ধনপতি সদাগর এক প্রতিবাদ
জয়তী রায়
মঙ্গল কাব্য এই কাহিনীর সূত্র হলেও
আমি দেখাতে চেয়েছি এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী ধর্মের বিরুদ্ধে ধনপতির প্রতিবাদের
জায়গাকে। সাধারণ মানুষের ভয় থেকে কিছু দেবদেবীর উৎপত্তি হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে রুখে
দাঁড়িয়েছিলেন সমাজ সচেতন মানুষ। যদিও জিতে যায় ঐ ভুঁইফোড় দেবীরাই। নিচু স্তরের
মানুষের কাছে আগেই অনেক আদর পেত এই তুকতাক
সাপখোপের দেবীরা। কিন্তু লক্ষ্য ছিলো উঁচু
মহলে ঢোকার ছাড় পত্র। তার জন্য অভিজাত সমাজের পূজো চাই। সে সময়ে বণিক সম্প্রদায়
ছিলো বাংলার প্রধান। তাঁদের বশ করতে পারলে উঁচু সমাজের ছাড়পত্র জুটে যাবে অনায়াসে!
বণিক সমাজও রুখে দাঁড়ালো এই অন্যায় ভাবে পূজো নেবার বিপক্ষে। কি হলো শেষ পর্যন্ত? সেই
নিয়ে আজকের কাহিনী,,,,,
বিস্তীর্ণ
জলরাশি। যতদূর চোখ যায় জল জল আর জল। সকালের রোদ পড়ে ঝিক মিক ঝিক মিক করে। যেন কচি
শিশুর মুখের হাসি। এখন কে বলবে তুফানের ছোঁয়াতে কেমন ফুঁসে উঠে কাল নাগিনীর মতো
ছোবল দিতে চায়? হিল হিল জিভ বার করে খেয়ে নেবে
বড়ো ডিঙ্গা ছোট ডিঙ্গা সব। জল যেমন জীবন জল তেমন সর্বনাশা।
সপ্তডিঙ্গা চলছে তর তর। সবচে বড় ডিঙ্গার নাম মধুকর।"গায়ে সোনার কাজ।
পত পত করে ত্রিশূল আঁকা পতাকা। ডিঙ্গার
মুখ মকরমুখো। সূঁচালু। পাছু মাছের ল্যাজ দিয়ে ঘেরা। দৈর্ঘ্য প্রস্থে বিশাল কলেবর। মধুকরের মাঝখানে
দু খানি ঘর। দুটি ঘর সোনার তৈরী।
ঘর দুটির দু পাশে নাইয়াদের বসার জায়গা। মধ্যভাগে বসে কান্ডারী।
পরের
ডিঙ্গা "দুর্গাবর। "এটির আছে জল দেয়াল। খোলের ভিতর খোল। গজ দন্তের কাজ
করা ডিঙিতে মা দুর্গার মুখ আঁকা।
পরের ডিঙ্গা "শঙ্খচূড়।" দৈত্যাকৃতি এই ডিঙ্গা আশি গজ জল ভাঙে।
শঙ্খচূড়ের নামে সব দুষ্ট আত্মা দূরে থাকে।
"চন্দ্রপাল "ডিঙ্গা মনোহর। আলো দিয়ে ঘেরা। চন্দ্রপাল যখন পাল তুলবে
তখন গরবিনী বধূর মতো রূপ পড়বে ফেটে।
"ছোটমুঠি" ডিঙিতে যাবে চাল।
ডিঙ্গার গায়ে আঁকা ধানের ছবি। ছোটমুঠির গায়ে রূপার কাজ , আঁধার
সাগরে জ্বল জ্বল করে।
"গুয়ারেখি" ডিঙ্গা ডুবুরি
নিয়ে যায়। পান সাজতে গুয়া, মান রাখতে গুয়া। সিংহমুখী
গুয়ারেখির দিমাগ আছে। পতাকায় সিংহের মুখ।
শেষ ডিঙ্গা "নাটশালা। "ওটিতে
গাবরদের (জোয়ান নাবিক) বাস। কৌতুক মজা তামাশায় ভরপুর। মানুষ বেশী রঙ্গ বেশী।
নাটশালার গায়ে হরেক কারুকাজ। ঢোল কাঁসির। বেনু বাঁশির।
সাতখানি ডিঙ্গা ভাসে জলে।
কান্ডার বুধন মধুকর ডিঙ্গায় থাকবে সবার আগে।
অভিজ্ঞ কান্ডার (ক্যাপ্টেন) সে। ধনপতি
সওদাগরের বাবা জয়পতির সঙ্গে নদী পথে
বাণিজ্যে একাই একশো বুধন জলের রং দেখলে বলে দেবে সব। এখন তাঁর বয়সে জরা। চোখে
ধোঁয়া। দেহে রস। কিন্তু জয়পতির ছেলে ধনপতিকে নিজের চোখের সামনে রাখবে। নদীর
অভিজ্ঞতা সাগরে কাজ দিবে গ?
ও কান্ডারী? জলের ভাষা বোঝে বুধন। নদী তো মেশে
সাগরে!
মধুকরের
পরের ডিঙা দুর্গাবরে আছেন ধনপতি। দুলে ওঠে
সপ্ত ডিঙ্গা। হুই চলে বাংলার প্রথম সাগর
পাড়ি দেওয়া সদাগর। শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে
থাকে প্রিয়া খুল্লনা,
ছ মাসের গর্ভ। বুক ঢিপ ঢিপ করে।
*
ছাদের
ঘরে জরি আর সাটিনের পর্দা ঝোলে। মখমলি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ফুরফুরে হাওয়াতে গড়গড়া
টানছেন ধনপতি সওদাগর। বাম নাসায় আঁচিল, বক্ষে ছয়
তিল, কপালে নিত্য শিবপূজার প্রণতি চিহ্ন।
দৈবজ্ঞ
বলেছিলো--" অ সাধু ধনপতি গ। কাউ( কাক) লয়ে সিংহল যাত্রা করোনা গ। নবমী শুভ
লয়। দশমীতে তিথি দোষ। রাতের অন্ধকারে
আগুনের চাঁই খসবে সাগরে। বড়ই করাল রূপ। ফনা তোলে সাগরের ঢেউ। গৃহে থাকো সাধু।
বাণিজ্য যাবা, অর্থ পাবা না। সাগর যাত্রা শুভ
না সদাগর।"
ঝটকা মেরে ওঠে ধনপতি। সাগর শুভ না? সব ধন তো
সাগরে। আকাশে কিছু নাই কেবল কাউ আর চিললোক (চিল)।
মাটিতে কেবল কাম আর অর্থ। নর জন্মে নিত্য কাম। ছয়মাস ঘরে থাকতে বলে দৈবজ্ঞ।
বলে --" যেয়োনা সাগরে সদাগর। সর্বনাশ হবে। বন্দী হবে। পথ নাই। শুধু প্রমাথ
প্রমাদ প্রলয় আর প্রয়াণ। "
ধাক্কা মেরে তাড়ালেন গণককে। ব্যাটা, অন্ন খায় পৃথিবীর গুণ গায় গগনের?
ইহলোকে বাস পরলোকে অবস্হান? দ্বিচারী গণক জাত।
মার গণককে।
দেমাক
নয় সাহস। নোনা জলে মানে সাগরে ভাসবে ডিঙি। এখনো কেউ যা করেনি তিনি করবেন, যাবেন
সিংহল। চন্দন কাঠ, লবঙ্গ, কুমকুম
কস্তুরী গন্ধচুয়া ভোট কম্বল আনবেন ডিঙ্গা ভরে। খুশী হবে দেশের রাজা। মাথা উঁচু হবে
সাধুর। আর সেখানে কিনা মেলা কথা ? নফরকে ডাকে সাধু। মধুকর ডিঙ্গা পাখির
মতো ভাসে। নফর হাত জোড় করে দাঁড়ায়। চাঁদ বলে ," এবার গিয়ে গণকের পাছায় লাথি
দিবি তিন।"
*
ভ্ৰমরা
গাঁয়ের নদী। নিত্য সঙ্গী। তার উপর দিয়ে চলা মানে সখার সঙ্গে গপ্পো
করতে করতে ডিঙ্গা বাওয়া। বুধন কান্ডারী হাঁক পাড়ে---" ডর নাই ডর নাই। চেনা জল
চেনা জল ডর নাই!" পিছন থেকে জবাব আসে --- ডর নাই। চেনা জল ডর নাই।"
ডিঙ্গা চলে প্রহর পেরিয়ে। নাটশালা ডিঙ্গা থেকে গান ভাসে--
" আমার বাড়িত গেলে মাঝি
বসতে দেব পেড়া
জলপান যে করতে দেবো
চিকন ধানের চূড়া।।
*
হেমন্তে
যাত্রা শুরু সাধুর। হেমন্তের হিম পড়ে জলে। রাত গভীর হয়। আঘন হিম ঘুমে নিথর জল, নীরব ডিঙ্গা
জল কেটে এগিয়ে চলে। বুড়োন মাঝি চোখ পাতে
আকাশে। চেনা ভ্রমরার কোল ছেড়ে ডিঙ্গা চলে অজয় নদের দিকে। বড়ো নদ। উদ্দাম উত্তাল
স্রোত দেখে বৃদ্ধ বুড়োনের চোখ অবাক। ডিঙ্গা লাফিয়ে চলে অজয় ছেড়ে ভাগীরথী অভিমুখে।
প্রণতি জানায় সাধু ধনপতি ভূতনাথের চরণে।
ডিঙ্গা গিয়ে থামে ভাগীরথী অজয় সঙ্গমে। নিষ্কলঙ্ক শুদ্ধ পবিত্র স্রোত সঙ্গম।
ধনপতির সপ্তডিঙা নিথর। রাত গভীর। সাধু করজোড়ে আরাধ্য দেবতা শিব কে ডাকে। শৈব সাধনা
মহান। জলে জঙ্গলে গ্রামে গঞ্জে পুরুষ পূজো
হবে। শিব পূজা। এবার সিংহল ঘুরে এলে আরো শক্তিশালী হবেন সাধু। আরো প্রচার করবেন
ভূতনাথের। ডিঙ্গায় ওঠার সময় লাথি মেরে ভেঙ্গে দিলেন চন্ডীর ঘট। আস্পর্ধা
নারী দেবতার। পুরুষের সঙ্গে সমান পূজা চায়। স্ত্রী লিঙ্গ দেবতা ছাই দেবতা। তাঁর
পূজা করলে বেনে সমাজে একঘরে হতে হবে। চাঁদ
সদাগর কত মার খেলো,
চ্যাঙ মুড়ি কানি দেবীকে তবু ছুঁড়ে দিলো বাম হাতে ফুল। দেবী কে পাছা ঠেকিয়ে বসতে দিলে রক্ষে আছে?
ধনপতি তাঁর বউ খুল্লনার
চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলেন। লাল চোখ দেখিয়ে বলেন --" আমি ধনপতি সদাগর। আমার
বাটিতে স্ত্রী লিঙ্গ অনার্য চন্ডীর পূজা?
জাত কুল সব যাবে!"
ধনপতি, সওদাগরের সদাগর। তারাদের মধ্যে যেমন চাঁদ, সদাগরদের
মধ্যে ধনপতি। তিনি যা করবেন, আদি বাঙলা সেদিকে যাবে। নবদ্বীপ
সপ্তগ্রাম মোগ্রা নীলাচল সব জায়গাতে রমরমা। দেশের রাজা হাত পেতে থাকে । সয়দাগর
কুপিত হলে দেশ অন্ধকার।
রাজা খাতির করে, দেশ খাতির করে, শিবের পূজো বেড়ে চলে গাঁয়ে গঞ্জে। আর অনার্য দেবীর পূজো হবে লুকিয়ে
চুরিয়ে। বৌ ঝি ঘট পাতবে। মনসার সাপের ভয়, চন্ডীর শাপের ভয়--
তবু পূজো বাড়ে না। দেবীদের মনে বাসনা, পূজো হোক তাদেরও! সয়দাগর
জাত রাজ্য শাসন করে। তাঁরা না মানলে দেবী পূজা জাতে উঠবে না।
মন খারাপ দেবীদের। রাগে দাঁত কিড়মিড়।
চাঁদ সয়দাগর বাম হাতে ফুল ছুঁড়ে দিলেন, মনসার পূজো চালু হলো। এখন যদি ধনপতি
পূজো করেন চন্ডীর তবে কাজ হয় একটা। পূজো
দূর, ঘটে লাথ মারে
ধনা?
চন্ডী ফুঁসে ওঠেন। মনসাকে বলেন নাগ বাহিনী নিয়ে আসতে। চিল্লাতে থাকে চন্ডী।
তাঁর এই লাঞ্ছনার কথা জানতে পারলে কেউ আর পূজো করবে তাঁকে? ধনপতির
নিপাত চাই। নতুবা কেউ মান্য করবে না তাঁকে। পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেন চন্ডী।
পদ্মার বুদ্ধি বেশী। সে আগেই চাঁদ সয়দাগরের সঙ্গে অনেক খেল খেলেছে। চাঁদ
বলেছিলো পাঁচ কুলীনের এক কুলীন সে। তাই চ্যাঙ মুড়ি কানির পূজো করবে না। তাঁর ধামে
মনসার প্রসাদ মিলবে না। মনসার মুখে ব্যাঙ চ্যাঙ ছুঁড়ে দিলো। ছানাদের (সাপ) বললেই
মেরে ফেলত চাঁদকে। তবে আর পূজো হতোনা মনসার। ঘরে ঘরে এমন নাগ পঞ্চমী হতো না। দুধ
দৈ মিষ্টান্ন অর্থ প্রতাপ ছড়াছড়ি। চাঁদকে মারলে হতোনা কিছুই। মনসা তাই বুদ্ধি দেয়
পূজো পেতে হলে ধনপতি বিনা হবে না গো মা। প্রাণে মেরোনা। মৃত্যু যন্ত্রনা তো
ক্ষণিক। আর সে মৃত্যুতে তোমার ভক্ত খুলনার কষ্ট বেশী। চাঁদ অনেক তেজী ছিলো গো মা।
ধনপতি সিধা মানুষ।
---" তবে? কি
করে ধাতে আনবো ধনা কে?"
----" সদাগর চলুক সপ্তডিঙা চড়ে
দক্ষিণ পাটনে (নৌবাণিজ্য কারণে সিংহল দেশ যাত্রা)। " মনসা হিস হিস করে
বলে-----" করুক বেচা কেনা। মা চন্ডী গো , আমি ঠিক সময়ে
ছ খানি ডিঙ্গা রসাতলে পাঠিয়ে দেব।
থাকবে শুধু দুর্গাবর আর মধুহীন ধনহীন ধনপতি।
ধনা দেখবে মাঝদরিয়ায় ভাসছে তুচ্ছ ডিঙি, আর ডুবছে তাঁর অমূল্য পণ ভর্তি ছয়
তরী। প্রাণে মারবো না গো। তবে এমন হাল করবো যে হালে পানি না পেয়ে পূজো করবে তোমার
সয়দাগর। "দুই দেবীর শলা অভিসন্ধি বিষ হয়ে জ্বলতে থাকে। ধক ধক করে লাল আঁখি। দাঁত বেরিয়ে পড়ে। জিভ
শানাতে থাকে। ছুঁয়ে ফেলতে চায় মুক্তবেণীর
পথে চলতে থাকা সপ্তডিঙা।
ত্রিবেণী সঙ্গমের জল পবিত্র। সাধু ধনপতি বেরিয়ে আসে বাইরে। করজোড়ে সঙ্গমপথে
দাঁড়ায়। দুপুরের সূর্য জলে ভাসে। স্নান সেরে দান সেরে
সপ্তডিঙ্গার নাইয়া গাবর নিয়ে যাত্রা শুরু করে ধনপতি।
সপ্তগ্রামে বাণিজ্যে আসে দুরদুরান্তের সদাগর। অঙ্গ বঙ্গ তেলঙ্গ কলিঙ্গ মগধ
মহারাষ্ট্র গুজরাট লঙ্কা কাঙ্গুর ত্রিহট্ট নাও ডিঙি নিয়ে আসে সব। বেলা বাড়লে আরো
চঞ্চল হয় সপ্তগ্রাম। সদাগর সদাগরকে কুশল বিনিময় করে। ক্রয় বিক্রয় হয়। রাত
বাড়ে। সুন্দরী বেশ্যারা ঢোকে সদাগরদের ঘরে। আনন্দে রাত কাটে। প্রবাহিত নদী স্রোত
বেয়ে পরের দিন কেটে যায় আয়েশে, মাঝরাতে দুলে ওঠে সপ্তডিঙা। বাহ বাহ ডাক পাড়ে
বুড়োন। সপ্তগ্রামের বাতি দূরে সরে যায়। মগরা বন্দর যাবে সপ্তডিঙা। নিশ্চিন্তে মহাদেব পূজো
করে ধনপতি। ওদিকে দেবীদের ষড়যন্ত্রে রণদামামা বাজতে থাকে জলতলে। ফুলে উঠে জল। পথ
হারায় কান্ডার। নদী যেন সাগর। নাইয়া হাঁক পাড়ে সামাল সামাল। কান্ডার অবাক। এমন হবার কথা নয়। শান্ত সাপের মতো নদী আজ
উদ্দাম। ধনপতি উচ্চস্বরে শিব ভজন গাইতে থাকে। শিব শিব মহেশ মহেশ। উত্তাল তরঙ্গে
ভাসতে থাকে শিবনাম। আকাশ বাতাস শিবনামে ভরে ওঠে। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বনার কাছে দেবনাম সাময়িক হেরে যায়, নাকি ভক্তের
পুরুষকারের পরীক্ষা? ধনপতি দেখে তাঁর সাধের ডিঙ্গারা জলতলে
যায় একে একে। দুর্গাবর একা ভাসে। বান্ধবহীন। বুঢ়া কান্ডারী বুড়োনের চোখে অপার বিস্ময়। কেমন করে ডোবে এমন
ছয় ডিঙ্গা? যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে? কোনো
চিহ্ন পর্যন্ত নাই? গাংচিল পাক খায় আর বলে নাই নাই নাই নাই।
দুর্গাবর অনিশ্চিত এক যাত্রা শুরু করে। এবার দক্ষিণে। একা
চলে দুর্গাবর। একা ভাসে দুর্গাবর। ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে ধনপতি। অতুল ঐশর্য
নিয়ে ডুবে গেছে ছয়খানি ডিঙ্গা। ধনপতি হাত দুখানি মুষ্টিবদ্ধ করে। নফর এসে দাঁড়ায়
পাশে। ফিস ফিস করে বলে ----"দেবীদের পূজো করবেন নাকি হুজুর?" ধনপতি চমকে তাকান। কর্কশ শব্দে উড়ে যায় চিল। দুলে ওঠে দুর্গাবর। মাঝি হাঁক
দেয় সামাল সামাল। নফরের মুখ নয় যেন পূজা লোভী দেবীর মুখ?
নীলাচল দেখে শান্ত হন ধনপতি। মনে মনে আরো প্রতিজ্ঞা করেন কিছুতেই ঐ চ্যাঙ
মুড়ি কানিদের কাছে নিজেকে বিক্রি করবেন না। গরিব মানুষদের অভিশাপের ভয় দেখিয়ে, ঘরে সাপ
ঢুকিয়ে, ভেদ বমি করিয়ে
নিজেদের পূজো আদায়ের মতলব এই দেবীদের। ভয় এদের প্রধান অস্ত্র। ধনপতি ভয় পান
না। এক ডিঙ্গা নিয়েই এগিয়ে যাবেন। ভয়ের
কাছে নতি স্বীকার নয়।
প্রহর যায়। সাগর শান্ত হয়। নীলাচল ছেড়ে এগোয়
দুর্গাবর। রাত গাঢ় । জলের রং কৃষ্ণবর্ণ। তারপরে চন্দ্রের কিরণ ঝল মল ঝল মল। পাল
নামায় কান্ডারী। তর তর বয়ে যায় দুর্গাবর। কথায় বলে সাগর না পেরোলে কেউ সদাগর হয়না।
তবে সাগরে সতর্ক থাকতে হয়। রাত কেটে যায় ভোর হয় শঙ্খদ্বীপে এসে। সাদা বালি, কত শত শঙ্খ--- দ্বীপ খানি যেন সাদা
ফুল একটি। হিম পড়ে সাদা বালি আরো সাদা। উজানিনগর থেকে যাত্রা শুরু হয়ে এখন
শঙ্খদ্বীপ। উত্তরা বায়ুতে হু হু করে শীত।
হিমে রাত আরো অন্ধকার। যাত্রা শুরু করে দুর্গাবর। এবার গন্তব্য সিংহল। রামের সেতু পার করে। তর তর করে এগোয় ডিঙ্গা। প্রাণে জল আসে ধনপতির।
একলা ডিঙ্গা নিয়েই পার হবেন সাগর। হুঙ্কার
দেন----" হেই শিবো শিবো হেই,,,,,
সব
মাঝি মাল্লা যোগান দেয় ---- " শিবো হেই,,,,
দেবী চন্ডী ভয় পেয়ে মা মনসার হাত চেপে ধরেন --
তোর আর কি অস্ত্র আছে রে?
খবর আসছে ধনপতি পৌঁছুলো বলে!'
মনসা বিষ হাসি হাসেন ---" এখনো অনেক
বাকি। সাগর আমার চেয়ে বেশী কে চেনে? সাগরের নীচে যত মণি মুক্তো ততো আমার
অনুচর। ডিঙ্গা ঘুরিয়ে দেবে মায়া জলের উপর দিয়ে। দেখবে কমলে কামিনী। মজা দেখো
তারপরে।"
চন্ডী কি বোঝেন না বোঝেন কেবল মাথা নাড়েন।
তিনি দেখেন ধনা কালিয়াদহে তারকা গোনে। সিংহল দেশ আর দূরে নেই। মনসার মনে কি খেলছে সেই জানে?
সিংহল প্রায় এসে গেছে। ধনপতির নাকে ভেসে আসে তীব্র সুবাস। কান্ডার অবাক হয়।
সদাগর গন্ধ পায় তারা পায়না। কান্ডার বিপদ বোঝে। ধনপতি দেখতে পায় সাগর জুড়ে অসংখ্য
শ্বেত, লাল, নীল পদ্ম ফুটে আছে। মাঝে একটি বড়ো পদ্ম । এক হাস্যবদনা রতিসুন্দরী রাজরূপী কন্যা বসে
ডাকে সদাগরকে। সংজ্ঞাহীন কামজর্জর ধনপতি সাগরের দিকে ধায়। আতংকিত নাইয়া আঁকড়ে ধরে
জল ছিটা দেয়। ডিঙ্গা দ্রুত এগোয়। নিশিবিকার হয়েছে সাধু সওদাগরের। পাল তলো রে।
ভাগো। ভাগো। সাধুকে ছই ঘরে পাঠিয়ে দাও।
ডিঙ্গা চলে পাল তুলে। তরঙ্গে তরঙ্গে খেলা রঙে নানা রং। দিনমণি ওঠে ডোবে।
কূল নাই কিনারা নাই। নোনা জলের রাশি। দূর হতে দেখা যায় এক সবুজ রেখা। নাইয়া চেঁচায়
" ডাঙ্গা ডাঙ্গা"। পাল নামে ধীরে। কান্ডার হাঁকে---" রত্নমালার
ঘাট!" মনে আনন্দ নামে । উল্লাসে
চেঁচায়, দামামা বাজায়। সাধু নামে ডিঙ্গা হতে। সামনে এক বেল গাছ। সাধু তাঁর নীচে
বসে ধ্যান করে। চোখ খুলতেই দেখেন রাজ্যের কোটাল। বিকট স্বরে বলে রাজপুরীতে ঢুকেই দামামা বাজাও কেন বাপ ?
চলো রাজার কাছে!"
ফুঁসে ওঠে ধনপতি । ফুঁসে ওঠে নাইয়া কান্ডার----" আমি বিদেশী। প্রীতি
পেলে থাকবো নয়তো যাবো। ধনপতি সদাগর এতো কথা শোনার বান্দা নয়!" কোটাল দিগারি ( ঘুষ) চায়। পরে অন্য কথা। উত্তেজিত
সাধু বলে--" কিছু কাজ কল্লি না , শুধু মুদু চোখ রাঙ্গাস, কাহন ( পয়সা) চাস। বড়ো দুষ্ট লোক তুই।" ধনপতি অন্যায় সহ্য করেনা।
সোজা মানুষ। কোটাল বোঝে এ ভয় পাবে না। সে মানে মানে সরে পড়ে।
পরদিন ধনপতি সিংহলরাজ দর্শনে যাবে। ভেট কিছু আছে সঙ্গে দুর্গাবরে। কিছু
লঙ্কা দ্বীপ হতে কেনে। প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে সাধু চলে রাজ সমীপে আর মনে ভাবে রাবণ
রাজের দেশ এটি। রাজপুরী সুন্দর সুরক্ষিত। পাথর আর কাঠ দিয়ে বানানো। রাজার সমুখে গিয়ে নিজের পরিচয় দেয় ধনপতি
---"আমার বাস গৌড় দেশে। চামর চন্দন শঙ্খ নিতে সাগর পাড়ি দিয়ে সিংহল আগমন।
জাতিতে আমি গন্ধবণিক। উৎপত্তি দত্ত কূলে। স্থিতি গঙ্গার নিকটে উজবেনিতে
(উজ্জয়িনী)। "
রাজার আদেশে সাগর যাত্রার গল্প
শোনায় সাধু। কিভাবে সব ডুবে গেলো। কমলে কামিনীর গল্প বলে। যে কামিনী এক মুখে এক
হাতি খায় অন্য মুখে উগরে দেয়। এই গল্প হজম
হয়না কারো। মিথ্যাবাদী বলে গাল পাড়ে। ধনপতি রেগে গিয়ে শর্ত করে ---"যদি
মিথ্যা হয় আমার বাক্য কারাগারে প্রবেশ করব বারোবছরের জন্য। "
রাজসভা স্তম্ভিত। এ কি আত্মবিশ্বাস না অহংকার? রাজা
বলে-/" সাধু স্থির হও। সুরাপান করে ভুল বলছো।" সাধু রোষে ওঠে। স্থির হয়
যাবে সব কালিয়াদহে কমলে কামিনী দেখতে।
না। কমলে কামিনী দেখাতে পারেনি ধনপতি। কোনো মৎসকন্যা নেই। কমল নেই। কামিনী
নেই। সব হতাশ। মনসার সেরা ছলনা এটি। ধনপতির কান্ডার সাক্ষ্য দেয় সেও দেখে নাই কমলে
কামিনী। মিথ্যাবাদী প্রমাণিত ধনপতি। বন্দী
হয়ে যান কারাগারে। ডিঙ্গা লুন্ঠন করে নেয় সব ধন। কান্ডার নাইয়া সব অসহায়। দেশে ফেরা
আর হবেনা।
কারাগারে বন্দী ধনপতি। সোজা শরীর। উন্নত চক্ষু। ঘন অন্ধকার বন্দী কক্ষে কে
যেন ফিস ফিস করে বলে ----" ধনপতি অ ধনপতি। কমলে কামিনী করে দেখবো রাজাকে।
তোমার পুত্র জন্মাবে। সপ্ত ডিঙ্গা ফিরিয়ে দেবো। একবার চন্ডী নাম কর। সব ফিরে পাবি
তুই।"
ধনপতি সপাটে লাথি মারে অন্ধকারে। এবার গর্জন করে দেবী। নানা রকম অমঙ্গলের কথা বলে। নিজের শক্তি
দেখানোর কথা বলে। লোভের কথা বলে। বলে বলে বলে ক্লান্ত চন্ডী অনুনয় করে--/-//---
" একবার চন্ডী নাম করবি সাধু?"
কোনো উত্তর নেই। আবার ডাকে চন্ডী --- ধনা?" উত্তর নেই। ধনপতি
কারাগারের পাথরের মেঝেকে আঁকড়ে গভীর ঘুমে নিমগ্ন।।
জয়তী রায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন