রীনা তালুকদার
রবীন্দ্র-নজরুল একজন বিশ্বকবি অন্যজন বিদ্রোহী কবি। দুইজনকে কেউ বড় বানায় কেউ
ছোট বানায়। অদ্ভূত বাঙালী জাতির সন্তান আমরা। অথচ দুইজনই যুগের কাছে শ্রেষ্ঠ। যে
বিষয়গুলো নজরুল-রবীন্দ্র পৃথক সেটি বিস্তর আলোচনার প্রয়াস রয়েছে। একই সাথে
রবীন্দ্র যুগে জন্মগ্রহণ করেও রবীন্দ্র থেকে যেমন পৃথক তেমনটি অন্যদের চেয়েও নজরুল
লেখনীর বৈশিষ্ট্যে পৃথক। ভাষা ব্যবহারের তীব্রতায় নজরুল নিজেকেই ছাড়িয়ে গেছেন।
রৌদ্ররস ও বীররসের দারুণ অভিব্যক্তিতে নজরুলের সাহসী ও বীরত্বের ভাষা সহজেই বোঝা
যায়। তিনি একই অর্থ প্রকাশক সমার্থক শব্দ বাক্যের গুণাবলী ঠিক রেখে অত্যন্ত সাবলিল
ভাবে ব্যবহার করেছেন। এটি একজন দক্ষ শিল্পীর পক্ষেই কেবল সম্ভব। তিনিই প্রথম
কবিতায় রঙীন চিত্রকল্প ব্যবহার করে কবিতার আঙ্গিক বদলে দিয়েছেন যা তাকে রবীন্দ্র ও
তার যুগের সবার থেকে পৃথক বৈশিষ্ট্য দান করেছে। তিনিই প্রথম সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়
কবিতায় লিখেছেন যা আর কেউ করেনি। বিশেষ করে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির পুরাণ, ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে কাব্যের বৈশিষ্ট্যে উন্নীত করেছেন। তিনি বলেছেন :
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বগ্য-মর্ত্য করতলে
তাজি বোররাক আর উচ্চৈ:স্রবা বাহন আমার হিম্মত হ্রেষা হেঁকে চলে।
তিনিই প্রথম কবি যিনি ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলেছেন। যা তার
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে একজন নাগররিক সৈনিক হিসাবে রূপান্তরের চিত্র ফুটে ওঠেছে।
নজরুল বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন বলেই তার পক্ষে বিভিন্ন ধর্ম ও ভাষাকে
একত্রীকরণে তার কবিতার উচ্চমার্গতা আমাদের কাছে এখনো আবেদনময়ী এবং তিনি পৃথক। এই
জন্যই নজকরুল সাম্যবাদের কবি। একই সাথে তিনি সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে
নির্যাতিত মানুষের শ্লোগানকে কবিতায় রূপ দিয়ে সর্বহারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
সুতরাং তিনি এখানে সর্বহারা সাহিত্যের স্রষ্টাও। আর সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে
তিনি বলেছেন :
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নরুজলের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐহিত্য নিয়ে প্রথম কাজ করেছেন। ইসলামকে তিনিই
প্রথম কাব্যিক দ্যেতনা দিয়ে কবিতায় তুলে ধরেছেন। তিনিই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে
কবিতায় আরবী,
ফার্সী শব্দের মিশ্রণে বাংলা সাহিত্যকে বহুমুখী করার চেষ্টা
করেছেন। তিনি লিখেছেন :
ঘুমাইয়া কাজা করেছ ফজর
তখনো জাগি নি যখন জোহর
হেলায় খেলায় কেটেছে আসর
মাগরিবের এবে শোন আজান।
বাংলা সঙ্গীতে তিনিই প্রথম ইসলামী ও কাওয়ালী সঙ্গীত, বাংলা
গজল গান,
আধুনিক বাংলা শ্যামা সঙ্গীত, কীর্তন
এবং বাংলা সঙ্গীতে ঝুমুর গানের স্রষ্টা। নজরুলের গল্প-উপন্যাসে হিন্দুরা কেন্দ্রীয়
চরিত্রে এসেছে। নজরুলের সাহিত্যে বহুমাত্রিকতার মিথস্কিয়া বুঝার চেষ্টা না করে কত
অপবাদ দেয়া হয়েছে। এত শৈল্পিক সৌকর্য্য দিয়ে কেউই তা সৃষ্টি করতে পারেনি। কতখানি
সাম্যবাদী চেতনা থাকলে একজন মুসলমান হয়েও তিনি শ্যামা সঙ্গীত রচনা করেছেন যা কেউ
করতে পারেনি। মহত্ত্বর মানবসত্তার সাথে সম্মিলনের স্বপ্নে নজরুল নিজেকে ভেঙে-চুরে
উচ্ছৃঙ্খল করে তুলেছেন, ব্যক্তি থেকে আমিতে পৌঁছাতে
রক্ত ঝরাতে হয়েছে। নিজস্ব মানসকে অন্যমনস্ক না করে সচেতন উদাসীনতায় সবসময় আত্মগত
পরিচয় নির্মাণ করার চেষ্টায় ব্রতী ছিলেন নজরুল। নজরুল নিজেকেই আবিস্কার করলেন
পরমসত্তায়। সুধীন্দ্রনাথ নিজস্বতায় বলেছেন :
স্পেন থেকে চীন প্রদোষে বিলীন
অথচ তাদের চিনি।
নজরুল আমি থেকে আমরাতে, কখনো আমরা ও আমি-র মাঝখানে, বিশ্বকে প্রতীকী ব্যাঞ্জনায় বিভক্ত করেছেন:
ঘরে এস সন্ধ্যা সবায় ডাকে
নয় তোরে নয় বলে একা তাকে;
পথের পথিক পথেই বসে থাকে,
জানে না সে কে তাহাকে চাবে
উদাস পথিক ভাবে।
বিশ্বকবির অনেক উৎসাহ উদ্দীপনায় অল্প সময়ের মধ্যেও সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা
সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রকে। নজরুল বন্ধু কাজী মোতাহার হোসনকে ২৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯২৮ সালে পত্রে লিখেছেন : রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায় বলতেন, 'দেখ উন্মাদ তোর জীবনে শেলির মতো কীটস-এর মতো খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে। তুই
প্রস্তুত হ! জীবনে সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারণে অন্যের জীবনকে
অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমার জীবন রয়ে গেছিল বিশুদ্ধ মরুভূমির
তপ্ত-মেঘের ঊর্ধ্বে কারণ্যর মতো। জীবনানন্দ দাশও নিজস্বতায় স্বকীয় ছিলেন। এইজন্য
বলেছেন : ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটতেছি পৃথিবীর পথে বলেই সর্বজনীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন পরিচ্ছন্নভাবে আত্মজগৎ তৈরি করেছেন। আধুনিকতার
প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘বিশ্বকে ব্যক্তিগত আসক্তভাবে না
দেখে বিশ্বকে নির্বিকার তদ্গতভাবে দেখা।’ রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব
সত্তার আত্মগত বিষয়ে দিয়েছেন- যে সাহিত্য নিজের হয়েও সকলের, সমকালের হয়েও চিরকালের সেই সাহিত্য চিরায়ত সাহিত্য।
রবীন্দ্র- নজরুল সম্পর্ক ও সামাজিক কুসংস্কার
রবীন্দ্র ও নজরুল বাংলা সাহিত্যের দুই উজ্জল নক্ষত্র। যাদের প্রয়োজন বাংলা
সাহিত্যে এখনো প্রবল। বাঙালীর জাতীয় অস্তিত্ব নির্ভরশীল রবীন্দ্রনাথে। রবীন্দ্রনাথ
বাঙালী থেকে পৃথক করা মোটেই সহজ নয়। একটি চক্র রবীন্দ্র-নজরুলের মধ্যে বিভেদ
সৃষ্টির চেষ্টা করেও সফল হয়নি। আর এর শুরুটা করেছিল রবীন্দ্র যুগ থেকেই। সেই সাথে
নজরুলকে জড়িয়ে। সমাজিক কিছু কুসংস্কার বার বারই রবীন্দ্র -নজরুল পরস্পরকে মুসলমানী
ও হিন্দুয়ানী তিলক লাগিয়ে গুরু-শিষ্য, শ্রদ্ধা-স্নেহের
সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আর একটি গোষ্ঠী উভয়কে বিরোধী করে সমাজকে বিচ্ছিন্ন
করার অপচেষ্টায় অব্যাহত রয়েছে। গীতাঞ্জলি গীতিকাব্য নজরুলের লেখা। রবীন্দ্রনাথ
নজরুলের পান্ডুলিপি চুরি করে নোবেল কমিটির কাছে জমা দিয়েছেন। নোবেল কমিটি ভুল করে
নজরুলের পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথকেই নোবেল পুরস্কার দিয়েছেন। মুসলমান হওয়ায় নজরুলকে
খ্রিস্টান-ইহুদি নিয়ন্ত্রিত নোবেল কমিটি পুরস্কার দিতে চাননি। কবি রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে আর কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ বা ২৫
মে। দুই কবির বয়সের ব্যবধান ৩৮ বছরের। রবীন্দ্রনাথের গানের বই বা গীতিকবিতা
গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয় ১৯১১-তে এবং নোবেল পুরস্কার পান ১৯১৩ সালে। অর্থাৎ কাজী
নজরুলের বয়স যখন ১২ বছর তখন গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল
পুরস্কার পান যখন, তখন কাজী নজরুলের বয়স মাত্র ১৪ বছর। নজরুল
তখন আসানসোলে দিনের বেলা রুটির দোকানে কাজ করে রাতের বেলা পুলিশের দারোগা রফিক
উদ্দিনের বাসার সিঁড়ির নীচে ঘুমাতেন। নজরুল সমৃদ্ধ লেখা তখনো লেখেননি। বরং
রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির ৭/৮ বছর পরে নজরুল সমৃদ্ধ লেখা লিখতে শুরু করেছেন।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বাঙালী পল্টনে যোগ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যাবার
পূর্বে নজরুলের কবি বলে কোন পরিচয় ছিলনা। নজরুল বাংলার সাহিত্যাঙ্গণে প্রবেশ করেন
সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে। ছোট বেলায় জেনেছি অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর
কাছে যে,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিংসা করতেন কবি কাজী নজরুলকে।
রবীন্দ্রনাথের ষড়যন্ত্রেই কাজী নজরুল সাহিত্যে নোবেল পাননি, নজরুলের নোবেল নিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! আর নজরুলের অসুস্থতার পিছনেও
রবীন্দ্রনাথই দায়ী। কাজী নজরুল ইসলাম মস্তিষ্কের ব্যাধিতে আক্রান্ত হন ১৯৪২ সালের
১০ই অক্টোবর। ঠাকুর বাড়ীতে নজরুলের ছিল অবাধ যাতায়াত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সাথে
নজরুলের সম্পর্ক যাই থাকুক নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা দেবীর পরিবারের সাথে
রবীন্দ্রনাথের পরিবারের সামান্যতম সম্পর্কও ছিলনা। এমনকি প্রমীলার পরিবারকে
রবীন্দ্র পরিবারের কেউ চিনে বলেও কেউ জানে না। নজরুলের হিন্দু স্ত্রী প্রমীলা বিয়ে
করেছেন। প্রতিক্রিয়াশীলরা বলে: প্রমীলা দেবী রবীন্দ্রনাথের ভাসতি বা নাতনি। অভিযোগ
হচ্ছে যখন নজরুল রবীন্দ্রনাথকে প্রতিভায় ছাড়িয়ে যাবার উপক্রম হলো; তখন রবীন্দ্রনাথ সুকৌশলে নজরুলকে ফাঁদে ফেলে নাতনিকে বিয়ে দিয়ে কৌশলে
কাব্যচর্চা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে স্ত্রী
প্রমীলাকে দিয়ে ধুতরা জাতীয় ফলের বিষ
খাইয়ে বিকৃত মস্তিস্ক বানিয়ে দেন। এইজন্য নজরুল অকালে কাব্যচর্চার ক্ষমতা হারান।
তাই নোবেল প্রাপ্ত বীন্দ্রনাথের বিশ্বকবির খেতাবটি অক্ষুন্ন থাকে। কাজী নজরুল প্রমিলা
দেবীকে বিয়ে করেন আলী আকবর নামক এক বন্ধুর সাথে বাংলাদেশের কুমিল্লায় বেড়াতে এসে।
তাঁর হিন্দু রমনী বিয়ের সাথে রবীন্দ্রনাথের দূরতম কোন সম্পর্ক ছিল না!
সাহিত্যান্ধ লোকরা বলেন : রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা
করেছেন। এইকারণেও রবীন্দ্রনাথকে পরিত্যাগ করা উচিৎ। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের
সিদ্ধান্তকে রবীন্দ্রনাথ বিরোধীতা করেছেন। ঐক্যপন্থীরা বলে রবীন্দ্রনাথও ইংরেজদের
এ ‘ভাগ কর ও শাসন কর নীতির ঘোর বিরোধীতা করেছিলেন। তিনি বাঙালি ঐক্যের সমর্থনে
গান,
কবিতা লিখেছিলেন। তার লেখা ও প্রচেষ্টায় অনেকেই উদ্বুদ্ধ
হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের লেখা দেশাত্ববোধক গান ও কবিতা মূলত: এই বঙ্গভঙ্গ রোধ
আন্দোলন কালেই লেখা। বিশাল ভারতে সূচের মতো ঢোকার জন্য ইংরেজরা বাংলাকেই বেছে
নিয়েছিল। আর ভারতে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে তার অগ্রভাগে ছিল বাঙালিরাই।
ইংরেজদের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে ভারত স্বাধীন হয়েছিল ঠিক। কিন্তু
ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামেরও চেষ্টা হয়েছিল কখনো কখনো। ইংরেজদের বিরুদ্ধে
বিপ্লবী ও সশস্ত্র আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল এই বাংলাই।
হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাঙালীরা একতাবদ্ধভাবে
ইংরেজ শাসনের জন্য ছিল হুমকি। মুসলমানদের সমর্থন এবং বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করে
ইংরেজ শাসনকে দীর্ঘায়িত করার সম্ভাবনা মিলেই ১৯০৫ সালে বঙ্গকে ভেঙ্গে দুই ভাগ করা
হয়। গণআন্দোলনে বঙ্গভঙ্গ রদ হল ১৯১১ সালে। প্রায় পাঁচ বছর পর বাংলা পুনরায় এক হল।
কিন্তুভাঙ্গনের সূচনা তা শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। কিন্তু তখনও
বঙ্গভঙ্গকারী বাঙালি মুসলমানদের তেমন কোন লাভ হয়নি। তাই ১৯৭১ সালে পুনরায়
পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করতে হয়েছিল। বঙ্গ ভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের কিছুটা
লাভ হয় এবং রাজধানী ঢাকা হওয়ায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। বঙ্গভঙ্গ রদ হলে কিছুটা
পিছিয়ে যায়। এই প্রেক্ষিতেই ইংরেজ সরকার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার
ঘোষণা দেয়। তখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বাঙালীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে ইংরেজদের কোন
চক্রান্ত ভেবে বিরোধীতা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীদের সাথে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কতটা সম্পৃক্ত ছিলেন তা অবশ্য
আলোচনা ও বুঝার বিষয়। কিন্তু রবীন্দ্র বিরোধী বুদ্ধিজীবীরা বলে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রৃতিষ্ঠার বিরোধীতায় রবীন্দ্রনাথ নেতৃত্ব দিয়েছেন। বঙ্গভঙ্গ আর
ইংরেজ বিরোধীরা বলেন : কোন আন্দোলনেই রবীন্দ্রনাথ নেতৃত্ব পর্যায়ে ছিলেন না। তিনি
কোন রাজনীতিবিদ বা নেতা ছিলেন না বরং বাঙালি জাতির ঐক্যের সহগামী একজন কবিমাত্র।
তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতার বিরোধীদের নেতৃত্বে কিভাবে জড়াবেন
রবীন্দ্রনাথ!
পাকিস্তান শাসনের দ্বিতীয় দশকেই রবীন্দ্র সুরের ‘আগুন
ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। বাঙালী সংস্কৃতির মূলৎপাটন করতে গিয়ে প্রচার মাধ্যম
রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করে আরো বেশী ছড়িয়ে দিয়েছিল সর্বত্র। বাংলাদেশ হবার পরও সেই
প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীর উত্তরাধিকারীরাও তৎপর ছিল রবীন্দ্রনাথকে পৃথক করার। এখন এই
প্রতিক্রিয়াশীলের বিচরণ আছে। সব সময়ই অপ্রকাশ্য আবার কখনো কখনো মিডিয়ার মাধ্যমে
নজরুলকে বড় আর রবীন্দ্রনাথকে ছোট করার নেতিবাচক অপপ্রয়াস চলমান। নজরুল-
রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক মোড়ক দিয়ে ধর্মকে পেঁচিয়ে হিন্দুত্ববাদ ও মুসলমানিত্ব
সাহিত্য পৃথক করার চেষ্টা সব সময়ই ছিল। বলা হতো নজরুল মুসলমান ছাড়াও হিন্দু পরিবেশে
বিচরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তা করেননি। আবার নজরুল সমাজের নিচু শ্রেণীর কথা বলেছেন
রবীন্দ্রনাথ বলেননি। নজরুল যুদ্ধ করেছেন বরীন্দ্রনাথ করেননি ইত্যাদি ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথ কোন ধর্মকে পৃথক মূল্যায়ন করে অন্য কোন ধর্মকে খাট করে কোন সাহিত্য
সৃষ্টি করার প্রমাণ দেখা যায় না। এসব
মিথ্যা অপ্রচার পাকিস্তান সরকারও ব্যাপক প্রচার করে পাকিস্তানী ছাত্র সংগঠন এনএসএফ
কর্মীরাও। জেনারেল আইয়ুব খানের শাসনামলে রবীন্দ্রনাথের রচনা কেউ যেন না পড়ে সেই জন্য এদেশের বাঙালী
মুসলমানদের মনে ঘৃণা জন্মানোর উদ্দেশ্যেই অপ্রচার চালানো হয়। সে একই সাথে
রবীন্দ্র-নজরুলকে মুসলমানী ও হিন্দুয়ানী সাহিত্যিক হিসাবে পৃথক করার চেষ্টা
করেছেন। আবার একই সাথে আমার সোনার বাংলা ... সঙ্গীতকে বর্জন ও নজরুলের কবিতার শব্দ
পরিবর্তন করার চেষ্টাও করেছে পাকিস্তান সরকার।
রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলিম স্বাতন্ত্র বা পার্থক্য বিলুপ্ত করাকে ‘আত্মহত্যার নামান্তর বলে প্রবন্ধ
লিখেছিলেন। তিনি বলেছেন : আমরা যে-ধর্মকে গ্রহণ করিয়াছি, তাহা
বিশ্বজনীন তথাপি তাহা হিন্দুরই ধর্ম। এই বিশ্বধর্মকে আমরা হিন্দুর চিত্ত দিয়াই
চিন্তা করিয়াছি,
হিন্দুর চিত্ত দিয়াই গ্রহণ করিয়াছি। শুধু ব্রহ্মের নামের মধ্যে
নহে,
ব্রহ্মের ধারণার মধ্যে নহে, আমাদের
ব্রহ্মের উপাসনার মধ্যেও একটি গভীর বিশেষত্ব আছেই— এই
বিশেষত্বের মধ্যে বহুশত বৎসরের হিন্দুর দর্শন, হিন্দুর
ভক্তিতত্ত্ব,
হিন্দুর যোগসাধনা, হিন্দুর অনুষ্ঠান
প্রতিষ্ঠান,
হিন্দুর ধ্যানদৃষ্টির বিশেষত্ব ওতপ্রোতভাবে মিলিত হইয়া আছে।
আছে বলিয়াই তাহা বিশেষভাবে উপাদেয়, আছে বলিয়াই পৃথিবীতে তাহার
বিশেষ মূল্য আছে। (রবীন্দ্র রচনাবলী) রবীন্দ্রনাথ তার কবিতা ও সাহিত্যের মৌলিক
উপাদানগুলো নিয়েছিলেন হিন্দু ধর্মের ইতিহাস-ঐতিহ্য, উপনিষদ, পুরাণ ও হিন্দু সংস্কৃতি এবং একই সাথে ইউরোপ থেকে। ছোটগল্প ‘প্রগতি সংহার দেখা যায় প্রগতির বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি
ফার্সী চর্চা করে ফার্সী মুসলিম কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হলেও ইসলামী ব্যক্তিদের
সাথে তার পরিচয় ও সম্পর্ক থাকলেও রবীন্দ্রনাথ সচেতনভাবেই নিজের চিন্তা ও সাহিত্যকে
ইসলাম ও মুসলিম উপাদান বা ঐতিহ্য থেকে পৃথক রাখার চেষ্টায় উত্তীর্ণ সক্ষম হয়েছেন।
হিন্দুত্বকে ধারণ করেই বিশ্বমানবতার কবি বা বিশ্বকবি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ এখানেই অত্যন্ত শক্তিশালী। ঠিক একই ভাবে শক্তিশালী মহাকবি আল্লামা
ইকবাল। তারা উভয়ে সেকুলার ছিলেন না ছিলেন ধর্মানুরাগী ছিলেন। অন্যদিকে, কবি হয়েও রাজনৈতিক জায়গায় ইকবাল ও রবিঠাকুর মাড়িয়ে কাজী নজরুল নিজের অবস্থানকে
পৃথক ধারায় শক্তিশালী করেছেন। কারণ, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে নজরুল
ছিলেন হিন্দু-মুসলিম মিলনের ঐতিহাসিক অগ্রদূত। যদিও অনেকেই ড. মুহম্মদ
কুদরত-ই-খোদার প্রসঙ্গ টেনে বলে পূর্ববঙ্গের মুসিলম বাঙালিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের সান্নিধ্য পেয়েছেন ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে সেকুলার শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রধান
ড. কুদরত-ই-খুদা। তিনি ১৯৩৬ সালে রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কেন হিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্বের উপর আরো লিখেননি যেটি দেশের স্বাধীনতার
জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল ? জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন:
হিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্ব অসম্ভব। হিন্দু সমাজকে আমি যতোটা জানি তুমি ততোটা জানো না।
কুদরত-ই-খোদা জিজ্ঞাসা করেন : ‘তাহলে সমাধান কী?’ রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘স্বাধীনতা তখনই আসবে যখন পুরো
দেশ হয় হিন্দু না হয় মুসলমান হবে। (মুহাম্মদ কুদরত-ই-খোদা, কবি
স্মৃতি,
ইকবাল ভুইয়া, পৃ-৩৬১)।
নজরুল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা:
১। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কবিতা পড়ে প্রথম তাকে দেখতে চেয়েছেন। রবীন্দ্র-নজরুলের
সরাসরি দেখা হয় ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে শান্তি নিকেতনে। তখন নজরুলের বয়স ২২ বছর।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নজরুলকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে যান। বোলপুর স্টেশনে কাজী
নজরুল ও ড. শহীদুল্লাহকে অভ্যর্থনা জানান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একান্ত সচিব কবি
সুধাকান্ত রায় চৌধুরী। পরে নজরুল অনেকবারই শান্তিক নিকেতনে গিয়ে হৈচৈ করে মাতিয়ে
রাখতেন বলে রবীন্দ্রনাথ হৈহৈ কাজী নামে ডাকতেন। নজরুল সেদিন রবীন্দ্রনাথের কাছে
একটি কবিতার আবৃত্তি শুনতে চাইলে রবীন্দ্রনাথ বললেন, সে কি ? আমি যে তোমার গান ও আবৃত্তি শোনবার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছি, তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও। নজরুল আবৃত্তি করেন অগ্নি-বীণার আগমনী কবিতাটি। এছাড়াও
তিনি কয়েকটি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে শোনান। নজরুলের অনুরোধে সেদিন রবীন্দ্রনাথ
আবৃত্তি করেন মাধবী হঠাৎ কোথা হতে, এল ফাগুন দিনের স্রোতে, এসে হেসেই বলে যাই যাই।..এরপর বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাত
হয়।
২। নজরুল ছিলেন জন্মগত ভাবে উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আর রবীন্দ্রনাথ তাকে
অকুণ্ঠ সমর্থন করেছেন।
৩। যখন নজরুল উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ‘আনন্দময়ীর
আগমনী কবিতা লিখে প্রথম আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে গেলেন তখন রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত
গীতি নাটিকাটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। নজরুলের বয়স তখন ২৩ বছর। তিনি উৎসর্গপত্রে
নজরুলকে কবি বলে সম্বোধন করে লেখেন: জাতির জীবনের বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার
সদ্য প্রকাশিত বসন্ত গীতিনাট্যখানি কবি নজরুলকে উৎসর্গ করছি। এর উৎসর্গ পত্রে লেখা ছিল: শ্রীমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম
স্নেহভাজনেষু। কবি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে জেলখানায় বইটি পাঠালেন
রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছাকাছি কবি-সাহিত্যিকগণ তখন অসন্তুষ্ট
হয়েছিলেন তাঁর প্রতি। এর জবাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়সহ
উপস্থিতজনদের উদ্দেশে বলেন, আমার বিশ্বাস তারা নজরুলের কবিতা
না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করছে। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করেনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছে মাত্র।... কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এও তোমাদের আবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি। আমি যদি আজ তরুণ হতাম, তাহলে আমার কলমেও এই সুর বাজত। বসন্ত গীতি নাটকের দুটি বই দিয়ে একটি কবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম দস্তখত করে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে বললেন: ‘তাকে (নজরুলকে) বলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে
পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ
জানাচ্ছি। আর বলো কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা যোগাবার কবিও তো চাই। বসন্ত নাটক উৎসর্গ ছিল
রবীন্দ্রনাথের জন্য রবীন্দ্র পরিবারের বাইরে প্রথম কাউকে বই উৎসর্গ করার ঘটনা।
নজরুল বইটি পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেন। এ বিষয়ে নজরুল লিখেছেন: এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ
তাঁর বসন্ত নাটক আমায় উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ-মালা পেয়ে আমি জেলের
সর্বজ্বালা,
যন্ত্রণা ক্লেশ ভুলে যাই।
৪। ১৯২৩-এর ১৪ এপ্রিল নজরুল যখন হুগলি জেলে জেল কর্তৃপক্ষের অসদাচরণের
বিরুদ্ধে অনশন করছেন। একটানা ৩৯ দিন চলে অনশন। দেশবাসী উদ্বিগ্ন। ইংরেজদের
বিরুদ্ধে মিটিং-মিছিল শুরু হয়। ১৯২৩ সালের ২১ মে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে দেশবন্ধু
চিত্তরঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে বিশাল জনসভা হয়। উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে অনশন
ভঙ্গ করার জন্য টেলিগ্রাম পাঠান প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায়। রবীন্দ্রনাথ
টেলিগ্রাম করে বলেছেন : Give up hunger strike our literature claims you.. যেহেতু নজরুল তখন হুগলী জেলে তাই ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবেই ঠিকানা
অস্পষ্ট লিখে টেলিগ্রামটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠিকানায় ফেরত পাঠান। নজরুল তাঁর
বন্ধু কুমিল্লার বীরেন্দ্রকুমারের মা বিরজা সুন্দরী দেবীর হাতে লেবুর সরবত পান করে
অনশন ভঙ্গ করেন।
৫। নজরুলের ধূমকেতু পত্রিকায় আশীর্বাদ জানিয়ে লিখেছেন :
আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দুর্গাশিরে,
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে,
আছে যারা অর্ধচেতন।
ধূমকেতু পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আর্শীবাদবাণীটি প্রকাশিত হতো। নজরুল ইসলাম সম্পাদিত
সাপ্তাহিক লাঙল-এর প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশীর্বচন লেখেন :
ধর,
হাল বলরাম, আন তব মরু-ভাঙা হল
বল দাও,
ফল দাও, স্তব্ধ হোক ব্যর্থ কোলাহল।
তারপর নজরুল ইসলাম সম্পাদিত সাপ্তাহিক লাঙল-এর প্রচ্ছদেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আর্শীবাদ লেখেন : ধর, হাল বলরাম, আন তব
মরু-ভাঙা হল,/
বল দাও, ফল দাও, স্তব্ধ
হোক ব্যর্থ কোলাহল। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, বিদ্রোহী,
ভাঙ্গার গান পড়ে রবীন্দ্রনাথ অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন নজরুল
ইসলামকে।
৬। গোরা উপন্যাস ছায়াছবিতে নজরুল ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ
এতে বাধা দিলে বিশ্ব কবি নিজেই তা প্রত্যাখ্যান করে নজররুলকে সঙ্গীত পরিচালনার
স্বীকৃতি প্রদান করেন।
৭। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বোলপুরের শান্তি নিকেতনে থাকার আহ্বান করেছেন।
বরীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন সৈনিক নজরুল শান্তি নিকেতনের শিক্ষার্থীদের শারীরিক শিক্ষা
দেবেন। অস্থির প্রকৃতির বিদ্রোহী নজরুল কোথায়ও নিয়মের বন্দীশিবিরে আটকে থাকাটা
পছন্দ করতেন না। বিশ্ব কবির সাথে নজরুলের দার্জিলিংয়ে দেখা হয়। এ সময় নজরুল প্রশ্ন
করেছেন,
আপনি তো ইতালি গেছেন সেখানে কবি দ্যনুনজিও’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি-না? রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছেন: ‘দেখা হবে কি করে তিনি যে তোমার
চেয়েও পাগল।
৮। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে মনে করতেন - কালের ভাষা যার কাব্যে বাণী রূপ পায় সে
কবি নয় মহাকবি
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নজরুলের ধারণা:
রবীন্দ্রনাথ- নজরুলের নিষ্ঠাবান পৃষ্ঠপোষক ও প্রেরণাদাতা ছিলেন। কাজী নজরুল
ইসলামের ছিল গভীর সখ্য ছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে। গভীরতার আড়ালে ছিল
দৃঢ় গুরু-শিষ্য সম্পর্ক। কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলাম ৩২, কলেজ
স্ট্রিটের যে বড়িটিতে দীর্ঘদিন ছিলেন। সেটি এখন শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের
ট্রাস্টভূক্ত সম্পত্তি। বাড়িটি এখন ব্যবহৃত হয় ঠাকুরের ভক্তদের পান্থশালা হিসেবে।
১। রবীন্দ্রনাথকে তিনি রীতিমত ইস্টদেবতার মতো পূজা দিতেন। যা দেখে ছোট বেলায়
সবাই তাকে ভৎর্সনা করতো।
২। যদি পূর্ণবার জন্মগ্রহণ করেন তাহলে রবীন্দ্র কাব্যগীতে অবগাহন করে জীবন
কাটিয়ে দিবেন
৩। রবীন্দ্রনাথের এত গান নজরুল মুখস্ত জানতেন যে সবাই তাকে গান গাওয়ার অনুরোধ
করলে তিনি যৌবনে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। এজন্য তাকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের হাফিজ
বলা হতো। নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের অধিক। নজরুলের গান নজরুল সঙ্গীত নামে
পরিচিত।
৪। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নজরুলের জীবনে ঘটেও গেছে নানা ঘটনা। নজরুল তখনও
রবীন্দ্রনাথকে দেখেননি। শুধু তাঁর লেখা পড়েই ব্যাকুল। নজরুল তখন আসানসোল মহকুমার
শিয়ালশোল রাজ হাইস্কুলের ছাত্র। রায় বাহাদুর পরিবার থেকে মাসে তের টাকা বৃত্তি
নিয়ে থাকেন স্কুলের একটি মেসে। সে সময় রবীন্দ্র রচনার এক উম্মাতাল পাঠক নজরুল।
নজরুলের এক সহপাঠি রবীন্দ্রনাথকে কটাক্ষ করে বলল, রবীন্দ্রনাথের
লেখা কি পড়! ওনার কোন কবিতা কি হয়। রবীন্দ্রনাথের নোবেল নিয়ে স্কুল বন্ধর কটাক্ষে
নজরুল ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ক্রোধে তাকে বাঁশের লাঠি দিয়ে আঘাত করে। পরে এই নিয়ে মামলা
হলে নজরুল কয়েক ঘন্টা জেলে থাকেন। কবিগুরুর অনুরোধেই শেষ পর্যন্ত নজরুল মুক্তি
পান।
৫। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৪০০ সাল কবিতা লেখেন ১৩০২ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে।
রবীন্দ্র নাথের ১৪০০ কবিতার জবাব হিসাবে নজরুল আজি হতে শতবর্ষ আগে শিরোনামে
কবিতাটি লিখেছেন। গুরু বরীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতুহলভরে,
আজি হতে শতবর্ষ পরে!
আবার শিষ্য কাজী নজরুল শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে গুরুর প্রতি লেখেন ১৩৩৪ সালের আষাঢ়
মাসে তাঁর ১৪০০ সাল কবিতায় । রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুল লেখেন :
আজি হতে শতবর্ষ আগে
কে কবি,
স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে,
আজি হতে শতবর্ষ আগে!
৬। ১৯২৮ সালে নজরুল তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন সঞ্চিতা রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ
করেন। বিভিন্ন রচনায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে উল্লেখ থাকলেও সম্পূর্ণ তাঁকে নিয়ে লেখা
কবিতাগুলো হলোÑনতুন চাঁদ গ্রন্থের অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি ও কিশোর রবি এবং শেষ সওগাত গ্রন্থের
রবিজন্মতিথি। রবীন্দ্রনাথের বয়স আশি বছর পূর্তি হয় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে । এই
জন্মদিনে অশ্রু পুস্পাঞ্জলি কবিতাটি রচনা করেন।
একই বছর রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে নজরুল যে গভীরভাবে দুঃখ পেয়েছেন। তা সহজে
অনুমেয় রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরপরই ৭ই আগস্ট, ১৯৪১
সালে নজরুলের লেখা। নজরুল তখন আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবর্ণনা প্রচার
করেন। তিনি আবৃত্তি করেন রবিহারা কবিতাটি। একই সাথে লিখেছেন ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত
রবিরে। এ ছাড়া সালাম অস্তরবি এবং মৃত্যুহীন রবীন্দ্র নামে দুটি কবিতা রচনা করেন।
ঠিক এক বছর পর নজরুল নিজেই অসুস্থ হয়ে চিরদিনের জন্য নির্বাক হয়ে যান। গর্বিত
বাঙালীর এই দুই মহা কবি প্রায় একই সময়ে নীরব হলেন। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের
মাত্র ২১ মাস পরে ১৯৪২ সালে নজরুল বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেন। সাহিত্য সাধনা করেছেন
২০ বছর। কাজী নজরুল ৭৭ বছর বেঁচেছিলেন আর রবীন্দ্রনাথ ৮০ বছর।
৭। কিশোর রবি কবিতাটি লিখেছেন এই মনে করে যে, রবীন্দ্রনাথের
আকাশচুম্বী প্রতিভা সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যয় হওয়া উচিত এই ধারণায়।
৮। নজরুল রবীন্দ্রনাথকে সুর্য সন্তান মনে করতেন। তাই তিনি কিশোর রবি কবিতাটি লিখেছেন।
৯। শনিবারের চিঠি গোষ্ঠীর ইন্ধনে দুজনের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল
তখন নজরুল বড়র পীরিতি বালির বাঁধ লিখেছেন। এই সময় নজরুল রবীন্দ্রনাথকে সঞ্চিতা
উৎসর্গ করেন এবং নজরুল তার নাগরিক পত্রিকার জন্য লেখা চেয়ে চিঠি পাঠান। তখনই
সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। আর নজরুলের চিঠি পেয়ে রবীন্দ্রনাথ তাকে দেখে যাওয়ার
আমন্ত্রণ জানান। এবং রবীন্দ্র নাথের আমন্ত্রণ পেয়ে নজরুল তীর্থ পথিক কবিতাটি রচনা
করেন।
১০। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিনে নজরুল লিখেছেন রবি হারা কবিতাটি। একই দিনে
কবিতাটি কলকাতা বেতারে প্রকাশিত হয় :
ভূ-ভারত জুড়ে হিংসা করেছে এক বাংলার তরে
আকাশের রবি কেমনে আসিল বাংলার কুঁড়ে ঘরে
এত বড় এত মহৎ বিশ্ব বিজয়ী মহামানব
বাংলার দীন হীন আঙ্গিনায় এত পারমোৎসব।
১১। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন: ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা
করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্টদেবতাকে
পূজা করে। ছেলেবেলা থেকে তার ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ, ফুল-চন্দন
দিয়ে সকাল সন্ধ্যা বন্দনা করেছি। এ নিয়ে কত লোক ঠাট্টা বিদ্রƒপ করেছে। আবার বলেছেন : অনেক দিন তাঁর কাছে না গেলে নিজে ডেকে পাঠিয়েছেন।
কতদিন তাঁর তপোবনে (শান্তিনিকেতন) গিয়ে থাকবার কথা বলেছেন। হতভাগা আমি তাঁর পায়ের
তলায় বসে মন্ত্র গ্রহণের অবসর করে উঠতে পারলাম না। বনের মোষ তাড়িয়েই দিন গেল।
কথাশিল্পী মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায় একদিন নজরুলের ভক্তি-শ্রদ্ধার কথা নজরুলের
উপস্থিতিতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেছিলেন: ‘যাক আমার আর ভয় নেই তাহলে। নজরুল সঙ্কোচে দূরে গিয়ে বসলেও রবীন্দ্রনাথ সস্নেহে
তাকে ডেকে কাছে বসিয়েছেন। নজরুল নিজেই লিখেছেন, তখন
আমার মনে হতো আমার পূজা সার্থক হলো, আমি বর পেলাম। এ কথা থেকে বোঝা
যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে কবি স্বীকৃতি দিতে কত আন্তরিক উদার ও অকুণ্ঠ ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ নজরুলের বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ডাকতেন উদ্দাম বলে। অনেকবার নজরুল
ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে কবিতা, গান শুনিয়ে তাঁর কাছ
থেকে প্রচুর উৎসাহ পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন নজরুল তাঁর কবি প্রতিভাকে অন্য
বিষয়ে নষ্ট করেন যথার্থ সৃষ্টির কাজে না লাগাক। এজন্য নজরুলকে তিনি একদিন (সঙ্গে
ছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর) তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচতে নিষেধ করেছিলেন। এই কথায় নজরুল
ক্ষুব্ধ হলেন। তখন আমার কৈফিয়ত কবিতায় তিনি লেখেন :
গুরু কন,
তুই করেছিস শুরু
তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর তত্ত্বের কথা নজরুল পরে ভেবেছেন।
১২। বিদ্রোহী কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯২১-এর ডিসেম্বর মাসে। পত্রিকাটি
নিয়ে নজরুল চলে যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। উচ্চকণ্ঠে ‘দে
গরুর গা ধুইয়ে গাইতে গাইতে নজরুল ঠাকুর বাড়িতে ঢুকে ডাকতে শুরু করলেন, গুরুদেব তুমি কোথায়, আমি এসেছি। রবীন্দ্রনাথ দোতালা
থেকে বললেন কি হয়েছে, এত হৈচৈ কিসের। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেন, গুরুদেব আমি আপনাকে খুন করবো। নিচে এসো। তারপর রবীন্দ্রনাথের সামনে উচ্চস্বরে
আবৃত্তি করতে থাকেন বিদ্রোহী কবিতাটি। রবীন্দ্রনাথ বিদ্রোহী কবিতা শুনে কবিতার
প্রশংসা করেন এবং নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন সত্যিই তুই আমাকে খুন করেছিস। এতই স্নেহ
মমতার সম্পর্ক ছিলো দুইজনের।
১৩। কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরীতে ১৯২২-এর ২৫ জুন রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে কবি
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। সদ্য প্রকাশিত দুটি বইয়ের কবি
নজরুল বসেছিলেন সাবর পিছনে। রবীন্দ্রনাথ তা লক্ষ্য করে নজরুলকে ডেকে পাশে বসালেন।
নজরুল সেখানে আবৃত্তি করেছেন সত্যকবি কবিতাটি। রবীন্দ্রনাথ এভাবেই নজরুলকে স্নেহের
বন্ধনে আবদ্ধ করায় সেই সমকালীন কবি-সাহিত্যিকরা ঈর্ষান্বিত হন। কিন্তু বিশ্ব কবি
সেগুলো আমলে নিতেন না।
১৪। নজরুল সৈনিক পদে চাকুরী করে ২১ বছর বয়সে কলকাতায় ফিরে আসেন ১৯২০-এর মার্চ
মাসে। কলকাতার ৩২, কলেজ স্ট্রিটে, বঙ্গীয়
মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র অফিসে ওঠেন। তখন তাঁর
বাক্স-পেটরার মধ্যে ছিল কবিতার খাতা, গল্পের খাতা, পুঁথি-পুস্তক, মাসিক পত্রিকা সেই সাথে প্রিয় গুরুর গানের স্বরলিপি। কমরেড
মোজাফফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, Ôনজরুল ইসলাম বহু
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। তিনি কি করে যে রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলো মুখস্ত করেছিলেন, তা ভেবে অবাক হই।” এ কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবহিত হবার পর খুবই
খুশি হয়ে বলেছিলেন, Ôআমারই তো মুখস্থ নেই।Õ
কাজী নজরুল ১৯৩৫-এর জুন মাসে নাগরিক পত্রিকার জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা
চেয়ে চিঠি পাঠান। তখন অসুস্থ রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭৫ বছর। চিঠির উত্তরে রবীন্দ্রনাথ
১৯৩৬-এর ১ সেপ্টেম্বর লিখেছের : ‘...তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছে আর কিছু না হোক করুণা দাবি করতে পারে। শুনেছি
বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি পাশের জিলায় (বীরভুমের বোলপুরে)। কখনো যদি ঐ
সীমানা পেরিয়ে আমাদের এদিকে আসতে পারো খুশি হব।’ উক্ত
চিঠির জবাবে নজরুল ‘নাগরিক’ পত্রিকায় লেখেন :
হে কবি,
হে ঋষি অন্তর্যামী আমারে করিও ক্ষমা।
পর্বত-সম শত দোষত্রুটিও চরণে হল জমা।..
তুমি ¯্রষ্টার শ্রেষ্ঠ বিস্ময়-
তব গুণে-গানে ভাষা-সুর যেন সব হয়ে যায় লয়।...
প্রার্থণা মোর, যদি আরবার জন্মি এ ধরণীতে,
আসি যেন শুধু গাহন করিতে তোমার কাব্য-গীতে।
মৌলবাদী হিন্দু-মুসলমানরা রবীন্দ্র-নজরুলের আন্তরিক সম্পর্ক থাকুক এটা মেনে
নিতে পারেনি। দুজনের মধ্যে ফাটল ধরানোর জন্য দুপক্ষ থেকেই সমালোচনা, আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র চলছিল। যাদের সাহিত্যের মর্ম বুঝার সামর্থ ছিলো না বা নেই
তারা রবীন্দ্র-নজরুলকে বিচার করেছেন ধর্ম
দিয়ে। অথচ এই দুই কবি মানবিকতার সাধনাই করে গেছেন চিরকাল। যার মহামানব হবার সাধনা
তাঁর চিরজীবনের,
তাঁর পক্ষে কোন অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক হওয়া সম্ভব নয়, তা বুঝবে না বা বুঝতে পারেনি প্রতিক্রিয়াশীলরা। রবীন্দ্র-নজরুল দুজনই ছিলেন
অসাম্প্রদায়িক সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে। রবীন্দ্র পরিবারে পৌত্তলিক কর্মের সুযোগ না
থাকলেও হিন্দু সংস্কৃতির পরিবেশ কিছুটা ছিল। রবীন্দ্রনাথও পিতৃসূত্রে ব্রাহ্ম
ধর্মের অনুসারী হলেও হিন্দু সংস্কৃতির আধারে বেড়ে ওঠেন। কিন্তু চিরকাল মানবধর্মের
সাধনা করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো
পাপ’। বলেন,
মানবিক ধর্মের কথা যা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উর্ধ্বে।
একইভাবে নজরুল বলেন, ‘আমি আজও মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি।
মানুষকে আমি শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি। স্রষ্টাকে আমি দেখিনি
কিন্তু মানুষকে আমি দেখেছি। এই ধূলিমাখা, অসহায়, দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করবে। দুজনের চলার পথ ও ধ্যান ধারণা ছিলো
সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুজনই যার যার অবস্থান থেকে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
নজরুলের লেখা পরিণতির সময় থেকেই প্রচারণা পাবার পর রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় ঘটে।
তাই দুজনেই দুজনের সহায়ক হিসাবে কাজ করেছেন। ১৯২০ থেকে ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকাল পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক স্নেহ, শ্রদ্ধা ও ভক্তির। মানুষ, মানবতা নিয়ে দুজনের ভাবনায়
ধর্মপরিচয়ের বাইরে মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখার। দুইজনই বাংলা সাহিত্য দিকপাল।
দুজনের কাব্যের দুটি পৃথক ধারা সময়ের পার্থক্যে কিছুটা ব্যবধান রয়েছে। কিন্তু
চিন্তা চেতনায় মিলিত ধারা একই বঙ্গোপসাগরেই মিশেছে। বঙ্গোপসাগরের জলে উপকৃত হই
সমস্ত বাঙালীই। রবীন্দ্রনাথ -নজরুল আমাদের চেতনায় মিশে আছে যুগে যুগে।
রীনা
তালুকদার
সংক্ষিপ্ত পরিচিত : নব্বই দশকের কবি, প্রাবন্ধিক। সাবেক সভাপতি, বদরুন্নেসা কলেজ ও সাবেক সহ-সভাপতি, ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ)
ছাত্রলীগ। সভাপতি- বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান কবিতা পরিষদ। সহ-সভাপতি, (তথ্য ও প্রযুক্তি)- অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠন। বিভাগীয় সম্পাদক-অনুপ্রাস
সাহিত্য পাতা দৈনিক নব অভিযান, দৈনিক স্বদেশ বিচিত্রা ও
সাপ্তাহিক কালধারা। বাবা -মো: আবদুল করিম। মাতা- আনোয়ারা বেগম। পড়াশুনা- এম.এ।
জন্ম -২১ আগস্ট,
১৯৭৩, জেলা- লক্ষ্মীপুর, বাংলাদেশ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ১৩টি, গবেষণা
প্রবন্ধ-২টি (বিজ্ঞান কবিতার ভাবনা ও কাব্য কথায় ইলিশ), সম্পাদনা
কাব্যগ্রন্থ-১টি, সহযোগী সম্পাদনা (বিষয়ভিত্তিক)- ১১টি।জাগ্রত
ছোট কাগজের সম্পাদক। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- সাত মার্চ শব্দের ডিনামাইট
(বঙ্গবন্ধু সিরিজ), বিজ্ঞান কবিতা, প্রেমের
বিজ্ঞান কবিতা,
স্বাধীনতা মঙ্গলে, বিজ্ঞান সনেট। বর্তমান
সময়ে তিনি বিজ্ঞান সমন্বয়ে কবিতাকে নতুনত্ব দিয়েছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়
নব্বই দশকে। লেখালেখির জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল স্মৃতি ফাউন্ডেশন-এর
মহান বিজয় দিবস-২০১১ সম্মাননা ও সাপ্তাহিক শারদীয়া কাব্যলোক বিশেষ সম্মাননা-২০১৩
পেয়েছেন। ঠিকানা: এ-২, বাণিজ্যবিতান সুপারমার্কেট, ইস্টকর্ণার,
২য়তলা, নীলক্ষেত, ঢাকা-১২০৫,
বাংলাদেশ। ইমেইল- rinakobi@yahoo.com ফোন:- 01716676350 ।
তথ্যসূত্র :
১। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা- ড. সৌমিত্র শেখর
২। রবীন্দ্র স্মরণ রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক- চতুরঙ্গ, দৈনিক জনকন্ঠ, মে ০৭, ২০১৬
৩। গুরু শিষ্য সম্পর্ক : রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল- হাবিবুর
রহমান স্বপন,
রাইজিংবিডি, ২৩ মে, ২০১৪
৪। নজরুল কাব্যে ঐতিহ্যের স্বরূপ, শাহাবুদ্দিন
আহমেদ,
জ্ঞান বিতরণী ২০০১।
৫। শাহাবুদ্দিন আহম্মদ ও মাসুম মজুমদারের সম্পাদনায় ১৯৯৯
সনে নজরুল জন্মশতবার্ষিকী স্মারক ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার'।
৬। ড.এস,এম, লুৎফর
রহমান-‘নজরুল অধ্যাপক' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ‘উচ্চ
শিক্ষা ক্ষেত্রে অবহেলিত নজরুল সাহিত্য।'
৭। প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ- ২৬ মে' ৯৯,
প্রধান অতিথির ভাষণ, জাতীয়
সেমিনার-২,
ই.ই. ঢাকা।
৮। গুগল, উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, রবীন্দ্র ও নজরুল রচনাবলী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন