বিরোধীশক্তিই গণতন্ত্রের একমাত্র রক্ষাকবচ ~ নাসির ওয়াদেন



বিরোধীশক্তিই  গণতন্ত্রের একমাত্র রক্ষাকবচ
নাসির ওয়াদেন

বহু ভাষা, বহুজাতি, বহু ধর্ম সমন্বিত আমাদের দেশ,ভারত। বিভিন্ন ঘটনা যেভাবে আমাদের দেশে সংঘটিত হচ্ছে বা ঘটানো হচ্ছে তাতে দেশের অখণ্ডতা বিপন্ন । সাম্প্রতিক মহামান্য উচ্চতম ন্যায়ালয় যে আদেশ বা নির্দেশ দিয়েছেন তাতে জনগণের মধ্যে ভরসার আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে বলা যেতেই পারে । স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও ভারতকে একটা সংকটের মুখে পড়তে হচ্ছে ,যখন "এক দেশ,এক জাতি "গঠনের কথা উঠছে, তখন দেখছি ভারত ক্রমাগত পিছনে হাঁটছে । এই দীর্ঘ সময় একটা দেশের কাছে কম সময় নয়, তথাপি স্বাধীনোত্তর ভারত যে অগ্রগতির পথে চলার কথা তার লক্ষ্য পথ থেকে অনেকটা পিছনে। ১৯১৭সালে রাশিয়ার পটপরিবর্তন বিশ্বের জনগণের মধ্যে নতুন আশা, উদ্দীপনা লক্ষ করা গেলেও,ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময়ে যাঁরা দেশকে গড়ার মহান দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাঁরা সঠিক দ্বায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। বিশ্ব সমাজতাত্ত্বিক দার্শনিক কার্ল মার্ক্স -এর দৃষ্টিতে ভারতের বিপ্লবের যাবতীয় গুণাবলী থাকা সত্ত্বেও ভারতে গণবিপ্লব সংঘটিত হলো না, অথচ,নানান সমস্যা সংকুল,ছত্রভঙ্গ আফিমগ্রস্ত চীন সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে গেল।ভারতের মতো সমস্যা জর্জরিত দেশ অন্ধকারের কূপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না ।কৃষক, শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে স্বপ্ন দেখেছিল, ভারত আত্মমর্যদাশীল হয়ে দেশকে বিশ্বের উন্নতশীল দেশে উপনীত হবে, সেই স্বপ্নে জল পড়ে যায় ।ভারতীয়দের মধ্যে আর্থিক, শারীরিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক আক্রমণ অব্যাহত থাকে। ইংরেজ দেশের ভার জোতদার, জমিদারের হাতে সঁপে যায়, ফলে ভারতের ভাগ্যাকাশে সিঁদুরে মেঘ থেকেই যায় ।
   
পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে রাশিয়ার পতনের পর বিশ্বের বুকে অখণ্ড সমাজতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে, দেশে দেশে সমাজতন্ত্র নয়,পুঁজিবাদই মূল এই তত্ত্ব দৃঢ়তা পায় ।মানুষের মনে যে, জৌলুস, আশা,ভরসা সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার, শিরদাঁড়া সোজা করার স্বপ্ন জেগেছিল অচিরেই তাতে ধুলোর প্রলেপ পড়ে ।উত্তর আধুনিকতাবাদী দার্শনিক অ্যালবাম সোহেল Social Text   এক আমেরিকান ম্যাগাজিনে ১৯৯৬ সালে মে মাসে "Transgressing the Boundaries', Towards a transformative Hermeneutics of Quantum Gravity" এক প্রবন্ধে সামাজিক ও ভাষাগত বিষয়ে লেখেন ।আদিম সাম্যবাদ,সামন্ততন্ত্র,পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আলাদা আলাদা জবানি থাকতে পারে, কিন্তু ঐতিহাসিক বস্তুবাদের জবানিতে সৃষ্টি সেটা ভ্রান্ত ।তাঁদের দর্শনের মূল কথা বিষয়গত বাস্তবতার " Objective Reality "অস্বীকার।জগতের অস্তিত্ব কেবল একান্তভাবেই বিষয়ীগত ' Subjective' উত্তর আধুনিকতা বিষয়ীগত আপেক্ষিকতাবাদের ' Subjective Relativism ' 'এর তত্ত্বে বিশ্বাসী ।তাঁদের ঘোষণা -মার্কসবাদ অচল,মার্কসবাদ মৃত,পুঁজিবাদই শেষ কথা বলে । সে যাই হোক, যেকথা বলতে পারি যে, ভারত-রাশিয়া সম্পর্কে জওহরলাল নেহরু থেকে জোট নিরপেক্ষনীতি কার্যকর করা হয়েছিল, সেখান থেকে যোজন যোজন দূরে বর্তমান সরকার তথা শাসক যেভাবে জাতিসত্ত্বার নামে জাতিভেদকে উস্কে দিচ্ছে তাতে দেশের অখণ্ডতা বিপন্ন ।জোট সরকারের নীতি অগ্রাহ্য করে একক দলীয়নীতি কার্যকর করার মধ্যদিয়ে বিভাজন নীতি প্রকট হচ্ছে । বর্তমান সরকারের এক অঘোষিত সাম্প্রদায়িকতানীতি যেভাবে জনগণকে পৃথকীকরণে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে সম্প্রীতি রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে । গো-হত্যা  ইস্যু সামনে এনে যেভাবে সংখ্যালঘু নিধনকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, তাতে গণহত্যাসংশয় বৃদ্ধি পাবে ।
   
সম্প্রতি কোরবানী উৎসব উপলক্ষে যে গণনিপীড়ন সংঘটিত হয়েছে, তাতে মানুষের বিশ্বাসে ফাটল বৃদ্ধি পাবে । ঝাড়খণ্ডের ঘটনা সেই ইঙ্গিতই বহন করে, বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্ত এলাকা জুড়ে এক উত্তেজনা পরিলক্ষিত হয । কেন্দ্রীয় সরকারের সহকর্মী রাজ্যসরকারের  পুলিশ ও প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে সংখ্যালঘুর বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট প্রত্যক্ষ হয়েছে, তা বিভাজনেকেই উস্কানি দেবে, প্রশাসনের তরফে এস,পির বক্তব্য আহত করে, তা কতটুকু যথার্থ অনুসন্ধান প্রয়োজন ।
  
অতিসাম্প্রতিক যে ঘটনা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তা মহামান্য উচ্চতম ন্যায়ালয়ের বক্তব্য ঘোষণা । সমাজকে রক্ষা করা, সামাজিক জনগণের, সংখ্যালঘু, দলিত, আদিবাসীদের জীবনরক্ষা,সংস্কৃতি সুরক্ষিত রাখা,স্বাধিকার রক্ষার স্বার্থে যদি কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন,সমাজকর্মীগণ আন্দোলন সংগঠিত করে থাকে, তাহলে তাঁদের গ্রেফতার করা হবে --মহারাষ্ট্র সরকারের পুণে পুলিশের ১লা জানুয়ারির ঘটনাকে উল্লেখ করে কবি -সমাজকর্মী ভারভারা রাও,ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী সুধা ভরদ্বাজ, আইনজীবী অরুণ ফেরেইরা, সমাজকর্মী লেখক ভেরনন  গঞ্জালভেস ও সাংবাদিক গৌতম নাভলাখাকে গ্রেফতারি নিয়ে হায়দরাবাদ,দিল্লি, ফরিদাবাদ, থানে ও গোয়া থেকে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে,তা কাম্য ছিল। মহামান্য উচ্চতর ন্যায়ালয়ের নির্দেশ তাঁদের স্বপ্গৃহে 'গৃহবন্দি' রাখার কথা বলা হয়েছে । বেপরোয়া গ্রেফতারি আজকের সমাজে একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে পশ্চিমবঙ্গে একই ঘটনার নীরব সাক্ষী অনেকেই। দেখা গেল যেভাবে বিরোধীদের মারদাঙ্গা করে মনোনয়নে শুরু থেকে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপ প্রয়োগ করে বাধা প্রদান করা হয়েছে, তা গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ বলা যেতে পারে ।ভোটে দাঁড়ানো থেকে ভোটাধিকার হরণ,স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ বিরল ঘটনা,উচ্চতম বিচারালয়ের রায় কিছুটা আশাহত হলেও তার পেছনে রায়হান যে, বিরোধীদের আশ্বস্ত করেছে তা পরবর্তী প্রতিফলন।। গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে  বামপন্থীদলের আন্দোলন যেভাবে  দুর্বার হওয়া দরকার, তা সেভাবে দানা বাঁধেনি। বিশেষ করে  মোদী সরকারের স্বৈরশাসনে সমাজকর্মীদের  গ্রেফতারের প্রতিবাদে রাজ্যের বামপন্থীদল সহ বুদ্ধিজীবীদের একাংশ র প্রতিবাদ মিছিল জনগণের কাছে প্রত্যাশার ।কারণ,প্রকৃতপক্ষে একমাত্র বামপন্থী দলই পারবে পচনশীল সমাজের অবাঞ্ছিত শোষণ, নিদারুন অনাচার,উৎপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ।বামপন্থীরা মতাদর্শগত নীতির কারণে নীরব থাকতে পারে না, যদি প্রতিবাদ আন্দোলনে সামিল না হয়, তবে ধরে নিতে হবে তাদের মধ্যে নীতিহীনতা কাজ করছে ।তাদের প্রধান লক্ষ্য দেশের অখণ্ডতা রক্ষা, জনগণকে রক্ষা অগ্রাধিকার। জাতিসত্ত্বা,ধর্ম, শ্রেণীর আগে জনগণের জীবন রক্ষা,তবেই দেশ এগিয়ে যেতে পারবে 
   
দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় হচ্ছে গণতন্ত্রের রক্ষাকারী ।  Democracy is of the people, by the people, for the people হলেও বাস্তবে জনগণের কোন ভূমিকা থাকছে না ।ফলে জনগণ মনে করে যে, সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে তার কোন ভূমিকা নেই । আবার যারা বেশি বেশি ক্ষমতা ভোগ করছে, তারা মনে করছে তারাই সব ক্ষমতার অধিকারী। তাই সামাজিক জীবনে বৈষম্য থাকার জন্য কেউ কেউ অপ্রয়োজনীয় কাজ করে ফেলে এবং তার ফলাফল হিসেবে সামাজিক দ্বন্দ্ব বিকশিত হয় । এক শ্রেণীর মানুষ সামাজিক বিভাজনের দ্বারা যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, আজ মানুষ তার মাসুল দিচ্ছে । সৃষ্টির সময়কালে জাতি, ধর্ম, বিশ্বাস অবিশ্বাস সৃষ্টির বহুপূর্বে সাম্যবাদী সমাজ বিদ্যমান ছিল । শোষণ, বঞ্চনা, পুঁজি ,সঞ্চয় ইত্যাদি থেকে লোভ লালসা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা জন্ম হয় । আজকে একশ্রেণীর মানুষ সর্বক্ষমতা ভোগের মানসে অকাজ,কুকাজ করতেও দ্বিধাবোধ করছে না । তাই বঞ্চিত মানুষের কাছে অস্ত্র হিসেবে বিচ্ছিন্নতাবাদ উঁকি দিচ্ছি, যা একমাত্র পথও নয়, কাম্য তো নয়ই। দলিত,আদিবাসী, সংখ্যালঘু, উচ্চ নীচু  ,অভিজাত আতরাফ শ্রেণি বিভাজনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে । এব্যাপারে ভোটনীতি মুখ্য হয়ে পড়েছে । ক্ষমতাসীন থাকার বাসনা থেকে এধরনের অভিব্যক্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে । গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে রাজনীতির রসে ধর্মীয় আড়ক মিশিয়ে দেওয়া থেকে দূরে না থাকলে কোন দেশ যেমন এগিয়ে যেতে পারে না, তেমনি দেশের হিত সাধনও অসম্ভব হবে নিঃসন্দেহে। গণতন্ত্র শক্তিশালী না হলে দেশ স্বাধীন ও স্বনির্ভর হতে পারে না । তাই গণতন্ত্র পবিত্র বস্তু । তাই বিরোধী শক্তি যতবেশি শক্তিশালী হবে, গণতন্ত্র ততবেশি সুরক্ষিত থাকবে ।
              
জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহনের অন্যতম শর্ত হোক, ভারতের অখণ্ডতা রক্ষা । মিলেমিশে একাকার  হবে সহস্রটি প্রাণ  । পবিত্র হবে ভারতের মহামূল্য বাণী, ভারত থাকবে ভারতেই।

নাসির ওয়াদেন


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন