“It
is a terrible calamity when human beings come near to one another and yet do
not recognize the deeper bond of human relationship; when a strong people
exploits the weaker and when some baser passion of men awaken at the meeting of
races, obscuring the truth that unites them. This is a shame and should not be
allowed to continue. I have felt deeply the pain of this unnatural situation.”
(Talks In China: The English Writings of Rabindranath Tagore: Edited By Sisir
Kumar Das. P-648)
আজ বাইশে শ্রাবণ। আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী আগের কথা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরের পৃথিবী। চীনে গিয়ে নানান কথার ভিতর এই অতি মূল্যবান কথা
কয়টি বলেছিলেন কবি। কবির তিরোধান দিবসে এই কথা কয়টিই যেন ঘুরেফিরে মনে আসছে
বারবার। একটু ভালো করে খেয়াল করলেই দেখা যাবে এই স্বল্প কয়টি কথার মধ্যে দিয়েই যেন
পরিপূর্ণ মানুষটি মূর্ত হয়ে উঠছেন। অত্যন্ত সুস্পষ্ট করে। কোন ধোঁয়াশা নাই।
বর্তমান সময়ের বুদ্ধিজীবী থেকে রাজনীতির কারবারীদের কথার জালের মতো। নানান
রবীন্দ্রনাথের যে মালাটি নিয়ে আমরা সারা বছর ঘুরে ফিরে বেড়াই নানান উদ্দেশে, তার
আসমুদ্রহিমাচলসম ব্যাপ্তির মধ্যেও এইটি যেন কবিমানসের মূল সুর। জাতি ধর্ম বর্ণ
নির্বিশেষে মনুষ্যত্বের যে উদ্বোধন, সেইখানেই কবির আজীবনের নোঙর। সেখানে আপোষহীন
আমাদের কবিকে কোন জাতপাত ধর্ম ভাষা কিংবা ভৌগলিক কোন সীমারেখাতেই ধরা ছোঁয়া সম্ভব
নয় কারুর পক্ষেই। সকল কালেরও উর্ধে উঠে কবি যেন সকল কালের সকল মানুষের মন মনন
চৈতন্যের বংশীবাদক। আজ বাইশে শ্রাবণে সেই কথাই স্মরণ করার দিন আমাদের।
কিন্তু সত্যই কি আমরা কবিকে স্মরণ করি? নাকি স্মরণ করি
কবির কবিখ্যাতিটুকুকেই? মূল প্রশ্ন এইখানেই। কবি খ্যাতির উর্ধে যে মানুষটি তাঁকে
আমরা ঠিক চিনতে পেরেছি তো? চেয়েছি তো আদৌ চিনতে? নাকি আমাদের যাবতীয় মোহ শুধু ঐ
কবিখ্যাতিকে নিয়েই। যদি তাই সত্য হয়, সত্য হওয়া অমূলকও নয় হয়তো। তবে বলতেই হয় আমরা
আসল ফেলে সুদের হিসাব করে চলেছি মাত্র।
যে উদ্ধৃতিটুকু দিয়ে শুরু করে ছিলাম, করার একটি উদ্দেশ্য
আছে অবশ্যই। আরও একটু ভালো করে খেয়াল করলে দুটি সত্য উঠে আসবে। এক, কবি ঠিক মূল যে
কথাটি বলতে চেয়েছিলেন তাঁর বক্তব্যের এই অংশে, অর্থাৎ মানবিক সংযোগের গভীরতর
আত্মিক সম্পর্কের বিষয়টি; এইটিই কিন্তু আবহমান ভারতীয় সভ্যতারও মূলমন্ত্র! জাতি
ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানবতার এতবড় মন্ত্র ভারতবর্ষেই প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল।
করেছিল হাজার হাজার বছর আগেই। এটি রবীন্দ্রনাথের মুখেই যে প্রথম উচ্চারিত তাও নয়।
কিন্তু কবি তাঁর আজীবন বাঁশরির বিচিত্র সুরবাহারের মূল তালটুকু এই মন্ত্রেই বেঁধে
ফেলেছিলেন অনেক অল্প বয়সেই। সেখানেই তাঁর বৈশিষ্ট। তিনি শুধু তাঁর স্বকীয়
নিজস্বতায় সেই তালটুকু নতুন করে ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন আমাদেরকে।
দ্বিতীয় যে সত্যটি উঠে আসে সেটি হলো, স্বাধীন ভারতের যে
সংবিধান, সেখানেও মূল সংবিধানটিও এই একই মন্ত্রেই দীক্ষিত কিন্তু। ভারতীয় সংবিধান
সম্বন্ধে একটু আধটু ধারণাও যাঁদের আছে, তাঁরা অন্তত সহমত হবেন আশা করি। স্বাধীনতার
পর ভারতীয় সংবিধান রচনা পর্বেই এই মন্ত্রই যেন বীজমন্ত্র ছিল সংবিধান রচয়িতাদের
মধ্যে। ঠিক যে সমন্বয় ও ঐক্যের কথা বলতে চেয়েছিলেন কবি, আমাদের সংবিধান তো তাকেই
স্বীকৃতি দিতে চেয়েছে প্রথম দিন থেকেই। তাই জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ব্রিটিশ
ভারতে বসবাসকারী সকলের জন্যেই স্বাধীন ভারতের সংবিধান আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল।
এইখানেই পাকিস্তানের সাথে পার্থক্য ভারতের। নানা জাতি নান মতের মধ্যেও মানবিক যে
ঐক্যসূত্র ভারতীয় সংবিধান তাকেই মান্যতা দিয়ে রচিত যে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নাই।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, আবহমান ভারতবর্ষের মূল যে বীজমন্ত্র,
সেই বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্য। মানবিক সংযোগের গভীরতর আত্মিক সম্পর্কের সত্যমূল্যে।
যে মূল্যবোধকেই কবি তাঁর ব্যক্তি জীবনেরও কেন্দ্রে রেখেছিলেন গভীরতর সংবেদনশীলতায়
সেই বীজমন্ত্রকেই শিরোধার্য্য করে রচিত হয়েছিল স্বাধীন ভারতের সংবিধান। অথচ আজকের
ভারতীয় রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে দেশ ও সমাজ সেই মূলমন্ত্রকেই যেন পদে পদে অস্বীকারের
চেষ্টা করে চলেছে অবিরত। এবং আরও একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারা যায়, সাম্রাজ্যবাদী
ইউরোপের দেশগুলির কবল থেকে মুক্ত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কালে আফ্রিকার
জাতিসমূহ যেমন পারস্পরিক বিদ্বেষ ও বিভেদকেই মান্যতা দিতে পরস্পর লড়াইয়ে মত্ত
হয়েছিল আজকের ভারতীয় রাজনীতির গতি প্রকৃতির ভবিষ্যৎ অভিমুখও যেন সেই দিকেরই ইঙ্গিতবাহী।
না হঠাৎ করে এরকমটা মনেও হচ্ছে না। হিন্দী হিন্দু হিন্দুস্তানের জিগির ওঠা এই
সময়েই দেখা যাচ্ছে চল্লিশ লক্ষ আসামবাসী বাঙালির ভারতীয় নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার
বন্দোবস্ত এখন প্রায় পাকা। কেবলমাত্র আসামের অসমীয়দের অহমীয় অস্মিতাকে মান্যতা
দিতেই এই বন্দোবস্ত। তখন এর ভবিষ্যৎ অভিঘাত ও অভিমুখ সম্বন্ধে আশঙ্কা জাগাটাই কি
স্বাভাবিক নয়? ইতিমধ্যেই ৯০০ বাঙালিকে ডিভোটার করে তাদের নিজ ভিটে মাটি থেকে
বলপূর্বক উচ্ছেদ করে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক করে রাখা হয়েছে। সহজেই অনুমান করা যায়
এই মুহূর্তে কেমন ভাবে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা। জানা যাচ্ছে আসাম সরকার কেন্দ্রীয়
সরকারের কাছ থেকে ৬৫ কোটি টাকা পেয়েছে শুধু নতুন নতুন ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরীর খরচ
বাবদই। চল্লিশ লক্ষ বাঙালি নাগরিকত্ব হারানোর শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে প্রায়
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর মতো শেষ মুহূর্তের অপেক্ষায়।
জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ বিভেদের এবং বৈরীতা চর্চার
সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের যে রাজনীতি বর্তমান ভারতবর্ষের আসল মুখ হয়ে দেখা দিচ্ছে তা
যে সম্পূর্ণতই ভারতীয় সংবিধান বিরোধী সেকথা প্রায় বিস্মৃত আজ অনেকেই। অনেকেই
রাজনৈতিক অভিসন্ধির ফয়দা লুটতে আসরে নেমে পড়েছেন কোমর বেঁধে। চারিদিকে এক দিশাহারা
কোলাহলে দেশের মূল সমস্যাগুলিই তলিয়ে যাচ্ছে পর্দার আড়ালে। আর বানিয়ে তোলা বাধিয়ে
দেওয়া সমস্যগুলি দিয়েই মানুষকে পণবন্দী করে রাখা হচ্ছে। আড়ালে ক্রমাগত লুঠ হয়ে
যাচ্ছে মানুষের ভালোভাবে সমৃদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকার যাবতীয় সম্ভাবনাগুলোই। এটাই
বর্তমান ভারতের মূল ছবি। সেখানে বাইশে শ্রাবণ যতই প্রাসঙ্গিক হোক না কেন,
ভারতবাসীর তাতে কিছুই এসে যায় না। যায় না বলেই এই বছরেই আসামে পঁচিশে বৈশাখের
ছুটিও বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। কবিকে জনমানস থেকে দূরবর্তী না রাখতে পারলে
রাজনীতিবিদদের সমূহ বিপদ।
ঠিক এই কারণেই আজ বাইশে শ্রাবণ গড্ডালিকা প্রবাহের
বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি সঞ্চয়ের দিনও হয়ে উঠতে পারে। পারে যদি
থাকে সদিচ্ছা।
অসাধারণ সম্পাদকীয় লেখা ।
উত্তরমুছুনআইভি