মৃত্যুদণ্ড
শাসনের
ছলনায় রাষ্ট্র কর্তৃক নরমেধ যজ্ঞ
অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
মৃত্যুদণ্ড বা প্রাণদণ্ড (Capital Punishment) হল
আইনি পদ্ধতিতে কোনো ব্যক্তিকে শাস্তিস্বরূপ হত্যা করা। যেসব অপরাধের শাস্তি হিসাবে
সাধারণত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে, সেগুলিকে বলা হয়
মৃত্যুদণ্ডার্হ অপরাধ। অতীতে প্রায় সকল দেশেই মৃত্যুদণ্ড প্রথা প্রচলিত ছিল।
বর্তমানে মাত্র ৫৮টি দেশ প্রত্যক্ষভাবে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে। ৯৫টি দেশ এই প্রথা
অবলুপ্ত করে দিচ্ছে। অবশিষ্ট দেশগুলি দশ বছর এই দণ্ড ব্যবহার করছে না বা যুদ্ধ
ইত্যাদি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ করছে না। অনেক দেশেই মৃত্যুদণ্ড
একটি বিতর্কের বিষয়। তবে একই রাজনৈতিক আদর্শ ও সাংস্কৃতিক অঞ্চলে মৃত্যুদণ্ড
নিয়ে মতান্তর রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৌলিক অধিকার সনদের ২ নং অনুচ্ছেদ
অনুযায়ী,
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলির উপর মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগে
নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
আজ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল অধিকাংশ দেশকেই "অ্যাবোলিশনিস্ট"
অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড বিলোপের পক্ষপাতী মনে করে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানাল
মৃত্যুদণ্ড বিলোপের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রসংঘে একটি অ-বাধ্যতামূলক প্রস্তাবনায় ভোটের
অনুমোদন দিয়েছে। যদিও বিশ্বের ৬০% মানুষ সেই সব দেশে বাস করেন, যেখানে মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্বের সর্বাধিক
জনসংখ্যাবিশিষ্ট চারটি দেশও (গণচিন, ভারত, মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোনেশিয়া)। চারটি দেশই ২০০৮ সালে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সভায়
"রেজোলিউশন অন আ মোরোটোরিয়াম অন দি ইউজ অফ দ্য ডেথ পেনাল্টি"-এর
বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। আসলে রাষ্ট্র তখনই সেই ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেবে, যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের পক্ষে ঝুঁকিকর হতে পারে। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেই মৃত্যুদণ্ডই কাঙ্ক্ষিত, যদি কোনো ব্যক্তি বিদ্রোহী হয় – এই বিদ্রোহীদেরই রাষ্ট্রদ্রোহী
হিসাবেই প্রতিপন্ন করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ডপূর্বক হত্যা করা হয়।
মৃত্যুদণ্ড হল অপরাধীর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি। যদিও পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না। কিন্তু বিশ্বের
বেশিরভাগ দেশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধি আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর করার পদ্ধতি একেক সময়ে একেক পদ্ধতিতে দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছেও। আমি এখানে
মৃত্যুদণ্ডের ৩৬টি পদ্ধতি উল্লেখ করব। অবশ্য সবকটি পদ্ধতি এখন
আর কার্যকর হয় না। তবুও জেনে রাখব।
(১) ইলেকট্রিক চেয়ার : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিটিকে একটা চেয়ারের সঙ্গে
বেঁধে বসিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সেই ব্যক্তির মাথায় একটা ভেজা স্পঞ্জ লাগানো হয়, যাতে বিদ্যুৎপ্রবাহ সহজেই কার্যকর হতে পারে। তার মাথায় এবং পায়ে ইলেকট্রোড
লাগিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত দু-বার বিদ্যুৎপ্রবাহ তার শরীরের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করানো
করা হয়। প্রথমবার ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ। এর ফলে ব্যক্তিটির
হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যায়। এরপর দ্বিতীয়বারের বিদ্যুৎপ্রবাহের ফলে তার শরীরের
ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুড়ে যায়।
(২) গ্যাস চেম্বার : একটি চেম্বারে
ছোটো একটা এয়ার-টাইট চেয়ার রাখা হয়। যাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে তাকে এই চেয়ারে
বসিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। চেয়ারের নীচে একটা পাত্রে পটাশিয়াম সায়ানাইড ক্যাপসুল
রেখে বাইরে থেকে চেম্বার বন্ধ করে দেওয়া
হয়। এরপর একটা নলের সাহায্যে বাইরে থেকেই চেয়ারের নীচে রাখা আর-একটি পাত্রে
সালফিউরিক অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি তখন তার শেষ কথা বলে
বা ইচ্ছা প্রকাশ করে। এরপরই মেসিনের সাহায্যে সায়ানাইড ক্যাপসুল এবং অ্যাসিড
একসঙ্গে মেশানো হয়। এর ফলে চেম্বার পটাশিয়াম সায়ানাইড গ্যাসে ভরে যায়। যাতে মৃত্যু
ত্বরান্বিত হয় সেইজন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ঘনঘন শ্বাস নিতে বলা হয়। ঘনঘন
শ্বাস নেওয়ার ফলে শরীরে তাড়াতাড়ি গ্যাস প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে
পড়ে। তবে অনেকক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি মৃত্যুভয়ে শ্বাস আটকে রাখে বলে
মৃত্যু বিলম্বিত হয়ে যায়।
(৩) ফায়ারিং স্কোয়াড : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির চোখ এবং হাত বেঁধে একটা
খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হয়। এরপর তার বুকে গোল একটা টার্গেট পেপার ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
কিছুটা দূরে পাঁচ-পাঁচজন শ্যুটার দাঁড়িয়ে থাকে। এদের প্রত্যেককে একটা করে গুলি
দেওয়া হয়। পাঁচজনের জন্য চারজনের কাছে আসল গুলি থাকে না, থাকে
ব্ল্যাংক গুলি। কিন্ত কোন চারজনের কাছে ব্ল্যাংক গুলি আছে সেটা পাঁচজন শ্যুটারের
একজনও জানতে পারবে না। কারণ ওদের কেউই বুঝতে পারবে না ঠিক কার গুলিতে
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। “ফায়ার” -- হুকুম বা নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে পাঁচজন শ্যুটারই একসঙ্গে গুলি করে এবং
ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তবে কোনো শ্যুটার যদি গুলি না-করে তাহলে তারও শাস্তির
ব্যবস্হা থাকে।
(৪) ফাঁসি : আইনানুগ সকল ফর্মালিটি শেষে ফাঁসির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে
নিয়ে আসা হয় কনডেম সেলে। সেখানে শুধু ফাঁসির আসামীরাই থাকে। অনেকটা ওয়েটিং রুমের
মতো। এখানে কয়েকদিন রাখা হয়। তার সঙ্গে যথাসম্ভব ভালো ব্যবহার করা হয়। ফাঁসির জন্য
বিদেশ থেকে আনা হয় দড়ি। সাধারণত জার্মানি থেকে বিশেষ এই দড়ি আনা হয়। নিয়ম করে
কয়েকবার এতে মাখানো হয় সবরি কলা আর মাখন। জল্লাদ নির্বাচন করা হয় কয়েদিদের মধ্য
থেকেই অথবা পেশাদার জল্লাদ। কোনো কোনো দেশে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের দিয়ে ফাঁসি
দেওয়ালে প্রতিটি ফাঁসি কার্যকরের জন্য ওই কয়েদির ২ মাস করে সাজা কমে। আসামীর
সম-ওজনের বালির বস্তা দিয়ে কয়েকবার ফাঁসির প্র্যাকটিস করা হয় কয়েকদিন আগেই। কনডেম
সেলে আসামীর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করানো হয়। তবে অনেকক্ষেত্রেই কবে ফাঁসি
কার্যকর হবে তা আসামী এবং আত্মীয়স্বজন কাউকেই বুঝতে দেওয়া হয় না। কিন্তু ফাঁসির দিন কয়েদি বুঝতে পারেন যে আজই
তার জীবনের শেষ রাত। দণ্ডপ্রাপ্তকে মাথা ঢেকে দেওয়া হয় এবং গলায় দড়ি পরিয়ে দেওয়া
হয়। জেল সুপার হাতে রুমাল নিয়ে ফাঁসির মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। দাঁড়িয়ে থাকেন
অন্যান্য চিকিৎসকসহ আরও কয়েকজন। জল্লাদের চোখ তখন রুমালের দিকে। ওই মুহূর্তে এই
রুমালই একজন মানুষকে এ-পার থেকে ও-পারে পাঠিয়ে দেওয়ার ভূমিকা পালন করে। রুমালের হেলনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির
পায়ের নিচ থেকে পাটাতন সরে যায়। গলায় আটকে যায় মোটা দড়ি। শুরু হয় রহস্যময় যাত্রা।
১০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখার পর একজন ডাক্তার এসে ঘাড়ের চামড়া কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
পড়ে থাকে নিথর দেহ। ফাঁসির সাধারণত ভিডিও করা হয় না। তবে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান ও জাপানি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ভিডিওতে ধারণ করা হয়েছিল।
জার্মানির নুরেমবার্গ ট্রায়ালের সেই ভিডিওটি ইউ টিউব ঘাঁটলেই দেখতে পাবেন। প্রায়
৬৫ বছর আগের ভিডিও, যেটা ২৮ মে ১৯৪৬ সালে কার্যকর করা হয়েছিল
ল্যান্ডসবার্গ জেলে। সংক্ষিপ্ত সময়ের ট্রাইবুন্যালের রায়ের কোনো আপিল করার সুযোগ
দেওয়া হয়নি।
(৫) ফাঁসি,
জলে ডুবানো এবং খণ্ডকরণ : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে একটি
কাঠের সঙ্গে বেঁধে ঘোড়া দিয়ে টানতে টানতে
নিয়ে যাওয়া হত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জায়গায়, অর্থাৎ
বধ্যভূমিতে। এরপরে সেই ব্যক্তিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হত ফাঁসির দড়িতে। মৃত্যু হওয়ার আগেই
সেই ব্যক্তির গলা থেকে ফাঁসির দড়ি থেকে খুলে দেওয়া হত। এ অবস্থায় তাকে জলে ডুবানো
হত। এরপরও মৃত্যু না হলে আধমরা ব্যক্তিকে হাত-পা বেঁধে তার পেট কেটে পেটের মধ্য
থেকে ভুড়ি বের করে আনা হত। এসময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখা হত যেন কোনোভাবেই তার মূল
রক্ত পরিবাহীতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ফলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির মৃত্যু হত
না। এরপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির সামনেই তারই নাড়িভুঁড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে
দেওয়া হত। এরপর ধারালো কুড়োল দিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে জীবন্ত অবস্থায়
কেটে চার টুকরো করা হত। সবশেষে তার মাথা কেটে ফেলা হত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাথা কাটার
আগে পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি বেঁচে থাকত। এখানেই শেষ নয়, এরপরে তার দেহের বিভিন্ন অংশ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হত, জনগণকে দেখানোর উদ্দেশ্যে। বীভৎস এই নরহত্যা হত রাষ্ট্রের নির্দেশে, শাসনের নামে। ফাঁসি, জলে ডুবানো, খণ্ডকরণ পদ্ধতিতে একসঙ্গে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা ইতিহাসে সব থেকে অমানবিক
পন্থা বলে বিবেচিত। বর্তমানে এই পদ্ধতিটি আর কার্যকর হয় না।
এখন মৃ্ত্যুদণ্ড পদ্ধতি নিয়ে নীচে যে আলোচনা করব যেগুলি বর্তমানে প্রচলিত না
থাকলেও প্রাচীন যুগে ছিল।
(৬) মুণ্ডচ্ছেদ বা শিরকর্তন : মুণ্ডচ্ছেদ বা শিরকর্তন (Guillotine) পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতি মূলত চালু করা হয় মানবিক দিক বিবেচনা
করে!! ১৭০০ শতকে এই পদ্ধতি চালু করা হয়, কেন-না তৎকালীন আমলে
বিশেষজ্ঞদের মতে এই পদ্ধতিতে আসামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে, তার কষ্ট কম হয়! তাই তৎকালীন সময়ে অনেক দেশ এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
করতে থাকে। কোনো মানুষ দোষী সাব্যস্ত হলে তার মুণ্ডচ্ছেদ করাই ছিল এই গিলোটিনের
কাজ। ডা. জোশেফ ইগনেস গিলোটিন ১৭৮৯ সালে প্রথম এই মারণযন্ত্রের প্রবর্তন করেন।
বিপ্লব চলাকালীন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত দোষীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তিনি এই অভিনব
যন্ত্রটির সুপারিশ করেন। প্রায় ২২৩ বছর আগে অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে ১৪ জুলাই বাস্তিল
দুর্গে বন্দুকের আওয়াজের মধ্যে ফরাসি বিপ্লবের নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তার ২ বছর পর
১৭৯১ সালে সে দেশের রাজা ষোড়শ লুই ছদ্মবেশে ভার্নেতে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন জুন
মাসের ২০-২১ তারিখে। তার ঠিক এক বছর সাত মাসের মাথায় ১৭৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি
রাজাকেই ধরে গিলোটিনে চালান করে দেওয়া হয়। মাটিতে গড়িয়ে পড়ে রাজার মুণ্ড। এভাবে কত
যে মানুষের মুণ্ডচ্ছেদ হয়েছে তার শেষ নেই। এজন্যই ফরাসি বিপ্লবের কাহিনি থেকে
গিলোটিনকে কিছুতেই আলাদা করা যায় না। ১৭৯২ সালের ২৫ এপ্রিল ডি গ্রিভ শহরের
উন্মুক্ত প্রান্তরে এটিকে স্থাপন করা হয় এবং সর্বপ্রথম একজন 'হাইওয়ে ম্যান'-এর মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। এরপর ওই বছরই পেরিসের
ডি লা কনকর্ডে প্রায় ৪০০০ মানুষের শিরশ্ছেদ হয় একইভাবে। উল্লেখযোগ্যতার মধ্যে ১৭৯৩
সালের জানুয়ারিতে রাজা ষোড়শ লুইয়ের পর ১৬ অক্টোবর রানি মারি আঁতোয়ানে, ৩১ অক্টোবর জিরদঁযাদের, ৮ নভেম্বর মাদাম রোঁলা, ১৭৯৪ সালে ৩০ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিলের মধ্যে জর্জ দাঁত ও তাঁর অনুগামীদের
গিলোটিনে হত্যা করা হয়। চাকা কীভাবে ঘোরে! দাঁতে ও তার পন্থীদের গিলোটিনে পাঠানোর
মূল হোতা যে বিপ্লবী নায়ক ব্যারিস্টার মেক্সিমলিয়ান মারি ইশিদর দ্য রোবসপিয়েরকেও
সেই নিমর্ম গিলোটিনে মাথা দিতে হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর করা বন্ধ হয়ে যায়। ফ্রান্সে গিলোটিনে শেষ মৃত্যুটি হয় ১৯৭৭ সালে। ১৯৬০
থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যেই গিলোটিনে মৃত্যুর হার কমে আসে। ১৯৮১ সালে ফ্রান্সে
মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ হয় ও সেইসঙ্গে মুণ্ডচ্ছেদও বন্ধ হয়ে যায়। ডা গিলোটিনও খুব
অল্পের জন্য গিলোটিনে মৃত্যু থেকে বেঁচে যান।
(৭) হাতির পায়ে পিষ্ট করে : মৃত্যদন্ড কার্যকর করার এই পদ্ধতি কিন্তু সুদুর
কোন দেশের প্রচলিত পদ্ধতি না, বরং আমাদের এই দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ার উদ্ভাবিত এবং একসময়ের বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বিশাল আকৃতির হাতি
তার পা দিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির মাথা থেঁতলে দিত। এক্ষেত্রে আবার হাতিকে
প্রশিক্ষণ দেওয়া হত, যাতে সে ধীরে ধীরে পায়ের চাপ বাড়ায়, যাতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ শাস্তি পায় মৃত্যুর সময়। এই পদ্ধতি
মূলত ব্যবহৃত হত রাজা বাদশাহদের আমলে।
(৮) চামড়া ছড়ানো : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির চামড়া ছাড়ানো (Flaying Skin) ছিল এক বীভৎস মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত
ব্যক্তিকে জীবিত অবস্থায় একটা লম্বা টেবিলের উপর বেঁধে তার চামড়া ছাড়ানো হয়। এই
ছাড়ানো চামড়া জনবহুল এলাকায় প্রকাশ্যে টানিয়ে রাখা হয়, যাতে
সবাই দেখতে পারে এবং শাসককে ভয় পায়।
(৯) স্কাফিজম : অতীতে পার্সিয়ান্দের মধ্যে প্রচলিত মৃত্যদণ্ড কার্যকর করার
পদ্ধতিই হল স্কাফিজম (Scaphism)। এ
পদ্ধতির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে একটি ডোবার কাছে
আনা হত। এরপর ডোবার সব থেকে কাছের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হত। এরপর সাজাপ্রাপ্ত
ব্যক্তিকে প্রচুর পরিমাণে দুধ এবং মধু খাওয়ানো হত, যত সময়
পর্যন্ত না তার ডাইরিয়া শুরু হত। ডাইরিয়া শুরু হলে তার সারা শরীরে মধু মাখিয়ে
দেওয়া হত। এই মধু মেখে দেওয়ার ফলে আশেপাশের অনেক কীটপতঙ্গরা আকৃষ্ট হত এবং
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির গায়ের চামড়া ভেদ করে বাসা বানাত। এই পদ্ধতিতে আসামির
মৃত্যু হতে সময় লাগত ২ সপ্তাহের মতো। ব্যক্তিটির ডাইরিয়া, গ্যাংগ্রিন
এবং অনাহারে মৃত্যু হত।
(১০) তক্তার উপর : এই উপায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করত সাধারণত জলদস্যুরা, যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাহাজ আক্রমণ করে জাহাজের সব কিছু লুট করে নিত। আর
যারা প্রতিরোধ গড়ে তুলত তাদের এইভাবে শাস্তি দিত। এক্ষেত্রে ব্যক্তিকে শুধুমাত্র
তক্তার উপর দিয়ে হাঁটিয়ে জলে ফেলে দেওয়া হত। কিন্তু তার হাত-পা কিছুই বাঁধা থাকত
না বলে জলে ভেসে থাকতে পারবে। কিন্তু জলে ভাসমান এইসব জাহাজের চারিপাশে সবসময় কিছু
হাঙ্গর ঘুরে বেড়াত, আর জলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই হাঙ্গরের বলি হত
এবং মৃত্যু কার্যকর হত।
(১১) মৃত্যু ঘটানোয় করাতের ব্যবহার : এই পদ্ধতি আগে চালু ছিল ইউরোপের বিভিন্ন
দেশ সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশগুলিতে। এক্ষেত্রে মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ
নগ্ন করে উলটো করে দুই পা দুই দিকে ফাঁক করে বেঁধে রাখা হত। এরপর মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত
ব্যক্তির যৌনাঙ্গ বরাবর করাত রেখে দেহকে মাঝ বরাবর কেটে ফেলা হত। আর উলটো করে করে
ঝোলানোর কারণে ব্যক্তিটির মস্তিষ্ক যথেষ্ট পরিমাণ রক্ত পেত, যাতে ব্যক্তিটি এই শরীরের মাঝ
বরাবর কেটে ফেলায় ব্যথা সম্পূর্ণটাই অনুভব করতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কাটার আগে
পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকতেন।
(১২) রিপাবলিকান বিবাহ : রিপাবলিকান বিবাহ (Republican Marriage) হল মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার এক অভিনব পদ্ধতি। এই পদ্ধতি হল একজন পুরুষ এবং
মহিলাকে নগ্ন করে এবং মুখোমুখি করে একসঙ্গে বেঁধে নদীর জলে ফেলে মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর করা হত। শুধুমাত্র ফ্রান্সে এই পদ্ধতি চালু ছিল।
(১৩) বেস্টিয়ারাই : বেস্টিয়ারাই (Bestiarii), আদি
রোমান সাম্রাজ্যের একটা ক্রীড়া। যেখানে বীরেরা হিংস্র প্রাণীর মুখোমুখি হয়ে তাদের পরাস্ত করত। কিন্তু এই ক্রীড়াকেও
ব্যাবহার করা হত মৃত্যুদন্ড কার্যকরের উপায় হিসাবে। যে সমস্ত ব্যক্তিদের
মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত তাদের সম্পূর্ণ নগ্ন করে ছেড়ে দেওয়া হত হিংস্র প্রাণীদের
মধ্যে এবং কোনোরূপ প্রতিরোধ ছাড়াই হিংস্র প্রাণীরা মেরে ফেলত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে এবং অবশ্যই খেয়ে
ফেলত। এই মৃত্যু দেখে এই ক্রীড়া দেখতে আসা দর্শকেরা উল্লাসে গলা ফাটাত। মৃত্যুও
শুধুমাত্র বিনোদন, ভাবা যায়!
(১৪) নিষ্পেষণ : নিষ্পেষণ (Crushing) পদ্ধতি মূলত
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার হত না, তবে যে
সকল ব্যক্তির উপর ব্যবহার করা হত তারা সকলেই মৃত্যুবরণ করত। এই পদ্ধতি চালু করা
হয়েছিল আমেরিকায়। আর সেখান থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এটির প্রসার ঘটে। তৎকালীন
সময়ে কোনো সাধারণ ব্যক্তি যদি কোনো
সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিশেষ ব্যক্তিদের দ্বারা দোষী হিসাবে আখ্যা পেত, তাহলে তাদের দিয়ে দোষ স্বীকার করানোর কাজেই ব্যাবহার করা হত এই পদ্ধতি।
এক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিটিকে মাটিতে শুইয়ে তার উপর ভারী বস্তু রাখা হত
এবং প্রতিবার তাকে তার দোষ স্বীকার করার কথা বলা হত। স্বীকার না-করা পর্যন্ত ওজন
বাড়িয়ে যাওয়া হত, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে মারা যায়। তবে দোষ
স্বীকার করলেও যে মুক্তি পেত তা নয়, সেই দোষের জন্য এবং সবাইকে
মিথ্যা বলার দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হত।
(১৫) সিমেন্টের জুতো : এই জুতো যেই সেই জুতো নয়, সিমেন্টের
তৈরি। এই পদ্ধতি অনেকটাই "রিপাবলিকান বিবাহ" পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড
কার্যকরের মতো,
অর্থাৎ নদীর জলে ডুবিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা। শুধু
পার্থক্য হল এখানে বিপরীত লিঙ্গের কারও সঙ্গে
না বেঁধে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির পায়ে পরিয়ে
দেওয়া হবে এই সিমেন্টের জুতো, যাতে ব্যক্তিটি জলের মধ্যে ভেসে
থাকতে না পারেন। এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সবচেয়ে বেশি প্রচলন ছিল
আমেরিকার মাফিয়াদের মধ্যে।
(১৬) রক্ত ঈগল : ফিনল্যান্ডে রক্তের ঈগল বা Blood Eagle পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রথা চালু ছিল। এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে দাঁড় করিয়ে টান টান করে বেঁধে তার
মেরুদণ্ড বরাবর কেটে তার বুকের পাজরের হাড় বের করে ভেঙে ঈগলের পাখার মতো মেলে রাখা
হত। এরপরে পিছন থেকে ফুসফুস বের করে রাখা হয়। এখানেই শেষ না, এর পরে বাইরে ঝুলে থাকা ফুসফুস এবং ক্ষত জায়গায় লবণ মাখিয়ে দেওয়া হত। এই
পদ্ধতিতে রক্তক্ষরণ কম হওয়ার কারণে ব্যক্তি অনেক সময় ধরে বেঁচে থাকত এবং মৃত্যুর
তীব্রতাও বৃদ্ধি পেত।
(১৭) ন্যায়ের ঝাঁকি : ন্যায়ের ঝাঁকি
বা Upright
Jerker পদ্ধতি প্রথম চালু হয় আমেরিকাতে। কিন্তু আমেরিকাতে বর্তমানে
এই পদ্ধতি নিষিদ্ধ হলেও বর্তমানে ইরানে এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা
হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে
প্রকাশ্যে গলায় দড়ি পরিয়ে দড়িটি উপরে দিকে টেনে তোলা হয়। দড়িটি তোলার সময় ঝাঁকি দেওয়া হয়, যাতে আসামির ঘাড় ছিঁড়ে যায়। দড়িটি তুলতে সাধারণত ক্রেন ব্যবহার করা হয়।
(১৮) মাজাটেল্লো : অত্যন্ত বীভৎস এই পদ্ধতি। মাজাটেল্লো বা Mazzatello হল এমনই একটি মৃত্যুদণ্ড প্রক্রিয়া। এ পদ্ধতি হল শহরের মাঝে উঁচু মঞ্চে
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আনা হয় এবং তার মাথায় কাঠের তৈরি এক হাতুড়ি দিয়ে জোড়ে
আঘাত করা হয়। তারপর আঘাতে আঘাতে মাথা থেঁতো করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হত।
অষ্টাদশ দশকের দিকে ইউরোপের যে সমস্ত দেশে যেখানে পোপের আইন চালু ছিল, সেখানেই এই প্রক্রিয়া চালু ছিল।
(১৯) জাফরি : জাফরি বা Gridiron পদ্ধতিতে
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে জ্বলন্ত কয়লার বিছানার উপর জোড় করে চেপে রাখা হত।
যতক্ষণ-না মৃত্যু না হত ততক্ষণ পর্যন্ত
এইভাবে জ্বলন্ত কয়লার বিছানায় শুইয়ে রাখা হত। এই পদ্ধতি বহুক্ষণ ধরে চলত। মৃত্যুও
আসত অনেক দেরিতে। তারপর শরীরের চামড়া পুড়ে সম্পূর্ণটাই কালো হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে
পড়ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি।
(২০) ক্যাথেরিনের চাকা : ক্যাথেরিনের চাকা বা Catherin Wheel বা Breaking
Wheel পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত
ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা। এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত
ব্যক্তিকে একটি চাকার সঙ্গে শক্ত করে
বাঁধা দেওয়া হয়। এরপর চাকাটি খুব জোরে
ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় জল্লাদ
ঘুরতে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে
শরীরে চাবুক বা লাঠি দিয়ে সজোরে উপর্যুপরি আঘাত করা হয়। এরপর জল্লাদ মোটা
লোহা দিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে হাতে আর পায়ে পেরেক পুঁতে দেয়। পুনরায় চাবুক আর লাঠি দিয়ে আঘাত দিতে শুরু করে
জল্লাদ। এরপর পেরেক পোঁতা অবস্থায় ব্যক্তিকে শহরের মাঝে জনসমক্ষে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যাতে সকলে এই নির্মমতা দেখতে পারে।
(২১) বাঁশ : এশিয়ার দেশগুলিতে একসময় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে বাঁশের
ব্যবহার হত। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার এক অভিনব এবং খুবই কষ্টদায়ক পদ্ধতি। এই
পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বাঁশের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রাখা হত।
যেহেতু বাঁশ গাছ অনেক তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায় (দৈনিক সর্বোচ্চ এক ফুটের মতো), তাই ধীরে ধীরে ছোটো বাঁশ ব্যক্তির দেহ ফুটো করে বের হয়ে যেত। এটি বেশ ধীরে হত
বলে ব্যক্তিটি অমানবিক যন্ত্রণা পেত এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হত।
(২২) সুড়সুড়ি : স্প্যানিসদের সুড়সুড়ি যন্ত্র বা Spanish Tickler বা বিড়ালের থাবা বা Cat's Paw পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড
পদ্ধতির উৎপত্তি স্প্যানিসে। এদের দ্বারাই ব্যবহৃত হওয়ার কারণে “স্প্যানিসদের সুড়সুড়ি যন্ত্র” নামেই বেশি পরিচিত।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে শক্ত করে বেঁধে রাখা হত শহরের জনবহুল এলাকায়। তারপর
জল্লাদ এই “সুড়সুড়ি দেওয়ার যন্ত্র” পরে যথেচ্ছ ভাবে ব্যক্তিটির
শরীরে আঁচড় দিত। এই আঁচড় যে সে আঁচড় নয়, এক্কেবারে শরীর থেকে
চামড়া আলাদা হয়ে যেত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মৃত্যু হত না এত সহজে। কিন্তু
যন্ত্রণা ভোগ করতে হত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির মৃত্যু হত মূলত রক্তক্ষরণের
কারণে। ইনফেকশনের কারণেও মৃত্যু হত।
(২৩) জীবিত কবর : প্রেমের অপরাধে আনারকলিকে জীবিত অবস্থায় কবর দেওয়া হচ্ছে, “মুঘল-ই-আজম”-এর এ দৃশ্যটি নিশ্চয় কেউ ভুলে যাননি। এমনই জীবিত কবর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতিটি ইতিহাসে অনেক
রাষ্ট্র গ্রহণ করেছিলেন। এই জীবিত অবস্থার কবর ঠিক আনারকলির মতো নয়। সাধারণত
বিদ্রোহীদের বা একাধিক হত্যাকারী বা ধর্ষণকারীদের এই ভাবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা
হত। সর্বশেষ এরকম কবর দেয় জাপানিরা, যখন তারা চিনে হামলা করেছিল তখন অনেক চাইনিজদের এইভাবে মৃত্যদণ্ড পদ্ধতি
প্রয়োগ করা হয়।
(২৪) বেঁধে পোড়ানো : খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পোড়ানো বা Burning at the Steak পদ্ধতিটি
মৃত্যুদণ্ড হিসাবে জনপ্রিয়(!) ছিল। মৃত্যদন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের একা অথবা একই
সঙ্গে অনেককে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হত। ১৬০০ সালে জিওনার্দো ব্রুনো
(১৫৪৮-১৬০০) নামে এক জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে রোমে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক
মতবাদকে সমর্থন করার 'অপরাধে' জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।
ব্রুনোকে আগুনে পোড়ানোর আগ পর্যন্ত চার্চ থেকে প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল যেন
তিনি কোপার্নিকাসের ভুল মতবাদ পরিত্যাগ করে বাইবেলের বিশ্বাসের সাথে সংগতিপূর্ণ
টলেমির 'পৃথিবী কেন্দ্রিক' মতবাদকে সত্য বলে মেনে নেন। বৈজ্ঞানিক
সত্যের প্রতি অবিচল ব্রুনো ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বরং
বিচারকদের দিকে তাকিয়ে অবিচলভাবে ব্রুনো উচ্চারণ করেছিলেন – “Perhaps you,
my judges, pronounce this sentence against me with greater fear than I recieve
it.” বোঝাই যাচ্ছে, ব্রুনোর নশ্বর দেহ যখন
আগুনের লালচে উত্তাপে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল, “ধর্ম
বেঁচে গেল”
ভেবে ধর্ম-ব্যবসায়ীরা কী উল্লাসই-না প্রকাশ করেছিল সেদিন।
তারপরেও ঈশ্বর এবং তার পুত্ররা সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণন শেষ পর্যন্ত কি
থামাতে পেরেছিলেন?
(২৫) নির্লজ্জ ষাঁড় : নির্লজ্জ ষাঁড় বা Brazen Bull পদ্ধতিতে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা আর-একটি অমানবিক পদ্ধতি। সিসিলির স্বৈরশাসক Akgragas এই পদ্ধতি প্রথম চালু করেছিলেন। পরামর্শদাতা ছিলেন তৎকালীন সময়ের ধাতু
কারুকার্যকর প্রিলিয়স (Prilios)। ধাতু দ্বারা নির্মিত এই
ষাঁড়কে এতটা বড়ো করে বানানো হত যেন এর পেটের মধ্যে একজন মানুষকে ঢোকানো সম্ভব হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ওই ষাঁড়ের পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে পেটের দিকে
আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হত। এর ফলে ষাঁড়ের ভিতরে থাকা ধীরে ধীরে সরাসরি আগুনে না ঝলসে আগুনের গনগনে
তাপে ব্যক্তিটির মৃত্যু হত। ষাঁড়টিকে এমনভাবে নির্মাণ করা হত যাতে ভিতরে পুড়তে
থাকা ব্যক্তিটির চিৎকার শুনে মনে হত যেন ষাঁড় চিৎকার করছে। পুড়তে থাকা ব্যক্তিটির ধোঁয়া ষাঁড়ের নাক দিয়ে বেরিয়ে আসত।
(২৬) লিং চি : লিং চি বা Ling Chi মৃত্যুদণ্ড পদ্ধতিটি
চিনে চালু ছিল। এই পদ্ধতিতে
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে লোকালয়ে এনে
বেঁধে ফেলত। এরপর একজন জল্লাদ বিশেষ ছুরি দিয়ে ব্যক্তির বিভিন্ন অঙ্গ তার দেহ থেকে
ধীরে ধীরে আলাদা করে দিত। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি যাতে দীর্ঘক্ষণ ধরে সর্বাধিক
যন্ত্রণা ভোগ করে সে ব্যাপারে নিশ্চিত করা ছিল জল্লাদের প্রধান উদ্দেশ্য। এ পদ্ধতি
কার্যকর করা হয় না।চিনেই ২০ সহস্রাব্দের শুরুতে এই পদ্ধতি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
(২৭) কলম্বিয়ার নেকটাই : এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় শুধুমাত্র
মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির গলা কাটা হয়, সেই
কাটা অংশ থেকে ব্যক্তির জিভ বের করে রাখা হয়। প্রকাশ্যে প্রদর্শনীর জন্যও রাখা হয়।
যাতে অন্যান্য মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয়। কলম্বিয়ার নেকটাই বা Colombian
Necktie পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতি এখনও কলম্বিয়া সহ
লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে।
(২৮) সেপপুকু : সেপপুকু বা Seppuku মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতি
আসলে আত্মহত্যার সামিল। জাপানের
সামুরাইদের মধ্যে বেশি প্রচলিত। এই পদ্ধতি মৃত্যুবরণ করা অনেকটা সন্মানের সঙ্গে
মৃত্যুবরণ করার পর্যায়ে পরে। সামুরাই নিজের তলোয়ার দিয়ে নিজের পেটে আঘাত করে নিজের
পেটের ভিতর দিয়ে নাড়িভুঁড়ি বাইরে বের করে নিয়ে আসে। সে সময় তার কাছের কোনো বন্ধু
তলোয়ার দিয়ে এক কোপে আত্মহত্যাকারীর মাথা শরীর থেকে পৃথকটা করে ফেলা হয়। এহেন
মৃত্যুবরণ করা অমানবিক মনে হলেও মৃত্যুবরণকারী সামুরাইয়ের কাছে এটি অনেক সন্মানের
সঙ্গে মৃত্যুবরণ করা এবং তার বন্ধুর কাছে বন্ধুর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো।
(২৯) ক্রুশকাঠে বিদ্ধ করা : ক্রুশকাঠে বিদ্ধ করে হত্যা বা Crucifixion যদিও ধর্মীয়ভাবে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের কাছে অনেক পবিত্র।মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত
সমস্ত ব্যক্তিকে এভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। এটি ছিল রোমানদের সব থেকে জনপ্রিয়
পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অনেক
অত্যাচার করা হয়। তারপর তাকে বাধ্য করা হত তাকে যে ক্রুশকাঠে ঝোলানো হবে সেই
ক্রুশকাঠটিকে নিজের কাঁধে করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
এরপর তাকে ক্রুশকাঠের উপর শুইয়ে তার দু-হাতের তালু বরাবর লোহার পেরেক পুঁতে দেওয়া
হয়। এছাড়াও তার দু-পা এক করে লোহার পেরেক পুঁতে দেওয়া হয় খুঁটির সঙ্গে। এভাবেই
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি ঝুলে থাকত মৃত্যু না-হওয়া পর্যন্ত। সাধারণত সপ্তাখানেক
সময় লাগত মৃত্যু হতে। মৃত্যু সম্পন্ন শ্বাস বন্ধ হয়ে। জিশুখ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়ে
মারা যান। এই ধারণা থেকেই খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের কাছে ক্রুশ একটি পবিত্র চিহ্ন বা
প্রতীক। কিন্তু খ্রিস্টজন্মের বহু আগে থেকেই রোমান সভ্যতায় খুঁজে পাওয়া যায় ইংরেজি
'T'
অক্ষর সদৃশ তিনবাহু বিশিষ্ট মানুষ হত্যা করার বিশেষ অস্ত্র
বিশেষ। উল্লেখ্য, 'T' থেকেই ক্রুশচিহ্ন এর সৃষ্টি হয়েছে এমন দাবি
কারও পক্ষেই জোর করে করা সম্ভব নয়। তবে দুটি প্রতীকের কাজের মিল এবং গাঠনিক মিল
বেশ স্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান। অনেকেই মনে করে থাকেন
জিশুখ্রিস্টর ক্রুসিফিকেশন ইতিহাসের প্রথম নির্মম হত্যাকাণ্ড। কিন্তু তাদের
এই ধারণা সম্পূর্ণই ভুল। আসিয়রিয়ান, গ্রিক এবং পারসিয়ান সভ্যতায়
ভুঁরি ভুঁরি উদাহারণ খুঁজে পাওয়া যায় ক্রুসিফিকেশন করে দেশদ্রোহী এবং ক্রীতদাসদের
হত্যা করার জন্য।
(৩০) বিষাক্ত ইনজেকশন : মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ব্যক্তিকে প্রথমে স্নান করিয়ে তার
শেষ খাবার দেওয়া হয় এবং তার নিজ ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করানো হয়। পরে তাকে একটা
ছোটো চেম্বারে নিয়ে একটা বিছানার সঙ্গে বাঁধা হয়। তার শরীরে দুটো নল ঢুকানো হয়
ইনজেকশনের মাধ্যমে। তার শরীরে প্রথমে সোডিয়াম থিওপেনটাল ৫০০০ মিলিগ্রাম দেওয়া হয়, যা এনেসথেসিয়ার কাজ করে। তারপরে পানকুরিয়াম ব্রোমাইড দেওয়া হয় ফুসফুস অবশ করার
জন্য। এর পরে দেওয়া হয় পটাশিয়াম ক্লোরাইড, হৃৎপিণ্ড
বন্ধ হওয়ার জন্য।
(৩১) পাথর নিক্ষেপ : এ পদ্ধতিতে
পুরুষের ক্ষেত্রে কোমর পর্যন্ত এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে বুক পর্যন্ত মাটিতে পোঁতা
হয়। কাছ থেকে মাঝারি সাইজের পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর করা হয়। পাথর যেন খুব বড়ো না হয়, যাতে হঠাৎ করেই ওই
ব্যক্তি মারা না যায়। তবে নিয়ম আছে যে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত
ব্যক্তি যদি পাথর নিক্ষেপের সময় গর্ত থেকে উঠে আসতে পারে, তবে তার মৃত্যুদণ্ড মকুব হয়ে
যাবে।
(৩২) বিষপান : বিষ পান করিয়েও অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হত। এ বিষয়ে
আমরা দার্শনিক সক্রেটিসের কথা মনে করতে পারি। গ্রিসের এথেন্সে তখনকার দিনের অন্যতম
রাজনীতিবিদ আনুতুস তাঁর বিরুদ্ধে মুখ্য অভিযোগ আনেন যে, তিনি
রাষ্ট্রের তরুণ সম্প্রদায়ের মনে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র এবং সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে
সন্দেহ,
অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধার ভাব সৃষ্টি করে চলেছেন৷ এসব অভিযোগে
অভিযুক্ত হয়ে তিনি বিচারকদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বিচারকদের বিচারে দোষী প্রমাণিত
হলে তার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। এথেন্সের কেন্দ্রবিন্দুতে বসেছে এ আদালত। আদালতের
বিচারক সংখ্যা ৫০০। বিচারকরা আসীন কাঠের বেঞ্চিতে। বিচারকদের চারপাশ ঘিরে উৎসুক
জনতার ভিড়। সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী তিন এথেনীয় নাগরিকও সেখানে হাজির। তিন
অভিযোগকারীকে তাদের অভিযোগ উত্থাপন করে বক্তব্য রাখার জন্য তিন ঘণ্টা সময় দেওয়া
হয়। এরপর সক্রেটিসকে সময় দেওয়া হবে তিন ঘণ্টা সময়, তার
বিরুদ্ধে অভিযোগ খণ্ডনের জন্য। বিচারকরা অভিযোগের সত্য-মিথ্যা নির্ধারণে ভোটের
মাধ্যমে তাদের রায় জানাবেন। বিচারকদের সামনে দুটি গোলাকার কলসি। একটিতে লেখা “guilty”, আর অপরটিতে “not guilty”। বিচারকরা তাদের ইচ্ছেমতো
যে-কোনো একটি কলসে তাদের নিজ নিজ চাকতি ফেলে সক্রেটিসের বিচারের রায় সমাধা করবেন।
এভাবে ভোটাধিকারভিত্তিক আদালতের রায়ে সক্রেটিসের পক্ষে ২২০ বিচারক ও বিপক্ষে ২৮০ বিচারকের
ভোট পড়ে। অতএব বিচারে সক্রেটিস দোষী সাব্যস্ত হন। এরপর এল সক্রেটিসের শাস্তি
নির্ধারণের পালা। অভিযোগকারী সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড দাবি করে। সক্রেটিসকে সুযোগ
দেওয়া হয়,
তার বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তি হতে পারে, সে ব্যাপারে পরামর্শ রাখার জন্য। অনেকে ধরে নিয়েছিলেন সক্রেটিস হয়তো বলবেন
তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে নির্বাসনে দেওয়া হোক। তা না-করে সক্রেটিস বরং সেদিন
বলেছিলেন,
তিনি ভণ্ড জ্ঞানীদের মুখোশ খুলে দিচ্ছেন। সক্রেটিসের নিজের
ভাষায় : “রাষ্ট্ররূপ মন্থরগতি অশ্বের জন্য আমি হচ্ছি বিধিদত্ত এক ড্যাঁশ পোকা।” অতএব তাকে পুরস্কৃত করাই উচিত। এমনি পরিস্থিতিতে তার ওপর চাপ আসে
বাস্তবভিত্তিক কোনো শাস্তির পরামর্শ দিতে। তখন তিনি চাপের মুখে বলেন, তাকে মোটা দাগে জরিমানা করা যেতে পারে। বিচারকরা শেষপর্যন্ত তার মৃত্যুদণ্ডই
ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার পর তাকে কাছাকাছি একটি কারাগারে নেওয়া হয়। এথেনীয় আইন
অনুযায়ী তার মৃত্যুদণ্ড সেখানেই কার্যকর করা হয়। আর সক্রেটিস নিজ হাতে হেমলক
বিষপানে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। মৃত্যুর আগে তিনি বিষপাত্র হাতে নিয়ে
বলেছিলেন : “I
to die, you to live, but only God knows who is correct.”
(৩৩) শূলে চড়ানো : ‘শূলে চড়ানো’ বা ‘শূলবিদ্ধ করা’ একটি প্রাচীন শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার
পদ্ধতি। নিঃসন্দেহে এটি ছিল ভয়াবহ ও বর্বরোচিত শাস্তি। প্রথম শূলে চড়ানোর ইতিহাস
পাওয়া যায় প্রাচীন নিকট প্রাচ্যে। সে সময় রাজদ্রোহীদের শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড
দেওয়া হত। তৎকালীন পারস্যের রাজা প্রথম দারায়ুস ব্যাবিলন জয় করার পর প্রায় ৩ হাজার
ব্যাবিলনবাসীকে শূলে চড়িয়েছিলেন। একটি সুচালো দণ্ড বা খুঁটিকে দেহের বিভিন্ন
ছিদ্রপথে বিশেষ করে পায়ুপথে প্রবেশ করানো হত। তারপর খুঁটিটিকে মাটিতে গেঁড়ে দেওয়া
হত। একসময় সুচালো অংশটি অপরাধীর শরীর ভেদ করে বুক অথবা ঘাড় দিয়ে বের হয়ে যেত।
অপরাধী ব্যক্তিটি এভাবে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। অনেক সময় খুঁটিটির মাথা
সুচালো না-করে ভোঁতা রাখা হত, যাতে হৃৎপিণ্ড বা অন্যান্য
প্রধান অঙ্গ বিদ্ধ হয়ে তাড়াতাড়ি মারা না যায়। এতে অপরাধী বেশি কষ্ট পেত। কেন-না
মারা যেতে কয়েক ঘণ্টা এমনকি একদিন সময়ও লাগত। শূলে চড়ানোর মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড
দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি কুখ্যাত ছিল প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ওয়ালেশিয়া রাজ্যের
যুবরাজ তৃতীয় ভ্লাদ যাকে বলা হয় ড্রাকুলা। তৎকালীন তুরস্কে এ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল।
তুর্কিদের হাতে একবার আটক হওয়ার সময় তৃতীয় ভ্লাদ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার এ পদ্ধতিটি
শিখে নেয়। ড্রাকুলা যুদ্ধবন্দি ও রাজদ্রোহীদের শূলে চড়াত সাধারণ প্রজাদের সামনেই, যাতে তারা ড্রাকুলাকে ভয় পায়। তার শত্রুদের জন্যও এটা ছিল তার ভয়াবহতার
ইঙ্গিত। তবে ড্রাকুলার শূলে চড়ানোর পদ্ধতি ছিল ভিন্নতর। পেট অথবা পিঠের মধ্য দিয়ে
সুচালো কোনো দণ্ড ঢুকিয়ে দিয়ে তা মাটিতে গেঁড়ে দেওয়া হত। এভাবে একসঙ্গে অনেক
মানুষকে শূলে চড়িয়েছেন ড্রাকুলা। আফ্রিকান উপজাতি জুলুদের মধ্যে শূলে চড়ানো
প্রচলিত ছিল। জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ায়ও
একসময় এ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। পাক-ভারত উপমহাদেশের মধ্যে ভারতের তামিলনাড়ু ও কেরালা
প্রদেশে নিকট অতীতে শূলে চড়ানোর মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত।
(৩৪) চূর্ণ বা পিষ্টকরণ : চূর্ণকরণ বা Crushing কোনো কিছু চাপা দিয়ে পিষ্ট করা ব্যাপারটা ইউরোপ, আমেরিকায়
বেশি প্রচলন ছিল। সাধারণত জোরপূর্বক কিছু আদায় করার ক্ষেত্রে তারা এই শাস্তিটি
ব্যবহার করত। এই পদ্ধতিতে বন্দিকে মাটির সঙ্গে শুইয়ে তার উপর কাঠের তক্তা রাখা হত
এবং কাঠের তক্তার উপর ভারী ভারী পাথর রাখা হত। ততক্ষণ পর্যন্ত এই শাস্তি চলতে থাকত
যতক্ষণ-না বন্দি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত। এছাড়া আরও একভাবে এটা করা হত।
(৩৫) বিশাল পাথর বেঁধে জলে নিক্ষেপ : প্রাচীনকালে অপরাধ করলে মৃত্যুদণ্ড
প্রাপ্ত ব্যক্তিকে সমুদ্র বা নদীর জলে ডুবিয়ে মারা হত। যাতে জলের উপর ভেসে উঠতে না
পারে এবং সাঁতরে পালিয়ে যেতে না পারে সে কারণে ব্যক্তির শরীরের সঙ্গে বিশাল পাথরের
চাঁই দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হত।সেই পাথরের ভারে ব্যক্তির দেহ জলের অতলে তলিয়ে যেত।
ভাগবতপুরাণে বর্ণিত হিরণ্যকশিপু-কায়াদু পুত্র প্রহ্লাদকে বিষ্ণুভক্ত হওয়ার অপরাধে
মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় পিতা হিরণ্যকশিপু স্বয়ং।কিন্তু যতবারই তিনি বালক
প্রহ্লাদকে বধ করতে যান, ততবারই বিষ্ণুর মায়াবলে
প্রহ্লাদের প্রাণ রক্ষা পায়। তারই মধ্যে প্রহ্লাদকে শরীরে পাথর বেঁধে জলে নিক্ষেপ
করা ছিল একটি উপায়। যদিও সব উপায়ই ব্যর্থ হয়েছিল গল্পের খাতিরে।
(৩৬) ঘোড়ার পিছনে বেঁধে : মধ্যযুগে রাজা সম্রাটরা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীর
দুই পায়ে শক্ত দড়ি বেঁধে সেই দুটি ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হত। এরপর ঘোড়া দুটিকে
ছুটিয়ে দেওয়া হত। দুটি ঘোড়া দু-দিকে তীব্র বেগে ছুটে যাওয়ার সময় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির পা ছিঁড়ে শরীর
দু-ভাগ হয়ে মারা যেত।
মানবসমাজে আসামীদের সর্বোচ্চ শাস্তি Capital Punishment হিসাবে বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত মৃত্যুদণ্ড। সর্বোচ্চ শাস্তি হিসাবে
মৃত্যুদণ্ড প্রথম কার্যকর করা হয় মিশরে খ্রিস্টপূর্ব ষোলো শতকে। তখন কুঠার দিয়ে
মুণ্ডচ্ছেদ করা হত। ১৭০০ সালে ব্রিটেনে সাধারণ অপরাধের জন্যও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ খ্রিস্টাব্দে কাদার মধ্যে পুঁতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করত
ব্রিটিশরা। ১৫৩১ সালে ব্রিটেনে নতুন আইনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় জীবন্ত সিদ্ধ
করে। ব্রিটিশ আমেরিকান কলোনীতে ১৬০৮ সালে প্রথম মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়
ভার্জিনিয়ার জর্জ কেন্ডাবালাকে। ১৯৭৭ সালে টেক্সাসে প্রথম বিষাক্ত ইনজেকশন পুশ করে
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এখন দেখি কোন্ দেশে কী ধরনের মৃত্যুদণ্ডের প্রচলন আছে।
(১) শিরচ্ছেদ - সৌদি আরব, কাতার। (২) ইলেকট্রিক চেয়ার -
আমেরিকা,
ফিলিপাইন। (৩) ধাক্কা মেরে পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়া - ইরান, চিলি। (৪) গ্যাস চেম্বার – আমেরিকা। (৫) ফাঁসি - আমেরিকা, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, মঙ্গোলিয়া,
জাপান, পাকিস্তান,ভারত,
মিশর, ফিলিপনস, সিঙ্গাপুর,
লাইবেরিয়া, কোরিয়া, বাংলাদেশ
সহ অনেক দেশে। (৬) ইনজেকশন - আমেরিকা, ফিলিপিনস, গুয়েতমালা,
থাইল্যান্ড, চিন, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম। (৭) ফায়ারিং স্কোয়াড - আমেরিকা, চিন, ভিয়েতনাম,
রাশিয়া, লেবানন সহ অনেক দেশে। (৮)
ছুরিকাঘাত –
সোমালিয়া ইত্যাদি।
শুধু সেই রাষ্ট্রের বিচার-ব্যবস্থাই নরহত্যায় সামিল হয় তা নয়, রাষ্ট্রের যন্ত্র তথা পুলিশ মায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সমস্ত শাখাই নরহত্যা করে
থাকে নির্বিচারে।পুলিশী হেফাজতে কত অভিযুক্তকে বিচারের আগে মেরে ফেলা হচ্ছে, তার হিসাব কে রেখেছে! সেনাবাহিনীর কর্মীরা বিনা প্ররোচনায় মানুষ হত্যা করে।
সেইরকমই এক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আজও প্রায় ১২ বছর ধরে শর্মিলা চানু অনশন চালিয়ে
যাচ্ছে।
থানা,
অর্থাৎ পুলিশ স্টেশনের কাছাকাছি যাদের বাড়ি তাদের প্রত্যেরই
নিশ্চয় পুলিসের হেফাজতে থাকা ধৃত ব্যক্তির আর্তনাদ শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তারপর
পরের দিন সকালে খবরের কাগজে পুলিশের বয়ানে আষাঢ়ে গল্পও পড়েছেন।আষাঢ়ে গল্প এক : ধৃত
ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছে। আষাঢ়ে গল্প দুই : এনকাউন্টারে মৃত্যু। সবাই যে এ ঢপের
গপ্পো বিশ্বাস করে তা নয়। ফলে তারা ঘেরাও করে, ওসির
শাস্তির দাবি করে।দু-চারদিন সেই প্রতিবাদের থাকে। তারপর সব শান্ত, যেন কিছুই হয়নি। অজানা থেকে যায় অত্যাচারী খুনী পুলিশের শাস্তি হল কি না।
সকলের কাছে এটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয় যে, পুলিশ
ধৃত ব্যক্তিকে মারধোর করবেই এবং তা অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার স্বার্থে। তাই
বলে মেরে ফেলবে ধৃত ব্যক্তিকে, তাও বিনা বিচারে?
পুলিশ মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে? পুলিশের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অধিকার আছে? প্রশ্ন অনেক হলেও উত্তর একটাই : না। কারণ আইনের রক্ষক পুলিশ বাহিনীও আইনের
অধীন। মূলত দুটি আইনের সাহায্যে পুলিশ ‘শান্তি-শৃঙ্খলা’ বজায় রাখে। (১) ভারতীয় দণ্ডবিধি বা ইন্ডিয়ান পেনাল কোড ও (২) সংশোধিত ফৌজদারি
কার্যবিধি,
১৯৭৩ বা ক্রিমিন্যাল প্রসিডিওর কোড। এই আইনে ধৃত ব্যক্তির
উপর নির্যাতনের কোনো অধিকার দেওয়া হয়নি পুলিশকে, কোনো
অবস্থাতেই নয়। তা সত্ত্বেও পুলিশ ধৃত ব্যক্তিকে যথেষ্ট বলপ্রয়োগ ও মারধোর করে।
ভারতীয় দণ্ডবিধি ৩৩০, ৩৩১ ধারায় ও ফৌজদারি কার্যবিধি ১৯৭ ধারায়
পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তির বন্দোবস্ত করা আছে। ‘অপরাধ
স্বীকৃতি আদায়ের জন্য’ শারীরিক আঘাত বা ক্ষত সৃষ্টি করা পুলিশের
অপরাধ। সেক্ষেত্রে পুলিশের সাত বছর কারাদণ্ড হতে পারে। ধৃত ব্যক্তি যদি গুরুতর আহত
হন তাহলে সেক্ষেত্রে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। আবার শারীরিক নির্যাতন না
করেও যদি নির্যাতনের ভয়ও দেখানো হয় তাহলে তাও নির্যাতন করার অপরাধ হিসাবে গণ্য
হবে। ১৯৮৯ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখে রাষ্ট্রপুঞ্জের পৃষ্ঠপোষকতায় জেনেভায়
অনুষ্ঠিত মানবাধিকার কমিশনের ৪৫ তম অধিবেশনে ভারত সরকারের প্রতিনিধি ও সংসদ সদস্য
এস এস আলুওয়ালিয়া তাঁর ভাষণে বলেন—“নিপীড়ন হচ্ছে সবচেয়ে জঘন্যতম
মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমরা এও মনে করি যে, নিপীড়নের বিভিন্ন পদ্ধতি
আছে। বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার জন্য এই ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, যা সাংবিধানিক সমানাধিকারকে লঙ্ঘন করে।জঘন্যতম অত্যাচারগুলি সংঘটিত হয় টর্চার
সেলে বা জেলখানায় ……… ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অথবা বাঁচার অধিকার
ভারতীয় সংবিধানে সকল নাগরিককে অর্পণ করেছে ……….ভারতের
আইনবিধিতে পুলিশ কর্তৃক ধৃত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পলায়নরত
অথবা বাধাদানকারী ধৃত ব্যক্তিকেও পুলিশ হত্যা করতে পারে না।……..জেরার সময় বন্দি ধৃতের উপর পুলিশ অফিসার ‘থার্ড
ডিগ্রি’
পদ্ধতি গ্রহণ না করে তার জন্য বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকার
নির্দেশ দিয়েছে।”
শুধু আইন নয়, সারা বিশ্বের কাছে ভারত সরকার ১৯৪৮ সালে ১০ই
ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘের দফা মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষর করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, সেই সনদের ৫ ধারা (“No one shall be subjected to torture or to cruel,
inhuman or degrading treatment or punishment.”) অনুসারে
ভারতে কোনো বন্দিকে কোনো ধরনের নির্যানত করা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি ও মানবাধিকার
লঙ্ঘন। মনে রাখা প্রয়োজন, নির্দিষ্ট বিধি মেনে পুলিশ কোনো
ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা মানেই সে ‘দোষী’ বা ‘অপরাধী’
নয়।যতদিন-না পর্যন্ত আদালতে ধৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ
পুলিশ প্রমাণ করতে না-পারছে ততদিন পর্যন্ত ধৃত ব্যক্তি নিরপরাধ এবং সেই নিরপরাধকে
অত্যাচারকরা সর্বাধিক ১৫ দিনের পুলিশ হাজতে শুধু বেআইনি নয়, তার ব্যক্তিসত্তার উপর চরমতম আঘাত। কারণ পুলিশ সাজা দেওয়ার অধিকারী নয়। সাজা
দেওয়ার একমাত্র অধিকার আছে আদালতের।
কলকাতার টালিগঞ্জে ‘রিট্রিট’ নামে অত্যাচার গৃহ আছে। খোদ লালবাজার সহ ভারতের সর্বত্র থানা লক আপে পুলিশ
কর্তৃক ধৃতদের উপর বীভৎস অত্যাচার চলে।নানা কায়দায় নির্যাতন করে বহু ধৃত ব্যক্তিকে
অত্যাচার করা হয়। অমানুষিক অত্যাচারের ফলে ধৃতব্যক্তি মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ে।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ট্রেনিং স্কুলে পুলিশ প্রশিক্ষণের সময় ‘থার্ড ডিগ্রি’ কায়দায় অত্যাচারের যে ফিরিস্তি পেশ করা
হয়েছে,
তা জানলে শিউরে উঠতে হয়। এলোপাথারি মারধোর করা, শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া, খাবার ও জল না দেওয়া এবং ঘুমোতে
না দেওয়া,
পেচ্ছাব খেতে বাধ্য করা, ইলেকট্রিক
শক দেওয়া,
উলঙ্গ করিয়ে ভিড় রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া, বাঁশকল করে মাথা নিচু করে ঝুলিয়ে আগাপাশতলা পেটানো, দু-পায়ে
দড়ি বেঁধে মাথা নিচের দিক করে দীর্ঘক্ষণ ঝুলিয়ে রাখা, গরম
জলের বোতল দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া, হাত-পা বেঁধে পাজামার ভিতর
আরশোলা বা ইঁদুর ঢুকিয়ে দেওয়া, দু-পায়ে দড়ি বেঁধে মাথা নিচের
দিক করে দীর্ঘক্ষণ ঝুলিয়ে রাখা অবস্থায় মাথা বস্তা বেঁধে দেওয়া হয় এবং বস্তার ভিতর
জ্যান্ত ইঁদুর বা আরশোলা ছেড়ে দেওয়া হয়, মলদ্বারের ভিতর কাঠি বা
বিদ্যুৎবাহী তার ঢুকিয়ে দেওয়া, দাড়ি বা চুল উপড়ে ফেলা, এক পায়ে এক হাত তুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা, ইংরেজি
Z-এর মতো ত্রিভঙ্গ অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা হামাগুড়ি দেওয়ানো, ধৃত বন্দির শরীরে পেট্রোল অথবা কেরোসিন অথবা অ্যাসিড সিরিঞ্জ দিয়ে পুশ করা
ইত্যাদি। এইরকম অমানুষিক অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেক ধৃত ব্যক্তি মারা
যান। ধৃত ছেড়ে দেওয়ার বাহানা করে মাঝরাতে লকআপ থেকে বের করে নির্জন জায়গায় নিয়ে
গিয়ে গুলি মেরে ফেলার অভিযোগও পুলিশের বিরুদ্ধে আছে।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এ এন মোল্লা ১৯৬৪ সালে জনৈক পুলিশ
অফিসার নঈমের বিরুদ্ধে জনৈক ভারতীয় নাগরিকের মামলার রায়ে বলেছিলেন : “সমস্ত দায়িত্ব নিয়েই আমি একথা বলতে পারি যে, সারা
দেশে এমন কোনো গোষ্ঠী নেই যাদের অপরাধের খতিয়ান ধারে কাছেও যেতে পারে সেই সংগঠিত
গুণ্ডাবাহিনীর,
যার নাম কিনা ভারতীয় পুলিশ বাহিনী।”
পুলিশ মানুষ হত্যা করে। অসহায় ধৃতদের নির্বিবাদে হত্যা করে। বিচারে ধৃতের
বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই হত্যা করে।বস্তুত ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর কাছে
ক্ষমতা বুঝে নেওয়ার পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘লৌহমানব’ বল্লভভাই প্যাটেল উচ্চকিত কণ্ঠে বলেছিলেন – “এতদিন
আমরা যে পুলিশ বাহিনীর সমালোচনা করেছিলাম, সে
অন্য পুলিশ। আর এখনকার পুলিশ হল স্বেচ্ছাসেবক……”। তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে গঙ্গা-যমুনা-কৃষ্ণা-গোদাবরী দিয়ে। ভারতের অন্য
রাজ্যের কথা কথা তো বাদই দিলাম। শুধু পশ্চিমবঙ্গে খুনি পুলিশবাহিনীদের ট্র্যাক
রেকর্ড দেখলে চমকে যেতে হয়।
যত দিন যাচ্ছে ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের পুলিশের নিশানা ততই
অব্যর্থ হয়ে উঠছে। মাথা, বুক, পেট
ভেদ করে তপ্ত সিসা অনেকদিন আগেই জানিয়ে দিয়েছে – প্রতিবাদ
করলেই মৃত্যু,
অধিকারের কথা বললেই বিচ্ছিন্নতাবাদী, মুখ খুললেই দেশদ্রোহিতা। অতএব চুপ করে থাকো সবাই। কথা বললেই গুম। বিরোধিতা
করলেই বিনাশ।অনুগত হও। অনুগত হও। অনুগত হও। বেগড়বাই করলেই রাষ্ট্রের অঙ্গুলি হেলনে
অন্তরীণ। গণতন্ত্রে মানুষের কথাই শেষ কথা, মানুষের হৃদয়ের ভাষাই রাষ্ট্রের ভাষা – এই পরম
সত্যটিকে বিদ্রূপ করতেই যেন পুলিশের কথাই শেষ কথা। পুলিশ-হাজতে বা তত্ত্বাবধানে
ধৃত ব্যক্তিদের মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে, তা
মানবসভ্যতার অপমৃত্যুকেই ডেকে আনছে।
১৯৪৭ সালের ১০ নভেম্বর। ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের বয়স তখন মাত্র তিন মাস। আমরা সেদিন প্রথম বুঝলাম শাসক বিদেশি না
স্বদেশি সেটা কোনো বিষয় নয় – শাসক শাসকই হয়। বিদেশিই হোক
অথবা স্বদেশি –
আসল বিষয় ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতার হস্তান্তর।ব্রিটিশদেরই তৈরি
‘স্পেশাল পাওয়ার বিল’ (এ বিল মানুষকে অবাধে খুন করার
বিল বা ছাড়পত্র) প্রত্যাহারের দাবিতে মিছিল বের করেছিল একদল ভারতীয় নাগরিক ভারতের
মাটিতেই।সম্পূর্ণ নিরীহ ওই মিছিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল স্বাধীন ভারতের স্বদেশি
পুলিশের গুলি।অকুস্থলে লুটিয়ে পড়ল আরডব্লিউএসির স্বেচ্ছাসেবক জনৈক শিশির মণ্ডল।
স্বাধীন দেশের স্বদেশি পুলিশের বন্দুকবাজির প্রথম শিকার।১৯৫৯ এবং ১৯৬৬ সালে
ভারতবাসী দু-দফায় খাদ্য আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ভংয়কর দানবীয় রূপ প্রত্যক্ষ
করেছিল। এ বছরেই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে দশ হাজারের বেশি
ছাত্রছাত্রীর এক বিশাল মিছিলের উপর পুলিশের গুলি চালায়। নির্বিচারে এই গুলি বর্ষণে
মৃত্যু হয় ১১ জনের। ৩ সেপ্টেম্বর আবার গুলি চলল কোলকাতা, হাওড়া
ও ২৪ পরগণায় –
মৃত্যু হল ১৫ জনের। পরের দিন আবার গুলিবর্ষণ। মৃ্ত্যু হল ১০ জনের। সব মিলিয়ে এক সপ্তাহে পুলিশ হত্যা করেছিল প্রায় ৮০ জনকে।
এলো ১৯৬৭ সাল। তৎকালীন মন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোঙারের জ্ঞাতসারে যুক্তফ্রন্টের
পুলিশ গুলি চালিয়ে সাতজন কৃষক মহিলাকে হত্যা করল। এদের মধ্যে একজনের পিঠে বাঁধা
ছিল এক দুধের শিশু। পুলিশের গুলি মাকে হত্যা করে শিশুটিকেও এফোঁড় ওফোঁড় করে
দিয়েছিল। সত্তর দশকে শুধুমাত্র কলকাতার বুকেই ১৭৮৩ জন যুবককে হত্যা করেছিল পুলিশ।
সে সময় নকশাল মানেই সে বধযোগ্য। ‘এনকাউন্টার’-এর নামে পুলিশ ঠান্ডা মাথায় হাজার হাজার যবককে হত্যা করেছিল।সত্তরের দশক ছিল
নরমেধ যজ্ঞের দশক। পুলিশের গলিতে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছিল এক সমমভাবনাময় তরুণ
প্রজন্মকে। মরিচঝাঁপির নিরীহ অসহায় মানুষদের পুড়িয়ে গণহত্যা, আনন্দমার্গীদের গণহত্যা, নন্দীগ্রামের গণহত্যার ঘটনাগুলির মতো
এরকম অজস্র ঘটনা আছে, সেগুলি পরপর সাল-তারিখ দিয়ে আলোচনা করলে
একটা গোটা মহাভারতে আঁটবে না।
Supreme
Court of India ধৃতের উপর পুলিশের অত্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর একটি JUDGMENT
দিলেন (Shri D.K. Basu,Ashok K. Johri vs State
Of West Bengal,State Of U.P on 18
December, 1996)। আমি পাঠকদের জ্ঞাতব্যের জন্য হুবহু তুলে ধরলাম।
WITH WRIT PETITION (CRL) NO. 592 OF 1987
J U D G M E N T DR. ANAND, J.
The Executive Chairman, Legal Aid Services, West Bengal, a
non-political organisation registered under the Societies Registration Act, on 26th August, 1986 addressed a letter
to the Chief Justice of India drawing his attention to certain news items
published in the Telegraph dated 20, 21 and 22 of July, 1986 and in the
Statesman and India express dated 17th August, 1986 regarding deaths in police lock-ups and custody. The Executive
Chairman after reproducing the new items submitted that it was imperative to
examine the issue in depth and to develop "custody jurisprudence" and
formulate modalities for awarding compensation to the victim and/or family
members of the victim for attrocities and death caused in police custody and to
provide for accountability of the efforts are often made to hush up the matter
of lock-up deaths and thus the crime goes unpunished and
"flourishes". It was requested that the letter alongwith the new
items be treated as a writ petition under "public interest litigation"
category.
Considering the importance of the issue raised in the letter
being concerned by frequent complaints regarding custodial violence and deaths
in police lock up, the letter was treated as a writ petition and notice was
issued on 9.2.1987 to the
respondents.
In response to the notice, the State of West Bengal filed a
counter. It was maintained that the police was no hushing up any matter of
lock-up death and that whereever police personnel were found to be responsible
for such death, action was being initiated against them. The respondents
characterised the writ petition as misconceived, misleading and untenable in
law.
While the writ petition was under consideration a letter
addressed by Shri Ashok Kumar Johri on 29.7.87 to the Hon'ble Chief Justice of India drawing the attention of
this Court to the death of one Mahesh Bihari of Pilkhana, Aligarh in police
custody was received. That letter was also treated as a writ petition and was
directed to be listed alongwith the writ petition filed by Shri D.K. Basu. On 14.8.1987 this Court made
the following order :
"In almost every
states there are allegations and these allegations are now increasing in
frequency of deaths in custody described generally by newspapers as lock-up
deaths. At present there does not appear to be any machinery to effectively
deal with such allegations. Since this is an all India question concerning all
States, it is desirable to issues notices to all the State Governments to find
out whether they are desire to say anything in the matter. Let notices issue to
all the State Governments. Let notice also issue to the Law Commission of India
with a request that suitable suggestions may be returnable in two months from
today."
In response to the notice, affidavits have been filed on behalf
of the States of West Bengal, Orissa, Assam Himachal Pradesh, Madhya Pradesh,
Harayana, Tamil Nadu, Meghalaya, Maharashtra and Manipur. Affidavits have also
been filed on behalf of Union Territory of Chandigarh and the Law Commission of
India.
During the course of hearing of the writ petitions, the Court
felt necessity of having assistance from the Bar and Dr. A.M. Singhvi, senior
advocate was requested to assist the Court as amicus curiae.
Learned counsel appearing for different States and Dr. Singhvi,
as a friend of the court. presented the case ably and though the effort on the
part of the States initially was to show that "everything was well"
within their respective States, learned counsel for the parties, as was
expected of them in view of the importance of the issue involved, rose above
their respective briefs and rendered useful assistance to this Court in
examining various facets of the issue and made certain suggestions for
formulation of guidelines by this court to minimise, if not prevent, custodial
violence and kith and kin of those who die in custody on account of torture.
The Law Commission of India also in response to the notice issued
by this Court forwarded a copy of the 113th Report regarding "injuries in police custody and
suggested incorporation of Section 114-B in the India Evidence Act."
The importance of affirmed rights of every human being need no
emphasis and, therefore, to deter breaches thereof becomes a sacred duty of the
Court, as the custodian and protector of the fundamental and the basic human
rights of the citizens. Custodial violence, including torture and death in the
lock ups, strikes a blow at the Rule of Law, which demands that the powers of
the executive should not only be derived from law but also that the same should
be limited by law. Custodial violence is a matter of concern. It is aggravated
by the fact that it is committed by persons who are supposed to be the
protectors of the citizens. It is committed under the shield of uniform and
authority in the four walls of a police station or lock-up, the victim being
totally helpless. The protection of an individual from torture and abuse by the
police and other law enforcing officers is a matter of deep concern in a free
society. These petitions raise important issues concerning police powers,
including whether monetary compensation should be awarded for established
infringement of the Fundamental Rights guaranteed by Articles 21 and 22 of the
Constitution of India. The issues are fundamental.
"Torture" has
not been defined in Constitution or in other penal laws. 'Torture' of a human
being by another human being is essentially an instrument to impose the will of
the 'strong' over the 'weak' by suffering. The word torture today has become
synonymous wit the darker side of human civilisation.
"Torture is a wound
in the soul so painful that sometimes you can almost touch it, but it is also
so intangible that there is not way to heal it. Torture is anguish squeezing in
your chest, cold as ice and heavy as a stone paralyzing as sleep and dark as
the abyss.
Torture is despair and
fear and
rage and hate. It
is a desire to
kill and
destroy including
yourself."
Adriana P. Bartow
No violation of any one of the human rights has been the subject
of so many Conventions and Declarations as 'torture'- all aiming at total
banning of it in all forms, but inspite of the commitments made to eliminate
torture, the fact remains that torture is more widespread not that ever before,
"Custodial torture" is a naked violation of human dignity and
degradation with destroys, to a very large extent, the individual personality.
IT is a calculated assault on human dignity and whenever human dignity is
wounded, civilisation takes a step backward-flag of humanity must on each such
occasion fly half-mast.
In all custodial crimes that is of real concern is not only
infliction of body pain but the mental agony which a person undergoes within
the four walls of police station or lock-up. Whether it is physical assault or
rape in police custody, the extent of trauma a person experiences is beyond the
purview of law.
"Custodial
violence" and abuse of police power is not only peculiar to this country,
but it is widespread. It has been the concern of international community
because the problem is universal and the challenge is almost global. The
Universal Declaration of Human Rights in 1984, which market the emergency of worldwide trend of protection and
guarantee of certain basic human rights, stipulates in Article 5 that "No one
shall be subjected to torture or to curel, inhuman or degrading treatment or
punishment." Despite the pious declaration, the crime continues unabated,
though every civilised nation shows its concern and takes steps for its
eradication.
In England, torture was once regarded as a normal practice to ger
information regarding the crime, the accomplices and the case property or to
extract confessions, but with the development of common law and more radical
ideas imbibing human though and approach, such inhuman practices were initially
discouraged and eventually almost done away with, certain aberrations here and
there notwithstanding. The police powers of arrest, detention and interrogation
in England were examined in depth by Sir Cyril Philips Committee- 'Report of a
Royal Commission on Criminal Procedure' (command - Paper 8092 of 1981). The
report of the Royal Commission is, instructive. In regard to the power of
arrest, the Report recommended that the power to arrest without a warrant must
be related to and limited by the object to be served by the arrest, namely, to
prevent the suspect from destroying evidence or interfering with witnesses or
warning accomplices who have not yet been arrested or where there is a good
reason to suspect the repetition of the offence and not to every case
irrespective of the object sought to be achieved.
The Royal Commission suggested certain restrictions on the power
of arrest on the basis of the `necessity principle'. The Royal commission said
:
".... We recommend that
detention upon arrest for a offence should continue only on one or more of the
following criteria :
(a) the person`s`s
unwillingness to identify himself so that summons may be served upon him;
(b) the need to
prevent the continuation or repetition of that offence;
(c) the need to
protect the arrested person`s himself or other persons or property;
(d) the need to
secure or preserve evidence of or relating to that offence or to obtain such
evidence from the suspect by questioning him; and
(e) the likelihood
of the person`s failing to appear at court to answer anycharge made against
him." The Royal Commission also suggested :
"To help to reduce
the use of arrest we would also propose the introduction here of a scheme that
is used in Ontario enabling a police officer to issue what is called an
appearance notice. That procedure can be used to obtain attendance at the
police station without resorting to arrest provided a power to arrest exists,
for example to be finger printed or to participate in an identification parade.
It could also be extended to attendance for interview at a time convenient both
to the suspect and to the police officer investigating the case...."
The power of arrest, interrogation and detention has now been
streamlined in England on the basis of the suggestions made by the Royal
Commission and incorporated in police and Criminal Evidence Act, 1984 and the incidence
of custodial violence has been minimised there to a very great extent.
Fundamental rights occupy a place of pride in the India
Constitution. Article 21 provides
"no person shall be deprived of his life or personal liberty expect
according to procedure established by law". Personal liberty, thus, is a
sacred and cherished right under the Constitution. The expression "life of
personal liberty" has been held to include the right to live with human
dignity and thus it would also include within itself a guarantee against
torture and assault by the State or its functionaries. Article 22 guarantees
protection against arrest and detention in certain cases and declares that no
person who is arrested shall be detained in custody without being informed of
the grounds of such arrest and the shall not be denied the right to consult and
defend himself by a legal practitioner of his choice. Clause (2) of Article 22 directs that the
person arrested and detained in custody shall be produced before the nearest
Magistrate within a period of 24 hours of such arrest, excluding the time necessary for the
journey from the place of arrest to the court of the Magistrate. Article 20(3) of the Constitution
lays down that a person accused of an offence shall not be compelled to be a
witness against himself. These are some of the constitutional safeguard
provided to a person with a view to protect his personal liberty against and
unjustified assault by the State, In tune with the constitutional guarantee a
number statutory provisions also seek to project personal liberty, dignity and
basic human rights of the citizens. Chapter V. of Criminal Procedure Code, 1973 deals with the
powers of arrest of a person and the safeguard which are required to be
followed by the police to protect the interest of the arrested person. Section 41, Cr. P.C. confers
powers on any police officer to arrest a person under the circumstances
specified therein without any order or a warrant of arrest from a Magistrate.
Section 46 provides the
method and manner of arrest. Under this Section no formality is necessary while
arresting a person. Under Section 49, the police is not permitted to use more restraint than is
necessary to permitted to use more restraint than is necessary to prevent the
escape of the person. Section 50 enjoins every police officer arresting any person without
warrant to communicate to him the full particulars of the offence for which he
is arrested and the grounds for such arrest. The police officer is further
enjoined to inform the person arrested that he is entitled to be released on
bail and he may arrange for sureties in the event of his arrest for a
non-bailable offence. Section 56 contains a mandatory provision requiring the police officer
making an arrest without warrant to produce the arrested person before a
Magistrate without unnecessary delay and Section 57 echoes Clause (2) of Article 22 of the Constituion of India. There are some other provisions
also like Section 53, 54 and 167 which are aimed at
affording procedural safeguards to a person arrested by the police. Whenever a
person dies in custody of the police, Section 176 requires the Magistrate to hold and enquiry into the cause of
death.
However, inspite of the constitutional and statutory provisions
aimed at safeguarding the personal liberty and life of a citizen, growing
incidence of torture and deaths in police custody has been a disturbing factor.
Experience shows that worst violations of human rights take place during the
course of investigation, when the police with a view to secure evidence or
confession often resorts to third degree methods including torture and adopts
techniques of screening arrest by either not recording the arrest or describing
the deprivation of liberty merely as a prolonged interrogation. A reading of
the morning newspapers almost everyday carrying reports of dehumanising
torture, assault, rape and death in custody of police or other governmental
agencies is indeed depressing. The increasing incidence of torture and death in
custody has assumed such alarming proportions that it is affecting the
creditibility of the Rule of Law and the administration of criminal justice
system. The community rightly feels perturbed. Society's cry for justice
becomes louder.
The Third Report of the National Police Commission in India
expressed its deep concern with custodial demoralising effect with custodial
torture was creating on the society as a whole. It made some very useful
suggestions. It suggested :
".......An arrest
during the investigation of a cognizable case may be considered justified in
one or other of the following circumstances :-
(1) The case involves a
grave offence like murder, dacoity, robbery, rape etc., and it is necessary to
arrest the accused and bring his movements under restraint to infuse confidence
among the terror stricken victims.
(ii) The accused is
likely to abscond and evade the processes of law.
(iii) The accused is
given to violent behaviour and is likely to commit further offences unless his
movements are brought under restraint.
(iv) The accused is
a habitual offender and unless kept in custody he is likely to commit similar
offences again. It would be desirable to insist through departmental
instructions that a police officer making an arrest should also record in the
case diary the reasons for making the arrest, thereby clarifying his conformity
to the specified guidelines......"
The recommendations of the Police Commission (supra) reflect the
constitutional concomitants of the fundamental right to personal liberty and
freedom. These recommendations, however, have not acquired any statutory status
so far.
This Court in Joginder Kumar Vs. State [1994 (4) SCC, 260] (to
which one of us, namely, Anand, J. was a party) considered the dynamics of
misuse of police power of arrest and opined :
"No arrest can be
made because it is lawful for the police officer to do so. The existence of the
power of arrest is one thing. The justification for the exercise of it is quite
another...No. arrest should be made without a reasonable satisfaction reached
after some investigation about the genuineness and bonafides of a complaint and
a reasonable belief both as to the person's complicity and even so as to the
need to effect arrest. Denying person his liberty is a serious matter."
Joginder Kumar's case (supra) involved arrest of a practising
lawyer who had bee called to the police station in connection with a case under
inquiry on 7.1.94. On not receiving
any satisfactory account of his whereabouts, the family member of the detained
lawyer preferred a petition in the nature of habeas corpus before this Court on
11.1.94 and in compliance
with the notice, the lawyer was produced on 14.1.94 before this court the police version was that during 7.1.94 and 14.1.94 the lawyer was not
in detention at all but was only assisting the police to detect some cases. The
detenue asserted otherwise. This Court was not satisfied with the police version.
It was noticed that though as on that day the relief in habeas corpus petition
could not be granted but the questions whether there had been any need to
detain the lawyer for 5 days and if
at all he was not in detention then why was this Court not informed. Were
important questions which required an answer. Besides, if there was detention
for 5 days, for what
reason was he detained. The Court' therefore, directed the District Judge,
Ghaziabad to make a detailed enquiry and submit his report within 4 weeks. The Court
voiced its concern regarding complaints of violations of human rights during
and after arrest. It said:
"The horizon of
human rights is expanding. at the same time, the crime rate is also increasing,
Of late, this Court has been receiving complaints about violations of human
rights because of indiscriminate arrests. How are we to strike a balance
between the two?
................................... A realistic approach should be made in this direction. The law of
arrest is one of balancing individual rights, liberties and privileges, on the
one hand, and individual duties, obligations weighing and balancing the rights,
liberties and privileges of he single individual and those of individuals
collectively; of simply deciding what is wanted and where to put the weight and
the emphasis; of deciding with comes first-the criminal or society, the law
violator or the abider....."
This Court then set down certain procedural
"requirements" in cases of arrest.
Custodial death is perhaps one of the worst crimes in a civilised
society governed by the Rule of Law. The rights inherent in Articles 21 and 22(1) of the Constitution
required to be jealously and scrupulously protected. We cannot wish away the
problem. Any form of torture of cruel, inhuman or degrading treatment would
fall within the inhibition of Article 21 of the Constitution, whether it occurs during investigation,
interrogation or otherwise. If the functionaries of the Government become law
breakers, it is bound to breed contempt for law and would encourage lawlessness
and every man would have the tendency to become law unto himself thereby
leading to anarchanism. No civilised nation can permit that tp happen. Does a
citizen shed off his fundamental right to life, the moment a policeman arrests
him? Can the right to life of a citizen be put in abeyance on his arrest? These
questions touch the spinal court of human rights jurisprudence. The answer,
indeed, has to be an emphatic 'No'. The precious right guaranteed by Article 21 of the Constitution
of India cannot be denied to convicted undertrials, detenues and other
prisoners in custody, except according to the procedure established by law by
placing such reasonable restrictions as are permitted by law.
In Neelabati Bahera Vs. State of Orissa [1993 (2) SCC, 746],
(to which Anand, J. was a party) this Court pointed out that prisoners and
detenues are not denuded of their fundamental rights under Article 21 and it is only
such restrictions as are permitted by law, which can be imposed on the enjoyment
of the fundamental rights of the arrestees and detenues. It was observed :
"It is axiomatic
that convicts, prisoners or undertrials are not denuded of their fundamental
rights under Article 21 and its is
only such restrictions, as are permitted by law, which can be imposed on the
enjoyment of the fundamental right by such persons. It is an obligation of the
State to ensure that there is no infringement of the indefeasible rights of a
citizen o life, except in accordance with law, while the citizen is in its
custody. The precious right guaranteed by Article 21 of the constitution of India cannot be denied to convicts,
undertrials or other prisoners in custody, expect according to procedure
established by law. There is a great responsibility on the police or prison
authorities to ensure that the citizen in its custody is not deprived of his
right to life. His liberty is in the very nature of things circumscribed by the
very fact of his confinement and therefore his interest in the limited liberty
left to him is rather precious. The duty of care on the part of the State is
responsible if the person in custody of the police is deprived of his life
except according to the procedure established by law.
Instances have come to out notice were the police has arrested a
person without warrant in connection with the investigation of an offence,
without recording the arrest, and the arrest person has been subjected to
torture to extract information from him for the purpose of further
investigation or for recovery of case property or for extracting confession
etc. The torture and injury caused on the body of the arrestee has sometime
resulted into his death. Death in custody is not generally shown in the records
of the lock-up and every effort is made by the police to dispose of the body or
to make out a case that the arrested person died after he was released from
custody. Any complaint against such torture or death is generally not given any
attention by the police officers because of ties of brotherhood. No first
information report at the instance of the victim or his kith and kin is
generally entertained and even the higher police officers turn a blind eye to
such complaints. Even where a formal prosecution is launched by the victim or
his kith and kin, no direct evidence is available to substantiate the charge of
torture or causing hurt resulting into death as the police lock-up where
generally torture or injury is caused is away from the public gaze and the
witnesses are either police men or co- prisoners who are highly reluctant to
appear as prosecution witness due to fear of letaliation by the superior
officers of the police. It is often seen that when a complaint is made against
torture, death or injury, in police custody, it is difficult to secure evidence
against the policemen responsible for resorting to third degree methods since
they are incharge of police station records which they do not find difficult to
manipulate. Consequently, prosecution against the delinquent officers generally
results in acquittal. State of Madhya Pradesh Vs. Shyamsunder Trivedi &
Ors. [ 1995 (3) Scale, 343 =] is an apt case
illustrative of the observations made by us above. In that case, Nathu Bnjara
was tortured at police station, Rampura during the interrogation. As a result
of extensive injuries caused to him he died in police custody at the police
station. The defence set up by the respondent police officials at the trial was
that Nathu Banjara had been released from police custody at about 10.30 p.m. after
interrogation 13.10.1986 itself vide entry
EX. P/22A in the Roznamcha
and that at about 7.00
a.m. on 14.10.1981, a death report
Ex. P/9 was recorded at
the police station, Rampura, at the instance of Ramesh respondent No. 6, to the effect
that he had found "one unknown person" near a tree by the side of the
tank riggling with pain in his chest and that as a soon as respondent No. 6 reached near him,
the said person died. The further case set up by SI Trivedi, respondent No. 1, incharge of the
police station was that after making a Roznamcha entry at 7.00 a.m. about his departure from the police station he (respondent
No. 1- Shyamsunder
Trivedi) and Constable Rajaram respondent proceeded to the spot where the dead
body was stated to be lying for conducting investigation under Section 174 Cr.P.C. He
summoned Ramesh Chandra and Goverdhan respondents to the spot and in their
presence prepared a panchnama EX. P/27 of the dead body recording the opinion therein to the effect
that no definite cause of death was known.
The First Additional Sessions Judge acquitted all the respondents
of all the charges holding that there was no direct evidence to connect the
respondents with the crime. The State of Madhya Pradesh went up in appeal
against the order of acquittal and the High Court maintained the acquittal of
respondents 2 to 7 but set aside the
acquittal of respondent No. 1, Shyamsunder Trivedi for offences under Section 218, 201 and 342 IPC. His acquittal
for the offences under Section 302/149 and 147 IPC was,
however, maintained. The State filed an appeal in this court by special leave.
This Court found that the following circumstances have been established by the
prosecution beyond every reasonable doubt and coupled with the direct evidence
of PWs 1, 3, 4, 8 and 18 those
circumstances were consistent only with the hypothesis of the quilt of the
respondents and were inconsistent with their innocence :
(a) that the
deceased had been brought alive to the police station ad was last seen alive
there on 13.10.81;
(b) That the dead
body of the deceased was taken out of the police station on 14.1.81 at about 2 p.m. for being
removed to the hospital;
(c) that SI Trivedi
respondent No. 1, Ram Naresh
shukla, Respondent and Ganiuddin respondent No. 5 were present at the police station and had all joined hands to
dispose of the dead body of Nathu-Banjara:
(d) That SI Trivedi,
respondent No. 1 created false
evidence and fabricated false clues in the shape of documentary evidence with a
view to screen the offence and for that matter, the offender:
(e) SI Trivedi
respondent in connivance with some of his subordinates, respondents herein had
taken steps to cremate the dead body in haste describing the deceased as a
'lavaris' though the identity of the deceased, when they had interrogated for a
sufficient long time was well known to them. and opined that:
"The observations of
the High Court that the presence and participation of these respondents in the
crime is doubtful are not borne out from the evidence on the record and appear
to be an unrealistic over simplification of the tell tale circumstances
established by the prosecution."
One of us (namely, Anand, J.) speaking for the Court went on to
observe :
"The trial court and
the High Court, if we may say so with respect, exhibited a total lack of
sensitivity and a 'could not careless' attitude in appreciating the evidence on
the record and thereby condoning the barbarous there degree methods which are
still being used, at some police stations, despite being illegal. The
exaggerated adherence to and insistence upon the establishment of proof beyond
every reasonable doubt, by the prosecution, ignoring the ground realities, the
fact situations and the peculiar circumstances of a given case, as in the
present case, often results in miscarriage of justice and makes the justice
delivery system a suspect. In the ultimate analysis the society suffers and a
criminal gets encouraged. Tortures in police custody, which of late are on the
increase, receive encouragement by this type of an unrealistic approach of the
Courts because it reinforces the belief in the mind of the police that no harm
would come to them if an odd prisoner dies in the lock-up, because there would
hardly be and evidence available to the prosecution to directly implicate them
with the torture. The Courts, must not loose sight of the fact that death in
police custody is perhaps on of the worst kind of crime in a a civilised
society, governed by the rule of law and poses a serious thereat to an orderly
civilised society."
This Court then suggested : "The Courts are also required to
have a change in their outlook and attitude, particularly in cases involving
custodial crimes and they should exhibit more sensitivity and adopt a realistic
rather than a narrow technical approach, while dealing with the case of
custodial crime so that as far as possible within their powers, the guilty
should not escape so that the victim of crime has the satisfaction that
ultimately the Majesty of Law has prevailed."
The State appeal was allowed and the acquittal of respondents 1, 3, 4 and 5 was set aside. The
respondents were convicted for various offences including the offence under
Section 304 Part II/34 IPC and sentenced
to various terms of imprisonment and fine ranging from Rs. 20,000/- to Rs.. 50,000/-. The fine was
directed to be paid to the heirs of Nathu Banjara by way of compensation. It
was further directed :
"The Trial Court
shall ensure, in case the fine is deposited by the accused respondents, that
the payment of the same is made to the heirs of deceased Nathu Banjara, and the
Court shall take all such precautions as are necessary to see that the money is
not allowed to fall into wrong hands and is utilised for the benefit of the
members of the family of the deceased Nathu Banjara, and if found practical by
deposit in nationalised Bank or post office on such terms as the Trial Court
may in consultation with the heirs for the deceased consider fit and
proper."
It needs no emphasis to say that when the crime goes unpunished,
the criminals are encouraged and the society suffers. The victim of crime or
his kith and kin become frustrated and contempt for law develops. It was
considering these aspects that the Law Commission in its 113th Report recommended the insertion of Section 114B in the Indian
Evidence Act. The Law Commission recommended in its 113th Report that in prosecution of a police officer for an alleged
offence of having caused bodily injury to a person, if there was evidence that
the injury was caused during the period when the person was in the custody of
the police, the Court may presume that the injury was caused by the police
officer having the custody of the person during that period. The Commission
further recommended that the court, while considering the question of
presumption, should have regard to all relevant circumstances including the
period of custody statement made by the victim, medical evidence and the
evidence with the Magistrate may have recorded. Change of burden of proof was,
thus, advocated. In sham Sunder Trivedi's case (supra) this Court also
expressed the hope that the Government and the legislature would give serious
thought to the recommendation of the Law Commission. Unfortunately, the
suggested amendment, has not been incorporated in the statute so far. The need
of amendment requires no emphasis - sharp rise i custodial violence, torture
and death in custody, justifies the urgency for the amendment and we invite
Parliament's attention to it.
Police is, no doubt, under a legal duty and has legitimate right
to arrest a criminal and to interrogate him during the investigation of a an
offence but it must be remembered that the law does not permit use of third
degree methods or torture of accused in custody during interrogation and
investigation with that view to solve the crime. End cannot justify the means.
The interrogation and investigation into a crime should be in true sense
purpose full to make the investigation effective. By torturing a person and
using their degree methods, the police would be accomplishing behind the closed
doors what the demands of our legal order forbid. No. society can permit it.
How do we check the abuse of police power? Transparency of action
and accountability perhaps are tow possible safeguards which this Court must
insist upon. Attention is also required to be paid to properly develop work
culture, training and orientation of police force consistent with basic human
values. Training methodology of the police needs restructuring. The force needs
to be infused with basic human values and made sensitive to the constitutional
ethos. Efforts must be made to change the attitude and approach of the police
personal handling investigations so that they do not sacrifice basic human
values during interrogation and do not resort to questionable form of
interrogation. With a view to bring in transparency, the presence of the
counsel of the arrestee at some point of time during the interrogation may
deter the police from using third degree methods during interrogation.
Apart from the police, there are several other governmental
authorities also like Directorate of Revenue Intelligence, Directorate of
Enforcement, Costal Guard, Central Reserve Police Force (CRPF), Border Security
Force (BSF), the Central Industrial Security Force (CISF), the State Armed
Police, Intelligence Agencies like the Intelligence Bureau, R.A.W, Central
Bureau of Investigation (CBI), CID, Tariff Police, Mounted Police and ITBP
which have the power to detain a person and to interrogated him in connection
with the investigation of economic offences, offences under the Essential
Commodities Act, Excise and Customs Act. Foreign Exchange Regulation Act etc.
There are instances of torture and death in custody of these authorities as
well, In re Death of Sawinder Singh Grover [1995 Supp (4) SCC, 450], (to which Kuldip
Singh, j. was a party) this Court took suo moto notice of the death of Sawinder
Singh Grover during his custody with the Directorate of Enforcement. After
getting an enquiry conducted by the additional District Judge, which disclosed
a prima facie case for investigation and prosecution, this Court directed the
CBI to lodge a FIR and initiate criminal proceeding against all persons named
in the report of the Additional District Judge and proceed against them. The
Union of India/Directorate of Enforcement was also directed to pay sum of Rs. 2 lacs to the widow
of the deceased by was of the relevant provisions of law to protect the
interest of arrested persons in such cases too is a genuine need.
There is one other aspect also which needs out consideration, We
are conscious of the fact that the police in India have to perform a difficult
and delicate task, particularly in view of the deteriorating law and order
situation, communal riots, political turmoil, student unrest, terrorist
activities, and among others the increasing number of underworld and armed
gangs and criminals, Many hard core criminals like extremist, the terrorists,
drug peddlers, smugglers who have organised gangs, have taken strong roots in
the society. It is being said in certain quarters that with more and more
liberalisation and enforcement of fundamental rights, it would lead to
difficulties in the detection of crimes committed by such categories of
hardened criminals by soft peddling interrogation. It is felt in those quarters
that if we lay to much of emphasis on protection of their fundamental rights
and human rights such criminals may go scot-free without exposing any element
or iota or criminality with the result, the crime would go unpunished and in
the ultimate analysis the society would suffer. The concern is genuine and the
problem is real. To deal with such a situation, a balanced approach is needed
to meet the ends of justice. This all the more so, in view of the expectation
of the society that police must deal with the criminals in an efficient and
effective manner and bring to book those who are involved in the crime. The
cure cannot, however, be worst than the disease itself.
The response of the American supreme Court to such an issue in
Miranda Vs. Arizona, 384 US 436 is instructive.
The Court said :
"A recurrent
argument, made in these cases is that society's need for interrogation
out-weighs the privilege. This argument is not unfamiliar to this Court. See.
e.g. Chambers v. Florida, 309 US 227, 240-41, 84 L ed 716, 724, 60 S Ct 472 (1940). The whose
thrust of out foregoing discussion demonstrates that the Constitution has
prescribed the rights of the individual when confronted with the power of
Government when it provided in the Fifth Amendment that an individual cannot be
compelled to be a witness against himself. That right cannot be abridged.
"
(Emphasis ours)
There can be no gain saying that freedom of an individual must yield to the
security of the State. The right of preventive detention of individuals in the
interest of security of the State in various situations prescribed under
different statures has been upheld by the Courts. The right to interrogate the
detenues, culprits or arrestees in the interest of the nation, must take
precedence over an individual's right to personal liberty. The latin maxim
salus populi est supreme lex (the safety of the people is the supreme law) and
salus republicae est suprema lex (safety of the state is the supreme law)
co-exist an dare not only important and relevant but lie at the heart of the
doctrine that the welfare of an individual must yield to that of the community.
The action of the State, however must be "right, just and fair".
Using any form of torture for extracting any kind of information would neither
be 'right nor just nor fair' and, therefore, would be impermissible, being
offensive to Article 21. Such
a crime-suspect must be interrogated - indeed subjected to sustained and
scientific interrogation determined in accordance with the provisions of law.
He cannot, however, be tortured or subjected to third degree methods or
eleminated with a view to elicit information, extract confession or drive
knowledge about his accomplices, weapons etc. His Constitutional right cannot
be abridged except in the manner permitted by law, though in the very nature of
things there would be qualitative difference in the methods of interrogation of
such a person as compared to an ordinary criminal. Challenge of terrorism must
be met wit innovative ideas and approach. State terrorism is not answer to
combat terrorism. State terrorism is no answer to combat terrorism. State
terrorism would only provide legitimacy to 'terrorism'. That would be bad for
the State, the community and above all for the Rule of Law. The State must,
therefore, ensure that various agencies deployed by it for combating terrorism
act within the bounds of law and not become law unto themselves. that the
terrorist has violated human rights of innocent citizens may render him liable
for punishment but it cannot justify the violation of this human rights expect
in the manner permitted by law. Need, therefore, is to develop scientific
methods of investigation and train the investigators properly to interrogate to
meet the challenge.
In addition to the statutory and constitutional requirements to
which we have made a reference, we are of the view that it would be useful and
effective to structure appropriate machinery for contemporaneous recording and
notification of all cases of arrest and detention to bring in transparency and
accountability. It is desirable that the officer arresting a person should
prepare a memo of his arrest on witness who may be a member of the family of
the arrestee or a respectable person of the locality from where the arrest is
made. The date and time of arrest shall be recorded in The memo which must also
be counter signed by The arrestee.
We therefore, consider it appropriate to issue the following
requirements to be followed in all cases of arrest or detention till legal
provisions are made in that behalf as preventive measures :
(1) The police
personnel carrying out the arrest and handling the interrogation of the
arrestee should bear accurate, visible and clear identification and name togs
with their designations. The particulars of all such police personnel who
handle interrogation of the arrestee must be recorded in a register.
(2) That the police
officer carrying out the arrest of the arrestee shall prepare a memo of arrest
at the time of arrest a such memo shall be attested by atleast one witness. who
may be either a member of the family of the arrestee or a respectable person of
the locality from where the arrest is made. It shall also be counter signed by
the arrestee and shall contain the time and date of arrest. (3) A person who has
been arrested or detained and is being held in custody in a police station or
interrogation centre or other lock-up, shall be entitled to have one friend or
relative or other person known to him or having interest in his welfare being
informed, as soon as practicable, that he has been arrested and is being
detained at the particular place, unless the attesting witness of the memo of
arrest is himself such a friend or a relative of the arrestee. (4) The time, place of
arrest and venue of custody of an arrestee must be notified by the police where
the next friend or relative of the arrestee lives outside the district or town
through the legal Aid Organisation in the District and the police station of
the area concerned telegraphically within a period of 8 to 12 hours after
the arrest.
(5) The person arrested
must be made aware of this right to have someone informed of his arrest or
detention as soon he is put under arrest or is detained.
(6) An entry must be
made in the diary at the place of detention regarding the arrest of the person
which shall also disclose the name of he next friend of the person who has been
informed of the arrest an the names and particulars of the police officials in
whose custody the arrestee is. (7) The arrestee should, where he so requests, be also examined at
the time of his arrest and major and minor injuries, if any present on his/her
body, must be recorded at that time. The "Inspection Memo" must be
signed both by the arrestee and the police officer effecting the arrest and its
copy provided to the arrestee.
(8) The arrestee should
be subjected to medical examination by trained doctor every 48 hours during his
detention in custody by a doctor on the panel of approved doctors appointed by
Director, Health Services of the concerned Stare or Union Territory. Director,
Health Services should prepare such a penal for all Tehsils and Districts as
well. (9) Copies of all the
documents including the memo of arrest, referred to above, should be sent to
the illaga Magistrate for his record.
(10) The arrestee may be
permitted to meet his lawyer during interrogation, though not throughout the
interrogation. (11) A police control
room should be provided at all district and state headquarters, where
information regarding the arrest and the place of custody of the arrestee shall
be communicated by the officer causing the arrest, within 12 hours of effecting the arrest and at the police control room it
should be displayed on a conspicuous notice board.
Failure to comply with the requirements hereinabove mentioned
shall apart from rendering the concerned official liable for departmental
action, also render his liable to be punished for contempt of court and the
proceedings for contempt of court may be instituted in any High Court of the
country, having territorial jurisdiction over the matter.
The requirements, referred to above flow from Articles 21 and 22 (1) of the Constitution
and need to be strictly followed. These would apply with equal force to the
other governmental agencies also to which a reference has been made earlier.
These requirements are in addition to the constitutional and statutory
safeguards and do not detract from various other directions given by the courts
from time to time in connection with the safeguarding of the rights and dignity
of the arrestee.
The requirements mentioned above shall be forwarded to the
Director General of Police and the Home Secretary of every Stare/Union
Territory and it shall be their obligation to circulate the same to every
police station under their charge and get the same notified at every police
station at conspicuous place. It would also be useful and serve larger interest
to broadcast the requirements on the All India Radio besides being shown on the
National network of Doordarshan and by publishing and distributing pamphlets in
the local language containing these requirements for information of the general
public. Creating awareness about the rights of the arrestee would in out
opinion be a step in the right direction to combat the evil of custodial crime
and bring in transparency and accountability. It is hoped that these
requirements would help to curb, if not totally eliminate, the use of
questionable methods during interrogation and investigation leading to
custodial commission of crimes.
PUNITIVE MEASURES UBI JUS IBI REMEDIUM - There is no wrong
without a remedy. The law will that in every case where man is wronged and
undamaged he must have a remedy. A mere declaration of invalidity of an action
or finding of custodial violence or death in lock-up does not by itself provide
any meaningful remedy to a person whose fundamental right to life has been
infringed. Much more needs to be done.
Some punitive provisions are contained in the Indian Penal Code
which seek to punish violation of right to life. Section 220 provides for punishment to an officer or authority who detains
or keeps a person in confinement with a corrupt or malicious motive. Section 330 and 331 provide for
punishment of those who inflict injury of grievous hurt on a person to extort
confession or information in regard to commission of an offence. Illustration
(a) and (b) to Section 330 make a
police officer guilty of torturing a person in order to induce him to confess
the commission of a crime or to induce him to confess the commission of a crime
or to induce him to point out places where stolen property is deposited.
Section 330, therefore,
directly makes torture during interrogation and investigation punishable under
the Indian Penal Code. These Statutory provisions are, However, inadequate to
repair the wrong done to the citizen. Prosecution of the offender is an
obligation of the State in case of every crime but the victim of crime needs to
be compensated monetarily also. The Court, where the infringement of the
fundamental right is established, therefore, cannot stop by giving a mere
declaration. It must proceed further and give compensatory relief, nor by way
of damages as in a civil action but by way of compensation under the public law
jurisdiction for the wrong done, due to breach of public duty by the State of
not protecting the fundamental right to life of the citizen. To repair the
wrong done and give judicial redress for legal injury is a compulsion of
judicial conscience.
Article 9(5) of
the International convent on civil and Political Rights, 1966 (ICCPR) provides that "anyone who has been the victim of
unlawful arrest or detention shall have enforceable right to
compensation". of course, the Government of India as the time of its
ratification (of ICCPR) in 1979 had made a specific reservation to the effect that the Indian
legal system does not recognise a right to compensation for victims of unlawful
arrest or detention and thus did not become party to the Convent. That
reservation, however, has now lost its relevance in view of the law laid down
by this Court in number of cases awarding compensation for the infringement of
the fundamental right to life of a citizen. (See with advantage Rudal Shah Vs.
State of Bihar [ 1983 (4) SCC, 141 ]: Sebastian M.
Hongrey Vs. Union of India [ 1984 (3) SCC, 339] and
1984 (3) SCC, 82]; Bhim Singh Vs
State of J & K [1984 (Supp)
SCC, 504 and 1985 (4) SCC, 677] Saheli Vs.
Commissioner of Police. Delhi [1990 (1) SCC 422]}.
There is indeed no express provision in the Constitution of India for grant of
compensation for violation of a fundamental right to life, nonetheless, this
Court has judicially evolved a right o compensation in cases of established
unconstitutional deprivation of person liberty or life. [See : Nilabati Bahara
Vs. State (Supra)] Till about tow decades ago the liability of the government
for tortious act of its public servants as generally limited and the person
affected could enforce his right in tort by filing a civil suit and there again
the defence of sovereign immunity was allowed to have its play. For the
violation of the fundamental right to life or the basic human rights, however,
this Court has taken the view that the defence of sovereign immunity is not
available to the State for the tortious act of the public servants and for the
established violation of the rights guaranteed by Article 21 of the Constitution of India. In Nilabati Behera Vs. State
(supra) the decision of this Court in Kasturi Lal Ralia Ram Jain Vs. State of
U.P. [1965 (1) SCR, 375] wherein the plea of
sovereign immunity had been upheld in a case of vicarious liability of the
State for the tort committed by its employees was explained thus:
"In this Context, it
is sufficient to say that the decision of this Court in Kasturilal upholding
the State's plea of sovereign immunity for tortious acts of its servants is
confined to the sphere of liability in tort, which is distinct from the State's
liability for contravention of fundamental rights to which the doctrine of
sovereign immunity has no application in the constitutional remedy under
Articles 32 and 226 of the
Constitution which enables award of compensation for contravention of
fundamental rights, when the only practicable mode of enforcement of the
fundamental rights can be the award of compensation. The decisions of this
court in Rudul Sah and others in that line relate to award of compensation for
contravention of fundamental rights, in the constitutional remedy upon Articles
32 and 226 of the
Constitution, On the other hand, Kasturilal related to the value of goods
seized and not returned to the owner due to the fault of government Servants,
the claim being of damages of the tort of conversion under the ordinary
process, and not a claim for compensation for violation of fundamental rights.
Kasturilal is, therefore, inapplicable in this context and
distinguishable."
The claim in public law for compensation for unconstitutional
deprivation of fundamental right to life and liberty, the protection of which
is guaranteed under the Constitution, is a claim based on strict liability and
is in addition to the claim available in private law for damages of tortious
acts of the public servants. Public law proceedings serve a different purpose
than the private law proceedings. Award of compensation for established
infringement of the indefeasible rights guaranteed under Article 21 of the
Constitutions is remedy available in public law since the purpose of public law
is not only to civilise public power but also to assure the citizens that they
live under a legal system wherein their rights and interests shall be protected
and preserved. Grant of compensation in proceedings under Article 32 or 226 of the
Constitution of India for the established violation or the fundamental rights
guaranteed under Article 21, is an exercise of the Courts under the public law jurisdiction
for penalising the wrong door and fixing the liability for the public wrong on
the State which failed in the discharge of its public duty to protect the
fundamental rights of the citizen.
The old doctrine of only relegating the aggrieved to the remedies
available in civil law limits the role of the courts too much, as the protector
and custodian of the indefeasible rights of the citizens. The courts have the
obligation to satisfy the social aspirations of the citizens because the court
and the law are for the people and expected to respond to their aspirations. A
Court of law cannot close its consciousness and aliveness to stark realities.
Mere punishment of the offender cannot give much solace to the family of the
victim - civil action for damage is a long drawn and cumber some judicial
process. Monetary compensation for redressal by the Court finding the
infringement of the indefeasible right to life of the citizen is, therefore, useful
and at times perhaps the only effective remedy to apply balm to the wounds of
the family members of the deceased victim. Who may have been the bread winner
of the family.
In Nilabati Bahera's case (supra), it was held: "Adverting
to the grant of relief to the heirs of a victim of custodial death for the
infraction or invasion of his rights guaranteed under Article 21 of the
Constitution of India, it is not always enough to relegate him to the ordinary
remedy of a civil suit to claim damages for the tortious act of the State as
that remedy in private law indeed is available to the aggrieved party. The
citizen complaining of the infringement of the indefeasible right under Article
21 of the
constitution cannot be told that for the established violation of the
fundamental right to life he cannot get any relief under the public law by the
courts exercising Writ jurisdiction, The primary source of the public law
proceedings stems from the prerogative writs and the courts have therefore, to
evolve ' new tools' to give relief in public law by moulding it according to
the situation with a view to preserve and protect the Rule of Law. While
concluding his first Hamlyn Lecture in 1949 under the title "freedom under the Law" Lord Denning
in his own style warned :
No one ca suppose that the executive will never be guilty the of
the sins that are common to all of us. Your may be sure that they will
sometimes to things which they ought to do : and will not do things that they
ought to do. But if and when wrongs are thereby suffered by any of us what is
the remedy? Our procedure for securing our personal freedom is efficient, out
procedure for preventing the abuse of power is not. Just as the pick and shovel
is no longer suitable for the winning of coal, so also the procedure of
mandamus, certiorari and actions on the case are not suitable for the winning
or freedom in the new age. They must be replaced by new and up-to date
machinery by declarations, injunctions and actions for negligence... This is
not the task of Parliament... the courts must do this. Of all the great tasks
that lie ahead this is the greatest.
Properly exercised the new powers of the executive lead to the
welfare state : but abused they lead to a totalitarian state. None such must
ever be allowed in this country."
A similar approach of redressing the wrong by award of monetary
compensation against the State for its failure to protect the fundamental
rights of the citizen has been adopted by the Courts of Ireland, which has a
written constitution, guaranteeing fundamental rights, but which also like the
Indian Constitution contains no provision of remedy for the infringement of
those rights. That has, however, not prevented the Court in Ireland from
developing remedies, including the award of damages, not only against
individuals guilty of infringement, but against the State itself.
The informative and educative observations of O' Dalaigh CJ in
The State (At the Prosecution of Quinn) v. Ryan [1965] IR 70 (122) deserve special
notice. The Learned Chief Justice said:
"It was not the
intention of the Constitution in guaranteeing the fundamental rights of the
citizen that these rights should be set at nought or circumvented. The
intention was that rights of substances were being assured to the individual and
that the Courts were the custodians of those rights. As a necessary corollary,
it follows that no one can with impunity set these rights at nought of
circumvent them, and that the Court's powers in this regard are as ample as the
defence of the Constitution require."
(Emphasis supplied)
In Byrne v. Ireland [1972] IR
241, Walsh J opined at
p 264:
"In several parts in
the Constitution duties to make certain provisions for the benefit of the
citizens are imposed on the State in terms which bestow rights upon the
citizens and, unless some contrary provision appears in the Constitution, the
Constitution must be deemed toe have created a remedy for the enforcement of
these rights. It follows that, where the right is one guaranteed by the State.
It is against the State that the remedy must be sought it there has been a
failure to discharge the constitutional obligation impose"
(Emphasis supplied)
In Maharaj Vs. Attorney General of Trinidad and Tobago [ (1978) 2 All E.R. 670]. The Privy Council while interpreting Section 6 of the
Constitution of Trinidad and Tobago held that though not expressly provided
therein, it permitted an order for monetary compensation, by way of 'redress'
for contravention of the basic human rights and fundamental freedoms. Lord
Diplock speaking for the majority said:
"It was argued on
behalf of the Attorney General that Section 6(2) does not permit of an order for monetary compensation despite the
fact that this kind of redress was ordered in Jaundoo v. Attorney General of
Guyana. Reliance was placed on the reference in the sub- section to 'enforcing,
or securing the enforcement of, any of the provisions of the said foregoing
sections' as the purpose for which orders etc. could be made. An order for
payment of compensation, it was submitted, did not amount to the enforcement of
the rights that had been contravened. In their Lordships' view of order for
payment of compensation when a right protected under Section 1 'has been'
contravened is clearly a form of 'redress' which a person is entitled to claim
under Section 6 (1) and may well be any
only practicable form of redress, as by now it is in the instant case. The
jurisdiction to make such an order is conferred on the High Court by para (a)
of Section 6(2), viz. jurisdiction
'to here and determine any application made by any person in pursuance of
sub-section (1) of this section'.
The very wide power to make orders, issue writs and give directions are
ancillary to this."
Lord diplock then went on to observe ( at page 680) : "Finally,
their Lordships would say something about the measure of monetary compensation
recoverable under Section 6 where the contravention of the claimant's constitutional rights
consists of deprivation of liberty otherwise that by due process of law. The
claim is not a claim in private law for damages for the tort of false
imprisonment, under which the damages recoverable are at large and would
include damages for loss of reputation. IT is a claim in public law for
compensation for deprivation of liberty alone."
In Simpson was, Attorney General [ Baigent's case ] (1994 NZLR, 667) the Court of Appeal
in NewZealand dealt with the issue in a very elaborate manner by reference to a
catena of authorities from different jurisdictions. It considered the
applicability of the doctrine of vicarious liability for torts, like unlawful
search, committed by the police officials which violate the New Zealand Bill of
Rights Act, 1990. While dealing with
the enforcement of rights and freedoms as guaranteed by the Bill of Rights for
which no specific remedy was provided. Hardie Boys, J. observed :
"The New Zealand
Bill of Rights Act, unless it is to be no more that an empty statement, is a
commitment by the Crown that those who in the three branches of the government
exercise its functions, powers and duties will observe the rights hat the Bill
affirms. it is I consider implicit in that commitment, indeed essential to its
worth, that the Courts are not only to observe the Bill in the discharge of
their own duties but are able to grant appropriate ad effective remedies where
rights have been infringed. I see no reason to think that this should depend on
the terms of a written constitution. Enjoyment of the basic human rights are
the entitlement of every citizen, and their protection the obligation of every
civilised state. They are inherent in and essential to the structure of
society. They do not depend on the legal or constitutional form in which they
are declared. the reasoning that has led the Privy Council and the Courts of
Ireland and India to the conclusions reached in the cases to which I have
referred (and they are but a sample) is in my opinion equally valid to the New
Zealand Bill of Rights Act if it is to have life and meaning." (Emphasis
supplied) The Court of appeal relied upon the judgment of the Irish Courts, the
Privy Council and referred to the law laid down in Nilabati Behera Vs. State
(supra) thus:
"Another valuable
authority comes from India, Where the constitution empowers the Supreme Court
to enforce rights guaranteed under it. In Nilabati Bahera V. State of Orissa (1993) Cri. LJ 2899, the Supreme Court
awarded damages against the Stare to the mother of a young man beaten to death
in police custody. The Court held that its power of enforcement imposed a duty
to "forge new tools", of which compensation was an appropriate on
where that was the only mode of redress available. This Was not a remedy in
tort, but one in public law based on strict liability for the contravention of
fundamental rights to which the principle of sovereign immunity does not apply.
These observations of Anand, J. at P 2912 may be noted.
The old doctrine of only relegating the aggrieved to the remedies
available in civil law limits the role of the courts too much as protector and
guarantor of the indefeasible rights of the citizens. The courts have the
obligation to satisfy the social aspirations of the citizens because the courts
and the law are for the people and expected to respond to their aspirations.
The purpose of public law is not only to civilize public that they live under a
legal system which aims to protect their interest and preserve their
rights."
Each the five members of the Court of Appeal in Simpson's case
(supra) delivered a separate judgment but there was unanimity of opinion
regarding the grant of pecuniary compensation to the victim, for the
contravention of his rights guaranteed under the Bill of Rights Act,
notwithstanding the absence of an express provision in that behalf in the Bill
of Rights Act.
Thus, to sum up, it is now a well accepted proposition in most of
the jurisdictions, that monetary or pecuniary compensation is an appropriate
and indeed an effective and sometimes perhaps the only suitable remedy for
redressal of the established infringement of the fundamental right to life of a
citizen by the public servants and the State is vicariously liable for their
acts. The claim of the citizen is based on the principle of strict liability to
which the defence of sovereign immunity is nor available and the citizen must
revive the amount of compensation from the State, which shall have the right to
be indemnified by the wrong doer. In the assessment of compensation, the
emphasis has to be on the compensatory and not on punitive element. The
objective is to apply balm to the wounds and not to punish the transgressor or
the offender, as awarding appropriate punishment for the offender, as awarding
appropriate punishment for the offence (irrespective of compensation) must be
left to the criminal courts in which the offender is prosecuted, which the
State, in law, is duty bound to do, That award of compensation in the public
law jurisdiction is also without prejudice to any other action like civil suit
for damages which is lawfully available to the victim or the heirs of the
deceased victim with respect to the same matter for the tortious act committed
by the functionaries of the State. The quantum of compensation will. of course,
depend upon the peculiar facts of each case and no strait jacket formula can be
evolved in that behalf. The relief to redress the wrong for the established
invasion of the fundamental rights of the citizen, under he public law
jurisdiction is, in addition to the traditional remedies and not it derrogation
of them. The amount of compensation as awarded by the Court and paid by the
State to redress The wrong done, may in a given case, be adjusted against any
amount which may be awarded to the claimant by way of damages in a civil suit.
Before parting with this judgment we wish to place on record our
appreciation for the learned counsel appearing for the States in general and
Dr. A.M. Singhvi, learned senior counsel who assisted the Court amicus curiae
in particular for the valuable assistances rendered by them. (Soures : http://indiankanoon.org/doc/501198/)
আদালত জাগ্রত! মানবাধিকার কমিশন জাগ্রত! তবুও পুলিশ পুলিশই আছে। পুলিশই বিচারক, পুলিশই দণ্ডদাতা, পুলিশই হত্যাকারী। সারা পৃথিবী জুড়ে কত যে
হাজার হাজার নিরীহ অসহায় মানুষের মৃত্যু হয় শুধুমাত্র পুলিশের গুলিতে, তার হিসাব কে রেখেছে!
পশ্চিমবঙ্গকে সরিয়ে রেখে ভারতের অন্য রাজ্যগুলির দিকে একটু তাকালে একই ঘটনারই
পুনরাবৃত্তি দেখতে পারবেন। ভারতের বাইরে অন্যান্য তথাকথিত সভ্য দেশগুলিতেও নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হয়। সেগুলি কিছু
উল্লেখ করতে মন চাইছে। বীভৎসতার বিচারে কিছু বাছাই ঘটনা।
ঘটনা –
১ : আতঙ্কিত করা, যথেচ্ছ প্রহার, যন্ত্রণা দেওয়া, ভয় দেখানো এবং শেষ পর্যায়ে ফায়ারিং
স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারায় গেস্টাপো (গেহেইম স্ট্যাটসপোলজে) ছিল
সিদ্ধহস্ত। গেস্টাপো, জার্মানের একটি সিক্রেট পুলিশ সংস্থা।
গেস্টাপো ছিল মানুষের তৈরি জঘন্য, নৃশংস, হিংস্র
এক সংস্থা। জার্মানিতে একটা সময় এসেছিল যখন গেস্টাপোর নাম শুনলে সাধারণ মানুষ
আতঙ্কে শিউরে উঠত।বন্ধ হয়ে যেত হৃদস্পন্দন। নিরপরাধ মানুষদের উপর অকথ্য অত্যাচার
করত এই সংস্থা। ‘ফ্রিডম অফ মুভমেন্ট’ ও ‘ফ্রিডম অফ স্পিচ’ যদি কোনো জার্মান নাগরিক, তবে তাদের যৌনাঙ্গে ইলেকট্রোডের শক, মহিলাদের ধর্ষণ, গোড়ালিতে দড়ি বেঁধে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য গাঁইতির
হাতল বা রবারের ডাণ্ডা বা বিষাক্ত ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করা হত। অত্যাচারের চূড়ান্ত
পর্যায়ে নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হত।
ঘটনা –
২ : রাশিয়ার পুলিশ সংস্থা কেজিবি। সোভিয়েট যুক্তরাষ্ট্রের
অসামরিক গোয়েন্দা পুলিশ বাহিনী ‘কমিটেট গাসুদোর্স্তভেন্নই
বেজোপোসনোস্তি’,
সংক্ষেপে কেজিবি। নাম শুনলেই প্যান্টে হিস্যু হয়ে যাবে
অসাড়ে। সরকার চালাত কমিউনিস্ট পার্টি, আর সেই সরকারের নির্দেশে
কেজিবি সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার করত। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রাশিয়ার সিক্রেট পুলিশ বাহিনী কাজ করছে ১৯১৭ সাল থেকে।জারের আমলে রাজ্যপাট
চালাতে অন্যান্য সরকারি দপ্তরের চেয়ে সিক্রেট পুলিশকে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী করে
গড়ে তোলা হয়েছিল। এটা গড়ে ওঠার পর থেকে এখনও পর্যন্ত এই পুলিশ বাহিনী কত লক্ষ রুশ
নাগরিককে যে হত্যা করেছে তার হিসাব নেই।
ঘটনা –
৩ : ইরাকের সিক্রেট সিকিউরিটি পুলিশ। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম
হোসেনের সামরিক সরকারের সঙ্গে কুর্দদের সংঘর্ষ লেগেই থাকত। শিশু, মহিলা,
পুরুষ নির্বিশেষে সুযোগ পেলেই নিরপরাধ কুর্দদের ঠান্ডা মাথায়
খুন করত ইরাকের সিক্রেট পুলিশ। সাদ্দামের সামরিক সরকার প্রায় ৩০০০ সাধারণ নিরীহ
কুর্দদের হত্যা করেছিল বলে জানা যায়।
ঘটনা –
৪ : ও জি পি ইউ, অর্থাৎ ‘ইউনাইটেট স্টেট পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন’। এই পুলিশ সংস্থাটি রাশিয়ার আর-একটি ঘাতকের দল।সামরিক বাহিনীতে কারা প্রশাসন ও
পার্টির সমালোচক, অন্য অর্থে বিপ্লবের প্রতিবন্ধক বা দেশের
শত্রু,
তাদের খুঁজে বের করার কাজে ওজিপিইউ প্রথমদিকে ব্যস্ত থাকলেও
পরে রাশিয়ার বৃহত্তম গণহত্যার জন্য এই সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছিল। তিরিশের দশকে
যখন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের ‘কালেকটিভাইজেশন প্রোগ্রাম’ রূপান্তরিত হয় তখন দেশের কৃষকরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চারে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
ওই প্রতিবাদী কৃষকদের কণ্ঠস্বরকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছিল এই ওজিপিইউ। রাশিয়ার
ইতিহাস অনুযায়ী বিশ্বযুদ্ধের সময় দুই কোটি রুশ নাগরিক জার্মানদের হাতে নিহত
হয়েছিল। কিন্তু তার আগে তিরিশের দশকে যে প্রায় সমসংখ্যক রুশি কৃষককে সে দেশের
সরকার গুলি করে,
ফাঁসি দিয়ে, বেয়নেটে বিদ্ধ করে ও লেবার
ক্যাম্পে পাঠিয়ে হত্যা করেছিল।এই গণহত্যার নায়ক পরবর্তীকালে তার কৃতকর্মের জন্য
অনুশোচনা করেননি, বরং আমজনতার সামনে তা গর্ব করে বলতেন।
প্রথমদিকে অবশ্য ব্যাপারটা চেপে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানরা যখন সব ফাঁস করে দেয়, তখনই
এই নৃশংস কৃষক হত্যার কথা বিশ্ব জানতে পেরেছিল। স্তালিনের দ্বিতীয় স্ত্রী নাজেদদা
এই গণহত্যার মানসিক চাপ সহ্য করতে না-পেরে শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করেছিল।
ঘটনা –
৫ : দেশের নাম আর্জেন্টিনা। তখন আর্জিন্টিনার রাষ্ট্রপ্রধান
কর্নেল জুয়ান ডোমিঙ্গো পেরন।‘ডিভিশন দা ইনফরমেশন পলিটিকাস
অ্যান্টিডোমোক্রেটিকাস’ হল সিক্রেট পুলিশের দল।
সংক্ষেপে ‘ডিপা’।নিপীড়ন,
নির্যাতন ও প্রচণ্ড অত্যাচারের জন্য অল্পদিনের মধ্যেই ‘ডিপা’
বিখ্যাত হয়ে ওঠে। আন্দোলন দমনের কাজে এই সিক্রেট পুলিশ
বাহিনীকে সাহায্য করত ‘আলিজায়া অ্যান্টি কমিউনাস্টা
আর্জেন্টিনা’
ও ‘কমান্ডো লিবারোটেডোরস দ্য
আমেরিকান’
নামের দুটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক গুণ্ডার দল, যাদের প্রত্যক্ষ মদত দিতেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট পেরন। রাজনৈতিক কর্মীদের
গ্রেপ্তার পর ভালো করে হাত-পা বেঁধে লরিতে তোলা হত। এরপর কবরখানায় নিয়ে গিয়ে আগের
থেকে খোঁড়া ট্রেঞ্চের সামনে জোর করে বসানো হত তাদের। অবধারিত মৃত্যুর জন্য আর
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হত না হতভাগ্য বন্দিদের। অকস্মাৎ পিছন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে
মেশিনগানের গুলি এসে ঝাঁঝরা করে দিত ওদের শরীর। রক্তাক্ত প্রাণহীন দেহগুলি গড়িয়ে
পড়ত ট্রেঞ্চের ভিতরে। অনেক সময় ভারপ্রাপ্ত অফিসার বন্দিদের মৃত্যুর আগে শেষবার
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার জন্য পাঁচ মিনিট সুযোগ দিত। গুলি করার আগে বন্দিদের
জানানো হত সরকারের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাদের এই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যাই
হোক,
ট্রেঞ্চে মৃতদেহের স্তূপ জমে উঠলে তরল দাহ্য বস্তু ছড়িয়ে
আগুন ধরিয়ে দেওয়া হত। এই সিক্রেট পুলিশের কীর্তিকলাপের এখানেই শেষ নয়। পৈশাচিক
আনন্দের জন্য এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক শক দিত পুরুষ বন্দিদের অণ্ডকোশে।
মহিলা বন্দিদের বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হত স্তনবৃন্তে। বন্দিদের মাথার উপর কয়েক
ক্যুইন্টাল ওজনের ভেজা ভূষির বস্তা চাপিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হত ঘণ্টার পর
ঘণ্টা। অত্যাচার চালাতে চালাতে পুলিশ বা
আর্মির লোকেরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে বিশ্রামের সময় সিগারেট ধরাত। ওই সিগারেটের জ্বলন্ত
টুকরো নেভাতে মহিলাদের যৌনাঙ্গকে অ্যাসট্রে হিসাবে ব্যবহার করত। অ্যামনেস্টি
ইন্টারন্যাশনালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে আর্জেন্টিনায়
অন্তত ৫০০০ পরিচিত রাজনৈতিক কর্মী চিরতরে হারিয়ে গেছেন।
ঘটনা –
৬ : দেশের নাম কলম্বিয়া।গোপন পুলিশ সংস্থার নাম ‘মুয়ের্তে এ সিকুয়েস্ট্রেটরস’, সংক্ষেপে ‘মাস’। গ্রেপ্তার ও অপহরণের পর সাধারণ মানুষকে হত্যা করায় সিদ্ধহস্ত এই স্কোয়াড। ১৯৮৩
সালে ৩০০০ বন্দিকে বিনাবিচারে হত্যা করে এই ডেথ স্কোয়াড। কলম্বিয়ার ম্যাগডালেনা
মিডিও এলাকায় ফাওয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী হাজার খানেক দরিদ্র কৃষক পতিত জমি পরিষ্কার
করে উন্নত পদ্ধতিতে চাষবাস শুরু করে। বছর দুই/তিন ভালো ফসল পেয়েছিল ওই কৃষকেরা।
এটাই চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াল। ভাড়াটে সেনা ও ডেথ স্কোয়াড ‘মাস’ একসঙ্গে ৮০০ কৃষককে হত্যা করল কোনোরকম প্ররোচনা ছাড়াই।
ঘটনা –
৭ : উগান্ডা, আফ্রিকা মহাদেশের একটি রাষ্ট্র।
ইদি আমিনের শাসনকাল।১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ সাল – ইদি আমিনের রাজত্বকালের
এই ৯ বছরে উগান্ডায় কমপক্ষে ১ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই নিহতের
আসল হিসাবে ১০ লক্ষও ছাপিয়ে যেতে পারে। প্রকৃত হিসাব কারোরই জানা নেই।
না,
আর নয়। সারা পৃথিবী জুড়ে পুলিশ কর্তৃক ধৃতদের হত্যা করার
ঘটনা পাওয়া যায় যে, চমকে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। হাড় হিম করা সেসব
কীর্তি।
“……..’নৈরাজ্য’
শব্দটার ভিতরে আছে 'রাজা' বিষয়ক ধ্যানধারণা। আসলে রাজ, বিরাজ, রাজ্য, রাজা,
রাজন, সম্রাট, রাষ্ট্র
প্রভৃতি শব্দের আদিতে আছে 'রাজ্' নামের
ধাতুটি (হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত বঙ্গীয় শব্দকোষ, পৃষ্ঠা ১৯০৭)। এই ‘রাজ্’-এর
অর্থ হচ্ছে ‘শোভা’,
‘দীপ্তি’ (হরিচরণ)। এই ধাতু থেকে উৎপত্তি
লাভ করা ‘রাজ’
শব্দটির অর্থ ‘শোভা পাওয়া’, ‘দীপ্তি পাওয়া’, ‘প্রকাশ পাওয়া’, ‘বিদ্যমান
থাকা’। এইভাবে ‘বিরাজ’
শব্দের অর্থ ‘শোভমান’, ‘শোভিত’,
‘দীপ্যমান’, দীপ্ত’; কিংবা ‘শোভা পাওয়া’, ‘শোভিত হওয়া’; ‘শোভা
করে অবস্থান করা’, ‘বিদ্যমান থাকা’, ‘উপস্থিত
থাকা’। ‘সম্রাট’
শব্দেরও অন্যতম অর্থ ‘রাজা’, এর গোড়ায় আছে ‘সম্ + রাজ + কিপ’, অর্থাৎ ‘যিনি মণ্ডলেশ্বর ও রাজগণের শাসক, তিনি সম্রাট’। তার মানে যিনি শোভা পান, যিনি দীপ্তি পান, যিনি প্রকাশ পান, যিনি বিদ্যমান থাকেন, তিনিই হন রাজা।
কিন্তু ‘রাজা’
ছাড়া বাকি সব মানুষ কি শোভা পান না?
দীপ্তি পান না? প্রকাশ পান না? বিদ্যমান থাকেন না?
নিশ্চয়ই পান, নিশ্চয়ই থাকেন। কিন্তু ‘রাজা’
ছাড়া অন্যসব লোকের শোভা, দীপ্তি, প্রকাশ,
বিদ্যমানতা প্রভৃতির বিশেষ কোনো মূল্য ‘আইনত’
নেই (আইন এখানে রাজার আইন, রাষ্ট্রের
আইন)। কেন-না ‘রাজা’
ছাড়া অন্যসব ব্যক্তিও যদি শোভা পান, দীপ্তি পান,
প্রকাশিত হন, বিদ্যমান থাকেন, তাহলে আর ‘রাজা’-র সঙ্গে সবার পার্থক্য কী থাকে?
সুতরাং,
রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন “আমরা
সবাই রাজা”,
তখনই আসে নৈরাজ্যের প্রশ্ন। কেন-না যে রাজ্যে বা যে
রাষ্ট্রে এক ‘রাজা’
ছাড়া আর কারোর অস্তিত্বের, বিদ্যমানতার, বিরাজমানতার স্বীকৃতিই নেই, সেই রাজ্য দিয়ে কার লাভ?
শুধু রাজাদের লাভ। এ কথা কে না জানে, রাজতন্ত্রের সর্বনিম্নপদস্থ দায়োয়ানটিও স্থানকালপাত্র মতো নিজেই খোদ রাজা; আগাপাছতলা এই রাজাদের সিস্টেম বা বন্দোবস্ত বা তন্ত্রের নামই তো দাঁড়িয়েছে
রাজতন্ত্র। রাজতন্ত্রে দাসত্ব ছাড়া আমাদের জন্য কিছু বরাদ্দ নেই। রাজাকে দেশ লিখে
দাও,
তারপর দেশের মালিক রাজাকে খাজনা দাও, আর রাজপেয়াদার লাঠির বাড়ি খাও—এই আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য।
তাহলে তো নৈরাজ্যই ভালো। রাজতন্ত্রের বদলে অরাজতন্ত্রই ভালো।
'রাষ্ট্র'
শব্দের উৎপত্তিও ওই একই জায়গা থেকে—‘রাজ্’ (হরিচরণ)। ‘রাষ্ট্র’
শব্দটির গোড়ায় আছে: “রাজ্+ত্র
(স্ট্রন্)”,
যার অর্থ “রাজ্য”। আর এই যে ‘স্ট্রন্’
—এর অর্থ সবসময়ই কোনোকিছুর গঠন-পরিগঠনের সঙ্গে যুক্ত। মানে
রাজত্ব বা বিরাজত্ব জিনিসটার যে গাঠনিক কাঠামো, তারই
নাম 'রাষ্ট্র'। আবার,
‘রাষ্ট্র’ কথাটার আরও একটা অর্থ ‘প্রচার,
প্রকাশ’ (হরিচরণ)। রাজার বিরাজত্ব যখন
প্রচারিত হয়,
প্রকাশিত হয় এবং সবাই সে ব্যাপারে সম্মত হয়, তখনই ‘রাষ্ট্র’
প্রতিষ্ঠা লাভ করে, গ্রামময়
রাষ্ট্র হয়ে যায়। এই গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার সঙ্গেই উপরের ওই ‘ত্র’
কথাটার সম্পর্ক। ‘ত্র’ অর্থ ‘তরণ-রহন (এখনি তরিত হয়ে অন্য কোথাও চলে যাব, এই
ভাব)’
(২০০৯ সালে প্রকাশিত কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ'’ (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক
শব্দার্থের অভিধান) পৃ. ৪৮৮]। তার মানে হলে, ‘রাজা’-র একক,
অদ্বিতীয় ও প্রশ্নাতীত বিরাজত্ব যখন বাকি সবাইকে ‘তরিত’
হয়ে কোথাও ‘রহন’ করে বা
রহে বা স্থিতি-কাঠামো লাভ করে, তখনই তার নাম হয় রাষ্ট্র।
‘রাষ্ট্র’
জিনিসটা তার মানে নিতান্তই রাজা’-র একক
ও অদ্বিতীয় বিদ্যমানতার সংস্থা। এ জিনিস কখনো জনগণের হতে পারে না। অতএব, বিদ্যমান গঠনকাঠামোয় ‘জনগণের রাষ্ট্র’ বলে কিছু হয় না। এইজন্যই রাষ্ট্র শব্দের আরও একটা অর্থ ‘উপদ্রব,
মকরাদি, দুর্ভিক্ষ’ (হরিচরণ)। তথাপি ‘সভ্যতা’ নামক গত পাঁচ হাজার বছরের
রাজতন্ত্রে-শাসনতন্ত্রে ‘রাজা’ ‘রাষ্ট্র’ প্রভৃতিকে এতটাই স্বাভাবিকভাবে দেখানো হয়েছে যে, এগুলো
সব ডালভাত তো বটেই, আলো-জল-হাওয়ার মতো প্রশ্নাতীত প্রাকৃতিক
ঘটনায় পরিণত হয়েছে যেন।
আজকের ‘রাজতন্ত্র’-এর মালিক-গোলাম-পেয়াদা আর নবরত্নসভার রাজ-বুদ্ধিজীবীরা এতক্ষণে হয়তো বলেই
ফেলেছেন -- তো জনাব, দেশটা চলবে কী করে, চালাবেটা
কে? প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ-অজ্ঞ রাজাদের, তাঁদের বাচাকাচ্চাদের, বাচ্চা-রাজাদের বা রাজসন্তানদের
এইরকম শিশুসুলভ প্রশ্নেরও সযত্ন উত্তর রচনা করতে হবে বৈকি। এবং সে উত্তর হতে হবে
চিন্তারহিত সাবালকের উপযোগী। কেন-না সে নিজে চিন্তা করবে না, খুঁজবে না,
ভাববে না, শুধু মুখস্থ কথা বলবে এবং ‘উত্তম পশু’-র মতো কুলগুরু পুরুতঠাকুরের শেখানো ‘গায়ত্রী
মন্ত্র’
জপে যাবে, আর এক প্রশ্ন হাজারোভাবে
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যাবে -- রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হবে তো, নইলে দেশটা চলবে কীভাবে?
তাকিয়ে দেখুন -- খোদ এই মহাবিশ্বপ্রকৃতিকে পরিচালনা করার জন্য কী কোনো
ব্যক্তি-রাজা লাগে? রাজতন্ত্র লাগে?
থানা-পুলিশ-পাইক-পেয়াদা-উজির-নাজির-হাকিম-হুকুম-কারাগার-মন্ত্রী-মিনিস্টার
লাগে? লাগে না। এগুলো লাগে
পদার্থ-শক্তি-প্রাণের সর্বোচ্চ অভিপ্রকাশ মানুষের বেলায়ই শুধু।
বাঘ-ভাল্লুক-শেয়াল-কুকুর-ইঁদুরের যা লাগে না, শাসকদের
তা লাগে। আশ্চর্য ঘটনা বটে। বনের রাজা সিংহ, অথবা
মাছের রাজা ইলিশ থেকে শুরু করে বাতির রাজা ফিলিপস পর্যন্ত যত বানোয়াট কেচ্ছা যে
নিছকই ‘রাজা’-র দীপ্তি বাড়ানোর বুদ্ধিবৃত্তিক ছলনা, সে কথা
বোঝা কী এতই কষ্ট? প্রয়োজনে স্মরণ করুন লোক-ছড়ার
ইঙ্গিত –
“মাছের রাজা রুই, শাকের রাজা পুঁই, নারীর মধ্যে আমেনার মা, পুরুষের মধ্যে মুই”।
হ্যাঁ,
‘রাজা’ একটি অভ্যাসের নামই বটে।
আনুষ্ঠানিক ‘রাজতন্ত্র’
তো এখন বিলুপ্ত-প্রায় পদার্থ। তার বদলে গণপতি গণেশের
গণতন্ত্রের উত্থানের হাওয়া নতুন করে বইতে লেগেছে শ' দুয়েক
বছর ধরে। তথাপি তথাকথিত নিরক্ষর-অশিক্ষিতদের জন্য মাতব্বর-চেয়ারম্যান তো লাগেই, সর্বোচ্চ শিক্ষালয়ের জন্যেও একজন বাদশাহি ভাইস-চ্যান্সেলরই লাগে। এতসব
দীক্ষায়ন-প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও কিন্তু ‘রাজা’ এবং ‘রাজতন্ত্র’-র বৈধতা ও যুক্তিসিদ্ধতা সম্পর্কে খটকা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয় না। মনের মধ্যে
কোথায় একটা খচখচানি থেকেই যায়। খটকাটা একেবারে আদি থেকেই ছিল বৈকি। মহাভারত তার
প্রমাণ। মহাভারতের যুদ্ধের পরে তাঁর সর্বগ্রহণযোগ্যতার কারণে সকলেই যুধিষ্ঠিরকে ‘রাজা’
হওয়ার জন্য অন্তহীন কাকুতি-মিনতি করেই চলেছিলেন। কিন্তু
যুধিষ্ঠির ছিলেন অনড়। ‘রাজা’ হতে
চাননি তিনি মোটেও। তিনি বলছিলেন তিনি ধর্ম-জগতের লোক, রাজা
তিনি হতে পারবেন না। মহাভারতের ‘শান্তিপর্ব’-এর গোড়ায় অর্জুনকে তিনি বলছিলেন: “আমি রাজ্যলোলুপ হইয়াই পাপপঙ্কে
লিপ্ত হইয়াছি। ... অতএব আমি সমস্ত রাজ্যসম্পদ পরিত্যাগপূর্বক শোকদুঃখবিবর্জিত
হইয়া অরণ্যে গমন করিব। আমার রাজ্য বা উপভোগ্য দ্রব্যে কিছুমাত্র অভিলাশ নাই।
অতঃপর তুমিই নির্বিঘ্নে এই পৃথিবী শাসন করো।"
যুধিষ্ঠিরের এই একান্ত উপলব্ধির উত্তরে নিতান্তই রুষ্ট অর্জুনের বক্তব্য ছিল
খুবই আক্রমণাত্মক ও সুস্পষ্ট এবং তাতে চিরন্তন ক্ষত্রিয়ধর্ম তথা কর্তৃত্বধর্মের
মহাসারকথাই ফুটে ওঠে – “যদি রাজধর্মে দ্বেষ প্রকাশ করিয়া আলস্যে
কালহরণ করিবেন,
তবে কি নিমিত্ত ধৃতরাষ্ট্রপক্ষীয় বীরগণকে বিনাশ করিলেন?
ক্ষাত্রধর্মাবলম্বী ব্যক্তিরা মিত্রের প্রতিও ক্ষমা, অনুকম্পা,
কারুণ্য বা অনৃশংসতা প্রকাশ করেন না। ... ক্ষত্রিয়গণ
হিংসার্থই জন্মগ্রহণ করেন। হিংসাই তাঁহাদের একমাত্র অবলম্বন, সুতরাং সেই সহজ-হিংসাধর্মের ও তাহার সৃষ্টিকর্তার নিন্দা করা ক্ষত্রিয়ের
নিতান্ত অকর্তব্য।" (মহাভারত, ২০০১ সালে প্রকাশিত কলকাতার 'তুলিকলম প্রকাশনী'-র রাজ-সংস্করণ)
ক্ষত্রিয়/শাসক/রাজনীতিবিদ এবং তাদের শাসনযন্ত্র তো আজকের দিনেও এমনকি বন্ধুর
প্রতিও “ক্ষমা,
অনুকম্পা, কারুণ্য বা অনৃশংসতা” প্রকাশ করে না, তা তো সমকালীন জাতীয় আন্তর্জাতিক রাজনীতির
দিকে তাকালেই বোঝা জলজ্যান্ত বোঝা যায়। ‘রাজনীতিতে
চিরস্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কিছু নেই’ জাতীয় কথা তো আর
এমনিতেই রটেনি! আদি ক্ষত্রিয় অর্জুন থেকেই এইসব ধারণার উত্পত্তি। কিন্তু যুধিষ্ঠির
তাঁর কথায় অনড়। রাজা হওয়ার যুক্তিপ্রণালী কিছুতেই তাঁর গ্রাহ্য হয় না— হওয়ার কথা না বলেই।
শেষপর্যন্ত রাজ-রাজত্বের যুক্তিসিদ্ধতা কীসের উপরে দাঁড়াচ্ছে সেটাই আপাতত
আমাদের দেখার বিষয়। তো অর্জুনের যে নিজের ক্ষত্রিয়ধর্ম নিয়ে গর্ব, সেই গর্ব নিয়ে ‘দেবত্ব’ অর্জন করা যায় না, ‘দেবলোকে’
যাওয়া যায় না, সে কথাই তুলে ধরেন
যুধিষ্ঠির। অনেক অনেক কথার পর অর্জুনকে এক পর্যায়ে তিনি বলেন – “যে ভূমিপতি এই অখিল ভূমণ্ডল মধ্যে একাধিপত্য বিস্তার করেন, তাঁহারও এক ভিন্ন দ্বিতীয় উদর নাই। তবে তুমি কি নিমিত্ত বিপুল রাজ্যভোগের
প্রশংসা করিতেছ? ... অতএব তুমি অগ্রে উদরকে পরাজিত
করো,
তাহা হইলেই তোমার সমুদয় পৃথিবী পরাজয় করা হইবে। ...
রাজ্যালাভ ও রাজ্যরক্ষা এই উভয়েই ধর্ম ও অধর্ম আছে, অতএব
উহা পরিত্যাগ করিয়া মহদ্ভার হইতে বিমুক্ত হও। ... যাহাদের বর্ণ ও আশ্রমাদির অভিমান
থাকে,
তাহারা পিতৃলোক, আর যাহারা অভিমানশূন্য, তাহারা দেবলোকে গমন করিয়া থাকে”।
কী সাংঘাতিক কথা। দেখা যাচ্ছে, বর্ণপ্রথার শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার
উপর দাঁড়িয়ে আছে যে রাজতন্ত্র, খোদ সেই “বর্ণ ও আশ্রমের অভিমান” যুধিষ্ঠির আর বহন করতে প্রস্তুত
নন। আর এই অভিমান না-থাকলে যে ‘রাজত্ব’-ই
অর্জন করা যায় না, সেই গুরুতর সত্যের প্রতিও এভাবে তিনি
ভাবিকালের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে বসে থাকেন। ‘রাজত্ব’ অর্জনের চেয়ে ‘দেবত্ব’ অর্জনের দিকেই তাঁর ঝোঁক। ফলত
তাঁর শোক,
আক্ষেপ, অনুতাপ ও পাপবোধ কিছুতেই
প্রশমিত হয় না,
বারংবার উথলে উঠতে থাকে। বেদব্যাসের কাছে তিনি অতঃপর এই
ভয়াবহ সত্য উচ্চারণ করতে ছাড়েন না যে ‘রাজা’ এবং ‘ধর্ম’,
‘রাজত্ব’ ও ‘ধর্মবোধ’ আসলে পরস্পরের বিরোধী – “ধর্মচর্যা ও রাজ্যরক্ষা এই উভয়
পরস্পর বিরুদ্ধ,
অতএব এক ব্যক্তি কীরূপে ধর্মরক্ষা ও রাজ্যভার গ্রহণ করিতে
পারে,
নিরন্তর এই চিন্তা করিয়া আমি মোহে বারংবার অভিভূত
হইতেছি।"
নকুল-সহদেব-দ্রৌপদী-ভীমের এবং ঋষি দেবস্থান ও মহর্ষি ব্যাসদেবের এবং
সর্বোপরি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের বহু বহু প্রকার, উপর্যুপরি, অনুরোধ-উপরোধ-যুক্তি-তর্ক-দৃষ্টান্ত ও উত্তেজনা-উক্তি এবং বিশেষত মহর্ষি
বৈশম্পায়ন বেদব্যাস কর্তৃক প্রায়শ্চিত্ত পাওয়ার উপায় বর্ণনার পর যুধিষ্ঠির অবশ্য
রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। কিন্তু সংশয় শোক তাঁর পিছু ছাড়ে না কিছুতেই। তখন বহু
কিছুর পর মহর্ষি বৈশম্পায়নের পরামর্শে সবাই মিলে তাঁকে নিয়ে যান ‘সর্বজ্ঞ ধর্মবেত্তা’ ‘কুরুকুলপিতামহ বৃদ্ধ ভীষ্মের
নিকট’
যুধিষ্ঠিরের ‘ধর্মগত সংশয় নিরাকরণ’ করার জন্য,
সবিস্তারে রাজধর্ম সম্পর্কে জানার জন্য। সেখানে ভীষ্ম
কর্তৃক নানারকম রাজধর্মবন্দনা এবং রাজার কর্তব্য-অকর্তব্য প্রভৃতি শোনার পরও
যুধিষ্ঠির সংশয়মুক্ত হন না; বরং তিনি এবার সেই মোক্ষম, একেবারে গোড়ার প্রশ্নটি উত্থাপন করেন – “পিতামহ!
‘রাজা’
এই শব্দটি কীরূপে সমুত্পন্ন হইল? রাজার হস্ত,
গ্রীবা, পৃষ্ঠ, মুখ, উদর,
শুক্র, অস্থি, মজ্জা, মাংস,
রক্ত, নিঃশ্বাস, উচ্ছ্বাস,
প্রাণ, শরীর, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়,
সুখ, দুঃখ, জন্ম ও
মরণ যেরূপ,
প্রজাগণেরও তদ্রূপ। তবে রাজা কিরূপে একাকী অসংখ্য
বিশিষ্টবুদ্ধি মহাবলপরাক্রান্ত পুরুষের উপর আধিপত্য করিয়া সমুদয় পৃথিবী পালন করিতে
সমর্থ হয়েন?
সকল লোকে কি নিমিত্ত রাজার প্রসাদলাভের আকাঙ্ক্ষা করে ...?”
এ প্রশ্ন তো চিরন্তন স্বাধীনতাপরায়ণেরই বটে। ‘রাজা’-র এবং ‘প্রজা’-র মধ্যে কী এমন দৈহিক-প্রাকৃতিক পার্থক্য আছে যে, একজন
মাত্র ব্যক্তি কোটি কোটি মানুষের ‘রাজা’ হয়ে
বসে থাকেন? আর লোকে তাঁকে মানেই-বা কী
কারণে?
গুরুতর এই প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্মদেব কিছুই লুকান না, ফাঁস করে দেন রাজতন্ত্রের গোড়ার গুমোর।
একটু ভিন্ন আঙ্গিকে হলেও, এমনকি ‘রাজা’-দের দিক থেকে হলেও মহাজ্ঞানী ভীষ্মদেব সেই স্মৃতিকথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায়
বয়ান করেন কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ-পরবর্তী কলিযুগের আদি রাজা যুধিষ্ঠিরের কাছে। এই
পৃথিবীর আদিতে যে অরাজ ছিল তার এবং সেই অরাজকে বলপ্রয়োগ ও শাস্ত্রপ্রয়োগের
মাধ্যমে উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠিত নয়া রাজতন্ত্রের, আদি
বৃত্তান্ত।
ভীষ্মদেবের কথায় যা বোঝা গেল: আদি সেই অরাজকে ভেঙে ফেলে দেবতারা যে আদি
দেবতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন তা ছিল মনুষ্যশ্রমনির্ভর। মানুষের প্রদত্ত ‘হোমাদি’
স্বরূপ অন্নেই দেবতাদের গ্রাসাচ্ছাদন হতে এবং সেটাকেই
দেবতারা বেদের নাম দিয়ে ‘ধর্ম’ বলে
মেলা দিন চালিয়েছেন। কিন্তু মনুষ্যসমাজ এক পর্যায়ে যখন তা আর মানল না, তখন দেবকুলের মুখে এই মর্মে অন্নাভাবের হাহাকার শোনা গেল -- নরলোকে আর বেদ
নাই;
নরলোকে আর ধর্ম নাই; সব
বিনষ্ট হয়ে গেছে; "মানবদিগের ক্রিয়াকলাপ উচ্ছিন্ন
হওয়াতে আমাদিগের অন্নাভাব হইয়াছে"; শুধু তাই নয়, সেই অন্নাভাবের পরিণামে দেবতারা আর দেবত্বই বজায় রাখতে পারছেন না বলে ব্রহ্মার
কাছে গিয়ে আক্ষেপ করছেন – “অতঃপর আমরা মনুষ্যের ন্যায়
অবস্থাপ্রাপ্ত হইলাম”।
মাঝখানে একটু টুকে রাখি – ‘দেবত্ব’ বা
বৈষম্য টিকিয়ে রাখার শর্তই হচ্ছে 'প্রিভিলেজ' বা বিশেষাধিকারতন্ত্র, অর্থাত্ অন্যের (মানুষের) শ্রমে
বসে বসে খাওয়া। বসে খাওয়ার ‘বিশেষ অধিকার’ না-থাকলে দেবতাও আর দেবতা থাকেন না, তাঁর অন্নাভাব ঘটে, তিনি মনুষ্যদশাপ্রাপ্ত হন।
তো,
ব্রহ্মা যেন নরলোক থেকে বেদ ও ধর্ম ধ্বংস হতে না দেন; একটা কিছু উপায় যেন তিনি ‘বুদ্ধি’ খাটিয়ে, “স্বীয় বুদ্ধিপ্রভাবে” বের করেন— দেবতাগণের এই সম্মিলিত নালিশ এবং আহাজারির মুখে ব্রহ্মা তাঁদের আশ্বস্ত করেন
-- নো টেনশন,
মুনষ্যজাতিকে আবার বেদ ও ধর্ম মানতে বাধ্য করা হবে। কিন্তু
কীভাবে? রাজাপ্রথার জোরে, রাজতন্ত্রের জোরে। কিন্তু
রাজতন্ত্র চলবে কীসের জোরে? রাজতন্ত্র
চলে কীসের জোরে? কেন — শাস্ত্রের
জোরে! স্বয়ং ব্রহ্মা সে উপায় বের করেন ‘বুদ্ধিবলে’। আদিতম ‘শাস্ত্র’
রচনা করে বসেন ‘প্রজাপতি’ ব্রহ্মা —
সৃষ্টি করেন তিনি ‘প্রকৃষ্টরূপে
জাত’
বিশেষ ধরনের মানুষকে যারা অতঃপর ‘প্রজা’ হিসাবে পরিচিত হবে।
আদিতম ‘শাস্ত্র’
আর ‘বুদ্ধিজীবী’-র সন্ধান তাহলে মহাভারতেই পাওয়া গেল — তিনি
খোদ ব্রহ্মা। জানা গেল-- তাঁর কাজ হচ্ছে শাসকদের অনুকূলে বৈষম্য ও
বিশোধিকারতন্ত্র টিকিয়ে রাখা — প্রজাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে এবং তাতে
কাজ না-হলে শাস্ত্রের জোর, শাস্তির জোর ও ভয়ের জোর
খাটানোর ‘প্রেসক্রিপশন’ দিয়ে। এভাবে অবশেষে বুদ্ধির জোরে এবং গায়ের
জোরে দুর্দান্ত ও দুর্দমনীয় মানুষকে শান্ত ও দমিত করার ব্যবস্থা হলে -- তাঁদেরকে
এই পৃথিবীতে রাজার রাজত্ব মানানো হলে, রাজবশীভূত করা হলে আদিতম
শাস্ত্রের জোরে এবং ‘দণ্ড’-ই হচ্ছে এই ভূভারতের আদিতম
শাস্ত্র। আর সেই শাস্ত্র চলে রাজা এবং রাজবুদ্ধিজীবীর যুগলবন্দিতে। এবার সেই
চাঞ্চল্যকর ইতিহাসের সারবিবরণী হুবহু শোনা যাক কুরুকুলপিতামহ সর্বজ্ঞ বৃদ্ধ
ভীষ্মের মুখে।
ভীষ্ম কহিলেন, “ধর্মরাজ! সত্যযুগে প্রথমে যেরূপে রাজত্বের
সৃষ্টি হয়,
তাহা অবহিত হইয়া শ্রবণ করো। সর্বপ্রথমে পৃথিবীতে রাজ্য, রাজা,
দণ্ড বা দণ্ডার্হ ব্যক্তি কিছুই ছিল না। মনুষ্যেরা একমাত্র
ধর্ম অবলম্বনপূর্বক পরস্পরকে রক্ষা করিত। মানবগণ এইরূপে কিছুদিন কালযাপন করিয়া
পরিশেষে পরস্পরের রক্ষণাবেক্ষণ নিতান্ত কষ্টকর বোধ করিতে লাগিল। ওই সময় মোহ
তাহাদিগের মনোমন্দিরে প্রবিষ্ট হইল। মোহের আবির্ভাববশত ক্রমশ জ্ঞান ও ধর্মের
লোপ হইতে লাগিল এবং মানবগণ ক্রমে ক্রমে লোভপরতন্ত্র, পরধনগ্রহণতত্পর, কামপরায়ণ,
বিষয়াসক্ত ও কার্য্যাকার্য্যবিবেকশূন্য হইয়া উঠিল। ...
নরলোক এইরূপে কুমার্গগামী হইলে বেদ বিনষ্ট ও ধর্ম এককালে বিলুপ্ত হইয়া গেল।
তখন দেবগণ নিতান্ত শঙ্কিতচিত্তে লোকপিতামহ ভগবান ব্রহ্মার শরণাপন্ন হইয়া
তাঁহাকে প্রসন্ন করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “ভগবন্!
লোভমোহাদি প্রভৃতি নীচবৃত্তিসমুদয় নরলোকস্থ সনাতন বেদ গ্রাস করাতে আমরা ভীত
হইয়াছি। বেদ ধ্বংস হওয়াতে ধর্মও বিনষ্ট হইয়াছে। অতঃপর আমরা মনুষ্যের ন্যায়
অবস্থাপ্রাপ্ত হইলাম। মানবগণ হোমাদি কার্য দ্বারা ঊর্দ্ধবর্ষী বলিয়া বিখ্যাত ছিল
এবং আমরা বারিবর্ষণাদি দ্বারা অধোবর্ষী বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিলাম; কিন্তু এক্ষণে মানবদিগের ক্রিয়াকলাপ উচ্ছিন্ন হওয়াতে আমাদিগের অন্নাভাব
হইয়াছে। অতএব যাহাতে আপনার প্রভাবে সম্ভত এই প্রাকৃতিক নিয়ম ধ্বংস না হয়, আপনি স্বীয় বুদ্ধিপ্রভাবে তাহার সদুপায় উদ্ভাবন করুন।'
তখন ভগবান্ কমলযোনি (ব্রহ্মা) সুরগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে দেবগণ! তোমরা ভীত হইও না; আমি অচিরাত উহার উপায় চিন্তা
করিতেছি।”
প্রজাপতি দেবগণকে এই কথা বলে বুদ্ধিবলে একটি লক্ষ
অধ্যায়যুক্ত নীতিশাস্ত্র রচনা করলেন। ...
ভগবান্ পদ্মযোনি ওই নীতিশাস্ত্র প্রণীত করিয়া ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণকে
হৃষ্টমনে কহিলেন, “সুরগণ! আমি ত্রিবর্গ সংস্থাপন ও লোকের
উপকার-সাধনের নিমিত্ত বাক্যের সারস্বরূপ এই নীতিশাস্ত্র উদ্ভাবন করিয়াছি। ইহা পাঠ
করিলে নিগ্রহ ও অনুগ্রহ দর্শনপূর্বক লোকরক্ষা করিবার বুদ্ধি জন্মিবে। এই
শাস্ত্রদ্বারা জগতের যাবতীয় লোক দণ্ডপ্রভাবে পুরুষার্থ ফললাভে সমর্থ হইবে; অতএব ইহার নাম দণ্ডনীতি হইল।
এতটা সুস্পষ্ট কথা আর কী হতে পারে। পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, ভূভারতের আদিতম নীতিশাস্ত্রটি হলো ‘দণ্ডনীতি’ এবং যুধিষ্ঠিরকে পিতামহ ভীষ্মদেব আরো বলেছিলেন, “দণ্ডপ্রভাবেই
জনসমাজে নীতি ও ধর্ম্মের প্রচার হইয়াছে”। তার মানে, ‘দণ্ডনীতি’-ই যে কর্তৃত্বতন্ত্রের আদিতম নীতিশাস্ত্র শুধু তা-ই নয়, এ জিনিস জনসমাজে প্রচলিত নীতিবোধের জনকও বটে। এবং এই নীতিবোধের প্রধান দুই
উপায় হচ্ছে “নিগ্রহ ও অনুগ্রহ”। এ-ই হলে সেই “নিমিত্ত”,
যে নিমিত্তে “সকল লোকে ... রাজার
প্রসাদলাভের আকাঙ্ক্ষা করে”। নইলে যে মার খেতে হবে, নিগৃহীত হতে হবে। তারচেয়ে অনুগ্রহ-তাড়নাই বাস্তবোচিত।
দণ্ডনীতি কী বস্তু, সমাজ-সংসারে এর কাজ কী তাও
যুধিষ্ঠিরকে সবিস্তারে বুঝিয়ে বলেছিলেন অর্জুন – “দণ্ড
প্রজাদিগকে শাসন ও রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া থাকে। সকলে নিদ্রায় অভিভূত হইলেও দণ্ড একাকী
জাগরিত থাকে। পণ্ডিতেরা দণ্ডকে প্রধান ধর্ম বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন”।
এসব কথা আজকের সংসদীয় গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের অত্যাধুনিক প্রবক্তাদের মুখে
শোনাও,
‘সভ্যতা’-র উষালগ্নের দণ্ড বা আইন
প্রয়োগকারী সত্তা অর্জুনের মুখে শোনাও তা-ই। কেন-না আইনের শাসন তথা দণ্ডনীতি
প্রতিষ্ঠার নামই ‘সভ্যতা’ এবং সত্যিকারের সভ্যতার নামে এই
জিনিসই চলছে গত পাঁচ হাজার বছরের ‘কর্তৃত্বতান্ত্রিক সভ্যতা’ জুড়ে। এই দণ্ডনির্ভর সভ্যতায় দণ্ডই ‘প্রধান ধর্ম’ বটে,
তবে তা ‘মনুষ্যধর্ম’ নয়,
‘শাস্ত্রধর্ম’ তথা ‘রাজধর্ম’ এবং সেই কারণেই বিপরীত দিক থেকে ‘প্রজা’-র
ধর্মও বটে। অন্য কথায় এ বস্তুই আজকের ‘সভ্য’যুগের
রাষ্ট্রের ধর্ম। আইনের ধর্মই তো দণ্ড। শাসনের ধর্মই তো দণ্ড। এই আইনের শাসনকে
কখনও সত্যিকারের মনুষ্যধর্মের নামে চালানো যায় না। একে চালাতে হয় শাস্ত্রধর্মের
নামে। এবং পুনরাবৃত্তি করতেই হবে, আদিতম শাস্ত্রধর্মের নামই
দণ্ডশাস্ত্র বা দণ্ডধর্ম বা কর্তৃত্বনীতি বা কর্তৃত্বধর্ম। এই জিনিসটিকেই
কর্তৃত্বতন্ত্র মানুষের ধর্ম এবং প্রকৃতির ধর্ম বলে চালাতে চায়।
যুধিষ্ঠিরকে অর্জুন বলছেন, ভয়ের রাজত্বই হচ্ছে দণ্ডনীতির
প্রাণ: “দণ্ডপ্রভাবে ধন ও ধান্য রক্ষিত হয়। ... অনেকানেক পাপপরায়ণ পামরেরা রাজদণ্ডভয়ে, অনেকে যমদণ্ডভয়ে, অনেকে পরলোকভয়ে এবং অনেকে লোকভয়ে
পাপানুষ্ঠান করিতে পারে না। অনেকে কেবল দণ্ডভয়েই পরস্পর পরস্পরকে ভক্ষণ করে না।
ফলত সংসারে প্রায় সমুদয় কার্য্যই দণ্ডভয়ে নির্বাহ হইতেছে। ... ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ,
বানপ্রস্থ ও ভিক্ষুক ইহারা দণ্ডের ভয়ে স্ব স্ব পথে অবস্থান
করিতেছেন। ভীত না হইলে কেহই যজ্ঞানুষ্ঠান, দান ও
নিয়ম প্রতিপালন করিতে ইচ্ছা করে না।“ তত্কালীন প্রধান সেনাপতি
অর্জুনের বক্তব্য খুবই পরিষ্কার। দণ্ডনীতি মানেই হচ্ছে দমননীতি এবং শাসন-ত্রাসনের
নীতি: “দমন ও শাসন করে বলিয়াই উহা দণ্ড নামে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে"। আর কার জন্য
কোন দণ্ড সমুচিত তার মোক্ষম বিধানও প্রস্তুত-- “দণ্ড
সংসার রক্ষা না করিলে সমুদয়ই গাঢ় অন্ধকারে নিমগ্ন হইত। দণ্ড দুর্দান্তদিগকে দমন ও
দুর্বিনীত ব্যক্তিদিগকে শাসন করিয়া থাকে। দমন ও শাসন করে বলিয়াই উহা দণ্ড নামে
নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। ব্রাহ্মণের তিরস্কার, ক্ষত্রিয়ের
বেতন প্রদান না করা, বৈশ্যের রাজসমীপে দ্রব্যজাত সমর্পণ এবং
শূদ্রের সর্বস্বাপহরণই সমুচিত দণ্ড।"
কি সুনির্দিষ্ট, কি তীব্রসূচিমুখ এই দণ্ডনীতি সেই প্রাচীনকাল
থেকেই। আর শাসনের প্রশ্নে সে কাউকেই ছাড়ে না। শাসনযন্ত্রের হাতে তথা শাসকের হাতে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ম্যানেজারদের হাতে ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র পর্যন্ত কারও কোনো
নিস্তার নাই। পার্থক্য আছে বৈকি। ব্রাহ্মণের জন্য “তিরস্কার”-ই যথেষ্ট। আর শূদ্রকে শায়েস্তা করার জন্য চাই তার “সর্বস্ব
অপহরণ?
করা।” (সেলিম রেজা নিউটন)
প্রাক-ঐতিহাসিককালে মানুষের আত্মরক্ষার প্রধান উপকরণ ছিল দণ্ড। এক্কেবারে
প্রথমদিকে ছিল শক্ত কাঠের লাঠি, পরবর্তী সময়ে হাড় বা ধাতুর তৈরি
দণ্ড বা অস্ত্র।লগুড়, গাছের গুঁড়ি, বীণার
ছড়,
যষ্টি, নৌকার দাঁড় লাঙলের ঈষ, হাত বা ভুজ – সবই দণ্ড। সুস্থিত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায়
রাজদণ্ড হল আইন ও বিচারের প্রতীক। জগতের সকলকে এ দমন করে, শাসন
বা সংযত করে –
তাই এর নাম দণ্ড। তাই শাসক হলেন দণ্ডধারী বা দণ্ডধর বা
দণ্ডপাণি। মনু বলেছেন – লঘু পাপে লঘু দণ্ড, গুরু পাপে গুরু দণ্ড। দণ্ড বিধান এবং দণ্ড প্রণয়ন রাষ্ট্রনায়কের অন্যতম
কর্তব্য।
মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায়ের ১৮ নম্বর শ্লোকে মনু বলছেন –“দণ্ড শাস্তি প্রজাঃ সর্বা এবাভিরক্ষতি।/দণ্ড সুপ্তেষু জাগর্তি দণ্ডং ধর্মং
বিদূর্বুধাঃ।।” অর্থাৎ দণ্ডই প্রজাদের শাসন করে, দণ্ডই তাদের রক্ষা করে, রক্ষক পুরুষেরা নিদ্রিত থাকলে
দণ্ডই জেগে থাকে। পণ্ডিতগণ দণ্ডকেই ধর্ম বলে জানেন।অপরদিকে দণ্ড না-থাকলে কী হত সে
বিষয়েও মনু বলেছেন – “যদি ন প্রণয়েদ্রাজা দণ্ডং
দণ্ড্যেষ্বতন্দ্রিতঃ।/শূলে মৎসানিবাপক্ষ্যন্ দূর্বলান বলবত্তরা।।” (মনুসংহিতা –
সপ্তম অধায় – শ্লোক ২০) অর্থাৎ রাজা যদি
অনলসভাবে দণ্ডনীয় ব্যক্তির দণ্ডবিধান না করতেন তবে শূলে মৎস্যের ন্যায় বলবান
ব্যক্তিরা দুর্বল ব্যক্তিগণকে উৎপীড়ন করত। আরও যা যা ঘটত সেগুলিও মনুসংহিতার সপ্তম
অধ্যায়ের ২১ নম্বর শ্লোকে উল্লেখ আছে – “অদ্যাৎ কাকঃ পুরোডাশং
শ্বাবলিহ্যাদ্ধবিস্তথা।/স্বাম্যঞ্চ ন স্যাৎ কস্মিংশ্চিৎ প্রবর্তেতাধরোত্তরম্।।” অর্থাৎ দণ্ড না হলে কাক যজ্ঞীয় পিঠা ভক্ষণ করত, কুকুর
যজ্ঞীয় হবি লেহন করত এবং কারও কোনো বিষয়ে অধিকার থাকত না। এক ওলট-পালট অবস্থার
সৃষ্টি হত।মনু মনে করেন, “ সর্বো দণ্ডজিতো লোকো দুর্লভো হি
শুচির্নরঃ।/দণ্ডস্য হি ভয়াৎ সর্বং জগদ্ভোগায় কল্পতে।।”(মনুসংহিতা
– সপ্তম অধ্যায় – শ্লোক ২২) অর্থাৎ দণ্ডের দ্বারাই সকল মানুষ
নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে, কারণ স্বভাবশুচি লোক দুর্লভ। দণ্ডেরই ভয়ে
সমগ্র জগৎ ভোগে সমর্থ হয়।
আগেই উল্লেখ করেছি লঘু পাপে লঘু দণ্ড, গুরু
পাপে গুরু দণ্ড।কোনো অপরাধ লঘু কোন অপরাধ গুরু, তা
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। শাস্তির ধরনও বদলে যায়। এ বড়ো আপেক্ষিক ব্যাপার। কোন
অন্যায়ের কোন শাস্তি হবে তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট সেই রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থার উপর, যা শাসক দ্বারা নির্দেশিত। লঘু পাপেও যে গুরু দণ্ড দেওয়া হয় এমন উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি আছে। প্রাচীন ভারতে ভয়ংকর আঘাতে তাৎক্ষণিক মৃত্যু
এবং অন্যান্য গুরুতর অপরাধ – যেমন বাবা-মা-ভাই-বোন-শিক্ষক-গুরু
এবং সন্ন্যাসী বা তপস্বীর মৃত্যু ঘটালে আগুনে পুড়িয়ে অথবা জলে ডুবিয়ে অথবা বিষ
খাইয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রযুক্ত হত। প্রাচীন রোমেও পিতৃহত্যা, স্বজনহত্যা
বা রাজহত্যার অপরাধীকে বুনো কুকুর বা বিষধর সাপের সঙ্গে থলির মধ্যে ঢুকিয়ে হত্যা
করা হত। ১৭৯৫-৫০ খ্রিস্টপূর্বে হামুরাবির আইন অনুসারে ব্যাবিলনে বিক্রেতা যদি মদ
বিক্রিতে মাপে কম দিত তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। প্রাচীন ভারতে নরহত্যা ছাড়া
যেসব অপরাধে মৃত্যুদণ্ড হত, তার মধ্যে আছে – রাজদ্রোহ,
মানী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে অপহরণ – বিশেষত নারীহরণ, উচ্চবর্ণের স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ যৌন সম্পর্ক, রাজাদেশ জাল বা নকল করা, চুরি ও চোরাই মালসহ ধরা পড়া, রাজকোশ থেকে মণিমাণিক্য চুরি, চাষের জন্য তৈরি বাঁধ বা সেতু
নষ্ট করা,
রাজার হাতি-ঘোড়া-রথ চুরি করা, ঘরবাড়ি
বা খেতখামারে আগুন লাগানো, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীর
মৃতদেহ সৎকার করা ইত্যাদি।এখানেই শেষ নয় – বৈদিক
ও পরবর্তী যুগে ব্রাহ্মণ ছিল অবধ্য। ব্রাহ্মণগণ প্রাণদণ্ডার্হ কোনো অপরাধ করলে
মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে দেশ থেকে নির্বাসন দেওয়া হত। তখনকার সময়ে ‘দেশ’
বলতে ভারত বহির্ভূত বোঝাত না, বোঝাতো
অন্য রাজ্য। অর্থাৎ কাম্পিল্যের নির্বাসিত ব্রাহ্মণ আরামসে মগধে বসবাস করতে কোনো
অসুবিধা ছিল না।প্রাচীন গ্রিসেও ‘nobleman’-দের ক্ষেত্রেও
মৃত্যুদণ্ডের বদলে নির্বাসন দেওয়া হত।তবে সেই নির্বাসিত ব্যক্তিটি যদি পুনরায়
রাষ্ট্রে প্রবেশ করলে তার সম্পত্তি হরণ করে প্রাণদণ্ড দেওয়া হত।তবে প্রাচীন ভারতে
শূদ্ররাই বেশি শাস্তি ভোগ করত।ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা শূদ্রদের তুলনায় মৃত্যুদণ্ড কমই
হত।
শাস্তির নামে মানুষ যে কত নৃশংস হত তার নমুনা ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে। হত্যার
ইতিহাসে রক্তাক্ত হয়ে আছে মানুষের সভ্যতা। ধমকে, দাবিয়ে
রাখার সভ্যতা। শুষে খাওয়ার সভ্যতা। ছোটো মাছকে গিলে খাওয়ার সভ্যতা। শাস্তি কেন
দেওয়া হত?
‘সবক’ শেখানোর জন্য?
বিশ্বাস করি না। মৃত্যুদণ্ড যিনি দেন, মৃত্যুদণ্ড যিনি কার্যকর করেন, মৃত্যুদণ্ডের মতো হত্যাকাণ্ড যে
বা যাঁরা সমর্থন করেন উল্লসিত হন তাঁরা প্রত্যেকেই হত্যাকারী। হত্যার সপক্ষে যাঁরা
বক্তৃতা দেন,
আসলে তাদের অন্তরের ভিতর
হত্যার স্পৃহা জেগেই থাকে, অবচেতন মনে। দেশদ্রোহী হলে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড।
দেশদ্রোহী এবং দেশপ্রেমী – এই দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়
মানুষ। কেন? কে দেশদ্রোহী?
কেই-বা দেশপ্রেমী? যদি কিষাণজি দেশদ্রোহী হন, যদি কাসভ দেশদ্রোহী হন, যদি আফজল গুরু দেশদ্রোহী হন – তবে ব্রিটিশ-ভারতে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় ধৃত রাজেন্দ্রপ্রসাদ বিসমিল ও
রোওশনলাল,
লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় ধৃত গণেশ পিংলে ও কর্তার সিং, দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলায় ধৃত বসন্ত বিশ্বাস, আলিপুর
বোমা মামলায় ধৃত কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন বসু, পুনা
কালেকটর হত্যার দায়ে ধৃত দামোদর চাপেকর ও বালকৃষ্ণ হরি চাপেকর প্রমুখ ব্যক্তিদের
দেশদ্রোহী ও সন্ত্রাসবাদীদের কী বলবেন? বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত একটি
আধাসামরিক বাহিনী। এটি অখন্ড পাকিস্তানপন্থী বাঙালি এবং উর্দুভাষী অবাঙালি
অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্যে লড়াইরত
মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনায় প্রথম রাজাকার
বাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি সত্যিকার আনুগত্য প্রদর্শন করে তারা
স্বাধীন বাংলাদেশের কাছে অপরাধী হলেও অখণ্ড পাকিস্তানের কাছে চরম আনুগত্য বইকি!
রেজাকার বা রাজাকার মানে স্বেচ্ছাসেবী, এই রাজাকারেরা হলেন
গোলাম আজম,
আব্বাস আলি খান (জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে
আমির),
মতিউর রহমান নিজামী, আলি
আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর ঢাকা
মহানগরীর প্রধান), মো: কামরুজ্জামান (জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের
সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল), দেলোয়ার হোসেন সাঈদি (জামাতে
ইসলামীর মজলিসের শুরার সদস্য), আবদুল কাদির মোল্লা (জামাতে
ইসলামের প্রচার সম্পাদক), ফজলুল কাদের চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী – যাদের অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি
আনুগত্য দেখানোর অভিযোগে অনেককেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রেজাকার বা রাজাকার
বাহিনী কোরান ছুঁয়ে শপথ নিতেন, "I shall bear true allegiance to the
constitution of Pakistan as framed by law and shall defend Pakistan, if
necessary, with my life." অর্থাৎ, "আমি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি সত্যিকার আনুগত্য
প্রদর্শন করব এবং জীবন দিয়ে হলেও পাকিস্তানকে রক্ষা করব।" ১৯৭১ সালের ১৬
ডিসেম্বর তারিখের আগে যারা ছিলেন পাকিস্তানের দেশপ্রেমী, ১৯৭১
সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখের পর থেকে তারাই দেশদ্রোহী হয়ে গেলেন। অসম সাহসিকতার জন্য
যাদের পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল, তাদেরই
কপালে জুটল মৃত্যুদণ্ড। অথচ ভাবুন তো, যদি কোনো কারণে
মুক্তিযুদ্ধ সফল না হত এই কাদের মোল্লারাই অখণ্ড পাকিস্তানের ঘরে ঘরে দেশপ্রেমী
হিসাবে পূজিত হতেন। তাই না?
১৯৪৭ সালের আগে ভারত কবে ভারতীয়দের ছিল? প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশরা শাসন করেছিল, তার
আগে প্রায় ৭০০ বছর মুসলিম শাসকরা শাসন করেছিল, তারও
আগে বেদের যুগ পর্যন্ত ভারত বিদেশিদের কর্তৃক শাসিত হয়েছে।এমনকি যে আর্যদের নিয়ে
আমাদের অহংকার,
সেই আর্যরা কিন্তু ভারতের ভূমিপুত্র নন, ভারত বংশোদ্ভূত নয় -- বিদেশিই। তখন বিপ্লবীরা কোথায় ছিলেন?
অত্যাচার কোন্ শাসক করেননি! তাহলে কার বা কাদের বিরুদ্ধে
সন্ত্রাসবাদ? দেশদ্রোহিতাই-বা কেন?
ব্রিটিশ-ভারতে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীদের মৃত্যুদণ্ড যদি
অনৈতিক হয়,
অন্যদের ক্ষেত্রে সেটা উলটো হবে কেন! অর্থাৎ দেশদ্রোহিতা বা
সন্ত্রাসবাদিতা যেহেতু দেশ-কাল বিশেষে আপেক্ষিক, সেই
কারণে সেইসব কোনো ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডও মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
দেশপ্রেমের প্রসঙ্গে বলব, কারা দেশপ্রেমী?
যাঁরা নানা ছলনায় কোটি কোটি টাকার আয়কর ফাঁকি দিয়ে
রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা করেন তাঁরা দেশপ্রেমী? যেসব নিয়োগ কর্তৃপক্ষ শ্রমিক বা কর্মচারীদের রক্ত শুষে খায় তাঁরা দেশপ্রেমী?
যেসব শ্রমিক বা কর্মচারীরা নানা কায়দায় শ্রম চুরি করে, মালপত্র ঝেঁড়ে ফাঁক করে দেয় তাঁরা দেশপ্রেমী? যে সব মাননীয় নাগরিকরা কালো টাকার পাহাড় জমান তাঁরা দেশপ্রেমী?
যেসব মাননীয় নাগরিকরা আয় বহির্ভূত প্রচুর অর্থ সুইস
ব্যাঙ্কে জমা রেখে আসেন তাঁরা দেশপ্রেমী? আয়কর দপ্তরের যেসব অসৎ অফিসারেরা অসৎ ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার আয়কর ফাঁকি
দেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে নিজে ‘লাল’ হয়ে
সরকারকে দিনের পর দিন ‘কালো’ করে
চলেছেন তাঁরা দেশপ্রেমী? যেসব
নির্লজ্জ নাগরিকরা দেশের যত্রতত্র দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব ছিটিয়ে দেশের সর্বত্র কলুষিত
করেন তাঁরা দেশপ্রেমী?
একদা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীকে জনসমক্ষে প্রকাশ্যে দণ্ড কার্যকর করা হত।
সেক্ষেত্রে দণ্ড প্রয়োগের স্থান-সময় আগেভাগে জানিয়ে দেওয়া হত, যাতে সাধারণ মানুষ যত বেশি সংখ্যক উপস্থিত থাকতে পারে। উদ্দেশ্য : যাতে সুস্থ
স্বাভাবিক মানুষেরা অপরাধীর দণ্ড নিজের চোখে দেখে অপরাধ বিষয়ে তার একটা বিরূপ
মানসিক প্রতিক্রিয়া হয় এবং তাতে সামাজিক সুফল মিলবে। না, মৃত্যুদণ্ড
দিয়ে এক ইঞ্চিও সামাজিক সুফল মেলেনি। হাজার হাজার বছর ধরে এত নৃশংস কঠোর দিয়েও
পৃথিবী অপরাধমুক্ত করা যায়নি। অপরাধ হয়েই চলেছে এবং তা হাজারবার মৃত্যুদণ্ড দিয়েও
অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না। কারণ প্রায় সব অপরাধের পিছনে থাকে আর্থ-সামাজিক
সংকট এবং মানসিক বৈকল্য, যার দায় কোনো রাষ্ট্র এড়াতে
পারে না।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি হত্যাকাণ্ড উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
গান্ধির হত্যাকারী ছিলেন তার মতোই একজন উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ। তার নাম নাথুরাম
গডসে।। গান্ধি হত্যাকাণ্ডে গডসের যে যুক্তি ছিল তা তার একার ছিল না। হিন্দুদের
একটি বিরাট অংশ গডসের যুক্তি সঠিক বলে মনে করত। ১৯৩৪ সালের জুলাই থেকে ১৯৪৪ সালের
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ছয়বার গান্ধিকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। নাথুরাম গডসে
১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার গান্ধিকে হত্যার চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি
আবার ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারি একই চেষ্টা চালান। পরপর দু-বার ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বার
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি সফল হন। তিনি মনে করতেন, অষ্টাদশ
শতাব্দীতে মোগলদের বিরুদ্ধে মারাঠা দস্যু শিবাজি, রাজা
রাবণের বিরুদ্ধে হিন্দু বীরদের সহিংস লড়াইয়ের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্রিটিশ
বিরোধী আন্দোলনে অহিংস পথ অবলম্বন করে গান্ধি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেছেন। তাই তাকে
হত্যা করা পুণ্যের কাজ। গডসে এ সিদ্ধান্তে আসেন যে, জাগতিক
বিচারে তার পরিণাম যাই হোক, পরজন্মে তিনি মুক্তি পাবেন।
শুধু তাই নয়,
গান্ধি হত্যাকাণ্ড সফল হলে তার স্বধর্মের অনুসারী ভারতের ৩০
কোটি হিন্দুও অবিচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে। গান্ধি হত্যাকাণ্ডে এগুলোই ছিল
নাথুরাম গডসের যুক্তি। মনে করতেন --
শিবাজি,
রানা প্রতাপ ও গুরু গোবিন্দের মতো ঐতিহাসিক বীর যোদ্ধাদের
বিপথগামী দেশপ্রেমিক হিসাবে নিন্দা করে গান্ধিজি নিজের আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করেছেন।
গান্ধিজি অহিংস ও সত্যাগ্রহ নীতির নামে দেশে অবর্ণনীয় দুর্দশা ডেকে এনেছেন।
পক্ষান্তরে,
রানা প্রতাপ, শিবাজি ও গুরুগোবিন্দ তাদের
জাতিকে যে মুক্তি এনে দিয়েছিলেন সেজন্য তারা জাতির হূদয়ে চিরজাগরুক হয়ে থাকবেন। এই
হল নাথুরাম গডসে।
মেরঠে নাথুরাম গডসের মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হবে বলা হয়েছিল অখিল ভারতীয় হিন্দু
মহাসভার পক্ষ থেকে। হিন্দু মহাসভার সভাপতি শুধু জানিয়েছেন, মন্দিরে
নাথুরাম গডসের সঙ্গে থাকবেন অখণ্ড ভারতমাতা। হিন্দু মহাসভার তরফে চন্দ্রপ্রকাশ
কৌশিক বলেছেন,
"মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে নাথুরাম গডসের কোনো ব্যক্তিগত দুশমনি
ছিল না। তবুও তিনি গান্ধিজিকে খুন করেছিলেন। কেন সেই ঘটনা ঘটেছিল, তার তদন্তও হয়নি। কেন হয়নি, সেটা একটা প্রশ্ন। যদি আকবর রোড, হুমায়ুন রোড, ঔরঙ্গজেব রোড থাকে, তা হলে
গডসের নামে কেন রাস্তা থাকবে না? কেন
তাঁর একটি মূর্তি তৈরি হবে না।" অর্থাৎ, আপনার
কাছে যে টেররিস্ট, আমার কাছে সে বিপ্লবী শহিদ। আপনার কাছে যে
গড,
আমার কাছে সে গডসে – এরকম
ব্যাপার আর কি! মহাত্মা গান্ধির ঘাতক নাথুরাম গডসেকে 'দেশপ্রেমিক' বলেছিলেন বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজ। সাক্ষী মহারাজ বলেন, "নাথুরাম গডসে একজন জাতীয়তাবাদী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধি যতটা করেছেন দেশের জন্য, গডসের অবদানও ততটা।" পরে অবশ্য চাপে পড়ে সাক্ষী মহারাজ বলেন, "যদি ভুল করে কিছু বলে থাকি, তা হলে কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি।
নাথুরাম গডসে দেশপ্রেমিক নয়। কখনও ছিল না।" চাপে পড়ে ভুল স্বীকার করা আর
শ্রদ্ধা থেকে সরে আসা এক ব্যাপার নয়।গডসের ফাঁসি হয়েছে একথা ঠিক। তবে তিনি যে
চিন্তায় আলোড়িত হতেন সে চিন্তার মৃত্যু হয়নি। এখনও ভারতের কট্টরপন্থি এবং উগ্রবাদী
হিন্দু গডসের চিন্তা ও চেতনায় আলোড়িত হয়। তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
রেহানা জাব্বারি। ইরানের এই ছাব্বিশ বর্ষীয় নারীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। জানা
গেছে ধর্ষণ চেষ্টাকারীর বুকে ছুরি বসানোর অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ইরানের
সুপ্রিম কোর্ট। ২৫ অক্টোবর তার মত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রেহানার ফাঁসির বিরোধিতা
করে গোটা বিশ্বের অজস্র মানবাধিকার সংগঠন। প্রাণভিক্ষার আবেদন জানায় দুনিয়ার অনেক
মানুষ। আর মেয়ের বদলে তাকেই ফাঁসিতে ঝোলানোর মিনতি করেছিলেন রেহানার মা শোলেহ।
কিন্তু কোনো কিছুতেই কান দেয়নি সরকার। মৃত্যুর আগে মাকে শেষ চিঠি লিখে গেছেন
রেহানা। মৃত্যুকে তিনি অভিহিত করেছেন
নিয়তির বিধান হিসাবে। ফাঁসির পর তার দেহাংশ দান করার অনুরোধ জানিয়েছেন
জন্মদাত্রীকে। রেহানার সেই মর্মস্পর্শী চিঠি গণমাধ্যমের হাতে তুলে দিয়েছেন
মানবাধিকার সংগঠন ও শান্তিকামী গোষ্ঠীর সদস্যরা।
“প্রিয় শোলেহ,
আজ জানতে পারলাম এবার আমার ‘কিসাস’ (ইরানের
আইন ব্যবস্থায় কর্মফল বিষয়ক বিধি)-এর সম্মুখীন হওয়ার সময় হয়েছে। জীবনের শেষ পাতায়
যে পৌঁছে গিয়েছি, তা তুমি নিজের মুখে আমায় জানাওনি ভেবে খারাপ
লাগছে। তোমার কি মনে হয়নি যে এটা আমার আগেই জানা উচিত ছিল? তুমি
দুঃখে ভেঙে পড়েছ জেনে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি। ফাঁসির আদেশ শোনার পর তোমার আর বাবার
হাতে চুমু খেতে দাওনি কেন আমায়?
দুনিয়া আমায় ১৯ বছর বাঁচতে দিয়েছিল। কেন-না সেই অভিশপ্ত রাতে আমারই তো মরে
যাওয়া উচিত ছিল,
তাই না? আমার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলার কথা
ছিল শহরের কোনো অজ্ঞাত কোনে। কয়েক দিন পর মর্গে যা শনাক্ত করার কথা ছিল তোমার।
সঙ্গে এটাও জানতে পারতে যে হত্যার আগে আমাকে ধর্ষণও করা হয়েছিল। হত্যাকারীরা
অবশ্যই ধরা পড়ত না, কারণ আমাদের না আছে অর্থ, না ক্ষমতা। তারপর বাকি জীবনটা সীমাহীন শোক ও অসহ্য লজ্জায় কাটিয়ে কয়েক বছর পর
তোমারও মৃত্যু হত। এটাই যে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে রাতের আকস্মিক আঘাত সবকিছু
ওলটপালট করে দিল। শহরের কোনো গলি নয়, আমার শরীরটা প্রথমে
ছুড়ে ফেলা হল এভিন জেলের নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে, আর
সেখান থেকে কবরের মতো এই শাহরে রায় কারাগারের সেলে। কিন্তু এ নিয়ে অনুযোগ কোরো না
মা,
এটাই নিয়তির বিধান। আর তুমি তো জানো যে মৃত্যুতেই সব শেষ
হয়ে যায় না।
মা,
তুমিই তো শিখিয়েছ অভিজ্ঞতা লাভ ও শিক্ষা পাওয়ার জন্যই
আমাদের জন্ম। তুমি বলেছিলে, প্রত্যেক জন্মে আমাদের কাঁধে এক
বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া থাকে। মাঝে মাঝে লড়াই করতে হয়, সে
শিক্ষা তো তোমার কাছ থেকেই পেয়েছি। সেই গল্পটা মনে পড়ছে, চাবুকের
ঝাপটা সহ্য করতে করতে একবার প্রতিবাদ জানানোর ফলে আরো নির্মমতার শিকার হয়েছিল এক
ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয়। কিন্তু প্রতিবাদ তো সে করেছিল! আমি শিখেছি, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অধ্যবসায় প্রয়োজন। তার জন্য যদি মৃত্যুও আসে, তাকেই মেনে নিতে হয়। স্কুলে যাওয়ার সময় তুমি শিখিয়েছিলে, নালিশ ও ঝগড়াঝাটির মাঝেও যেন নিজের নারীসত্তাকে বিসর্জন না দিই। তোমার মনে
আছে মা,
কত যত্ন করেই-না মেয়েদের খুঁটিনাটি সহবত শিখিয়েছিলে আমাদের?
কিন্তু তুমি ভুল জানতে, মা। এই
ঘটনার সময় আমার সেসব তালিম একেবারেই কাজে লাগেনি। আদালতে আমায় এক ঠান্ডা মাথার
খুনি হিসাবে পেশ করা হয়। কিন্তু আমি চোখের জল ফেলিনি। ভিক্ষাও করিনি। আমি কাঁদিনি, কারণ আইনের প্রতি আমার অটুট আস্থা ছিল। কিন্তু বিচারে বলা হল, খুনের অভিযোগের মুখেও নাকি আমি নিরুত্তাপ। আচ্ছা মা, আমি তো
কোনো দিন একটা মশাও মারিনি। আরশোলাদের চটিপেটা না করে শুঁড় ধরে জানলার বাইরে ফেলে
দিয়েছি। সেই আমিই নাকি মাথা রেখে মানুষ খুন করেছি! উলটো ছোটবেলার ওই কথাগুলো শুনে
বিচারপতি বললেন,
আমি নাকি মনে মনে পুরুষালি। তিনি একবার চেয়েও দেখলেন না, ঘটনার সময় আমার হাতের লম্বা নখের উপর কী সুন্দর নেল পালিশের জেল্লা ছিল। হাতের
তালু কত নরম তুলতুলে ছিল।
সেই বিচারকের হাত থেকে সুবিচার পাওয়ার আশা অতি বড়ো আশাবাদীও করতে পারে কি?
তাই তো নারীত্বের পুরস্কার হিসেবে মাথা মুড়িয়ে ১১ দিনের
নির্জনবাসের হুকুম দেওয়া হল। দেখেছ মা, তোমার ছোট্ট রেহানা এই
ক-দিনেই কতটা বড়ো হয়ে গিয়েছে?
এবার আমার অন্তিম ইচ্ছেটা বলি, শোনো। কেঁদো না মা, এখন শোকের সময় নয়। ওরা আমায় ফাঁসি দেওয়ার পর আমার চোখ, কিডনি, হৃদ্যন্ত্র, হাড় আর যা যা কিছু দরকার -- যেন আর কারও
জীবন রক্ষা করতে কাজে লাগানো হয়। তবে যিনিই এসব পাবেন, কখনোই
যেন আমার নাম না জানেন। আমি চাই না, এর জন্য আমার সমাধিতে কেউ ফুলের
তোড়া রেখে আসুক, এমনকি তুমিও না। আমি চাই না, আমার কবরের সামনে বসে কালো পোশাক পরে কান্নায় ভেঙে পড়ো তুমি। বরং আমার দুঃখের
দিনগুলো সব হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ো।
এই পৃথিবী আমাদের ভালোবাসেনি, মা। চায়নি, আমি সুখী হই। এবার মৃত্যুর আলিঙ্গনে তার পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে। তবে
সৃষ্টিকর্তার এজলাসে সুবিচার আমি পাবই। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি অভিযোগের আঙুল তুলব
সেই সমস্ত পুলিশ অফিসারের দিকে, বিচারকদের দিকে, আইনজীবীদের দিকে, আর তাদের দিকে- যারা আমার অধিকার বুটের নিচে
পিষে দিয়েছে,
বিচারের নামে মিথ্যা ও অজ্ঞানতার কুয়াশায় সত্যকে আড়াল
করেছে। একবারও বোঝার চেষ্টা করেনি, চোখের সামনে যা দেখা যায় সেটাই
সর্বদা সত্যি নয়।
আমার নরম মনের শোলেহ, মনে রেখো সেই দুনিয়ায় তুমি আর
আমি থাকব অভিযোগকারীর আসনে। আর ওরা দাঁড়াবে আসামির কাঠগড়ায়। দেখিই না, সৃষ্টিকর্তা কী চান! তবে একটাই আরজি, মৃত্যুর হাত ধরে দীর্ঘ
যাত্রা শুরুর প্রাকমুহূর্ত পর্যন্ত তোমায় জড়িয়ে থাকতে চাই, মা গো! তোমাকে যে খুব খু-উ-ব ভালোবাসি।”
তবে রেহানার মৃত্যুদণ্ডের কারণ নিয়ে অন্যেরা অন্য মতও পোষণ করেন।তারা বলছেন --
ইরানের রেহানা জাব্বারি নামে এক মহিলার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে সারা বিশ্বে ব্যাপক
অপপ্রচার চলছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ঝড় উঠেছে ওই নারীর
পক্ষে তবে নিতান্তই অসত্যের পক্ষে। প্রকৃত সত্য হল রেহানা ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে
গিয়ে খুন করেননি। ঘটনাটি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ইরানের বিচার বিভাগ এতটা
নারী বিদ্বেষী নয় যে, অন্যায়ভাবে একজন নারীকে ফাঁসি দেবে।
হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল। ওই মহিলা তার দোষও স্বীকার করেছেন আদালতে।
রেহানা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণেও ব্যর্থ হয়েছেন। ঘটনাটি হচ্ছে দুজনের অবৈধ সম্পর্কের
জের ধরে এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় এবং এই খুনের ঘটনা ঘটে। সে
ক্ষেত্রে পুরুষ লোকটি যে ভালো মানুষ ছিলেন তা বলার সুযোগ নেই। টানাপড়েনের একটি
পর্যায়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। যার কারণে রেহানা লোকটিকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন।
খুনের দুই দিন আগে রেহানা নতুন ছুরি কিনেছিলেন এবং তার এক বান্ধবীকে এসএমএস
করেছিলেন যে,
খুনের ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে। এই মহিলার সঙ্গে ইরানের আদালতের
এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে, তাকে ফাঁসি দিয়ে দুনিয়া থেকে
বিদায় দিয়ে দেবে। অথবা এই মহিলা ইরানের জন্য কোনো হুমকি ছিলেন সে কারণে তার ফাঁসি
কার্যকর করা হল। বরং যদি এমন হত যে, খুন হয়নি বরং অবৈধ সম্পর্ক বা
ধর্ষণের ঘটনার বিচার হচ্ছে, তাহলে ওই পুরুষ লোকটাও
মৃত্যুদণ্ডের মুখে পড়ত। এবং এ ক্ষেত্রেও ইরানের আইন অনুসরণ করা হত। দেখা হত না কে
পুরুষ আর কে নারী। যেমনটি দেখা হয়নি রেহানার ক্ষেত্রে। আলোচ্য হত্যাকাণ্ডটি ২০০৭
সালে সংঘটিত হয়। ঘটনাটি সাত বছর ধরে পুঙ্খানুপঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে তারপর ইরানের
আদালত রায় দিয়েছে। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে পরে আবার বিচার হয়েছে এবং রায় বহাল রাখে।
তারপরও এক মাস দেরি করা হয়েছে যে ভিক্টিম পরিবার যদি মাফ করে দেয় তাহলে ফাঁসিটি
কার্যকর করা হবে না। কিন্তু ওই পরিবার মাফ করেনি। ইরানের বিচার ব্যবস্থায় খুনের
ঘটনায় কারও মৃত্যুদণ্ড হলে ভিক্টিম পরিবার ছাড়া কারও পক্ষে সে রায় উল্টানোর সুযোগ
নেই। এমনকি প্রেসিডেন্ট বা সর্বোচ্চ নেতাও পারেন না।
ঔরঙ্গজেব ছিলেন মুঘল সম্রাটদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অত্যাচারী, নৃশংস,
ধর্মান্ধ ও কামুক প্রকৃতির একজন শাসক। ঔরঙ্গজেবের আদেশ মেনে
মুঘলসেনারা হিন্দু তথা অমুসলিমদের ধরে এনে মুসলমান বানাত। যারা মুসলমান হতে
অস্বীকৃতি জানাত তাদেরকে শিরচ্ছেদ করা হত। ঔরঙ্গজেব ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের লোভে ভাইদের হত্যা করেছিল
এবং পিতা সম্রাট শাজাহানকে বন্দি করেছিল
কারাগারে। সেই অপরাধের অভিযোগের ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে বলে শুনিনি।
কোনোভাবেই মৃত্যুদণ্ড সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। হত্যা করার অধিকার কারোর থাকতে
পারে না। নখের বদলে নখ, দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ – এ ব্যবস্থা সমাজে কোনো কাজে লাগে না। এটা
প্রতিহিংসাপরায়ণতা। অপরাধের বদলে অপরাধ করা।
সমাজ,
ধর্ম ও রাজনীতি
বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ লেখকদের জন্য সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আছে এবং হয়তো-বা
থাকবে। ভিন্ন মতাবলম্বী লেখকের উপর যে-কোনো সময়ে রাষ্ট্রের খড়গহস্ত নেমে আসতে
পারে। গ্রেফতার হতে পারেন লেখক, লেখক নির্বাসিত হতে পারেন, এবং মৃত্যুদণ্ড পেতে পারেন। শুধু রাষ্ট্রই নয় — বিভিন্ন
ধর্মীয়,
রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর
সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হতে পারে লেখক। সেই লেখক যদি সরকারের অপ্রিয়ভাজন হন তাহলে
রাষ্ট্র সেই সুযোগ নিয়ে সেই একই পদ্ধতি প্রয়োগ হতে পারে।
ধর্ম এবং বিজ্ঞান বিষয়ে নতুন চিন্তাধারা প্রকাশ করেছিলেন ইটালিয়ান দার্শনিক ও
বিজ্ঞানী জিওর্ডানো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০) তার রচনাসমূহে। সাত বছর ব্যাপী মামলার পরে
১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আগুনে পুড়িয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। প্যাটৃক ১৯১৬
খ্রিস্টাব্দে আয়ারল্যান্ডের কবি ও টিচার প্যাট্রিক হেনরি পিয়ার্স (১৮৭৯-১৯১৬) তার
সহবিপ্লবীদের নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ধরা পড়েন ও
তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের গুলিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। স্পেনের সুবিখ্যাত লেখক ও
নাট্যকার ফেডারিকো গার্সিয়া লোরকাকে (১৮৯৬-১৯৩৬) স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের প্রথমদিকে
মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ন্যাশনালিস্ট সিভিল গভর্নর। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনী তাকে
প্রথমে অকথ্য অত্যাচার করে এবং পরে তাকে হত্যা করে। তার কবর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সমাজ,
রাষ্ট্র ও ধর্ম বিষয়ে এখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলে
গিয়েছে। এমনকি যারা ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি তাদের মধ্যেও নিজেদের ধর্ম বিষয়ে নতুন
চিন্তাভাবনা এসেছে। এর কারণ হচ্ছে মানুষ চেয়েছে ধর্মের আওতায় থেকেও পরিবর্তিত
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে। আর তার ফলে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন ইসুতে ধর্মীয়
দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছে।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘পঞ্চশিলা’-তে বলা হয়েছে—“প্রত্যেকেই শাস্তিকে ভয় পায়। প্রত্যেকেই
মৃত্যুকে ভয় পায়। ঠিক তোমারই মতো। সুতরাং তুমি কাউকে হত্যা করবে না, অথবা এমন কিছু করবে না যার ফলে কেউ নিহত হতে পারে।” বলা
হয়েছে –
“তাকেই আমি ব্রাহ্মণ বলব যে অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছে এবং সকল
প্রাণীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ছেড়ে দিয়েছে। সে কাউকে হত্যা করে না। সে অন্য কোনো
ব্যক্তিকে হত্যায় সাহায্য করে না।” অনেক বৌদ্ধগণ মনে করেন কোনো
আইনগত পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিরোধী তাদের ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলোর
মধ্যে বেশির ভাগ দেশে কিছু অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ৮১৮ খ্রিস্টাব্দে
জাপানের সম্রাট সাগা মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও কিছু জমিদার তাদের
এলাকায় মৃত্যুদণ্ড চালু রেখেছিলেন। ১১৬৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানে আবার মৃত্যুদণ্ড চালু
হয়। এখনো তাই। অবশ্য সম্প্রতি জাপানের কিছু বিচারক মৃত্যুদণ্ড সই করতে রাজি হননি।
এ ক্ষেত্রে যুক্তিস্বরূপ তারা নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য
বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে ভুটান ও মঙ্গোলিয়া মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। শ্রীলংকা
একসময়ে মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করলেও আবার সেটা চালু করেছে। থাইল্যান্ডে মৃত্যুদণ্ড
বরাবরই চালু ছিল এবং আছে। তবে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে এ বিষয়ে
মতভিন্নতা আছে। বুদ্ধ তার বাণী দিয়ে খুনি এবং অপরাধীদের যে সংশোধিত করেছিলেন সে
বিষয়ে বৌদ্ধ পুরাণে অনেক কাহিনি আছে। যেমন, আঙ্গুলিশালা
৯৯৯ জনকে হত্যার পর নিজের মা এবং বুদ্ধকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধের
প্রভাবে তিনি অনুতপ্ত হন এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সব পশুপ্রাণী হত্যা সম্রাট অশোক নিষিদ্ধ
করেছিলেন এবং তিনি চেয়েছিলেন মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে। মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে বহু
রকমের মতামত আছে। কেউ মনে করেন, জিশু যে ক্ষমার বাণী প্রচার
করেছিলেন তার সম্পূর্ণ বিরোধী মৃত্যুদণ্ড, কারণ
এটি প্রতিহিংসার বাস্তবায়ন। সুতরাং এটি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। আবার কেউ
মনে করেন,
ওল্ড টেস্টামেন্ট আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত।
মৃত্যুদণ্ড বিরোধীরা মনে করিয়ে দেন, জিশু বলেছিলেন, এক গালে চড় খেলে আর-এক গাল বাড়িয়ে দিতে। তারা মনে করিয়ে দেন, পরকীয়া প্রেমে অভিযুক্ত ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এক নারীকে যখন পাথর ছুড়ে মারা
হচ্ছিল তখন জিশু সেটা বন্ধ করেন। মৃত্যুদণ্ডবিরোধীরা বলেন, এই
ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, শারীরিকভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার
বিপক্ষে ছিলেন যিশু। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের পক্ষেও ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা আছেন। আমেরিকায় সকল ধরনের মৃত্যুদণ্ডের
বিরোধিতা যারা সবচেয়ে আগে করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টানদের
একটি শাখা,
দি রিলিজিয়াস সোসাইটি অফ ফ্রেন্ডস বা কোয়েকার চার্চ।
সাদার্ন ব্যাপটিস্টরা খুন ও দেশদ্রোহিতার দায়ে দণ্ডিতদের মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করলেও
তারা বলেন,
সেখানে যেন কোনো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা অথবা রাষ্ট্রীয়
বৈষম্য না থাকে। ইউনাইটেড মেথডিস্ট চার্চ এবং অন্যান্য মেথডিস্ট চার্চও
মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। তারা বলেন, সামাজিক প্রতিশোধ নিতে কোনো
মানুষকে মেরে ফেলা উচিত নয়। মেথডিস্ট চার্চ আরও বলে, মৃত্যুদণ্ডের
শিকার হয় অসমভাবে গরিব, অশিক্ষিত, সংখ্যালঘু এবং মানসিক রোগাক্রান্ত অথবা আবেগপ্রবণ মানুষরা। হিন্দু ধর্মের
বিভিন্ন গ্রন্থে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে এবং বিপক্ষে বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে অহিংসার
বাণী প্রচারিত হয়েছে যেখানে দাবি করা হয়েছে “আত্মা
অবিনশ্বর …
মৃত্যু কেবল দৈহিকভাবে হতে পারে।” কিন্তু
ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়েছে, খুনের কারণে এবং ন্যায়সঙ্গত
যুদ্ধের সময়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে। মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে ইসলামি জ্ঞানীজনদের
মধ্যে কিছু বিতর্ক আছে। প্রায় সব ইসলামি দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। তবে সেটা
কার্যকরের পন্থা হয় ভিন্ন। কিছু ইসলামি দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি
ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে বাঁচতে পারেন। বর্তমান যুগে অধিকাংশ খ্রিস্টানরা যেমন
মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন তেমনটা মুসলিমরা করেননি। তদুপরি কিছু মুসলিম
দেশে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় এবং সেই ছবি পত্রিকা ও ইন্টারনেটে প্রকাশ
করায় মুসলিমরা সাধারণত চিত্রিত হয়েছেন মৃত্যুদণ্ডের পক্ষপাতী এবং প্রাচীনপন্থী
রূপে। ইহুদি ধর্মে নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করা হয়। তবে সেই দণ্ড দেওয়ার
আগে সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় সকল সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া
হয়েছে। একটি নির্দেশে বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ডের মামলায় তিনজন নয়, অন্ততপক্ষে ২৩ জন বিচারককে থাকতে হবে। দ্বাদশ শতাব্দীর ইহুদি জ্ঞানী ব্যক্তি
মুসা ইবনে মায়মুন বলেন, একজন নিরপরাধের মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর করার চাইতে এক হাজার অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া শ্রেয়। মুসা বিন মায়মুন যুক্তি
দেন,
সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত না-হয়ে একজন অভিযুক্তকে মেরে ফেললে
আমরা একটা পিচ্ছিল পথে পড়ে যাব এবং শেষ পর্যন্ত বিচারকের অভিরুচি মোতাবেক দণ্ড
হবে। “It
is better and more satisfactory to acquit a thousand guilty persons than to put
a single innocent one to death... that executing a defendant on anything less
than absolute certainly would lead to a slippery slope of decreasing burdens of
proof, until we would be convicting merely, according to the judge's caprice.”
কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর মনে করেন, সন্ত্রাসবাদীদেরও
মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত নয়। শশী থারুর ট্যুইট করে বললেন, “এটি
একটি বিলুপ্তপ্রায় শান্তি। এইসব দোষীদের কোনও ছুটি না-দিয়ে সারাজীবন জেল বন্দি করে
রাখা উচিত।”
শশী বলেন, “একসময় সমাজে এই ধারণা ছিল যে
কেউ কাউকে খুন করলে তাকে মৃত্যুর সাজাই দিতে হবে। আমরা এযুগে দাঁড়িয়ে কেন সেই
পন্থা অবলম্বন করব? আমরা যখনই মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করি, তখন আমরা ওদের জায়গাতেই পৌঁছে যাই। ওরা খুনি। তাই বলে আমাদের উচিত নয় ওদের মতো
ব্যবহার করা।”
মুম্বই বিস্ফোরণে দোষী সাব্যস্ত ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির পর
দুঃখপ্রকাশ করে ট্যুইট করেছিলেন শশী থারুর। সেই প্রসঙ্গে এদিন এই কংগ্রেস সাংসদ
বলেন,
“আমি কোনও নির্দিষ্ট মামলার বিরুদ্ধে একথা বলিনি।
মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিরুদ্ধে বলেছি।” থারুর জানান, ইতিমধ্যেই ১৪৩টি দেশে মৃত্যুদণ্ড উঠে গিয়েছে। অন্য ২৫ টি দেশে আইনের থাকলেও তা
প্রয়োগ করা হয় না। মাত্র ৩৫ টি দেশে এই আইনের প্রয়োগ রয়েছে।
অপরাধবিজ্ঞানী ও সমাজতাত্ত্বিক পণ্ডিতরা মনে করেন, সুসংগঠিত
সুস্থিত সমাজব্যবস্থায় কিছু সংখ্যক মানুষ কেন অসুস্থ-অস্বাভাবিক-অসামাজিক
মানসিকতায় সমাজবিরোধী অপরাধে প্রবৃত্ত হয় এবং কঠোর শাস্তির বিধান ও দৃষ্টান্ত
থাকলেও কেন অপরাধ থেকে নিবৃত্ত হয় না? মানুষের সামাজিক অস্তিত্বে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় চিন্তাভাবনা এবং নানান মানসিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া কার্যকর থাকে। এসব
বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান ও অপরাধবিজ্ঞানে গবেষণা চলছে। আর্থ-সামাজিক প্রভাব, অপরাধমনস্কতা, বংশানুক্রমিক বা জিনগত প্রবণতা – মানসিক ও শারীরিক প্রক্রিয়ার দ্বারা অপরাধীর সংশোধন প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে
জড়িত।প্রাচীন ভারতে এবং অন্যান্য দেশেও সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক আদর্শে মানুষ
নামক প্রাণীটির সম্পর্কে দু-রকম ভাবনা নিবদ্ধ।মনু দণ্ডের আলোচনায় বলেছেন – দণ্ড ছাড়া সমাজ অচল। কারণ সবদিক বিচারে একেবারে খাঁটি মানুষ বিরল। “দুর্লভো হি শুচির নরঃ”।
মানুষ জৈবিক কারণে (ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও যৌনতাড়নায়) এবং
সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিতাড়িত হয়ে অনেকসময় অপরাধে
প্ররোচিত হয়। অর্থাৎ সামাজিক বৈষম্য এবং বিরুদ্ধ অবস্থায় অসহিষ্ণু হয়ে মানুষ
অপরাধে প্রবৃত্ত হয়। সুতরাং তাঁদের মতে অপরাধ তথা অপরাধী দুই-ই সমাজের সৃষ্টি।
অতএব মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হত্যার পথ থেকে সরে গিয়ে সমাজব্যবস্থাকে সার্বজনীন কল্যাণ
এবং সুসংহত আদর্শের অনুকূল করে গড়ে তুলতে পারলে সমাজ থেকে অনেক অপরাধই লুপ্ত হয়ে
যাব। চাই একটা সাম্যের সমাজ। সাম্যের সমাজ তৈরি করতে পারলে অপরাধমুক্ত পৃথিবী
উপহার দেওয়া সম্ভব।
কিছুদিন আগে ভারতে এক সন্ত্রাসবাদীর মৃত্যুদণ্ডকে কেন্দ্র করে জনৈক ব্যক্তি
ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে বললেন, যাঁরা মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে
বক্তব্য রাখছেন তাঁরা আসলে দেশদ্রোহী। তিনি আরও বলেছিলেন, এদের
মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড দিলে আমাদের ট্যাক্সের টাকা থেকে পুষতে
হবে কেন? আমি বলি -- ট্যাক্সের টাকা?
কী হয় আমাদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে? কোথায় খরচ হয়ে যায় সেই টাকা? সুইস
ব্যাঙ্কে যে হাজার হাজার কোটি কালো টাকা যেসব মহামতিরা গচ্ছিত রেখেছেন তারা কি
দেশপ্রেমী? এই যে হাজার হাজার কোটি টাকা
তাঁদের সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত আছে সেগুলি কোন্ টাকা? দেখবেন নাকি পাসবইগুলি? এইসব
তথ্য WikiLeaks–এ ফাঁস হয়েছে। (১) Ashok Gehlot (2,20,000
কোটি টাকা),
(২) Rahul Gandhi (1,58,000
কোটি টাকা),
(৩) Harshad Mehta (1,35,800
কোটি টাকা), (৪) Sharad Pawar (82,000 কোটি টাকা), (৫) Ashok Chavan (76,888 কোটি টাকা), (৬) Harish Rawat (75,000 কোটি টাকা), (৭) Sonia Gandhi (56,800 কোটি টাকা), (৮) Muthuvel Karunanidhi (35,000 কোটি টাকা), (৯) Digvijay Singh (28,900 কোটি টাকা), (১০) Kapil Sibal (28,000 কোটি টাকা), (১১) Rajeev Gandhi (19,800 কোটি টাকা), (১২) Palaniappan Chidambaram (15,040 কোটি টাকা), (১৩) Jayaram Jaylalitha (15,000 কোটি টাকা), (১৪) Kalanithi Maran (15,000 কোটি টাকা), (১৫) HD Kumarswamy (14,500),
(১৬) Ahmed Patel (9,000), (১৭) J
M Scindia (9,000), (১৮) Ketan Parekh (8,200 কোটি টাকা), (১৯) Andimuthu Raja (7,800 কোটি টাকা), (২০) Suresh Kalmadi (5,900 কোটি টাকা)। (http://www.india.com/news/india/list-of-black-money-holders-in-swiss-bank-accounts-leaked-by-wikileaks-182160/) এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ভারতের কোনো লাগবে ? এত হাজার হাজার কোটি টাকা সব দেশ থেকে বিদেশে চলে গেল!! দেশ সর্বস্বান্ত হল।
লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি আর মুদ্রাস্ফীতির জন্য কে বা কারা দায়ী?
আর একটা মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত মানুষকে বাঁচিয়ে রেখে সশ্রম
কারাদণ্ড দিলে কত কোটি টাকা খরচা হয়ে যেত? জেলে আসামীদের রেখে দিলে যদি আপনার ট্যাক্সের টাকা খরচা হয়ে যায়, তাহলে তো লাখো লাখো জেলবন্দি সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের হত্যা করে ফেলা উচিত। শুধু
যে সাজাপ্রাপ্ত আসামীরাই জেলবন্দি থাকে তা
তো নয়,
বহু অভিযুক্ত বিনা বিচারে জেলখানাগুলিতে বছর বছর ধরে পচছে।
টাকা লাগে না? টাকা লাগে বলে মৃত্যুদণ্ড বা
হত্যা করা কোন্ যুক্তিতে? প্রাণদণ্ড বহাল রাখা
মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই দণ্ড বিচারক ও জুরিমহোদয়দের ব্যক্তিগত নীতিবোধ, আবেগ-অনুভূতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, জন্মগত
সংস্কার-পরম্পরা এবং পছন্দ-অপছন্দ অনুযায়ী প্রযুক্ত হয়। কখনো-কখনো তাদের ভুল
সিদ্ধান্তের ফলে নির্দোষ মানুষও এমন দণ্ড পায়। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ সাপেক্ষে এই দণ্ড বিহিত হয়।পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে খুব কম
খুনিই দ্বিতীয়বার খুন করে। কিন্তু ফাঁসুড়েরা একাধিকবার খুন করে। খুন করে রাষ্ট্রের
নির্দেশে। অনেকেক্ষেত্রেই এইসব ফাঁসুড়েরা হয় সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা। প্রাসঙ্গিক
কারণেই,
আমি এমনই এক ফাঁসুড়ের কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই, যিনি নিজেই একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামী। বঙ্গবন্ধুর খুনী এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে
দণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর যে কয়েকটা নাম খুব বেশি আলোচিত
হয়েছে তার মধ্যে একটি নাম শাহজাহান। শাহজাহানের পুরো নাম কাদের মোহম্মদ শাহজাহান
ভূঁইয়া। জেলখানার ভিতর তাকে ‘জল্লাদ শাহজাহান’ নামেই চেনেন সবাই। এই শাহজাহান জেলখানার ভিতরে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের অনেকগুলি
বসন্ত। জল্লাদ শাহজাহান দীর্ঘ ৩৬ বছর যাবৎ কারাবন্দি অবস্থায় আছেন। রাষ্ট্রের
নির্দেশে এ পর্যন্ত ৪৫ জনকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছেন তিনি। ব্যক্তি হিসেবে
শাহজাহান ভূঁইয়া খুবই ভালো প্রকৃতির ছিলেন। পারতপক্ষে কারোর উপকার ছাড়া ক্ষতি
করার চেষ্টা করতেন না। তিনি প্রচণ্ড বন্ধুপাগল ছিলেন। একবার তার গ্রামে নারীঘটিত
একটি ঘটনা ঘটে। তাতে দুই বন্ধুসহ তার নামে অভিযোগ ওঠে। তাকে নিয়ে গ্রামে
বিচার-সালিশ বসে। সেই বিচারে তাকে অপরাধী প্রমাণ করে সাজা দেওয়া হয়। এরপর থেকেই
তার ক্ষিপ্রতা শুরু। তিনি অপমান সহ্য করতে না-পেরে সিদ্ধান্ত নেন অপরাধ জগতে
প্রবেশ করে এই অপমানের চরম প্রতিশোধ নেবেন। নারীঘটিত ওই ঘটনার পর শাহজাহান ভূঁইয়া
বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। তা ছাড়া
কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করার পর থেকে যে-কোনো অপারেশনে তার চাহিদা দিন দিন বাড়তে
থাকে। তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন করেছিলেন ১৯৭৯ সালে মাদারিপুর জেলায়।
আর তা ছিল শাহজাহান ভূঁইয়ার জীবনের শেষ অপারেশন।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায়
যাবে। রাতভর মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হলেও পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি।
শাহজাহান ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন। পথে পুলিশ তাকে আটক করে এবং
তার গতিময় জীবনের সমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় বন্দিজীবন। ১৯৭৯ সালে আটক হওয়ার আগে ও
পরে তার নামে সর্বমোট ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি অস্ত্র মামলা, একটি ডাকাতি মামলা এবং ৩৪টি হত্যা মামলা। ১৯৮৮ সালে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়।
এরপর ১৯৯৫ সালে তার ১৪৩ বছরের সাজা হয়। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১০০ বছর মকুব
হয়ে ৪৩ বছরের জেল হয়। জেল থেকে বের হওয়ার তারিখ শাহজাহানের জেল কার্ডের উপর
লেখা আছে ‘ডেট অব রিলিজ ২০৩৫’।
যখন তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন তখন তার বয়স হবে ৮৫ বছর। কী লাভ হবে তখন
কারাগার থেকে বের হয়ে? এ জন্য
তিনি সিদ্ধান্ত নেন জল্লাদের খাতায় নাম লেখাতে। তিনি জানতেন একটা ফাঁসি দিলে দুই
মাস চার দিনের সাজা কমে। এভাবে যদি সাজা কিছুটা কমে! জেলারের অনুমতি নিয়ে ১৯৮৯
সালে প্রথম তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসাবে গফরগাঁওয়ে নুরুল ইসলামকে ফাঁসি দেন। ওটাই
ছিল শাহজাহানের জীবনে কারাগারে কাউকে প্রথম ফাঁসি দেওয়া। তার যোগ্যতা দেখে আট বছর
পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের আসন প্রদান করে। আর প্রধান
জল্লাদ হওয়ার পর ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন তিনি। ১৯৭১
সালের পর এখন পর্যন্ত সাড়ে চার শতাধিক মানুষকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এক
হাজারের বেশি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি কারাগারে রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা
কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন শতাধিক। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ছাড়াও দেশের আরও
১৪টি কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ আছে।
জল্লাদ শাহজাহান বলেন, “যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল
তিনি তাদের ফাঁসি দিয়েছেন।” তিনি আশা করেছিলেন “শেখের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী, সে তার দিকে একটু সুনজর দেবেন।
কিন্তু কে রাখে কার খবর? তার
কথা কেউ বিবেচনা করেনি।” তিনি বলেন, “নেলসন ম্যান্ডেলা বেশি সময় জেলখানায় কাটিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন। আর এখন
তিনি (শাহজাহান) জীবনের ৩৬টি বছর কারাগারে কাটিয়ে দিলেন। বাইরে মানুষ হত্যা করলে
জেল হয়,
ফাঁসি হয়। আর এখানে এত মানুষ হত্যা করছি, কিন্তু কিছুই হয় না।”
মেরঠের কাল্লু ও তাঁর ছেলে মামু এবং পশ্চিমবঙ্গের নাটা মল্লিক মারা যাওয়ার
পরে বর্ষীয়ান বাবুই আপাতত ভারতের তথা দেশের একমাত্র ফাঁসুড়ে। ইন্দিরা গান্ধির
হত্যাকারী সতবন্ত সিংহ ও কেহর সিংহের ফাঁসিও দিয়েছিলেন বাবু ও কাল্লু। নাটা
মল্লিক শেষবার ২০০৪ সালে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে ফাঁসি দেন। তবে বাবু অসমে ফের
ফাঁসি দিতে আসতে রাজি হলেও বাবুর দুই ছেলে বাবার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। তাঁরা
ফাঁসুড়ের বৃত্তি গ্রহণে রাজি নন।
যেসব রাষ্ট্র হত্যা করবেনই ঠিক করে ফেলেছেন তখন সাধারণ মানুষকে দিয়ে কেন হত্যা
করানো হবে,
সেই ব্যক্তি যিনি সাজাপ্রাপ্ত? এই হত্যাকাণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনেতা অথবা প্রধানমন্ত্রী
অথবা রাষ্ট্রপতি অথবা দণ্ডদাতা বিচারপতিই কার্যকর করুন না, নিজের
হাতে।
বহুকাল আগে থেকেই চালু থাকলেও বিংশ শতাব্দীতে মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে ক্রমেই
বিভিন্ন দেশে জোরালো যুক্তিতর্ক হচ্ছে। বিশেষত মৃত্যুদণ্ড বিলোপের জন্য বিভিন্ন
দেশে প্রভাবশালী কিছু সংগঠন গড়ে ওঠে। যেমন ব্রিটেনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
ইত্যাদি। যাদের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে পৃথিবী থেকে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা।
অপরদিকে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষেও মতামত আসতে থাকে, বিশেষত
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে যে সাধারণ যুক্তি দেওয়া হয়, তা হল -- এর ফলে অপরাধের সংখ্যা কমে যায়, এটা
পুলিশ ও সরকারি উকিলের সহায়ক হয়। মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করে
বিনিময়ে জীবন রক্ষার ডিল করতে পারে, দণ্ডিত অপরাধী আর কোনোদিনই যে
অপরাধের পুনরাবৃত্তি করতে পারবে না সেটা মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করে। শিশু হত্যা, সিরিয়াল খুন এবং নির্যাতনমূলক হত্যার মতো নৃশংস অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডই
হচ্ছে ন্যায়সঙ্গত শাস্তি।
মৃত্যুদণ্ড বিরোধীরা যুক্তি দেন যে, এসব যুক্তির বিপরীতে
যারা হত্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সবাই যে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড চান, তা নয়। যেমন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির হত্যাকারীকে সোনিয়া
গান্ধি মকুব করে দিয়েছিলেন। সাধারণত দেখা যায়, সংখ্যাগুরু
সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা ও বিত্তশালীরা বিভিন্নভাবে মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রেহাই
পেয়ে যায়। কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ঠ ও গরীবরা মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয়। মৃত্যুদণ্ড
সহিংসতার কালচারকে উৎসাহিত করে। ফলে দেশে সহিংসতা বেড়ে যায়। মৃত্যুদণ্ড মানুষের
মৌলিক অধিকার লংঘন করে। মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করার পিছনে আর যুক্তির মধ্যে আছে। যেমন – (১) নানা স্তরে সাক্ষ্য, জিজ্ঞাসাবাদ, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের পরই একজনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তার পরও
প্রশ্ন থেকে যায় সে বিচারও কি ভুলত্রুটিমুক্ত? প্রশ্নাতীতভাবে এর উত্তর হবে, না। তাহলে নির্দোষ ব্যক্তির
ফাঁসি হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে। তাহলে যার জীবন নেওয়া হল তার জীবন
কি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব, যদি পরে দেখা যায় সে ব্যক্তি
সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ? (২) দোষী ব্যক্তি যেন আর
অপরাধ করতে না-পারে সেজন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তার
দণ্ডও হয়ে থাকে। কিন্তু দোষী ব্যক্তিকে যদি মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আজীবন কারাদণ্ড
দেওয়া হয়,
তাহলে সে তো আর অপরাধ করতে পারছে না। “বিরল থেকে বিরলতম” অপরাধের ক্ষেত্রে যদি অপরাধীকে কঠোরভাবে
সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় আমৃত্যু -- তাহলে কেন মৃত্যুদণ্ড? (৩) খুনের শাস্তি আর-একটি ‘খুন’ দিয়ে
হতে পারে না। এটাকে কোনোভাবেই ন্যায়বিচার বলা যায় না। প্রতিশোধ বলা যেতে পারে। (৪)
সংবিধানের জীবনের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তার সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা মোটেও
সংগতিপূর্ণ নয়।
দেখা গেছে,
সারা বিশ্বে যত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, তার ৯০ শতাংশই হয় এশিয়ায়। এমনকি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সুদান, ইরান এবং সৌদি আরবে ১৮ বছরের কম বয়সিকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কী ভয়ঙ্কর! চিনে
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১২ সালে এ সংখ্যা চার হাজারেরও অধিক। প্রাচীন
এবং মধ্যযুগে প্রায় সব দেশেই প্রকাশ্যেই ফাঁসি দেওয়ার রীতি থাকলেও বর্তমানে ইরান, সৌদি আরব এবং সোমালিয়া ছাড়া অন্য সব দেশে তা বন্ধ করা হয়েছে।
সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তখনকার আদালত। অভিযোগ— তিনি যুবসমাজকে ধ্বংস করছেন। তার বয়স ছিল তখন ৬৩ বছর। তিনি আরও দীর্ঘ জীবন
পেলে পৃথিবী আরও কত কী পেত, সেটা ভাবাই যায় না। মৃত্যুদণ্ডের
মাধ্যমে এভাবে কত ক্ষতি হয়ে গেল পৃথিবীর, কে তার হিসাব রাখে?
একবিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের অপরাধের জন্য আর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া
হয় না ঠিকই,
কিন্তু অন্যান্য অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার হার এখনও
অনেক বেশি। মূলত হত্যা, নিজ দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ধর্ষণ,
মাদক পাচার এ ধরনের অপরাধের কারণেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়ে
থাকে। সামান্য কিছু চুরি করার কারণেও ইংল্যান্ডের মতো দেশে বছরে শত শত মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর হত একসময়। অষ্টম হেনরির সময় ৭২ হাজার চোরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। নিশ্চয়ই
সেদিন আর নেই। মানুষ সভ্য হয়েছে বলে দাবি করে। সভ্য হওয়ার নমুনা হিসাবে পৃথিবীর
অনেক দেশেই মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত হচ্ছে একের পর এক। যেসব দেশে এখনও বন্ধ হয়নি, সেখানেও মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করার জন্য আন্দোলন চলছে।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭০ টি মানবাধিকার সংস্থা সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে
মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে লন্ডন ভিত্তিক মনেস্টি
ইন্টারন্যাশনাল অন্যতম। অ্যামনেস্টির দেওয়া তথ্য মতে -- "এখন পর্যন্ত ১৪০টি
দেশ মৃত্যুদণ্ড আইনগতভাবে বা প্রথা হিসাবে বাতিল করেছে। যে মাত্র নয়টি দেশ ২০০৯
থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ফাঁসি কার্যকর করেছে তার মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ অন্যতম।" প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ড এবং কার্যকর বিষয়ে
অ্যামনেস্টি বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, শাস্তি হিসাবে বিশ্বে ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার
সংখ্যা বেড়েছে৷ ২০১৪ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ২ হাজার ৪৬৬ জন, যা
আগের বছরের তুলনায় শতকরা হিসাবে ২৮ ভাগ বেশি৷ মিশর ও নাইজেরিয়ায় গণবিচারে কয়েক শত
মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় এই সংখ্যা বেড়েছে৷ অ্যামনেস্টি বলছে, চিনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার কারণে
সেখানকার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হিসাব পাওয়া যায় না৷ চিন এই হিসাব প্রকাশ করে না৷
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রদত্ত বার্ষিক রিপোর্টের পরিসংখ্যান থেকে যায় যে, ১৯৯৬ সালে সারা বিশ্বে মোট ৪২৭২ জন ফাঁসিতে মৃতর মধ্যে ৩৫০০ জন শুধু চিনের। এই
তালিকায় এগিয়ে আছে মুসলিম রাষ্ট্রগুলি। রাশিয়া, ইউক্রেন, ইরান,
তুর্কমেনিস্তান, আমেরিকা, পাকিস্তান,
বাংলাদেশ এবং ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলিতে মাত্র ওই এক বছরে শত
শত মানুষকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।১৯৯৫ সালে গোটা দুনিয়ায় হত্যা করা হয়েছিল
৩২৭০ জনকে। ২০১৩ সালের মতো ২০১৪ সালেও ২২টি দেশেই শুধু মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়৷ ২০
বছর আগে সংস্থাটি যখন প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে তখন মোট ৪২টি দেশে মৃত্যুদণ্ড
দেওয়া হয়েছিল৷
অ্যামনেস্টির ‘ডিরেক্টর অফ গ্লোবাল ইস্যুজ' অড্রে
গাউঘ্রান বলেন,
‘‘মৃত্যুদণ্ড কোনো সুবিচার নয়৷'' মিশর
এবং নাইজেরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে অ্যামনেস্টি ভীষণ উদ্বিগ্ন৷ ২০১৪ সালে নাইজেরিয়ায়
৬৫৯ জন এবং মিশরে কমপক্ষে ৫০৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়৷ দু-দেশেই বৃদ্ধির হার
উদ্বেগজনক৷ ২০১৩ সালে ১৪১ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল নাইজেরীয় সরকার৷ মিশরে সে বছর
১০০-র মতো লোককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল৷
আমি মৃত্যুদণ্ড বিরোধী। আমি মনে করি রত্নাকররা “বাল্মীকি” হতে পারলে ধনঞ্জয়রাও অন্য কিছু হতে পারত। সেদিন যদি রত্নাকরকে জঘন্য খুনের অপরাধের কারণে ক্ষমা না-করে হত্যা করা হত, “রামায়ণম্”
কোথায় পেতাম? মহাকবি
কোথায় পেতাম? রত্নাকরকে বাঁচিয়ে সমাজের কি
খুব ক্ষতি হয়ে গেছে? মৃত্যুদণ্ড কোনো রাষ্ট্রের
স্বৈরচারিতারই নামান্তর। না, রাষ্ট্রের এহেন স্বৈরাচারিতা
মেনে নেওয়া যায় না। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের বাঁচার অধিকার
আছে। ফাঁসির বদলে অন্য যে-কোনো শাস্তি তারা পেতে পারে। আমৃত্যু যাবজ্জীবন?
নয় কেন? অবশ্য আজকাল আমি যাবজ্জীবনেও
আপত্তি করি। জেলখানা ব্যাপারটাকেই পছন্দ করি না। জেলখানাগুলি হতে পারে সংশোধনী
কেন্দ্র। যতদিন মাথার দুষ্টু কীটগুলি মরে যাচ্ছে, ততদিন
পর্যন্ত অপরাধীরা থাকবে ওই কেন্দ্রে। কে যেন একজন বলেছিলেন, “জেলখানার ঘরগুলি হতে পারে এক-একটা ক্লাসরুম, আর
জেলখানাগুলো এক-একটা বিশ্ববিদ্যালয়”। কিছুদিন আগে সুইডেনের
কিছু জেলখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কারণ জেলে মোটেও লোক নেই। অপরাধের সংখ্যা কম, তাই আসামীর সংখ্যাও কম। সমাজটাকে বৈষম্যহীন যত করা যায়, যত সমতা আনা যায় মানুষে-মানুষে, অপরাধ তত কমে যায়। কোনও প্রাণীই
বা কোনও মানুষই অপরাধী বা সন্ত্রাসী হয়ে জন্ম নেয় না। একটি শিশুকে যদি সুস্থ
সুন্দর শিক্ষিত পরিবেশ দেওয়া না-হয়, একটি শিশুর গড়ে ওঠার সময় যদি
তার মস্তিষ্কে ক্রমাগত আবর্জনা ঢালা হতে থাকে, তবে এই
শিশুরাই বড়ো হয়ে অপরাধ আর সন্ত্রাসে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। এ কি ওদের দোষ? নাকি যারা আবর্জনা ঢালে, আবর্জনা ঢালার যে প্রথা যারা
চালু রাখছে সমাজে, তাদের দোষ! একই সমাজে বাস করে আমি
মৌলবাদ-বিরোধী,
কেউ মৌলবাদী, কেউ খুনী, ধর্ষক,
চোর, আবার কেউ সৎ, সজ্জন। সমাজ এক হলেও শিক্ষা ভিন্ন বলেই এমন হয়। একদল লোক বিজ্ঞান শিক্ষা
পাচ্ছে,
মানবাধিকার সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করছে, আলোকিত
হচ্ছে। আর-এক দলকে ধর্মান্ধ, মূর্খ, কূপমণ্ডুক
আর বর্বর বানানো হচ্ছে। ফেলে রাখা হচ্ছে ঘোর অন্ধকারে। শিক্ষার ব্যবস্থাটা সবার
জন্য সমান হলে,
শিক্ষাটা সুস্থ শিক্ষা হলে, সমানাধিকারের
শিক্ষা হলে,
মানুষেরা মন্দ না-হয়ে ভালো হত। ছোটখাটো অভদ্রতা, অসভ্যতা,
অপরাধ থাকলেও সমাজ এমনভাবে নষ্টদের দখলে চলে যেত না, এত লক্ষ লক্ষ লোক খুনের পিপাসা নিয়ে রাজপথে তাণ্ডব করত না। যে দেশে সবার জন্য
খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য নেই, সেই
দেশে অরাজকতা থাকবেই। অন্য সব ব্যবস্থার মতোই বিচারব্যবস্থাতেও আছে পাহাড়প্রমাণ
গলদ। বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, “অপরাধীর যথার্থ দণ্ড না হইলে
সমাজের অমঙ্গল”। কিন্তু দণ্ডের যথার্থতাই যদি প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ায়?
আইএসআইয়ের ফলিত রাশিবিজ্ঞানের দুই অধ্যাপকের গবেষণা প্রশ্ন
তুলেছে এক দশকেরও বেশি আগের ধনঞ্জয়ের ‘বিরলতম’ অপরাধের
তদন্ত প্রক্রিয়াকে নিয়েই। প্রশ্ন তুলেছে, বহুচর্চিত আরুষি মামলার
মতো হেতাল পারেখ হত্যাকাণ্ড ‘অনার কিলিং’ নয় তো? তারাশঙ্করের ভাষায় – “কলঙ্কিনী রাধার দণ্ড না দিলে মান থাকে কোথা?” গবেষকদের
বিলম্বিত গবেষণা ভিত্তিহীন হতেই পারে। কিন্তু সর্বনাশা সংশয়টা অন্যত্র। যে তদন্তের
শাস্তি হিসাবে রাষ্ট্র কেড়ে নিয়েছে জলজ্যান্ত একটা প্রাণ, সে
তদন্ত ঘিরে আদৌ কোনো প্রশ্নের অবকাশ থাকবে কেন? কেন থাকবে এক শতাংশ সন্দেহের জায়গাও? “জাজমেন্ট অফ এরর” হলে আর ফেরানো যাবে না ফাঁসিতে ঝোলানো
দণ্ডিতকে! সে কারণেই অপরাধ করলে কী কারণে অপরাধ করেছে, কোথায়
ভুল ছিল এসব না ভেবে, ভুলগুলি শোধরানোর চেষ্টা না-করে অপরাধীকে
জেলে ভরা হয়,
অথবা হত্যা বা খুন করা হয়। আসলে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে অনেক
সমস্যার চটজলদি সমাধান করতে চায় রাষ্ট্রগুলি। কিন্তু একে সমস্যার সত্যিকারের
সমাধান হয় না। অপরাধ বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা, এক
চিলতেও কমে না। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে সেই ভয়ে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে বলে যাঁরা
এরকম ধারণার পক্ষপাতী, তাঁদের মৃত্যুদণ্ডবিরোধীরা বলেন – যেহেতু অনেক খুনের ঘটনায় অপরাধী ধরা পড়ে না, দীর্ঘসূত্রী
বিচারপদ্ধতি,
জুরিদের মতপার্থক্য এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান বিরলতম (rarest of the
rare) হওয়ার ফলে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে অপরাধ কমবে। যদি
কমত তাহলে মৃত্যুদণ্ড চলছে হাজার হাজার বছর ধরে, এতদিনে
অপরাধমুক্ত একটা পৃথিবীতে বাস করতাম আমরা। এখন বসে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আর্টিকেল
লিখতে হত না।তা ছাড়া এমন কোনো পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই, যার
দ্বারা প্রমাণ করা যায় যে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় অপরাধ কমেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে।
এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, যে দেশগুলি থেকে মৃত্যুদণ্ড
বিলুপ্ত হয়ে গেছে চিরতরে, সে দেশে বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতায়
ভরে গেছে!
সারা পৃথিবীতে ঈশ্বর বিশ্বাসীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁদের বলি আস্থা রাখুন
ঈশ্বরের প্রতি। মৃত্যুদণ্ড দিলে তিনিই দেবেন, আপনি
নন। ঈশ্বর কারোকে হত্যা করার অধিকার দেননি, এমন
কোনো দলিলও নেই মানুষের হাতে। সুস্থ সমাজের জন্য আপনি বড়োজোর সেই সংশ্লিষ্ট
মানুষটিকে সংশোধনের সবরকমের ব্যবস্থা করতে পারেন। আপনার উপযুক্ত করে পুনর্বাসনও
দিতে পারেন। যেদিন মানুষ একটা জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে সেদিন মানুষ অবশ্যই জীবন
নেবে। একজন অসুস্থ মানুষ হঠকারিতা করে ফেলেছে বলে অন্য একজন সুস্থ
বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সেই একই হঠকারিতা করবে? (সমাপ্ত)
অনির্বাণ
বন্দ্যোপাধ্যায়
তথ্যসূত্র : (১) রাজা এবং রাষ্ট্রের ধর্ম: দণ্ডনীতির
উৎপত্তির গল্প -- অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন, (২) প্রাণদণ্ড – ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশ (৩)
মনুসংহিতা (সপ্তম অধ্যায়), (৪) সেতু –
১৫ জুলাই, ১৯৯৯, (৫) মানবাধিকার ও সিক্রেট পুলিশ – প্রদীপচন্দ্র বসু, (৬) লাঞ্ছিত মানবাত্মা – সৌমেন নাগ, (৭) মাসিক বাঙলাদেশ – মে ২০০৩, (৮) Wikipedia,
(৯) WikiLeaks, (১০) অর্থশাস্ত্রম্ – কৌটিল্য, (১১) দেশ – চিঠিপত্র – ৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৩,
(১২) এবেলা – ৮ আগস্ট, ২০১৫।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন