। অবিকল আরণ্যকে যেমন পড়েছিলাম, তেমনভাবে বড় বড় গাছের নীচে মিশমিশে কালো রঙের পাথর ছড়িয়ে আছে। তার কোনওটা গোলটে, কোনওটা আবার লম্বা। যেন কোনও আদিম উপজাতিদের সমাধিক্ষেত্র। আসলে বনের মধ্যে পাহাড় থেকে বর্ষার জলের তোড়ে পাথরগুলো নেমে এসেছে। তারপর গাছের শেকড়ের সঙ্গে জড়িয়ে ওই জায়গায় স্থায়ী হয়ে গেছে। বায়ুর চলাচলে ক্ষয় হয়ে গিয়ে নানা আকৃতি নিয়েছে।

একজায়গা দিয়ে গাড়িতে যাওয়ার সময় উৎকট দুর্গন্ধ পেয়ে চমকে তাকিয়ে দেখি, বিরাট বিরাট দুটি জংলি বাদামের গাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। এদের ফুল খুব ছোট আর লাল রঙের। গাছের দিকে তাকিয়ে দেখলাম গাছে প্রচুর ফুল এবং ফল দুটিই আছে। গাছের তলা ঝরে পড়া ফুলে ভরে আছে। এই দুর্গন্ধের কারণ হলো এই গাছের ফুল, এখান থেকেই এই দুর্গন্ধ আসছে। জংলি বাদাম গাছের ফুলে অবিকল বিষ্ঠার মতো গন্ধ হয়। গন্ধটা অনেকটা গাঁদাল পাতার মতো বিশ্রী। তাই এই গাছের নাম হলো স্টারকিউলিয়া ফোটিডা। এই ফোটিডা কথাটি ল্যাটিন শব্দ, এর অর্থ হলো বিষ্ঠার দুর্গন্ধ। ফোটিডা কথাটিও সেই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ এই গাছের ফল অপূর্ব সুস্বাদু। কাচা ফল লাল রঙের। আকারে বেশ বড়, অনেকটা উল্টানো বাটির মতো দেখতে। ফল পাকলে ধূসর কালো রঙের হয়। ফল বিদারী প্রকৃতির, পাকলে গোটা ফল থেকে বীজ ছড়িয়ে মাটিতে পড়ে। ভেতরের বীজটি ভেজে বা কাচা খাওয়া হয়।

বড় বড় গাছের কোটরে পাখিরা ফিরে আসছে, ক্রমে ধূসর গোধূলি নেমে এল অরণ্যের বুকে। কতরকম যে পাখি দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। টিয়া তো ঝাঁকে ঝাঁকে আছে, এছাড়া বেনেবউ, বক, ছাতারে, পাহাড়ি ঘুঘু, ধনেশ---- মন ভরে উঠলো। এরা সবাই একই দিকে উড়ে চলেছে। সবাই সূর্যের দিকে অর্থাৎ পশ্চিমে চলেছে। পাখিরা মনে হয়, সূর্যের দিকেই সকালে উড়ে যায় এবং সূর্যের অস্ত যাওয়ার সময় একই ভাবে সূর্যের চলার দিকে অর্থাৎ পশ্চিমদিকে ফিরে আসে। বনের মধ্যে অনেক দেহাতি মানুষ দেখলাম। তারা সবাই ঘাস কাটতে এসেছে দলে দলে। রাশি রাশি ঘাস ও বুনো ঝোপ কেটে বনের বিভিন্ন জায়গায় স্তুপ করে রেখেছে তারা। 'আজ এত মানুষের ভীড়ে জন্তু জানোয়ার সব পালিয়েছে', ড্রাইভার বললো।

তবুও থাকি কিছুটা সময়, এই আলো নিভে আসা বনের পথে----- ফেরার সময় আমাদের জন্য বিস্ময় সাজিয়ে রেখেছিলেন বনদেবী। একটা সবুজ ঘাসে ভরা জমিতে চারটে শিয়াল জাতীয় প্রাণী দেখলাম। তারা কিন্তু শিয়ালের মতো ভীরু নয়, আমাদের গাড়ি দেখেও ওখান থেকে চলে গেল না। বরং দিব্যি  দাঁড়িয়ে থাকলো। আমরা সেই খানিকটা কুকুরের মতো দেখতে প্রাণীগুলোর ছবি তুললাম। যখন গেটের বাইরে এলাম ঘড়িতে ছটা। ফরেস্ট গার্ড আমাদের মোবাইলের ছবি দেখে বললেন, আরে! এ তো অবাক কাণ্ড! এ তো নেকড়ে! বাঘ তবুও দেখা যায়! নেকড়ে দেখা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার! আপনারা ভাগ্যবান। এ কিন্তু শেয়াল নয়। তারপর সে জনে জনে ডেকে সবাইকে আমাদের নেকড়ে দেখার গল্প করতে লাগলো। বনের বুকে ধীরে ধীরে রাত নেমে এল। আজই বেতলায় শেষ রাত আমাদের। অন্ধকার নামতেই ঠাণ্ডা লাগছে বেশ। আমরা একটু উষ্ণতার খোঁজে ফরেস্টে ঢোকার গেটের উল্টোঅদিকের চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে উষ্ণ চায়ে গলা ভেজালাম। কাল সপ্তমী। কালকের দিনটা নেতারহাট আর আগামী রাতটা রাঁচিতে কাটিয়ে অষ্টমীর দিন দুপুরেই আমরা আবার কলকাতায়। পুজোর কলকাতার একটা অনবদ্য আকর্ষণ আছে।

খুব সকালেই যাত্রা শুরু হলো আমাদের। চলেছি নেতারহাট। দূরত্ব এখান থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার। যে পথে এসেছিলাম সেদিকেই চললাম সোজা রাস্তায় জঙ্গলের বাফার এরিয়া ধরে। কোথাও পাতলা কোথাও বা ঘন জঙ্গল। অপূর্ব এক পথ। নেতারহাট পৌঁছাতে ইচ্ছাই করছে না। মন বলছে এই পথ যদি না শেষ হয়! কেবল চলা, চলা আর চলা। পথের দুধারে বড় বড় গাছ তাদের মাথাগুলো পরস্পর জুড়ে তৈরি করেছে বনবীথি। মাঝখানে কালো ফিতের মতো পিচ রাস্তা আর তাতে পাহাড়ি ভূমির জন্য সামান্য ঢেউ খেলানো। কোথাও বন্য কাঞ্চন লতায় ফুল ধরেছে। এটাও বাউহিনিয়ার একটা জাত। তার ডালগুলো কাছির দড়ির মতো মোটা আর পাকানো। কোথাও পুষ্পিত কাঠহুল, কোথাও বা বন্য অ্যারারুটের গাছ, তাতে লম্বা লম্বা লালচে বাদামী রঙের পাকা ফল দুলছে। এই ফলের বীজ গুড়ো করেও একধরণের চিটচিটে শর্করা পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে পাকা ফসলের ক্ষেত। গরীব লোকের খোলার চালের বাড়ি। উলঙ্গ শিশুর দল। হনুমান মন্দির, পাথরের বাধানো পাতকুয়ো থেকে জল তুলছে কোনও আদিবাসী মেয়ে। হাতে তার একরাশ চুড়ি, গায়ের রঙ ময়লা। এ এক অন্যরকম ভারতবর্ষ। এখানে উচ্চবিত্ত স্মার্টফোন হাতে ঘোরা তরুণ তরুণীরা বড় বেমানান। মহুয়া টাঁড় থেকে রাস্তা বায়ে বেঁকে গেল। এবার আমরা নেতারহাটের পথ ধরেছি।

কাছাকাছি একটা দোকানে সামান্য জলখাবার খেয়ে নিলাম আমরা। আটার মোটা মোটা কচুরি, জল মেশানো পানসে তরকারী আর রঙ ছাড়া ফ্যাকাশে রঙের জিলিপি। জিলিপির স্বাদ বেশ ভালো। আমার এমন নিরাভরণ দোকানটির আতিথেয়তা বেশ ভালোলাগলো। কাচা শালপাতায় খাবার দেওয়াহাত ধুতে গেলে হাতে খুশি হয়ে জল ঢেলে দেওয়া, সবকিছুতেই অপটু গ্রাম্যতা আছে, যা মুগ্ধ করে।

নেতারহাটের কাছে ঝাড়খণ্ড ট্যুরিসমের থাকার হোটেলে এসে দুপুরের খাবার অর্ডার করে আমরা বের হলাম চারপাশটা দেখে নিতে। কাছাকাছি আছে নাশপাতি গার্ডেন, নেতারহাট স্কুল, ম্যাগনোলিয়া সানসেট পয়েন্ট, কোয়েল ভিউ পয়েন্ট, তেহর ড্যাম। নাশপাতি গার্ডেন যাওয়ার পথে পড়লো তেহর ড্যাম। কাছাকাছি একটি পাহাড়ি ঝোরা আছে, তার নাম অম্বি ঝোরা। তারপাশে বিস্তৃত মাঠে ধোপারা কাপড় কেচে মেলে দিয়েছে। দু পাশে কেবল ধানক্ষেত আর ধানক্ষেত। বাসস্ট্যান্ডে এক জায়গায় লেখা ছিল 'নেতারহাট দ্য কুইন অফ দি প্লেট্যু।' সত্যিই এই পাহাড়ি ভ্যালি অপরূপ রূপসী। তার রূপ যেন অফুরন্ত। অম্বি ঝোরা বুড়হা নদীর সঙ্গে মিশেছে। সেখানে তৈরি হয়েছে একটি বাঁধ। জঙ্গল ও পাহাড়ের পটভূমিতে জায়গাটা মন ভরায়।

খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পেলাম নাশপাতি বাগান। অনেকটা আপেল গাছের মতো দেখতে গাছগুলিকে। এখানে সারিবদ্ধভাবে নাশপাতির চাষ করা হয়েছে। বর্ষার পর এখন নাশপাতি শেষ। তাই গাছে ফল দেখতে পেলাম না। ফলের সময় চার-পাঁচ টাকা কিলো দরে এখানে নাশপাতি বিক্রি হয়। উজ্জ্বল সবুজ চকচকে পাতার গাছগুলিও বেশ সুন্দর। বাগান দেখে আমরা চলেছি ম্যাগনোলিয়া সানসেট পয়েন্ট দেখতে। এটি বটুয়াটোলা নামের এক জায়গায় অবস্থিত। জায়গাটির নামকরণ হয়েছে এক ব্রিটিশ তরুণীর নাম অনুযায়ী, যার নাম ছিল ম্যাগনোলিয়া। দুপাশে অরণ্যের পটভূমি আর একপাশে পাহাড়ের বুকে গভীর খাদ। খাদের ধারটা বাধানো এবং পাঁচীল দিয়ে ঘেরা। সামনে উন্মুক্ত হাহাকার করা শূন্যতা। দূরে দূরে কেবল দু একটি ঘর বাড়ি চোখে পড়ছে। এই পয়েন্ট থেকে ম্যাগনোলিয়া নামক একজন ব্রিটিশ তরুণী তার পোষ্য ঘোড়া নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। ম্যাগনোলিয়া এই পাহাড় ও উপত্যকার একজন মেষপালক উপজাতিয় ছেলেকে ভালোবেসেছিল। তার প্রেমে সফলতার কোনও আশা নেই দেখে ম্যাগনোলিয়া এই উপত্যকার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার প্রাণত্যাগ করেছিল। এ এক চিরকালের প্রেমের গল্প। এই জায়গায় দাঁড়াতেই, প্রবল বেগে হু হু করে বয়ে চলা বাতাস যেন আমাদের উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। এ যেন ম্যাগনোলিয়ার বিরহী হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস। কোন সুদূর অতীতের এক ভালোবাসার কাহিনী এখনও যেন মনকে ভারী করে তোলে। এখানে ম্যাগনোলিয়া ও বাঁশি বাজানো সেই রাখাল ছেলের একসঙ্গে একটি সুন্দর মূর্তি আছে আর ম্যাগনোলিয়ার সেই ঘোড়াটিরও একটি মূর্তি আছে। মৃত্যুর পর তাদের প্রেম চিরকালের জন্য অমর হয়ে গেছে।

ম্যাগনোলিয়া সানসেট পয়েন্টে সূর্যাস্ত দেখার আর উপায় নেই। নেতারহাট থেকে রাঁচি বহুদূর পথ। আমরা জায়গাটা ভালো লাগলেও আর দেরি না করে চলে এলাম পরবর্তী পয়েন্ট কোয়েল রিভার পয়েন্টে। কোয়েলনদী একটু দূরের একটি গ্রাম টাটুয়াপানি থেকে নেমে এসেছে এইখানে। দুপাশে পাইন বন এবং মাঝখান থেকে বয়ে গেছে, রূপোর মতো স্বচ্ছ নদীটি। একটা নিরালা বিকেল এখানে চুপ করে বসে, অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায়।

এলাম নেতারহাট স্কুলে। এটি ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি বিখ্যাত স্কুল। এখানে এখনও ছাত্ররা শিক্ষক শিক্ষিকাদের শ্রীমানজী ও মাতাজী বলে সম্বোধন করে থাকে। স্কুলটি ছেলেদের। এখানে ক্লাশ সেভেন থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত আছে। ভারতের বহু বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিতলোক এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। স্কুলের সবুজ খেলার মাঠের পাশ থেকে আমরা দেখে এলাম আবাসিক এই বিশাল বিদ্যালয়কে। প্রায় ২১টি ছাত্রাবাস আছে এখানে। পাহাড় জঙ্গল নিয়ে চারপাশের সুন্দর পটভূমিতে স্কুলটি মুগ্ধ করে।

এরপর মধ্যাহ্নভোজের পর আমরা চললাম রাঁচির দিকে। বনের গল্প এখানেই শেষ। এবার শহরের গল্প। সে গল্প অন্য অবসরে করা যাবে।
 
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী



1 টি মন্তব্য: