কেন পড়ব কবিতা? ~ অলভ্য ঘোষ



কেন পড়ব কবিতা?
অলভ্য ঘোষ

ইদানীং প্রায় শোনা যায়; কবিতার পাঠক কমছে স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং না বাড়ালে কাউকে ইমপ্রেসড করা যায় না বাস্তবে নেমে না এলে জীবন প্রতি-পদক্ষেপে বিশ্বাস ঘাতকতা করবে কবিরা কাজকর্ম করবে না ভেক ধরে দিস্তা দিস্তা কবিতা লিখে মানুষকে এক্সপ্লয়েড করে খেটে খা দেখবি কবিতা উবে যাবে যা ব্যবহারিক জীবনে একটুও কাজে আসবেনা পড়ে কী লাভ কবিতার বই পড়ার চাইতে বেনী মাধব শীলের পাঁজি পড়া ভাল

গোর্কির "রাজাধিরাজ দর্শন " থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আমি যদি জিঞ্জাসা করি;
"আপনার চেকবোই ছাড়া অন্য আর কোন্ বইটা আপনার খুব ভাল লাগে?"

উত্তর অনিবার্য "সারা দুনিয়ার দুটি বই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়; একখানি হল বাইবেল, আর একখানি হল
আমার অফিসের লেজার বই"
এমন রাজা ধীরাজেরা নির্বিকারে আর বলতে পারে;
"আমার মৃত্যুর পর গভর্নমেন্ট যদি আমার সেই লেজার বইখানা ছাপায়; তা হলে জগতের অনেক কল্যাণ হবে লোকে একটা মহৎ দৃষ্টান্ত পাবে, কি করে সামান্য অবস্থা থেকে নিজেকে উন্নত করা যায়"


গোর্কির আর এক রাজা মনে করেন;
"একটি জাতকে শাসন করা হল সবচেয়ে বড় আট্"
বোহেমিয়ান কবিতা সম্পর্কে এই মানুষেরাই খারা করেন জটিল কঠিন ব্যকারনের ব্যাখ্যা
সত্যি কারের কবিতা হল নিয়ম তান্ত্রিকতা, বাধ্যতা, যাকে বলে ডিসিপ্লিন, বুঝলেন? সৈন্যদের কুচকাওয়াজ আর ছন্দবন্ধ কবিতা একই জিনিস
আর সহজ সরল ব্যাখ্যা বেড়িয়ে আসে হৃদয়হীন অমানবিক অসাম্যবাদী দের কবিতা জ্ঞানে:
কবিতার মধ্যে যেমন শব্দ-প্যারেডের সারিতে তেমনি এক এক জন সৈনিক………………………..ঠিক হয়ে সাড়ি বেঁধে দাঁড়াও, বেয়নেট তুলে নাও, তারপর ফায়ার বুলেটের মত অব্যার্থ লাগাবে হৃদয়ে………….কতগুলো মগজ ফুঁড়ে বেড়িয়ে যাবে ……………এই তো কবিতা
এই সব রাজাদের মনে বিশ্বাস নেই আছে সদা সর্বদা সন্দেহ প্রগাড় বাসা বেঁধে বসে
আমার প্রজাদের মধ্যে যে যারা বুদ্ধিমান,যাদের খ্যাতি আছে, তারা শুনছি নাকি সবাই সাম্যবাদী হয়ে যাচ্ছে

এই সাম্যবাদী উৎকৃষ্ট মন ও মনন থেকেই কবিতার জন্ম হয় তাই কবিতা লাভ লোকসানের ফসল নয়; কবিতা জীবন সৌকুমার্যের ফসল একটা সুকুমার বৃত্তি যদিও ফসল মাত্রই কমোডিটি দুনিয়া বলবে উপভোগ্য হলে উপভোক্তা নিশ্চয়ই আছে আসলে সব কিছুকেই পণ্য বানিয়ে ফয়দা তোলার চেষ্টা চালিয়ে চলেছে এক বেনিয়া সম্প্রদায় সাড়া পৃথিবী জুড়ে ওদেরয়ই প্রতিষ্ঠিত সুবিধাবাদী দর্শনের রঙ্গিন চশমা পড়ানো রয়েছে সাধারণ মানুষের চোখে পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এমন কোন সত্যিকার কবি জন্মায়নি যাকে অপমানিত হতে হয়নি ক্ষুদার্থ আন্দোলনের  শক্তিশালী কবি শৈলেশ্বর ঘোষ জানিয়ে ছিলেন একবার এরকম একটা কথা যে কবিশব্দটা বিদ্রোহ বাচক জানিয়ে ছিলেন কবি মানে, যে বেকে বসে আজ পর্যন্ত কবিতা লিখে ধনী হয়ে গেছেন এমন কবির সন্ধান আমি পাইনি তবুও অন্যান্য শিল্প মাধ্যম গুলোর মত প্রতিটি যুগে প্রতিটি  কালে কবির মনের তাগিদ থেকেই জন্ম নিয়েছে কবিতারা বেঁচে থাকতে ভ্যান গঘের তো একটি  ছবিও বিক্রি হয়নি,তবু তিনি এঁকে গেছেন, যে কোন শিল্প এই তাগিদ থেকেই জন্ম নেয়; কবিতাও এর ব্যতিক্রম নয়
এরিস্টটলের মতে শিল্প হচ্ছে জীবনের
অনুকৃতি আর ম্যাথু আর্নল্ডের মতে; সাহিত্য হচ্ছে জীবনের ভাষ্য আর্টের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নজরুল বলেছেন;
-আর্টের অর্থ সত্যের প্রকাশ ( execution of truth ) এবং সত্য  মাত্রই সুন্দর সত্য চির মঙ্গল ময়, আর্টকে সৃষ্টি, আনন্দ বা মানুষ এবং প্রকৃতি ইত্যাদি অনেক কিছু বলা যেতে পারে তবে সত্যের প্রকাশ হচ্ছে  এর অন্যতম উদ্দেশ্য
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন;
সেটা সত্য হোক \শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ \ সত্য মূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি \ ভালো নয়, ভাল নয় নকল সে সৌখিন মজদুরি
গোর্কী শিল্প ও শিল্পী  সম্বন্ধে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন;
শিল্পী হচ্ছেন তাঁর দেশের ও তার স্বদেশ ও সমাজের যেন চক্ষু, কর্ণ আর হৃদয় এক কথায় তার যুগের বানী বা  প্রতিধ্বনি তিনি যথাসাধ্য সব কিছু জানবেন অতীতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকবে যত বেশী ততই তিনি নিজের যুগকে ভালভাবে বুঝতে পারবেন,ততই তিনি তার কালের সার্বজনীন বিপ্লবী রূপে ও কর্তব্যের পরিধি তীব্রভাবে গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন জনগণের ইতিহাস তাঁর  জানা উচিত, শুধু জানা উচিত বললেই হবে না, তাঁকে তা,জানতেই হবে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা গুলি সম্পর্কে জনগণের মনোভাব কি তাও তাকে বুঝতে হবে
শিল্পীর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে  রমাঁ রোঁলা আরো সুন্দর করে বলেছেন-শ্রমিকেরা যে পথ গড়ছে বুদ্ধি জীবীদের তা আলোকিত করতে হবে তাঁরা দুটি বিভিন্ন মজুরের দল কিন্ত্তু কাজের লক্ষ্য এক যে সংগ্রাম আজ নতুন পৃথিবীর সৃষ্টি করছে তাঁর মহান যোদ্ধা হওয়ার চাইতে বুদ্ধিজীবীদের আর কোন বড় কাজ নেই
এসব পথ ধরেই কবিতা কোন রাজনৈতিক নেতার চিপ স্টান্ট দেওয়া বক্তব্য নয়; কবির হৃদয়ের জারণ, তার জীবন অভিজ্ঞান পিকিউলিয়ার হ্যালুসিনেশন নয়;
এক্সপ্রেশন অফ হাট অ্যান্ট মাইন্ড ইন্টু দ্যা সোসাইটি

বিষ্ণু দে বলেছিলেন, কবিতা রচনা আসলে আত্ম সচেতন কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশ জানিয়ে ছিলেন; সত্যিকার কবিতা পড়ে আমাদের কী মনে হয়
মনে হয়, এ-জিনিস আমারও অভিজ্ঞতায় ছিল
যখন মানুষের ভেতর কার  সমস্ত এক্সপ্রেশান গুলো হারিয়ে যাচ্ছে! কবিই ইনটেনসিভ কেয়ার নিচ্ছে সেরিব্রাল অ্যাটাক হওয়া আমাদের মস্তিষ্কের ৬৯ সালে স্বদেশ সেন এর লেখা একটা কবিতার পঙক্তি ভীষণ বলতে ইচ্ছে করছে
-পৃথিবীতে তুমি কখন বলনা জায়গা নেই
কবিদের Mesmerism Power থাকে কবিতা সরবরের জল এতে স্নান করলে স্বস্তি মেলে এই ইট কাট লৌহ কপাটের পৃথিবী সুন্দর একটা উদ্যানে পরিণত হয় অর্থের চেয়ে দারিদ্র, আলোর চেয়ে অন্ধকার কবিদের
কল্পনাকে বেশী স্টিমিউলেট করে
বিউটি ইউ ডেথ বিউটি ইজ হেভেন বিউটি ইজ লাইট বিউটি ইউ ডার্কনেস
গোর্কী তার মা উপন্যাসে বলেছেন;
-       আর যে মানুষ ভালবেসে সারা পৃথিবীকে কোল  দিতে পারবে, যে মানুষ সর্ব বন্ধন মুক্ত সেই হবে পুরুষোত্তমকারণ সব চেয়ে বড় সৌন্দর্য ওই মুক্তিতে যারা এই নব জীবনের সাধনা করবে তারাই হবে মহাজাতি
কবি-তাইতো আমাদের ধূল পড়া চেতনাকে ধুয়ে মুছে সূক্ষ্ম বোধ গুলকে জাগিয়ে তোলে কবিতার অভিঘাতের দ্যোতনা প্রতিনিয়ত তৈরি করে-চলে দোলাচলের ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান  ফলে প্রস্ফুটিত হয় একটা নিটোল সুন্দর জীবন দর্শনের জীবন খুঁজে পায় তার এথিক্স!
আয়না মহল উপন্যাসে সুচিত্রা ভট্টাচার্য বলেছেন;
কেউ ভাবে যেমন আছি তাতেই সুখকেউ জীবন ভোর কোথায় সুখ, কোথায় সুখ বলে হাতড়ে বেড়াচ্ছে আবার কেউ বা মনে করে, সুখ মানুষের জন্যনয় ওটা একটা সাবহিউম্যান অনুভূতি
এই অস্তিত্বের ঘেরা টোপ থেকে বাড় করে কবিতাই আমাদের বিশাল বিশ্বব্রম্ভান্ডের সম্মুখীন দাড় করায় আমরা নির্নিমেষ চোখে দেখি আমরা কত তুচ্ছ নগণ্য এ বিশ্ব-পৃথিবীতে নিজেদের সুখ দুক্ষ গুলো তখন মূল্যহীন হয়ে গিয়ে পাখির পালকের মতো হালকা করে হৃদয় কে
দুনিয়া জুড়ে পেষাই কলে ফেলে মানুষকে পিষে গুড়িয়ে রাত্তির দিন টাকা তৈরি হচ্ছে! গোটা দুনিয়াটাই টাঁকশাল
…………….“ মানুষের ইচ্ছার ও সীমা নেই, তবু পৃথিবী আত্মিক সম্পদে তেমন বড় হতে পারছে কই! তার কারণ হচ্ছে টাকার মাপ কাটিতেই মাপা হয় সব মানুষ ভাবে স্বাধীন হওয়া মানে অনেক টাকা জমানো জ্ঞান সঞ্চয়ের চেয়ে অর্থ সঞ্চয়ের দিকেই তাদের নজর বেশী
(গোর্কী মাউপন্যাস )

কোনভাবে রুটিরুজির একটা সিকিওরড বন্দোবস্ত এক্সপেকষ্টেনের কড়া সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়ানো বর্তমান পৃথিবীতে কবিতা মনের ফিজিওথেরাপি আয়নার সামনে এলে যেমন আমরা আমাদের চিনতে পারি কবিতাও তেমনি আমাদের স্বরূপের মুখ মুখি দাঁড়করিয়ে দেয় মনকে নাড়াদিয়ে চাঙ্গা করে তোলে, সঞ্চয় হয় কিছু বিশুদ্ধতা আত্মার স্বচ্ছতায় কনফিডেন্স লেবেল টা যায় বেড়ে আজকের ইনার ক্রাইসিস, ম্যান্টল ক্রাইসিস; আত্মিক সংকটের দুর্দিনে কবিতা মহা-ঔষধি শেষ করবো জয় গোস্বামীর  গোসাই বাগান থেকে একটা উদ্ধৃতি দিয়ে
শতাব্দী শতাব্দী ধরে কবিকে তো দ্রষ্টা বলে আসছে পৃথিবী জন্মান্ধ টাইরেসিয়স, তিনিও তো দ্রষ্টাই ছিলেন দৈবঞ্জ টাইরেসিয়স? যিনি ভবিষ্যৎকে দেখতে পেতেন? হ্যাঁ; দেখতে পেতেন পাখির ভাষা বুঝতে পারতেন দৈববাণী শুনতে পেতেন কিন্তু নিজের বাঁচার পথ দেখতে পেতেন না এক বালক তাঁকে হাত ধরে নিয়ে যেত

অলভ্য ঘোষ

তথ্য সূত্র:
( ১) গোর্কী গল্পসমগ্র
(ক) রাজা ধীরাজ দর্শন
(খ) আর একজন রাজার সঙ্গে
অনুবাদ:- নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়
(২)শারদীয়া দেশ 2006
আয়না মহল”-
উপন্যাস:-সুচিত্রা ভট্টাচার্য
(৩) মা
উপন্যাস:-ম্যাকসিম গোর্কি
(৪) গোসাই বাগান
-জয় গোস্বামী
(৫) শতকথায় নজরুল:
নজরুলের শিল্প সত্তা
প্রাবন্ধিক:-সফিউদ্দিন আহমদ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন