সিবিএসইর উত্থানে
রাজ্যের আর্থ-সামাজিক সর্বনাশ
সিদ্ধাব্রত দাস
ভারত যখন স্বাধীন ভাবে পথ চলা শুরু করে তখন
শিক্ষাকে রাজ্য তালিকায় রাখা হয়েছিল। পরে ১৯৭৫ এর জরুরি অবস্থার সময়ে ইন্দিরা
গান্ধী সরকার সংবিধানের ৪২ম সংশোধনের দ্বারা শিক্ষাকে রাজ্য তালিকা থেকে যৌথ তালিকায়
নিয়ে আসে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর অজুহাত দিয়ে। ১৯৭৬ এর আগে শিক্ষার নীতি নির্দ্ধারণ
করত রাজ্য। কিন্তু ১৯৭৬ থেকে শিক্ষার নীতি নির্দ্ধারণ করতে শুরু করে কেন্দ্র, রাজ্য উভয়।
এই পরিবর্তনের ফলে যেটা দেখা যায় যে দিল্লি
বোর্ড মূলত সিবিএসই এবং আইসিএসইর প্রাধান্যতা বেড়ে যায়। কেন্দ্রীয় সরকারি শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলি বিপুল অর্থ সাহায্য পেতে শুরু করে। রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বৈষম্য প্রকট হতে থাকে। সর্বভারতীয় সব পরীক্ষায় তাদের
পাঠ্যক্রমই মান্যতা পায় এবং রাজ্য বোর্ড থেকে লোক সরতে থাকে। দিল্লি বোর্ডে পড়া
ছেলেমেয়েরা নম্বর অনেক বেশি পায়, সর্বভারতীয় পরীক্ষায় সুযোগ বেশি পায় এবং তাই
স্কুলগুলো নিজেদের সিবিএসই, আইসিএসই এফিলিয়াশনের জন্য
সরকারের কাছে আবেদন করতে থাকে। তখন বাধ্য হয়ে রাজ্য সরকারকেও তাদের শিক্ষা নীতি
দিল্লির ধাঁচে পাল্টাতে হয়ে। কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি, উল্টে ক্ষতি হয়েছে। তার প্রমান পশ্চিমবঙ্গ জয়েন্টে এমসিকিউ চালু হওয়ার পর
বিপুল সংখ্যক সিবিএসসি ছাত্রের ভালো ফল। এবছর প্রথম ১০ জনের এক জনও পশ্চিমবঙ্গ
বোর্ড থেকে নয়। আগে কিন্তু এরম ছিল না।
আজ শিক্ষার ক্ষেত্রে দিল্লি বোর্ডকে এড়িয়ে
পড়াশুনো করা প্রায় অসম্ভব। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির পরীক্ষা, ইউপিএসসি,
আইআইটি, এআইইইই সর্বত্রই দিল্লি বোর্ডের
পাঠক্রম মেনে চলে। তার সাথে এক নতুন সংযোজন হয়েছে ডাক্তারিতে ভর্তি হওয়ার জন্য নীট
পরীক্ষা। বিগত দু বছর ধরে যে নীট পরীক্ষা হচ্ছে তাতে কি ভাবে রাজ্য বোর্ডের ছেলে
মেয়েদের বঞ্চিত করা হচ্ছে তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। ২০১৭ সালে কঠিন বাংলা প্রশ্নপত্র
এলো, আর এ বছর তো বাংলা প্রশ্নপত্র পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌছলই
না। দিল্লি বোর্ডে কিন্তু কেউ বাংলায় পড়াশুনো করেনা। এর ফল ভুগতে হলো রাজ্য বোর্ডে
পড়া বাংলা মাধ্যমের বাঙালি ছাত্র ছাত্রীদেরই। ২০১৩ সালে পর থেকে নীটের যে ফল
প্রকাশ হয়েছে তাতে উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের নাম ও পদবি দেখলেই এটা পরিস্কার হয়ে
যাবে মূলত কারা সুযোগ পাচ্ছে আর কারা পাচ্ছে না আর ২০১৩ সালের আগের পরিস্থিতিতে
কারা পেত। রাজ্যের মানুষের খাটনির টাকায়
বাইরের রাজ্যের ছেলে মেয়েরা ডাক্তার হচ্ছে। এখন আবার কেন্দ্রীয় সরকার চেষ্টা করছে
নীটের মতো একটা ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও সর্বভারতীয় পরীক্ষা করা যায় কিনা। এই সকল পরীক্ষার
কেন্দ্রিয়করনের ফলে রাজ্য বোর্ডের ছেলে মেয়েরা তাদের নিজেদের রাজ্যের ন্যায্য সিট
বাইরের রাজ্যের কাছে হারাচ্ছে। এবং সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে সিবিএসই ছাত্র ছাত্রীরা।
দিল্লি বোর্ডে পড়ে মূলত শহুরে ও উচ্চবিত্ত
ঘরের ছেলে মেয়েরা। কেন্দ্রীয় সরকারের এই শিক্ষা নীতির ফলে সর্বভারতীয় সকল পরীক্ষায়
মূলত তাদেরই জয়জয়কার। হিন্দি রাজ্যের ছেলে মেয়েদের অসুবিধা হয় না কিন্তু যারা
অহিন্দি রাজ্যের বোর্ডে পড়ে তারা বেশির ভাগ সেই রাজ্যের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন
মধ্যবিত্ত এবং মফস্বল এলাকার মানুষ। তাদের সর্বভারতীয় স্তরে খুজে পাওয়া যায় না। এই
নীতির ফলে সমাজে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য আরো প্রকট আকার ধারন করছে।
আজ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর হতে গেলে সর্বত্রই যদি সিবিএসইতে সুযোগ বেশি হয়ে তাহলে আর কেউ
রাজ্য বোর্ডে কেন পড়বে? অদূর ভবিষ্যতে রাজ্য বোর্ডের কি কোনো
অস্তিত্ব থাকবে? অহিন্দি রাজ্যের মফস্বলের ছেলে মেয়েরা যাদের
জন্য রাজ্য বোর্ডই সব তারা কোথায় যাবে? যারা অহিন্দি মাধ্যমে
পড়তে চায় তারা কোথায় যাবে, তাদের ভবিষ্যত কী হবে? আর এই শহুরে সিবিএসসিতে পড়া ছেলে মেয়েরা কি গ্রামে গিয়ে রোগী দেখবে?
শিক্ষকতা করবে? সাধারন মানুষের জন্য কাজ করবে?
অহিন্দি রাজ্যের ভূগোল, ইতিহাস এবং
ভাষা কিন্তু দিল্লি বোর্ডের পাঠ্যক্রমে বেশি প্রাধান্য পায়না। সিবিএসইতে পড়া কোনো
বাঙালি ছেলের প্রথম ভাষা কিন্তু বাংলা নয়, বেশির ভাগ
ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়। কেউ কেউ তো আবার ইংলিশ, হিন্দির
পর ফ্রেঞ্চ, জার্মান কিংবা ম্যান্ডারিন নেয়। তাহলে কি নতুন
প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারবে? ১০০০
বছরে পুরোন ভাষা কি এই শতকেই অবলুপ্ত হতে চলেছে?
রাজ্য বোর্ডকে দুর্বল করা মানে নিম্ন
মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষদের দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড থেকে দূরে রাখা। ভারতের
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করা। এই শিক্ষা নীতির পরিবর্তন অতি দ্রুত না ঘটলে
সমাজে গরিব-বড়লোকের মধ্যে বৈষম্য প্রকট হবে, শহর-গ্রামের মধ্যে দূরত্ব বাড়বে,
অহিন্দি ভাষী দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিনত হবে এবং ভারতবর্ষ একটি
দুর্বল রাষ্ট্রে পরিনত হবে। ভারতের মতো একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রে এই শিক্ষা নীতি
ক্ষতিকারক, তাই সংবিধানে শিক্ষা প্রদানের দায়িত্ব রাজ্য কে
দেওয়া হয়েছিল, সেই দায়িত্ব রাজ্যকেই সম্পূর্ণ রূপে ফিরিয়ে
দেওয়া হোক। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রের রাজ্যের প্রতি সৎ সন্তান সুলভ
মানসিকতা কখনোই কাম্য নয়।
সিদ্ধাব্রত দাস
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন