তরঙ্গের আয়না ~ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়




তরঙ্গের আয়না
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


কোনদিকে যাব? সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে সুবিমল   দেখে চারদিকে  চারটে রাস্তা চলে গেছে অনেক হিসেব নিকেশ করে ভেবেচিন্তেও অনাবশ্যক এক অন্ধতার মধ্যেই তলিয়ে যায় সে মাথার ভেতর অনিবার্য বিশৃঙ্খলা আসলে নিজের  ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলোও স্পষ্টত অনুমান করতে পারছে না সে আজ তার কোন কাজ নেই একা চুপচাপ ছুটির বিকাল বার্ষিক  পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর  এক স্তব্ধতা অভ্যস্ত প্রাত্যহিকতার চিরচেনা  ছবিটা আজ নেই ব্যস্ততা নেই, কেউ আসার নেই বাড়িতে  কেউ ডাকার নেই তার অপেক্ষায় বসে নেই কেউ কোথাও ইলেকট্রিক তারে আটকে যাওয়া ঘুড়ির মত থমকে আছে  তার অফুরন্ত  সময়
                   দীনুর  দোকানে এক কাপ চা আর তিন টাকার তেলেভাজা   খাওয়ার পর  একটা বিড়ি ধরানোর ইচ্ছে  হয়েছিল সুবিমলের তখনই  নিতাই নস্করের সাথে দেখা  টেবিলের বিপরীত দিকে বসে পেপার পড়ছে, পেপাররের আড়ালটা সরে যেতেই  দুচারটে কথা বেরিয়ে এল  -  আরে সুবিমল, কি খবর? আজকাল এত পালিয়ে পালিয়ে বেড়াও, তোমার তো টিকিই দেখা যায় না শেষের কথাগুলো কাঁটার মত বিঁধলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে সুবিমল বলল
-চলে যাচ্ছে তোমার খবর কি?  
-এই একরকম  খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে  নিতাই তার দিকে তাকিয়ে  বলল-    আরে বসো, তোমার সাথে পেরাইভেট কিছু কথা আছে সুবিমল দেখল  নিতাই,  গোবিন্দ, সনাতন আর ফটিক এরা চারজন তাকে ঘিরে রয়েছে কোমরে হাত দিয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কার সাথে যেন ঝগড়া করছে সনাতন এদের প্রাইভেট কথা মানে আরও একরাশ অন্ধকার আরও তলিয়ে যাওয়া  অসহ্য লাগলেও দোকান ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারছিল না সুবিমল চারজন  কেউই তার বন্ধু নয়, এক এক সময় এরা তাকে ঠকিয়েছে  সৌজন্যতার কোন প্রশ্ন নেই দীনুর দোকান সংলগ্ন বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে সুবিমল নোনা ধরা খয়াটে ইটের গাঁথুনি পচা গলা বেওয়ারিশ পুরানো লাশের মত  নিজের বাড়িটার কথা মনে পড়ে চাপ চাপ অন্ধকারে কেমন ভৌতিক লাগে ঘরদোর মাংস খুবলে নেওয়া লাশের মত কোথাও কোথাও  খাবলা খাবলা  প্লাস্টার  ছড়ে গেছে
-একটা পিওনের চাকরি আছে, তিন লাখ লাগবে
সুবিমল একসময় স্বপ্ন দেখত, এখন আর এসবে পাত্তা দেয়না আমার দরকার নেইঅন্য কাউকে বল
-তুমি থাকতে অন্য কাউকে কেন? 
সুবিমল জানে আবার একটা ফাঁদ পাতছে নিতাই সে চোখমুখের কাঠিন্য শিথিল না করেই হাসে বললাম তো  দরকার নেই  
 নিতাই এর কথাগুলো নিয়ে  কোন তরঙ্গ তৈরি হচ্ছিলনা মনে বস্তুত কিছুই  ভাব ছিলনা সুবিমল মনের ভেতর কালো কালো ধোঁয়া উঠছিল বিপন্নতার চোঁয়া ঢেকুর রাস্তায় কয়েকটা বাচ্চা হেঁটে গেল হিপ হিপ হুররেজেতার উল্লাসসবাই জিততে চায় অথচ তার ভেতরে কেবল ব্যর্থতার হাহাকার  
       কষা মাংসের  গন্ধে চনমনিয়ে উঠে  খিদে সম্বিত ফিরে আসে  সুবিমলের চায়ের দোকান সন্ধ্যের পর হোটেল হয়ে ওঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে  দেখে সাড়ে পাঁচ টা ডিসেম্বরের সন্ধ্যে নেমেছে বাতাসে  গন্ধ ওড়ে  আহা কতদিন মাংস খাওয়া হয়নি তার দারুন সুঘ্রান ভাসছে শীতের হাওয়ায় কারা যেন  সুন্দর করে   মাংস রাঁধছে আজ  এই আমিষ গন্ধ অতিক্রম করে  আরেকটা গন্ধ আসছে নাকে  কড়াই ডালে  জম্পেশ  সম্বার দিয়েছে কেউ  কতদিন  কড়াই শুটি কেনা হয়নি তার, একশ টাকা কিলো এখন আচ্ছে দিন আর আসবেনা,  হাতে কাজ নেই  লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রতিটি জিনিষের দরদাম উজ্জ্বল ভবিষ্যতের  ইশারা ধুয়ে মুছে যাচ্ছে    স্নায়ুর ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে খিদে রোজকার ডাল ভাত  চচ্চড়ির বলয় থেকে একটু মুক্তি, একটু নিরমলতা এটুকুই তার চাহিদা  সুবিমল ভাবে আর বসে থাকা ঠিক নয়, সন্ধ্যে নেমে আসছে যদিও এই  চায়ের দোকানে সে নিয়মিত আসেনা সে জানে সন্ধ্যে নামলে এখানে মদ আর জুয়ার আসর চলবে এলেও কোন বিতর্কে জড়ায় না সে   চুপচাপ চা খেয়ে উঠে যায়
-আসি, নিতাই  
-আরে বসো, বসো  
-জরুরি কাজ আছে  
-কি এমন রাজকাজ শুনি, একদিন না গেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে?
ওদের পাল্লায় পড়েই বিজনেসে টাকা ঢেলেছিল সুবিমল  সে তো কবেই ভরা নদীর জলে ভেসে গেছে
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সে ওরা চারজন ক্রিকেট বলের মত তাকে নিয়ে লোফালুফি করে  খানিকক্ষণ সরু এবং লোভী চোখে তাকায়, যেন  কোন ইউরেনাসের মানুষ দেখছে অথবা  ভাবছে অনেকদিন পর ফিরে এসেছে মুর্গিটা তবু সে কিছু বলতে পারেনা, অপমানের বদলা নিতে পারেনা, প্রতারণারও চুপচাপ বেরিয়ে আসে এড়িয়ে যায়, এই পালিয়ে আসা কি পরাজয়? সুবিমল বুঝতে পারেনা, সে সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে ভাবে -  কোন দিকে যাব?



-, আপনি?
বেল বাজানোর অনেকক্ষণ পর দরজা খোলে বীথিকা ঘরের ভেতর নীলাভ আলো জ্বলছে আর হালকা মৃদু একটা গান ভেসে আসছে গানের কথাগুলো অস্পষ্ট  ধরা দেয়না শ্রবনেন্দ্রিয়ে
-শুভম বাড়ি আছে? 
-না,  ওর ফিরতে রাত হবে,  অফিসে একটা পার্টি আছে 
কষা মাংসের গন্ধটা বাতাসে ভেসে উঠল আবার এর নাম আনন্দ এর নাম জীবন   , আচ্ছা  একবুক কষ্ট নিয়ে  রাস্তার দিকে ফিরে দাঁড়াল সুবিমল
-কিছু বলার ছিল?
-না, না, এমনিই একটু গল্প করতাম
-তাহলে রোববারে আসুন, বা টোয়েন্টি ফিফথ ডিসেম্বর
- দেখি যদি সময় পাই সাইকেলে চাপতে না চাপতেই সুবিমল দরজা বন্ধ করার শব্দ পেল আর বাইরের আলোটাও নিভে গেল এক নিমেষে শব্দটা ঠিক অভ্যস্ত ছন্দের নয়, একটু অন্যরকম তেমন ঠাণ্ডা না পড়লেও মনের ভেতরটা কনকন করে ওঠে তার কেবল শীত শীত অনুভূতি আসে 
বন্ধুরা সবাই  সুখী সংসারী ব্যস্ততায় আগাপাস্তালা মোড়া সুন্দর কর্মসুচীতে সাজানো এক একটি দিন কত রঙিন উষ্ণতা মুখর অথচ  নিরাবরন নিরাভরন তার দিনলিপি এখনও অবধি সে যা রোজগার করে তা দিয়ে কোন রকমে একবেলা চলে গতবছর পর্যন্ত বেঁচে ছিল তার  মা মায়ের বেঁচে থাকার কষ্ট দেখতে দেখতে সে  ভাবত  মৃত্যুই হয়তো এর অনিবার্য মুক্তি শেষের দিকে  মাথাটা  কাজ করত না মায়ের, নিজের ছেলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত কিন্তু  চিনতে পারতনা মা, আমি সুবু বলে ঝাকুনি দিলেও কোন প্রতিক্রিয়া টের পাওয়া যেতনা এক  নির্জন অন্ধকারে  মশারীর বাইরে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ  নিঃশ্বাস পতনের শব্দ পেত, বাথারুমে নিয়ে গেলেও কোলে করে নিয়ে যেতে হত এর নাম বার্ধক্য মায়ের পিঠে কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিজের অপদার্থতার কথা ভাবত সে কোন কাজেরই যোগ্য হয়ে ওঠেনি অকম্মা, অকালকুষ্মাণ্ড এবং নিমুরোদে নিজের স্বল্প রোজগার আর  মায়ের পেনশনের কিছু টাকা,  তা দিয়ে দুজনের সংসার চলে যেত  কুলিয়ে গুছিয়ে ডাক্তার আর ওষুধে যৎসামান্য কিছু খাটের মধ্যে সারাদিন শুয়ে থাকত  মা, নিতান্ত অবহালা আর দায়সারা কর্তব্যে সুবিমল কোনরকমে বার দুয়েক  বাথরুমে নিয়ে যেত, খাইয়ে দিত  খাবার ও ওষুধ জীবনে অনেককিছুই করবার চেষ্টা করেছিল সে ছোটখাটো ব্যবসা, কোম্পানির এজেন্সী থেকে চালকলের লেবার   কিছুই  তার  হয়নি একবছরের মাথাতেই  বসে যায় ব্যবসা পুঁজি সটকে যায় চারদিকে সবাইকে ধার দিয়ে সে তখন প্রায় ফতুর সরল বিশ্বাস  নিয়ে এসব হয়না  এখানে নিজেকে ফুলিয়ে দেখার মিথ্যে ফানুশ আছে চতুর বিজ্ঞাপনের জৌলুস আর প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ এসব যোগ্যতায় সে অচল আবেগপ্রবন মানুষ  কারবারে  মানায় না  সুবিমলের চাহিদা বিশেষ নয়, দুবেলা খাবার, আর অল্পস্বল্প খরচ করার উদারতা এটুকু পেলেই সে রাজা অথচ সকাল বিকাল দুবেলা জনা দশেক ছাত্র পড়িয়েও সে যা পায় তাতে  কোন বিলাসিতাই মানায় না  পরীক্ষার পর মাস দুয়েক তাও থাকেনা, তখন  সে জেনুইন বেকার  কোন রকমে দিন গুজরান মা মারা যাওয়ার পর খা খা করে বাড়িটা একটা কুকুর কেঁদে উঠলেও ছমছম করে সারা শরীর নিটোল অন্ধকারে চোখ রেখে ধংসস্তুপের মত বিধ্বস্ত বাড়িটাকে দেখে বাইরে সিঁড়িগুলো এমন ভাবে ভেঙে গেছে  যে উপরে ওঠা যায়না কৌতূহল প্রবন  রাতচোরা পাখিরা আবিস্কারের আনন্দে বিমর্ষ বাড়ির চারপাশে ঘোরাফেরা করে ভারি  সোনাঝুরি কাঠের রংচটা দরজাটা বন্ধই থাকে তালা বন্ধ  সুবিমল ভুলেও তা খোলে না সেখানে  বাদুড় আর ইঁদুরের উৎপাত আরশোলাদের অবাধ পর্যটন
       আজ শুভমের বাড়ি না গেলেই ভালো হত মন ভরে আছে বিস্বাদে আলোটাও নিভিয়ে দিল না হয় একটু বিজলি বেশি পুড়ত কত হিসেবী হয়ে যাচ্ছে সবাই  মানুষ বোধহয় বন্ধুত্বের থেকেও তার সামাজিক অবস্থানকেই বেশি ভালোবাসে এই যে মানুষগুলো যারা মুখে সুখি পরিবারের বিজ্ঞাপন সেঁটে রাস্তায় ঘোরে, হেসে হেসে কথা বলে, চারপাশে ছড়িয়ে রাখে ঐশ্বর্য এরাও ভেতরে ভেতরে কোথাও একা  আসলে  বন্ধুর কাছেও ব্যথা বেদনা আড়াল করে হেসে উঠতে জানাটাই এখন আর্ট    
মানুষ এরকমই বাইরে একটা সুদৃশ্য চৌকাঠ তাতে বর্ণময় পালিশ দিয়ে আড়াল করে রাখে মনের  ময়লা আসবাব এগুলো দেখা যায়না বাইরে থেকে আলো আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকে  এক চিলতে নিস্প্রান হাসি
-         

কোনদিকে যাব সুবিমল এলোমেলো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে  বিপন্ন আকাশ দেখে অন্ধকার  আজ চাঁদ ওঠেনি রাস্তায় আলো নেই, বোধ হয় লোডশেডিং এই অনুচিন্তার ভেতরই ঝপ করে   স্ট্রীটলাইটের তির্যক আলোটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পাওয়ার এল সাইকেলে চাপতে গিয়ে তার মনে হল   কি হবে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেই একটা  ছবির কথা মনে পড়ল তার একজন বেরোজগার  মানুষ একসময়  প্রচুর বন্ধু ছিল তারবিপদে পড়লে মানুষ তাকে ডাকত কারো রক্তের দরকার, কারো দরকার একজন লোক যে রোগীর পাশে রাত জাগবে  ছবিটা বদলে গেল ধীরে ধীরে রোজ একটার পর একটা বন্ধু তাকে ছেড়ে চলে যেতে শুরু করল তাদের ধারণা এই বুঝি সে ধার চেয়ে বসবে, বা  কোন সাহায্য চাইবে   এক শূন্য চেয়ারে বসে    মানুষটা   ভাবতে থাকে ... এরা কি কেউ বন্ধু ছিল কখনও, কোনদিন?
- আরে তুই সুবু না?
-কেউ কি ডাকল তাকে? কে? সামনের   একটা স্করপিও এসে থামল এক ভদ্রমহিলা  নেমে এলেন চেনা চেনা মুখ, কিন্তু দীর্ঘ অদর্শনে একটা সর পড়ে গেছে  - মালা, তুই? বিশ্বাস কর তোকে চিনতে পারিনি খুব  রোগা হয়ে গেছিস
রত্নমালা তাকায় তার দিকে  - সে অনেককথা,  তোকে বলব  একদিন আজ আমার বাড়ি চল এই তো অল্প একটু পথ, গল্প করতে করতে চলে যাব ড্রাইভারকে ডেকে নির্দেশ দেয় তুমি গাড়ি নিয়ে চলে যাও শম্ভু, আমরা হেঁটে যাচ্ছি 
-না রে, আজ নয়, সামনের রোববার
-না আজই তোর কোন কথাই শুনবো না কতদিন পর দেখা   রত্নমালার  চোখে সত্যিই  নক্ষত্রের দীপ্তি  অনুভব করে সুবিমল   জীবন গিয়েছে চলে  কুড়ি কুড়ি  বছরের পার তারপর এই  জেলা শহরে আজ এক অদ্ভুত বিপন্ন  সময়ে   তার সাথে দেখা  শূন্য রাস্তায়  দাঁড়িয়েও কি আশ্চর্য  রজতাভ আলো  তুই একই রকম থেকে গেছিস মালা  রত্নমালা অন্যমনস্ক ভাবে হাসে চল্লিশ পেরুচ্ছি সুবু, মেঘে মেঘে বেলা কম হল না বয়স অনেককিছু দেয়, কেড়েও নেয় কত  অভিজ্ঞতা  নিয়ে জীবন চলতে থাকে   কত যন্ত্রনা, সুখ অসুখ  বয়সই লুকিয়ে রাখে কোন এক গোপন অলিন্দে 
সুবিমলের চোখ অনির্দিষ্ট সে মনের গতিপথ ধরে  ভাবতে চেষ্টা করে আত্মসমাহিত অথচ উজ্জ্বলতায় ভরপুর একটি মুখ এবং তার রেখাঙ্কিত মানচিত্র  অনিমেষ তাকিয়ে থাকে,  তাকিয়েই থাকে একেকটি রেখার নীচে অনেক কথা   জমে আছে, অস্পষ্ট, ছায়া ছায়া, ঠিক কবিতার মত সবাই বুঝতে পারেনা কেউ কেউ পারে 
                    অসম্ভব  যত্ন করে  ঘর সাজিয়েছে মালা অপূর্ব সুন্দর  বাড়িটা সদ্য কিনেছে সে, এখানে বদলি হয়ে আসার পর  পাঁচ বছর গ্রামের দিকে  কলেজে পড়ানোর   পর এখন  এই জেলা শহরে ইন্টেরিয়র  ডেকোরেশনে সুরুচির ছাপ   জানলার  দিকে তাকিয়ে  সুবিমল দেখে  সুদৃশ্য  কাঁচে  পলকাটা নকশা স্টেইনড   গ্লাসের ভেতর  চুইয়ে আসে অলৌকিক আলো  এই কেতাদুরস্ত জীবনপ্রনালীর মধ্যে  কোথাও  বাউন্ডুলে জীবনকে অনায়াসে  বেছে নিয়েছে সে এতে তার কোন অস্বস্তি নেই মাসীমা  বলল  মাঝে মাঝে এসো সুবিমল, যাওয়া আসা না থাকলে মানুষ তো একাই, বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত আমাকে তোমার মায়ের মতই মনে করো চোখে জল এসে গিয়েছিল  তুইও অনেক রোগা হয়ে গেছিস সুবু,  শরীরের যত্ন নিস,  রত্নমালা একসময় বলে,  চা নয়  তোকে  একগ্লাস হরলিক্স বানিয়ে দিই আজ শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছিস  কেন? আমি কি  তোর গেস্ট না বন্ধু ?
-   বন্ধু বলেই তো
  গ্লাসে আন্তরিকতার সংজ্ঞাতীত স্পর্শ অনুভব করল  সে এত  ভালোবাসা পৃথিবীতে আছে কী সুন্দর এই দুনিয়া
                ভালোবেসে বিয়ে করলেও  তিন বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি  দাম্পত্য সম্পর্ক এই তিন বছরও খুব ছন্দময় নয়, একটা টিউমার সবকিছু তছনছ করে দেয় রত্নমালারডাক্তার বলল ক্যানসার  বাদ দিতেই  হবে  শুধু জরায়ু  নয়,  জীবন থেকে বাদ চলে গেল  দাম্পত্যসুখক্যানসারের হাত থেকে শরীরটাকে বাঁচালেও সম্পর্কের গভীরে ছড়িয়ে যাওয়া  ঘা আর শুকোয় নি। ব্যক্তিগত শূন্যতা ভালোবাসা দিয়ে ভর্তি করতে গিয়ে  সে দেখেছে এক কৃষ্ণগহ্বর অন্ধকার কীভাবে গিলে নেয় বাঁচার সুখ   দিনের পর দিন অপমান আর জ্বালা  একদিকে জীবন একদিকে মৃত্যুসম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার শূন্যতা অন্যদিকে এই ত্রিভুজের মাঝে দাঁড়িয়ে কি থাকে। লড়াই। একাকীত্ব আর জেদ। গল্পটা বলে যায় রত্নমালাকোন আড়াল নেই, কোন অস্পষ্টতা নেই,  কোন চৌকাঠ নেই ভেতরের হাহাকার অবধি দেখতে পায় সুবিমলনিজেকে মেলে দেয় সেও, নিজের রক্তপাত, শূন্যতা এবং ব্যর্থতার সমস্ত গল্প, সংকোচ ছাড়াই সে উগরে দেয়  কত সহজে
-তুই খেয়ে নে, অনেক রাত করে দিলাম গরম মাংসের ঝোল থেকে ধোঁয়া উঠছে তখনও সম্বার দেওয়া সুস্বাদু কড়াই ডাল আর লুচি স্বপ্নের বৃত্তটা কি বাস্তবকেও ছুয়ে ফেলে মাঝে মাঝে কিকরে সম্ভব হয় তা মনের কথাগুলো ইথারে ভাসতে ভাসতে কোথাও গিয়ে ধাক্কা মারে নিশ্চয়ই দূর কোন নীহারিকায়
- আমার একটা উপকার করে দিবি সুবিমল?
 - সংকোচ কেন, বল কি করতে হবে?
-একটা বাড়ি জোগাড় করে দিবি, পুরানো বাড়ি হলেও চলবে
- পুরানো বাড়ি?  মাংসের ঝোলে চুমুক দিতে দিতে  থমকে যায় সুবিমল সে বুঝতে পারেনা কিছুই 
- তরঙ্গের আয়না দুঃস্থ অনাথ শিশুদের জন্য যে স্কুলটা শুরু করেছি  তার একটা স্থায়ী ঠিকানা চাই চিন্তা নেই নায্য ভাড়া দেব আর চাই একজন সত্যিকারের শিক্ষক
-ঠিক আছে মালা, সন্ধান পেলে আমি অবশ্যই জানাবো
 তরঙ্গের আয়না নামটা অন্যরকম প্রতিটি  শিশুর মধ্যে  রয়েছে অনন্ত শক্তির এক অপরিসীম তরঙ্গ ওরা  জানেনা, ওরা  কিছুই জানেনা ওদের চোখের সামনে  আয়নাটা তুলে ধরতে হবে দেখতে পাবে নিজেকে আর আবিস্কার  করবে আগামীদিনের এক সমুজ্জ্বল সম্ভাবনা এই সাহসটুকুই তো খুব জরুরী নিজেকে খুঁজে পাওয়ার উৎসভূমি  
                    বাইরে বেরিয়ে এসে সুবিমল দেখে  এই অমাবস্যাতেও আকাশে  আলো  উজ্জ্বল আলোয় অনেকদূর ভেসে যায় তার দৃষ্টি পথ ভুল হয়না  আর কোন চৌরাস্তা নেই  নিজের বাড়ির সামনে এসে সে  দেখতে পায়  সারা বাড়িটা হাসছে  স্বপ্নের মধ্যে দেয়ালা করছে আলোর শিশুরা প্লাস্টার খসে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন গুলো কখন বাচ্চাদের অপটু ছবিতে ভরে উঠেছে কত রঙ, কত ছবি শিশু আর স্বপ্নের চেয়ে শক্তিশালী কিছু নেই পৃথিবীতে এরাই বদলে দিতে পারে  আমূল ভূখণ্ড  মালাকে কালই বলতে হবে আমার বাড়িটা একবার দেখে যেতে পারিস, যদি পছন্দ হয়


বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

২টি মন্তব্য: