আসামে ব্রাত্য বাঙালি ~ শ্রীশুভ্র


আসামে ব্রাত্য বাঙালি
শ্রীশুভ্র

উপক্রমনিকা

কি হচ্ছে আসামে? যা হচ্ছে হতে দাও। ঠিকই তো হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গেও হোক। ভারতবর্ষ কেবল মাত্র ভারতীয়দের জন্য। সেখানে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ বন্ধ হোক। সমস্ত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের খেদিয়ে দাও এমনটাই মনে করেন অধিকাংশ বাঙালি। বিশেষত তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত উচ্চবিত্ত শ্রেণীর বাঙালিএবং অবশ্যই বর্ণহিন্দু বাঙালি সম্প্রদায়। বাঙালি অর্থাৎ বাংলাভাষী ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক ভাবে যে ভুখণ্ডে এই ভাষাভাষী জনগ‌োষ্ঠীর উদ্ভব, সেই জনগোষ্ঠী কোনদিনও এক ও অভিন্ন বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে স্বীকার করে নি।
ঠিক যে অখণ্ড জাতিসত্ত্বাকে স্বীকার করেই ব্রিটিশ, ফরাসী জার্মান রুশ গ্রীক জাপানী চৈনিক প্রভৃতি জাতির উত্থান। না বাঙালি এইসকল জাতি গোষ্ঠীর থেকে ধর্মে ও প্রকৃতিতে, স্বভাবে ও শিক্ষায়, বিশ্বাস ও চেতনায় সম্পূর্ণ পৃথক। বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত জাতির জন্য এক নিয়ম এক ধরণ, কিন্তু অনন্য বাঙালির জন্য ঠিক উল্টো ধরণ উল্টো নিয়ম। তাই বাঙালি সমাজ ও সম্প্রদায় নানারকম ভাবে নানান গোষ্ঠী স্বার্থে বিভক্ত। অর্থনৈতিক স্বার্থে উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত বিত্তহীন। সাম্প্রদায়িক স্বার্থে হিন্দু ও মুসলমানরাষ্ট্রীয় স্বার্থে ভারতীয় ও বাংলাদেশী। মানসিকতার স্বার্থে ঘটি ও বাঙাল। রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলীয় মতাদর্শী। এইরকম নানান গোষ্ঠীর বাঙালি পরস্পর পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিযোগী ও অন্য গোষ্ঠী বিদ্বেষী। এই যে গোষ্ঠী বিদ্বেষ, এইটিই হলো বাঙালির অন্যতম প্রধান চরিত্র বিশেষ। আবার এই গোষ্ঠী বিদ্বেষ কিন্তু মূলত বাংলাভাষী অন্যান্য গোষ্ঠীগুলির সম্বন্ধেই। অথচ অবাঙালি নানান জাতি গোষ্ঠীর সম্বন্ধে অবশ্য বাঙালি মাত্রেই ভীষণ রকমের সংবেদনশীল। যে সংবেদনশীলতায় একজন ভারতীয় বাঙালির চেতনায় আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত ভারতের প্রতিটি অবাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মানুষই তার আপন স্বদেশীয় ভাইবোন, বিশেষত ধর্মীয় সম্প্রদায়গত পরিচয় যদি এক হয় তবে তো কথাই নাই। আবার বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানসে আবিশ্ব সকল মুসলিমই তার আত্মার আত্মীয়। এইভাবেই বাঙালি সকল পরিস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে পরস্পর দলাদলি গালাগালি করেই বিদেশীদের সাথে সর্বদা গলাগলি করে থাকতেই স্বচ্ছন্দ বেশি। আর সেই কারণেই বাংলার বাঙালি কেউ ভারত পন্থী। কেউ পাকিস্তান পন্থী। কেউই বাংলা পন্থী নয়। বড়জোর স্বাধীন বাংলাদেশর নাগরিক হিসাবে বাংলাদেশ পন্থী। যাদের চেতনায় আজ আর ধরাই পড়ে না যে বাংলাদেশ আসলেই বাংলার একটি টুকরো মাত্র। এক খণ্ডিত বাংলা। সেখানে অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছেন, স্বাধীন বাংলাদেশই সম্পূর্ণ বাংলা।

বর্তমান

“এক”

এত কথার অবতারণ করার একটিই কারণ, বাঙালির মানস প্রকৃতির ধরণটি সম্বন্ধে সঠিক পরিচয় না থাকলে বর্তমান পরিস্থিতির কোন কিছুই অনুধাবন করা সম্ভব নয় কারুর পক্ষেই। সে তিনি যে পক্ষেই থাকুন না কেন। সত্যিই কি হচ্ছে আসামে। আসামে বাঙালি বিদ্বেষের ইতিহাস নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পরপরই সেই বিদ্বেষ নানান সময়ে নানান পর্বেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেকথা সকলেরই জানা। অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, সেসব এখন ইতিহাস। আসাম এখন শান্ত। সেখানে সকলে মিলেমিশে এক হয়ে বসবাস করছেন সম্প্রীতির বাতাবরণে। অনেকেরই বক্তব্য এই সময়ে অযথা উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে সম্প্রীতির বাতাবরণ নষ্ট করবেন না। শান্ত আসামকে নতুন করে অশান্ত করার অপচেষ্টা থেকে নিজে বিরত থাকুন। অপরকেও বিরত রাখুন। শুনতে খুবই ভালো লাগে এমন পরামর্শ। কিন্তু কথায় বলে চোখ বন্ধ রাখলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না। কি হচ্ছে আজ আসামে? না জাতীয় নাগরিকত্ব পঞ্জির নথিভুক্তি করণ। যার ফলে চল্লিশ লক্ষের বেশি মানুষের নাগরিকত্ব আজ প্রশ্নচিহ্নের সামনে। একই পরিবারে কেউ ভারতীয় আবার কেউ বিদেশী। হ্যাঁ এটাই তো আজ ঘটেছে শান্ত আসামে। ঘটছে কোন রাজনৈতিক আন্দোলনে নয়। ঘটছে সরকারী কার্যক্রমে। সরকার চালাচ্ছেন কারা? না বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট। সরকারি যুক্তি কি, না সবকিছুই হচ্ছে মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের তত্বাবধানে বিগত শতকের আটের দশকের মধ্যপর্যায়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের করা এক চুক্তির বলে। সেই চুক্তি ও চুক্তির কারণ ইত্যাদির বিষয়ে সকলেই অবগত। নতুন করে কিছুই বলার নাই। কিন্তু যাঁরা বলছেন, শান্ত আসামকে অশান্ত করবেন না, তাঁরা কি একবারও এটা ভেবে দেখেছেন, যে আসাম যদি শান্তই হয়, তবে কি প্রয়োজন ছিল তেত্রিশ বছর আগের একটি চুক্তিকে আজকের এই শান্ত ও সম্প্রীতির সময়ে বাস্তবায়িত করে তোলার। আজকে যখন সত্যই আশির দশকের মতো বাঙালি খেদাও অভিযানে নামেন নি অসমীয়রা। তাহলে? তাহলে কেন নতুন করে এবং সরকারী ভাবেই অনুপ্রবেশকারী তকমায় বাঙালি খেদানো শুরু হলো? যে কোন সৎ ও বিবেকী মানুষকেই এই প্রশ্ন নাড়া দেবে। কিন্তু যাঁরা স্বেচ্ছায় আচ্ছন্ন করে রেখেছেন নিজেদের বোধ ও বুদ্ধি মানবিক নীতি ও আদর্শ তাঁদের অসাড় চেতনায় এসব কথা অর্থহীন বলেই প্রতিপন্ন হবে। তাঁরা প্রধাণত নিজ গোষ্ঠী স্বার্থ ও রাজনৈতিক পক্ষ অবলম্বন করেই অবদমিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করতে থাকবেন স্বপক্ষ সমর্থনে। একটু চতুর যাঁরা তাঁরা ভাষিক বিষোদ্গার না করে গোটা বিষয়টি যে সুপ্রীমকোর্টের তত্বাবধানে সেকথাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিতর্কে দাঁড়ি টানবেন।

এই এন-আর-সি’র বিষয়ে যাঁরা অবগত আছেন, তাঁরা জানেন আসামে এটি চালু করার পিছনে অহমীয় অস্মিতার বর্তমান প্রেক্ষাপটটি ঠিক কি রকম। আপাত শান্ত আসামে ১৯৮৫-৮৬ সালের অসম চুক্তির বাস্তবায়ন না হলে পরিস্থিতি কতটা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে পারে সে অভিজ্ঞতাও অনেকেরই আছে। ফলে আসাম শান্ত বলে যাঁরা শীতঘুম দেওয়ার ও দেওয়ানোর পক্ষপাতী তাঁরা কিন্তু কোন না কোন রাজনৈতিক সমীকরণ থেকেই সেটি করছেন। সেটি আর যাই হোক বাস্তবচিতও নয়। সত্যও নয়। আসামে বিগত সাত দশক ব্যাপি জাতি দাঙ্গা ও বাঙালি বিদ্বেষের যে ধারাবাহিক ঐতিহ্য যার একটা চুড়ান্ত রূপ প্রত্যক্ষ করেছি আমরা বিগত শতকের আশির দশকেই, সেটি কিন্তু ছাইচাপা আগুনের মতোই সমগ্র আসামব্যাপি আজও বিদ্যমান। বিদ্যমান কেননা সেই অসমচুক্তি। যার ভিত্তিতে ১৯৭১-এর ২৪-২৫শে মার্চকে ভিত্তি বর্ষ ধরে অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেটি যদি আজ কোনভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়, কাল যে সারা আসাম ব্যাপি বাঙালি খেদানোর উদ্দেশে সরাসরি জাতিদাঙ্গা শুরু হয়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবেন? এই অসমচুক্তিই কিন্তু প্রকৃত পক্ষে অহমীয় অস্মিতার অগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েই রেখেছে। ফলে যখনই হোক যেভাবেই হোক বাঙালি খেদাতেই হবে। তা সে যে সরকারের হাত দিয়েই হোক না কেন। আসামের বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু এইটাই। হ্যাঁ অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, বাঙালি খেদানোর কথাটি ঠিক নয়। অসমচুক্তি, আসামে অনুপ্রবেশকারীদের আসাম থেকে বহিস্কারের উদ্দেশেই করা। বাঙালি খেদানোর জন্য নয়। হ্যাঁ সেটি খাতায় কলমে। বাস্তবে নয় আদৌ। যদি তাই হতো তাহলে চল্লিশ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব চলে যেত না। যার মধ্যে সম্পূর্ণ বৈধ কাগজপত্র থাকা লক্ষ লক্ষ ভারতীয় বাঙালি নাগরিকও রয়েছেন। কি তাঁদের অপরাধ? না তাঁদের মাতৃভাষা বাংলা। সেটাই তাঁদের নাগরিকত্ব হরণের পক্ষে যথেষ্ট। আর কোন কারণের দরকার নাই। কোন সরকারই সেই কথা মুখে বলতে পারে না। কিন্তু কাজে করে দেখাতে পারে। করছেও তাই। আসামে বসবাসকারী বৈধ বাঙালি নাগরিকদের মনে সেটাই আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে আজকে। আর সেখানেই অহমীয় অস্মিতার মন জয় করে ফেলেছে আসামের বর্তমান শাসকগোষ্টী। ভারতীয় বিজেপি এটাকেই পাখির চোখ করে আসামের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার রূপরেখা তৈরী করে এগিয়েছিল এতদিন। আজকে তারা সফল। আর এই সাফল্যের উপর ভর দিয়েই তারা পশ্চিম বাংলায় থাবা বসাতে তৎপর। বর্তমান রাজনৈতিক আবহ সুস্পষ্টভাবে তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই শান্ত আসাম বলে যাঁরা শীতঘুম দেওয়ার পক্ষপাতী, তাঁরা সত্যইই বসে রয়েছেন নিজেদের তৈরী আইভরি টাওয়ারেই।

“দুই”

আসামে নাগরিকত্ব হারানো এই চল্লিশ লক্ষ মানুষের মধ্যে বেশিরভাগই ১৯৭১ এর ২৪শে মার্চের আগে আসা শরণার্থী ও তাদেরই বংশধর। যে সংখ্যাটির বেশিরভাগই দারিদ্রসীমার আসেপাশে থাকা তথাকথিত শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত শ্রেণীরএছাড়াও ১৯৪৭-এর বহু আগে থেকেই বাস করা লক্ষ লক্ষ বাঙালি ভুমিপুত্রদের বংশধররাও আজ নাগরিকত্ব হারিয়ে বিপন্ন। এখন প্রশ্ন ১৯৭১-এর ২৪-২৫শে মার্চকে ভিত্তিবর্ষ ধরে যে জাতীয় নাগরিককত্ব পঞ্জি করা হয়েছে তার মূলেই রয়েছে সবচেয়ে বড়ো গলদ। কেননা, আজ থেকে ৪৭ বছর আগের যে সব কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্যে, সেই সব কাগজপত্র প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে কজনের ঘরে সযত্নে রক্ষিত থাকতে পারে? বিশেষত জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশই যেখানে বিদ্যালয় শিক্ষা থেকে নাগরিক জীবনযাপন থেকে বঞ্চিত ও শতহস্ত দূরে? এবং এই অর্ধশতাব্দী সময় সীমায় কতবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে আসামের জনজীবন? এই সমস্ত বাস্তব পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি পঞ্চাশ বছর পর পঞ্চাশ বছর আগেকার কাগজপত্র দাবি করে তবে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক সেই দাবির নৈতিকতা নিয়েই। এবং সর্বপরি, আজকে এই প্রযুক্তির যুগে বসে, প্রায় প্রত্যেকেরই হাতে ভোটার কার্ড আধার কার্ড এবং মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তদের হাতে প্যান কার্ড রয়েছে ঠিকই। মনে রাখতে হবে এই ভারতবর্ষেই পঞ্চাশ বছর আগে এইসব পরিচয় পত্র বা এইধরনের পরিচয় পত্রের মতো কোন কিছুই ছিল না। সেসময় কজনেরই বা পাসপোর্ট থাকত? প্রত্যন্ত অঞ্চলে কজনের হাতেই বা রেশন কার্ড বা গৃহসম্পত্তির দলিল দস্তাবেজ থাকতো? কিংবা থাকতে বিবাহের রেজিস্ট্রেশনের সার্টিফিকেট? এমন কি বার্থ সার্টিফিকেট থাকা মানুষের সংখ্যাটিও নেহাতই যৎসামান্যের বেশি হতে পারে না। এরপরেও বোঝা দরকার, যাঁদের সেইসব কাগজপত্র ছিল, তাঁদের মধ্যেও কতজনের পক্ষে সম্ভব সেই সব কাগজপত্র সযত্নে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে সংরক্ষিত রাখা? কজনই বা আজ জীবিত রয়েছেন? পরবর্তী প্রজন্মের কতজনের পক্ষে সম্ভব সেই সব কাগজ ঠিক মতো দেখেনো? আসলে রাষ্ট্রব্যবস্থাও এই সব কিছুই জানে। আর জানে বলেই এইটিকেই সুচতুর ভাবে কাজে লাগিয়ে অনুপ্রবেশকারী বিতারণের নামে বাঙালি খেদানোর কাজে লাগানো হচ্ছে। লাগানো যে হচ্ছে তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ, আসামে এই এন-আর-সি কার্যকর করার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবেই অসমীয়া জনগোষ্ঠীকে ওরিজিন্যাল ইনহ্যাবিট্যান্ট ও বাঙালিদের নন ওরিজিন্যাল ইনহাবিট্যান্ট এই দুই ভাগে ভাগ করে, দুই রকম পদ্ধতিতে নাগরিক পঞ্জিতে নাম তোলার ব্যবস্থা হয়েছে। ফলে যে ফাঁক দিয়ে অধিকাংশ বৈধ ভারতীয় বাঙালিকেও অনুপ্রবেশকারীর তকমা দেওয়া যাবে, সেই ফাঁকটাই অসমীয়াদের জন্যে রাখা হয় নি। ঠিক এইখানেই রাষ্ট্র ব্যবস্থার চালাকিসুপ্রীমকোর্টের দোহাই দিয়ে সুচতুরভাবে যে কাজটি করা হচ্ছে। এইভাবেই সরকারীভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ব্যবহার করে আসামের জোট সরকার সেই অহমীয় অস্মিতাকেই আবার সুকৌশলে সমগ্র আসাম ব্যাপি জাগিয়ে তুলছে। যেখানে বাঙালি মাত্রেই বিদেশী। বাঙালি মাত্রেই অনুপ্রবেশকারী।

ইতিহাস

এবার একটু ইতিহাসের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখে নেওয়া যাক। সত্যিই কি আসামে বাঙালি মাত্রেই অনুপ্রবেশকারী? আর অসমীয়া মাত্রেই আসামের ভূমিপুত্র? ইতিহাসবিদদের কথা অনুযায়ী ১৮২৬ সালে আরাকানরাজদের হাত থেকে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চল ব্রিটিশের হাতে আসে। ইতিহাসবিদদের দাবি, এই অঞ্চলের অহমীয় জনগোষ্ঠী মুলত আরাকান ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল থেকেই কালে কালে এই অঞ্চলে অনুপ্রবেশ করে বসবাস করা শুরু করে। ফলে বর্তমান অসমীয়দের পূর্বপুরুষরাও ভারতের বাইরে থেকেই আগত। এখন বিস্তৃত এই অঞ্চল ব্রিটিশের হাতে আসার পর স্বভাবতই সেখানের জনজীবনের উপর ব্রিটিশের শাসনপ্রণালীর প্রভাব পড়তে শুরু করে। প্রথম দিকে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী এই বিস্তীর্ণ ভুখণ্ডকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর অন্তর্ভুক্ত করে শাসনকার্য পরিচালনার উদ্দেশে শিক্ষিত বাঙালি বর্ণহিন্দুদের উপরেই ভরসা করতে থাকে। কারণ এই অঞ্চলে উপযুক্ত শিক্ষিত মানুষের অভাবে এটাই ব্রিটিশের কাছে সহজ সমাধান ছিল। ইতিহাসবিদরা আরও জানাচ্ছেন, এই ভুখণ্ডের অনগ্রসর আঞ্চলিক জুম পদ্ধতির চাষাবাদের বদলে পূর্ব বাংলার কৃষকদেরকে এখানে নিয়ে এসে কৃষিকার্যের উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে ব্রিটিশরাই। সাথে চা বাগানগুলিতে শ্রমিক যোগান দিতে বিহার ও মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদেরকেও এখানে নিয়ে আসা শুরু হয়। ফলে কালে কালে এই অঞ্চলের জনজীবনের পরিবর্তন হতে থাকে স্বাভাবিক নিয়মেই। এবং এর ফলে ১৮৩৮ খৃষ্টাব্দে ইংরাজীর সাথে বাংলাকেও এই অঞ্চলের সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয় ব্রিটিশ প্রশাসন। এরপর ১৮৭৩ খৃষ্টাব্দে আসামকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী থেকে পৃথক করে আলাদা প্রদেশ গঠন করা হয়। এই অব্দি কোন সমস্যা ছিল না। সমস্যার সূত্রপাত হয় এরপরেই। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন অভিভক্ত বাংলাকে প্রথম ভাগ করে বাংলার গোয়ালপাড়া, কাছাড়, শ্রীহট্ট, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি শিলচরকে নবগঠিত আসামের সাথে জুড়ে দেয়। এই অঞ্চলের চৌদ্দ পুরুষ বসবাসকারী বাঙালির কপাল পোড়ে সেইসময়েই। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ১৯০৫-এর দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় কলকাতা ও ঢাকা কেন্দ্রিক বঙ্গসমাজের দাবিদাওয়ার মধ্যে অবিভক্ত বাংলার এই অঞ্চলগুলি বাদ পড়ে যায়। সেদিনের নেতা মনীষীদের কারুরই খেয়াল হয় না, বাংলার একটি বিস্তৃত অংশ বাংলার বাইরেই অনাদর অবহেলায় পড়ে থাকলো। বঙ্গভঙ্গ রোধের আনন্দ উত্তেজনায় চাপা পড়ে গেল প্রথম বঙ্গভঙ্গের অনুচ্চারিত বেদনার ইতিহাস। চৌদ্দপুরুষের ভিটে মাটি নিয়েই এক বিস্তৃত অঞ্চলের বাঙালির পরিচয় হয়ে গেল অসমে বসবাসকারী বাঙালি হিসাবেই। ইতিহাসের এ এক নিদারুণ মর্মান্তিক অধ্যায়মর্মান্তিক কেননা, সারা বাঙলায় কোন নেতা মনীষী বুদ্ধুজীবীরই খেয়াল হলো না এই বিষয়টি। সেদিন যদি কোলকাতাকে বিহারের সাথে জুড়ে দেওয়া হতো, একমাত্র তখনই বৃহত্তর বঙ্গসমাজ এই নিদারুণ ঘটনার মর্ম সম্যক উপলব্ধি করতে পারতো। ফলে ইতিহাসের ধারা বদলে গেল ব্রিটিশের শাসন ও বঙ্গসমাজের উদাসীনতার কারণেই।

এরপর এল সেই কালরাত্রি। ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্ট। অবশিষ্ট বাংলাকে কেটে দুটুকরো করে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো। এবং বাঙালি কোন রকম প্রতিবাদ আন্দোলন ছাড়াই সেই বিভক্তি মেনে নিলো অম্লানবদনে। কেননা আত্মঘাতী বাঙালি মূলত একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতিগোষ্ঠী। সেই ইতিহাস প্রবন্ধের প্রারম্ভেই তুলে ধরা হয়েছে। সেই অন্ধকার কালরাত্রিকে ঠেকানোর তবু একটা প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন শরৎ বসু ও আবুল হাশিম। কিন্তু যেহেতু তাঁরা কেউই জননেতা ছিলেন না, তাই তাঁদের প্রয়াসে জল ঢেলে দিতে সমর্থ হয়েছিল ব্রিটিশ, তাদের ভারতীয় এজেন্ট কংগ্রেস মুসলীম লীগ ও হিন্দু মহাসভার সরাসরি সহায়তায়। আর এই বিষয়ে সর্বাগ্রে যে বাঙালির নাম উঠে আসে তিনিই হলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। পলাশীর প্রান্তরে এক মীরজাফর ব্রিটিশের হাতে বাংলাকে তুলে দিয়েছিল। আর সেই ব্রিটিশ চলে যাওয়ার সময় তাদের বাংলা ভাগের চক্রান্তে সর্বপ্রকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে শরৎ বসু আবুল হাশিমের অখণ্ড ও স্বাধীন বাংলার প্রয়াসকে বানচাল করে এই শ্যামাপ্রসাদ ১৪ই আগস্ট বাংলাকে দুটুকরো করে উর্ধবাহু হয়েছিলেন। ব্রিটিশের আমদানী করা সেই দ্বিজাতিতত্ত্বকেই সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে সফল করে। এই প্রসঙ্গেই স্মরণীয়, এই সেই শ্যামাপ্রসাদ যিনি, ১৯৪৭ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী বাঙলার তৎকালীন গভর্নর স্যার ফেডারিক বারোজের দরবারে গিয়ে দাবি জানান সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারতকে বিভক্ত করা হলে বাঙালকেও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত করতে হবে এবং বাঙলার হিন্দু প্রধান অঞ্চলে একটি পৃথক প্রদেশ গঠন করে তাকে ভারতীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। (অমৃত বাজার পত্রিকা; ২৪শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৭)। সফল হলো ব্রিটিশের পরিকল্পনা। সুচতুর ব্রিটিশ ভারত শাসনকালে যে জাতির কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল, সেই জাতিকেই তিনটুকরো করে দিয়ে প্রতিশোধ নিয়ে গেল বাঙালার এইসব মীরজাফরদেরই সহায়তায়।


তৃতীয় বারের জন্য বাংলাকে ভাগ করা হলো। এবারের ভাগ হলো সর্বাত্মক ও মারাত্মক। না এই প্রবন্ধের বিষয় বাংলা ভাগ নয়। কিন্তু আসাম সমস্যার প্রেক্ষাপটটা বুঝতে হলে এই ন্যূনতম ইতিহাসটুকু মাথায় রাখতেই হবে। বাংলা ভাগের এই পর্বে, ১৮৭৪ সালে আসামে অন্তর্ভুক্ত হওয়া শ্রীহট্টের একটা বড়ো অংশ ফিরে এলো বিভক্ত পূর্ব বাংলায়। সেখানে বসবাসকারী বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল নিজভুমের সাথে পুনরায় সংযুক্ত হতে পেরে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকেই শিরধার্য্য করে শ্রীহট্টের বাঙালি হিন্দু এবার ছড়িয়ে পড়লো পার্শ্ববর্তী বাংলার অংশ করিমগঞ্জ হাইলাকান্দি শিলচর সহ গোটা বরাক উপত্যাকায়। স্বভাবতঃই সন্নিহিত পূর্ববাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকাংশও এই ভাবেই বরাক উপত্যাকার করিমগঞ্জ হাইলাকান্দি শিলচরেই মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে থাকলো দিনে দিনে। বাড়তে থাকলো বাঙালি জনসংখ্যা। বাড়তে থাকল অহমীয়া অস্মিতা। অহমীয়রা ধরেই নিলো পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা গোয়ালপাড়া কাছাড় করিমগঞ্জ হাইলাকান্দি শিলচর সহ গোটা বরাক উপত্যাকার তারই ভূমিপুত্র। আর বাঙালিই সেখানে অনুপ্রবেশকারী। শুরু হলো স্বাধীন ভারতের আসামে বাঙালি বিদ্বেষের রাজনীতি। মানুষ ভুলতে বসলো বরাক উপত্যাকা সহ গোয়ালপাড়া কাছাড়ের পূর্ব ইতিহাস। ভুলে গেল আসামে জনবসতি গড়ে ওঠার ব্রিটিশ পর্বের ইতিহাস। ভুলে গেল আধুনিক আসাম গড়ে ওঠার পিছনে বাঙালির অবদান। ভুলে গেল মূল বাংলা থেকে আসামের সাথে জুড়ে দেওয়া জনপদগুলির আসল ভূমিপুত্র কারা। দুঃখের বিষয়, বাঙালি নিজেও বিস্মৃত হলো সেই ইতিহাস। তাই প্রতিপদে অহমীয়া অস্মিতার কাছে মাথা মত করে অসমীয়দের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জীবন করল শুরু। এরই প্রেক্ষিতে আসামে ভাষা আন্দোলনে বাঙালির শহীদ হওয়া। বিগত সাত দশক ব্যাপি বাঙালি বিদ্বেষের বাতাবরণ ও জাতিদাঙ্গার হত্যালীলায় সহস্র বাঙালির শহীদ হওয়া। এবং লক্ষ লক্ষ বাঙালির আসাম ত্যাগ। না হলে আসামে আজকের ভারতীয় নাগরিকত্ব হারানো বাঙালির সংখ্যাটি চল্লিশ লাখ না হয়ে কয়েক কোটিতে গিয়ে পৌঁছাতো।

ইতিহাসের এই প্রসঙ্গ শেষ করবো একটি ঐতিহাসিক উদ্ধৃতি দিয়ে। সেই ১৯৪৭-এর ২৬শে জানুয়ারী। কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় সারা ভারত ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মির কনফারেন্স। এই সম্মেলনেই শরৎ বসু তাঁর ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, “….India must be a Union of autonomous socialist republics and I believe that if the different provinces are redistributed on a linguistic basis and what are today called provinces are converted into autonomous socialist republics; those socialist republics will gladly co-operate with one another in forming an Indian Union. It is not the Indian Union of British conception and British making. I look forward to that Union  and not to the Union of British conception and British making(Sarat Chandra Bose: Commemoration Volume; Sarat Bose Academy, Calcutta. 1982; P-72)

এবং এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে এরই কিছুদিন আগে, আবুল হাশিমের সাথে প্রথম সাক্ষাতে, শরৎচন্দ্র বসু হাশিম সাহেবকে জানিয়ে ছিলেন যে তিনি মনে করেন ভারত একটি দেশ নয়, একটি উপমহাদেশ, এবং ভারতীয়রা এক জাতি নয় এবং ভারত যথার্থভাবে তখনই স্বাধীন হবে যখন ভারতের অঙ্গ রাজ্যগুলি ও জাতিসমূহ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হবে। (কামরুদ্দীন আহমেদ: ‘বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মপ্রকাশ’ দ্বিতীয় খণ্ড; ১৩৮২, পৃ: ১৫২)

কিন্তু আত্মঘাতী বাঙালি, ইতিহাস বিস্মৃত বাঙালি, সাম্প্রদায়িক বাঙালি, গোষ্ঠী বিভক্ত বাঙালি স্বভাবতঃই কর্ণপাত করে নি সেসব কথায়। আজও করে না। আদৌ কি করবে কোনদিন? বাঙালি জাতীয়তার শিরদাঁড়ায় মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে?

পর্যালোচনা

“এক”

সেদিন যদি শরৎচন্দ্র বসুর নীতি মেনে স্বাধীন ভারত গঠিত হতো, তবে আজকের ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি দেশের মতোই একাধিক স্বাধীন দেশের একটি সমবায় হিসাবে বিশ্বে অত্যন্ত মর্য্যাদার সাথে আত্মপ্রকাশ ঘটত প্রতিটি স্বাধীন সার্বভৌম ভারতীয় জাতি সমূহের। ঠিক ইউরোপের মতোই এবং সম্পূর্ণ ভাষা ভিত্তিক এক একটি স্বাধীন জাতির আত্মপ্রকাশের ভিতর দিয়ে সেই সকল জাতির প্রত্যেকে আবিশ্ব মাথা উঁচু করে নিজ নিজ জাতির উন্নতিতে আত্মনিয়োগ করতে পারতো। ঠিক যেমনটি করেছে ইউরোপের স্বাধীন জাতিগুলি। কিন্তু তা হয় নি। হয় নি কারণ ব্রিটিশ সেটি চায় নি। হয় নি কারণ পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পাওয়া বৃটিশের ফেলে যাওয়া দুই টুকরো সাম্রাজ্যের পরিচালক শ্রেণীও সেটি চায় নি। ব্রিটিশ বিদায় নিলেও বিদায় নেয় নি ব্রিটিশের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ। যা চরিতার্থ করার জন্যেই তাদের ভারতীয় এজেন্ট কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের হাতে দিয়ে যায় শাসনভারব্রিটিশ প্রভুর জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় প্রভুরা। তারপর বিগত সাতটি দশকে ইতিহাসের জল অনেকদূর গড়িয়েছে। আর ব্রিটিশের পুঁতে যাওয়া ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিষবৃক্ষের শাখা প্রশাখাই বিস্তৃত হয়েছে শুধু। সেই বিষবৃক্ষেরই অন্যতম পরিণতি আসামের বাঙালিদের বিড়ম্বিত ভাগ্যের পরিহাস।

স্বাধীন ভারতের সংবিধানে জাতি ধর্ম ভাষা বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই স্বাধীন ভারতের যেকোন অংশেই থাকার অধিকার রয়েছে। দেশভাগের সময় সেই কথাই দেওয়া ছিল। ব্রিটিশ ভারতের যে কোন প্রান্তের নাগরিক খণ্ডিত ভারতে বসবাস করতে চাইলে ভারত তার নাগরিকত্ব স্বীকারে অঙ্গীকার বদ্ধ। সেই অঙ্গীকারেই দেশভাগের পর কোটি কোটি হিন্দু যেমন খণ্ডিত ভারতের সীমানায় প্রবেশ করেছে, ঠিক তেমনই কোটি কোটি মুসলমানও ভারতবর্ষ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যায় নি কিন্তু। ফলে স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পরে আজকের ভারতবর্ষ যদি হিন্দী হিন্দু হিন্দুস্তানের স্লোগান আউড়ায় তবে সেটি হবে সংবিধান বিরোধী ভারত বিরোধী কর্মকাণ্ডই। দুঃখের বিষয় আজ ঠিক সেটাই হচ্ছে।

এবার একটু ফিরে যাওয়া যাক আবার আসামে। সেই অহমীয় অস্মিতার পরিমণ্ডলে। শরৎচন্দ্র বসুর নীতিতে ব্রিটিশ পরবর্তী ভারতবর্ষে ভাষা ভিত্তিক স্বাধীন জাতি সমূহের এক একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সৃষ্টি হলে বাংলাও এক অখণ্ড স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ হিসাবেই আত্মপ্রকাশ করতো। যেখানে বাংলাভাষী সকল অঞ্চলগুলি নিয়েই গড়ে উঠতে পারতো অখণ্ড বঙ্গ। পশ্চিমে আজকের বিহারের সেদিনের বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ণিয়া, ভাগলপুর রাঁচী ধানবাদ। দক্ষিণে কটক উত্তরে গোয়ালপাড়া কাছাড় বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যাকা। পূর্বে ত্রিপুরাএই সকল বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি নিয়েই অখণ্ড বাংলা বাঙালির নিজভূমি হিসাবেই আত্মপ্রকাশ করলে বাংলা ছেড়ে বাঙালিকে আর পার্শ্ববর্তী জাতিসমূহের দেশে গিয়ে বসবাস করতে হতো না তার ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিচিতি নিয়ে। দ্বিজাতিতত্বের বিষবৃক্ষের শিকড় উপড়ে ফেলে সকল বাঙালি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার নাগরিক পরিচয় নিয়েই আবিশ্ব পরিচিতি লাভ করতে পারতো ঠিক ব্রিটিশ ফারাসী জার্মান গ্রীক রুশ জাপানী চিনাদের মতোই। কিন্তু সেসব ঘটেনি কিছুই। উল্টে কি ঘটল? আত্মঘাতী, ইতিহাস বিস্মৃত, সাম্প্রদায়িক এবং নানান ধরণের গোষ্ঠী বিভাজিত বাঙালির হাত থেকে এক লহমায় হাতছাড়া হয়ে গেল একাধিক বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল। পশ্চিমে পূর্ণিয়া ভাগলপুর রাঁচী ধানবাদ, দক্ষিণে কটক, উত্তরে সেই গোয়াল পাড়া কাছাড় সহ সমগ্র বরাক উপত্যাকাই। বাঙালিকে নিজভুমেই পরবাসী হয়ে থাকতে হলো কোথাও বিহারের অধিবাসী হয়ে কোথাও উড়িষ্যার অধিবাসী হয়ে, কোথাও আসামের অধিবাসী হয়ে। হ্যাঁ আত্মঘাতী জাতির, ইতিহাস বিস্মৃত জাতির এটাই স্বাভাবিক পরিণতি। অবশ্য এখানেই শেষ নয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সাত দশক ব্যাপি লাগাতার অনুপ্রবেশের ফলে আজকের পশ্চিম বঙ্গের ডেমগ্রাফিক পরিচয়ই পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিত ভাবেই। বিহার উত্তর প্রদেশ উড়িষ্যা ও আজকের ঝাড়খণ্ড থেকে কোটি কোটি অবাঙালি তাদের ভাষা কৃষ্টি সংস্কৃতি নিয়ে স্থায়ী ভাবে বসতি গড়ে ফেলেছে গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই। সঠিক জনসংখ্যার বিন্যাস প্রকাশ হলে দেখা যেত আজ এই রাজ্যের অবাঙালির সংখ্যা ত্রিশ শতাংশের বেশি। এতটুকু একটি রাজ্যে আজ বাঙালি নিজেই কোনঠাসা। সরকারী চাকুরীর একটা বড়ো অংশেই অবাঙালিদের রমরমা। ব্যবসা বাণিজ্যে তো তারাই পরিচালনায়। এমনকি রাজ্য রাজনীতির প্রশাসনিক স্তরেও অবাঙালিদের একটা বড়ো অংশই জায়গায় করে নিয়েছে। না, যে ভারতীয় সংবিধানের কথা বলা হয়েছে একটু আগেই, সেই সংবিধানেই এই পরিণতির স্বীকৃতি রয়েছেকিন্তু ঠিক এই একই কথাও তো প্রযোজ্য আসামের বেলায়। সেখানেও ঐতিহাসিক ভাবেই এবং সংবিধান মেনেই বাঙালির বসবাস। তাহলে বিগত সাত দশকে কয়েক কোটি বাঙালিকে আসাম থেকে জাতিদাঙ্গায় খেদানো হলো কি ভাবে? কেনই বা আজকে অনুপ্রবেশের ভেক ধরে চল্লিশ কোটি ভারতীয় বাঙালির নাগরিকত্ব কেড়েই নেওয়া হলো সরকারী ভাবেই। সংবিধানের কোন ফাঁক গলে ঘটে গেল এত বড়ো অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ড। আজকের বাঙালি তার হিসাব নেবে না? যদি না নেয়, তবে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যেও আসামের পরিণতিই নাচ্ছেবুঝতে হবে আমাদের সেইটিই। বিগত সাত দশক ধরে কিংবা চল্লিশ বছর ধরেও যারা ভারতীয় নাগরিক হিসাবে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে এসেছেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়ে অংশ নিয়েছেন আজকে এক লহমায় তাঁরাই ব্রাত্য হয়ে গেলেন? এত সহজ হিসাব? বিশ্বে আর কোথাও ঘটেছে এর আগে? সাত দশকের হিসাবও যদি ছেড়ে দেওয়া যায়, বিগত চল্লিশ দশক ধরে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশ নেওয়া ভোটাধিকার প্রাপ্ত নাগরিকের নাগরিকত্ব হরণ বিশ্বের কোন দেশের সংবিধানেই কি সম্ভব? ভাবতে হবে না সেই প্রশ্ন?

“দুই”

অনেকেই যুক্তি দিচ্ছেন আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি অনুপ্রবেশকারীরাই আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বৈধ ভারতীয় নাগরিকদের অন্নে ভাগ বসাচ্ছেন। এই সব অনুপ্রবেশকারীদের তাড়িয়ে দিলেই এই দুই রাজ্যের ভরতীয়রা সুখে সাচ্ছন্দে ভালো ভাবে দুমুঠো খেয়ে পড়ে বাঁচার সুযোগ পাবেন। তাই এই দুই রাজ্যেই এন-আর –সি’ করার দরকার। এই অনুপ্রবেশকারীরাই নাকি, এখানকার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়ে বিভিন্ন পেশা থেকে বৈধ ভারতীয়দের হঠিয়ে দিয়ে জায়গা দখল করে নিচ্ছ। বেশ। যদি এই কথাই সত্য হয়, তবে সেই সত্য তো দক্ষিণে তামিলনাড়ুর বেলাতেও সমান ভাবে প্রযোজ্য! যেখানে বিগত সাত দশক ব্যাপি শ্রীলঙ্কা থেকে জাতিদাঙ্গায় ও অর্থনৈতিক অবরোধে বিপর্যস্ত কোটি কোটি সিংহলী তামিল ভারতের এই তামিলনাড়ু ও সন্নিহিত রাজ্যগুলিতে অনুপ্রবেশ করে ভারতীয় নাগরিক হিসাবেই শান্তিতে বসবাস করছেন। কই সেখানে তো এই এন-আর-সি চালু করে সিংহলী তামিল অনুপ্রবেশকারীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে শ্রীলঙ্কায় বিতারণের কথা উঠছে না। কোন পক্ষ থেকেই! তাহলে? কিংবা ধরা যাক, উত্তরে নেপাল থেকে আগত বিদেশী নেপালীদের সারা ভারতব্যাপি ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে সুখে শান্তিতে সমৃদ্ধিতে বসবাস করার বিগত সাতদশক ব্যাপি ধারাবাহিক বাস্তবতার। কই সেই নেপালী অনুপ্রবেশকারীদের ক্ষেত্রেও তো এই এন-আর-সি করে তাদের নাগরিকত্ব হরণের কোন বন্দোবস্ত করা হচ্ছে না? নাকি এই সব সিংহলী তামিল আর নেপালের নেপালীরা ভারতীয়দের অন্নে ভাগ বসাচ্ছে না। এঁরা তবে কেউই ভারতীয় অর্থনীতিকেও পঙ্গু করে দেননি? বিভিন্ন পেশায় ভারতীদের হঠিয়ে তাদের জায়গাও নিশ্চয় দখল করে নেয় নি? শুধু বাঙালি অনুপ্রবেশকারী বা অসমে সংযুক্ত বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের চৌদ্দ পুরুষ ধরে বসবাসকারীরাই ভারতীয় অর্থনীতির বিপদ? অনেকে আবার ধরেই নিয়ে থাকেন বাঙালি অনুপ্রবেশকারী মাত্রেই জঙ্গী ও নাশকতামূলক কার্যকলাপের সাথে যুক্ত। অথচ ভারতেরই এক ভুতপূর্ব প্রধানমন্ত্রীর হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে আছে অনুপ্রবেশকারী তামিল নাশকতাবাদীদের নামই। কিন্তু সেই দৃষ্টান্ত দেখিয়েও সকল তামিল অনুপ্রবেশকারীকেই জঙ্গী অপবাদও তো দেওয়া হয় না। তাহলে? একই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জাতির অনুপ্রবেশেকারীর জন্যে বিভিন্ন নিয়ম কেন? এই যে বিভিন্নতা এটা কি ভারতীয় সংবিধান স্বীকৃত? প্রশ্ন তুলবেন না আজকের শিক্ষিত বাঙালি সম্প্রদায়?

“তিন”

অনুপ্রবেশের তত্ব ও সেই সূত্রে বৈধ ভারতীয় নাগরিকদের অন্নে ভাগ বসানোর অসাড় প্রচার যে পুরোপুরিই চরম ভাঁওতা, সেই বিষয়টি আসলেই এমন সহজেই বুঝে নেওয়া যেতে পারে, যদি কেউ বুঝতে চায় আদৌ। এবার ভারতীয় অর্থনীতির বিপদ প্রসঙ্গেও একটু আলোকপাত করা যাক। আজকের ক্ষমতাসীন বিজেপী সরকার ২০১৪’র নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল প্রধানত যে যে বিষয়গুলিকে তুলে ধরে ও প্রতিশ্রতি দিয়ে, তার মধ্যে অন্যতমই ছিল, সুইস ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ভারতীয় শিল্পপতি থেকে শুরু করে বিত্তশালী পেশাজীবি মানুষেদের লক্ষ লক্ষ কোটি কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসে সকল ভারতীয় নাগরিকের ব্যাঙ্কে একাউন্টে ১৫ লক্ষ করে টাকা জমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। সারা ভারতের নাগরিক মাত্রেই আজ জেনে গিয়েছেন এটি একটি চরমতম ভাঁওতার বেশি কিছুই ছিল না। সুইস ব্যাঙ্ক থেকে একটি কালো টাকাও দেশে ফিরিয়ে আনেনি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। সকলেই জানেন আনবেনও না। বরং উল্টে এই সরকারের আমলেই সরকারের মন্ত্রী সাংসদ ঘনিষ্ঠ একাধিক শিল্পপতি বৈধ ভারতীয় নাগরিকদের কস্টার্জিত হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে লুঠ করে নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছেন, ক্ষমতাসীন সরকারী দলেরই সহয়তায়। এই সব লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা দেশেরই সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চিত ধনের সমস্টির একটা বৃহত্তর অংশ। যে টাকা দেশীয় অর্থনীতিতে সঠিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগ করতে পারলে নতুন নতুন সন্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রচুর কর্মসংস্থান হতো। যার সরাসরি প্রভাবে দেশের বেকার সমস্যার সমাধানে প্রভুত উপকার সাধিত হতো। এবং ভারতীয় অর্থনীতির বাজারও আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারতো। এই সহজ সরল হিসাবটুকু বুঝে নিতে অর্থনীতির ক্লাসে নাম লেখাতে হয় না কিন্তু। ফলে আজকে যারা বাঙালি অনুপ্রবেশকারীর তকমা লাগিয়ে আসামের নাগরিকত্ব হারানো মানুষগুলির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একের পর এক অসাড় ও মিথ্যা প্রচারে সামিল হচ্ছেন তাঁরা যে সবকিছু জেনে বুঝেই মিথ্যা প্রচারে নেমেছেন, সেই সোজা কথাটুকু বুঝতেও খুব বেশিদিন স্কুল কলেজে যাতয়াত করার রেকর্ড না থাকলেও চলে।

“চার”

স্মরণে রাখতে হবে, আজকের আসামের দক্ষিণাংশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলই কিন্ত আসলে ১৮৭৪ সালের অবিভক্ত অখণ্ড বাংলা থেকে নিয়ে জুড়ে দেওয়া ভূখণ্ড। বিগত সাত দশকেরও বেশি সময় যে ভূখণ্ডকে অসমীয় মাত্রেই আসামের ভূমি বলে বিশ্বাস করে এসেছে। আর মনে করেছে এই ভুখণ্ডের বাঙালি মাত্রেই অনুপ্রবেশকারী। তা সে ১৯৭১’রের আগে বা পরে আসা বাঙালিই হোক না কেন। এবং তাদের অর্থাৎ সেই বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতি সমগ্র আসামের অসমীয়দের ভাষা ও সংস্কৃতিকে গ্রাস করে ফেলবে একদিন। ঠিক এই বিশ্বাস থেকেই অসমীয়দের বাঙালি বিদ্বেষের শুরু। রাজনীতি কিভাবে সেই বিদ্বেষের পালে হাওয়া লাগিয়ে ক্ষমতাদখলের পাশার ঘুটি সাজায় সেটি অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু সাধারণ অসমবাসীর এই বিশ্বাস ও বিদ্বেষ একটি জাতির পক্ষে অপরাধ কি? যে কোন জাতিই কিন্তু তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে সুরক্ষিত করতে চাইবে। সেটাই তো স্বাভাবিক। সব জাতিই তো আর বাঙালির মতো অপর জাতির পদলেহনকারী হবে না। ফলে একটি আত্মসচেতন আত্মমর্য্যাদাপূর্ণ জাতি যখনই অন্য জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবকে ভয় পেতে শুরু করবে, তখনই কিন্তু সেই জাতি সেই ভয় ও আতঙ্ক থেকেই প্রতিরোধস্পৃহ হয়ে উঠবে। যে কোন জাতির পক্ষেই এটি সমান সত্য। আবিশ্ব অনন্য একমাত্র বাঙালি জাতি ছাড়া। আসমের অহমীয় অস্মিতার এটাই গোড়ার কথা। আর সেটি সম্ভব হয়েছে, প্রতিটি অসমীয়ই প্রথমে এবং সর্বপরি অসমীয়। তারপর তারা ভারতবর্ষের নাগরিক। ঠিক যে ভাবে প্রতিটি তামিল আগে তামিল পরে ভারতীয় নাগরিক। শুধু তামিলরাই বা কেন, দক্ষিণ ভারতের সকল জাতিসমূহই ঠিক এই ভাবনার শরিক। মারাঠা থেকে গুজরাটি উড়িষ্যাবাসী থেকে কাশ্মীরী। নাগা থেকে মণিপুরি। একমাত্র বাঙালিই সকলের আগে ভারতীয়। তারপর বাঙালি। তাও অনেক লজ্জাশরমের বাধা ডিঙিয়ে। তাই অসমীয়দের অহমীয় অস্মিতার ভিত্তিটুকু একজন বাঙালির বোধগম্যতার পরিসরের বাইরে।

বাইরে বলেই আজকে পশ্চিমবঙ্গে যেখানে প্রায় তিরিশ শতাংশের বেশি অবাঙালি  পাকাপাকি ভাবেই পশ্চিমবঙ্গে বসতি ও বংশবিস্তারে ব্যস্ত যাদের মধ্যে একটা বড়ো অংশই নিজেদেরকে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিপুত্র বলে দাবি করে, তাদেরকেও বাঙালি স্বজাতি বলেই বুকে টেনে নিয়েছে। বাঙালির সামনে রয়েছে ভারতীয় সংবিধান। যেখানে ভারতবর্ষের যে কোন অংশেই যে কোন ভারতীয় জাতির মানুষের বসবাসের সমান অধিকার। ঠিক এই কারণেই নিয়মিত ভাবে পশ্চিমবঙ্গে অবাঙালিদের অনুপ্রবেশকে, কোন বাঙালিই খারাপ চোখে দেখে না। ধারাবাহিক ভাবে বাংলা ভাষার উপর হিন্দীর প্রভাব, বঙ্গসংস্কৃতির উপর হিন্দুস্তানী সংস্কৃতির প্রভাবকে বাঙালি সাদরে বরণ করে নিয়েছে। এমনকি একেবারে সাম্প্রতিক কালেই অবাঙালিদের বিভিন্ন উৎসব পার্বণকেও বাঙালি আপন করে নিতে শুরু করে দিয়েছে, অবাঙালিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। যার সুনিশ্চিত অভিমুখই হল অদূর ভবিষ্যতেই বাঙালির নিজস্ব উৎসব পার্বণগুলির অধিকাংশেরই অবলুপ্তি। ঠিক যে কাজটি দক্ষিণ ভারতীয় জাতিগুলির কেউই করার কথা কল্পনাও করতে পারে না। পারেনি অসমীয়রাও তাদের অহমীয় অস্মিতায়। এখানেই বাঙালির অনন্যতা। আর তার আত্মঘাতী প্রকৃতি।

“পাঁচ”

স্বাধীনতার পর পর যে কারণে ভুতপূর্ব আসাম ভেঙে অরুণাচল মনিপুর নাগাল্যাণ্ড মিজোরাম আলাদা আলাদা রাজ্য হিসাবে গঠন করা হলো, তখন ঠিক সেই একই কারণে কেন বরাক উপত্যাকার বাংলার ভূখণ্ডকে আলাদা একটি রাজ্যের পরিচয় দেওয়া হলো না? কেন গোয়ালপারা ও তৎসন্নিহিত বাংলার ভূখণ্ডকে পশ্চিমবঙ্গের সাথে জুড়ে দেওয়া হলো না? এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করলেই তো আসামে বাঙালির সংখ্যা অনেক কমে যেত। অসমীয়দেরও বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির আতঙ্ক থেকে মুক্তি মিলতো সহজেই। আসলে এই কাজটি করতে গেলে যে ন্যূনতম বাঙালি জাতীয়তাবোধের বিকাশ জরুরী, সেটি বাঙালিদের কোনদিনও গড়েই ওঠেনিএই অঞ্চলের ইতিহাসবিস্মৃত বাঙালি আসামকেই সতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে অসমীয়দেরকেই আপন ভাই মনে করে বসেছিল। অসমীয়দের জাতিসত্ত্বার বিকাশের স্বাভাবিক ধারাটি অনুধাবনই করতে পারেনি কোনদিন। আজকেও এই অঞ্চলের বাঙালি মনেপ্রাণে অসমীয়দের আপন স্বজাতিই মনে করে। করে কেন, না উভয়ই ভারতীয়। তাদের সেই ভুলের মাশুল স্বরূপই চল্লিশ লক্ষ বাঙালির ভারতীয় নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হলো আজ। এবং সরকারী ভাবেই।

অনেকেই বলবেন তা কেন, এটাও তো চূড়ান্ত তালিকা নয়। চূড়ান্ত খসড়া মাত্র। এখনো তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য আবেদন করার সময় থাকছে। না সেই কথা শুনে উর্ধবাহু হওয়ার মতো কিছু নাই। কারণ বহুবিধ। এই চূড়ান্ত খসড়ায় যাদের নাম বাদ পড়েছে, তারা কিন্তু প্রায় প্রত্যেকেই তাদের ভারতীয়ত্বের যৎযাবতীয় প্রমাণপত্রই দাখিল করেছিলেন ইতিমধ্যেই। যার ভিত্তিতেই এই চূড়ান্ত খসড়ার প্রকাশ। ফলে সেই সব প্রমাণপত্র ইতিমধ্যেই সরকার কর্তৃক বাতিল বলেই গ্রাহ্য হয়েছে ধরে নিতে হবে। এবং এই চল্লিশ লক্ষের অধিকাংশই জানেন নতুন করে দাখিল করার মতো আর কোন কাগজপত্রই তাঁদের হাতে আর নাই। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, আলাদীনের আশ্চর্য্য প্রদীপের দৌলতে রাতারাতি এই চল্লিশ লক্ষের হাতে এই কয়দিনে এমন সব অকাট্য প্রমাণাদি এসে পৌঁছিয়েছে যে সেসব দাখিল করলেই ভারতীয় নাগরিকত্ব সুনিশ্চিত; তবে মাত্র মাস দেড়েকের সময়সীমায় এত লোকের পক্ষে সম্ভব হবে তো সেগুলিকে ঠিক মতো কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছিয়ে দেওয়া? প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যাচ্ছে। প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে সরকারী পরিকাঠামো ও সদিচ্ছা সম্বন্ধেও। আবার এরই মধ্যে শোনা যাচ্ছে, না, এই সময়সীমায় আবেদন করলে নাগরিকত্ব হরণের কারণ জানা যাবে মাত্র। অর্থাৎ গোটা বিষয়টি নিয়েই ধোঁয়াশায় লক্ষ লক্ষ বাঙালি বৈধ ভারতীয় নাগরিক।

“ছয়”

আসামে ক্ষমতায় আসার আগে ভারতীয় বিজেপী প্রচার করেছিল, ক্ষমতায় এলেই ২০১৪’র আগে আসা সকল হিন্দু শরণার্থীদেরকেই ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ঠিক এই প্রতিশ্রুতিতেই সেখানে অধিকাংশ বাঙালিই বিজেপি-জোটকে জেতাতে ঢালাও ভাবে বিজেপিকেই ভোট দেয়। আপন নাগরিকত্ব টিকিয়ে রাখতে। ভোটজয়ের জন্যে আবারও বাঙালিকে সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্বে বিভক্ত করে দেওয়া হলো। ফলও মিলল হাতে হাতে, বিজেপির জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরই হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালির অধিকাংশের নাগরিকত্বই এখন বিশ বাঁও জলে! না শুধুই বিজেপির দিকে আঙুল তুললেও হবে না। আসামে বাঙালি খেদানোর ইতিহাসে কংগ্রেসের ভুমিকাও কম বাঙালির স্বার্থ বিরোধী নয়। যে অসমচুক্তির ফলে আজ এই এন-আর-সি, সেই চুক্তিকেই বাঙালি বিতারণে সরকারী শীলমোহর বলা যেতে পারে।

অনেকেই জানেন অসমীয়া জাত্যাভিমানীদের মতে বাংলাভাষী মানেই অনুপ্রবেশকারী এবং বাংলাদেশি। এদের মতে ১৯৭১ সালকে যে ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়েছে তা আইন নয়,একটি গেজেট নোটিফিকেশন মাত্র। সংবিধান যেদিন গৃহীত হয়েছে সেদিন (১৯৪৯ এর ২৬ নভেম্বর) যারা এই ভূখণ্ডে ছিলেন তারা বা তাদের বংশধররা নাগরিক, এটাই আইন। এবং কার্যত নাগরিকত্বের এই পঞ্জিকরণ আদৌ ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে হচ্ছে না। জমির দলিল, পূর্বপুরুষের ১৯৫১ সালের ভোটের লিস্টে নাম আছে কি না, আবেদনকারী প্রকৃতই বংশধর কি না, তার বার্থ সার্টিফিকেট জরুরী। সেটিও আবার জন্মানোর খুব বেশিদিন পর  সংগৃহিত হলে হবে না। এই ধরণেরই সব প্রমাণপত্র চাওয়া হচ্ছে, তার একটিই কারণ সত্তর আশি বছর আগের কাগজপত্র অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে তাদের নাগরিকত্ব হরণের কাজটি মাখনের ভিতর ছুরি চালানোর মতোই সহজ হয়ে যাবে।

এদিকে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ভারতের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ (সংশোধনী) বিল এনে বাঙালিদের মধ্যে আবার সেই দ্বিজাতিতত্বের ধর্মীয় বিভাজনের কৌশল সৃষ্টি করছে এই বিলে বলা হয়েছে ২০১৪ সালের আগে প্রতিবেশী দেশগুলি অর্থাৎ আফগানিস্তান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ,মায়ানমার থেকে ধর্মীয় ও সামাজিক হিংসার কারণে যেসব হিন্দু , বৌদ্ধ , শিখ, জৈন, খৃস্টান ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে তারা নাগরিকত্ব পাবে, কিন্তু কোনো মুসলমান পাবেনা। অথচ আন্তর্জাতিক ভাবেই এই আইন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার নীতি অনুযায়ীই সম্পূর্ণ অবৈধ। আবার ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টিও ভারতের সংবিধানেও অবৈধ। সম্পূর্ণভাবেই সংবিধান বিরোধী। এদিকে বিজেপির জোটসঙ্গী অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলি জানিয়ে দিয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেবার চেষ্টা হলে তারা জোট ত্যাগ করবে। আসামের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীও এই বিল না মানার পূর্বাভাষ দিয়ে পদত্যাগের সম্ভাবনার কথাও নাকি জানিয়ে দিয়েছেন। স্বভাবতঃই অসমীয়রা মনে করছেন এই বিল পাশ হলে হিন্দু বাঙালিদের নাগরিকত্ব ও বৈধতা দেওয়া হবে। যেটা তারা কোনভাবেই মেনে নেবেন না। কারণ আসামে জাতি বৈরীতা বাঙালিদেরকে নিয়ে। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালিদেরকে পুরোপুরি না খেদানো পর্য্যন্ত এই জাতি বৈরীতার অবসান হবে না কিছুতেই। মজার কথা বিধানসভা ভোটের নির্বাচনী প্রচারের সময় এরাই কিন্তু চুপ করে বসেছিলেন। বিজেপির হিন্দু তোষণের ফাঁকা প্রচারের ভাঁওতায় বাঙালি হিন্দুদের ভোটে বিজেপি-জোট সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্যে। এখন ভোটে জেতার পর মুখ আর মুখোশ আলাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে বিষয়টির ভবিষ্যত অভিমুখ কোনদিকে বুঝতে বিশেষ বেগ পাওয়ার কথা নয়। ঠিক এই ভাবেই ইতিহাসের পর্বে পর্বে বোকা বাঙালিকে বোকা বানানোর ধারাবাহিক ঐতিহ্য আজও সমান তালে বজায় আছে। বাঙালির তাতেও অসুবিধা নাই বলেই মনে হয়। নাই বলেই আজ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির একটা বড়ো অংশই বিজেপির সুরে সুর মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও এই এন-আর-সি চালু করতে চাইছেনতাঁরা ভাবছেন এই সুযোগে যদি পূ্র্ববঙ্গ আগত কোটি কোটি উদ্বাস্তুদের বংশধরদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা যায়, তবে তাদের জায়গা জমি দখল করে নেওয়ার একটা সুযোগ খুলে যেতেও পারে। আর এই কাজে তারা জানেন পাশে পেয়ে যাবেন রাজ্যে বসতি বিস্তার করা প্রায় তিরিশ শতাংশ অবাঙালি অনুপ্রবেশকারী। যারা ইতিমধ্যেই এরাজ্যের কয়েকটি শহরে এস-আর-সি চালু করার দাবিতে মিছিলও বার করে ফেলেছেন। সত্যই ধন্য বাঙালি। ধন্য তোমার আত্মঘাতী অবিমৃশ্যকারী আত্মা।

সমাধান সূত্র

না কোন পথে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে, সেকথা বলার এক্তিয়ার প্রবন্ধ লেখকের থাকতে পারে না। তার জন্য সংবিধান আছে। রাজনৈতিক নানান পক্ষ রয়েছে। রয়েছে জনগণের জনকন্ঠ। রয়েছে নির্বাচিত সরকার ও সর্বপরি ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এবং সুপ্রীম কোর্ট। কিন্তু একজন ভারতীয় নাগরিক হিসাবে, প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত প্রকাশেরও অধিকার রয়েছে সাংবিধানিক ভাবেই। সেই সূত্রেই কোন কোন পথে সমস্যার সমাধান হতে পারে, কি কি সম্ভাবনা রয়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে, সেই দিকে একবার আলোকপাত করাই যেতে পারে। বলাই বাহুল্য সেটিও একজন ভারতীয় নাগরিকের ব্যক্তিগত অভিমতের বেশি কিছু নয়।

“এক”
২০১৪ সালের পূর্বে আসা শরণার্থী প্রসঙ্গে যে ধর্মীয় বিভাজন করা হয়েছে, রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবিকতা বিরোধী সেই অমানবিক নীতির বদল ঘটিয়ে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শরণার্থীর জন্যেই ভারতীয় সংবিধানের ধারা মেনে সমান নীতি গ্রহণ করে তাদের ভারতবর্ষে আশ্রয় দিয়ে নাগরিকত্ব প্রদান।

অনেকেই বলবেন, তাতে অসমীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। তাঁরা তো কিছুতেই সেরকম কিছু মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। শুরু হবে আবার নতুম করে জাতি দাঙ্গার হত্যালীলা। প্রশ্ন সেটি নয়, প্রশ্ন হলো ভারতীয় সংবিধানকে মান্যতা দেওয়ার দায়ভার কি একা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরই? অসমীয়রা কি তবে ভারতীয় সংবিধানের বাইরে? যদি তাই হয়, তবে তো তর্কের খাতিরেই প্রশ্ন উঠে যায়, অসমীয়রাই তবে ভারতবর্ষে প্রধানতম অনুপ্রবেশকারী। যারা ভারতীয় সংবিধানই মেনে নিতে রাজী নয়।

“দুই”

অহমীয় অস্মিতা যদি স্বীকার করে নেওয়াই উচিত কাজ হয়, যদি আসাম কেবল অসমীয়দের জন্যেই স্বীকৃত হয়, তাহলে ১৮৭৪ সালের আগে অবিভক্ত বাংলার ঠিক যে যে অঞ্চলগুলি আসামের সাথে ব্রিটিশ যুক্ত করেছিল, এবং এখনো আসামের সাথেই সংযুক্ত আছে, সেই সেই অঞ্চলগুলিকে আসাম থেকে পৃথক করে আলাদা রাজ্য গঠন করাই তো সংবিধান সম্মত সমাধান হতে পারে। যে রাজ্য হবে বাংলা ভাষাভাষীদের নিজস্ব ভূমি। ইতিহাসের একটি অন্যায়েরও সঠিক বিচার করা হতে পারে সেই পথে। বিশেষত অতি সাম্প্রতিক কালেই যেখানে বিহার থেকে আলাদা হয়ে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা পেয়েছে ঝাড়খণ্ড। মধ্যপ্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে ছত্রিশগড়। অন্ধপ্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে তেলেঙ্গানা। উত্তরপ্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে উত্তরাখণ্ড। তাহলে আসামের বাঙালিদের জন্যেই বা পৃথক রাজ্য গঠনে অসুবিধা কোথায়? এই সহজ সরল প্রশ্নটি ওঠাই তো স্বাভাবিক! এবং কোন কোন অঞ্চল কিভাবে নতুন করে বিন্যস্ত হতে পারে তার প্রাথমিক রূপরেখা বর্তমান প্রবন্ধের মধ্যপর্বেই দেওয়া আছে।

“তিন”

সমাধান সূত্রের এক ও দুই ধারা পরস্পরের পরিপূরক। কিন্তু এই চল্লিশ লক্ষ বাঙালিকে কোনভাবেই যদি ভারতীয় নাগরিক বলে স্বীকার করা নাই হয় শেষ অব্দি, এবং বাংলাদেশও যদি তাদেরকে নিজ দেশের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিয়ে ফিরিয়ে নিতে নাই চায় তবে সেটি শুধু জাতীয় সঙ্কট নয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্কটেই পরিণত হবে। এবং যাঁরা পশ্চিমবঙ্গেও আসামের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে উৎসুক, তাঁদের সেই অপচষ্টাও যদি সার্থক ভাবে দানা বাঁধে তবে কিন্তু বাঙালির আত্মপরিচয়ের সঙ্কট একবিংশ শতকের ইতিহাসে অন্যতম রক্তক্ষয়ী অধ্যায়েরও জন্ম দিতে পারে।

“চার”

খবরে প্রকাশ ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আসাম সরকারকে ৬৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে শুধু ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরী করার জন্য। যেখানে এই চল্লিশ লক্ষ নাগরিকত্ব হারানো বাঙালির ঠিকানা হবে। জার্মানীর ইহুদী নিধনের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের পর এমন বিপুল পরিকল্পনা বিশ্বে এই প্রথম। এবং সংবাদ সূত্র অনুযায়ী ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ক্যাম্পে ডিভোটার চিহ্নিত ৯০০জনকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। যে সংখ্যাটি আগামী সময়ে ছুঁয়ে ফেলতে পারে চল্লিশ লক্ষ! কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে জেলের কয়েদির মতো কতদিন বাঁচিয়ে রাখা হবে? তাদের খাওয়ানোর দায়িত্ব কে নেবে? ভারত সরকার না আসাম সরকার? না কি তাদের সকলকেই মৃত্যুদণ্ড দিয়েই হবে সমস্যার সমাধান। কিন্তু সেই সমাধান স্থায়ী হবে তো আদৌ?

জানি না আমরা কেউই। একমাত্র সময়ই বলতে পারে কি হবে বাংলা বাঙালি বাঙালিত্বের ভবিষ্যতের দিন। আপাতত সামনের ছবিটা অস্পষ্ট এবং পথ দিশাহারা। এবং এরাজ্যের অধিকাংশ বাঙালিই সুখকর দিবানিদ্রায় মগ্ন নিশ্চিন্তে।

উপসংহার:

লাখ কথার এক কথা বলেছেন ত্রিপুরার বর্তমান রাজ্যপাল। তিনি কোন ধর্মের, কি তার মাতৃভাষা। নৃতাত্বিক পরিচয়ে কে বা কারা তার স্বদেশী আমরা সেসব দিকে যাচ্ছি না। কিন্তু তাঁর কথার গুরুত্ব সমধিক। তাঁর পরামর্শ, আসামের সকল বাঙালিরই উচিৎ বাংলার বদলে অসমীয় ভাষা সংস্কৃতিকেই আপন করে নেওয়া। অর্থাৎ -হে বাঙালি কি হবে নিজের আত্মপরিচয় নিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি থেকে মৃত্যুর দিন গুনে? তার থেকে মুচলেকা দিয়ে বাঙালিত্ব বিসর্জন দিয়ে অসমীয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করাই কি বাস্তবচিত নহে? কিন্তু রাজ্যপাল আমাদের জানান নি তাঁর এই পরামর্শ অহমীয় অস্মিতায় স্বীকৃত কিনা। অর্থাৎ আসামের অসমীয়রা তখন পরিবর্তিত মাতৃভাষার নব্য অসমীয় বাঙালিকে স্বজন স্বজাতি বলে বুকে টেনে নেবে তো? কোন প্রশ্নচিহ্ন বা অন্য কোন শর্তাবলী থাকবে না তো সাথে? রাজ্যপালের এই কথায় একটা বিষয় পরিস্কার, আসামের সমস্যা অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে নয়। সমস্যা বাঙালি ও বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিকে নিয়েই। ঠিক যে বিষয়টি তুলে ধরাই ছিল বর্তমান প্রবন্ধের অন্যতম প্রতিবাদ্য। আমাদের কৃতজ্ঞতা তাঁর কাছে।

সত্যিই খুবই প্রণিধানযোগ্য পরামর্শই দিয়েছেন ত্রিপুরার বর্তমান রাজ্যপাল। আমাদেরও খুব জানতে ইচ্ছা করে, তিনি তাঁর আপন রাজ্যে অনুপ্রেবেশকারী অবাঙালিদেরকেও কি এমনই সুপরামর্শ দেবেন কোনদিন? তোমরাও ‘অ আ –শেখে নি সে কথা কওয়া’ পাঠ করে বাংলাভাষী বাঙালি হয়ে যাও এই পশ্চিমবঙ্গে! তাহলেই আজ যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি অবাঙালির জনসংখ্যার অনুপাত নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে তাঁদের মাথাই লজ্জায় কাটা যাবে অচিরে? নাকি অদূর ভবিষ্যতে সেই মাথাগুলিই কাটতে এই রাজ্যের বাঙালিদেরকেও আপন মাতৃভাষা সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে হিন্দী হিন্দু হিন্দুস্তানী হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেবেন তিনি বা তাঁর সোগোত্র স্বজনরাই। আমাদের হয়ত খুব বেশিদিন আর অপেক্ষা করেও থাকতে হবে না উত্তরগুলির সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে। ততদিন ইতিহাস বিস্মৃত আত্মঘাতী গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত জাতীয়তাবোধের শিকড়হীন বাঙালির দিবানিদ্রার সুখে কোন ব্যাঘাত ঘটবে না নিশ্চিত।

শ্রীশুভ্র


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন