সন্তান
কোয়েলী ঘোষ
খুব ভোরে উঠতে হয় কাবেরীকে। এই সময় না উঠলে দুটো মেয়েকে তৈরি করে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে আসা, দুটো করে টিফিন বক্স তৈরি করা, পর পর যন্ত্রের মতন কাজ। জি টি রোডে বাস আসে ঠিক
সকাল সাড়ে সাতটায়। হুড়মুড় চলে সেই সকাল থেকেই। প্রবাল ঘুম থেকে তোলে,ব্রাশ
ধরিয়ে দেয়। স্নান করে খেয়ে ওরা চলে যায়।
রাস্তা পেরিয়ে তুলে দিয়ে আসে প্রবাল। ফিরে এসেই সেও বেরোবে। এইসময় মনে হয় আরও দুটো হাত থাকলে ভাল হত কাবেরীর।সাড়ে আটটার মধ্যেই ভাত খেয়ে সেও দৌড়োয়। অফিসের বাস এসে দাঁড়ায়।
রাস্তা পেরিয়ে তুলে দিয়ে আসে প্রবাল। ফিরে এসেই সেও বেরোবে। এইসময় মনে হয় আরও দুটো হাত থাকলে ভাল হত কাবেরীর।সাড়ে আটটার মধ্যেই ভাত খেয়ে সেও দৌড়োয়। অফিসের বাস এসে দাঁড়ায়।
এবার একটু বসতে সময় পায় সে।
হাউসলোণ পেয়ে শহরতলীতে একটা ছয়শ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট
কিনেছে প্রবাল। তিনটে ব্লক, লিফট আছে। নতুন ফ্ল্যাট বলে এখনও কারো সাথে আলাপ হয়
নি।
#
#
বাজারটা সকাল সকাল বেশ জমে ওঠে।তখন বাবুরা বাজারে আসে। যা দাম বলে কিনে নেয়
থলে ভর্তি। কাবেরী বলে --থাক, বাজার আমি ধীরে সুস্থ্যে করব। কাজের মেয়ে কাজ করে
বেরিয়ে গেলে সেও থলে নিয়ে বেরোয়। দর দস্তুর করে সবজি,মাছ কেনে।
এ ব্লকের এক মহিলা বেশ বয়স্ক। পা টেনে টেনে বাজারে আসেন। দেখা হয়ে যায়। রোজ তিনি এক গাদা সবজি, মাংস
কেনেন।
আপনার বাড়িতে কেউ নেই? এত কষ্ট করে বয়ে নিয়ে যান ---
তিনি হাসেন। সবাই আছে,
আমার সন্তানেরা, দুপুরবেলা নীচে এসো,দেখতে
পাবে। একটা নাগাদ,কেমন?
দুপুর একটা বাজলেই সেই বয়স্কা মহিলা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নামেন। হাতে মস্ত বড় এক গামলা। তাতে ভাত,ডাল,সবজি,মাংস মেশানো খিচুড়ি, শালপাতায় একে একে খিচুড়ি তুলে দেন। আয় লালু, আয় ভুলু,আয়
কালু --সব খেয়ে নে। এরাই তবে সন্তান। পাত চেটে চেটে খাওয়া হলে আর এক হাতা করে মায়ের মত এগিয়ে দেয়, আর একটু খা --- পেট ভরেছে?
কাবেরী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে আর ভাবে, আজকের এই নিষ্ঠুর দুনিয়াতে এমন মানুষ আছেন ---
সিঁড়িতে বসে দুজনে গল্প করে। বৃদ্ধা বলেন -- নিজের ছেলেমেয়ে হয় নি জানো! ঘোলাটে দৃষ্টি যেন বহুদূরের কোন
স্মৃতির বাঁকে পথ হারায় ---
কত টুকুই বা বয়স ছিল। সেই কবে এসেছিলাম
শ্বশুরবাড়ি। যৌথ পরিবারে কত মানুষ! তোমরা যেমন মেশিন
পাচ্ছ কাপড় কাচার, মিক্সারে মশলা, লাইটার জ্বাললেই আগুন তেমন কি ছিল? কয়লার উনুন, দুম দুম করে কয়লা ভাঙা, ঘুঁটে সাজানো, ধোঁয়া,কালি --আর কালিময় এক জীবন। দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে বড় ক্লান্ত। কেটে গেল কত বছর, মা হতে পারলাম না। বাঁজা বলে গালমন্দ
খেতাম বাড়িতে। ফুরিয়ে এল জীবন। সেই বিরাট বাড়ি ছেড়ে শেষে এই ফ্ল্যাট।
আর আপনার স্বামী? তিনি কি করেন?
একই ফ্ল্যাট, ঘর
আলাদা, বিশাল প্রাচীর। মাঝে মাঝে খুব একা লাগে, নিঃসঙ্গ। যত তাড়াতাড়ি ভগবান নিয়ে নেন ততই ভাল।বাঁচতে ইচ্ছে করে না।
নির্জন দুপুরে কথাগুলো পাক খেয়ে খেয়ে মরে --
আপনি খেয়েছেন?
হ্যাঁ।
লালু,ভুলুরা
তখন খেয়ে দেয়ে ল্যাজ নাড়ছে। মাথা নড়িয়ে বললেন ---
মানুষের চেয়ে এরাই ভাল বুঝেছ?
তা যা বলেছেন। কাহিনীগুলো প্রায় সব এক।
কাবেরী ঘড়ি দেখে। পিঠে ব্যথা করে। আজ দুপুরে একটুও শোয়া হল না। আচ্ছা মাসিমা,এবার উঠি, একটু
পরেই মেয়েদের আনতে যেতে হবে। আপনিও ঘরে যান। যদি কিছু দরকার হয় আমার ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখুন। আমি আসব।
তিনি হাসলেন। ভাল লাগল তোমাকে। পরের দুঃখের কথা কে ভাবে বল! একটা কথা বলব? আমি চলে গেলে এদের একটু খেতে দেবে?
দেব। আপনার মতন করে না পারলেও
যতটা পারব। আমিও ভালবাসি এদের। তিনি হাতে হাত রাখলেন। কি কর্কশ হাত, হাজার শিরদাঁড়া নীল হয়ে গিয়ে ওপরে উঠেছে। আস্তে আস্তে উঠলেন তিনি।তারপর পা টেনে টেনে চললেন। অনেক পুরনো একটা গান গাইত কাবেরী। তার শেষ দুটো লাইন মনে
পড়ল। ''এ জীবনভার হয়েছে অবহ, সঁপিব
তোমার হাতে -- ''
#
#
বিকেলে মেয়েদের নিয়ে কাছেই মাঠে নিয়ে যায়। এক দল মেয়ে ক্যারাটে শিখছে, সাদা
ড্রেস। এখন মেয়েদের এটাই রেওয়াজ। শক্ত করে গড়তে হবে,লড়তে
হবে। নিজেদের নিরাপদ রাখতে হবে। এদেরও ভর্তি করে দেবে
কাবেরী পরের মাসে। কাল ছোট মেয়ে বলছিল --ম্যাম আজ শিখিয়েছেন
কি জানো?
কি রে?
গুড টাচ, ব্যাড
টাচ --- কেউ গায়ে হাত দিলে বলবে --- ডোন্ট টাচ।
এসব কাবেরীদের সময়ে কেউ কি বলেছিল? মেয়েদের খুব সাবধানে রাখতে হবে। সবসময় চোখে চোখে,
যা হচ্ছে সব।
বিকেলে ফিরে দুধ সুজি বানায়। প্রবাল ফিরে আসে ছটা নাগাদ। কাবেরী চা বানায়। বানাতে বানাতে দুপুরের ঘটনা বলে।
জানো এক মাসীমার সাথে পরিচয় হল। তিনি রোজ কুকুরদের খেতে দেন।
প্রবাল বলে --হ্যাঁ জানি। এসব একপক্ষ গল্প শুনো না। উনার স্বামীর সাথে
পরিচয় হয়েছে। তিনি রোজ সামনের হোটেলে ভাত খান, জানো? এদিকে
রাজ্যের কুকুরদের জন্য রান্না হয় আর স্বামীর জন্য রান্না হয় না?
কাবেরী অবাক হয়। না,
এত কথা হয়নি। এসব ব্যক্তিগত কথা সে
জানতেও চায় না। তবে সেই স্পর্শ, সেই একাকীত্ব কোথাও ছুঁয়ে গেছে।
মেয়েগুলোকে পড়তে বসাতে হবে। বেশ চাপ আছে স্কুলে।
#
#
দিন যায় --এক একদিন এক এক ঘটনা শোনা যায় ফ্ল্যাটে। ঘটনা রটনা করে কাজের মেয়েরা। এক একজন সাত আটটা
বাড়িতে কাজ করে। এ বাড়ির খবর ও বাড়িতে পাচার হয়। গল্প বেশ মুখরোচক।
জানো তো অবাড়ির মেয়ে ও বাড়ির ছেলের সাথে পালিয়েছে।
রায় বাড়ির বউ এমন ক্যাট ক্যাট করে কথা শোনায় যে কি বলব!
বাসন মাজতে মাজতে বকবক! এ এক যন্ত্রণা।
শোন, আমার
বাড়ি কাজ করতে এলে এত বকবে না। অন্য বাড়ির কথা এ বাড়িতে
বলবে না, আমার বাড়ির কথাও না। খুব অপছন্দ করি। নিজের কাজ করে বাড়ি চলে যাবে।
এমন কথা মলিনা আগে শোনে নি। এই শুনবে বলে সব তো বসে থাকে।
কারো সাথে কারো ভাব জমে ওঠে, দুদিন সই সখি করে গল্প তারপরেই সে চোখের বালি। এই কারণে কিছুতেই কাবেরীর ফ্ল্যাট ভাল লাগে না। কাজ করেই সময় চলে যায় -- পরের গল্প শোনার সময় কই! মলিনা চলে গেলে বইয়ের পাতা
খোলে।
পর পর ঘটনা ঘটতেই থাকে। সেনবাবুর ছেলে মারা যায়। এত জোরে মোটর সাইকেল
চালিয়েছিল যে অ্যাকসিডেন্ট! স্তব্ধতা নেমে আসে।
কখনো ভাল খবর আসে। কারো ছেলে ভাল চাকরি
পেয়েছে, মা গর্ব করে বলে। এ যেন এক প্রতিযোগিতা।
#
#
দুদিন হল সেই মাসীমাকে দেখতে পাচ্ছে না কাবেরী। কুকুরগুলো কাতরস্বরে কাঁদছে দেখে ভাবল --যাই, একবার নিজেই দেখে আসি। দরজায় একটা মস্ত বড়
তালা। কোথায় গেলেন তিনি? পাশের
বাড়ির কলিং বেল বাজাতেই রিয়া বলল --না গো, দেখতে পাইনি। জানি না তো, বলেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তবে কি শরীর খারাপ হল?
এদিকে কুকুরের চিৎকার সহ্য হচ্ছে না বলে বাড়তি ভাত মেখে
দুপুরে কাবেরী নামল।
কেউ এগিয়ে এল, কেউ খেল, কেউ খেল না। শুকনো মুখ, নে রে বাবা খেয়ে নে,
তোদের মা এসে গেলে আবার যত্ন করে খেতে দেবে। কুই কুই শব্দে ওরা এগিয়ে এল।
#
#
গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ল তারপরের দিন। আশে পাশে ফ্ল্যাটের সবার সন্দেহ ঘনীভূত হল ক্রমশ; ---মাসীমার
কিছু হয় নি তো?
কাবেরী ছুটল তাড়াতাড়ি।
পুলিশে খবর দিলেন কেউ। দরজা ভাঙা হল। মশারির ভিতর তিনি একলা পড়েছিলেন। দেহ পচে গলে এমন অবস্থা যে চাদর দিয়ে মুড়ে নেওয়া হল শরীরটা। তারপর পুলিশের গাড়িতে তোলা হল।
কিন্তু উনার স্বামী কই? স্বামীর খবর কেউ বলতে পারলেন না। স্ত্রীর মৃত্যুর পরও
তিনি বাইরে তালা দিয়ে চলে গেছেন -- এ কথা ভাবতেও কষ্ট, মেনে নেওয়াও মুস্কিল। রিয়া বলল --- এমন খিটখিটে মানুষ আমি আর
দেখিনি। মাসীমার হাতে খেতেন পর্যন্ত না। নিজের ঘর বাড়ি সব আগেই ভাইপোকে লিখে দিয়েছে। যারা সারাজীবন কথা শুনিয়েছে মাসীমাকে, তাদের দিকে এত দরদ! এই নিয়েই মাসীমার অভিমান ছিল। বলতেন -যদি দিয়ে দিত কোন সেবা প্রতিষ্ঠানকে বুঝতাম। এই তো দেখছেন অবস্থা! কাছেই তো বাড়ি, কেউ কি এল একবার দেখতে? খবর তো
পেয়েই গেছে।
গাড়িটি তখন চলতে শুরু করেছে। চারিদিকে বিকট গন্ধ ছড়িয়েছে, কোন
আত্মীয় এল না, খই ছড়াল না। এমন পরিণতি দেখে মন খুব খারাপ। দূর থেকে হাতজোড় করে
প্রণাম জানাল।
হঠাৎ চিৎকার করে আকাশের দিকে মুখ তুলে কেঁদে উঠল এক পাল
সন্তান। ওরা ছুটল গাড়ির পিছু পিছু ---
কোয়েলী
ঘোষ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন