ঘুমাও ক্লডিয়াস ~ মহুয়া মল্লিক



ঘুমাও ক্লডিয়াস
মহুয়া মল্লিক

 (এক)

 হাম্বালো ম্যাঘা রানী
তোর পোলাডা কতখানি
হাত চারি লম্বা, গলায় একটা কম্ফা
কম্ফা লইয়া হাটে যায়
ধাপুড় ধুপুড় আছাড় খায়
চিনা খ্যাতে চিন চিনানি
ধান খ্যাতে হাঁটু পানি
হাম্বালো ম্যাঘা রানী

মেয়েটি পায়ে নূপুর নেই, আলতায় রাঙানো টুকটুকে পা ও নেই,
আকাশে ছেয়ে যাওয়া পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ দেখে মেয়েটি্র ছোটবেলার মত রাঙা পায়ে ঝোপ ঝাড় ভেঙে একছুট্টে নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুর করে ছড়া বলাও নেই এই কংক্রিটের জঙ্গলে সবুজ নেই, নদী নেই, সতেজতা নেই তবু মেয়েটি মেঘ দেখলে পাগল হয়ে যায়, যেমন আজ মেঘ দেখতেই দুড়দাড় করে প্যারাপিটহীন ছাদের দিকে দৌড়ে গেল ভাগ্যিস সন্ধ্যের আবছা আলোয় কেউ তাকে দেখল না, দেখলেই ফিসফিস জলো বাতাসের, ‘কী অলক্ষ্মী বৌ রে বাবানা কেউ দেখেনি দুহাত দুপাশে পাখির মত বিছিয়ে দিল মেয়েটি আর তখনই পুষ্প বৃষ্টির মত সাদা যুঁই ফুলের মত বৃষ্টিকণারা তার মুখে চোখে ঝাপটা দিয়ে এসে পড়ল মেয়েটি গুনগুন করে উঠলো, “হাম্বালো ম্যাঘা রানীইইইইইই’......বারবার আওড়াতে থাকল শৈশবের প্রিয় ছড়াটি আশ আর মেটেনা একসময় ক্লান্ত হয়ে ছাদের মধ্যেই শুয়ে পড়ল জল থৈ থৈ ছাদ আর মেয়েটি একাত্ম হয়ে গেল। আহ কী শান্তি যেন নদী মাতৃকার নরম কোলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে সে
একসময় হুঁশ ফেরে, নদীর গন্ধ মুছে নিচে নামতে হবে তাকে। নাহ এমন কিছু রাজকার্য তার পড়ে নেই, সে রান্নাঘরে না ঢুকলেও রান্না হয়ে যায়, ঘরকন্না না দেখলেও সবকিছু নিপাট, ঝকঝকে এই যে পড়শি বাড়ির ধূপ, সাঁঝবাতির গন্ধ মাখা বাতাস জানান দিচ্ছে, সন্ধ্যে নেমে গেছে তার কোনো তাড়া নেই শাঁখে ফু দেবার, বলা ভালো অধিকার নেই, এ বাড়ির কোনো কিছুতেই তার অধিকার নেই যেন সে কুটনো কুটলে, হাতে কালচে ছোপ লাগবে, যেন সে রান্নাঘরের আঁচে রঙ পোড়ালে এ বাড়ির অপমান আত্মীয় স্বজনের কাছে মাথা হেঁট হয়ে যাবে ছিঃ দত্ত বাড়ির বৌ কে বুঝি এভাবে খাটিয়ে মারে ! দাসীবাঁদীর কাজ সে করবে কেন? সে না রাজরানী ! পায়ের উপর পা তুলে বসে সে কাটিয়ে দেবে অনায়াসেই পাড়ার মেয়ে বৌদের কাছে সে যত ঈর্ষা র পাত্রী ততই না দত্ত বাড়ির গৌরব

মেয়েটি নেমে আসে, ভিজে শাড়ি পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে, তবু সে দ্রুত নামে,প্রায় এক ছুটে অনেকটা নেমে যাবার পর, মরাল গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকালো, আর চোখে পড়ল সিঁড়ির কোণার ঘর যেটা সব সময় বন্ধ থাকে সেখান থেকে সরু একটা আলোর রেখা অন্ধকার বারান্দায় এসে পড়েছে, মেয়েটি মন্ত্রমুগ্ধের মত আলোক রেখাটিকে কিছুক্ষণ দেখল তারপর এক ছুট্টে বন্ধ দরজার সামনে ভিতরে কেউ আছে কিনা জানেনা, তবে সেই বড় তালাটা লাগানো নেই, হাতের হাল্কা চাপে দরজাটা হাট হয়ে খুলে গেল মেয়েটি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখে ভিতরে টুক করে ঢুকে গেল
ঘরে আসবাব পত্র বলতে কাঠের একটা টেবিল, চেয়ার, আর একটা কাঠের র‍্যাক সেই র‍্যাকে নানান সাইজের নানান আকৃতির শিশি বোতল সাজানো প্রত্যেকটাতেই নাম্বারিং করা ১, ২, ৩, ৪, ৫ ...মেয়েটি এক একটা নাম্বার ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় এক সময় টেবিলের ড্রয়ারে তার হাত পৌঁছে যায়, চাবি সঙ্গেই লাগানো, ঘোরাতেই খুলে গেল পুরনো একটা ডায়েরি, মেয়েটি পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছে, শিশির গায়ের লেবেলিং এর রহস্য ভেদ হয়ে আসছে, শুধুই কী লেবেলিং এর রহস্য ! মেয়েটি একটু একটু করে এক বিষাক্ত রাজ্যপাটে জড়িয়ে গেছে স্পষ্ট টের পাচ্ছে

      (দুই)

মেয়েটা কই? এই এক জ্বালা আমার কোথায় যে যায়, দুপুরে দুচোখের পাতা ভাতঘুমে জুড়ে এসেছে কী আসেনি, মেয়ে চড়ুই পাখির মত ফুড়ুৎ এত উড়ু উড়ু মন কেন তোমার কলেজ পাস বৌ এর? কোথায় পাশ দেওয়া মেয়ে  চশমা এঁটে মোটা মোটা বই পড়বে, না হয় দুধের সর হলুদ বাঁটার রূপটানে নিজেকে মুড়ে রাখবে! তা নয়, বাগান, ছাত, সিঁড়ির অন্ধকার কোণ, কখন যে কোথায় থাকে হাঁটে তো না যেন উড়ে বেড়ায় নিঃশব্দে আসা যাওয়া কিছুই টের পাওয়া যায়না
ছাড়ো, ছাড়ো, কখন না আবার দেখে ফেলে, বরং রাত্রে ঘুমিয়ে গেলে ...
উমমমম, নাহ আরেকটু, আরেকটু প্লিজ বেলা পিসি আরেকটু তোমার কোলে মুখ ডুবিয়ে শুতে দাও
রোজ এক জিনিস বেলা পিসি এ বাড়ির হোল টাইমার প্রভাব প্রতিপত্তি, বিশ্বস্ততায় তার সমতুল্য আরেকটি খুঁজে বার করা মুশকিল এ বাড়ির বৌ হয়ে আসা অবধি মেয়েটি পদে পদে সেটি টের পাচ্ছে একাই দশজনের মত খাটতে পারে বাড়ির কাজ, রান্না, পোষ্ট অফিসের এম আই এস, বাজার- দোকান সবেতেই এই একটা মানুষ খেটে যাচ্ছে
যখন বৌ হয়ে আসে, শাশুড়ি মা বিছানার সঙ্গে মিশে আছেন, সেই রোগীর সেবা দক্ষ নার্সের মত বেলা পিসি একা সামলেছে নতুন বৌ কী করা উচিৎ ভেবে না পেয়ে হয়ত বেড প্যান এগিয়ে দিতে গেছে, ছোঁ মেরে হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়েছে কিন্তু অদ্ভূত ব্যাপার এত কিছুতেও কিন্তু শাশুড়ি মায়ের মুখে বিরক্তির রেখাগুলো মিলিয়ে যায়নি বেলা পিসিকে দেখলেই বিরক্ত হতেন, ঘরে থাকলে দেওয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুতেন ও বুঝত না ভদ্র মহিলা কেন এত বিরক্ত হন? বেলা পিসির তো এই সংসারে অবদান কিছু কম নয়
“বৌমা তুমি এখানে কতক্ষণ?
হাত খোঁপা করতে করতে বেরিয়ে এল বেলা পিসি। সে তখন বারান্দার এক কোণে বৃষ্টিস্নাত মাধবী লতার গাছটার গায়ে পরম মমতায় হাত বোলাচ্ছিল ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে বেলা পিসিকে দেখল সে এখনো এক ঢাল কালো কুচকুচে চুল শরীরের বাঁক ঈর্ষনীয় কত বয়স হবে পঞ্চাশ বাহান্ন? ও তাকিয়ে দেখতেই থাকে বেলা পিসির অবিন্যস্ত বেশবাশের দিকে, দেখতেই থাকে
বেলা পিসি যেন এই অদ্ভূত দৃষ্টির সামনে একটু কুঁকড়ে যায় কোনও ক্রমে বলে, “বৌমা তুমি ঘরে যাও সন্ধ্যেটা দিয়েই তোমার আর খোকার চা দিয়ে আসছি চায়ের সঙ্গে কি খাবে? আম তেল দিয়ে একটু মুড়ি মাখা দিই নাকি বাদাম পাঁপড় ভাজা?”
ও কিছু বলে না ওদের কথার মাঝেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে এ বাড়ির খোকা শার্টের বোতাম আঁটতে আঁটতে  ওদের দুজনকে এক ঝলক দেখেই সিঁড়ির দিকে হাঁটা লাগায় স্বগোক্তি করে, “ এই যা উপরের ঘরের দরজাটা খোলা’।
বেলা পিসি একটু বুঝি কেঁপে গেল? নাকি সান্ধ্য বাতাস কিছুটা বিভ্রম ঘটিয়ে ছড়িয়ে মায়ালোকে উড়ে গেল? মেয়েটা বুঝতে পারেনা
সাঁঝ বাতির নিভে যাওয়া সলতের গন্ধ ছাপিয়ে উঠে আসছে বিষ বাষ্পের তীব্র গন্ধ, মেয়েটার মাথাটা টলে যায় পাগলের মত কিছু হাতড়াতে থাকে সে, দু’হাত দিয়ে তাড়িয়ে দিতে চায় এই ঝাঁঝালো গন্ধটা হাতড়াতে থাকে নদীর গন্ধ, সোঁদা মাটির গন্ধ আর স্বর্ণচাঁপার গন্ধ
“বৌমা, ও বৌমা এমন করছ কেন গো? ও খোকা একবার দেখে যাও, ভর সন্ধ্যে বেলায় এ কি সর্বনাশ হলো গো!”
মেয়েটি লুটিয়ে পড়তে পড়তে টের পায় এক স্নেহময়ী মা নদীর মত স্নিগ্ধ কোল বিছিয়ে তাকে টেনে নিল গভীরে

            (তিন)

 বেলা, বেলাদি, বেলা বৌদি, বেলা পিসি এর বাইরে তার যে একটা পরিচয় ছিল সে কথা আজ সে নিজেও কি মনে রেখেছে? অথচ এই বৌটার কচি পানপাতার মত সবুজ লাবণ্যে টলটল মুখটা দেখে সে নিজেও থমকে যায় মেয়েটা গভীর আগ্রহে বাঁধানো একটা খাতা খুলে পেন ধরে তার দিকেই সাগ্রহে তাকিয়ে আছে
“তা ও বৌমা তুমি বুঝি গপ্পো লেখ?
“উফ এত কথা বোলনাতো, তাড়াতাড়ি শুরু কর’। মেয়েটির তর সয় না, বেলা পিসিকে দেখে আর ভাবে, এই মানুষটার মধ্যে অনেক গল্প আছে চাই একটু ভালোবাসা আর বিশ্বাস, একটু একটু করে সেটা অর্জন করতে পারলেই,হাল্কা একটু টোকা, ওমনি গল্প ঝরে ঝরে পড়বে বুদ্ধিমতি সে, তাই প্রথমেই বেলা পিসির ফেলে আসা জীবনটাকে টোকা দিয়েছে স্মৃতি মেদুর পৌষের রোদের মত স্বপ্নরা এখন বেলা পিসির গভীর কালো দুচোখের পাতায় আলতো সোহাগ মাখিয়ে দিচ্ছে
মেয়েটি উঠে গেছে, এখন সামনে থেকে সরে যেতে হবে বেলা পিসি এখন নিজের সঙ্গে নিযেকে ছুঁয়ে কথা বলবে মেয়েটি একটু দূরে সরে যায়, তারপর একটু একটু করে এ্কসময় বেলা পিসির পরিধির বাইরে চলে যায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে, বন্ধ দরজার পাশে ঘোরাঘুরি করে সেদিনের পর থেকে এ বাড়ির খোকা আরো সাবধানী মেয়েটি ও কি কম সাবধানী নয়? আজকাল তার আগের মত ঝিমিয়ে থাকা ভাবটা কমে আসছে, শীর্ণ শরীরে বর্ষার নদীর মত প্লাবন খোকা গজগজ করে, “এই বেলা হারামজাদি, মেয়েটাকে রোজ রাত্রে দুধ গেলাচ্ছিস তো?” “হ্যাঁ খোকা রোজ তো খাওয়াই’। “বুড়ি মাগী, খাওয়াস তো ও মাগীর গতর ফেটে পরে কী করে?
বেলা পিসি কেঁদে ফেলে, “এমন কথা শুনিনি, বৌ এর স্বাস্থ্য ফিরলে সোয়ামীর অস্বস্তি’। এক এক রাত্রে বলিষ্ঠ পুরুষটির পেষণে কান্না ঠিকরে আসে “এবার আমায় ছাড়ান দাও খোকা, তোমার ওমন সুন্দরী যুবতী বৌ, তারে নাও’। থুঃথুঃ করে এ বাড়ির খোকা, ‘সেই ছোট থেকে শুধু তোকে নিয়েছি, শুধু তোকেই নেব যতদিন তুই বাঁচবি’
ভোর রাত্রে বেলা পিসি বারান্দায় পা ছড়িয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে কপাল চাপড়ায়, কেন তার মরণ হয়না! নিজেকে অভিসম্পাত করে
“ইচ্ছে হয় না শাস্তি দিতে?” ফিসফিস করে ভোর রাত্রে বেলা পিসির কানের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় মেয়েটি
ভুত দেখার মত চমকে ওঠে বেলা পিসি “তুমি ঘুম থেকে উঠে পড়লে? দুধ খাওনি?
মেয়েটির সরু হাত সাঁড়াশির মত চেপে ধরে তার কব্জী “পিসি তুমি জানতে রোজ রাত্রে ঐ দুধে কি মেশানো হয়?
“ঘুমের ওষুধ” খোকা বলে, তোমার দুবলা শরীরে ঘুম দরকার’।
মেয়েটির চোখ জোড়া অন্ধকারে ধক করে জ্বলে ওঠে ঘুমের ওষুধ?
“হ্যাঁ মা’
মেয়েটি বুঝতে পারে বেলা পিসি কিচ্ছু জানেনা যেমন জানেনা এই অনাচারের শেষ কোথায় এই বাড়ির কর্তার হাত ধরে যে অনাচার শুরু হয়েছিল তা একদিন কিশোর পুত্রের হাতে উঠে এসেছিল দিনের পর দিন নিজেকে নিঃশব্দে ক্ষয় করে যাচ্ছে এক মহিলা, তার দীর্ঘ নিঃশ্বাস কি পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছেনা এ বাড়ির অন্দরমহল?
বেলা পিসি চোখ খোলে তরতর করে বলে যায় ফেলে আসা অতীতের কথা খোকার বাবা ছিল থানার বড় অফিসার বেলা পিসির ঘরের লোকটা, শরিকিদের সঙ্গে ঝগড়া করে জঙ্গলে গিয়ে বিষ খেয়ে মরে পড়ে ছিল কিন্তু পুলিশ এসে বারবার তাকেই জিজ্ঞেস করলো, সে কেন ঝগড়া করেছিল? সব ওই হারামজাদী বিধবা ননদের কাজ আবাগীর বেটির নিজের সংসার হয়নি বলে কারুর সুখ দেখতে পারেনা সে যত বলে তার সঙ্গে গোপালের বাপের ভালো বনিবনা ছিল কে শোনে কার কথা?
খোকার বাবা একদিন রাত্রে এলো, ননদ কে কি বোঝাল সেই জানে, বারবার দুজনে বলতে লাগল তার জেল হয়ে যাবে কোথাও পালিয়ে গেলে বেঁচে যাবে বছর কয়েক পরে সব ঠিক হয়ে গেলে সে আবার ফিরে আসবে
মাথার ঠিক ছিল না, ওদের কথা শুনে অন্ধকার রাস্তায় পা বাড়ালো বেলা পিসি সামনের বাঁশ বাগানটা পেরতেই মুখ চেপে কে যেন ধরল খোকার বাপ শিয়ালদার হোটেলে রেখে কদিন এই শরীরটা বন্ধু বান্ধব নিয়ে চেটে পুটে খেল তারপর রুগ্ন বৌ আর সংসারের জোয়াল  কাঁধে চাপিয়ে দিল একটু আধটু পড়াশোনা  জানা ছিল বলে ঘর বাইরের কাজ একা হাতে সামলে নিল বেলা পিসি
‘কিন্তু, তোমার গোপাল?
সে আমার ননদের কাছে ভালোই থাকবে আর এ বাড়িতে এসে আমি খোকাকে পেয়ে পুত্র শোক ভুলে ছিলাম খোকা তখন দশ বছর আমার খুব ন্যাওটা ছিল কিন্তু আরও পাঁচ ছ বছর পর এক রাত্রে সে দেখে ফেলে তার বাবার সঙ্গে আমাকে পরের দিন তার বাবা চলে যেতেই জোর করে আমায় ...... ছেলের নজরে দেখতাম ওকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে এক ভঙ্গুর রমণী
‘শাস্তি, শাস্তি, খুব শাস্তি হওয়া দরকার তুমি চাওনা শাস্তি হোক?
বেলা পিসির চোখে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ওঠে চাই, চাই, চাই রে মা শাস্তি চাই, ধ্বংস চাই এই অনাচারের দুলে দুলে বলতে থাকে সে। মেয়েটি দেখে একটি জমাট মাটির মূর্তি একটু একটু করে ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়ছে বাতাসে নোনা নদীর গন্ধ ভেসে এলো, মেয়েটি প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল

(চার)

নিস্তব্ধ দুপুর, কেউ কোথাও নেই দু একটা উদাসী ডাহুকের ডাক শুধু ভেসে আসছে তবু বেলা পিসির সাবধানতার অন্ত নেই, সিঁড়ির মুখে বসে আছেন, যদিও সদর দরজা ভিতর থেকে বন্ধ
মেয়েটা একটু আগেই ব্লাউজের ভিতর থেকে চাবিটা বার করেছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মুচকি হেসেছে আনমনে ভাগ্যিস বেলা পিসি ছিল, ভাগ্যিস বেলা পিসির এই রূপ যৌবন ছিল রাত্রের অন্ধকারে তার খোকার কোমর থেকে চাবিটা সরিয়ে সাবানে ছাপ তুলে আবার যথাস্থানে ফিরিয়ে দেওয়া, উফ রুদ্ধশ্বাস এক পর্যায়
মেয়েটি ডায়েরির পাতা উল্টে যায় নাম্বার ওয়ান, নাম্বার টু পড়তে থাকে আর উঠে এসে দাঁড়ায় র‍্যাকে সাজানো শিশি বোতলের সামনে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে ভেতরের আপাত নিরীহ পদার্থ গুলোকে কত নাম, কত কাজ তাদের Sulpher mustard, strychnine, Ricin ছোট ছোট শিশি গুলিতে   নিথর নিস্পন্দ একটু ছোঁয়ায় চামড়া, চোখ, ফুসফুস পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে কেউ বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র কে আক্রমণ করে মৃত্যুর শেষ ঘণ্টা বাজিয়ে দিতে পারে
নাহ মেয়েটির পছন্দ হয়না কি যেন খুঁজতেই থাকে সে এক সময় ডায়েরির পাতায় পেয়েও যায় মন দিয়ে অক্ষর সমুদ্রে ঝাঁপ দেয় Aconitum, Aconite, Devil’s helmet, wolf’s bane উফ কতনা নাম পাশেই লাল কালিতে নোট করা “কুইন অফ অল পয়জন’। মেয়েটি একবার ছুটে গেল র‍্যাকের কাছে লেবেলিং এর নাম্বার ধরে শিশিটা মিলিয়ে নিল এরপর এর কার্যকারিতা মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলো পড়তে পড়তে মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি খেলা করে গেল এই তো পেয়েছে, খুব দ্রুত এবং সহজে মিশে যায় রক্তস্রোতে  এই মারাত্মক বিষ এবং চল্লিশ থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে এই বিষ কাজ করতে শুরু করে অতএব এতেই কাজ হবে মেয়েটা শুনশান দুপুরে ঠা ঠা করে হাসতে থাকে নিজেকে তার প্রেতিনী মনে হয়
এই গরমে অফিস থেকে ফিরে এ বাড়ির খোকার এক গ্লাস ঘোলের শরবত চাই বেলা পিসি খুব মনোযোগ সহকারে শরবত বানাচ্ছে এদিক ওদিক দেখে রান্নাঘরের এক কোণ থেকে ছোট্ট শিশি টা বার করে পুরোটাই ঢেলে দিল আর কী আশ্চর্য  একটুও হাত কাঁপলনা তার
মেয়েটার উঠোন থেকে তীক্ষ্ণ নজরে বেলা পিসির গতিবিধি লক্ষ্য করে যাচ্ছে এতদিন নিজের নামটাই সে ভুলে গিয়েছিল দত্ত বাড়িতে আসা ইস্তক সে শুধু এ বাড়ির কাছে মেয়েটা বা বৌমা
বেলা পিসি উঠোন ছাড়িয়ে বারান্দায় উঠলো, লম্বা বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সিঁড়ির দিকে খোকা এখন দোতলায় তার গোপন ঘরে, নিশ্চয় আজও নতুন কিছু সংগ্রহ করে এনেছে তাই স্নান সেরেই উঠে গেছে খোকা এখন বিষ জমাচ্ছে, যেমন জমিয়ে এসেছে এত গুলো বছর একটু একটু করে যেদিন থেকে টের পেল তার রুগ্ন মায়ের গোঙানির শব্দ চাপা পড়ে যায় দুটো কামার্ত মানুষের শীৎকারে সেদিন থেকেই তো খোকা একটু একটু করে বিষ জমাচ্ছে, ঠোঁটের ডগায়, জিহ্বার আগায়, সারা শরীর ভরে যাবার পর একটা আস্ত ঘরে
এক পা এক পা করে বেলা পিসি চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে মেয়েটার মনে পড়ে যাচ্ছে নিজের নাম হ্যাঁ অ্যাগ্রিপিন্না সম্রাট ক্লডিয়াসের দয়িতা যে কিনা এক প্লেট মাশরুমের সুস্বাদু পদের সঙ্গে  বিষাক্ত অ্যাকনাইট মিশিয়ে হত্যা করেছিল ক্লডিয়াসকে সেই থেকে এই বিষাক্ত উদ্ভিদটি “মেয়েদের অভিশাপ” নামে কলঙ্কিত
অ্যাগ্রিপিন্না ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে প্রশস্ত ছাদে মাটিতে লুটোচ্ছে তার রক্তিম আঁচল আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে, সে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে শুরু করলো, আজ বৃষ্টিতে মুছে যাক এই বিষাক্ত রাজ্যপাট এই বৃষ্টি চাঁদোয়ার নিচে ঘুমাও ক্লডিয়াস, শান্তিতে ঘুমাও


মহুয়া মল্লিক


1 টি মন্তব্য: