কামালদা
পার্থ বসু
( ১ )
(নামের বানান ইংরেজিতে kamal. কমল পড়া যায়। কামালও। কমল থেকে কামাল হয়ে ওঠার একটি কষ্টের ইতিহাস আছে। পূর্ব
পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক। কারাবাস এড়াতে ভাষা মতিনের নির্দেশে এক
কাপড়ে দেশ ছাড়েন। রোমহর্ষক তাঁর জীবন। পাঠক
শুনলে সহমত হবেন এঁর কাহিনী ছাড়া পূব বাংলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে
যায়।)
পরিচয়ের প্রথম দিন থেকে শুরু করি।
চাকরিতে ভিন রাজ্যের মেয়াদ শেষ করে কোলকাতায় ফিরেছি। যোগ দিয়েছি ব্যাঙ্কের ক্যামাক
স্ট্রীট শাখায়। এই শাখায় আগেও কাজ করে গেছি। এখন আগের সবাই তো নেই। যারা ছিল তাদের
একজন, দিলীপ, আমায়
চিনত লিখি টিখি এই সুবাদে, বলে
গেল ওই যে টাক মাথার ভদ্রলোক – সাবধানে থাকবেন সাহেব। আঁতেল।
বিজ্ঞান নিয়ে দেশ বিদেশে লেখেন। কবিতায় খার আছে।
মানে কথার খোঁচাটি হল উনি কবিদের মত
সস্তা বুদ্ধিজীবী নন। উনি বিজ্ঞানী। ঘ্যাম।
আমি জবাব দিলাম না। জানি কবিতা পড়েন
কম লোক। আধুনিক কবিতা হলে তো কথাই নেই। কিন্তু বিজ্ঞানের লোক শুনে শ্রদ্ধা হল।
আলাপ করার ইচ্ছেও। নিজে রসায়নের ছাত্র ছিলাম একসময়। এখন ভুলে গেছি। এখন ব্যাঙ্কে।
সে দিনই শেষ বেলায় নিজেই এলেন
ভদ্রলোক। আলাপ করতে। এসেই প্রশ্ন-- আপনি নাকি কবিতা লেখেন? বুঝলাম ছেলেটি ওনারও কানভারী করেছে। আমি খুব ঠাণ্ডা গলায় জানালাম-- তেমন কিছু
বলার মত না। উনি দেখলাম খবর নিয়েছেন-- আমাদের ব্যাঙ্কে তো তিন কবি শুনলাম সাগরময়
ঘোষের দেশ পত্রিকায় লিখেছেন। আপনি একজন। এখানে বলে নি সে সময় দেশের কবিতা বিভাগ
দেখতেন সুনীল বসু। নজর রাখতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তখন দেশ ছিল সাপ্তাহিক। এখনকার
মত মর্যাদা হারায় নি। বললাম-- হ্যাঁ। লিখি বটে। আবারও বলছি তেমন কিছু নয়। উনি
থামিয়ে দিয়ে বললেন-- আমায় পড়াতে পারেন আপনার কবিতা। আমার অনেক প্রতিষ্ঠিত কবিদের
সাথে যোগাযোগ আছে। আমায় যা পড়ানোর দিলীপ আগেই পড়িয়েছে। আমার উদ্দেশ্য ছিল যেভাবেই
হোক ওনাকে নিরুৎসাহিত করা। একগাল হাসলাম।
মানে আমি থাকলাম আমিতে, উনি
বুঝলেন ওনার মত।
দিন তিনেকও যায় নি। আমার টেবিলে এলেন
ভদ্রলোক। –
শুদ্ধসত্ত্ব বসুকে চেনেন আপনি?
অবশ্যই।
এককের সম্পাদক। স্কুলে বাংলা পড়াতেন
জ্যোতির্ময় পাহাড়ি। তাঁর মুখেই প্রথম শোনা। পাহাড়িবাবু কবিতা লিখতেন। চিঠি লিখতেন
কবিকে। একক সম্পাদককে। এককালে রেলে ট্রেড ইউনিয়ন করেছেন। পরে বাংলার অধ্যাপনা।
স্টাইলিস্টিক্সের উপর বাংলায় লেখেন, গ্রন্থ
রচনা করেন তিনিই প্রথম। সে বই এমন কি বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্রদেরও সে সময়ের অগতির গতি। এককে লেখেন নি কে? সুনীল, শক্তি, শরৎ থেকে প্রবীণ ও নবীন সব কবিরাই। বিরল যে কয়েকজন ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের
সমগ্র রচনা পড়েছেন, বিশ্লেষণ করেছেন শুদ্ধসত্ত্ব
তাদের মধ্যে এক। অনেকগুলি কবিতা প্রবন্ধের বই। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁকে লেখা
প্রতিটি চিঠির জবাব দিতেন। দায়সারা ভাবে নয়। গুরুত্ব দিয়ে। পাহাড়ি বাবু পড়ে
শোনাতেন আমাদের। অথচ ক্ষমতাকে তোষণ তাঁর ধাতে ছিল না। সরকারী পুরষ্কার জোটে নি।
কিন্তু সবচেয়ে বড় যে পুরষ্কার পেয়েছিলেন মানুষের নিঃশর্ত ভালবাসা।
কথাগুলি বলে নিলাম। শুদ্ধসত্ত্ব বসুর
কোলকাতার বাসভবনে মাসিক সাহিত্যপাঠের আসরে আমি, আফসার
আহমেদ,
মাবুদ আলী – কত নাম করব-- প্রায় নিয়মিত
যেতাম একসময়।
শুদ্ধদা আপনার কথায় জানতে চাইলেন আবার
কবে উদয় হল পার্থ? অনেকদিন আসে না। একদিন নিয়ে
আসুন। আমার কবিতা নিয়ে ঢাউস সার্টিফিকেট দিয়েছেন। জানালেন। আমি বললাম বটে শুদ্ধদা
যা বলেছেন স্নেহবশত, কামালদা
কানে নিলেন না। তো আবার শুদ্ধদার কাছে যাতায়াত শুরু হল। আর একটা জায়গায় প্রায়
যেতাম-- কবি বিষ্ণু দে-র বাসায়। কবি তখন প্রয়াত। কিন্তু কবির জীবৎকাল থেকেই
কামালদা তাদের পারিবারিক বন্ধু। অন্য বন্ধুদের কথা পরে বলছি। কামালদা আমার লেখা
তখন সাগ্রহে পড়ছেন শুধু না, নতুন
অপ্রকাশিত লেখারও প্রথম শ্রোতা। মোট কথা সবাই
দেখল কামালদার সাথে ভাব আমার জমে গেছে।
অফিসে কিন্তু কামালদাকে সবাই চিনত
কমলদা নামে। কমল ভট্টাচার্য। কমল থেকে কামাল হওয়ার একটা ইতিহাস আছে। শুনব।
কামালদার মুখেই শুনব। তার আগে ততক্ষণ ওনাকে কমলদা বলে ডাকা যাক।
পণ্ডিত মানুষ। জ্যোতির্বিজ্ঞানের
চর্চা করেন। স্কাই ওয়াচার। আকাশদ্রষ্টা। বিজ্ঞানমনস্ক। ঘৃণা করেন জ্যোতিষ,
বুজরুকী আর কুসংস্কার। নাস্তিক? বলা ভাল নিরীশ্বরবাদী। বৌ নেই। বই নিয়েই দিন কাটে। সংসারে কেউ নেই। তিন কুলেও। এ সবই কানাঘুসোয় শোনা। দেশভাগের অনেক পরে এপার বাংলায় চলে এসেছেন। এর বেশী
জানা হয় নি। জিজ্ঞেসও করি নি।
কিন্তু সেই লোকটিই আজ ক'দিন ধরে অফিস আসছেন না। এক মিনিট লেটে আসার নজীর নেই যার কেরিয়ারে সেই কিনা
লা-পতা! অফিসের চীফ ম্যানেজার ডেকে বললেন-- কমলদার খবর রাখেন কিছু?
জানলে তো বলব। সাহেব বললেন – চলুন। কমলদার বাড়ি যাই। খোঁজ নিয়ে আসি। কমলদা পদমর্যাদায় অফিসের স্পেশাল
অ্যাসিস্টান্ট। বাংলায় বড় বাবু। কিন্তু সবাই শ্রদ্ধা ও সমীহ করতেন। ভালবাসতেন।
বাড়িটা চেনেন তো?
উত্তরে না বলতে হল। কমলদা ডাকেন নি। আমারও যাওয়া হয় নি।
অতএব স্টাফ ফাইল থেকে ঠিকানা নিয়ে
রওনা দিলাম আমরা কয়জন। আসলে সাকুল্যে তিনজন। সি এম, আমি আর
পৃথ্বীশ নামের এক ইউনিয়ন নেতা। গেলাম সি এমের গাড়িতে।
কমলদাকে পেলাম না। বাড়ি মানে বাসা।
ভাড়ায় থাকেন। দোতলা বাড়ি। একতলায় দুটি ঘর নিয়ে থাকেন। বাসার নাম সলিচুড। ইংরেজিতে solitude. বাসার ডান দিকে দেওয়াল বেয়ে একটেরে নিভাঁজ সিঁড়ি। সিঁড়ির মাথায় ছাদ নেই। কেন
জানি না জৌলুষ নাই থাক গ্রীক স্থাপত্যের কথা মনে এল। নাম ধরে ডাকতে সিঁড়ির সবচেয়ে
ওপরের ধাপে দেখা দিলেন এক রমণী। বলা উচিত আবির্ভাব হল। পৃথিবীর সমস্ত বিষাদ যেন
তার মুখে। যেন অনেকদিন পর এতজন পুরুষ দেখলেন। দেবী বললেন-- উনি তো নাই। কোথায়
জানতে চেয়ে শুনলাম-- হাসপাতালে। কোন হাসপাতালে? দেবীও জানেন না। কুতো মনুষ্যাঃ। জানালেন-- উনি জানান নি। উনি কারও সেবা নেন
না। কাউরে বিব্রত করেন না।
অফিসে জয়েন করার পর সে কি আফসোস
কমলদার !-- আপনারা আমার বাসায় গিয়ে ফিরে এলেন। আমি যে কি লজ্জিত। বাসায় ডাকি নি
কখনও আপনাদের। একা থাকি। এত অগোছাল।--- সেদিন নয়, পরে একদিন সুযোগ বুঝে প্রশ্ন করলাম-- বিয়ে করেন নি কেন জানতে পারি?
না, প্রেমে চোট খেয়েছেন কিনা এইসব
ব্যক্তিগত গল্পে আগ্রহ নেই, কিন্তু বৌ তো বেশী বয়সের বন্ধুও
বটে। সঙ্গ দিত। সুখে অসুখে পাশে থাকতেন। যা আপনার প্রয়োজন।
খানিক সময় চুপ করে রইলেন। কমলদা।
তারপর বললেন-- আপনাকে বলা যায়। শোনাব একদিন।
( ২ )
আজ ডাক পেলাম কমলদার। ইতিমধ্যে আমি
বদলী হয়ে অন্য শাখায়। ইতিমধ্যে বছর দুই কেটে গেছে। কমলদা ফোনের ও প্রান্ত থেকে
বললেন-- আজ সময় হবে? দেখা হতে পারে?
সন্ধ্যে ঠিক ছ'টায় পৌঁছে গেলাম। বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের থেকে থিয়েটার রোডে ঢুকতেই দোতলায়
রেস্তরাঁ। রাস্তাটির নাম এখন সেক্সপিয়ার সরণি। রেস্তরাঁর নাম মনে নেই। কামালদা
অপেক্ষা করছিলেন। ওয়েটারকে ডেকে খাবারের এলাহি অর্ডার দিলেন। আর শর্ত দিলেন – আজকের বিল উনিই পে করবেন। এখানে বলে নিই, কামালদার
সাথে সপরিবারে আরও অনেক রেস্তরাঁ বা ধাবায়
জলযোগ করেছি। জলযোগ না বলে ভুরিভোজ বললে অত্যুক্তি হয় না। দু এক ক্ষেত্রে বড় জোর
কফি বা চায়ের দাম দিতে পেরেছি। সব ক্ষেত্রেই উনি হোস্ট। এর অন্যথা হয় নি। হতে দেন
নি।
ওয়েটার খাবার সার্ভ করে গেল। কামালদা
কাঁটাচামচ নাড়তে নাড়তে তাঁর কাহিনী শুরু করলেন। সেই কথা তাঁর মুখেই শোনা যাক।
উত্তম পুরুষে।
রেস্তোরাঁয় জানালার এক পাশে একটু
নির্জন কোণে বসেছিলাম আমরা। কামালদা তাঁর প্রথম লাইন শুরু করলেন ইংরেজিতে। খুব
চমকে দেওয়া একটি লাইনে। ইংরেজি ভাষায় কিছুটা আড়াল দিয়ে শুরু। তারপর নিপাট বাংলায়।
শুনুন তবে।
( ৩ )
I am the illegitimate son of a widow mother. অবিভক্ত বাংলায় ফরিদপুরে আমার জন্ম। মা বাল্যে বিধবা হয়েছিলেন। যৌবনে আমার এক
কাকার সাথে তাঁর শারীরিক সম্পর্ক হয়। সে কালে এরকম আকছার হত। চাপাও পড়ত। বাচ্চাটি
গর্ভেই নিকেশ করার জন্য জটিলা কুটিলা, গ্রাম্য জড়ি বুটির অভাব
ছিল না। মা রাজী হলেন না। পরিবারের কলঙ্কের ভয়, কিছুতেই কোন উপদেশেই কান পাতলেন না। শিশুটিকে নষ্ট করতে তিনি নারাজ। অবৈধ
সন্তান? মা তো লেখপড়া শেখেন নি। তিনি
তাঁর মত করে জেনেছিলেন অবৈধ পিতাই যার পিতৃত্বে সংকোচ, স্বীকার
করতে ভয় পান।
যাকে বলে ঢি ঢি পড়ে গেল। কত আর, কত দিন আর চাপা রাখা যাবে। পাড়া পড়শিও জানল ক্রমে। নিন্দা, গঞ্জনা নিত্যকার ব্যাপার হয়ে উঠল। মা মুখ বুজে সইতে লাগলেন। সব অপমান সয়ে
গর্ভের শিশুটি তিনি ধারণ করলেন জন্ম পর্যন্ত। একটি শিশুর মুখ দেখার জন্য কি যে
উদগ্রীব ছিলেন তিনি!
শিশুর জন্মের পর লাঞ্ছনা বাড়ল বৈ কমল
না। তীব্র হল। এতটাই আমার যখন বয়স মাত্র সাত দিন, গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়ে মরলেন মা আমার।
(হতচকিত। মুখের গ্রাস মুখেই রয়ে
গেছে। মনে আছে আমার হাতের লোম অব্দি দাঁড়িয়ে গেছে। কাঁটা দিচ্ছে গায়ে। আজ এতদিন
বাদে তা লিখতে গিয়ে, আজও।)
পিতৃপরিচয়হীন সদ্য মাতৃহারা শিশুটিকে
নিয়ে গেলেন তার বড় বোন। তিনি অপুত্রক। হতভাগ্য শিশুটি মাসীর আশ্রয় পেল। সেকালের
পারিবারিক কাঠামোয় মাসীও যৌথ পরিবারের বধূ। সংসারে আর পাঁচটা শিশুর সাথে বড় হতে
লাগল সেও।
তাই?
এখন যেভাবে বুঝি আস্তে আস্তে টের
পেলাম আমি এ সংসারে আর পাঁচটা শিশুর মত নই। আমার কপালে মায়ের দুধ জোটে নি কখনও।
মায়ের কোল? তাও দিনে দিনে কেমন বিবর্ণ
লাগল। আমাকে নিয়ে যৌথ পরিবারে অশান্তি শুরু হল। আমাকে নিয়েই। ছোটরা নয়। বড়রাই কলহ
করতেন। নিঃসন্তান মাসী মেসোর সম্পত্তি ভোগ করবে শেষে কিনা এক জন্মপরিচয়হীন--
বাস্টার্ড! কথাটি এভাবেই কানে এসেছিল একদিন। ইতর শব্দটি ইংরেজিতে বলা হলেও, অর্থ না বুঝলেও, লক্ষ্য যে আমি বুঝতে অসুবিধা হল না। যাকে
জেঠিমা বলতাম আমি কেঁদে পড়লাম তাঁর কাছে। জানতে চাইলাম শব্দটির মানে। জেঠিমা
সান্ত্বনা দিলেন বড়দের কথায় কান দিও না। বড়রা অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেন। তোমার
এখন জানার বয়স হয় নি। তিনি খুব আদর করে চোখ মুছিয়ে দিলেন আমার। আমি কিন্তু সেদিন
থেকেই অনুমান করলাম এ বাড়ির আমি আসলে কেউ না।
এঁদের সাথে রক্তের কোন সম্পর্ক নেই
আমার। তাহলে পড়ে আছি কেন এ বাড়িতে। পালাব। পালাবই। গায়ে গতরে আর একটু বড় হতেই, তখন ক্লাস ফাইভের ছাত্র, পালালাম।
এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছি। পরনে একটি হাফ
হাতা শার্ট আর হাফ প্যান্ট। ট্রেনে চেপে সোজা ঢাকায়। টিকিট কাটি নি। টিকিট চায়ও নি
কেউ। স্টেশন থেকে পায়ে পায়ে রমনা ময়দান। বেশ পছন্দ হয়ে গেল। পাশেই ছিল ভারত সেবাশ্রম
সংঘের এক কেন্দ্র। অন্নকূটে দু বেলা খাবার। টিউবওয়েলের জলে দুপুরে
স্নান। রাতে পার্কের বেঞ্চে শুয়ে আরামের ঘুম। আমায় আর পায় কে?
ভোজনং যত্রং তত্রং শয়নং হট্টমন্দিরে। আমার এখন ওপার অগাধ
স্বাধীনতা। কেউ শাসন করার নেই। ফরিদপুরে শেষের দিকটা খুব বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম।
খুব খিটখিটে। আমাদের গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবার। চলতে ফিরতে নানা সংস্কার, বিধি নিষেধ। কিন্তু যেদিন থেকে জেনেছি আমি এঁদের কেউ না, আমি এসব নিয়ম কানুন মানবো কেন? গরাই
নদীতে আমায় ডিঙ্গি বাইতে শিখিয়েছিল যে আসগর, আমাদের
প্রজা,
মুসলমান মানে আমাদের সমাজে জল-অচল। তো?
আমি দিব্যি এক পাতায় টিফিন ভাগ করে খেয়েছি তার সাথে। বাড়ির
অজান্তেই। আমাদের দেবদেউলের পাশে ছিল এক পঞ্চমুন্ডীর আসন। একদিন মাটি খুঁড়ে খুঁজে
দেখতে গেলাম আসনের তলায় সত্যি আছেটা কি? মাসী ওই একদিনই গায়ে হাত তুলেছিলেন আমার। না। মার খেয়েও মাসীর উপর অভিমান করি
নি। আমাকে প্রহার না করে মাসীর উপায় ছিল না। ভাগ্যিস পালিয়ে এলাম। আমার জন্য
মা্সীকে আর কারও কাছে ছোট হতে হবে না।
কিন্তু পার্কেও শান্তি কই? একদিন, বলা ভাল, এক রাতে পার্কের বেঞ্চে শুয়ে কখন অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঢাকা শহরের দোকানপাট
বন্ধ হব হব। অন্নকূট থেকে ভরপেট খেয়ে আমার দু চোখ তখন যাকে বলে জুড়ে গেছে।
সুখনিদ্রায়। কে যেন ডাকলেন-- ওঠ খোকা। বাড়ি যাও।
কে ডাকে? কাঁচা ঘুমে পাক ধরছে সবে। চটকে গেল। বিরক্ত হলাম খুব। চোখ কচলে উঠে দেখি এক
কোট টাই পরা সুবেশ ভদ্রলোক সামনে দাঁড়িয়ে।
তো? =মেজাজটাই বিগড়ে গেল-- কে আপনি?
আমার ঘুম ভাঙালেন কেন?
-----রাত হল। বাড়ি যেতে হবে না?
বেঞ্চেই শুয়ে থাকবে?
খুব রাগের সঙ্গে উত্তর দিলাম-- সে
খোঁজে আপনার কি দরকার মশাই? আমি
এখানেই থাকি। এই আকাশের নীচেই আমার ঘর বলুন যাই বলুন সব। আমায় ঘুমোতে দিন।
জ্বালাবেন না।
আমি এবার বেঞ্চে পাশ ফিরে আবার শুলাম।
কি বিপদ! ভদ্রলোক একপাশে বসে পড়লেন।
এবার গায়ে হাত দিয়ে খুব স্নেহের সঙ্গে জানতে চাইলেন-- বাড়ি থেকে পালিয়েছ বুঝি?
আমি ঝাঁঝের সঙ্গে জানালাম আমি তা
জানাতে বাধ্য নই। এত প্রশ্ন করার উনি কে? রাগের চোটে বলেও ফেললাম আমার আসলে আপনজন কেউ নেই। ফেরার কোন ঠিকানাও নেই। এই
পার্ক এখন আমার আস্তানা।
ক'দিন?
ভদ্রলোক কথা থামালেন না। মাথার উপর ছাদ নেই। সামনে বর্ষায়,
শীতে কি হবে ভেবেছ? হঠাৎ বলে বসলেন-- আমি বলি কি তুমি আমার সঙ্গে চল। আমার বাসায়। বাসায় আমার
স্ত্রী আছেন। আর দুই মেয়ে। আমার কোন ছেলে নেই। তুমি আমার কাছে ছেলের আদরে থাকতে
পার। ভেবে দেখ।
এতক্ষনে মতলব টের পেলাম। এই বয়সে কম তো দেখলাম না! সপাটে জবাব দিলাম-- বাচ্চা ছেলে দেখে ভাববেন না আমি
দুনিয়া দেখি নি। আপনার চাকর লাগবে তো? যান মশাই, আমি কারও চাকর হতে জন্মাই নি।
এই বেশ আছি। আপনি বিদেয় হন।
ঘটনা হল, আমার
এই কথায় রাগা তো দূরের কথা মহাশয় আমার পাশে বসে বলে চললেন-- ছি ছি। তোমায় চাকর
ভাবছে কে? আমি কথা দিচ্ছি তোমায় সন্তান
স্নেহে মানুষ করব। আমি কি তোমায় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখব নাকি?
গিয়েই দেখ। ভাল না লাগলে আটকাব না।
দেরী কর না। চল।
নিমরাজি ছেলেটি কখন যেন হাঁটতে শুরু
করল। পার্কের বাইরে দাঁড় করানো ছিল একটি দামী বিদেশী গাড়ি। যাওয়ার পথে কিছু
কেনাকাটা করলেন আমার জন্য। জামাকাপড়। বাটার দোকানে ঝাঁপ পড়ার মুহূর্তে থামালেন।
জুতো কিনলেন। চপ্পল। গাড়ি থামল গিয়ে সদরঘাট। একটি সুদৃশ্য বাংলোর গেটে কলিং বেল
বাজাতেই দরজা অল্প ফাঁক হল। মুখ বাড়ালেন পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে
সিঁদুর এক মা। দুপাশে উঁকি দিচ্ছে দুটি ছোট্ট মেয়ে। একটু পরেই নাম জানব। মায়ের চোখে প্রশ্ন, বিস্ময়। জানতে চাইলেন-- আমি কে?
ভদ্রলোক এক কথায় জবাব দিলেন-- পথে
কুড়িয়ে পেলাম হীরে। কার তা জানা নেই। যত্ন করে রেখে দাও।
ভদ্রলোক দ্রুত ভিতরে গেলেন। আমি রইলাম
মায়ের জিম্মায়।
আশ্চর্য! প্রথম দেখাতেই মা-কে আমার
ভাল লেগে গেছিল। মা আমায় আক্ষরিক অর্থেই বুকে টেনে নিলেন। স্নানঘরে নিজের হাতে
গোসল করিয়ে দিলেন। নতুন পোষাকে আমি তখন ফিট বাবুটি।
( কামালদার কথায় কখন মগ্ন ডুবে গেছি।
একটি ভাগ্যহত শিশু আত্মপরিচয়ের সংকট নিয়ে ঘর ছেড়েছে। রূপকথার মত আশ্রয় পাচ্ছে
পার্কের বেঞ্চ থেকে সদরঘাটের বাংলোয়। শুধু মা নয়, সাথে পাচ্ছে দু দুটি বোন। মেলাতে পারছিলাম না মায়ের কপালে সিঁদুর আর গোসলের
চিত্রকল্প। কামালদা দ্রুত সেই প্রসঙ্গে চলে এলেন।)
যে ভদ্রলোক আশ্রয় দিলেন তিনি আলী হোসেন
সাহেব। ঢাকায় ইউ এস আই এস লাইব্রেরির উচ্চপদস্থ কর্মী। দুই মেয়ে তাঁর। আমার নতুন
করে পাওয়া দুই বোন-- শাহানারা আর জাহানারা। আলী সাহেব গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির
সমর্থক ছিলেন। হিন্দু মেয়ে, ব্রাহ্মণের মেয়েকে বিয়ে
করেছিলেন স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে। রেজিস্ট্রি করে। স্ত্রীকে ধর্মান্তরিত করেন
নি। দোতলায় মায়ের জন্য একটি ঠাকুরঘর পর্যন্ত রয়েছে। মা তাঁর সংস্কার মত সিঁদুর
পরেন। বাধা কোথায়?
সেই রাত প্রাণ ভরে স্বপ্ন দেখলাম।
চাইছিলাম যেন না ফুরোয়। হয়তো গায়ে চিমটি কেটে দেখছিলাম যা কিছু ঘটছে সব সত্যি তো!
ভোর হল এক সময়। আমার নতুন দিনের, নতুন
জীবনের ভোর। আমি তখন ঘুড়ির মত উড়ছি। তুলোর মত ভাসছি। মাসীর বাড়ির হাজার বাছবিচার, বিধি নিয়ম নেই এখানে। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। শ্বাস নিলাম বুক ভরে। মনে হল
আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।
দিন তিনেকের মাথায় খাবার টেবিলে কথাটা
পারলেন আলী সাহেব-- তোমায় ঢাকার পাবলিক স্কুলে ভর্তি হতে হবে। আমি চাই না আমার
আশ্রিতের পরিচয়য়ে ভর্তি হও তুমি। তোমায় আমার সন্তান এই পরিচয়য়ে স্কুলে দাখিল করব
ভাবছি। সে ক্ষেত্রে তোমার একটি মুসলিম নাম দেওয়া দরকার হচ্ছে। রাজী তো?
রাজী মানে? আমি তো
এক পায়ে খাড়া। মাসীর বাড়ি আমার নাম ছিল কমল। মাসিরা ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ। এখানে আমার কমল নামটি কামাল করে নিতে বেগ পেতে হল না। কিন্তু আমার গররাজী
হওয়ার কিছু কারণও ছিল বই কি। এঁদের আমার জন্মপরিচয়ের
অন্ধকার দিকটি খুলে বলা হয় নি। ওনারা জানতেও চান নি সেভাবে এই ক'দিনে। কেন মনে হল সে কথা গোপন রাখাই ভাল। তবে কি যে মিথ্যে জন্ম পরিচয়কে
অস্বীকার করে এই পালিয়ে এসেছি, এখানেও শুরু করব আবার এক মিথ্যে
পরিচয়ে? বলে বসলাম-- কামাল নামে ভর্তি
হব। কিন্তু তার আগে আমি মুসলমান হব। সুন্নত করে। যেমন প্রথা।
বাধা দিলেন আলী সাহেব। আমার এই
প্রস্তাবে ঘোর আপত্তি জানালেন। তাঁর কথায়-- দেখ বাপু, আমি
নিজে মুসলমানের ঘরে জন্মেছি এই যা। আমি দেখ নামাজ পড়ি না। রোজাও রাখি না। তোমাদের
মা ব্রাহ্মণের মেয়ে। তিনি তাঁর মত পুজো আচ্চা নিয়ে থাকেন। আমি তাতেও বাধা দিই না।
ধর্ম ব্যাপারটা যার যার নিজের। আমার দুই মেয়েও বড় হয়ে ঠিক করবে কি তাদের ধর্ম। আমি
তো সেই রকমই ভাবি। আমি বিশ্বাস করি মার্ক্সবাদে। চাকরির স্বার্থে এটা গোপন রাখতে
হয়। তবে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জানে। তুমি একে নাবালক। নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার
বয়স হয় নি। হ্যাঁ, বড় হয়ে নিজের বুদ্ধি বিবেচনায় যদি মনে হয়
ইসলাম প্রেমের ধর্ম, তোমায় টানছে তখন যা ইচ্ছে হয়
কর। এখন যদি তোমার মতে সায় দিই বন্ধুরাই তো আড়ালে বা প্রকাশ্যেও আওয়াজ দেবে আমায়--
খুব যে প্রগতিশীলতার বড়াই কর, এতিম
ছেলেটিকে সুযোগ বুঝে এই যে সুন্নৎ করাচ্ছ--- ভাল, ভালই।
পথে এস।
আলী সাহেব আরও অনেক কিছু বলে
যাচ্ছিলেন। সেগুলি যুক্তি দিয়ে সামাল দেওয়ার বয়স বা বুদ্ধি না থাক আমার ছিল আবেগ।
এবং ছেলেমানুষি গোঁ। আমার ওই একটাই অস্ত্র।জীবনের এই অধ্যায় সত্যি দিয়ে শুরু হোক
এই আর্তি আমার জন্মের করুণ ইতিহাসের গল্পে তাঁর মন পাবে কিনা সংশয় ছিল। সংকোচ ছিল।
লজ্জাও ছিল। আমি গোঁ ধরে রইলাম। আমার এক গোঁ। এবং ব্যগ্র। আমি মুসলমান হব। নইলে
অনশন। সত্যাগ্রহ শুরু করলাম বলতে পারেন। এবং জিতলাম আমিই। আলী সাহেব বাধ্য হলেন
সম্মতি দিতে। আমার মুসলমানি কিন্তু বেশ ধুমধামের সঙ্গেই সম্পন্ন হল। বন্ধু স্বজন
আত্মীয়দের দাওয়াত দিয়েছিলেন আলী সাহেব। সবাই দোয়া করে গেলেন। অনেক উপহার পেয়েছিলাম
মনে আছে।
আমার জীবনের অন্ধকারের গল্প আলী
সাহেবকে এর পরেও খুলে বললে ভাল হত কি? পরের ইতিহাস তাহলে অন্য রকম হত? সে
কথায় আসা যাক।
ছাত্র হিসাবে মেধাবী ছিলাম। পাক্কা
তিন বছর ছিলাম আলী সাহেবের ডেরায়। সেই সুখের দিনগুলি কখনও ভুলব না। এতদিনে মা
পেয়েছি। দুটি বোন পেয়েছি। আর আলী সাহেবের যে স্নেহ যত্ন পেয়েছি তার তুলনা হয় না।
সংস্কৃতিবান মানুষ। অগাধ পড়াশুনা। যুক্তিবাদী। ওই বয়সে তাঁকে সমূহ বুঝে উঠতে পারি
নি। কিন্তু মানুষটি অযথা গম্ভীর থাকা পছন্দ করতেন না। মাসীর বাড়িতে বংশের বড়দের
সঙ্গে ছোটদের একটা দুরত্বের পাঁচিল ছিল, এখানে সেই আড়ালটাই
হাওয়া। আলী সাহেব ছেলেমেয়েদের সাথে মিশতেন বন্ধুর মত। মানে সময় পেলেই। অফিসে
শুনেছি তিনি ছিলেন রাশভারি লোক। মাসীর বাড়ি আমি ছিলাম টবের গাছ। এখানে মাটি পেলাম।
এবার শিকড় ছড়ানোর পালা। গাছটি বড় হচ্ছে।
কিন্তু ঝড় এল। গাছটিও উৎপাটিত।
(কথায় কথায় অনেকটা সময় কেটেছে। কলেজ
জীবনে কফি হাউসে এক কাপ কফি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। খুব বেশী হলে আর এক
কাপ। এখানে সময় পরিবেশ দুটোই আলাদা। কামালদা ওয়েটারকে ডেকে আর এক প্রস্থ খাবারের
অর্ডার দিলেন। ওয়েটার প্লেট তুলে টেবিল সাফা করে গেল। আবার খাবার আনবে। কামালদা
বলে চললেন--)
মাসী কিন্তু সত্যিই ভালবাসতেন আমায়।
তাঁর দুর্ভাগা বোনের বহু বেদনার একমাত্র স্মৃতি ততোধিক দুর্ভাগা এই হারিয়ে যাওয়া
শিশুটির জন্য তিনি নানা ভাবে খোঁজ নিয়েছেন। মেসো ভালবাসতেন কিনা ভেবে দেখি নি। তবে
ফরিদপুরে পাঠশালায় ভর্তি হতে মেসোর নামই বাবা হিসাবে দেখানো হয়েছিল। গোপালচন্দ্র
ভট্টাচার্য। আমার অফিস রেকর্ডেও, পাসপোর্টে, ইমিগ্রেশন সার্টিফিকেটে ওই নামটাই দেওয়া আছে। মিথ্যে হলেও একটা সামাজিক পরিচয়
তো দিয়েছিলেন। সাথে থাকলে বাড়ির পোষা গরু ছাগলের জন্যও তো মায়া পড়ে। তাঁরা দুজনেই
সন্ধান জারি রেখেছিলেন।
ঢাকায় তখন একটি ইংরেজি কাগজ বার হত--
মর্নিং স্টার। আমাদের স্টেটসম্যানের মত। তখন আজকের মত এত ছবি তোলার চল ছিল না।
আমার কোন ছবিও ছিল না মাসীর কাছে। ওঁরা কিন্তু প্রতি বছর নিয়ম করে ঠিক যেদিন
পালিয়েছিলাম ওই দিনটিতে মর্নিং স্টারে ছোট ছেলেটির বিবরণ দিয়ে নিরুদ্দেশ বিজ্ঞপ্তি
দেওয়া শুরু করলেন। বয়স, উচ্চতা, গায়ের
রং,
পরনে কি পোশাক ছিল এইসব জানিয়ে। আমি ইংরেজি কাগজ খুব
খুঁটিয়ে পড়তাম। আলী সাহেব শিখিয়েছিলেন। এতে ইংরেজি ভাষা সহজে আয়ত্তে আসবে। আমার
চোখে পড়ল ওই বিজ্ঞাপন। ভয় হত আলী সাহেবের না চোখে পড়ে। ওই জায়গাটুকু কালির দোয়াত
উল্টে বা অন্য ভাবে যাতে না
পড়তে পারে কেউ এমন করে দিতাম। অন্য কেউ মানে আলী সাহেব। উনি খবরের কাগজের
পোকা।
কাগজটি কিন্তু আলী সাহেব অফিসেও
পেতেন। পড়তেন। সুতরাং তাঁর চোখে পড়ল।
আগেই বলেছি আলী সাহেব আমার জন্মের
গল্প জানতেন না। এবং বিজ্ঞাপন চোখে পড়ায় তিনি দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিলেন।
বিবেকবান মানুষটি ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়লেন। দেখেই মনে হয়েছিল ভাল ঘরের ছেলে। একটি
পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষা এতটাই অন্ধ করে দিল তাঁকে! তাঁরই কি উচিৎ ছিল না আর একটু
বিস্তারিত খবর নেওয়া? তাঁরই হৃদয় যখন এতটা দুর্বল হয়ে
পড়েছে,
না জানি ছেলেটির সত্যিকারের বাবা মা কি যন্ত্রণাই না সহ্য
করছেন! কামাল এখন তাঁর পরিবারের একজন। তাকে ছাড়ার কথা ভাবতেই অবশ হয়ে আসছে শরীর।
কিন্তু ছেলেটির প্রতি তার বাবা মা-র দাবী অস্বীকার করেন কোন অধিকারে?
যত কষ্টই হোক কাউকে না জানিয়ে জীবনের খুব কঠিন সিদ্ধান্তটি
নিয়ে ফেললেন তিনি। ফরিদপুরে চিঠি পাঠালেন-- আপনাদের হারানিধি
হয়তো আমার হেফাজতে। যত্নেই রেখেছি সাধ্যমত। সত্বর আসুন।
(কে বলে স্মৃতি সততই সুখের?
স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম চোখের পিছনে মেঘ। গলা বৃষ্টিভেজা। এই
মুহূর্তে উনি দূরের মানুষ। সেই শৈশবে দাঁড়িয়ে। সেই দুরাগত কণ্ঠ আবার কানে এল--)
মাসী এলেন। সাথে এসেছেন মেসো। অনেক পথ
উজিয়ে এসেছেন। বেলা দ্বিপ্রহর। এ সময় অতিথিকে অন্ন ব্যঞ্জনে আপ্যায়ন বিধেয়। কিন্তু
ওনারা গোঁড়া ব্রাহ্মণ। যবনের গৃহে জলস্পর্শ করলেন না। আলী সাহেব করজোড়ে অনুনয়
করলেন। তাঁর স্ত্রী ব্রাহ্মণকন্যা। নিত্য পূজাপাঠ করেন। তিনি পবিত্র ভাবে আয়োজন
করবেন।অন্যথায় পাকশালার সমস্ত যোগান দিলে যদি তাঁরা সপাকে রাঁধেন। মেসো কিছুতেই
রাজী হলেন না। তাঁরা সেই দণ্ডেই ফিরতে চান।
মা এদিকে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন।
বোনেরা চীৎকার করে কাঁদছে। আলী সাহেব আলাদা করে ডাকলেন আমায়। বাড়ি যাও কামাল।
তোমার নিজের বাড়ি। তবে, একটা কথা। তাঁর গলায় উদ্বেগ।
তোমার বাবা দেখলাম কি ভীষণ ছোঁয়াছুত মানেন। তুমি যে মুসলমান হয়েছ ওঁরা যেন জানতে
না পারেন। ওনারা সইতে পারবেন না। শোকে মৃত্যুও হতে পারে এমন কি।
আমি মুখ নিচু করে শুনছিলাম। ঘটনার
আকস্মিকতায় হতচকিত আমিও। চোখে জল। আলী সাহেব আরও কত কি বলছিলেন। আমার মন ছিল না সেদিকে।
শেষ যে কথা কানে এল-- আমি কিন্তু সব সময় তোমার পাশে আছি জানবে। যে কোন প্রয়োজনে
জানিও।
দৃশ্যটা কল্পনা করুন। যেন মেয়েকে
শ্বশুরবাড়ি পাঠাচ্ছেন তিনি। মাসীর সাথে রওনা দিলাম। ফিরেও তাকালাম না পিছনে। ফিরব
না এখানে আর কখনও। চিঠি দেওয়ার আগে একবার অন্তত আমাকে জানাতেই পারতেন! মাসী আমায়
ফিরিয়ে নিয়ে চললেন। একটুও বাড়িয়ে বলছি না। আমার মনে হচ্ছিল ছেলেধরার খপ্পরে পড়েছি।
(একটানা কথা বলতে বলতে একটু
ক্লান্ত কি কমলদা? একটু থামলেন। একটু জিরিয়ে
নেওয়ার মত। হৃদয় খুঁড়ে বেদনার কথা শোনাচ্ছেন। ক্লান্তি নয়, তৃষ্ণায়
কাতর। গলা শুকিয়ে গেছে, ভিজিয়ে নিন আগে। দৃশ্যত আনমনা, কিন্তু কমলদা গুছিয়ে নিচ্ছিলেন টুকরো স্মৃতির খোলামকুচি। যার দাম নেই। অথচ
মহার্ঘ। মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছিলেন। তারপর। যেন ধ্যানস্থ ছিলেন,
সচকিত, আবার
সরব। যেন দূরাগত ধ্বনি। আসুন মনোযোগী হই। কান পাতি।)
ফেরার সময় নদীপথে। পদ্মা,
মেঘনা, ধলেশ্বরী
হয়ে। চার প্রহর। এ কেমন ঘরে ফিরছি? ঘর
মানে তো যার জন্য মন কেমন করে। আমি ভগ্ন মনোরথ ফিরছি। যাচ্ছি। স্বেচ্ছায় নয়। কেউ
টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোলের কাছে নিয়ে বসেছেন মাসী। চোখে জল। মুছিয়ে দিচ্ছেন। তিনি কি
ভাবছেন? আনন্দাশ্রু?
শান্ত নদীটি। ছবির মতন। যেন সেও টের পেল আমার বুকের ঝড়। সে
হঠাৎ ফুঁসে উঠল।
জাহাজ মাঝ গাঙে। ঢেউ উঠল। প্রলয়।
তুফান। আতঙ্কে যাত্রীরা কাঁদছে। জপছে যে যার ইষ্টনাম। জাহাজ ডোবে ডোবে। ভাসছে
মোচার খোলার মত। অবশেষে-- একসময়--
ঝড় থামল। আমরাও ঘাটে পৌঁছলাম। সেই
থেকেই আমার ঠিকানা ঝড়। ঘর নয়। আজীবন, আমৃত্যু সফরে আমার বিশ্বস্ত সঙ্গী। ঝড়।
যে অসম্মানের ধুলো গায়ে বাড়ি ছেড়ে
পালিয়েছিলাম ফিরে এসে দেখলাম সারা গাঁয়ে বিজয় উৎসব। তখন এতটা ভাবি নি। আজ বুঝি
আমায় ফিরিয়ে এনে তাঁরাও একটা সম্মানের লড়াই লড়ছিলেন। খুলে বলি। হিন্দু ব্রাহ্মনের
ছেলে যবনের ঘরে তিন বছর! এই তথ্যে এই শিশুটিকে ঘিরে, তখন কিশোর,
যা কিছু বিবাদ চাপা পড়ল। সমাজপতিরা, যত আত্মীয় স্বজন বাড়িতে এলেন। তুলনা ঠিক হচ্ছে না হয়তো,
তাঁরা যেন বন্দিনী সীতাকে রাবনের ডেরা থেকে উদ্ধার করে
এনেছেন। আলী সাহেব কি রাবণ? এখানে
যুদ্ধ হল কই? তিনি তো নিজের ইচ্ছায় –! তবু যবনের ঘরে তিন বছর! যবনের
অন্নে এতদিন! তার প্রায়শ্চিত্ত হওয়া চাই।
শুদ্ধি চাই।
একসাথে পৈতেটাও হয়ে যাক। বামুনের ছেলে। শেষমেশ এটাই সাব্যস্ত হল।
একবার পালিয়েছি। আমাকে বিশ্বাস নেই।
সতর্ক পাহারা বসল। যাকে নিয়ে এতকিছু আয়োজন তার মত? তার আবার মত কিসের? সব
কিছুই ধর্মমতে করা হচ্ছে। আর আমিও পড়লাম ধর্ম সংকটেই। আমার মুসলমানির কথা এঁদের
বলব না। আলী সাহেবকে কথা দেওয়া আছে। বলে দিলে মেসো মরবে শোকে?
কিন্তু আমিও বাঁচব কি?
বেশ ধুমধাম করেই পৈতা হয়ে গেল। যেভাবে
সমারোহে সুন্নৎ হয়েছিল আমার।
তখন নিয়মমত দন্ড নিয়ে সন্ন্যাস নিলাম।
আজকের দিনের মত আচার বিচার এত সংক্ষিপ্ত ছিল না। আজ পৈতে, কাল
ভূরিভোজ এই শর্টকাট ছিল না। এখন আমি সাতদিন শ্রীঘরে। ব্রহ্মচারী। দণ্ডী। দণ্ড ভাঙব
সপ্তাহ ফুরোলে।
ফান্দে পড়িয়াছে বাঘ, কান্দিতেও নারে, ব্রাহ্মন্য সম্পন্ন হইল
ষোড়শপচারে।
সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম
মুসলমানের উপনয়ন সংস্কার সম্পন্ন হইল।
****
ফেরা অব্দি মাথায় ঘুরছিল আবার পালাবো। ভবি ভুলিবার নয়। যাবো কোথায়?
আবার আলী সাহেবের কাছে? আবার মায়ের কাছে? উঁহু। সে সুতোও ছেঁড়া। ওখানেও
ফিরব না। তবে আগে তো পালাই। অথচ যেভাবে পাহারা আছে। ঘিরে আছে সব সময়। অদ্ভুত ভাবে
সুযোগ এসে গেল।
দণ্ডী ভাঙতে হয় সাত দিনের দিন। নদীতে
স্নান করে। আুবার সংসারে ফেরা। বিধিমত এই দৃশ্য শুদ্রের নিষিদ্ধ দেখা। সাথে থাকবে
কেবল ব্রাহ্মণ। এক প্রৌঢ় দুর্বল ব্রাহ্মণ আমার সঙ্গী হলেন।
এই সুবর্ণ সুযোগ। ছাড়লে আবার পাবো না।
সুতরাং,
বামুন মারি নি কিন্তু পেটালাম। উধাও হলাম।
দৃশ্যটি ভাবুন। এবারও পোশাক বলতে ধুতি, উত্তরীয়। আঙুলে সোনার কিছু আংটি ছিল। পৈতে উপলক্ষে পাওয়া উপহার। এ সবই অসহ্য
লাগছে। প্রাণপণে ছুটছি, আর
ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি সব। এগুলি পাথেয় হতে পারে, কাজে
লাগতে পারে, সেটাও ভাবি নি। আমার পিছুটান
নেই কোন। সীতা তাঁর স্বর্ণ আভরণ ছুঁড়ে ফেলে
তাঁর যাওয়ার পথের একটি দিশাই না রাখতে
চেয়েছিলেন? আমার সে দায় নেই। জন্মভিটা নেই।
তবু বাঁচতে হবে। বেঁচে থাকতে হবে।
দস্তুর মতন। ঠাঁই খুঁজে নেব। কোথাও না কোথাও। এবারেও ট্রেনে চাপলাম। ট্রেনে যেতে যেতে
চোখে পড়ল স্টেশনের নামফলক-- কাশিয়ানি। মনে পড়ল এখানে একটি বিখ্যাত স্কুল আছে।
টেস্ট পেপারে দেখেছি।
কাশিয়ানির বিখ্যাত সেন পরিবারের
প্রতিষ্ঠা করা স্কুল। সে সময় দোর্দণ্ড প্রতাপে স্কুল চালাচ্ছেন ভূপেন সেন মশাই।
হেড মাস্টার।
পায়ে পায়ে পৌঁছলাম স্কুলে। হেড স্যার
অফিসেই ছিলেন। সাহস করে উঁকি দিলাম-- আসব স্যার?
অনুমতির অপেক্ষা না করে আমি কিন্তু
ঢুকে পড়েছি। আমার ধড়াচুড়ো দেখে অন্য কারও
চোখ কপালে উঠতোই। স্যার সামলে নিলেন। মেঘস্বরে জানতে চাইলেন-- কি চাই?
আপনার স্কুলে পড়তে চাই স্যার – সিধে বলে দিলাম। পাল্টা প্রশ্ন আসার আগেই এও বলে দিলাম-- আমি খুব ভাগ্যহত ছেলে
স্যার। আমায় দেখার কেউ নেই। সামনে পেছনে দাঁড়াবার কেউ নেই। আমার কোন গার্জেন নেই।
তবে আমি ঢাকার বিখ্যাত স্কুলে পড়তাম স্যার। আমার কাছে প্রমাণ চাইলে দিতে পারব না।
কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা নিন। দিতে রাজী আছি। নিরাশ কব না।
একটুও না ঘাবড়ে মরীয়া হয়ে বলছিলাম যা
কিছু। আর যাই হোক, আমার কিছু তো হারাবার নেই। হেড
স্যর এতক্ষণে সকৌতুকে জানতে চাইলেন-- বটে! কেউ নেই তোমার? কেউ দেখার নেই? তা বল তো দেখি এই যে আমার
স্কুলে ভর্তি হতে চাও এর খরচ আছে তো? ক্লাসের মাস মাইনে আছে। কে দেবে? তাঁর উপর ধর বই খাতা। তার খরচ আছে। কিনতে হবে। কে দেবে?
তোমার তো আবার মাথার উপর কেউ নেই বলছ। মানে হস্টেলে থাকবে।
তারও খরচ আছে। খাই খর্চা আছে। কে দেবে?
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছিল। মুখ ফস্কে
বলে ফেললাম-- আপনি দেবেন স্যার।
ভুপেন সেন মশাই এই রকম জবাবের কথা ভাবতেই
পারেন নি। কিছু একটা ভাবলেন। তারপর প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন-- খাওয়া দাওয়া করেছ কিছু?
একজনকে ডেকে পাঠিয়ে তার সঙ্গে যেতে বললেন আমায়। খেয়ে দেয়ে
দুপুরে বিশ্রাম নিয়ে তাঁর বাড়িতে
যাওয়ার আজ্ঞা হল। তখন সিদ্ধান্ত জানাবেন।
বিকালে যখন পৌঁছলাম স্যারের বাড়ি তিনি
তখন আরও কিছু বয়স্য জনের সঙ্গে দাওয়ায়। মনে হয় আমার কথাই আলোচনা হচ্ছিল। আমি যেতে
দেরী করি নি। যেতেই বললেন পাশের জনকে-- এর কথাই বলছিলাম। এবার আমার দিকে ঘুরে
সরাসরি বললেন-- কোন ক্লাসে পড়তে চাও? ঢাকায় ইংরেজি মাধ্যমে সাত ক্লাসে পড়তাম স্যার। এখানেও সেভেন থেকেই শুরু করব।
এখানে তো বাংলা মাধ্যমে পড়তে হবে।
স্যার বললেন-- বেশ। কিন্তু তোমার সব
খরচ আমায় দিতে হবে বলেছ। আমি রাজী। তবে আমারও কিছু শর্ত আছে। কানাইলাল আমার
স্কুলের ক্লাস সেভেনের ফার্স্ট বয়। তাকে হারাতে হবে। যদি পার তোমার স্কুল মায় কলেজ
শিক্ষার ভার আমার। রাজী।
দ্বিতীয় অপশন নেই। তৎক্ষণাৎ জানালাম--
রাজী।
বিনীত কণ্ঠে এটুকু জানিয়ে রাখি কথা
রেখেছিলাম। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষাতেই প্রমাণ দিলাম। ব্যস। চোখে পড়ে গেলাম স্যারেদের
আর সমস্ত ছাত্রদেরও। ভাগ্যের আকাশ তবে মেঘমুক্ত। তাই? মেঘ ঘনাল বাংলার আকাশে। পূব বাংলা। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান।
একান্নর ভাষা আন্দোলনের পর আট বছর
কেটে গেছে। বাংলা ভাষার অধিকার অর্জিত হয়েছে। কিন্তু নতুন নতুন আঘাত আসছে নানা
ভাবে। মার্শাল শাসক ফরমান দিলেন পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত হবে – পাক সরেজমিন সাদ বাদ। বলে নিই, এত দিন
দুই পাকিস্তানে এক জাতীয় সঙ্গীতের চলন ছিল না। ১৯৫৬য় পূব পাকিস্তানের বাঙালী,
বিশেষ করে মুসলমান বাঙালীর বাংলায় যে জাতীয় সংগীত গাওয়ার
অভিজ্ঞতা হয় সেটি ছিল কবি গোলাম মোস্তাফার লেখা-- পুরব বাংলার শ্যামলিমায়,
পঞ্চনদীর তীরে অরুণিমায়, ধুসর
সিন্ধু মরুসাহারায়, দুনিয়ায় জাগে যে আবাদ,পাকিস্তান জিন্দাবাদ। ১৯৫৮ য় এলেন আইয়ুব খান। সামরিক
ফরমানের এক খোঁচায় গানটি বাতিল হল। এল পুস্তু ভাষায় লেখা-- পাক সার জমিন সাদ বাদ,
কিসওয়ারে
হাছিন সাদ বাদ। বাঙালীর আঁতে
স্বাভাবিক ভাবেই লাগল। সংখ্যার বিচারে দুই পাকিস্তান মিলিয়ে বাংলাই সংখ্যা
গরিষ্ঠের ভাষা। এটিও তাদের কাছে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্ত মনে হল। আপাতভাবে
পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত হবে একটাই এ ভাবনায় যুক্তি আছে। কিন্তু সেই সম্মান বাংলা
ভাষা পাবে না কেন। জনমানসে ক্ষোভ দানা বাঁধল। একান্নর মতই এবারেও এগিয়ে এলেন
ছাত্ররা। সিদ্ধান্ত হল স্কুলে স্কুলে ছাত্ররা স্বাধীনতা দিবসের,
মানে ১৪ ই আগস্টের পতাকা উত্তোলন বয়কট করবে। আন্দোলন জারি
থাকবে।
এ ঘটনাটি, এখনও স্পষ্ট মনে আছে, অক্টোবরের।
তখনকার হিসেবে জিলা ফরিদপুর, উপজিলা গোপালগঞ্জ। থানা
কাশিয়ানি।স্কুলের পাশেই যে ময়দান, তার এক
কিনারে ইকবাল ক্লাব। স্থানীয় বয়স্করা মনে করতে পারবেন। চায়ের দোকানে বসেছিলাম আমরা
কয়েকজন। থানায় অভিযোগ দায়ের হল বিপ্লব উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে পতাকা উত্তোলনে
আমাদের গরহাজিরায় জাতীয় পতাকার অসম্মান হয়েছে। বাকিদেড় কথা এখন বলছি না। গ্রেপ্তার
হলাম আমি।
****
(৪)
কমলদা বলে চললেন--
তারিখটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ২৭ শে
অক্টোবর ১৯৫৯। এই দিনেই ঠিক একবছর আগে পাকিস্তানে প্রথম জারি হয়েছে সামরিক শাসন। একান্নয় একটি মিলিটারি
ক্যু ব্যর্থ হয়েছিল। কম্যুনিস্ট কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজেরও সমর্থন ছিল তার পিছনে।
পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা জেনারাল আয়ুব খানের সহায়তায় তা
দমন করেন। আয়ুব প্রমোশন পেয়েছিলেন অনেককে ডিঙিয়ে। আঠান্নয় তিনি মীর্জা তাঁকেই
সামরিক প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ দেন। এমনকি আয়ুবকে প্রধানমন্ত্রী করে প্রকৌশলীদের
সমন্বয়ে একটি মন্ত্রী সভাও গড়ে দেন। আয়ুবের এই প্রধানমন্ত্রীত্বের মেয়াদ ছিল মাত্র
১৩ ঘণ্টার। পাকিস্তানের সব চেয়ে কম সময়ের পি এম। বন্দুকের মুখে মীর্জা পদত্যাগে
বাধ্য হন। সংবিধান বাতিল ঘোষিত হয়। আয়ুব হলেন সর্বেসর্বা। ইহাই বিপ্লব। এই বিপ্লব
উদযাপনের জন্যই এই দিনের পতাকা উত্তোলন। সেখানে হাজির না থাকা অপরাধ বই কি।
মীর্জা সম্বন্ধে কিন্তু একটি তথ্য এখানে জানিয়ে দিই। বংশ পরিচয়ে ইনি
মুর্শিদাবাদের রাজ পরিবারের সেই মীরজাফরের নাতির তরফ। মীরজাফর খাল কেটে যে কুমীর
এনেছিলেন তা ব্রিটিশের শাসন। মীর্জা গণতন্ত্রের আঙিনায় খাল কেটে যে কুমীর আনলেন তা
মার্শাল ল। যাই হোক, কথায় আসি।
জেল হাজতে এক রাত। পর দিনই আমায় পেশ করা হল আদালতে। পুলিশ খুব তৎপর ছিল বলতেই হবে। সামরিক জমানা।
কাজে গতি এসেছে। কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতের
প্রশ্নে যতই চাপা অসন্তোষ থাক, সামরিক
শাসনের প্রাথমিক ধাক্কা তখনও সামলে উঠতে
পারে নি জনতা। আয়ুব কিছু জনমুখী সংস্কারেও হাত দিলেন। ভূমি সংস্কার করলেন।
কালোবাজারি আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। কিন্তু গণতন্ত্রের অভিলাষ মানুষের
মনের মধ্যে ধুমায়িত হচ্ছিল। চুয়ান্নতেই পাকিস্তান মুসলিম লীগ প্রায় মুছে গেছিল
পুবের মাটিতে। স্বায়ত্তশাসন এমন কি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের উদ্ভব, বাঙালী জাতিসত্ত্বার উত্থান একটি ঐতিহাসিক পরিণতি।
ছাত্ররাই উদ্যোগ নিল প্রথমে।
গণতন্ত্রের খুনি সামরিক শাসনকে তারা বিপ্লব মানতে রাজী নয়। কিন্তু কতটা সোচ্চার
প্রতিবাদ সম্ভব এখন? সারা পাকিস্তানের জনতার ৫৪ % বাঙালী। কিন্তু
প্রশাসনে এবং প্রগতির হিস্যায় তারা আনুপাতিক ভাবে বঞ্চিত। পূব পাকিস্তান কার্যত
পশ্চিমের কলোনি। তবু পাকিস্তান ভাঙার কথা স্বপ্নেও ভাবি নি আমরা। গোটা পঞ্চাশের
দশক আমরা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছি। তবু ঐক্য চেয়েছি পশ্চিমের সাথে। ক্লাসে
শিখতাম-- ভারতের ম্যাপের পুবে ও পশ্চিমে পাখির দুই ডানার মত কি সুন্দর পাকিস্তান!
পাখিটি কোথায় তখনও ভাবতে শিখি নি। সিদ্ধান্ত হয়েছিল সমূহ বয়কট নয়,
প্রতীকী বয়কট করা হবে। নেতৃত্বে ছিলাম আমরা জনা পাঁচেক।
বাকিদের আড়াল করার জন্য নানান উদ্যোগ ছিল। অভিভাবকদের তরফে। আমার তো কেউ নেই!
ও সি আমায় চিনতেন। পাকিস্তানে ছাত্ররা
মানুষ হোত ভারতের সঙ্গে একটি ছায়াযুদ্ধের আবহেই। প্রশাসন রক্ষী বাহিনী গড়ে দিচ্ছে।
সামিল ছাত্ররা। আমিও। ভারতীয় চর ধরে পুলিশের প্রশংসা পেয়েছি এক সময়। স্কুল স্তরে
জাতির জনক জিন্নাকে নিয়ে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে প্রাইজ পেয়েছি। উনি
জানতেন। তবু সামরিক ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করার সাধ্য ছিল না তার। হাবে ভাবে আমার
প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করলেন অবশ্য। আদালতে কিন্তু সহজেই পার পেয়ে গেলাম। আদালত
তো দু দেশেই ব্রিটিশ উত্তরাধিকার। আমি নাবালক। সুতরাং অভিযোগ গ্রাহ্য হল না।
বেকসুর খালাস।
শাসক ছাড়ল না। এবারে কাজীর বিচার।
জাতীয় পতাকার অসম্মান করেছি। এই অপরাধ
তাঁর বিচারের আর শাস্তির আওতায় পড়ে। এখানে সাবালক বা নাবালক তা বিবেচ্য নয়। যা
বিবেচনার তা হোল শাস্তির মাত্রা।
কাজী সাহেব আমায় আশীটি বেত্রাঘাতের
আদেশ দিলেন। কিন্তু অপরাধী কিশোরের মুখ দেখে তাঁর মায়া হোল। আদেশ দিলেন-- বয়স বর
কম। নাদান। আশীটি বেত মার। কিন্তু আস্তে। না লাগে।
কাজীর বিচার নিয়ে নানা জনে নানা কথা
বলে থাকেন, হাসি রঙ্গ করেন শুনেছি। কিন্তু এই বিচারে বুঝেছিলাম শাসন করা তারই সাজে যিনি সোহাগ করেন। কাজীর
বিচারের এই মানবিক স্বরূপ আমি শরীর দিয়ে যতটা তারও চেয়ে হৃদয় দিয়ে বুঝলাম।
স্কুলে ফিরলাম। এবং ফিরেই যেন মাথায়
বাজ পড়ল আমার। খবর পেলাম স্কুল কমিটি রাস্টিকেট করেছেন আমায়। হেড স্যার নিজে অফিস
ঘরে ডেকে খবর দিলেন। বলা ভাল এমন অবস্থা হবে ভাবি নি। হেড স্যার আমার সব কাজেই
লক্ষ্য রাখতেন। বাধা দেন নি। বরং টের পেতাম তাঁর প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে।
কি করব এখন? ভিতরে তোলপাড়। কানে এল-- স্যার বলছেন-- আমরা নিরুপায়। তুমি নাবালক। তাই আদালতে
ছাড়া পেয়েছ। সরকারও বলে নি কিছু। কিন্তু বাস্তব কথা হল মিলিটারিকে খেপিয়ে আমি
স্কুল রাখতে পারব না। তারা যা পারে নি আমায় কিছুটা হলেও করে দেখাতে হোল। তবে তুমি
নিরাশ্রয় ভেব না। আজ থেকে হস্টেলে নয়, তুমি থাকবে আমার
বাড়িতেই। ফাইনাল পরীক্ষা দিও প্রাইভেটে।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমার আর কোন বাঁধন
রইল না। তো ঝাঁপ দিলাম।
বাহান্নয় বাংলা ভাষার অধিকার অর্জন
করেছিলাম আমরা। সত্য। কিন্তু পাক জমানায় নিরন্তর বাধা এসেছে তার প্রয়োগে,
চর্চায়। ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষে নীল হতে হতে বাঙালী
তখন উপশম চেয়েছে, ত্রান চেয়েছে,
আরোগ্য চেয়েছে রবীন্দ্র, নজরুল, হাছন, লালনে। তার লোকায়ত ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে।
ছায়ানট ও সহযোগী বন্ধুরা ক্রমশ শিকড়ের
সন্ধানে ব্রতী হয়েছেন। একদিকে অলীক অবাস্তব পাক জাতীয়তা, অন্য দিকে বাঙালীর আত্ম অন্বেষণ – আমাদের যাত্রা হল শুরু।
সে গল্প শোনাতে গেলে রাত কেটে যাবে,তবু
শেষ হবে না। 'পাকিস্তান'
এই অসম্ভব স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল যে বাঙালীরা তাদের মোহভঙ্গ
হচ্ছিল ক্রমেই। ছলে বলে উর্দু চাপানোর কৌশল অব্যাহত। রবীন্দ্রনাথ ব্রাত্য। এমনকি
নজরুল সম্পাদিত হচ্ছেন ইচ্ছেমত। অথচ জিন্নাহ যে
পাকিস্তান চেয়েছিলেন তা শুধু মুসলমানের নয়। সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থান,
সমান অধিকার সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। জিন্নাহ নিজে
ছিলেন মুক্তমনা, অসাম্প্রদায়িক। পাক সংসদে জিন্নার প্রথম ভাষণ পড়ে দেখুন।
দুর্ভাগ্য জিন্না দেহ রাখলেন। লিয়াকত আলী খান নিহত হলেন। পাক গণতন্ত্রের চারা
গাছটি মুড়িয়ে খেল
কারা তা সবাই জানেন। বলার অপেক্ষা
রাখে না।
সদ্য গঠিত পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান
বাঙালী তখনও শিক্ষায় পিছিয়ে। প্রাগ্রসর হিন্দুরা দেশ ছাড়ছেন। প্রমাদ গনলেন মৌলনা
ভাসানির মত নেতারা। এগিয়ে এলেন কবি জসীমউদ্দিন। আবদুল মতিন। বয়সে তরুণ মতিনকে পরে আমরা ভাষা মতিন বলে চিনব। গঠন করা হল
সংখ্যালঘু মৈত্রী সমিতি। সমিতির কাজ
হিন্দুদের বিশেষ করে বোঝানো এ দেশ, এ মাটি পরম্পরাগত ভাবেই আপনাদের। আপনারা গেলে ভাষার বিপদ। বাংলা ভাষা বাঁচবে
না। আমি সক্রিয় ভাবে সামিল হলাম এই উদ্যোগে। নেতৃত্বের আলোয় আসার মোহ
আমার ছিল না। একে তো পুলিশের খাতায় নাম উঠে গেছে। মতিনের সাথে পরিচয় বাড়ল। মতিন
আমায় কাজ দিলেন। কিন্তু আড়ালে রাখাই শ্রেয় মনে করলেন। আমি তাই এই পর্বে কর্মী
ছিলাম। নেতা নই। তবে এই পর্বে মানুষের কাছে পৌঁছতে শিখলাম। মানুষকে ভালবাসতে শিখলাম।
ভালোবাসা পেলামও।শিখলাম ভূগোল দিয়ে জাতি
পরিচয় হয় না,
ভাষাই হল জাতীয়তার অসাম্প্রদায়িক একক।
তখন তো আজকের মত ওয়েব ছিল না। এত
বলিষ্ঠ মিডিয়া ছিল না। সীমান্ত পার হত কেবল কলহ আর বিদ্বেষের খবর। কে জানত এমন
একটি মৈত্রী প্রচেষ্টা সেদিনও সক্রিয় ছিল? কমলদা না বললে জানাই হোত না কিছু। ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম
হয়তো। কমলদা বললেন--
শুনছেন? দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা এসে গেল। প্রাইভেটে ফর্ম
ভরলাম। পরীক্ষা দিলাম। এই অবকাশে আরও কি দায়িত্ব পাব ভাবছি, মতিন খবর দিল--- পালাও। এক্ষুনি পালাও।
মতিন আমার ভাগ্য বিড়ম্বনার খুঁটিনাটি
না হোক অনেকটাই জানত। জানত আমার কোন পিছুটান নেই। এদিকে
নাবালক যে ছেলেটিকে একদিন নাগালে পায় নি, জঙ্গিশাহী ওত পেতে আছে। তার অভিধানে কোন ক্ষমা নেই। কঠিন সাঁড়াশি ঘাড় তাক করে
আছে। সাবালক হলেই গারদে।
দেশ ছাড়লাম। এক বস্ত্রে। এক দণ্ডে।
বলা হোল না –
আবার আসিব ফিরে।
শহর কোলকাতায় আমার বেঁচে থাকার
রোজনামচা বারান্তরে শোনাব। শুধু এটুকু জানাই অদ্ভুত ভাবে আশ্রয় পেলাম ফাদার
আঁতোয়ানের কাছে। ভারত পথিক ফাদার আঁতোয়ান ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক
ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক। একে একে আলাপ হয়ে গেল কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়,
কবি বিষ্ণু দে, কবি শুদ্ধসত্ত বসু-- সাহিত্য আর বিজ্ঞান জগতের অনেক মহারথীদের সঙ্গে। তাঁদের
সস্নেহ প্রশ্রয়ে টিঁকে গেলাম।বাঁচার জন্য নানা জীবিকায় গেছি। রেসের মাঠের জকি,
কাগজের হকার, হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের
কম্পাউন্ডার-- কি না! এবং এই পর্বে ফাদারকে এত ভালোবেসে ফেললাম! যেমন
রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, তেমনি বাজাতেন বেহালা। বেহালার
করুণ সুরে কি যে মথিত হতাম! একদিন ফাদারকে আবেদন জানালাম আমায় দীক্ষা দিন।
ব্যাপ্টাইজ করুন।
আমার জীবনের গল্প ফাদারকে বিশদে
শুনিয়েছিলাম। ফাদার বোঝানোর প্রয়াস পেলেন তুমি মানব সাগরে স্নান করেছ কমল। তোমার
আর নদী নালায় ডুব দেওয়ার দরকার নেই। যেমন আছো, থাকো।
ফাদারকে চোখের জলে জানালাম দয়াল যীশুকে আমি ভালবাসি ফাদার। আমায় ফেরাবেন না।
ফাদার ফেরান নি আমায়।
তার মানে খ্রিশ্চান হলেন?
এখন?-- প্রশ্ন
করলাম।
কমলদা বললেন – আপনি
তো জানেন,
আমি এথিস্ট। নিরিশ্বরবাদী।
অনেকটা সময় নিয়েছি আমরা। কমলদাকে
আজকের মত শেষ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম-- যে গল্প আপনার শুনলাম কমলদা তা সত্য বলেই কোন
রোমাঞ্চ কাহিনীকেও হার মানায়। কিন্তু যে উত্তর শোনার জন্য এই সাক্ষাৎ আজকের তা
বললেন কই?
আমি তো শুনতে চেয়েছিলাম বিয়ে করেন নি কেন।
কমলদা ডেসার্টের অর্ডার দিলেন। তারপর
অনুচ্চ কণ্ঠে বলতে শুরু করলেন--
ভেবে দেখুন পার্থ,
মা যদি আমি গর্ভে থাকতেই আত্মহত্যা করতেন আমার এই পৃথিবীতে
আসাই হোত না। ভেবে দেখুন তো যে মা আমায় দশ মাস গর্ভে ধারণ করলেন,
যার দয়ায় আমি দুনিয়ার আলো দেখলাম তাঁর কোন স্মৃতি আমার নেই।
এমন হতভাগ্য আর কেউ আপনার জানা আছে?
একটু থেমে বললেন--
জাবালির গল্প জানেন তো?
জাবালির পিতৃপরিচয় ছিল না। কিন্তু মা ছিল। মায়ের স্মৃতি
দূরের কথা মায়ের নাম অব্দি আমায় জানায় নি কেউ। আচ্ছা মা যখন আমায় গর্ভে ধরেন তাঁর
বয়স কত ছিল? ১৮? ১৯? ২২?
বলতে পারেন আমার যখন বিবাহের বয়স হোল, যুবক হলাম ঘরে বাইরে যে কোন মেয়েকে দেখে যে প্রশ্ন আমায় প্রথম তাড়িত করত আমার
মা কি এই রকম দেখতে ছিলেন?
আজীবন প্রতিটি মেয়ের মুখে নিজের
মা-কে খুঁজে ফিরলেন কমলদা! পরিযায়ী পাখি। বিবাহের লোভনীয় অধ্যায় তাঁর জীবনে এল না
কখনও।
আর কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না কমলদা।
আমিও কান্নায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি। কমলদা এবার তাঁর বাসায় ফিরবেন যার পোশাকি নাম
সলিচুড। আমারও একটু নির্জনতা চাই। আপাতত জনারণ্যে রাস্তায় নেমে এলাম। দুজনেই। একা।
পার্থ বসু
কামালদার আরেক কিস্তি কবে পাবো?তর সইছে না।মাঝে মাঝে আপনার শরীর খারাপ যায়।তখন ভয় হয়।ভয় হয় কামালদার জন্যও।
উত্তরমুছুন