বং বনসাই ~ মৈ মৈত্রেয়ী



বং বনসাই
মৈ মৈত্রেয়ী

স্বদেশী কোনো গাছের বীজ যদি বিদেশের মাটিতে ফেলা হয়, তাহলে সে নিজের মতো করে সেই মাটিকে আঁকড়ে ধরে। সেই দেশের জলবায়ুতে নিজেকে মানিয়ে নেয় ঠিকই কিন্তু নিজের বৈশিষ্ট্যকে বজায় রাখে। কিন্তু সেই গাছকে যদি বড় করে প্রবাসে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে অনেকসময়ই সে তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। অথচ এর উল্টোটা হওয়াই কিন্তু স্বাভাবিক ছিল।

ঘড়ির কাঁটা আর সময় একটা গোটা দিনকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে বারবার, পরিবর্তন হয় শুধু তারিখ, মাস এবং বছরের।  সময় যত এগোতে থাকে বাড়তে থাকে পিছুটান। ফেলে আসা রেডিওটায় বেজে ওঠে আগমনী বার্তা। বছরের পর বছর প্রবাসে কাটানোর পরে, ঘরে ফেরার পথ যখন প্রায় ঝাপসা হয়ে আসে তখনই মনরশ্মি ছুঁয়ে ফেলে, ফেলে আসা মেঠো পথ। তখন তারা বাংলায়তেই কথা বলে, বাংলাতেই গায় আবার তাদের দুঃখের ভাষাও বাংলা হয়ে ঝড়ে পড়ে নবীনদের সামনে। ঝকঝকে ভেজা রাস্তায় হাঁটতে গিয়েও তারা হোঁচট খান, মনে পড়ে যায় জমা জলে ঝপাং করা শৈশব। রাস্তার ধারে খুঁজে বেড়ান, দেশবাড়ি গাছের শুকিয়ে যাওয়া পাতার স্তূপ। বাড়িতে যত্ন করে রাঁধেন বেগুন দিয়ে মাঝের ঝোল। নিজেদের সময় অনুযায়ী পুজো পার্বণে অংশগ্রহণ করলেও, মন পড়ে থাকে মা জেঠিমার হাতে বানানো নারকোলের মিষ্টি, নাড়ু আর পিঠের সুবাসের দিকে। আপনজনদের পড়ে শোনান রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ বা শঙ্খ ঘোষের কবিতা। বাড়িতে চলে অতুলপ্রসাদী বা কখনও কখনও রামকুমারবাবুর টপ্পা। দেওয়ালে শোভা পায় সুকুমার রায় বা সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরা বন্দী ফোটো ফ্রেম। কেউ হয়তো বিগত তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে দেশের বাইরে চার দেওয়ালে বন্দী। কিন্তু চার দেওয়ালই প্রতিনিয়ত বলে ওঠে যে তুমি বাঙালি। অথচ সেই দেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়ে যেতে হয় প্রতিনিয়ত। তাদের স্বপ্নে ভেসে ওঠে পুকুরের জল, নারকোল গাছের সারি, তালের শাঁস, খেজুরের রস, গাঢ় লাল রঙের মেঝে, লাল পাড় সাদা শাড়ি, খোঁপার কাঁটা, সন্ধ্যা প্রদীপের গন্ধ, মা দিদিমার পায়ের আলতা আর তার সাথে ঘটিবাটির শব্দ। স্বদেশে কেউ না থাকলেও নিজের বাড়িটাকেই তারা দেশ বানিয়ে নেয়। ছেলেমেয়েদের সাথে বাংলায় কথা বললেও , লেখা শেখানোটা অনেক সময়ই সম্ভব হয় ওঠে না। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। নতুন বীজ তার মতো করে বাঙ্গালিয়ানা বজায় রাখে। 

বনেদী বড়লোক এবং উঠতি বড়লোকের মধ্যে যে তফাৎ, ঠিক সেই রকমই অসদৃশতা দেখা যায় ওপরের আলোচ্য বাঙালি এবং নিম্নোক্ত বাঙালিদের মধ্যে।

প্রবাসী হিসেবে এরা বয়োসন্ধির দোরগোড়ায়। এই ধরণের বাঙালিরা বাংলিশে কথা বলা পচ্ছন্দ করে। শুভ বিজয়ার ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে হ্যাপি বিজয়া। বাঙালি সব্জি বিক্রেতার কাছে গিয়ে পালংশাকের বদলে যখন স্পিনাচ আছে ভাইয়াবলে কর্কশ শব্দে ডেকে ওঠে তখন সব্জীদাদাও হকচকিয়ে বলে হা হা আছে দাদাতো এই বাঙালিরা খুবই বিপদজনক প্রানীবিশেষ। আর এদের জন্যই বিশ্বভাষার দরবারে সপ্তম স্থানাধিকারি বাংলা ভাষা, একটি আঞ্চলিক ভাষায় পরিণত হয়েছে। বাঙালি জাতি এমনিতেই সর্বংসহা। অন্য সংস্কৃতিকে যেমন খুব সহজেই আপন করে নিতে পারে তেমনি ঠেলে সরিয়ে দিতে পারে নিজের অস্তিত্বকে। যেমন বিজয়ার কোনো অনুষ্ঠানে বাচ্ছা ছেলেমেয়েরা যখন হিন্দী গান চালিয়ে নেচে ওঠে আর চারপাশের বড়রা কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ বলে উৎসাহ দিয়ে চলে তখন মনে হতে বাধ্য যে হায় রে বাঙালি আর তার শিক্ষা। দোষ বড়দের, তারা নিজেদের ড্যাডি ও মাম্মি বলে পরিচিত করাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। এরা লক্সমি পুজো করে, সারাস্বতি নামটাও খুব কষ্ট করে উচ্চারণ করতে সক্ষম, কালী পুজোর বদলে দিওয়ালি এবং বছরে দুবার হ্যাপি নিউ ইয়ার উদযাপন করে। পুজোতে এরা কন্ট্র্যাক্ট দেয়, ঠাকুরমশাইকে। বটি থেকে শুরু করে কাঁসার পাত্র, ফল সব্জি, ধুতি গামছা এই সব জিনিস ঠাকুরমশাই নিজেই নিয়ে আসেন আর পুজো শেষ করে লোটাকম্বল গুছিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেন। এই পুজোয়, না হয় ভক্তি না থাকে প্রান। বাড়িতে কাউকে নেমন্তন্ন করলে, হোম ডেলিভারি অর্ডার করা হয় কিন্তু মনে রাখতে হবে যে বাঙালি খাবারই চাই। এক মাত্র পদবী বাদ দিয়ে আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। বাহ্যিক আবরণের মোহমায়ায়, ক্ষীণ হয়ে আসে বাঙালি আত্মা। এরা বং হয়ে দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহন করে।

সব থেকে মুশকিলে পড়ে নতুন প্রবাসি বাঙালিরা। চেনা ফুটপাত, আভিজাত্যের শৌখিনতায় মাখা গলির ভাঁজ, স্নান সেরে অফিস যাওয়ার আগে মায়ের হাতের গরম ভাত, বিকেলের ফুচকা বা চপ মুড়ি, বন্ধুদের সাথে চায়ের কাপে হুল্লোর  - এই সব কিছু ছেড়ে ট্রেনে বা প্লেনে মাত্র কয়েকঘন্টার দূরত্বে শুধুমাত্র জীবিকার জন্য যখন অন্য রাজ্যে বা দেশে চলে যেতে হয়ে তখনই সব থেকে বেশি মনে পড়ে বাংলাকে। নতুন জায়গায় পা দিয়েই মনে হয়, সে একা। ট্যাক্সি থেকে শুরু করে দোকানের হোর্ডিং, বাসের নাম্বার, সবকিছুর মাঝে নিজেকে তার পরিযায়ী মনে হয়। এক গলা কষ্ট দলা পাকিয়ে মনে করায় যে তুমি এখন প্রবাসী। ছেড়ে আসা পথের ছায়াও এক সময় সঙ্গ ছেড়ে দেয়। চারপাশের ভিড়ও কোনো পথিককে একা করে দিতে পারে। ল্যাম্প পোস্ট, রাস্তার ধারে বড় বড় বিল্ডিং, অজানা পথ সব কিছুর মধ্যেই এক বাঙালি খুঁজে চলে আরেক বাঙালিকে। কিন্তু প্রবাসে, বাঙালি পাওয়া যতটাই কঠিন বং পাওয়া তার থেকে অনেক সহজ। কারণ ততদিনে সময়-প্রবীন বাঙালিরা নিজেদের একটা আলাদা জগৎ তৈরী করে নিয়েছেন। তারা তখন বং থেকে আবার বাঙালি হয়ে গেছেন। আর বংরা তখন নাক উঁচু করে ভেটকি ছেড়ে টুনা ফিস কিনতে ব্যস্ত।  তাই নবীনরা এই ফিসি বংকে খুঁজে পেয়ে ঝাপিয়ে পড়লেও বং নামক মানুষরা নির্দ্ধিধায় তাদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়।  অনেকটা আগের দিনের ভাসুরদের মতো। তাদের ধারণা যে নতুন আসা বাঙালিরা হয়তো আদিখ্যেতা স্বরূপ বংদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলতে পারে।  তাই পাশাপাশি আসনে বসলেও দূরত্ব থাকে হিমালয় এবং কন্যাকুমারির মতো। বং-এর পাশে বসে থাকা সদ্য প্রবাসি বাঙালিটি, এক ঢোক জল খাওয়ার সাথে সাথে গিলে নেয় ঘর ছাড়ার কষ্ট। অজানা প্রবাসে  ধীরে ধীরে যখন মানিয়ে নেওয়া শেখে তখন তার কাছে দুটো রাস্তা খোলা থাকে। এক - বাঙালি এবং দুই - বং। চারা গাছের এবার বড় হওয়ার পালা।

তবে কলকাতার অনেক বাঙালিই এখন বং হয়ে গেছে। তারা হয় হিন্দী বা বাংলিশে কথা বলতে অভ্যস্ত। সে উবের-এর চালক হোক বা বাসের কন্ড্যাক্টর, শপিং মলের বিক্রেতা বা ইস্তিরি আলা। এই রকম খিচুড়ি ভাষা, আর কোনো জায়গায় শোনা যায় না। আমাদের এখানকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভাষা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা থাকে। অনেক বাবা-মাই হিন্দী এবং ইংলিশ বেছে নেন কারণ তাদের মতে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ শূন্য। অপর দিকে অন্যরাজ্যে কিন্তু এই বৈষম্য নেই। মাতৃভাষা থাকতেই হবে, তারপর অন্য ভাষা। কেন এই বৈষম্য! কারণ আমরা নিজেরাই বাংলা ভাষার অসম্মান করছি দিনের পর দিন।

ছোটবেলায় বাড়িতে বড় কেউ এলে তাদের সামনে বাচ্ছারা কবিতা আবৃতি করতো আর এখন তারা রাইম বলে। কবিতা কাকে বলে? সুকুমার রায় কে? ঠাকুরমার ঝুলি বা ঈশপের গল্পে কী আছে? ফেলুদা বা কাকাবাবুকে তো ছবিতেই দেখা যায় তাই বইয়ের গন্ধ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

দায় আমাদের, দোষ আমাদের। বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা মৃতপ্রায়। তাল মিলিয়ে চলতে চলতে আমরাই মিলিয়ে যাচ্ছি। কিছু মানুষ এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু বেশিরভাগ বং-ই  ব্যান্ড বাজিয়ে আ মরি বাংলা ভাষাকে পাথরে বেঁধে গঙ্গার জলে ভাসান দিয়ে দিয়েছে। নিজেরাই শিকল তুলে দিয়েছে তাদের সদর দরজায়। আর আমরা ধাক্কা মেরে চলেছি সেই সদর দরজায়, ছাতিম ফুলের গন্ধ মাখানো আজও যে বাকি রয়ে গেছে। একটা পাথরের আঘাতই ঢেউ তুলে দেয় নদীর বুকে সেখানে যে ভাষার জন্য রক্ত ঝড়েছে তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। কলম আর কাগজ সাথেই আছে, দরকার শুধু ধৈর্য আর সংযম। বনসাইয়ের আড়ষ্টতা কাটিয়ে ডানা মেলার পালা। এই গাছে ফুল ফুটবেই। মাটির টানে ঘরে ফেরা মানুষগুলোকে যাতে আশ্বাস দেওয়া যায় যে যেমন ভাবে ফেলে গেছিলে তোমাদের অস্তিত্ব ঠিক তেমন ভাবেই তোমাদের ফিরিয়ে দিলাম আমার বাংলাকে।

   মৈ মৈত্রেয়ী
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন