জীবাত্মা
মৈ মৈত্রেয়ী
ওলো মেয়ে,
আদ্রা এসে পড়বে যে মা। উঠে পড়ো। ক্লান্তির সাগরে মুক্তো
খুঁজলে গুগুলিই উঠবে মা। একরাশ বন্ধনী তোমার জন্য রাখা আছে যে। তেল চকচকে কলা
পাতায় দই চিড়ে মেখে এনেছি সোনা … খেয়ে নাও।
সংশয় সাগরে তার জীবন-তরনী টলোমলো। সে, কী এবং কেন?
তার আসল পরিচয়ের ঠিকানা হাড়িয়ে গেছে। ছোটো ছোটো বৈতরণী পার
করে,
আজ সে সমুদ্রে এসে হাজির হয়েছে। ঘামে ভেজা নোনতা জলের
ঝাপটায়,
সর্ব শরীর আজ ক্ষত বিক্ষত। তবু তাঁকে প্রসাধনের
দাঁড়িপাল্লায় চাপানো হবে।
ভোরের সোনা আলোয় মাখা বাজুবন্ধ, তেজ বিচ্ছুরিত সাতনলী হার আর
কপাল জুড়ে রক্ত টীকা। আদ্রা আসার সময় হয়ে এলো। রূপবতী নারীকে, দোলনচাঁপায় চাপিয়ে সাজিয়ে সবাই আজ ঘরমুখো। একা মেয়ে পড়ে থাকে, সতীচ্ছেদের অপেক্ষায়। প্রতিবছর।
চার দেওয়ালের মাঝে আরও একটা দেওয়াল। সেই দেওয়াল অবশ্য ফুলের। ঘরের দেওয়াল রঙিন
আর ছদ্ম দেয়ালের রঙ সাদা। কোমল হাতে একটা একটা করে পাপড়ি ছিঁড়ে, সাজিয়ে রাখা হয়েছে দুধসাদা চাদরের ওপর। একটি রাতের অপেক্ষা।
পরেরদিন গোলাপের পাপড়িগুলো এদিক ওদিক ইতস্তত ভাবে পড়ে থাকে। লাল গোলাপের
পাপড়ির মাঝে রক্তের লাল মিশে থাকে। আহ... শান্তি শান্তি। এ জমিতে কেউ আঘাত করে নি
আগে। এ জমি আমার, এ জমি উর্বর। দু-চারটে বীজ বপন করতে পারলেই
বংশ রক্ষা হবে। না বাপু মেয়ে চাই না। ছেলে দাও। সেই ছেলেকে আবার এনে দাও আরেকটি
নতুন জমি।ফসল ফলবে।
তৈরি হও জননী। আষাঢ় মাস এসেছে। তোমার
আচ্ছাদন টেনে ছিড়ে ফেলা হবে। শুষ্ক জমির ওপর বীর্য ঢালবে মেঘ। তিনদিন তোমাকে আমরা
ছুঁতে পারবো না। তুমি অচ্ছুৎ তুমি তখন নোংরা। তোমার ক্ষিদে পাবে না, নিদ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় তোমার ওপর চেপে বসবে গ্যালন গ্যালন বৃষ্টির কণা। তিনদিন
বাদে,
যখন তুমি নেতিয়ে পড়েছো যখন তোমার যোনীতে একবছরের জন্য বীর্য
জমা পড়েছে তখন তোমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে সেখানে বীজ
বপন করবো মা। তোমার রক্তে ভেজা ফসলে আমাদের পেট ভরবে।
তুমি ভেবোনা যে এই তিনদিন তোমাকে আমরা সম্মানের চোখে দেখবো। ঋতুকালে মেয়েরা
অশুচি। রজঃসলা ধরিত্রী, তুমিও কিছু মাত্র ভিন্ন নও।
যোনি-আকৃতিবিশিষ্ট পাথরের মধ্যে জমে থাকা আয়রন সমৃদ্ধ লাল জলে গামছা ভিজিয়ে আমার
পুণ্য অর্জন করবো। কিন্তু তোমার দেখা পাবো না। তুমি তখন বন্ধ দরজার আড়ালে, ব্যাথায় কাতর হয়ে পড়ে থাকবে। তুমি তখন অসূর্যম্পর্শ্যা ।
আমার কষ্ট হয় মা, যন্ত্রণা হয়। আমার যোনি, আমার দেহ কী শুধুমাত্র পুরুষের জন্য? ফসল ফলানোর জন্য? জমির উর্বতা বৃদ্ধিতেই কী পুরুষের
পুরুষত্ব?
না,
কখনোই নয়। প্রতিটা মানুষ অর্ধনারীশ্বর। প্রতিটা মানুষ
পুরুষত্ব এবং নারীত্বের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করে। অযাচিত রাগ, তেজ,
জেদ, প্রভুত্ব এই বিশেষনের মাধ্যমে
যেমন পুরুষকে চিহ্নিত করা যায় না তেমনি কোমলতা, শালীনতা, মায়ামমতা - নারী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নয়। প্রাণ প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে, নারী এবং পুরুষ একই স্বত্বায়
পরিণত হয়।
আমাদের প্রতিষ্ঠাতার কারুশীলতায়, নারীর যোনি এবং পুরুষের
লিঙ্গ দ্বারাই যথাক্রমে নারী এবং পুরুষকে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু শারীরিক আবরণ এবং
মানসিক গঠনের মাধ্যমে, সত্যিই কী তাঁদের শক্তির বিচার করা যায়? যাবতীয় ধ্যান ধারনাকে দূরে সড়ালে, পর্দার আড়াল থেকে দেখা
দেয় আসল শক্তির আধার। আর তাকে বলা হয় চরিত্র।
মৃত্তিকার অনেক রূপ। কোনো সময় সে কোমল আবার কোনো সময় যে পাথরের মত শক্ত, কোনো সময় সে পিচ্ছিল আবার কোনোসময় সে উর্বর। মানব চরিত্র অনেকটা সেই রকম। যে
রকম ভাবে লালিত পালিত হয়, সেটাই তার বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা
পড়ে। দেবী দুর্গা যেমন আদিমতম শক্তিপুঞ্জের কেন্দ্রস্থল তেমনি উদাসীনতায় মত্ত বাবা
ভোলানাথ। জগৎ সংসারের সমন্বয়ই এই বিশ্ব গড়ে ওঠে।
যুগ যুগান্ত ধরে, আমাদের চারপাশে কিছু অদৃশ্য গন্ডী কাটা
রয়েছে। সেই গন্ডীর মধ্যে দুর্বোধ্য এবং অজানা ভাষায় লেখা আছে সবকিছুর বিধি নিষেধ।
যেমন –
পুরুষদের শক্ত খোলোকের মধ্যে যেমন অনুভূতি বা কষ্টের দেখা
মেলা ভার তেমনি নারী চরিত্র অতীবমাত্রায় দুর্বল। তাই আজও যদি কোনো পুরুষ চোখের জল
ফেলে তখন তাঁকে নারী বলা হয় আর কোনো নারীচরিত্রে যদি দৃঢ়তার খোঁজ মেলে তখন তাঁকে
বিষ নজরে বিদ্ধ করা হয়। এইবার যদি প্রশ্ন করা হয় যে গন্ডী লিখনের রচয়িতা কে? কার হাত দিয়ে নারী - পুরুষের সংজ্ঞা খোদিত করা হয়েছে? পুরুষের
চোখের জলকে কেন অপমান করা হয়? বাচ্চা ছেলের আঘাত লাগলে তার মা
কেন তাঁকে বলেন যে “মেয়েছেলে”-র মত কাঁদতে নেই? আনন্দ-বহিঃপ্রকাশের উচ্ছ্বাসে উচ্চস্বরে মেতে উঠলে কেন কোনো মেয়ের কন্ঠ রোধ
করা হয়?
সহজভাবে সবকিছু বিচার করা খুব সহজ কিন্তু জটিলতার তল পাওয়া বেশ মুশকিল। একটি
সূক্ষ আঘাতের মাধ্যমে এই গন্ডী কেটে বেরিয়ে আসা যায়। যুগযুগান্ত ধরে চলে আসা, কালের বহমান নিয়মকে অগ্রাহ্য করার সময় এসেছে। ঋতুমতী নারীকে সহানুভূতি দেওয়ার
দরকার নেই,
তাঁর পাশে থাকা দরকার। সংসারের ভার বহনে ক্লান্ত পুরুষের
কাঁধে হাত রাখো নারী। সম্মানের বিচার - সতীচ্ছেদের মাধ্যমে করাটা অসম্মানজনক।
চরিত্র বিশ্লেষণ কখনোই যেন যোনি বা লিঙ্গের মাধ্যমে করা না হয়। পিতা এবং মাতার
সমন্বয়েই রচিত হয় মহাবিশ্ব।
তাই ছদ্ম দেওয়ালের ভেলা বেঁধে ভাসিয়ে দেওয়া হোক শাস্ত্রের জঞ্জালে। পাঁকেই
জন্ম নেবে ভবিষ্যতের পদ্ম। আর সেই পদ্মের পাপড়িতেই উন্মোচিত হবে নারী এবং পুরুষের যথোপযুক্ত
প্রাপ্য সম্মান। আদ্রার স্পর্শে ধরিত্রী্তে যেন শুধু কামের উদ্ভব না হয়, বৃষ্টির ফোঁটায় যেন মিশে থাকে আদি এবং অকৃত্তিম ভালাবাসা। ধরিত্রীর শীৎকারে
যেন শুধু বেদনা না থাকে, সে যেন আদ্রার কাছে তাঁর যোনি
মেলে ধরে গোলাপের পাপড়ির মতো।
আর এঁদের সহবাসে রচিত হবে মানুষের সম্মানের ইতিহাস আর মানুষ তা এগিয়ে নিয়ে
যাবে সময়ের ভেলায়। সে চলতেই থাকবে, প্রতিনিয়ত, ক্রমাগত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অন্তর্গত উত্তর-গীতা ৪৩তম শ্লোক
গবামনেকবর্ণানাং ক্ষীরং স্যাদেকর্ণতঃ।
ক্ষীরবদ্ দৃশ্যতে জ্ঞানং দেহানাঞ্চ গবাং যথা ।।৪৩
গরু রয়েছে নানা রঙের। একের সঙ্গে অপরের কোন মিলই নেই, কিন্তু
তারা যে দুধ দেয়, তার রঙ একটাই – সাদা।
সেই রকমই এই যে জীবদেহে কত না বৈচিত্র। এটি বাইরের রূপ। ভিতরে সবার কিন্তু সেই একই
জীবাত্মা ।।৪৩।।
দৈহিক পরিচয় বা চর্ম আবরণের ভেদাভেদ মুছিয়ে দিতে পারলে তবেই মনুষ্যত্বের জয়
নিশ্চিত করা যাবে। সাদা কাপড়ের ওপর রক্তের দাগের মাধ্যমে উদ্বলিত হোক নারী পুরুষের
আত্মার মিলন।
©মৈ মৈত্রেয়ী
মৈ
মৈত্রেয়ী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন