কেন্দ্রীয় ফিন্যান্স কমিশন: এক নির্লজ্জ শোষনের ধারাবাহিকতা ~ সিদ্ধব্রত দাস


কেন্দ্রীয় ফিন্যান্স কমিশন:
এক নির্লজ্জ শোষনের ধারাবাহিকতা
সিদ্ধব্রত দাস

যেকোনো সরকারের মূলে হলো রাজস্ব আদায় এবং তার দ্বারা রাষ্ট্রের উন্নয়ন। এই নিরিখে সরকার বাজেট পেশ করে এবং প্রতি বছর নির্ণয় করে কোন খাতে কত ব্যায় করবে এবং সেই অর্থ কোথা থেকে আসবে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ভারত যেহেতু একটি উপনিবেশ ছিল মাত্র তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিলোনা। ব্রিটিশ সরকারের মূল লক্ষ্য ভারতের উন্নয়ন ছিল না, ছিল তাদের নিজেদের উন্নয়ন। যতটুকু না দিলেই নয়, ততটাই আমরা পেতাম।

রাজস্বের কেন্দ্রীয়করণ একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্টতাব্রিটিশ সরকারও সেই এক নিয়মে চলতো, প্রদেশের উন্নয়নের জন্য সামান্য মাত্র টাকা তারা দিত। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দীর্ঘ আন্দোলনের চাপে নতি স্বীকার করে সেই ব্যবস্থা তারা পাল্টালো। গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯৩৫ নিয়ে এলো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে ব্রিটিশকে রেখে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রাদেশিক সরকার গঠন করার নীতি তারা নিলো।

এই প্রদেশ ও কেন্দ্রের মধ্যে যে রাজস্ব বন্ঠিত হবে তা কি অনুপাতে হবে তা ঠিক করার জন্য তারা নিয়ে এলো "নিয়েমেয়ের আওয়ার্ড" (Niemeyer Award)"নিয়েমেয়ের আওয়ার্ড" এই রাজস্ব কেন্দ্রিয়করণের নীতি থেকে কিছুটা সরলেও বেশির ভাগটা ব্রিটিশের হাথেই রেখেছিল। ব্রিটিশ সরকার যা কর আদায় করত তার ৫০% নিজের কাছে রাখতো আর ৫০% সকল প্রদেশের মধ্যে ভাগ করে দিত। সেই নিয়মে পরাধীন ভারতে বাংলার ভাগ্যে জুটত প্রদেশের ভাগের ২০%

ভারত স্বাধীন হবার পর নেহরু সরকার রাজ্যগুলোর মধ্যে রাজস্ব বন্টনের জন্য ফিন্যান্স কমিশন স্থাপন করে। সেই ফিন্যান্স কমিশন তখন ঠিক করে রাজস্ব আদায়ের ভিত্তিতে নয় জনসংখ্যার ভিত্তিতে রাজস্ব বন্ঠিত হবে। তার মানে সব রাজ্যের থেকে সমান কর আদায় করবে কিন্তু যার যেরম জনসংখ্যা সে সেরম রাজস্ব পাবে।"নিয়েমেয়ের আওয়ার্ড" যে আয়কর ব্রিটিশ নানান প্রদেশ থেকে আদায় করতো তার ৫০% রাজ্যকে দিত। হিন্দু মহাসভার কেসি নিয়োগির নেতৃত্বে নেহরু সরকার যে প্রথম ফিন্যান্স কমিশন গঠন করলো, সেই কমিশন রাজ্যের ভাগ ৫০% থেকে সামান্য বাড়িয়ে ৫৫% করলো। আর সেই ৫৫% এবার রাজ্যের মধ্যে ভাগ হবে। ৮০% হবে জনসংখ্যার ভিত্তি আর ২০% রাজস্ব আদায়ের ভিত্তিতে। পরবর্তী সময়ে সেটা বেড়ে হয়ে ৯০% আর ১০%। ব্রিটিশ সরকার প্রদেশের মধ্যে যে ৫০% দিত তারা কিন্তু জনসংখ্যার ভিত্তিতে দিত না, দিত কোন প্রদেশ কত রাজস্ব আদায় করেছে তার ভিত্তিতে। সেই সময়ে ভারতের ৭৫% রাজস্ব আসত দুটো জায়গা থেকে ক্যালকাটা আর বোম্বে কিন্তু যেই হিসেবটা হয়ে গেল জনসংখ্যার ভিত্তিতে সেই পশ্চিমবঙ্গর ভাগ হয়ে গেল ১২%।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকার দিচ্ছিল ২০%, স্বাধীন ভারত দিচ্ছে ১২%। আমাদের রক্ত-জল করা টাকা আর সেই টাকা আমার ঘরে আসছে না, সমৃদ্ধ হচ্ছে অন্য রাজ্য। এই ৯০% ও ১০% অনুপাত চলে ১৯৮৪ সাল অব্দি। পরে জনসংখ্যার ভাগটা কমলেও আজও কিন্তু জনসংখ্যাই রাজস্ব বণ্টনে একটা বড় ভূমিকা নেয়। চতুর্দশ ফিন্যান্স কমিশন ১৯৭১ এর জনসংখ্যাটা ধরে তার সাথে ২০১১ সালের জনসংখ্যাকেও মান্যতা দেয়

এবং এর সাথে আর একটা জিনিসও মাথায় রাখতে হবে ১৯৭১ থেকে ২০১১ এই সময়ে ভারতের কোন কোন রাজ্যে কি হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ? আর ২০১১ কিংবা বর্তমান জনসংখ্যাকে আমরা মান্যতা দিলে তাতে কোন রাজ্যের রাজস্ব বাড়বে আর কোন রাজ্যের কমবে ? ভারতের ফার্টিলিটি রেট ২.৩৪ তার মানে প্রতি মা পিছু ২ টোর বেশি শিশু জন্মায়। ভারতের প্রায় সকল হিন্দি রাজ্যের ফার্টিলিটি রেট এর চেয়ে অনেক বেশি আর পশ্চিমবঙ্গ এবং দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর ফার্টিলিটি রেট ২ এর চেয়ে কম। মানে প্রতি দম্পতি পিছু হিন্দি রাজ্যে ২টোর বেশি শিশু জন্মায় ও আহিন্দি রাজ্যে ২টোর কম জন্মায়। যদি এই নিওমই চলতে থাকে তাহলে সময়ের সাথে হিন্দি রাজ্যের জনসংখ্যা অনেক গুন বৃদ্ধি পাবে ও বাংলা এবং দক্ষিন ভারতের রাজ্যের জনসংখ্যা দিন দিন কমবে। এর ফল আমাদের সামনে। আজ বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের ভাগ কমতে কমতে দাঁড়িয়েছে ৭%।

বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৭ সালে যে পঞ্চদশ ফিন্যান্স কমিশন স্থাপন করেছে এন.কে.সিংয়ের নেতৃত্বে তার সুপারিশ হলো ২০১১র জনসংখ্যার ভিত্তিতেই এবার রাজস্ব বন্টন হোক। যদি এটা সরকার মেনে নেয় তাহলে পশ্চিমবঙ্গ ২০২০-২৫ সালের মধ্যে প্রায় ২৫০০০ থেকে ৩৫০০০ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হতে চলেছে। আর ঠিক একই কারনে হিন্দি রাজ্যগুলো বিপুল অর্থ পেতে চলেছে। এই বঞ্চনা কেন ? এটা তো ভালো কাজের শাস্তি পেলো পশ্চিমবঙ্গ।

যদি জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে কেন্দ্র অর্থ দিয়ে সাহায্য করে তাহলে কি কোনো রাজ্য সরকার তার জনসংখ্যা কমানোর চেষ্টা করবে ? তারা তো চাইবে তাদের রাজ্যের জনসংখ্যা আরো বারুক। ভালো কাজ করার জন্য পুরষ্কৃত করার জায়গায় উল্টে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। আজ বাংলার মানুষ কর দেয় কিন্তু সেটা বাংলার সরকারের রাজকোষে ফেরে না। প্রতি হিন্দি রাজ্য যে অনুপাতে কর কেন্দ্রকে দেয় তার চেয়ে বেশি পায় এবং বাংলা সহ দক্ষিন ভারতের রাজ্য যে অনুপাতে কর কেন্দ্রকে দেয় তার চেয়ে কম ফেরত পায়। যার ফলে বাংলা দুর্বল থেকে দুর্বলতর রাজ্যে পরিনত হয়। অনেকে ভাবে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবনতি এবং বিশিল্পায়নের মূলে বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার আসার অনেক আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে ঘুন ধরে গিয়েছিল নেহরুর ও পরবর্তী কংগ্রেস সরকারের নীতিতে। মানে যদি ব্রিটিশ সরকার থাকতো এবং আমরা যদি তাদের নিয়মে রাজস্ব বন্টন করতাম, অন্তত আড়াই গুন বেশি রাজস্ব ফেরত পেতাম এই ৭০ বছরে। আমাদের নিজেদের সরকারের কাছ থেকে এমন বিমাতৃসুলভ আচরন কখনই কাম্য নয়।

সিদ্ধব্রত দাস



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন