জীবনের সারস্বত ধ্বনি
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
ইন্দ্রিয়জ অনুভবযোগ্য পরিসর অতিক্রম করে আমাদের চেতনা যখন আমাদের পরিচালিত করে প্রকাশের
উৎসভূমি এবং অস্তিত্বের অনিঃশেষ বিন্দুর
দিকে। সম্প্রসারিত করে আমাদের পুনর্নবায়িত বীক্ষণের
ঐশ্বর্যে। তখনই নিজের চারপাশে
স্পন্দনময় অতীন্দ্রিয় জগতের আভাস প্রতিবিম্বিত হয় সত্তায়। তখনই মনে হয় Turns of our existences
here and now into a simple point on the line of an infinite destiny. কবি রত্নদীপা দে ঘোষের দশম কাব্যগ্রন্থ ‘ মামেকং
শরণম’ পড়তে পড়তে ঠিক
এরকমই এক অনুভব অপার্থিব উন্মাদনায় ঝঙ্কৃত হয়েছে মর্মে। ভগবৎগীতায় শ্রীকৃষ্ণ
অর্জুনকে যে কথাগুলো বলেছেন কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে। বস্তুগত অস্তিত্বের বাইরে প্রগাঢ় এবং
সর্বপ্রসারিত অনুভূতিবিশ্বের দরজা জানলা দোহাট করে খুলে দিয়েছেন। যার ফলে নৈসর্গিক আজানে কল্লোলিত হয়েছে জীবনের সারস্বত
ধ্বনি। সেই
সংশ্লেষনী উপলব্ধির নির্যাসই এই কাব্যগ্রন্থের আশ্রয়। গীতার ১৮ টি
অধ্যায়ের সমস্ত শ্লোক থেকে চিন্তাবীজ সংগ্রহ করে যৌক্তিক পরম্পরায় রত্নদীপা
প্রসারিত করেছেন তাঁর দূরান্বয়ী দৃষ্টি। একান্তের স্পষ্টতায় শুনতে পেয়েছেন সেই ‘অনন্তবীজের ব্রহ্মশাঁখ’ অখণ্ডমণ্ডলাকার দুন্দুভি। অনুরণিত তুমুল প্রতিধ্বনির শব্দে ভিজে গেছে তাঁর
প্রবহমান শব্দপথ- “
শোক আসলে একটি সাদা ঘোড়ার পুরাণ। তোমাকে সংশোধন/ দেবে
না হে। শোককে প্রশ্রয় দিয়ো না …পীতাভ রশ্মির
মতো নিজেকে ছড়িয়ে দাও… গতিপথ বদলে ফিরে এসো …’’
অস্তিত্বের নিরবচ্ছিন্ন রূপান্তরের কথা স্মরণ করিয়েই শোককে প্রত্যাখান করা যায়। চূর্ণ করা যায়
মায়াজগতের যাবতীয় শৃঙ্খলা। নিসর্গলীন বোধের অন্তর্দীপ্ত প্রবাহে এবং
নান্দনিক প্রভায় আলোকিত হয়েছে অন্তহীন অখণ্ড জীবনের বিচ্ছুরণ। দহনের প্রতিটি নীরবতার ধ্বংসকালীন অনুরাগকে
ভাঙচুর করে তছনছ করে উঠে এসেছে মাতৃস্তন্যের সেই অতলান্ত শৈশব – ‘দিব্যদৃষ্টি
দিচ্ছি তোমাকে। গর্ভগৃহের ভেতর। আহ্বানের সুদূরে
নিয়ে যাই তোমাকে। সাধ মেটাও। যুদ্ধের দোরগোড়ায়
মাদল বাজুক মহাজীবনের। কীর্তনের
সম্ভাবনায় এসো অর্জুন। ’
সময় এবং চিরকালীন সত্যের দ্বিরালাপকে এভাবেই
চিহ্নিত করেছেন রত্নদীপা। কুহকের ভেতর অবভাসের ভেতর নিমজ্জিত দিশাহীনতা থেকে
এভাবেই সত্যশ্রয়ী এক দিগন্তের উন্মোচন। জীবন
এবং জগত সম্পর্কে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ
বিষয়এর নির্মোক মোচন করে মানব আর প্রকৃতির রহস্য, মহাবিশ্বের ক্রিয়াপ্রকরন সহ
সমস্ত দার্শনিকতার প্রতিপ্রশ্নে প্যান্থেইস্টিক ভাবনার বলয়টির শরণ নেওয়াই কি তাহলে
মানুষের নিয়তি- ‘সর্ব্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণম ব্রজ
অহমাত্মাম সর্বপাপেভ্যো মোক্ষধোয়ামি মহাসুচ… ’। সত্যের ছদ্মবেশে যা চোখের সামনে আসবে, মোহ তৈরি
করবে তাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে জীবনে গ্রহন করতে হবে। এই জিজ্ঞাসার নাম আত্মজিজ্ঞাসা। আপাতরুদ্ধ দানবীয় রূঢ়তার নির্মোক ভেঙে স্বপ্ন
উপযোগী আত্মানুসন্ধান – ‘বিসর্জন
নগরেও আমি কিন্তু এক বিজয় উদ্ধত রাখাল’।
কবি দীনেশ কর শূন্য দশকের বাংলা কবিতায় এক
সুপরিচিত নাম। “উপাস্য আলোর
চারপাশে”তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। সত্তার নিবিড় এবং প্রকাশময় আকাঙ্ক্ষার ভেতর
গ্রথিত হয়েছে তাঁর যাপনের বর্ণমালা। রবীন্দ্রসংগীতের মধ্য দিয়ে খনন করেছেন কবিতার
ধ্রুবপথ। ব্যক্তি
আশ্রয়ে উপলব্ধ এবং স্বোপার্জিত অভিজ্ঞতার মর্মমূল থেকে উঠে এসেছে কাব্যিক প্রকল্প। আত্মআবিষ্কারের দ্যোতনাগর্ভে সঞ্চারিত হয়েছে
আস্তিত্বিক জিজ্ঞাসার আধার –
“প্রতিশ্রুতি তোমারও প্রিয় বর্ণ। ধীরে ধীরে পঙ্কিলতা। যেভাবে রাত্রি গ্রাস করে রোদের শরীর এবং
স্মৃতি ভিন্ন সমস্ত আড়ষ্ট অনবশিষ্ট। দু-হাতের দায়িত্ব পুড়িয়ে নির্ঘুম কি ঘুমন্ত
পুনরায়?”( হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে )
এই ঘুমের ভেতরেই থাকে জাগরণের নির্মল
প্রস্তুতি। আসলে এক
অপেক্ষা এক অপরিজ্ঞাতের মুখোমুখি সাক্ষাতের অপেক্ষা যা আমাদের আবহমান উজ্জ্বল উচ্ছল জীবনের উপর সাদা চাদর বিছিয়ে দেয়। ‘দিনের অন্যমনস্কতায় ক্রমে ক্রমে
রাত্রির অধিকার’ নিয়ে আসে লুণ্ঠিত হতে হতেও যেভাবে ক্রমে
দীর্ঘ প্রস্তাব নিরাবরণের সামনে নৈবেদ্য
সাজায়, যেভাবে আমরা অতীত ছেড়ে খুঁজে নিই উত্তরণের অভিমুখ আর ‘প্রতিটি বিস্ফোরণের ভেতর জমতে থাকে আত্মলাভের অলিখিত বিলম্ব’। এই অপেক্ষার ভেতরেই যতিশূন্য যাত্রার আয়োজন –
“ প্রসুপ্ত শিরা ছিঁড়ে যে মেলছে পাপড়ি,
তারই নামে কি হোমহিরণ,
শিরোধার্য সমস্ত শপথ- এ জিজ্ঞাসায় ডোবাইনি, অথচ
এই
মাহেন্দ্রধারায় একান্ত অঞ্জলি। ঋতু ও
রিপুর
আলাপন। ভুবনে যখন দোলাচল, ভীরুতা
এক খোলস অন্য খোলসে” ( নয় এ মধুর
খেলা )
এক খোলস থেকে অন্য খোলসে রূপান্তরিত হওয়ার যে
ধূসর গন্তব্য সেখানেই অনিশ্চয়তার পরম
নিশ্চিত আশ্রয় উপলব্ধি করেন দীনেশ। দেখতে
পান ‘ প্রেমিকার মতো অলীক। তোমার
মোচনে তার মহত্ব। ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের বাহক সেই নদীপথ যেখানে
অনুতপ্ত অক্ষরের সারি
নির্দয়
হতে যে হাত প্রয়োজন,
যত পা,
পাশবিকতা, ফুঁ
কীভাবে ওড়াবে সময়, যা কেবল
মুহূর্তের
সমষ্টি মাত্র নয়?
নষ্ট তরঙ্গ নাও
ও ঢেউ (যদি প্রেম দিলে না প্রাণে )
সময় কি কেবল মুহুর্তের সমষ্টি? না কি নিরবচ্ছিন্ন এক তরঙ্গ
যেখানে চেতনাসম্পৃক্ত এক অনন্তের আশ্রয়। আলিঙ্গনের অধিক আলিঙ্গন নিয়ে তার কাঠামোর ভেতর
এসে দাঁড়াচ্ছে মানুষ। তৈরি করছে
সম্পর্ক। তৈরি করছে
সম্ভাবনা। তৈরি করছে অভিনয়ের এক রহস্য জগত
“অভিনয়ও কি সম্পর্কের একটি নাম,
যেমন ভাই বোন প্রেমিকা? মুখস্থ সংলাপে যখন
বাঁচছি যে যার মতো? তুমি
গঙ্গা না হলে আমি ভগীরথ নই। ” (এসো এসো পার হয়ে মোর )
Art is concerned with an integral
reproduction of men’s life,
depending men in the totality of their
relations with each other and the world around them.
দীনেশের কবিতায় তারই অনুরণন। সামাজিক বাস্তবতার
বিভিন্ন গ্রন্থিল আবেষ্টনী জীবনকে সুসংহত বন্ধনে উপস্থাপিত করে -
“অন্ধকার হয়ে যে দাঁড়াল আগে, তার গায়ে ফুটবে এত জোনাকি, যেন তারায় তারায় লিখেছে
কেউ পৃথিবীর নাম- তুমি ভাবো নি কখনও। এমনকি এই বুকে রাখো নি কারও বসুন্ধরা”
প্রচ্ছদের যথযথ রেখা ও রঙের ব্যবহার
কাব্যগ্রন্থ দুটিকে শিল্পময় করেছে, আকর্ষণীয় করেছে।
মামেকং শরণম। । রত্নদীপা দে ঘোষ। । সিগনেট প্রেস। । প্রচ্ছদ- দেবাশিস সাহা। । মূল্য ১০০ টাকা। ।
উপাস্য আলোর চারপাশে। । দীনেশ কর। । ধানসিড়ি। । প্রচ্ছদ- রাজদীপ পুরী। । দাম ১০০ টাকা। ।
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন