সমকামিতার
চতুষ্কোণ
পারমিতা চক্রবর্ত্তী
বাংলায় সমকামিতা শব্দটির গঠন সংস্কৃত-সঞ্জাত। সংস্কৃত শব্দ ‘সম’-যার অর্থ সমান অথবা অনুরূপ এবং ‘কাম’ শব্দের
অন্যতম অর্থ যৌন চাহিদা, রতিক্রিয়া তথা যৌন তৃপ্তি।
অতঃপর এই দুই শব্দের সংযোগে উৎপন্ন সমকামিতা শব্দ বলতে আমরা বুঝি অনুরূপ বা সমান
বা একই লিঙ্গের মানুষের (বা প্রাণীর ক্ষেত্রে অন্য প্রাণীর) প্রতি যৌন আকর্ষণ ৷'সমকামিতা'
ইংরেজি প্রতিশব্দ হোমোসেক্সুয়ালিটি৷ যা এসেছে গ্রিক শব্দ ‘হোমো’
এবং ল্যাটিন শব্দ ‘সেক্সাস’। গ্রিক ভাষায় ‘হোমো’ বলতে বোঝায় সমধর্মী বা একই
ধরণের।
আর ‘সেক্সাস’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে যৌনতা ৷ সুতরাং 'সমকামিতা' শব্দটির বিশ্নেষণ দেখে আমরা বুঝতে পারছি যৌনতা মুখ্য৷ এখন যৌনতা বলতে আমরা সাধারণত নারী পুরুষের মধ্যে যৌনক্রিয়া বা যৌনউত্তাপকে বুঝি। '' যৌনতা" শব্দটি বিতর্কিত৷ সভ্যতার প্রথম দিকে সিন্ধু সভ্যতার দিকে তাকিয়ে বর্তমান ভারতীয় সংস্কৃতির উদ্ভবের রেখাপাত করা যায়, যা প্রায় ৫৫০০ বছর আগেকার প্রাচীন মিশরীয় এবং সুমেরীয় সভ্যতার সাথে সমসাময়িক ছিলো।ঐ সময়কালে, সামাজিক যৌন মনোভাব অনেকের অজানা ছিলো। যৌনতা সম্পর্কে সিন্ধু সভ্যতার মধ্যেই প্রজনন প্রথার চর্চা পরিলক্ষিত হয়েছে।
আর ‘সেক্সাস’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে যৌনতা ৷ সুতরাং 'সমকামিতা' শব্দটির বিশ্নেষণ দেখে আমরা বুঝতে পারছি যৌনতা মুখ্য৷ এখন যৌনতা বলতে আমরা সাধারণত নারী পুরুষের মধ্যে যৌনক্রিয়া বা যৌনউত্তাপকে বুঝি। '' যৌনতা" শব্দটি বিতর্কিত৷ সভ্যতার প্রথম দিকে সিন্ধু সভ্যতার দিকে তাকিয়ে বর্তমান ভারতীয় সংস্কৃতির উদ্ভবের রেখাপাত করা যায়, যা প্রায় ৫৫০০ বছর আগেকার প্রাচীন মিশরীয় এবং সুমেরীয় সভ্যতার সাথে সমসাময়িক ছিলো।ঐ সময়কালে, সামাজিক যৌন মনোভাব অনেকের অজানা ছিলো। যৌনতা সম্পর্কে সিন্ধু সভ্যতার মধ্যেই প্রজনন প্রথার চর্চা পরিলক্ষিত হয়েছে।
তারপর সভ্যতার অগ্রগতির পর দেখা যাচ্ছে 'সমকামিতা' নিয়ে মানুষ ভাবছে। একইসাথে উভকামিতা ও বিপরীতকামিতার সাথে
সমকামিতা বিপরীতকামী-সমকামী অনবচ্ছেদের অন্তর্গত যৌন অভিমুখীতাকে তিনটি প্রধান
ভাগের অন্যতম বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।কিন্তু কেন সমকামিতা? কিংবা একই লিঙ্গের মানুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ কেন? বিজ্ঞানীরা
সমকামিতার প্রকৃত কারণ জানেন না, কিন্তু তারা বিশ্বাস করেন যে, জিনগত,
হরমোনগত এবং পরিবেশগত কারণসমূহের এক জটিল আন্তঃক্রিয়ার ফলে
এটি ঘটে থাকে ৷কিন্তু এখন কেন মানুষের মধ্যে সমকামিতা প্রকোপ দেখা যাচ্ছে৷ 'প্রকোপ '
শব্দটি এই কারণেই বললাম বর্তমানে এটা ব্যাধির মত বিস্তৃতি
লাভ করছে৷ কিন্তু মানুষের সচেতন পছন্দের কোনো ভূমিকা নেই? কিন্তু তারা এখন
জীববিদ্যা-নির্ভর তত্ত্বগুলোে বেশি সমর্থন করে থাকেন,এর
অন্তর্গত হল জিন, মাতৃগর্ভের পরিবেশ, এই দুই
প্রভাবের মেলবন্ধন অথবা এই সব কিছুর সাথে সামাজিক প্রভাবের মেলবন্ধন।
যৌন অভিমুখীতা নির্ধারণে যে সন্তানপালন বা শৈশবের অভিজ্ঞতার কোনো ভূমিকা আছে
তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ সমকামী যৌন আচরণকে অপ্রাকৃতিক মনে করলেও
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সমকামিতা মানব যৌনতার একটি
সাধারণ ও প্রাকৃতিক প্রকরণ, এবং অন্য কোনো প্রভাবকের
অস্তিত্ব ছাড়া এটি কোনো নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না।যৌন
অভিমুখীতা পরিবর্তনের বিভিন্ন কর্মসূচীর কার্যকারিতা সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ নেই ৷
এখন 'সমকামিতা '
নামটিও লিঙ্গভেদের কারণে বিভিন্ন নামে অভিহিত হয় ৷ যা কিনা
পুরুষ ও নারী সমকামীকে চিহ্নিতকরণ করে থাকে৷ প্রশ্ন উঠতেই পারে একদিকে সমকাম আবার
অপরদিকে লিঙ্গভেদে নামকরণ ৷ কেন ? তথ্য প্রমাণের দ্বারা দেখা গেছে
উভয় লিঙ্গের সরকামিতার ভাবনাচিন্তা থেকে এমন নামকরণ ৷
মহিলা সমকামীদের বোঝাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দটি হল লেসবিয়ান এবং পুরুষ
সমকামীদের ক্ষেত্রে গে, যদিও গে কথাটি প্রায়শ সমকামী
মহিলা ও পুরুষ উভয়কে বোঝাতেও সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়। নানা কারণে স্বঘোষিত
সমকামীর সংখ্যা এবং মোট জনসংখ্যার মধ্যে সমলৈঙ্গিক সম্পর্কে আবদ্ধ মানুষের অনুপাত
নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। এই কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হল সমকামভীতি ও বিপরীতকামবাদের
সমর্থনজনিত বৈষম্যের কারণে অনেক সমকামী প্রকাশ্যে তাদের যৌনতা স্বীকার না করা।
অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও সমকামী আচরণের নিদর্শন নথিভুক্ত হয়েছে।অনেক সমকামী মানুষ
স্থায়ী পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকেন, যদিও আদমশুমারির ফর্ম, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইত্যাদির
আনুকূল্যে তাদের আত্মপ্রকাশের পথ নিরাপদ হয়েছে তবে সেটা একেবারে সাম্প্রতিক কালে।
মূল মনস্তাত্ত্বিক গঠনের দিক দিয়ে এই সম্পর্কগুলো বিপরীতকামী সম্পর্কের সমান।
নথিভুক্ত ইতিহাস জুড়ে সমকামী সম্পর্ক এবং কার্যকলাপের প্রশস্তি ও নিন্দা -
উভয়েরই নিদর্শন মেলে ৷কেবল প্রকাশের ভঙ্গিমা ও সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতিজনিত তারতম্য
দেখা যায়।ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে সমকামীদের অধিকারপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে
বিশ্বব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়েছে, যার অন্তর্গত বিবাহ, দত্তক গ্রহণ ও সন্তানপালন, কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকার, সামরিক পরিষেবা, স্বাস্থ্য পরিষেবায় সমানাধিকার, এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সমকামীদের নিরাপত্তার স্বার্থে অ্যান্টি-বুলিং আইন কার্যকর
রয়েছে ৷ ধীরে ধীরে সমকামীদের প্রতি সচেতনতা বেড়ে গেছে অনেক l কিন্তু ভারতবর্ষের মত দেশে যেখানে 'বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ' এই মতবাদে বিশ্বাসী হয়েও " সমকামিতা' কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি তেমন ভাবে। আমাদের সংস্কৃতি যেখানে নারী
পুরুষের সহবস্থান যতক্ষণ না সামাজিক হয় ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ বলে মনে করে না৷ আজও
যৌনতা নিয়ে বললে কিছু মানুষের ভ্রুকুন্ঠিত হয় ৷ আমাদের সংস্কৃতি আমাদের পিছিয়ে
রাখেনি আমাদের সংযত, পরিমিত, সুষ্ঠ জীবনযাপন করতে শিখিয়েছে ৷ একই ঘরে অভিবাকদের সাথে সিনেমা,টিভি দেখতে যৌনদৃশ্যে বাবা মা'র সাথে
সাথে সন্তানরাও স্বাভাবিক বোধ করেন না ৷এই আমাদের সংস্কৃতি ৷ তবে এটা দ্রুত পরিবর্তনীয়
৷
ইসরাইলকে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সমকামীদের প্রতি সবচেয়ে সহনশীল দেশ
বলে মনে করা হয়, এবং তেল আভিভকে একারণে "মধ্যপ্রাচ্যের
পুরুষ সমকামী রাজধানী" নামে ডাকা হয়,যা
বিশ্বের সমকামীদের প্রতি সবচেয়ে বন্ধুসুলভ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত
হয়।এখানে সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে ৷সমকামিতার সমর্থনে তেল আভিভে প্রতি বছর
বার্ষিক গৌরব মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
২০১৬জেরুজালেম ঘটনা: ইসরাইলে আলোচিত বার্ষিক র্যালিতে সমকামীদের ওপর
হামলাকারী ইয়েশাই শিলসেলকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে দেশের আদালত। আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময় ইয়েশাই বলছিলেন, ‘‘আমি
উপরওয়ালার ইচ্ছায় কাজটা করেছি। এরকম সমকামী র্যালি যাতে ভবিষ্যতে না হয়।”এক ইসরাইলি কট্টরপন্থী ইহুদি হামলা চালিয়েছে। র্যালি চলাকালে একটি ছুরি নিয়ে
আকস্মিক হামলা চালায় ওই ব্যক্তি।
২০১৬ ৩১ আগস্ট তার এলোপাতাড়ি ছুরির খোঁচায় আহত হয়েছিলেন ৬ জন। এদের একজন
তরুণী শিরা বানকী (১৬) হাসপাতালে মারা যান।
এর আগেও সে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। ২০০৫ সালে সমকামীদের একটি র্যালিতে হামলা
চালিয়ে চারজনকে ছুরিকাহত করার অভিযোগে কারাদণ্ড ভোগ করছিল সে। কিছুদিন পরে সে
কারাগার থেকে ছাড়া পায় এবং আবারও একই ঘটনা ঘটাল। ছয়জনকে ছুরিকাহত করার পর ইয়েশাই
শিলসেলকে ধরে ফেলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, প্রায়
৫ হাজার মানুষ এ আয়োজনে অংশ নিয়েছিলেন। তারা একটি রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছিলেন। এমন
সময় একটি সুপার মার্কেট থেকে একজন সেই ভিড়ের মধ্যে খোলা ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং
অংশগ্রহণকারীদের কয়েকজনকে ছুরিকাহত করে।সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে সরকারী অনুশাসন বৈধতা
দিলেও সচেতনতা বেড়ে ওঠেনি৷
অন্যদিকে,
মধ্যপ্রাচ্যের অনেক সরকার প্রায়শই সমকামিতাকে এড়িয়ে যায়, এর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এবং একে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। মুসলিম
দেশসমূহের সবগুলোতেই সমকামিতা অবৈধ।বহু মুসলিম দেশে সমলিঙ্গীয় যৌনসংগমের ফলে
আইনগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের সাজা প্রদান করা হয়, এরা
হল: সৌদি আরব,
ইরান, মোরিতানিয়া, উত্তর নাইজেরিয়া, সুদান, এবং
ইয়েমেন। ইরানের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ২০০৭ সালে কলম্বিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বক্তব্য প্রদানকালে বলেন যে, ইরানে
কোন সমকামী লোকজন নেই। সম্ভবত, এর একটি কারণ হতে পারে যে, তারা সরকারি তহবিল না পাওয়া অথবা পরিবার কর্তৃক ত্যাজ্য হওয়ার ভয়ে তাদের
যৌন পরিচয়কে লুকিয়ে রাখে।
"কাম" শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে বৈধতা৷ বৈধতা এই কারণে বললাম
আমাদের ছোট বেলায় অনেককেই দেখেছি
বাবা, মা 'র
সামনে বসে সিনেমা দেখার অনুমতি অবধি ছিল
না৷ আলোচনা তো অনেক দূর ৷লুকিয়ে দেখতে হত
সিনেমা। মহাভারত কিংবা রামায়ণ টিভিতে দেখার সময়
বিজ্ঞাপনে যদি যৌনতার উস্কানিমূলক কিছু অংশ থাকত তবে চ্যানেল পরির্বতন করে দেওয়া হত৷ আসলে যৌনতা জীবনের একটা অঙ্গ এটা
ভাবতে শেখান হয়নি তা স্কুল খেকেই হোক কিংবা সমাজ৷ আজকাল ইংরাজী মাধ্যম স্কুলে
জীবনশৈলী পড়ান হয় ৷ শেখান হয় জীবনের সময়ের প্রবাহমানতকে ৷ ছেলেমেয়ে বড় হবার
সাথে সাথে তাদের মানসিক গঠন যে দরকার তা বুঝেছে আজকের মা, বাবা 'রা ৷ এ প্রসঙ্গে আমার বাড়ির উল্টোদিকে এক পরিবারের ঘটনা বলি ৷ যার জন্য আমার
এই বিষয় নিয়ে লেখা। একটি পরিবারে একটি মাত্র মেয়ে নাম তমসা।ছোট থেকেই ভীষণ ভালো ও পড়াশুনায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিসম ও মাসকমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশুনা শেষ
করে চাকরী দিল্লীতে করে৷ বাবা, মা' আদরের মেয়ে একদিন ঘোষণা করে, বিয়ে
সে করবে না ৷ কলকাতার বহু বন্ধুবান্ধব তার সাথে যোগাযোগও করে কারণ জানার জন্য I প্রত্যেককে সে একই একই কথা বলে," বিয়ে করার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয় সে৷" তমসার মা,
বাবা তাকে না জানিয়ে একদিন তমসার দিল্লীর ফ্ল্যাটে গিয়ে
দেখে সে একটি মে সাথে থাকতে শুরু করেছে এবং ওরা একসাথেই থাকবে৷ বাবা,
মা 'র প্রবল চাপে তমসা সুইসাইড
করতে অবধি যায় ৷ অসহায় হয়ে মা,
বাবা ছেড়ে চলে আসে ৷
আমাদের দেশে এখনও " সমকামিতা'' স্বীকৃতি দেয়নি সে
অর্থে তবুও সচেতনতা বাড়ছে৷ পাশ্চত্য দেশে ব্যস্ততম জীবনযাত্রায় "
সমকামিতা" প্রকোপ বেড়ে চলছে ক্রমাগত ৷আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের
আগে দ্বৈত সত্তাবিশিষ্ট মানুষদের কেন্দ্র করে সমকামিতার বিশেষ একটি প্রকারের
আকর্ষণ লাভ করেছিল। সাধারণত এই ধরণের মানুষদের ছোটবেলাতেই
শনাক্ত করা হত ৷তার মা-বাবা তাকে উক্ত স্বীকৃত পথে জীবন কাটানোর প্রস্তাব দিতেন, আর সন্তান সম্মত হলে তাকে সঠিক পদ্ধতিতে পালন করে তার নির্বাচিত লিঙ্গের জন্য
নির্দিষ্ট আচারের শিক্ষা দেওয়া হত। দ্বৈত সত্তার মানুষেরা সাধারণত শামানের স্থান
লাভ করত এবং সাধারণ শামানদের চেয়ে অধিক ক্ষমতাশালী বলে গণ্য হত। তাদের যৌনসঙ্গী
হত গোষ্ঠীর অন্যান্য সমলিঙ্গের সদস্যেরা ৷ এইভাবে চলত জীবন৷ আসলে সমমনভাবাপন্ন
মানুষরা যখন এই জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠল, গড়ে উঠল গোষ্ঠী অর্থাৎ সমষ্টি৷ এক সমষ্টি থেকে আর এক সমষ্টি নির্বাচনের
ভিত্তিতে সঙ্গী নির্বাচন এমনকি বিবাহ অবধি হয়ে থাকত৷
লাতিন আমেরিকার প্রাক্-ঔপনিবেশিক বিভিন্ন সভ্যতা, যথা:
আজটেক,
মায়া, কেচুয়া, মোচে,
জাপোটেক এবং ব্রাজিলের টুপিনাম্বা জনজাতির মধ্যে প্রকাশ্য
সমকামী ও রূপান্তরকামী ব্যক্তিবর্গের বসবাস ছিল।স্পেনীয় বিজেতারা স্থানীয় সমাজে
অবাধ "সডোমি" উদ্যাপন দেখে ভীত হয়ে তা নির্মূল করার বিশেষ চেষ্টা করে।
এই চেষ্টার মধ্যে ছিল জনসমাগমে মৃত্যুদণ্ড, পুড়িয়ে
মারা এবং অভিযুক্তকে কুকুর দিয়ে খাওয়ানো। সুতরাং যতই পাশ্চত্য মহাদেশে "
সমকামিতা "স্বীকৃতি দিক একে নিয়ে বর্বরতা শেষ নেই৷ এবং এই বর্বরতা পরিণতি
মৃত্যু অবধি ছিল৷
তবে অতীত কিন্তু অন্য কথা বলে৷ আব্রাহামীয় ধর্মসমূহের দ্বারা প্রভাবিত
সংস্কৃতিসমূহে আইন ও গির্জা কতৃক সডোমিকে ঐশ্বরিক বিধানের পরিপন্থী তথা 'প্রকৃতির বিরুদ্ধাচার' বলে অভিহিত করা হয়েছে।
পুরুষদের মধ্যে পায়ুসঙ্গমের নিন্দা অবশ্য খ্রিস্টধর্মের চেয়েও প্রাচীন ৷প্লেটোর
কাজকর্মেও "অপ্রাকৃতিক"-এর ধারণার প্রমাণ পাওয়া যায়। বহু ঐতিহাসিক
ব্যক্তিত্ব,
যেমন সক্রেটিস, লর্ড বায়রন, দ্বিতীয় এডওয়ার্ড, হাদ্রিয়ান এর ক্ষেত্রে সমকামী বা উভকামীর মত পরিভাষাগুলো
মাঝেমধ্যে প্রয়োগ করা হয়। মিশেল ফুকোর ন্যায় কিছু দার্শনিকের মতে এই অভ্যাস ভুল, কারণ প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় সমাজে যৌনতার উক্ত ধারণাগুলির অস্তিত্ব ছিল না
৷তাই আধুনিক যুগে নির্ণীত শব্দ দিয়ে তৎকালীন পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গেলে
কালবিভ্রাটজনিত দোষের আশঙ্কা তৈরি হয়। অবশ্য অন্যান্য দার্শনিক এই বক্তব্যকে
চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন।
সমকামিতা " নিয়ে দেশ ও কালভেদে সমকামিতার প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির
বিভিন্ন স্তর পরিলক্ষিত হয়েছে। সমকামী সম্পর্ককে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক বলে মনে
করা,
এর প্রতি সামাজিক উদাসীনতা, সাধারণ
সহনশীলতা বা তীব্র অসহনশীলতা, একে একপ্রকার লঘু পাপ হিসেবে
গণ্য করা থেকে শুরু করে আইন প্রণয়ন ও বিচারব্যবস্থার সাহায্যে এর অবদমন এবং
মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে সমাজ সমকামিতাকে গ্রহণ বা বর্জন করেছে।
প্রাক্-শিল্পায়ন সংস্কৃতিসমূহের ঐতিহাসিক ও জাতিতত্ত্বগত নমুনার একটি
সুপরিকল্পিত সংকলনে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী "সমীক্ষাধীন ৪২ টি সংস্কৃতির ৪১
শতাংশে সমকামিতার প্রবল বিরোধিতার নমুনা পাওয়া গেছে; ২১% এর
পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, আর ১২% জানিয়েছে তারা এমন কোনো
ধারণার সঙ্গে পরিচিত নয়। সমীক্ষাধীন ৭০ টি জাতির মধ্যে ৫৯% জানিয়েছে সমকামিতা
তাদের মধ্যে অনুপস্থিত বা বিরল, এবং অবশিষ্ট ৪১% এর মতে তা
উপস্থিত বা 'বিরল নয়'। সমকামিতা শব্দটিকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয় ৷ অনেকেই স্বীকার করতে চান না৷
আমার ধারণা এই যে শতাংশ মানুষ সমকামিতার বিপক্ষে কিংবা তারা আদৌ পরিচিত নন এটার
একটি কারণ সমাজতত্ত্ব ও মনোসত্ত্ব৷
চীনে সমকামিতাকে "কাটা পীচের
প্রণয়" এবং আরও বিভিন্ন উপমার মধ্য দিয়ে কমবেশি খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দ
থেকেই ইতিহাসে স্থান দেওয়া হয়েছে। চীনা সাহিত্যের বহু বিখ্যাত কাজকর্মে
সমকামিতার উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমান পর্যালোচকদের কাছে ধ্রুপদী উপন্যাস লাল
ঘরের স্বপ্ন-তে বর্ণিত সমসাময়িক সমকামী ও বিপরীতকামী প্রেমের বর্ণনা সমান
স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হয়। কনফুসীয় ধর্ম মূলত একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন
হওয়ার ফলে এতে সম বা বিপরীত কোনো রকম কাম সংক্রান্ত বিস্তৃত বিধিনিষেধ নেই।
বিয়ান এর চাই প্রভৃতি মিং
সাহিত্যকীর্তিতে সমকামী প্রণয়কে বিপরীতকামী প্রণয় অপেক্ষা অধিক উপভোগ্য ও অধিক
"সামঞ্জস্যপূর্ণ" বলে বর্ণনা করা হয়েছে।লিউ সুং রাজবংশের আমলের লেখক
ওয়াং শুনু দাবি করেছেন যে তৃতীয় শতাব্দীর শেষভাগে সমকামিতা বিপরীতকামিতার মতই
বহুপ্রচলিত ছিল।
মধ্যযুগে তাং বংশের শাসনকালে চীনে সমকামিতার প্রতি বিরূপতার সূচনা হয়। এর
মূলে ছিল খ্রিস্ট ধর্ম ও ইসলামের আবির্ভাব। তবে এই বিরূপতা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা
পায় মাঞ্চু আমলে পাশ্চাত্যকরণ ও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
সাম্প্রতিক কালে নবলব্ধ সামাজিক সহনশীলতা এবং টোকিও, ওসাকা
প্রভৃতি মহানগরে বিকল্প যৌনতার মানুষদের তথাকথিত "মুক্তাঞ্চল" জাপানে
বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও জাপানে সমকামীরা প্রায়ই
তাঁদের যৌন পরিচয় গোপন রাখতেন; অনেকে বিপরীত লিঙ্গের সাথে
বিবাহবন্ধনে সম্মতি দিতেন। সমলৈঙ্গিক বিবাহ জাপানে আইনসম্মত নয়। জাপান টাইম্স এর
প্রতিবেদন অনুযায়ী এই বিষয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিতর্কও হয় না।
সমকামিতা এমন এক বিষয় যার ব্যাখা প্রাচীনকাল থেকে এখন অবধি খোঁজার চেষ্টা চলে
আসছে৷ নারী, পুরুষ সকল শ্রেণীর মানুষের
মধ্যে সমকামিতা বর্তমান৷ তবুও এ নিয়ে বিচার, বিশ্নেষণ আলোচনা চলে আসবে৷ পরিসংখ্যান দিয়ে ঢাকা হবে কিন্তু নির্মূল হবে না৷
তথ্যসূত্র: অন্তর্জাল
পারমিতা
চক্রবর্ত্তী
একদম সময়োপযোগী লেখা । শুভেচ্ছা.....
উত্তরমুছুন