মা
মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী
চৌধুরী হোম স্টে-তে আজ সাড়া পড়ে গেছে। বড় খোকা ছোটো খোকা তাদের কথা রেখেছে, ফিরে এসেছে তারা। সব দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত চিত্রলেখা। এখন
থেকে তার অবসর জীবনের শুরু। হোম স্টে-র আয়তন বাড়ানো দরকার, আরোও উন্নয়ন দরকার। হোম স্টে-র তো বটেই, গ্রামেরও
রাস্তা ইত্যাদি ভালো করার দরকার। কাজের মানুষ তাদের অনেক আছে, কারণ তাদের হোম স্টে-র সুনাম ছড়িয়ে পড়ায় প্রায় সারা বছর ভীড় লেগেই থাকে।
এখন থেকে হোম স্টে পরিবারের মাথা হিসেবেই শুধু থাকবে চিত্রলেখা; বাকি সব কাজ, চিন্তা ছেলেদের। বছর কয়েক আগেও কি চিত্রলেখা
ভাবতে পেরেছিলো আজকের দিনটার কথা? যেবারের আলোচনায় উঠে এসেছিলো
চৌধুরী হোম স্টে-র পরিকল্পনা। দোতলার ঘর লাগোয়া খোলা ছাদে বসে বড় খোকা, ছোটো খোকা,
কাজের মানুষ, অচেনা অতিথিদের হাঁক ডাকে, চিত্রলেখার মনেপড়ে সেই দিনটার কথা।
আজও ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভাঙে চিত্রলেখার। ভবেশ চৌধুরীর শ্রাদ্ধ শান্তি
সব সুষ্ঠু ভাবেই মিটেছে গতকাল। ঘরের লাগোয়া অর্ধচন্দ্রাকার ছাদটাতে এসে দাঁড়ায়
অভ্যেস মতো। গতরাতেও অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়েছে। ফুলের গন্ধে বাতাস ভরা কিন্তু গুমোট
হয়ে রয়েছে,
ভোরের স্নিগ্ধতা যেন উধাও। অকারণ তাকিয়ে রইল চিত্রলেখা। এই
বাড়ি,
বাগান, পুকুর সব কিছুর মধ্যে তার
অস্তিত্ব মিশে রয়েছে। নিজের সবটুকু মিশিয়ে দিয়ে এতকাল রক্ষা করেছে চৌধুরী
পরিবারকে। যদিও আজকের পরিণতি তার অজানা ছিলো না, তাও, সেটা যে এতো দ্রুত ঘটবে তার জন্যও যেন প্রস্তুত ছিলো না। আজ সকালটায় একটু
ঠান্ডা বাতাসের যেন বড় প্রয়োজন ছিলো তার। গতরাতের ছোটো খোকার বলা কথাগুলো কিছুতেই
হজম হচ্ছে না। যে বাড়িতে সে এগারো বারো বছর থেকে রয়েছে, দুই
খোকাকে মানুষ করেছে, সেই বাড়ি বিক্রী করে দিতে চায় ওরা। ওদেরই বা
কি দোষ?
এই অজ পাড়া গাঁয়ে, এতোবড় বাড়ি, বাগান মেন্টেন করতে খরচ হবে না? সব চুকিয়ে বুকিয়ে নিজেদের খোপে
ঢুকে থাকবে,
সেটাই তো স্বাভাবিক। প্রত্যেকের সংসারে ঝামেলা আছে, খরচও। এতোদিন চিত্রলেখা সামলে রাখলেও, বাবার
অবর্তমানে সব তো তাদের ঘাড়েই পড়বে।বিক্রী করছে করুক, তা’বলে চিত্রলেখাকে অপমান করে?
বাড়িটার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে দোতলায় ডান হাতে এই ছাদটা, যেখানে চিত্রলেখা দাঁড়িয়ে। কাজেই ছাদটায় দাঁড়ালে বাড়ির সামনের রাস্তা, পাশের বাগান, আর পিছনদিকের পুকুর, বাগানে
ঘেরা মঠখোলা সব দেখা যায়। মঠখোলা হলো, চৌধুরী পরিবারের নিজস্ব
শ্মশান। সেখানে ভবেশ চৌধুরীর প্রপিতামহকে অবধি দাহ করা হয়েছে। প্রায় একা লড়াই করে
মঠখোলা বন্ধ করেছে চিত্রলেখা। বাড়িতে থাকাকালীন একটা মানুষ মারা যাওয়াটাই বাড়ির
ছোটোদের কাছে যথেষ্ট ভয়ের। তারওপর যদি সেই চেনা মানুষটির দেহ খানা, বলতে গেলে প্রায় চোখের ওপরে চিতার আগুনে পোড়ানো হয়। এবং দরজা, জানলা বন্ধ রাখতেই হয় গন্ধ ঠেকানোর জন্য। বাচ্চারা তাতে আরোই কৌতুহলী হয়ে পড়ে, ফলে একঝলক মড়া পোড়ানো দেখে ফেলে বড় খোকার সে কী অবস্থাটাই না হয়েছিলো। মঠখোলায়
যেকটা মঠ বা স্মৃতিমন্দির ছিলো, সেগুলো যেমনকার তেমনই আছে, বাকি অংশে প্রচুর গাছ লাগিয়েছিলো চিত্রলেখা। আম, কাঁঠাল, লিচু,
জামরুল, কালোজাম, নিম,
কলা যখন যেমন পেরেছে। কোনোটাই দারুণ উচ্চমানের ফল না দিলেও
মন্দও হয় না। তাছাড়া গ্রামের গরীব মানুষদের জন্য সবই সমান। এসব ফল হলে, প্রথম প্রথম বাড়ির লোকেদের খাওয়া ছাড়াও, দু’হাতে বিলিয়েছে চিত্রলেখা। মঠখোলা আর মূল বাড়ির মাঝামাঝি তাদের নিজস্ব পুকুর, যার জল
চৌধুরীদের কাছে গঙ্গার জলের সমতূল্য। তার পাড় বাঁধানোও চিত্রলেখারই সৌজন্যে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সকালের কর্ম সারতে যায়
চিত্রলেখা। ভবেশ চৌধুরী তাঁর সময়ের তুলনায় যথেষ্টর বেশীই সৌখীন ও আধুনিক ছিলেন
বলেই,
দোতলায় তাঁর ঘরের লাগোয়া কলঘর তৈরী করিয়ে ছিলেন। চিত্রলেখা
সেইটেই ব্যবহার করে বলে একান্তে নিজের সকালের স্নানাদি সেরে নীচে নামতে পারে।
তারপর রান্নাঘরে বামুন ঠাকুরকে সকালের জলখাবারের, দুপুরের
রান্নার হিসেব দেয়। আগে বাড়িতেই গরু ছিলো, ছাগল
ছিলো,
তাদের সকালের খাবার দেওয়া, দুধ
দোয়ানো,
গোয়াল ঘর পরিষ্কার করা সব একা হাতে করত চিত্রলেখা। বয়স
বাড়ার সঙ্গে আর্থিক অবস্থার দিকে তাকিয়ে গরু ছাগল বিদেয় করেছে। ভবেশ চৌধুরী শয্যা
নেবার পর আরোও সচেতন হয়ে যতোটুকু খরচ কমানো যায় বা কোনো ভাবে যদি সামান্য আয়
বাড়ানো যায় তার চেষ্টাই করেছে সে। বড় খোকা, ছোটো
খোকার পড়াশোনা,
বা বিয়ে সবই কিন্তু চিত্রলেখা তার নিজের বুদ্ধি ও পুঁজি
লাগিয়েই করেছে। এমনকি আজ ভবেশ চৌধুরীর শেষকৃত্য যথেষ্ট বড় করে করলেও বড় খোকা, ছোটোখোকার কাছে এক পয়সার জন্যও হাত পাতেনি চিত্রলেখা। এতোকিছুর পরেও তার যে
চূড়ান্ত অপমান হয়েছে গতরাত্রে, স্নান করতে করতে, তারই একটা বিহিত মনে মনে ছকে নিলো চিত্রলেখা।
নীচের তলায় এসে এতোবছরের অভ্যাসমতো খুব স্বাভাবিক ভাবে নিত্যকর্ম শুরু করে।
এখন আবার গয়লাকে বলে রেখেছে রোজ সকালে দুধ দিতে। টাটকা দুধ ফুটিয়ে ঠান্ডা করে
রাখতে হয়। খোকাদের ছেলেমেয়ের জন্য, খোকাদের সকালের জলখাবারের জন্য।
তারা নাকি ভূট্টার চিঁড়ে খায় দুধ দিয়ে। তবে, আজ
কালের মধ্যেই যেহেতু খোকারা সব চলে যাবে, তাই আজ দুপুরের খাবারের
ভালো আয়োজন ভেবে রেখেছে চিত্রলেখা। তাদের পুকুর যদিও ইঁজারা দেওয়া তাও তাদের সঙ্গে
চুক্তিই আছে,
তেমন প্রয়োজনে পুকুরের একটা বা দুটো বড় মাছ ব্যবহার করতে
পারবে চৌধুরীরা। কাজেই এই ক’দিন খোকারা নিয়ম এক ফোঁটা না
মানলেও নিরামিষ খেয়েছে পাঁচন গেলা মুখে। যদিও রোজই, দু’বেলা,
নিরামিষের নানান লোভনীয় পদ বানাতে নির্দেশ দিয়েছে চিত্রলেখা, সে নিজে অবশ্য মালসা পুড়িয়েছে। আজ মাছ হবে, মাংসও
হবে,
বাচ্চারা চাইলে ডিমও হবে। সকালের জলখাবারে না হলে বিকেলের
জলখাবারে লুচি হবে। রান্নার বামুন ঠাকুর আর তার সহকারীদের কী কী কাটা বাটা হবে, সব নির্দেশ দিয়ে, ধীর পায়ে বাড়ির সামনের টানা বারান্দায়
দাঁড়ায়।
একটা নুড়ি ফেলা রাস্তা বাড়ির পাঁচিল অবধি, যার
দুই ধারে মরশুমী ফুলের গাছ। আর রাস্তার দু’পাশের
জমিতে কামিনী,
গন্ধরাজ, জুঁই, বেল, কৃষ্ণচূড়া,
রাধাচূড়া, পলাশ, কুন্দ, বকুল যা যা সুগন্ধী বা রঙিন ফুলের গাছ পেরেছে লাগিয়ে গেছে চিত্রলেখা। তাইবলে
মোটেও জঙ্গল বানায়নি, নিজের হাতে যত্ন করে এসবের। এই অজ পাড়াগাঁয়ে
আর মালী পাবে কোথায়? খুব জোর নিড়ানি এসে ঘাস কেটে দিয়ে যায়।
আচ্ছা খোকাদের মনে কোনোদিন প্রশ্ন জাগেনি, এই
বাড়ি,
বাগান, তাদের পঙ্গু শয্যাশায়ী বাবা
সবের দেখভাল কী করে করছে চিত্রলেখা? একা হাতেই তো করেছে। ভবেশ চৌধুরীর মৃত্যুকালে যদি পঁচাশি বছর হয়ে থাকে তাহলে
চিত্রলেখার এখন অন্ততঃ পঁয়ষট্টি, তার বেশী বই কম না। এই বয়সেও সে
এতো পরিশ্রম করে, উপরন্তু টাকার জোগান রাখতে হয় তার। নাঃ, তারা যদি এতো শত চিন্তা করতই তাহলে অতোগুলো কটু কথা সরাসরি বলতে পারতো না।
এক এক করে খোকাদের পরিবার সব জাগছে, টের পায় চিত্রলেখা। এই ক’দিনেই খোকাদের ছেলেমেয়েগুলো বড্ড ন্যাওটা হয়ে উঠেছে তার। বউমারা তেমন সম্মান
না দেখালেও অপমান কিছু করেনি। তাদের জলখাবারের ব্যবস্থা কোরে, পুকুরের দিকে যায়। মাছ ধরা হচ্ছে, যাতে বেশি মাছ ধরে
কোনোরকম অপচয় না হয় সেটা দেখাও তো তারই কাজ। মাছধরার লোকেদের কথাবার্তার আওয়াজে
একে একে পুকুর পাড়ে হাজির হয় ওরাও। বাচ্চাদের চোখেমুখে বিস্ময়, শহরে এ দৃশ্য তো এখন বিরল। তারা স্বচক্ষে এই প্রথম দেখছে এসব। বড় বড় দুটো মাছ
বেছে রেখে বাকি পোনা মাছ গুলোকে আবার জলে ছেড়ে দিতে বলে চিত্রলেখা আর ছোটোমাছ যা
ওঠে সেটা মাছধরাদের ভাগেই যায়, তেমনটাই নিয়ম।
রান্না ঘরে আজও উনোনে রান্না হয়। যদিও লোক সংখ্যা কমে যাওয়ার পর চিত্রলেখা
তোলা উনোনের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। কিন্তু, এই
কটাদিন সেই বড় বড় বাসন, উনোন সব ব্যবহার হচ্ছে আগের
মতো। আজও খাবার টেবিল বস্তুটি নেই এবাড়িতে। পিঁড়ি পেতে খেতে বসতে হয়। এই ক’দিন চিত্রলেখা নিজের কোনো আধিপত্য ফলায়নি কারোর ওপর। কিন্তু আজ, হয়ত আগামী কাল সক্কাল সক্কাল ফেরা বলেই, চিত্রলেখা
ওদের সবাইকে সেই সাবেকী ভঙ্গিতে দুপুরে খাওয়ার অনুরোধ করে। সে অনুরোধ মৃদু স্বরে
হলেও এতোটাই দৃঢ় ছিলো যে, কেউ ফেলতে পারেনি। এমন টাটকা
মাছ,
মাংস, সব্জি বোধহয় তারা বহু যুগের
মধ্যে খায়নি। রান্নাও চমৎকার আর এতোদিন পর আমিষ পেয়ে সবারই খাওয়া বেশিই হয়ে গেলো।
খাওয়ার পর টানা বারান্দায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ওরা। বৃষ্টি উপভোগ করতে। চিত্রলেখা
সেখানে দু’তিনটে ঝাঁপির মতো জিনিস নিয়ে পৌঁছয়। নাতি নাতনিদের বলে,
“তোমরা তো সব কাল ভোর হতে হতেই চলে যাবে। এসো, এখন
তাহলে তোমাদের একটা গল্প বলি। এবেলার খাওয়া ভালো লেগেছে তো? “
“হ্যাঁ,
খুব। কিসের গল্প বলবে?”
“ধরো,
এই বাড়ি, তোমাদের পরিবারের পুরোনো গল্প
যদি বলি?
শুনবে না? আসলে তোমরা সব এখন বড় হয়েছ তো, পড়াশোনা করেছ, তোমাদের বাবাদের মতো চাকরি করতে বিলেত-টিলেত
যাবেও শুনলাম। এবারে বোধহয় তোমাদের সবটা জানার সময় এসেছে। দেখো, একটা মানুষের পুরো ঘটনা না জেনে তাকে অপমান করা খুব সহজ। কিন্তু তার
সারাজীবনের সমস্ত ঘটনা শুনে নিয়ে তারপর তোমরা নিজেরা বিচার কোরো, কেমন?”
ছেলেমেয়েরা একটা কিছু আন্দাজ করে নড়েচড়ে বসে। বউমারাও
খাওয়ার পর বারান্দায় বসে আরাম করছিলো, তারাও সরে আসে। শুধু
খোকারা উঠে যেতে চায়, চিত্রলেখা বাধা দেয়,
“না না,
তোমরাও থাকো বড় খোকা, ছোটো
খোকা। দেখো,
কাল রাতে ছোটো খোকা আমায় কিছু ছোটো-বড় কথা বলেছে, বড় খোকা তাতে প্রতিবাদ করেনি। মানে, সেও ওই কথাগুলো বিশ্বাস
করে। প্রথমটায় খুব অপমানিত হলেও পরে ভেবে দেখলাম, ওদের
কোনো দোষ নেই। আমি কে, কেন এবাড়িতে রয়েছি সেগুলো তো ওদের অজানা। না, অজানা বললে ভুল বলা হলো, ওরা লোকের মুখে শুনেছে। কিন্তু
কোনোদিন ওদের বাবাকে বা আমাকে জিজ্ঞেস করার সৎ সাহস হয়নি। বাবা জীবিত থাকতে আমার
মুখের ওপর বলতে পারেনি। তাই, সুযোগে বলে ফেলেছে।”
মাথা নীচু করে বসে থাকে খোকারা, তারা কল্পনাও করতে পারেনি একজন
স্বল্প শিক্ষিত মহিলার এমন সংযত আচরণ।
“খুব ছোটো বয়সে, জানো, আমার
বিয়ে হয়ে যায়। তখনকার দিনে তোমরা ভাবতেও পারবে না, মেয়েদের
কেমন সম্মান ছিলো। একটা মেয়েকে তার বাবা মা যদি লেখাপড়া শেখাতো, তাদের একঘরে করত গ্রামের মানুষ। একঘরে বুঝলে তো? কেউ
তাদের সাথে কথা বলবে না, কেউ কিছু বিক্রী করবে না, জল নিতে দেবে না পাড়ার পুকুর থেকে। সেই হেন সময়েও আমার বাবা আমায় পড়তে এবং
নিজের নাম লিখতে শিখিয়েছিলেন। সব জেনে শুনেও। তা, আমার
আট পুরতে পুরতেই বিয়ে হলো, সে বোধহয় আমার দাদুর বয়সী কোনো
মানুষের সঙ্গে। কিন্তু, আমি ‘বড়’ না হওয়া অবধি শ্বশুর বাড়ি যেতে পারব না। এই ‘বড়’ হওয়া মানে কিন্তু শুধুই বয়স বাড়া নয়, যেমন হলে মেয়েরা মা হতে
পারে,
তেমন হওয়া আরকি। রয়ে গেলাম বাপের বাড়ি। ঘুরি, ফিরি,
মায়ের হাতে হাতে কাজ শিখি আর বাবার কাছ থেকে একটু একটু
লেখাপড়া শিখি।
“এই চলতে চলতে একদিন তখন আমার বছর এগারো মতো বয়স, কেমন
করে জানি লোক জানাজানি হয়ে গেলো, আমি লেখাপড়া শিখেছি। হয়ত, আমিই বড়াই করেছিলাম, এতোবছর পর আর মনে নেই। তাতেই
গ্রামের মানুষ ক্ষেপে উঠেছিলো, তারই মধ্যে খবর এলো যিনি আমার
স্বামী ছিলেন উনি স্বর্গবাসী হয়েছেন। ব্যস্, আর যায়
কোথায়,
গ্রামের লোকে বলল, এ আমার লেখাপড়া শেখারই
ফল। তারও পরে আমি ‘বড়’ হলাম। বিধবা মানুষের নাকি ওসব
হতে নেই,
কাজেই বাবাকে নির্দেশ দেওয়া হলো, হয়
আমায় তাড়িয়ে দিক, নাহলে একঘরে হতে হবে। বাবা বেচারা কী করেন? ঘরে আরোও ছোটো ছোটো বোন, তাদের বিয়ের খোঁজ শুরু হয়েছে।
“কাজেই,
বাবা একদিন আমায় নিয়ে রওনা দিলেন। কতো পথ হেঁটে আমরা
রেলগাড়ি চড়ব বলে, ইস্টিশনে পৌঁছলাম। সেখানে এক কোণায় আমায়
বসিয়ে,
বাবা গেলেন টিকিট আনতে। সেই যে গেলেন, আর এলেন না। আমার কেমন মনেই হচ্ছিল, বাবা আর আসবেন না। কারণ, আমায় বসিয়ে যাবার সময় বাবা কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছিলেন। টিকিট আনতে গেলে কী কেউ
কাঁদে?
যাইহোক, প্রায় সারাদিন বসে বসে বেশ ক’বার এমুখের ওমুখের গাড়ি আসা যাওয়া দেখলাম। সন্ধ্যা নাগাদ একটা গাড়ি এলো, আমি জানি না কি ভেবে চড়ে বসলাম গাড়িতে। আমার রকম সকম দেখে সবাই বুঝতে পারছিলো, আমি জীবনে প্রথমবার চড়েছি। যদিও সারাদিনে দেখে আমি আন্দাজ করে নিয়েছিলাম, কেমন করে চড়তে হয়। ভয় করছিলো খুব জানো, একটা
ঘর সেটা দৌড়চ্ছে, কেবল মনে হচ্ছিল আমি পড়ে যাবো। ক্ষিধেয়, তেষ্টায়,
ক্লান্তিতে তখন কাহিল অবস্থা। সেই সময়ে তোমাদের ঠাকুর্দাদার
বাবা যিনি,
তিনি আমায় আবিষ্কার করেন।
“আমি কিন্তু,
চৌধুরীবাবুদের নাম মুখে আনি না, ওঁরা
আমার প্রণম্য। তো, বড় বাবু আমায় অনেক প্রশ্ন করে বোধহয় বুঝে
গেছিলেন আমার অবস্থা, তাই দয়া করে আমায় নিয়ে আসেন এই বাড়িতে।
এতোবড় বাড়ি,
এতো লোকজন আমি তো এর আগে দেখিইনি কখনও। বুড়ো বাবু তখন বেঁচে
আছেন,
কিন্তু শয্যাশায়ী। বুড়ো বাবু কে বুঝলে তো? যিনি আমায় নিয়ে এলেন তাঁর বাবা। প্রথমে আমি বুড়ো বাবুর সেবার কাজ পেলাম।
বুঝলাম,
এ বাড়িতে আমার ঠাঁই হলো। হলো শুধু না, সসম্মানে হলো। বুড়ো বাবুর সব কাজ করানো, তাঁকে
পরিষ্কার রাখা,
তাঁকে নাম গান শোনানো সব করতে করতে খুব অল্পদিনের মধ্যেই
আমি সবার প্রিয় হয়ে উঠলাম। বিধবা বলে আচার বিচার যেমন করতে হয় সব করতাম। সেই সময়ে
তোমাদের ঠাকুমা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বড় খোকা তখন ছোটই আর ছোটো খোকার কয়েকদিন বয়স।
তারই মধ্যে চলে গেলেন বুড়ো বাবু। তাঁকে ওই মঠখোলায় দাহ করা হলো। মা অসুস্থ, শোকের বাড়ি,
সবাই নিজের নিজের মতো ব্যস্ত। বড় খোকার খেয়াল রাখার কেউ
ছিলো না। বড় খোকা বুঝি দেখে ফেলে সেই মড়া পোড়ানোর দৃশ্য। রাতে তার জ্বর; জ্বরের ঘোরে কাঁদে আর বলে ‘আমায় ওভাবে পুড়িও না। আমার কষ্ট
হবে।’
তখন দায়িত্ব পেলাম, বড়
খোকা,
ছোটো খোকা আর তাদের মায়ের। শয্যাশায়ী মানুষটার সেবা করি
একহাতে,
অন্য হাতে দুই বাচ্চা সামলাই। তখন আমার বয়স বারো তেরো মতো
হবে। তোমরা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এটা ভাবতে পারো?” পিন
পতন নিস্তব্ধতা বারান্দায়। শুধু বাইরে আবার অঝোর ধারায় বৃষ্টি, বজ্রবিদ্যুৎ সহ। চিত্রলেখার জীবন শুনতে শুনতে, সবারই
মন নরম হয়ে গেছে, শুকনো মাটিতে অঝোর ধারা পড়লে যেমন হয়।
“যাইহোক,
আমি তো আশ্রয়ের মতো আশ্রয় পেয়ে কাজের দায়িত্ব পেয়ে, নিজের দুঃখের জীবন ভুলেই গেছিলাম। তখন থেকেই সময় পেলে আগানে বাগানে ঘুরি।
বিধবা,
তায় দুই বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া, হলে কী
হবে?
আসলে তো ওটা আমার নেচে বেড়ানোর বয়স, না? কাজেই সুযোগ পেলেই টুক করে বাগানে ঘুরতাম। এদিক ওদিক সাফ করতাম, কোন গাছের চারা না জেনেই গাছের চারা পেলেই তাকে উঠিয়ে যত্ন করে ভালো কোথাও
লাগাতাম। ক্রমে ক্রমে বাড়ির চেহারা বদলে যেতে থাকল আমার যত্নে। বাড়ির কাজের
মানুষরা,
গ্রামের মানুষরাও কেমন সমীহ করতে থাকল দেখি আমায়। যেন, আমি এই বাড়িরই মেয়ে বা বউ। আমিও দেখলাম, বড়
বাবু,
বড় মা থেকে বৌরানী, খোকারা
সবাই আমার ওপর নির্ভর করে। আমার আঁচলে সংসারের চাবির গোছা কবে যেন বাঁধা হয়ে গেলো।
“দিনগুলো বেশ ভালোই চলছিলো। আমি নিজে টেরও পাইনি কবে আমি সোমত্থ হয়ে গেছি। এই
সময়ে বড় মার শরীর খুব খারাপ করলো, সেই খবর পৌঁছল ভিন রাজ্যে কাজ
করতে যাওয়া তোমাদের ঠাকুর্দার কাছে। তিনি এলেন এবং এতো বছর পর হঠাৎ আমায় আবিষ্কার
করলেন যেন। আগে তো ছোট্টটি দেখেছেন বা বলতে পারো, তখন
সেভাবে দেখেননি। বড় মা দেহ রাখলেন ক’টাদিন যমে মানুষে টানাটানি করে। যখন বড় মা কে দাহ করার জন্য তৈরি করা হলো, বড় খোকা হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকে। ছোটো খোকাও ততোদিনে বেশ খানিকটা বড় হয়েছে।
আমার মনে পড়ল সেই বুড়ো বাবুর বেলায় বড় খোকার কী হয়েছিলো। আমি গিয়ে বড় বাবুর পায়ে
পড়লাম। যদিও আগে বহুবার তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করে বিফল হয়েছি। তাও আরেকবার চেষ্টা
করা,
আরকি। বাড়ির বাকীরাও অবাক আমার কথা শুনে, চৌধুরীরা জমিদার না হলেও গ্রামের মাথা তো বটেই। পাঁচপেঁচী লোকেদের শ্মশানে
তাঁরা কখনও পুড়তে পারে? তাঁরা নানান কথা বলেন, অমঙ্গল হবে ইত্যাদি। কিন্তু আমি তো
তখন খোকাদের মায়ের ভূমিকায়, সন্তানের অসুস্থতার চেয়ে কী
সংসারে আর বড় অমঙ্গল কিছু আছে? আমি যতোটুকু বুঝেছিলাম তাতে মা
পাখির মতো দুই ডানা দিয়ে খোকাদের আড়াল করাই উচিত মনে হয়েছিলো। বড় বাবু তখন শোকে
পাথর,
সিদ্ধান্ত কিছু নেবার মতো অবস্থাই ছিলো না তাঁর। তবে চৌধুরী
বাবু মানে তোমাদের ঠাকুর্দাদা সব শুনে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, বড় মা
কে গ্রামের শ্মশানেই নিয়ে যাবেন, বাড়ির মঠখোলা সেই দিন থেকে বন্ধ
হলো।
“কিন্তু,
এরপরেই আমি চৌধুরী বাবুর চোখে পড়লাম। তিনি তখন জানলেন আমার
ওপর কতোটা নির্ভরশীল এই সংসার। রান্না ঘর থেকে বৈঠক খানা, গোয়াল
ঘর,
বাগান, রুগ্না বৌ, কোলের খোকারা, অসহায় বড় বাবু সবাই আমার সিদ্ধান্তকেই
গুরুত্ব দেয়। আমার আঁচলে সংসারের চাবি, কিন্তু কোনো অপচয় আমি
হতে দিই না,
বাইরের মানুষ হয়েও। সংসার বুঝি এতো সাজানো, গোছানো নিখুঁত ভাবে আগেও চলেনি। বড় মার কাজ সব সুষ্ঠু ভাবে মিটে যাবার পরেও
চৌধুরী বাবুর দেখি ফিরে যাওয়ার বিশেষ আগ্রহ নেই। একদিন সন্ধ্যায়, নিয়ম করে খোকাদের নিয়ে আমি পড়াতে বসেছি। চৌধুরী বাবু সেটা দেখে আরোও বিস্মিত।
কারণ,
ওই যে, তখনকার দিনে মেয়েরা লেখা পড়াই
জানতো না। বা জানলেও ছেলেমেয়েদের পড়ানোর যোগ্য না। কিন্তু আমি লেখাপড়া জানি সেটা
তো বড় বাবু প্রথম দিন থেকেই জানতেন আর তাই দুপুর বেলাগুলোতে আমায় পড়াতেন, অঙ্ক শেখাতেন। সেই জন্যই তো, সংসারের টাকা পয়সা সব হিসেব করে
গুছিয়ে রাখতে পারি। সব কথা সেই সন্ধ্যায় ধরা পড়ল চৌধুরী বাবুর কাছে।
“এরপরের ঘটনাই সবথেকে অদ্ভুত। যেহেতু বৌরানী লেখা পড়া জানতেন না, আগ্রহও ছিলো না, এদিকে আমার খুব পড়াশোনার আগ্রহ। ফলে, চৌধুরী বাবুও যেমন আকৃষ্ট হলেন; আমিও। বাবু মাঝে মাঝেই, শহরে গিয়ে বই নিয়ে আসতেন। বঙ্কিম বাবু, রবি
বাবু,
শরৎ বাবুর লেখা আমি আগেও পড়েছি, বড়
বাবু বেছে বেছে পড়িয়েছেন। কিন্তু চৌধুরী বাবু এমন সব লেখা পড়ালেন যে আমি কেমন যেন
হয়ে গেলাম। সত্যিই তো, আমি বিধবা ঠিকই, কিন্তু
আমি তো কোনো কিছু বোঝার আগেই বৈধব্যকে আপন করেছি। একটা পুরুষ মানুষের সান্নিধ্য, তার ছোঁওয়া,
তার ভালোবাসা কেমন হতে পারে এসব তো আমার সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা। আগে আগে বই পড়লে আমি সেসব আবার বৌরানীকেও শোনাতাম। কিন্তু এই সব লেখার
কথা বৌরানী শুনে শিউরে উঠে কান চাপা দেন। কাজেই তার কাছে গল্প করা বন্ধ হয়ে, ক্রমে দুপুরের সব কাজ সারবার পর আমি চলে যেতাম বইঘরে। বিকেল অবধি, বাবু বই পড়তেন আর আমি জানলার কাছটাতে বসে শুনতাম। অমন রূপবান পুরুষ, তায় এতো সুন্দর বাচনভঙ্গী আমি যেন কোন ঘোরের মধ্যে চলে যেতাম। মনে হতো, এ যেন আমার জন্যই লেখা। বাংলাদেশে এতো বিধবা, আর
তাদের আমার মতো কপাল? তাদের জীবনেও প্রেম আসতে পারে? সারাদিন কাজের ফাঁকে চিন্তা করতাম এইসব। দুপুরের ওই সময়টুকুর জন্য প্রাণ
আঁকুপাঁকু করত। অথচ, কেউ আমার কোনো কাজে খুঁত পেতো না। ফলে কেউ
আঙ্গুল তোলবার সুযোগ পেতো না।
“এর মধ্যে বাড়ির দোতলা হলো, সারাদিন মুনিষ খাটে, ইঁট,
চুন, বালি, সুঁড়কি
চারিদিকে। অতো হল্লার মধ্যেও যেন দুপুরের সময়টুকু এসেই যেতো। বৌরানীকে ধুলো বালির
থেকে বাঁচিয়ে রাখতাম। খোকাদেরও। দোতলা হলে পর, বৌরানীকে
ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো দোতলার ঘরে। খোলামেলা ঘর, ঘরের
বাইরে চাঁদের মতো একফালি ছাদ, আর ঘরের লাগোয়া কলঘর, ঘরে বিজলি বাতি। বৌরানীর যেন প্রাণ ফিরে এলো। ধীরে ধীরে নিজের স্নান ইত্যাদি
নিজেই করতে লাগলেন। এক এক করে খোকাদের বোডিং ইস্কুলে পাঠানো হলো। বড় বাবু বা
চৌধুরী বাবু সবারই ইচ্ছা ছিলো খোকারা বিলেত যাবে পড়াশোনা করতে। বড় বাবু সব
ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। যদি জলপানি না ও পায় তাতেও বড় বাবুর জমা টাকার সুদে ওদের
দু’জনের লেখাপড়া সুন্দর ভাবে চলবে। এবং বড় বাবু ওই তহবিলের দেখভালের দায়িত্বও
আমায় দেন,
এতো ভরসা করতেন আমায়। এরপর এক সময়ে বড় বাবু দেহ রাখলেন।
বাবু তখন মহা সমস্যায়। কারণ, এতোদিন বড় বাবু রোজগার করতেন, ফলে সেই যে বড় মার চলে যাওয়ার সময়ে চৌধুরী বাবু বাড়ি এসেছিলেন আর তো কাজে
যাননি। কাজেই এখন তিনি হলেন সংসারের মাথা, তাঁকে
তো রোজগারের দিকে তাকাতে হয়। ফলে তখন আমার নামতে হলো মাঠে।
“এক এক করে কাজের মানুষ বেশিরভাগই বিদায় দিয়েছিলাম। বাড়িতে চারটে মানুষ তাদের
কাজ করার জন্য কি আর বাড়ি ভর্তি লোক লাগে? প্রায়, আমি একাই তো পারি। ততোদিনে গরু, ছাগল বিদায় করে দিয়েছি। বাড়িতে
বাচ্চারা নেই,
কিসে লাগে অতো দুধ? আর
কিছু খরচও কমলো। তারপর বড় বাবু চলে যাবার পর তো তিনটি প্রাণী। রান্না খাওয়া অল্পের
ওপর দিয়েই হয়ে যায়, কাজেই কাজের লোক এক আধজন। বাগানের গাছ, পুকুর সব ইঁজারা দিলাম, তাতে ভালোই রোজগার হতো। আর
নিজেদের স্বার্থেই যারা ইঁজারা নিলো তারাই দেখভাল করতো বাগানের বা পুকুরের। ও
হ্যাঁ,
বৌরানী সেই ওপরের কলঘরে তোলা জলে স্নান সারলেও আমি
কিন্তুবাড়ির কাজের মহিলাদের মতোই বরাবর পুকুরেই যেতাম। প্রত্যেক গ্রীষ্মের শেষদিকে, পুকুর ছেঁচে ফেলা হতো, আবার বর্ষায় টলটলে জলে ভরে উঠত। বোডিং ইস্কুলে যাবারও বেশ আগে, একদিন আসেপাশে কেউ নেই দেখে, ছোটো খোকা পুকুরে নামতে গিয়ে পা পিছলে, জল
খেয়ে,
ডুবে যায় আরকি। আমি ঠিক সেই সময়েই পুকুরে না গেলে আজকের দিন
আর দেখাই হতো না ছোটো খোকার। সেই ঘটনায়, বৌরানী বহুদিন অবধি
কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। সেই গ্রীষ্মেই আমি বড় বাবুকে বলে পুকুর ঘাট বাঁধানোর
বন্দোবস্ত করি। আর বর্ষায় হাতে ধরে ছোটো খোকাকে সাঁতার শেখাই।
“চৌধুরী বাবুর সাথে আমার সম্পর্কটা ততোদিনে গাঢ় হয়ে গেছে। আজ স্বীকার করতে কোনো
বাধা নেই,
আমাদের দু’জনের প্রেম ছিলো। তবে, সাধারণ নারী পুরুষের প্রেমের মতো নয়। ভক্ত আর ভগবানের যে প্রেম এও প্রায় সেই
পর্যায়ের। প্রথম জীবন থেকেই আমি যেহেতু বৈধব্য পালন করেছি, পুরুষের
ভালোবাসা বা পুরুষের স্পর্শ কেমন আমার অজানা ছিলো। আর, এই
খানেই আমার লক্ষ্মণরেখা টানা হয়ে গেছিলো। কারণ, আমার
তো সেই ‘অন্ধের কি বা রাত্রি কি বা দিন’ দশা। পুরুষের আদর বলতে যা বোঝায়, তার স্বাদ তো অজানা, কাজেই তার জন্য আকাঙ্ক্ষাও তেমন
তৈরী হতে দিইনি। বাবু যদি বিবাহিত না হতেন, তাহলে
হয়ত আমি এতো দৃঢ় হয়ে থাকতাম না। কিন্তু অমন দেবীর মতো বৌরানীকে ঠকাতে আমার মন
চায়নি। অথচ,
বাবুর সঙ্গ ত্যাগ করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিলো। পতঙ্গ মরবে
জেনেও যেমন আগুনে ঝাঁপ দেয়, আমারও সেই দশা। চৌধুরী বাবুর
সাথে বহুদিন বাগানে বসে কবিতা শুনেছি, বৃষ্টি ভিজতে ভিজতে গান
শুনেছি,
আমার জীবন কানায় কানায় ভরে নিয়েছিলাম। এই সব থেকেই গ্রামে
রটে যায়,
আমি বাবুর ‘রক্ষিতা’। আমাদের মধ্যের সম্পর্ক বোঝার মতো মানসিকতা তখন তো ছিলই না, এখনও বুঝি মানুষের তৈরী হয়নি। চৌধুরী বাবুর তরফ থেকেও কিন্তু কোনোদিন শরীরের
প্রতি আকর্ষণ অনুভব করিনি। তাঁর সে ইচ্ছা তাঁর স্ত্রী পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তিনিও তাঁর বিবাহিত স্ত্রী, দুই সন্তানের মা কে তাঁর
প্রাপ্য সম্মান সবই দিতেন। সে ব্যাপারে কোনো খামতি ছিলো না। কিন্তু বাবু যেমন গান, কবিতা,
উপন্যাস নিয়ে বিভোর হয়ে থাকতে ভালোবাসতেন; বাড়ির কেউ সেটা বুঝতে চাননি, বৌরানীও না। সোজা কথায় সংসারী ছিলেন না এক ফোঁটাও। প্রথম
জীবনে বড় বাবুর চাপে পড়ে বিয়ে এবং সংসারের দায়িত্ব পালনে চাকরি করতে বাধ্য
হয়েছিলেন। আমার সান্নিধ্যে তাঁর অসাংসারিক রূপ টা যত্নে লালিত হয়েছিলো বলে, উনি খুব স্বস্ত্বি বোধ করতেন।
বড় বাবু মারা যাবার পর কিন্তু আমরা বৌরানী সহ এই গান, কবিতা
পাঠের আসর বসানোর চেষ্টা করেছিলাম। বৌরানীর কোনো দোষ নেই, তিনি
এসবের রস পেতেন না। তাই কতোক বিরক্ত হতেন আবার কখনও একঘেয়েমি বোধ করে ঘুমিয়ে
পড়তেন। মানুষের মতো মানুষের জীবন পেয়েছিলাম আমি। লেখাপড়া শেখা, পরিবারের সদস্য না হয়েও একটা গোটা সংসারের দায়িত্ব, সন্তান
ধারণ না করেও দুই সন্তানের মা, কোনোরকম গ্লানি হয় তেমন কাজ না
করেও অমন রাজপুত্রের মতো প্রেমিক। আর কী লাগে বলতো এক জীবনে?
“তবে,
বৌরানীর মৃত্যুটা আজও আমাকে কষ্ট দেয়। খোকারা দু’জনেই যখন একসাথে বিলেত যাবার সুযোগ পেলো। আমি জোর করেই বাবুকে আর রুগ্না
বৌরানীকে পাঠাই ওদের বিদায় জানাতে। না, আমি যাইনি। যাইনি তার
কারণ,
আমি চেয়েছিলাম, কটাদিন বৌরানী সম্পূর্ণ
ভাবে তাঁর স্বামী ও পুত্রদের পান। তিনি অসুস্থ বলে সারাজীবন নির্ভরশীল হয়ে রইলেন। এই
বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে কোত্থাও পা রাখেননি। বদ্যি তো বলেন যে, হাওয়া বদল করলে মানুষের শরীর ভালো হয়। তো বৌরানীর হাওয়া বদলও হবে, আর জীবনে কোনো একসময়ে তো নিজের ইচ্ছানুযায়ী বাঁচলেন। অনেক সাহস দিয়ে, এক বুড়ি ঝি কে সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়েছিলাম। প্রয়োজনীয় সব কিছু গুছিয়ে দিয়ে
দিয়েছিলাম। বৌরানী কিন্তু তখন আর অসুস্থ কিছু ছিলেন না। প্রবল অসুখে শরীর ভেঙ্গে
গেছিলো যে,
সেটা আর সারেনি, আর আমি যেহেতু দশ হাতে
দশ দিক সামলাতাম, উনিও পরনির্ভর হয়েই থাকতে অভ্যস্ত হয়ে
গেছিলেন। কিন্তু খোকাদের রওনা করে দিয়ে বাবু যখন ফিরলেন, তখন
তাঁদের বিধ্যস্ত অবস্থা। এক পথ দুর্ঘটনায় যখম হয়ে অর্ধ পঙ্গু অবস্থায় ফিরলেন দু’জনে। খোকারা তখন জাহাজে, কাজেই খবর পৌঁছানো যায়নি।
বহুদিন পর যখন তারা বিলেত পৌঁছে চিঠি পাঠায়, তখন
উত্তরে আমি জানাই খবরটা। বৌরানী বেঁচে থাকলেও আর সুস্থ হতে পারলেন না। বাবু যদিও
বা বছর দুয়েক পর সুস্থ স্বাভাবিক হলেন।
“ধীরে ধীরে বৌরানী কেমন মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে গেলেন। আমায় দেখলেই হিংস্র হয়ে
উঠতেন,
আমি ওঁর বিষয় সম্পত্তি, স্বামী, সন্তান সব কেড়ে নিয়েছি বলে দোষারোপ করতেন। কাজের লোক আবার রাখতে বাধ্য হলাম।
কারণ,
বৌরানী আমার সেবা নেন না, আমার
হাতের রান্না খান না। বাবুকে সারাটা সময় বৌরানীর ঘরেই থাকতে হতো। স্নান খাওয়ার
জন্যও বলতে গেলে চোখের আড়াল হতে পারতেন না। বৌরানী ঘুমোলে হয়ত কোনোদিন চৌধুরী বাবু
বইএর ঘরে বসতেন। বাড়িতে কাজের মানুষ আবার
আসায় ঘরের খবরে রঙ চড়ে বাইরে যেতে লাগলো আর ক্রমশঃ মানুষের মনের ভুল ধারণা দৃঢ় হতে
থাকলো। এরপর,
বৌরানীর মহাপ্রস্থান, বাবুর
পক্ষাঘাত হয়ে কেমন তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকল সব। খোকারা ভাগ্যিস নিজেরা নিজেরা বিয়ে
করে নিয়েছিলো,
না হলে তো, বাবুর ক্ষমতাই ছিলো না দাঁড়িয়ে
থেকে বিয়ে দেবার। আর আমি তো____।
“গ্রামের লোকে বাইরে থেকে যা শুনেছে, নিজেদের মতো করে বুঝেছে
আর সেই কথাই খোকাদের কানে তুলেছে। খোকাদের পক্ষে কী আর বিচার করা সম্ভব? কারণ,
বৌরানী মারা যাবার পর তারা যখন এবাড়িতে এসে থেকেছে, অবশ্যই আমাকে বাবুর ঘরে ঘুমোতে দেখেছে। বন্ধ দরজার ওপারে, তিনি পালঙ্কে আর আমি মেঝেতে কি না সে জানার প্রবৃত্তি তো হয়নি। গ্রামের
লোকেদের কথাই সঠিক মনে হয়েছে তাদের। আর যে বয়সে বা যে শারিরীক পরিস্থিতিতে আমি
বাবুর আয়ার মতো রাতে তাঁর ঘরে ঘুমিয়েছি; সেই পরিবেশে আর যাইহোক, শারিরীক সম্পর্ক হতে পারে না, এটা খোকাদের ভাবা উচিত ছিলো।
হ্যাঁ,
এই সময়ে এসে বাবুর শরীর স্পর্শ করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু
পক্ষাঘাতে পঙ্গু একটা মানুষ আর ঠাকুরের মূর্তির মধ্যে কী কোনো তফাৎ থাকে গো?
“সারাজীবন,
একটা পরিবারের কেউ না হয়েও, তার
পূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ করে গেলাম। রক্ষা করেছি সব, আমি তো
‘রক্ষিতা’ই বৈকী। আমার আর কিছু বলার নেই, চাওয়ারও নেই। কাজেই, খোকারা,
তোমাদের সম্পত্তি তোমরা বিক্রী করবে, না ,
ভাড়া দেবে, সম্পূর্ণ তোমাদের ব্যাপার। এই
রইল চাবি আর এই তোমাদের মায়ের গয়নার বাক্স। কি কি গয়না ওতে ছিলো বা আছে আমার জানা
নেই। তোমাদের জানা থাকলে মিলিয়ে নিও। আর, এই সেই ত’বিলের হিসেব, যার জোরেই আমি এতোবছর তোমাদের মুখাপেক্ষী না
হয়ে তোমাদের পরিবারের সব কাজ সুষ্ঠুভাবে করে গেছি। আমি মুক্তি পেলাম। এবারে বাকি
জীবনটুকু কাশীবাসী হয়ে ভিক্ষান্নে চলে যাবে আমার। তোমরা সুখে থেকো সবাই। তবে, এটুকুই অনুরোধ করবো, এবার থেকে কারোদিকে আঙ্গুল
তোলার সময়ে মনেরেখো, একটা আঙ্গুল তার দিকে হতে গেলে বাকি তিনটে
আঙ্গুল কিন্তু নিজের দিকে আসে।”
ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। কারণ, বসে
থাকলে তো তার চলবে না। রাতের রান্নার তোড়জোড় করতে হবে। সাথে নিজের সম্বলটুকুও
গুছিয়ে নিতে হবে। কাল সকালে সেও বাকিদের সাথেই চলে যাবে সব ছেড়ে, মনস্থির করেই ফেলেছে সে।
“পিসি মা”
ডাক শুনে থমকে দাঁড়ায় চিত্রলেখা। মুহূর্তে চোখ ভরে আসে জলে।
সেই তো,
সেই তো, খোকারা তো ছোটোবেলায় এই বলেই
ডাকতো তাকে। আবার ডাকে ওরা। ফিরে দাঁড়াতে বাধ্য হয় চিত্রলেখা। নাতি নাতনিরা এসে
ধরে ধরে বসায় আবার চিত্রলেখাকে। “কেন ছোটো খোকা? কাল রাত্রে যখন বারেবারে বাবার রক্ষিতা বলছিলে, তখন
একবারের জন্যও মনেপড়েনি যে, আমি তোমাদের পিসি মা হই?” মনে মনে ওদের বলতে ইচ্ছে করলেও মুখে আর আসে না কথা।
“পিসি মা,
মাফ করো আমাদের” পায়ের ওপর পড়ে খোকারা।
“একী!! ওঠো ওঠো। আসলে কী জানো বাবারা অনেক সময়ে নিজের চোখে দেখার মধ্যেও কোথাও
ফাঁক থেকে যেতে পারে। সেটা সরাসরি কথা বলে নিলে সঠিক ভাবে ভরাট হয়। অন্যের কথায়
যদি শূন্যস্থান ভরো, তাহলে এই রকমই হয়ে যায়। তাও তো ধরো, আমি তোমাদের কাছে অকপটে সব স্বীকার করতে পারলাম। যদি সে সুযোগ না পেতাম? সারাজীবন ত্যাগ করার পরেও ‘রক্ষিতা’র আক্ষ্যা পেয়ে মরতাম, বলো?”
“পিসি মা। আর না। একবারও না। তুমি আর ওই কথাটা বোলো না। ছোটোখোকার মনে না থাকতে
পারে,
আমার তো মনে আছে তুমি কিভাবে ভুলিয়ে খাওয়াতে, গল্প বলে ঘুম পাড়াতে। আমার পছন্দের মাছ মাংস সব নাকে কাপড় চাপা দিয়ে রান্না
করতে। অথচ,
তুমি খেতে না সেটা কিন্তু কোনোদিন আমি লক্ষ্যই করিনি। মা কে
আমরা কতোটুকুই বা পেয়েছি? সাঁতার শেখানো, শরীর চর্চা,
প্রথম লেখা পড়া শেখানো, বড় দের
মান্যি করা সব শিক্ষাই তো তোমার থেকে পাওয়া”
“পিসি মা,
আমার সত্যিই এই নামে তোমায় আর ডাকবার অধিকার আছে কি না জানি
না। তবে ওই কথায় আছে না? ‘কুপুত্র যদিই বা হয় কুমাতা কখনও
নয়’
আমি জানি আমায় তুমি ঠিক ক্ষমা করে দেবে। বলো ক্ষমা করোনি?”
“হ্যাঁ বাবারা, আমি তো তোমাদের মা। ক্ষমা না করে কোথায় যাবো
বলো?”
“তাহলে,
তুমি বলো তুমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে না?”
“কিন্তু এতোবড় বাড়িতে একা কী করে থাকি? তারওপর
আর তো আমার শরীর দেয় না, এই বাড়ির যত্ন করা”
“না না আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। যাতে, তোমার
একা থাকতে হবে না, তুমি মনের মতো কাজও পাবে, আবার এই বাড়ির দেখভালের পুরো খরচ উঠে আসবে”
শহরের কোনো এক সংস্থা মোটা টাকার বিনিময়ে, চৌধুরী
বাড়ি কিনে গ্রামের মধ্যে হোম স্টে করবে বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলো। এখন ছোটো খোকা
নিজেই সেই বুদ্ধিটা কাজে লাগাতে চায়। তাহলে চিত্রলেখাকে ঠাঁই নাড়া হতে হয় না।
বাড়িতে আবার কাজের মানুষ, রান্নার ঠাকুর সবাই ফিরে আসবে।
সারাজীবন চিত্রলেখা তো এই কাজই করেছে, ফলে তার মতো করে
"হোম স্টে" ক'জন চালাতে পারবে? শহুরে ব্যস্ততার মাঝে যারা দু’দণ্ড বিশ্রাম খোঁজেন, তাঁদের বেড়াতে আসার উপযুক্ত ব্যবস্থা হবে। গ্রামের মানুষদের কর্ম সংস্থান
হবে।একা একা থাকতে হবে না চিত্রলেখাকে। আর বড় খোকা, ছোটো
খোকা চাকরি থেকে অবসর নিলে বা প্রয়োজনে তাড়াতাড়ি অবসর নিয়ে; সপরিবার পাকাপাকি ভাবে চলে আসবে
এই বাড়িতেই। তারা ফিরে এলেই অখণ্ড অবসর চিত্রলেখার। আপাততঃ, চিত্রলেখার তত্ত্বাবধানে চলবে চৌধুরী হোম স্টে। একদিন তাকে আশ্রয় দিয়ে
সসম্মানে এই পরিবারে স্থান দিয়েছিলো পরিবারের ঊর্ধতন প্রজন্ম। তার 'রক্ষিতা'
বদনাম ঘুচিয়ে হারানো সম্মান ফিরিয়ে দেবে চৌধুরী পরিবারের
নতুন প্রজন্ম।
মৈত্রেয়ী
চক্রবর্তী
Opurbo
উত্তরমুছুন