অমিয়ভূষণের উপন্যাস ভাবনা ও মহিষকুড়ার উপকথা ~ সুস্মিতা কৌশিকী




অমিয়ভূষণের উপন্যাস ভাবনা
মহিষকুড়ার উপকথা

সুস্মিতা কৌশিকী

      গড়পড়তা বাঙালি পাঠকের উপন্যাস ভাবনা যে উচ্চতায় শেষ হয়, তারও অনেক  উচ্চতায়  অমিয়ভূষণের উপন্যাস ভাবনার শুরু তাই হয়তো তাঁর উপন্যাস পাঠকের সুস্বাদু (মুচমুচে মুখরোচক তিনি কোনদিন লেখেনই নি) মনে হয়নি যারাও বা সাহস করে দু' চারটি উপন্যাস  পড়েছেন, বুঝেছেন হজমকরা সহজসাধ্য নয় তবে তাতে এই ঔপন্যাসিকের কিছু যায় আসেনি তিনি বেঁচে থাকতেও কারণ তিনি সুনীল, হুমায়ূন, শীর্ষেন্দুর মতো শুধু সাহিত্য চর্চা করতে চাননি তিনি আমৃত্যু শিল্পের অনুরাগী ছিলেন, এক নির্বিণ্ণ সাধক বই লিখে টাকা করে ফুলে ফেঁপে ওঠা যায় ঠিকই কিন্তু তাতে শিল্প হয় না শিল্প নিভৃত চর্চার বিষয়  সমসাময়িক পাঠকের খোঁজে তিনি লেখেন নি কোনদিনই কুচবিহারের আর এক বিশিষ্ট সাহিত্যিক অরুনেশ ঘোষকে  দেওয়া সাক্ষাৎকারে অমিয়ভূষন তাঁর সমকালীন ঔপন্যাসিকদের বিখ্যাত লেখা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তাতে বাঙালি পাঠকের একশো ভাগ  বিস্ময়ের উদ্রেগ হয় বিভূতি বন্দ্যোর আরন্যক পড়েছি, ভালো বই তবে একে উপন্যাস বলা চলে না " তারাশঙ্করের কালিন্দী'র গল্প তাঁর ভালো লেগেছিল, ভালো লেগেছিল মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা র ' আরম্ভ আর প্রস্থান'  তবে ' পড়ে আলোড়িত হওয়ার মতো কিছু নয় ' অবশ্য এসবের কারণ দর্শিয়েছেন তিনি " রাশিয়ান, ফরাসী, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, ইটালিয়ান ( ইংরেজি অনুবাদে ) এবং বহু ইংরেজি ও আমেরিকান উপন্যাস পড়া থাকায় হয়তো এরকম হয়েছে এসবের তুলনায় বাংলা উপন্যাসকে জোলো মনে হতো"

    বলা বাহুল্য শুধু তত্ত্বে নয় অমিয়ভূষনের উপন্যাস- ভাবনা উপস্থাপনেও ব্যতিক্রমী তাঁর ভাবনা ছকে বাঁধা পথে আটকে থাকেনি কারণ তিনি নিজেই বলতে ভালোবাসতেন 'Boy meets a girl '  এর মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিক্রমা তা তিনি কখনোই  ভাবতে পারেননি"প্রকৃতপক্ষে  উপন্যাস পোর্টম্যান্টো নয় যে তার মধ্যে একই সঙ্গে মায়ের চিঠি, ফুটো মোজা ও ইস্তেহার পুরে আধুনিকতার গাড়িতে চড়া যাবে উপন্যাস আমাদের কৌতূহল নিবারণ করে না এবং আমাদের অ্যাডোলেসেন্ট যৌনপ্রবৃত্তির পরিতৃপ্তির উপায়ও নয় " "উপন্যাস তত্ত্ব নয়এবং বোধহয় সেজন্যই উপন্যাসের ভাষাও  বাক্যের পর বাক্য বসানো নয় উপন্যাস গল্প নয় যে গল্পটা পাঠকের মাথায় ঢুকেছে কি না তা জানলেই ভাষা সম্বন্ধে সব জানা হল উপন্যাস ইনসেস্ট ইত্যাদির বর্ননা নয় যে সাংবাদিক মাত্রেই ঔপন্যাসিক হয়ে যাবেন ওদিকে আবার উপন্যাস ভাষাচর্চাও নয় যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন বলেই 'শেষের কবিতা ' উপন্যাস হয়ে উঠবে অন্যদিকে উপন্যাস বড় করে বলা গল্প নয় যে কেউ এ বিষয়ে চালাকি করে বলবে উপন্যাস বড়ও বটে গল্পও বটে " উপন্যাস,একজন বিলিতি রসিকের কথা এনে বলা যায়,  " গল্প থাকায় আমরা দুঃখিত, এবং  গল্প যে রাখা হয় তা গল্প বলার উদ্দেশ্যে নয়, কোনটা আগে কোনটা পরে  ঘটেছে তা ধরিয়ে দিতে" "প্রকৃতপক্ষে একটা থিম যা আমাদের চোখের নীচে ফুটিয়ে তোলা হয় একটা থিম  যা হয়ে ওঠেঅর্থাৎ থিম নামে এক জীবন্ত বিষয়ের ভাব"

           অমিয়ভূষণের উপন্যাস সংখ্যা খুব বেশি নয় তবে একথা হলপ করে বলা যায় প্রত্যেকটি উপন্যাস বিষয়ে,ভাবনায়, উপস্থাপনের মাধুর্য্যে সাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে তিনি যে বিষয়কে উপন্যাসের উপজিব্য করে তুলতে চেয়েছেন তা একান্ত ভাবে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত ঔপন্যাসিকের প্রত্যক্ষ সংযোগ না থাকলে তাঁর উপন্যাস কৃত্রিমতার দোষে দুষ্ট হতো কিন্তু তা তিনি হতে দেন নি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে খন্ডে খন্ডে ধরে নিজের কল্পনায়, বোধে, হৃদয়বত্তার প্রলেপে সঞ্জাত করে সম্পৃক্ত ও সংযুক্ত করেছেন তাই তো তিনি অনায়াসে বলতে পারেন     "আমি‌ শরৎচন্দ্রের মতো  বাসন - মাজা সাহিত্য লিখি না আমি মহাশ্বেতা দেবীর মতো সেকেন্ডারী অভিজ্ঞতা দিয়ে লিখি না বিবর আমি দু - পাতা পড়েছি হাস্যকর আমার স্ত্রী  আমাকে হাসুলি বাঁকের উপকথা তিনপাতা পড়ে শুনিয়ে ছিলেন তারপর আর পড়িনি রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ছাড়া আর গুলো কিছুই হয়নি সুনীল গাঙ্গুলীর তো অনেক টাকা, কিন্তু বলার মতো লেখা ক'টা খুঁজে পাবেন? "

            এসব  উচ্চারণ কোন সাহিত্যিকের আত্মম্ভরিতা নয়, এ হলো শিল্পীর আভিজাত্য তিনি সাহিত্য করে টাকা রোজগার করতে চাননি, তাই তো তিনি কোনদিনই প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী ছিলেন না তিনি অনায়াসে বলতে পারেন " আমি এক প্রতিষ্ঠিত প্রৌঢ় ", দৌড়ে তাঁর কোন স্পৃহাই ছিল নাঅমিয়ভূষণ জাত শিল্পীআর একজন শিল্পীর মনন সবসময় ঝুঁকে থাকে ধ্রুপদী পাঠে অমিয়ভূষণের তরুণ বয়সে গোটা ইউরোপিয় গদ্য সাহিত্যে বিপুল আলোড়নের সময় জার্মানিতে টমাস মান আর তাঁর ঠিক বিপরীতে ফানৎস্ কাফকা, ফরাসিতে আলবেয়ার কাম্যু ও জাঁ পল সার্ত্র, ইংরেজি ভাষায় জেমস্ জয়েস সাহিত্য তাঁর নতুন দিশা খুঁজছে এঁদের অনুসিন্ধিৎসু কলমের আঁচড়ে অমিয়ভূষণের সাথে ইউরোপিয় নতুন গদ্য সাহিত্যের যোগাযোগ কতটা ছিল --- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন --- " এই লেখক গুলি প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র এঁদের কোন গোষ্ঠী ছিল  না যে আন্দোলন বা আলোড়ন হবে এঁদের উপন্যাস পড়ে সত্যিকারের পাঠক দম মেরে যায়, হয়তো তেমন সাহসী হলে তেমন কোনও ধৈর্যশীল দু- একটা অন্তর্গূঢ় প্রবন্ধ লেখেন এখানে বলে রাখা ভালো সার্ত্র ও কাম্যুর নাম মান, কাফকা, জয়েসের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে  বলা বোধ হয় সংগত হয় না ফরাসি নাম সেরকম বলতে হলে প্রুস্তের নাম করা যায় বরং আসলে কাফকার বই ছাপা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পরে তা কী বিষয়ে এ বুঝতেই এখনও সময় চলে যায়মানের বেলায় পাঠক বুঁদ হয়ে মানেই ডুবে যায় এদের নিয়ে আলোড়ন করার মতো জনতা কোথায় সার্ত্র ও কাম্যু প্রচারবিদ্ ছিলেন তাঁদের দর্শন ছিল তাঁদের দর্শন যত সোচ্চার তাঁদের শিল্প রং - চটা" কতটা সমৃদ্ধ পাঠগ্রহন করে থাকলে একজন সাহিত্যিক অন্য জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যের সম্পর্কে এমন উক্তি করতে পারেন ভাবলে অবাক হতে হয় বৈকি তবে এসব শুধু বলার জন্য বলা নয়, বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি হাতেকলমে কাজ করে দেখিয়েছেন নিজের লেখা সম্পর্কেও তিনি দীপ্তকন্ঠী তাঁর সাথে একমত হতেই হয় যখন তিনি বলেন " আমার লেখা বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ার জন্য নয়।।।আমার পঞ্চাশটা রিফাইড পাঠক হলেই চলবে আমি লিখি পঞ্চাশ বছর পরের পাঠকের জন্য আমার আদর্শ ব্যাসদেব তিনি লিখেছিলেন কালো মানুষদের কথা মহাভারত ব্যাসের নাতিপুতিদের গল্প তিনিও কালো মানুষ ছিলেন আমি লিখি হলুদ মানুষদের কথা রাভা, কোচ, মেচ, রাজবংশীদের কথা আমি তাদের হাতের পাতার মত চিনি" আসলে ১৯৬০ এর শেষ থেকে ১৯৬৩ এর গোড়ার দিক পর্যন্ত কোচবিহার ডাকঘরে টাউন ইন্সপেক্টর এবং কখনো ইন্সপেক্টর অব পোস্ট অফিসেস হিসাবে দায়িত্ব পালন কালে অমিয়ভূষন চষে বেড়িয়েছেন সংলগ্ন এলাকাগুলি, সাইকেলে, গ্রামের অলিগলি, বনের পথ, পথের ধারে বন, বনের নদী, নদীর সন্নিকটে অনুচ্চ পাহাড় সবই তার খুব পরিচিত, সবই তার লেখার বিষয়বস্তু

    কুচবিহার- আলিপুরদুয়ার আসাম সংলগ্ন বনঘেরা ডুয়ার্স অঞ্চলের এমনই এক চির পরিচিত হলুদ মানুষ, এক অকিঞ্চন আসফাক,  যে তার একমাত্র রত্ন রমনী ও তার ঔরসজাতকে নিজের করে রাখতেও ব্যর্থ তারই কাহিনী 'মহিষকুড়ার উপকথা '  কিন্তু কথায় কথা বাড়ে আকারে ছোট কিন্তু ভাবে গভীর এই উপন্যাস বা উপন্যাসিকাটি ডালপালা বিস্তার করে বহুধা বিস্তৃত ও ব্যাপক অর্থে উঠে আসে পাঠকের কাছে সমাজের নিম্নবর্গের গাথা থেকে হয়ে ওঠে চিরন্তনী মানবের কাহিনী -- তারই এক সজল পাঠ নিতে ইচ্ছুক এই আলোচনায়

      মহিষকুড়া কোন সম্ভ্রান্ত জনপথ নয় এক নগন্য গ্রাম, বিস্তীর্ণ সবুজ সাগরে একটা বিচ্ছিন্ন ছোট দ্বীপ, জঙ্গলে ঘেরা সবুজ অরণ্যানীর কোলে বাস করা এক মানবগোষ্ঠির একান্ত আশ্রয়স্থল, যারা শুধু বিচ্ছিন্নতার ধারক নয় বাহকও কিন্তু বৈপরিত্য এখানেই মাথাচারা দিয়ে ওঠে দূর থেকে দেখলে মনে হওয়া আশ্চর্য নয় যে মহিষকুড়া, ছোটশালবাড়ি,ভোটমারি, তুরুককাটা গ্রামগুলি সবুজের কোলে ঘুমিয়ে আছে সেখানেও আসলে কিন্তু জীবনচর্চার অদৃশ্য শৃঙ্খলগুলি বিদ্যমান কারণ বনের বুক চিরে চলে যাওয়া মেটে পথ কিছুক্ষণের মধ্যেই সমঝোতা করে নেয় ঘনপিচের সড়কের সাথে কালো পিচের রাস্তাগুলি যেন এইখানে বসবাসকারী বাসিন্দাদের জীবনের সীমাবদ্ধতা গুলির নির্ণায়ক শক্তি এখানে অরণ্য অরণ্য নয়, সারল্য সারল্য নয়, জটিলতার জালে আবদ্ধ এক অবোধগম্যতা কারণ যারা বনের বুকে ফুটন্ত কালো গরম পিচ ঢেলে সড়ক তৈরী করে আর যারা লাঙলের পিছনে ধৈর্য নিয়ে এগোয় তারা একই জাতের আগুনে পুড়লে তবু আশা থাকে, ছাইয়ের তলা থেকে নবাঙ্কুর দেখা দেয়; লোভের লাঙলে পড়লে তেমন যে শাল - পদাতিকের নিরেট নিশ্চিদ্র ব্যূহ, এক বনস্পতির এলাকা থেকে অন্য বনস্পতির এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত বিষমুখ কাঁটালতার তেমন যে সব ব্যারিকেড --- সব ধ্বসে যায়, তফাৎ শুধু আমাদের ভাবনায় লাঙলের সঙ্গে লোভ শব্দটি যোগ করতে অনিচ্ছা উৎপাদন হয় এই কৃষিভিত্তিক দেশের প্রেক্ষিতে

       এই মহিষকুড়া অঞ্চলেরই অলিখিত মালিক বছর ষাটের জাফরুল্লা ব্যাপারি সম্ভ্রান্ত কৃষক তার গোয়াল ভর্তি গোরু মোষ, ঘরে চার বিবি, এক ছেলে, বাড়ি ভর্তি চাকরবাকর প্রত্যেকেই জাফরুল্লার শাসনের কাছে জুবুথুবু আবার প্রত্যেকেই তার অধিনস্থ মূকপ্রাণের উপর নিজের শক্তি প্রদর্শন করতে উদ্যতব্যতিক্রম শুধু আসফাক, এক বিচ্ছিন্ন,অন্তর্মুখী হলুদ গাত্রবর্ণের ভিন্ন মানুষ সে মহিষকুড়ার উপকথা এমন এক কাহিনীকে তুলে ধরে ( নিছক গল্প বলা বা কাহিনীর ঘনঘটা অমিয়ভূষনের উপন্যাসে সর্বদাই অনিপস্থিত আর এই‌বিষয়েই তিনি এক ও অদ্বিতীয় ) যার জন্য এমন এক প্রক্ষিতের প্রয়োজন যেখানে দ্বৈত সত্ত্বা  বিদ্যমান রয়েছে মানুষ, মানবেতর, প্রকৃতি সকলেই দ্বৈতসত্তার অধিকারী এখানে চাউটিয়া জাফরুল্লার একান্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত চারকদের মধ্যে অন্যতম, মোষের বাথানের কঠিন কাজগুলোর ভার তার উপরে, দুধ দোয়া ও শহরে চালান করাও তার কাজের মধ্যে পড়ে বুনোমোষদের শাসনকরার বিশেষ কায়দা সে রপ্ত করেছে সে এখন এই এলাকার বিশিষ্ট ফান্দি  ( বুনোমোষ ধরার লোক ) ছমির নিতান্ত সাধারণ কর্মী -- 'খড়িফাড়া ' 'তরকারি বাগান তদ্বির' করে, হাঁস মুরগি দেখা কামলাখাটা লোক কিন্তু সেও তার ক্ষমতা প্রদর্শন করে মোষ, গরু, পাঠা খাসি করার সময় নাসির ও সাত্তার লাঙলদার, মূলত তামাকের ক্ষেতে তাদের কাজ বঞ্জর জমিতে আশাতিরিক্ত ফসল ফলিয়ে তারা তাদের শ্রেষ্টত্বের দাবিদার আসফাকের দ্বৈত সত্তা একেবারে ভিন্ন সে কখনো মহিষ হয়ে যায় না, এ রূপান্তর কাফকান মেটামরফোসিস নয়, এখানে মার্কেজের ম্যাজিক রিয়ালিজমও নেই, বা  ভার্জিনিয়া উলফের split personality,এ একেবারে বুনো গন্ধযুক্ত এক বনেচরের মনজগতের বিচিত্ররূপ হরিণ হরিণীর বিচরণ ক্রিয়া যেমন মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতে পারে বাঘের তীঘ্ন দাঁতের আঘাতে আবার সেই বাঘের জয়ও শেষ কথা নয় তাকেও দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান করে রক্তচক্ষু মহিষরাজ তার কালো,ছড়ানো প্রকান্ড এক জোড়া শিং এর দম্ভে অযুত বিচিত্র চিত্রদেহ পাখপাখালি যেমন আছে, তেমনী অভাব নেই বিষধর অহিকুলের ক্ষমতা যেমন আছে, তাকে দ্রুত উৎখাত করে নতুন ক্ষমতায়নও আছে আবার এখানেই অরণ্য তার সতন্ত্র চরিত্র ঝেরে ফেলে ঢুকে যায় মানুষের চরিত্রের ভেতর, জীবনে, যাপনে পশুদের নির্বীজ করার কাজটি একটু বাড়তি উৎসাহ নিয়েই করে থাকে ছমির আসফাক লক্ষ্য করেছে ছমির মিঞা একটুও বিচলিত না হয়ে, বেশ আনন্দের সঙ্গেই চোখের নিমেষে কাজটা সেরে ফেলে  কিন্তু পশুটির যন্ত্রনা আসফাকের মনবেদনাকে ছুঁয়ে যায় -- সে পশুটির চোয়ালের দিকে চেয়ে থাকে, তার মনে হয় " সেই মোষের এঁড়ের বড় বড় চোখ দিয়ে জল পড়ে সর্দির মতো শুকিয়ে আছে চোয়ালে " কোথাও কী আসফাক নিজেকে দেখতে পায় এই মূক পশুর মধ্যে? তার অদম্য যৌবন, পৌরুষ বাঁধা পড়ে আছে, অকেজ হয়ে আছে জাফরুল্লার "পায়োর " এর কাছে, ইংরেজি পাওয়ার শব্দটিকেই আসফাক যতদূর পারে উচ্চারণ করে -- অনুধাবন করতে চেষ্টা করে কী আজব এই শব্দ - কত বিচিত্র তার অর্থ ও অর্থের প্রসারণ ঔপন্যাসিক মজুমদার এখানেই জাফরুল্লার  পৌরুষের প্রকৃতিগত অভাবকেই  যেন ইঙ্গিতে   দেখিয়েে দিতে  চেয়েছেন  তার বহিরাঙ্গের পাওয়ারের  আস্ফালনের মধ্য দিয়ে

       ছমির বলে 'পায়োর 'বদলাতে গঞ্জে গিয়েই জাফরুল্লা তিসরা বিবিকে দেখতে পায় এবং এও বোধগম্য হয় যে তার বড় ও মেজ বিবির বয়স হয়েছে কিন্তু জাফরুল্লার পাওয়ার তখনও বর্তমান যদিও এই তিন বিবিই দীর্ঘ পতিত একমাত্র কমরুনই জাফরুল্লা কে একটি সন্তান দিয়েছে বছর সাতেক আগে এবং তারপর থেকে দীর্ঘ দিন সেও পতিত আর এই কমরুনই কোন এক অজ্ঞাত কারনে তার আত্মজকে শিখিয়ে দেয় আসফাককে  অন্যান্য চাকরের  মতো নাম ধরে না ডাকতে তাই মুনাফ আসফাককে " মিঞাসাহেব " বলে ডাকে এই সূত্র ধরেই আমরা ফিরে দেখতে পারি আসফাকের ধূসর অতীত এবং বুধাই রায়ের পাওয়ার ছ বিঘা জমির ভাগচাষি আসফাকের বাপ বাবার মৃত্যুর পর বুধাই জমিতে নতুন আধিয়ার দিল আধিয়ার জমিবাড়ির দখল নিতে এলে ভয়ে গ্রাম ছেড়ে বনের পথে পা বাড়ায় আসফাক সেই বনেই বেদিয়ার দলে সদ্য বিধবা কমরুনের সাথে তার দেখা ও ভাব ভালোবাসা " বিস্ময়ের মতো শোনালেও জন্মদরিদ্র আসফাক সেই প্রথম এক রত্ন দেখেছিল নীলাভ বেগুনি রঙের মতো মেঘ - মেঘ পাহাড়ের কোলে সবুজ মেঘ মেঘ বনের মাথা বাদামি রঙের সমান্তরাল সরলরেখার মতো গাছের গুঁড়ি, তার কোলে হালকা নীল নদীর জল সেই নদী যেখানে সবুজে নীলে মিশানো কখনো মোষ - রঙের পাথরের আড়ালে বাঁক নিয়েছে, সেখানে সকালের চকচকে আলোয় নিরাবরণ এক বাঁকে ভরা জলে চকচকে মেয়েমানুষের শরীর কমরুনের শরীরের উত্তাপ পেয়েছিল আসফাক চেয়েছিল কমরুনকে নিয়েই বনে বনে ঘুরে বেদিয়ার জীবন কাটাবে কিন্তু সেদিনও সে জানতো না পৃথিবীর সব জমিরই মালিক আছে, এমনকি বনও কারো না কারো মালিকানাধীন  যেমন তাকে একদিন জানায়  জাফরুল্লার বড়বিবি  "  তা আসফাক, এই পিথিমিতে যত জমি দেখো, তা সবই কোনো না কোনো জাফরের এই বন দেখো, তাও একজনের" আর এই তথাকথিত মালিকরাই জাফরুল্লার মতো পায়োরের অধিকারী তাই কমরুনেরও বুড়ো হেঁড়ে মাথা একবুক দাড়ির জাফরুল্লার মধ্যে বেদিয়া- দলপতিকে খুঁজে পেতে খুব বেশি দেরী হয়নি  জাফরুল্লার পাওয়ার সর্বগ্রাসী, নির্বাক পশু থেকে শুরু করে নিশ্চলা বনপ্রকৃতি সবই তার ক্ষমতার নীচে স্তব্ধ আর এই ক্ষমতার অন্যতম হাতিয়ার তার বন্দুক ও সরু লাঠির মতো কালো চকচকে সেই নলটা থেকে যা বের হয় উচ্চপদস্থ আমলাদের পোষাকের পাওয়ারও তো জাফরুল্লার পায়োরেরই অনুকুলে তবু এই সবের বিপরীতে আছে আদি অকৃত্রিম পুরুষের শক্তি -- আসফাকের মতো আর বুনো মোষটার মতো --- যে দশ বছর আগে একবার এসেছিল, আর এ অঞ্চলের অনেক মোষই আকারে প্রকারে এখন অন্য মোষ থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে যেমন হয়েছে মুনাফ জাফরুল্লা, সরকারী আমলারা জাফরুল্লার অধিনস্থ সকলকর্মির ক্ষমতা ও নতুন ক্ষমতায়নের বিপরীতে আছে এক কোমলমতির মানুষ তার সমস্ত সহানুভুতি ও অন্ত:স্থিত বিদ্রোহ নিয়ে -- যা প্রকাশ্যে আনার সাহসটুকু  সঞ্চয় করেও সে ব্যর্থ হয়,এই বিশাল ক্ষমতাজালের মধ্যে  আবদ্ধ হয়ে ছটফট করে কিন্তু একই সঙ্গে মনে মনে জাফরুল্লার  পাওয়ায়ের বিরুদ্ধাচারণ করে নিজের মনেই এক অদ্ভুত সুখ অনুভব করে

        জাফরুল্লার ওষুধ আনতে শহরে যায় আসফাক রাতের মধ্যেই ফিরে আসার কথা বুড়ো  জাফরুল্লার হাত পা অবশ হয়ে আসে এই ওষুধের অভাবেছমির মিঞা অবশ্য মশকরা করে বলে বিবিদের ( বিশেষ করে ছোট বিবি আর কমরুনের ) ঘরে যেতেই মালিকের এই ওষুধের বিশেষ প্রয়োজন মুহূর্তে আসফাকের মনে ঘুরে দাঁড়াবার ইচ্ছে বিদ্যুতের মতো চমক দিয়ে যায় --- "এ ওষুধটা কি তেমন নয়,যার অভাবে মানুষ মরে? ধক করে উঠল আসফাকের বুকের মধ্যে " কি ইঙ্গিত দিয়ে যান ঔপন্যাসিক? আসফাক ইচ্ছে করেই বনের পথ ধরে এবং পথ ভুলে সারারাত বনের মধ্যেই এলোপাথারি ঘুরে বেড়ায় সে যেন নিজেকে নতুন ভাবে আবিস্কার করে সেই বনে, সেই নির্জন পরিবেশে লটা ( ঘাস ) তুলে গোড়াটা মুখে দিয়ে মিষ্টি স্বাদে খুঁতখুত করে হাসে " সে তাড়াতাড়ি চলতে লাগল আর সেই অবস্থায় গাছের পাতার ছায়া যেমন তার গায়ের উপরে ছায়ার ছবি আঁকছিল, তার মধ্যেও ভয় আর সাহস, আনন্দ আর উত্তেজনা, নানা রেখা এঁকে নাচতে থাকল সে এবার আরো জোরে আরো টেনে আঁ - আঁ- আঁ ড় শব্দ করে ডেকে উঠল কান পেতে শুনল, প্রতিধ্বনি যেন একটা উঠছে আর সেই মুহূর্তে সে অনুভব করল সে মোষ হয়ে গিয়েছে একটা বুনো মোষ সে নিজেই, এই ভেবে তার নিঃশ্বাস গরম হয়ে ফোঁসফোঁস করতে লাগল সে প্রাণভরে ডেকে উঠল আঁ আঁ ড়।।।আর ঠিক এখানেই গল্পটা আর অকিঞ্চনের একমাত্র রত্ন রমনী আর তার আত্মজ কে হারিয়ে ফেলার গল্প থাকে না যে মানুষ প্রেম শব্দটি পর্যন্ত শোনেনি তার মধ্যেও জ্ঞানবৃক্ষের ফলের আভাস উঁকি দিয়ে যায় আসফাক নিজে নিজেই বলতে থাকে " কিন্তুক মোর দেরিটা থাকি গেইল " নির্বিষ প্রতিশোধের হাসি খুঁতখুত করে হাসে " তো ব্যাপারি, তোমরা থাপ্পর মারছেন, দশবিঘা ভুঁই দিছেন, মুইও চাষ দেং নাই " "মুইও দেরি করছং, তোমরা মারেন নাই তামাম শুধ

           কাহিনীর একটানা ন্যারেটিং থেকে মুক্তি দিয়ে ঔপন্যাসিক অসংখ্য খন্ড চিত্রে, উপকাহিনীতে, ইতিহাস কথায় উপন্যাসকে গতিশীল  করেছেন, যা  আদতে এই উপকথাকে অনন্যতা দান করে জনমানুষের কথায় পরিনত করেছে আর এই কাজে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হয়েছে উপন্যাসে ব্যবহৃত ভাষা অমিয়ভূষণের উপন্যাস সম্পর্কে দুটি লাইন লিখলেও একটি লাইন অবশ্য তার ভাষাশৈলী নিয়ে কথা বলবে উপন্যাসের কাহিনী বিন্যাসে যে ভাষার তিনি ব্যবহার করেছেন বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে তা শুধু কমলকুমার মজুমদারের  সঙ্গেই তুলনীয় তবে কমলকুমারের বাংলার মতো তা ফরাসীগন্ধী নয় মোটেও, অমিয়ভূষনের ভাষা আদ্যান্ত বাংলা একটি আঞ্চলিক ভাষাকে তিনি এমন মিষ্টতা দান করেছেন যে তা বিশিষ্টের ভাষা বলেই বোধ হয় মহিষকুড়ার উপকথা য় তিনি  কথোপকথনের জন্য রাজবংশী ভাষার ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সতর্কভাবে যেন পুরো উপন্যাসটি আঞ্চলিক উপন্যাসে পরিগনিত না হয় একদিকে যেমন চরিত্রকে সজীব ও অকৃত্রিম রাখতে, অন্যদিকে তাঁর thought process কেও চালনা করতে তিনি রাজবংশী ভাষায় dialogue ব্যবহার করেছেন স্থানে স্থানে কিন্তু   নিয়ন্ত্রিত ভাবে  যাতে পাঠকের সাথে কমিউনিকেশন ইনকমপ্লিট না থাকে ১৯৬২ সালের শারদীয় গণবার্তায় 'একটি খামারের গল্প 'নামে যে গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল তাই ছিল মহিষকুড়ার উপকথা উপন্যাসিকার বীজস্বরূপ ১৯৭৯ সালে শারদীয় পরিচয় পত্রিকায় মহিষকুড়ার উপকথা র প্রকাশকাল, এই মধ্যবর্তী সময়ে লেখক যে তাঁর শব্দ ভান্ডার কে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত করেছেন তা দুটি লেখা পাঠেই স্পষ্ট হয়ে যায়এইখানেও  অমিয়ভূষনের অনন্যতা তিনি এক ও অদ্বিতীয়

কথা ঋণ:
প্রবন্ধ সংগ্রহ - অমিয়ভূষন মজুমদার
              
সুস্মিতা কৌশিকী




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন