বাংলা নাটকে মাইকেল মধুসূদন দত্তর অবদান ~ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়




বাংলা নাটকে
মাইকেল মধুসূদন দত্তর অবদান
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়


বাংলা নাট্যসাহিত্যের পিতৃপুরুষ বলে কাউকে যদি চিহ্নিত করতে হয় তবে নিশ্চিত ভাবেই তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত অথচ মধুসূদন কখনও বাংলা সাহিত্যের জন্য কলম ধরবেন তা তাঁর অতিবড় বন্ধুও ভাবনায় আনেন নি সেই আদিযুগের বাংলা ভাষার প্রতি মধুসূদনের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না প্যারিচাঁদ মিত্রর (টেকচাঁদ ঠাকুর) চলিত ভাষায় লেখা প্রথম বাংলা উপন্যাস পড়ে মধুসূদন বলেছিলেন এ রকম ভাষায় জেলেরা কথা বলে, যদি না তুমি সংস্কৃত থেকে ভাষা গ্রহণ করো  (It is the language of the fishermen, unless you import largely from Sangskrit) প্রবল আত্মবিশ্বাসে মধুসূদন বলেছিলেন, ‘দেখবেন আমি যে ভাষা সৃষ্টি করবো তাইই চিরস্থায়ী হবে
উপস্থিত সকলে বিদ্রুপ করেছিলেন কারণ তৎকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি মধুসূদনের কিছুমাত্র অনুরাগ ছিল না তাঁর সৃজনাকাঙ্খি মনন তখন দখল করেছে ইংরাজি ভাষা আর সেক্সপীয়ার, বায়রন, শেলীর মত হওয়ার আর সেক্সপীয়ার, বায়রনের দেশে পা রাখার প্রবল বাসনা সেই সময়, হিন্দু রক্ষণশীলতার বাধায় বিলেত যাওয়া সহজ ছিল না, জাতিচ্যুত হতে হ সেই বাধা অতিক্রম করতে উনিশ বছর বয়সে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলেন এবং আত্মীয় পরিজন পরিত্যক্ত হয়ে নিঃসঙ্গ মধুসূদন এক তামিল সহপাঠীর সাহায্যে মাদ্রাজ চলে গেলেন ১৮৪৭এর শেষের দিকে মধুসূদনের আট বছর মাদ্রাজ প্রবাসকালে কলকাতায় আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না এমনকি পিতা, মাতার মৃত্যু সংবাদও পান নি সকলেই ধরে নিয়েছিলেন মধুসূদন মৃত পৈত্রিক সম্পত্তিও আত্মীয় পরিজনদের দ্বারা বে-দখল হয়ে যায় এই সংবাদ পেয়ে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে আসেন

মধুসূদনের আট বছরের মাদ্রাজ প্রবাসজীবনে মোটেই সুস্থিতি ছিল না কিছু কাল শিক্ষকতা, সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ এবং সংবাদপত্র প্রকাশনা ও সম্পাদনা করেন ১৮৪৯এ মাদ্রাজ মেল এসাইলামএ শিক্ষকতা করার সময় ঐ স্কুলেই অধ্যয়নরতা রেবেকা ম্যাক্টাভিলকে বিবাহ করেন কয়েকবছর পরে ১৮৫৫তে রেবেকার সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয় মধুসূদন তখন দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক ওই বছরের ডিসেম্বরে  ফরাসী মহিলা এমিলিয়া হেনরিএটা সোফিয়াকে বিবাহ করেন ইতিমধ্যে মাদ্রাজে পত্র-পত্রিকায় ইংরাজি কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে সুখ্যাতি অর্জন করেন মধুসূদন মাদ্রাজ প্রবাসকালেই তাঁর প্রথম গ্রন্থ  প্রকাশিত হয় ক্যাপটিভ লেডি বইটি পড়ে তাঁর সাহিত্যকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে ভারতপ্রেমিক শিক্ষাবিদ ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন মত প্রকাশ করেন যে এই সাহিত্যপ্রতিভা তাঁর মাতৃভাষায় নিয়োজিত হলে সেই সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে বাল্যবন্ধু গৌরদাস বসাক বেথুনের প্রসংশা মধুসূদনকে জানিয়ে এক পত্রে  লেখেন আমরা ইংরাজি সাহিত্যে আর একজন বায়রন কিংবা শেলি চাই না, আমরা চাই বাংলা সাহিত্যে একজন বায়রন কিংবা শেলি বেথুনের প্রশংসা ও গৌরদাসের পত্র মধুসুদনকে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার প্রত্যয় জাগিয়েছিল ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি সকালে প্রায় রিক্ত হাতে মধুসূদন কলকাতায় ফিরে এলেন, হিতৈষিদের সহায়তায় পুলিশ কোর্টে কেরাণীর পদে একটি কাজ পেলেন  মধুসূদনের বয়স তখন বত্রিশ

বাংলা নাট্যক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্তর আবির্ভাব আকস্মিক বাংলা নাট্যাভিনয় প্রত্যক্ষ করার কোন অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না বাংলা নাট্যক্ষেত্রে মধুসূদন দত্তর আবির্ভাব ও অবদান প্রসঙ্গে যাবার আগে বাঙালির থিয়েটারের উদ্ভব ও বিকাশের বিষয়টি ছুঁয়ে যাওয়া প্রয়োজন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীরা তাদের বিনোদনের জন্য এদেশে থিয়েটারের আমদানি করেছিল সে অনেককাল আগে, পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজরা তখন এদেশে পাকাপোক্ত হয়ে বসেছে, শুরু হয়েছে কলকার নগরায়ন এই সময়ে ইংরেজরা এখনকার লালবাজারের কাছে প্লে হাউসপ্রতিষ্ঠা করে বাংলা থিয়েটার ব্যাপারটা তখন কারো দূর কল্পনাতেও ছিল না বাংলা গদ্যসাহিত্যের সূচনাইতো হয়েছে আরো একশো বছর পরে আঠেরো শতকের শেষে গেরেসিম লেবেডেফ নামে একজন রুশ পর্যটক ভারতে এসেছিলেন লেবেডেফ বাংলা ভাষা আয়ত্ব করে ১৭৯৫ খৃষ্টাব্দে  দি ডিসগাইসনামের ইংরাজি প্রহসনটির বাংলা অনুবাদ করে তাঁর ভাষাশিক্ষক গোলকনাথ দাসের সহায়তায় বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন কলকাতায় এখনকার এজরা স্ট্রীটের কাছে ডুমতলায় অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে লেবেডফের সেই নাট্যাভিনয় – ‘কাল্পনিক সঙ বদলই প্রথম বাংলা নাট্যাভিনয় লেবেডফের এই নাট্যাভিনয় একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র কারণ এই অভিনয়ের পর বাংলা নাট্যাভিনয়ের কোন ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হয়নি এরপর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময়ে কোন মৌলিক বাংলা নাটকের অভিনয় সংবাদ জানা যায় না অভিনয় উপযোগী প্রথম মৌলিক বাংলা নাটকই লেখা হয় ১৮৫৭তে সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্নের কুলিন কুল সর্বস্ব রংপুরের জমিদার কৌলিন্যপ্রথা বিরোধী নাটক লেখার প্রতিযোগিতা আহ্বান করেছিলেন এই সুযোগেই সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্ন দুটি নাটক কুলিন কুল সর্বস্বনবনাটকরচনা করে পুরস্কৃত হন ১৮৩৫ নাগাদ কলকাতায় বাংলা ভাষায় নাট্যাভিনয়ের সংবাদ জানা যায় ইংরাজদের দেখাদেখি কলকাতার ধনাঢ্য জমিদারবাবুরা তাদের গৃহপ্রাঙ্গণে বা বাগানবাড়িতে শখের থিয়েটার খোলেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সেখানে অবশ্য সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার থাকতো না

কলকাতায় তখন নাট্যাভিনয় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই সময় সেকালের পাইকপাড়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহ তাদের বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে বেলগাছিয়া নাট্যশালার পত্তন করেন, আর এই বেলগাছিয়া নাট্যশালার হাত ধরেই বাংলা নাট্যক্ষত্রে নবযুগের সূচনা হ এদের উদ্যোগেই এদেশে প্রথম সার্থক বাংলা নাট্যাভিনয় হল এবং বাংলা নাট্য সাহিত্য পেল মধুসূদন দত্তকে  রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলীনাটকটি বেলগাছিয়া নাট্যশালায় প্রথম অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হয় নাট্যানুষ্ঠানে অনেক উচ্চপদস্থ ইংরাজ দর্শক নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন নাট্যাভিনয়ের উদ্যোক্তা পাইকপাড়ার রাজারা ইংরাজ দর্শকদের জন্য রত্নাবলীর ইংরাজি অনুবাদ করাতে চাইলেন বেলগাছিয়া থিয়েটারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও মধুসূদনের বাল্যবন্ধু গৌরদাস বসাকের পরামর্শে পাইকপাড়ার রাজারা রত্নাবলীনাটকের অনুবাদের দায়িত্ব মধুসূদনকে দিয়েছিলেন মধুসূদনের ইংরাজি অনুবাদ উচ্চপ্রসংশিত হয়েছিল রত্নাবলীনাটকের ইংরাজি অনুবাদের মধ্য দিয়েই কলকাতার অভিজাত মহলে সুপরিচিত হলেন বস্তুত, এর মধ্য দিয়েই মধুসূদনের সাহিত্যসাধনারও যথার্থ সূচনা হ

রত্নাবলীনাটকের রিহার্শালে প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন মধুসূদন রিহার্শাল দেখে মধুসূদন হতাশ হয়েছিলেন এই ভেবে যে এহেন এক দুর্বল নাটকের জন্য রাজারা বিপুল অর্থব্যয় করছেন! বন্ধু গৌরদাস বসাককে লিখেছিলেন হোয়াট এ পিটি, দি রাজাস সুড হ্যাভ স্পেন্ট সাচ এ লট অফ মানি অন সাচ এ মিসারেবল প্লে বাংলা গদ্যসাহিত্যের সেই প্রথম যুগে ভাষার দৈন্য উপলব্ধি করে কলম ধরলেন মধুসূদন, সৃষ্টি হল বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক নাটক শর্মিষ্ঠা কেন তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে প্রবেশ করলেন তাও বললেন শর্মিষ্ঠার নাটকের প্রস্তাবনায় লিখলেন

কোথা বাল্মীকি ব্যাস    কোথা তব কালিদাস
        কোথা ভবভূতি মহোদয়
অলীক কূনাট্য রঙ্গে    মজে লোকে রাড়ে বঙ্গে
                নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়
সুধারস অনাদরে              বিষবারি পান করে
        তাহে হয় তনু মনঃক্ষয়
মধুবলে জাগো মা গো         বিভু স্থানে এই মাগ
       
সুরসে প্রবৃত্ত হউক তব তনয় নিচয়
১৮৫৯ খৃষ্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর বেলগাছিয়া থিয়েটারে শর্মিষ্ঠাঅভিনীত হয় এবং পাইকপাড়ার রাজাদের অর্থানুকুল্যে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় শর্মিষ্ঠার নাট্যকাহিনি মহাভারতের আদিপর্বের যযাতি-দেবযানী উপাখ্যান থেকে গৃহীত হয়েছে
শর্মিষ্ঠালেখার পর নাটকটির বাংলা ভাষার কোন ভুল-ভ্রান্তি আছে কি না নাটকটি প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশকে পড়তে দিয়ে ভুলগুলিকে দাগ দিতে বলেছিলেন তর্কবাগীশ বলেছিলেন দাগ দিতে গেলে কিছু থাকবে না তবে আমরা পৃথিবী থেকে চলে গেলে তোমার বইয়ের খুব কদর হবে মধুসূদন রামনারায়ণ তর্করত্নকে নাটকে ব্যকরণগত ভুল যদি কিছু থাকে দেখিয়ে দিতে বলেছিলেন রামনারায়ণ পরামর্শ দিয়েছিলেন সংস্কৃত নাটক অনুকরণ করে লেখার মধুসূদন সেই পরামর্শে কর্নপাত করেননি
       
মধুসূদন শুধু একখানি নাটকই লিখলেন না, প্রথম বাংলাভাষায় সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যেরও সূচনা করলেন আধুনিক নাট্যভাষা কেমন হবে তারও যেন নির্দেশ করে গেলেন বস্তুত, এরপর থেকেই বাংলা নাটকে প্রাচীন সংস্কৃত নাট্যরীতির অবসান হয়ে গেল মধুসূদন সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্নকে শর্মিষ্ঠানাটকের ভাষায় ব্যকরণগত কিছু ভুল থাকলে তা সংশোধন করে দিতে অনুরোধ করেছিলেন রামনারায়ণ শর্মিষ্ঠার গঠন প্রণালীর কিছু পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু প্রবল আত্মবিশ্বাসী মধুসূদন তা অগ্রাহ্য করেন শর্মিষ্ঠার অভিনয় সাফল্য মধুসূদনকে প্রবলভাবে বাংলা নাট্যক্ষেত্রে নিয়ে এসেছিল মনস্বী রাজেন্দ্রলাল মিত্র বিবিধার্থ সংগ্রহপত্রিকায় শর্মিষ্ঠার বিস্তারিত আলোচনা করে লিখেছিলেন বাঙালি নাট্যকারে ও দত্তজয়ে এই বিশেষ প্রভেদ যে,পূর্বক্তেরা অভিনয়ে কি প্রকার বাক্যে কি প্রকার ফলোৎপত্তি হইবে তাহার বিবেচনা না করিয়া নাটক রচনা করেন; দত্তজ তাহার বিপরীতে অভিনয়ে কি প্রয়োজন, কি উপায়ে অভিনেয় বস্তু সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত লইবে; এবং কোন প্রণালীর অবলম্বনে নাটক দর্শকদিগের আশু হৃদয়গ্রাহী হইবেক ইহা বিশেষ বিবেচনাপূর্বক শর্মিষ্ঠা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন

ঐ বছরেই পাইকপাড়ার রাজার অনুরোধে তিনি দুখানি প্রহসন রচনা করলেন একেই বলে সভ্যতা  বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ একেই কি বলে সভ্যতায়উনিশ শতকের মূল্যবোধহীন অধঃপতিত সমাজের চেহারা, ইংরাজি শিক্ষিত যুবসমাজের ভ্রষ্টাচার ও হিন্দুত্বের ভন্ডামীকে শাণিত শ্লেষ ও ব্যঙ্গে আঘাত করলেন  দ্বিতীয় প্রহসন বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁতে প্রাচীন ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের লাম্পট্য, কদাচার বর্ণীত হয়েছে তৎকালীন সমাজ, ব্যক্তি তাদের অনৈতিকতা ও ভ্রষ্টাচার ব্যঙ্গ ও কৌতুকের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন প্রহসন দুটির নাট্যভাষা চলিত বাংলা এক্ষেত্রেও মধুসূদনই পথ প্রদর্শক, বাংলা নাটকে সসমকালীন সমাজবাস্তবতার ছবি আঁকার ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে দীনবন্ধু মিত্র তাঁর সধবার একাদশীপ্রহসন রচনায় মধুসূদনের নাট্যভাষারই অনুসরণ করেছিলেন

১৮৬০এ মধুসূদন লেখেন তাঁর দ্বিতীয় নাটক পদ্মাবতী এই নাটকেই মধুসূদন ব্যবহার করেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রচলন সেই প্রথম গ্রীক পুরাণের আখ্যান আপল অফ ডিসকর্ডএর ছায়া অবলম্বনে পদ্মাবতীরচিত হয়েছিল পদ্মাবতীনাটকের মধ্য দিয়ে বাংলা নাটকে অমিত্রাক্ষর ছন্দের সার্থক প্রয়োগের ব্যাপারেও পথ-প্রদর্শ হয়ে রইলেন মধুসূদন পরের বছর, ১৮৬১তে মধুসূদন রচনা করেন ঐতিহাসিক নাটক কৃষ্ণকুমারী   বাংলাসাহিত্যের সব আলোচকরাই কৃষ্ণকুমারীকে মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ নাটক বলে চিহ্নিত করেছেন এটি বাংলা নাট্যসাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক নাটকও বটে কৃষ্ণকুমারীর আখ্যান চয়ন করেছিলেন কর্ণেল টডের বিখ্যাত এনালস এন্ড এনটিকস অফ রাজস্থানগ্রন্থ থেকে রাণা ভীম সিংহের কুমারী কন্যা কৃষ্ণার, রাজ্যের কল্যাণে পিতাকে দারুণ বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য স্বেচ্ছায় আত্মনিধনের কাহিনী বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্তগ্রন্থে প্রয়াত অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন রচনা, গ্রন্থনা,ঘটনা-সংঘাত ও সংলাপের দিক দিয়ে এ নাটক মাইকেলের নাট্যপ্রতিভার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় বহন করছে, বাংলা নাটকের ইতিহাসেও এর স্থান খুব উচ্চে
       
বেলগাছিয়া থিয়েটারে নাট্যকার রূপে যুক্ত থাকার সময় বাল্যবন্ধু গৌরদাস বসাক ও সে যুগের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা কেশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি থেকে মধুসূদনের নাট্যচিন্তার সূত্রগুলি জানা যায় ধনাঢ্য জমিদারদের বাগানবাড়ি থেকে বাংলা থিয়েটারকে উদ্ধার করে যথার্থ গণতান্ত্রিক চেতনায় প্রতিষ্ঠিত করাও মধুসূদনের নাট্যাদর্শ ছিল তাই তাঁর সব নাটকেই প্রাচীন সামন্ততন্ত্র লালিত সমাজ বন্দোবস্তের অমানবিক দিককেই উন্মোচিত করেছেন তাই মানবীয় অধিকারে বঞ্চিতা শর্মিষ্ঠা তাঁর নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র হন কৃষ্ণকুমারী নাটকে রাজপুত রাজাদের বীরত্বের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে তাদের পারস্পরিক কলহ,ঈর্ষা, নারী লোলুপতার সামন্ততান্ত্রিক অনাচারকে তুলে ধরেন নাট্য-আখ্যানে এবং মেঘনাদ বধমহাকাব্যে পৌরাণিক কাহিনী গৌণ হয়ে, মুখ্য হয়ে ওঠে নিজ জন্মভূমি রক্ষার প্রতিজ্ঞা, দেশপ্রেম বাংলা নাটকে দেশপ্রেমের চেতনার প্রথম পাঠ মধুসূদনের নাটকেই মেঘনাদ বধকাব্যে পাই দেশপ্রেমের উচ্চারণ জন্মভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে?” মেঘনাদ বধ কাব্যমধুসূদন নাটকাকারে লেখেন নি, যদিও এর নাট্যরূপান্তর বেঙ্গল থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয় ১৮৭৫এর ৬ই মার্চ প্রমীলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নটী বিনোদিনী
       
মধুসূদন শুধু বাংলা মঞ্চের জন্য সার্থক নাটক রচনা করেই থেমে থাকেন নি, বাংলা থিয়েটারের সেই ঊষালগ্নে থিয়েটার পরিচালনায় আধুনিকতা আনা বা সংস্কারের ক্ষেত্রেও ছিলেন নিরলস ১৮৭২এর ৬ই ডিসেম্বর দীনবন্ধু মিত্রর নীলদর্পণ অভিনয়ের মধ্যদিয়ে পথ চলা শুরু করেছিল আমাদের প্রথম সাধারণ রঙ্গালয় জমিদারদের বাগানবাড়ি থেকে থিয়েটার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেল থিয়েটারের দরজা টিকিট বিক্রি করে নাটক দেখার শুরু সেদিন থেকেই পরের বছর গোড়ার দিকে ধনকুবের আশুতোষ দেবের (ছাতু বাবু) দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ ৯ নম্বর বিডন স্ট্রীটে প্রতিষ্ঠা করলেন কলকাতার প্রথম স্থায়ী নাট্যশালা বেঙ্গল থিয়েটার সুচারুভাবে থিয়েটার পরিচালনার জন্য একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হল আর এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখেরা শরৎচন্দ্র ঘোষ মধুসূদনকে অনুরোধ করলেন তার বেঙ্গল থিয়েটারের জন্য নাটক লিখে দিতে মধুসূদন সম্মত হলেন দুটি নাটক লিখে দিতে একটি শর্তে, তা হল নাটকের স্ত্রীচরিত্রগুলি স্ত্রীলোকদের দিয়েই অভিনয় করাতে হবে এর আগে নাটকে স্ত্রীচরিত্রগুলি পুরুষ অভিনেতারাই অভিনয় করতেন শর্মিষ্ঠানাটকে বা সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রথম নাটক নীলদর্পণএ পুরুষ অভিনেতারাই স্ত্রী চরিত্রিগুলি রূপায়িত করেছিলেন থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের প্রস্তাবে বেঙ্গল থিয়েটারের উপদেষ্টা কমিটির সভায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত মানুষ বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু মধুসূদন অনড় ছিলেন অভিনেত্রী নিয়োগের প্রস্তাব গৃহীত হলে ক্রুদ্ধ বিদ্যাসাগর থিয়েটারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন করেন ততকালীন রক্ষণশীল সমাজ, থিয়েটারে মেয়েরা অভিনয় করবে একথা ভাবতেই পারতো না পুরুষ অভিনেতারাও সমাজে সম্মানের যায়গায় থাকতেন না মেয়েদের গান গাওয়াও নিষিদ্ধ ছিল সেই সমাজে থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের পক্ষে সওয়াল করা নিশ্চিতভাবেই এক অগ্রবর্তী ভাবনা ছিল ১৭৯৫তে লেবেডফের থিয়েটারে গণিকাপল্লী থেকে অভিনেত্রী সংগৃহীত হয়েছিল ১৮৩৫ এ শ্যামবাজারে নবীনচন্দ্র বসুর বাড়িতে যে শখের থিয়েটার হয় তাতেও স্ত্রী চরিত্রে কয়েকজন বারাঙ্গনা কন্যা অভিনয় করেছিলেন এবং সেকালীন পত্রিকা ও সমাজপতিরা তীব্র আক্রমণ করেছিল      

এইসময় মধুসূদন খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থাতেও তিনি বেঙ্গল থিয়েটারের জন্য দুটি নাটক রচনায় হাত দেন – ‘মায়া কাননবিষ না ধনুর্গুন মৃত্যুর কয়েকদিন আগে মায়াকাননরচনা সম্পূর্ণ করেন কিন্তু দ্বিতীয় নাটকটি  শেষ করে যেতে পারেন নি মায়াকাননই মধুসূদনের শেষ নাটক এইভাবে মধুসূদনের পরামর্শে বাংলা থিয়েটারের নতুন দিগন্তের উন্মোচন হল বেঙ্গল থিয়েটারচারজন অভিনেত্রী নিয়োগ করল তারা হলেন জগত্তারিণী, গোলাপসুন্দরী, এলোকেশী ও শ্যামাসুন্দরী বেঙ্গল থিয়েটারের উদবোধনের মাস দেড়েক আগেই মধুসূদনের মৃত্যু হয় শোকের আবহে শরৎচন্দ্র তাঁর থিয়েটারের উদবোধন মায়াকাননএর পরিবর্তে শর্মিষ্ঠার অভিনয় দিয়ে করেছিলেন ১৮৭৩এর ১৬ই অগষ্ট  এই দিন থেকেই অভিনেত্রীদের বাংলা থিয়েটারের দ্বার খুলে গেলো যার অক্লান্ত সৈনিক হয়ে রইলেন মাইকেল মধসূদন দত্ত মধুসূদন এই দিনটি দেখে যেতে পারেন নি

অভিনেত্রীদের জন্য বাংলা থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার সামাজিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী ছিল, শুধু থিয়েটারের ক্ষেত্রেই নঢ়, সমাজ-অগ্রগতির ক্ষেত্রেও আমরা জানি উনিশ শতকের সেই সময়ের বাংলার সমাজ সাক্ষি ছিল কদর্য বাবু সংস্কৃতির, যখন বারাঙ্গনা গমন, রক্ষিতা পোষণ, অসামাজিক প্রণয় প্রায় বৈধতা পেয়েছিল  সম্ভ্রান্ত পরিবারের  পীড়িতা রমণীরাও বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিতেন বারাঙ্গনা পল্লীতে অন্ধকার জগতে বেড়েওঠা পিতৃপরিচয়হীনা বারাঙ্গনা কন্যারা সমাজের মূলস্রোতে একটু অন্যভাবে, একটু সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন থিয়েটারে অভিনয়ের মধ্যে প্রবর্তী সত্তর/আশি বছর বাংলা থিয়েটারকে আলোকিত করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন অন্ধকার জগত থেকে উঠে আসা এরাই সমাজের রক্তচোখ উপেক্ষা করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত ব্যক্তিত্বের মতামত অগ্রাহ্য করে বেঙ্গল থিয়েটারের কর্ণধারদের সাহস জুগিয়েছিলেন মধুসূদন অতয়েব আমাদের বুঝতে বাকি থাকেনা যে মধুসূদন শুথু আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যেরই পিতৃপুরুষ ছিলেন না, বাংলা থিয়েটারের নির্মাণে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক চেতনা প্রসারের ক্ষেত্রেও অগ্রপথিক ছিলেন মাত্র ৪টি নাটক ও দুটি প্রহসন রচনার সুবাদে মধুসূদন আধুনিক বাংলা নাটককে দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করেছিলেন, বাংলা নাটককে অবিস্মরনীয় ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছিলেন দ্বিধাহীনভাবে একথা বলতেই হবে যতদিন বাংলা ভাষার, বাংলা নাটকের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন বাংলা নাটকের পিতৃপুরুষ রূপে উচ্চারিত হবে মাইকেল মধুসূদন দত্তর নাম বাংলা নাট্যসাহিত্যে অমিত ঐশ্বর্য দান করেছেন যিনি, তাকে শেষ জীবন কাটাতে হয়েছে আত্মীয়-পরিজন পরিত্যক্ত, কপর্দকহীন, চিকিৎসাহীন এক নিঃসঙ্গ গ্রন্থাগার কক্ষে তারপর দাতব্য চিকিৎসালয়ে এই লজ্জাও বাঙ্গালিকে কুরে কুরে খাবে চিরদিন মৃত্যুর পনেরো বছর পরে তাঁর সমাধিস্থলে পাকা গাঁথুনি করে তাঁর নিজেরই লেখা যে সমাধিলিপি উৎকীর্ণ করা আছে, সেটিই উদ্ধার করি এই সামান্য রচনা শেষে
দাঁড়াও পথিক-বর
জন্ম যদি তব বঙ্গে! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত
দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন! ......


ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

তথ্যসূত্র – (১)সাহিত্যসাধক চরিতমালা / ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (২) মধুসূদন স্মৃতি / ইন্দুভূষণ দাস (৩) বাংলা সাহিত্যের স্পম্পূর্ণ ইতিহাস / অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যা (৪) রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী / অমিত মৈত্র (৫) নাট্য আকাডেমি পত্রিকা


1 টি মন্তব্য: