আসুন ঘাস খাই ~ পার্থ বসু



আসুন ঘাস খাই
পার্থ বসু

অনুকূলবাবু ঠিক করেছিলেন ঘাস খাবেনগরু ঘোড়া অশ্ব দিব্যি ঘাস খেয়ে বেঁচে আছেরবি ঠাকুরের সেই ছড়াটি মনে আছে তো?

পরিণতিতে দুদিন না যেতে যেতে বিজ্ঞানে একটি মহা শোকবার্তা লিপিবদ্ধ হয়েছিল
সেটাও স্মরণ করুন

তর্কটা আমিষ নিরামিষের নয়মানুষের খাদ্যাভ্যাস,  তার রুচি,  খাদ্যের অধিকার এবং খাদ্য বিপণনের অধিকার তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ব্যাপারহিন্দীতেও প্রবাদ আছে,  আপ রুচি খানারাষ্ট্র এখানে চোখ রাঙানোর কে?

অথচ আখলাক কাণ্ডের থেকে যে অসভ্যতা প্রকাশ্যে এসেছিল সারা গোবলয়ে আজ তা কুলোর বাতাস পেয়ে তুঙ্গেসম্প্রতি এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্ণৌ বেঞ্চ খুব উদ্বেগের সঙ্গে তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেনধর্মের স্বঘোষিত ঠিকাদাররা যখন মসনদে,  জানি না,  চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী এই প্রবচন তাদের গায়ে লাগবে কিনা

ঘাস না খেয়ে মাংসে আসিকবি জীবনানন্দ কমলালেবুর মাংস নিয়ে রোগশয্যায় হাজির হওয়ার অভিলাষ জানিয়েছিলেনআমরা আজ মহামাংস নিয়ে চর্চা করবএজন্য এখুনি পুরান ঘাঁটব নাআগমবাগীশের তন্ত্রসার এই সেদিনের পু্ঁথিসাধনায় সিদ্ধি পেতে যে আটপ্রকার মহামাংসের কথা লিখছেন তিনি তার প্রথমটিই গোমাংস

তক্কে তক্কে তর্কে আসি

হিন্দু বনাম গোমাংস এভাবে না দেখে ব্রাহ্মণ বনাম গোমাংস বিষয়টি এভাবে দেখি আসুনহিন্দু বললে আগে হিন্দুত্বের সংঞ্জা সীমানা নিয়ে আলোচনা করতে হয়কে না জানে বর্ণাশ্রমে ব্রাহ্মণের আগ্রাসন আছেসেখানে ব্রাত্যজন ব্যাধ কালকেতুও আছেআমরা একটু বামুন ঠাকুরদের পৌরাণিক হাঁড়ির খবর নিই

ব্রাহ্মণরা কি গরু খেতেন?

একটি বিরাট যজ্ঞভূমিতে যাই চলুন রন্তিদেবীরর যজ্ঞআমন্ত্রিতরা খেতে বসেছেনমাংসে টান পড়বে বুঝে পাচক বাউনরা আগেই গেয়ে দিলেন-- কব্জী ডুবিয়ে খাওয়া যাবে নাগরু মারা হয়েছে মাত্র একুশ হাজার( সাহিত্যসংহিতা, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭৬, প্রণেতা ব্যাসঋষি)

রামচন্দ্র যদিও বর্ণাশ্রমে ক্ষত্রিয়তিনি বিষ্ণুর অবতারব্রাহ্মণেরও উপাস্যআর হৈ চৈ বাঁধাচ্ছেন রামভক্তরাইআসুন বনবাস পর্বে রামচন্দ্রজী কি কি আহার করতেন সেটাও দেখিজলখাবার নয়,  একদম লাঞ্চের মেনুতে চোখ বোলাই

১) তিন প্রকার মদ(আসব)
      গুড় থেকে জাত গৌড়ী
      পিঠে পচিয়ে উৎপন্ন পৌষ্ঠী
      মধু থেকে তৈরী মাদ্ধী

২) শিককাবাবসেকালে কইত শূলপক্কগোমাংসের

৩) সবজীর বিস্তৃত উল্লেখ নেইসবজী মানে তো শাকপাতাযে বস্তুটি ছাড়া আজকের ভারতে তরকারী মুখে রোচে না সেই আলুই ছিল মহাভারতে অনুপস্থিততো রান্নার এলেম দেখাতে সীতামাইয়ার মাংস ছাড়া বিকল্প নেই

ভিরমি খাচ্ছেন না আশা করিধাতস্থ করতে এটুকুও মনে করিয়ে দিই-- সংস্কৃতে গোঘ্ন কথাটির অর্থ যার সম্মানে যার আহারে তুষ্টির জন্য গো নিধন করা হয় তিনিই গোঘ্নমানে অতিথি

এবার একটু বিবেকানন্দ পড়ে নিই

"এই ভারতবর্ষেই এমন এক দিন ছিল যখন কোন ব্রাহ্মণ গোমাংস না খেলে ব্রাহ্মণই থাকতে পারতেন নাযখন কোন সন্ন্যাসী, রাজা কিংবা বড় মানুষ বাড়িতে আসতেন বলি দেওয়া হোত সবচেয়ে ভালো ষাঁড়টিকে"( বিবেকানন্দ রচনাসমগ্র, অদ্বৈত প্রকাশনী, ৩য় খণ্ড, ১৭২ পৃষ্ঠা)

এখানে বিষ্ণুপুরাণ থেকেও কয়েক লাইন একই সাথে পড়ে নিন—

"ব্রাহ্মণদের গোমাংস খাইয়ে হবিষ্য করালে পিতৃপক্ষ সর্বাধিক একাদশ মাসের জন্য পরিতৃপ্ত হন"(বিষ্ণুপুরাণ, ৩/১৬)

বেদ উপনিষদে গোমাংসের সমর্থনে  গাদাগুচ্ছের বিধান পাচ্ছিউপনিষদে ভালো সন্তানের জন্য ষাঁড়ের মাংস উত্তম বলা হয়েছে(বৃহদারণ্যক, ৬/৪/১৮)

এখানে বলে রাখি এই সেদিনও যে দেশটি ছিল রামভক্তদের গর্বের দুনিয়ার একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র সেই নেপালের ছেত্রীরা পরম্পরাগত ভাবেই মহিষের মাংসও আজও ভক্ষণ করেনযজ্ঞের প্রশস্ত মাংস গরু ছাড়াও অন্তত তিনটি

মহিষের মাংস,  বৃষ মাংস এবং অজ মাংস

রাম ও রামায়নের কথা আগেই বললামমহাভারত দেখা যাককথায় বলে যাহা নাই ভারতে, তাহা নাই ভারতেকিশোরী মোহন গাঙ্গুলী আমাদের জন্য মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করে দিয়েছেনবনপর্ব ২০৭ পাতায় যানগরু খাওয়ার বিশদ বর্ণনা আছে

জগৎগুরু শঙ্করাচার্য কোন পক্ষে?তাঁর সুবিখ্যাত গীতাভাষ্যের বয়ান তুলে দিচ্ছিঅধ্যায়৩,  পাদ্য ১, সূত্র ২৫পড়ুন

"যজ্ঞে পশুহত্যা পাপ বলে বিবেচিত হবে নাকারণ ইহা শাস্ত্র অনুমোদিত"

মনুসংহিতা কি কয়?

৫/৪৪-- "শ্রুতিবিহিত পশুবধ অহিংস মানিতে হয়কারণ ইহা বেদবিধি"

ঋগ্বেদসংহিতাতেও বলা হচ্ছে—

"যজ্ঞে অগ্নিতে নিবেদনের জন্য বলদ,  ষাঁড় আর দুগ্ধহীনা গাভী প্রশস্ত"

তাহলে এতো বৈদিক সমর্থন সত্ত্বেও ব্রাহ্মণের পাতে গোমাংস ব্রাত্য হল কবে থেকে?এমনকি গোমাংসের গন্ধ শুঁকেও ধর্মে পতিত হয়ে ধর্মান্তরিত হওয়ার গল্প আকছারগোমাংসবিরোধীরাও শরণ নিচ্ছেন ঋগ্বেদেশোলোক সংখ্যা ৭/৫৬/১৭সমাপতনে ৫৬" আর সাতসতেরো একগুঁয়েমির একটি পরিসরে শোলোকটি ইচ্ছামত ব্যাখ্যা হয়েছেনিষেধ ছিল দুধেল গাই হত্যারদুগ্ধবতী তাই অঘ্ন্যাবধ্য নয়নিষেধ ছিল এমনকি গোদুগ্ধ পানেওকার বিরুদ্ধে?বহিঃশত্রুরযারা দেশকে আক্রমন করে প্রাণীর মাংস, ঘোড়ার মাংস এমনকি নরমাংস ভক্ষণ করেশোলোকে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানদুধ যে খায় তার বুক বর্শায় বিদীর্ণ করবিধানটি নরলোকের উপর চেপে বসল কালক্রমেএই নরলোক অবশ্য বর্ণাশ্রমের অনুগামীরাসার্বজনীন কখনই নয়

এনারা কথায় কথায় অথর্ব বেদ থেকে একটিই শোলোক আওড়ান নিজেদের মত করে—

সূত্র ৮/১০/১৫- -- গরু নিধন কর নাগরু নিষ্পাপ এবং গরু অদিতিতাকে টুকরো টুকরো করে কর্তন কর নাকেন একথা বলা হল, কোন প্রেক্ষিতে তা বোঝার সময় কই?রাজনীতি তার নিজের মত বুঝে নেয়বোঝায়

বৌদ্ধযুগের আগে অবদি ব্রাহ্মণরা চুটিয়ে গোমাংস খেয়েছেনতারপর বৌদ্ধধর্মের অহিংসার আদর্শে ঘর বাঁচাতে গোবলয় কালে কালে নিরামিষের ভেক নিয়েছে

সে আর এক গল্প


পার্থ বসু









কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন