ধর্ম যখন মানবিকতার অন্তরায়
তৈমুর খান
ধর্মই কি একদিন পৃথিবী ধ্বংস করিবে? যেদিন হইতে
ধর্ম আসিয়াছে সেদিন হইতে যুদ্ধও আসিয়াছে। ধর্ম যদি শান্তি লইয়া আসিত তাহা হইলে
পৃথিবীতে কি এত মৃত্যু, এত রক্তপাত দেখিতে হইত? মানবিকতা বনাম ধর্ম — কে বড়ো? ধার্মিকেরা ধর্মকেই বড়ো করিয়া তুলিয়া ধরিবেন। মানবিকতাকে ধর্মের কাছে
তুচ্ছ করিয়া হীন প্রতিপন্ন করিবেন। কারণ মানবিকতায় পরকাল নাই। পরকালের মোহময়
সুখের হাতছানিও নাই। ধর্ম এভাবেই যুক্তি ও সত্যকে অস্বীকার করেই তাহার সাম্রাজ্য
বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। আমেরিকান মুক্তচিন্তাবিদ লেখক লেমুয়েল কে. ওয়াশবার্ন
(১৮৪৬) এই জন্যই বলিয়াছেন : “Most
men would kill the truth, if the truth would kill their religion.” সুতরাং ধর্ম একটি অন্ধকার অদৃশ্য
রূপকথার কাল্পনিক প্রজ্ঞা মাত্র। ধর্মজীবীদের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত
কাল্পনিক সত্যের উপরই ইহার ইমারত নির্মিত হয়। হয়তো এই কথা ভাবিয়াই বিশ্ব বিখ্যাত
বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলিয়াছিলেন : “‘religious truth’ conveys nothing clear to me at all.” এই সত্যকে খুঁজিয়া দেখিবার
প্রয়াস কাহারও নাই, অথচ এক প্রগাঢ় অন্ধ আবেগ রহিয়াছে। এই
আবেগ এমনই যাহা এ বিষয়ে অধিক প্রশ্নও তুলিবে না। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাইয়া
চলিতে পারিলেই নিজেকে ধন্য মনে করিবে।
বর্তমানে সব রাষ্ট্রই ধর্মকে রাজনীতির অংশ
করিয়া তুলিয়াছে। ধর্মকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাতির আবেগ করিবার প্রয়াস দেখাইতেছে। ফলে অধিকাংশ রাষ্ট্রই একদেশদর্শী ধর্মতাত্ত্বিক
রাষ্ট্রে পরিণত হইবার প্রয়াস পাইতেছে। স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন ধর্মীয় পন্থীরা
নানাদিক দিয়া হেনস্থার শিকার হইয়া চলিয়াছে। তাহাদের খাদ্যাভ্যাস, বসবাস,
ধনপ্রাণ রক্ষার নানা পরিপন্থী আইনও বিপজ্জনক হইয়া দেখা দিতেছে।
ধর্মের দোহাই দিয়া মানুষ হত্যা করাও সহজ হইয়াছে। নারীদের ধর্ষণ করিবার অজুহাতও
জুটিয়াছে। আবার ভোটে জিতিয়া সাম্রাজ্য লাভ করিবারও এক অনুপম পন্থা হইল এই
ধর্ম। ধর্ম কী না করিতে পারে ! ফুটপাথ হইতে তুলিয়া রাজসিংহাসনে বসাইতে পারে। গুরু
বানাইয়া রাজ-ঐশ্বর্য আনিয়া দিতে পারে। তাহার সহিত সুন্দরী যুবতী যাহারা গোপিণী
হইয়া কামসেবনের বস্তুতে পরিণত হইতে পারে। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আসিয়া সেলাম ঠুকিয়া
যাইতে পারে। ধর্মস্থান বা ধর্মগৃহ নির্মাণ করিয়া বাহাদুরি লইতে পারে। ধর্মমঞ্চ
তৈরি করিয়া ভাষণ দিয়া,
প্রলোভন দিয়া সকলকে জোটবদ্ধ করিতে পারে। সুতরাং ধর্মের অপার ও
বিস্ময়কর ক্ষমতা। রাজনৈতিক ব্যবসায়, অর্থনৈতিক ব্যবসায় এবং
ভণ্ডামির চূড়ান্ত অভিনয়ে ইহাকে নিপুণভাবে ব্যবহার করিতে পারিলে খুব অল্প সময়েই
বিখ্যাত হইতে পারিবে।
এখন সারাবিশ্বময় ধর্মের বহুমুখী ক্রিয়ার
প্রভাব লক্ষ করিতেছি। কোন্ রাষ্ট্রের নাম বলিব? আপনারাই দেখুন, প্রায় সব রাষ্ট্রেই কমবেশি ঘটনা ও অঘটন ঘটিয়া চলিয়াছে। ধর্মের অমানবিক
আচরণের নিন্দা করিলে মানবিক ব্যক্তিটির বাঁচিবারও অধিকার কাড়িয়া লইতেছে। পিস্তলের
গুলি কিংবা কাতির চোট কিংবা তরোয়ালের কোপ পড়িতেছে। ধর্মের সৈনিকেরা সর্বত্রই
ঘুরিতেছে। রাষ্ট্র তাহাদের মদত দিতেও কার্পণ্য করে নাই। কোনও কোনও শাসকই স্বয়ং
ধর্মের সৈনিক। তিনিই অন্যান্য সৈনিকদের পরিচালনা করিতেছেন। ধর্মের দোহাই দিয়া
মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করিয়া ভিন্নধর্মীয়দের বিতাড়ন, তাহাদের
নারীকে হরণ ও ভোগচরিতার্থ, হত্যা ও ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াইয়া
কোণঠাসা করিবার কৌশল প্রয়োগ করিতেছেন। তাহা হইলে ধর্ম লইয়া
কূটনীতি কি কম হইল?
ভেক ধারণ করিয়া, নিজস্ব
সততার প্রচার করিয়া, জনমোহিনী কথাবার্তা বলিয়া দুর্বল মূর্খ
ধর্মভীরুদের বশীভূত করা এমন আর কী কাজ? যেকোনও মুহূর্তে তাহা
সহজেই করা সম্ভব।
ধর্মকে সজীবিত রাখিয়াছে ধর্মগ্রন্থগুলি। সমাজে সম্প্রদায়ে সেগুলি “ঈশ্বরের বাণী” সুতরাং অপরিবর্তনীয় বলিয়া
প্রচারও পাইয়াছে। সেইসব মহালৌকিক বিষয়ে কাহারও কিছু বলিবার উপায় নাই। আর সেইসব
গ্রন্থের নিয়মনীতি প্রচার করিয়া স্বর্গ ও নরকের ধারণা দান করিয়া উগ্র ধর্মবিশ্বাসী
সম্প্রদায় তৈরি করিবার পথ সুগম হইয়াছে। মানবিকতাকে দূরে সরাইয়া ধর্মের মায়াজালে
মনুষ্যপ্রজাতির পতঙ্গকে আটকাইয়া শোষণ করা বেশ সহজ। ধর্মীয় শোষণে মনুষ্যকুল যাতনা
ভোগ করিতে পারে, নিজের ইজ্জৎটাও দান করিতে পারে। একসময়
সর্বস্বও তুলে দিতে পিছ পা হয় না। ধর্মের কারণেই দেশভাগ হইয়াছে, আরও খণ্ড খণ্ড হইবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হইয়াছে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা তো
নিত্যদিনের ঘটনা। গুরু হইতে গোরু, বিদ্যা হইতে বিদ্বেষ ধর্ম
সকলকেই গ্রাস করিয়াছে। কোন্ রাস্তায় ধর্ম নাই? যেখানেই পথ
খুঁজি, দেখি, ধর্ম রক্তচক্ষু লইয়া
দাঁড়াইয়া আছে। যাহা সাধারণ, যাহা সহজ সুন্দর হইত, তাহা ধর্মের কারণেই tremendous হইয়া উঠিয়াছে। এই কারণেই Absurdism - এর প্রবক্তা ফরাসি
দার্শনিক, লেখক তথা সাংবাদিক আলবার্ট কামুজ (১৯১৩) বলিয়াছেন: “Nobody realizes that some people
expend tremendous energy merely to be normal.”
মানবিকতার প্রেক্ষণটি এখান হইতেই বুঝা সম্ভব।
মানবিকতা মানবধর্মের ব্যাপ্তি লইয়া বিরাজ
করিতেছে। সমাজে মানবিকতা মনুষ্য প্রজাতিকে কখনও খণ্ডিত করিতে চাহে নাই।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-পরিচয় মানবিকতার নিকটে প্রয়োজন হয় না। মানব-প্রেমের এই শিক্ষণটি
প্রচলিত গ্রন্থবদ্ধ ধর্মগুলি দিতে পারে নাই। যদিও কোনও কোনও অংশে তাহা আলোকিত
হইয়াছে, তথাপি ধর্মগুরুগণ ইহার বিকৃত ব্যাখ্যাদান করিয়া সমাজকে ভ্রষ্ট পথ
দেখাইতেছেন। প্রতিটি মানুষই প্রেম—হৃদয় ও ধ্বংস লইয়া
জন্মগ্রহণ করে। এই প্রেম তাহার ব্যক্তিগত জীবনেরই আত্মস্ফুরণে বিকশিত হইতে থাকে।
যাহা “হৃদয়”
নামক মনেরই সমুদ্র তরঙ্গ বিক্ষোভে উচ্ছ্বসিত। আবার চূড়ান্ত
পরিণতির মধ্যেও তাহার অগ্রসর কাম্য। মানবিক সীমানার এই চিরন্তন বোধটি বব মার্লি
(১৯৪৫) তাঁহার একটি গানে বলিয়াছেন : “One
love, one heart, one destiny.” মানবিক পথের ব্যক্তিসীমানাকে আমরা অস্বীকার করিতে পারি না। ধর্ম যেখানে
উদ্দেশ্য সাধনের পথ চেনাইতে ব্যস্ত, মানবিকতা সেখানে এক
সৌন্দর্যের নিবেদনে আত্মোৎসর্গের মার্জিত বিনয় দান করিতে পারে। সেখানে অহংকার
থাকিতে পারে না। সপ্তদশ শতকের ইংরাজ কবি আলেকজান্ডার পোপ (১৬৮৮) বলিয়াছেন: “To err is human, to forgive,
divine.” — মনুষ্য ধর্ম
এমনই যে, সেখানে ভুল হইলেও তাহার মর্যাদা ও মাহাত্ম্য
কিছুমাত্র কমে নাই। বরং ক্ষমা ও ভালবাসায় অমেয় স্বর্গীয় অনুভূতি লাভ করা যায়। আজ
যে হানাহানির বর্বর যুগ চলিতেছে তাহার মূল কারণ যে ধর্ম তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে
না।
“ধর্ম” কথাটির ভিতর ঈশ্বরতত্ত্বের কী
ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তাহা কোনওকালেই বুঝিতে পারি নাই। প্রতিটি ধর্মকেই আমার শয়তান
বলিয়া বোধ হয়। এই যুগের দার্শনিক তথা সমাজতত্ত্ববিদ ভেক্সেন ক্রাবট্রি (Vexen
Crabtree, 1975) এই কারণেই বলিয়াছেন : “If there is a God, it must be
evil.” যাকেই ঈশ্বর বোধ হোক,
তিনি যে গুরুতর একটি শয়তান
পৃথিবীতে তাহার বহু প্রমাণ রহিয়াছে। যদি সত্যি সত্যি পৃথিবী ধর্মহীন শুধু
মনুষ্যজাতির পৃথিবী হইতে পারিত, তাহা হইলে হয়তো কিছুটা
শান্তি মিলিতে পারিত। এখন ধর্মস্রোত এতই বাড়িতেছে যে প্লাবন আসিতে খুব দেরি হইবে
না। আর ধর্মই হয়তো ধ্বংস লইয়া আসিবে সভ্যতার।
তৈমুর খান
বর্তমান বিশ্বের সঠিক পর্যালোচনা। ধন্যবাদ তৈমুর।
উত্তরমুছুন