আলোছায়ার বেদনাকীর্ণ জোৎস্না রাতের কবি তৈমুর খান
নাসির
ওয়াদেন
কবি অভাবী নৌকায় চড়ে কষ্টের জলে
বিতৃষ্ণার পাল তুলে যখন মনোজগতের কল্পিত জোৎস্নার ভেতর দিয়ে দুঃখ সাগরে পাড়ি দিতে
থাকেন,
তখন তাঁর বোধের জগতে নাড়া দেয় বিশ্বাসের ভগ্নচূড়া চর। যে
চরের উপর প্রপতিত সূর্যরশ্মি সদ্য ধুয়ে যাওয়া বালির চিকচিক সৌন্দর্যকে প্রস্ফুটিত
করে মনের মধ্যে ফোঁটা ফুলের মতো, তখন চারিদিকের হতাশা আর
বেদনাগুলো মিলেমিশে, জোটবেঁধে,অহংকারী
স্রোতের দ্বারা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
রাত্রি অন্ধকার,অভাবও অন্ধকার। কিন্তু রাত্রির অবসানে দিনের আলো প্রত্যাশার, বাঁচার স্পৃহাকে সজাগ করে তুললেও অভাব নিত্য লেগে থাকে সংসারে। কঠিন ও বাস্তব পাথরের আঘাতে পথ হাঁটতে হাঁটতে ' আমার
ভালো থাকা'
কিংবা ' আমার ভালো হওয়ার ' যে কল্পনা,
যে প্রচেষ্টা অনেকটা মাঠে মারা যায় অগণিত সবজিচারার ঝলসে
যাওয়ার মতো। আকাশ ছোঁয়া প্রতিযোগিতা, চীনের প্রাচীরের মতো
লোভ আর সুনামির মতো প্রতিহিংসা যখন নেমে আসে চোখের সামনে তখন নিজের পছন্দসই কাজ
খোঁজা কিংবা ভোগবিলাসী ভাবনাকে কপাল ভেবে অপার্থিব কল্পনালোকের অপ্রাপ্ত আশা ছাড়া
আর কিছুই মনে হয় না।রাত্রির অন্ধকারের মতো বিশাল পাথরের বোঝাও
কবি ঝেড়ে ফেলতে চান--- " রাত্রির লোনাস্তন আর পরকালের অলৌকিক চাবুক/ শূন্যতা
বিস্তার করে শুধু,।,।" জীবন সংকুচিত, জীবন ক্ষণস্থায়ী। তাই মনের ইচ্ছা অভিমানগুলো ক্রমাগত ক্ষয়ে
ক্ষয়ে যাচ্ছে, " উড়নায় জড়িয়ে যাচ্ছে
অভিমান/ কতক্ষণ ভরসা রাখা যাবে? গোপনে গোপনে চলে যাচ্ছে দিন
/আবছা আঁধারে,।,,,।" " যে পথ বিষাক্ত হাওয়ায় ছিন্নবিদীর্ণ হতে হতে চলে,শব্দকে পাথেয় করে, তাকে কি কেউ পথ বলে? হ্যাঁ, বলে। স্মৃতির ঔরসে রঙিন হয়ে ওঠে সেই সব পথ। পথের দীর্ঘ দীর্ঘ চরাচর জুড়ে কেঁদে
ওঠে পিপাসারা,
অসহায় পথ দেখতে থাকে কুমারী বিকেল কীভাবে সর্বনাশের দিকে
থেঁতলে যায়।" লিখেছেন নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায় কবির 'উন্মাদ
বিকেলের জংশন'
কবিতাগ্রন্থে বার্ল্ব হিসেবে। কবির ভাবনার পথ দুঃসময় ছুঁয়ে
যায় --" অন্ধপাখির গানে/ সেই স্বরলিপিতে পাই জীবনের মানে।' জীবনকে খুঁজে পেতে চায় কবি --মন ভাসে ঠিক " বৃষ্টির চাবুকে কাঁদে নদী ঘরে
ঘরে /মনের নৌকা তাতেই ভেসে যায়।" পথ দীর্ঘ -- সেই
দীর্ঘায়িত পথে ভরসাকে হাতের তলানিতে রেখে সম্মুখীন হয় হৃদয়ের কাছে। সেই পথের
বিশ্বাস,
-- একদিন মুগ্ধতা এসে বসবে মানবতার ছায়ায়। কবি আশাবাদী, হতাশাগ্রস্ত জীবনের প্রবঞ্চনা আর বিদ্যুতের চাবুক তাঁকে কোণঠাসা করতে পারে নি
--" এককোণে একটা শুকনো কাঠ ধরে ভাসছি /আর কল্পনাকে সেতু গড়ার জন্য চিৎকার
করে ভাসছি।" এবং অদূরে অলৌকিক মায়া মুগ্ধকর প্রকৃতির আলোছায়ায়--"
অন্ধকারে নক্ষত্ররা ঝরে, কোথাও ওড়ে ছাই/ একান্ত, আমি শুধু দূরে আলোর রাস্তা খুঁজে পাই।" এখানে মরানদীর
বুকে একসময় জেগে ওঠে প্লাবণের ধারা, যে ধারা বয়ে গিয়ে জন্ম দেয়
নিত্য সবুজের কণা আর বিশ্বাসী হাওয়ার তরঙ্গ -- সেই হাওয়াও লিখে রাখে অতীতের স্মৃতি, -- " সম্পর্ক জলের মতো ফিরে আসে / ফোঁটায় ফোঁটায় নামে / ভেজাতে থাকে নিশুতি বেদনায়।" শান্ত, নিরুত্তর আবেগ রোমন্থনই কবিতা। কবি ডুবে যায়
আপন মন ও মননের গভীরে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিসমূহের ভেতর
খুঁজে পায় তার বিষয় এবং রূপায়িত করার জন্য প্রেরণা --সেই প্রেরণার মধ্যদিয়েই
মন্ময় তথা ব্যক্তিনিষ্ঠ কবিতার জাত হয়। " নিজের মায়াবী
দুধটুকু তোমাকেই উৎসর্গ করি / আমার শব্দের সন্তানগুলো সব/তোমার শান্ত স্থির মুখ
লক্ষ করে /জন্ম নেয়--"। কখনো কখনো কবিকে ব্যক্তি সত্বার বাইরের বস্তুজগতের
অভিমুখী হতে হয়। মন যখন অন্তর্মুখী না হয়ে বহির্মুখী হয়ে বিশ্ব-জগতের আবেগ, অভিঘাতকে মন্থন করে কবিতার জন্ম দেয় --তখন সেই তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ কবিতা
চমৎকার রূপে নির্মিত হয় --" চুল খুলে চলে গেল সে এক ঝড়/ কোন পাহাড়ের পাদদেশে
তার ঘুমের শহর " অথবা " প্রাচুর্যের কোমরের নিচে চাঁদ ঝোলে /বিশল্যকরণী
জোৎস্না /জোৎস্নায় সারারাত খেলে/ হিরণ্য মাছেরা।" মন্ময় কবিতা বা লিরিক কবিতা
মনের গভীরে নাড়া দেয় পাঠকের -- সেই পাঠকও কল্পলোকে বিচরণ করতে থাকে -- "
জোৎস্নার ধারণা পেতে পেতে / মেঘ-ঝড়ে ঢেকে গেছে আকাশ /তস্তুরির পর তস্তুরি সাজিয়ে
দিয়েছে শূন্যতা " -- শূন্যতার মূলে আঘাত -যার ফল শূন্য - কিন্তু আঘাতের ঝংকার
কবির মনে মন্ময় চিন্তা বা ভাবকে উস্কে দিয়ে যায়। " এক একটি চাবুক সুন্দরী
নারীর মতো/সমস্ত মন জুড়ে বেদনার গান / আঘাতে আঘাতে বেজে ওঠে।"
আত্মমগ্নতা কবির হৃদয়ে --আবেগ, সংযোগ,
ব্যথা, আনন্দ,হাসিকান্নাকে
লিরিকের মূল সুর ধরলেও কবিসত্বায় তন্ময় ভাবও লক্ষ করা যায় -- বস্তুনিষ্ঠ কবিতা
আমাদের বহির্জগতের কদর্য রূপ যেমন টেনে আনে, তেমনি
মানবতার সুরও ঝংকৃত হতে থাকে। " আমার বাড়ি সেই
তো বিনয়পুর / রোজ সন্ধ্যায় ছন্দ খুঁজে ফিরি /মন্দাক্রান্তা আর কি কেউ হবে? "--মন্দাক্রান্তা কবির চোখে পার্থিব চরিত্রকেও ছাড়িয়ে গেছে, বস্তুনিষ্ঠ ভাবনাকে আলোকিত করেছে এক উপমা যা সংস্কৃতের ছন্দের মতো ধীরগতি সম্পন্ন
কিন্তু আবেগী,স্থিতধী এবং মননশীলতার চিত্রকল্প। "আমি শুধু নষ্ট হই
" -- কবি মনে মনে ভিজতে থাকে আবেগ ভরা মেঘের জলধারায় --সেই আবেগ, আস্ফালন নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় --" যতটুকু বেঁচে আছি, তার অধিক মৃত/ আস্ফালন যতটুকু তার অধিক সংযত।" কবির স্পর্শ লেগে আছে
সংযমে। সংযম ছাড়া বেঁচে থাকা যায় না, জীবনের তীব্র কশাঘাতে
মানুষ জর্জরিত হয়েও পালিয়ে যেতে চায়না --দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিবাদ করতে, লড়াই করতে চায় -- লড়াকু মন নিয়ে ভেসে যাওয়া সংসারকে খড়কুটো দিয়ে নতুন বাসা
বানাতে চায়। কবিদের কাজ ছন্নছাড়া মেঘের মতো উড়ে যাওয়া
নয় -- সেই ছন্নছাড়া মেঘকুলকে সংবদ্ধ করে, জমাট করে বৃষ্টি ঝরানো
-- সজীবতা ফিরিয়ে আনা, প্রকৃতির বুকে সবুজের উপহার বিছানো, সৃষ্টির মধ্যে মানবতার সুরকে উচ্চে তুলে ধরা, মৃতপ্রায়
জীবকে সঞ্জীবনী সুধা, বিশল্যীকরণ ঔষধি পান করান। " আবার
ফিরুক দিন অক্লান্ত শপথে / বিশ্বাসের স্বরলিপি বাজুক রক্তঝরা ঠোঁটে "। মানুষই
আসল নির্মাতা,
মানুষই গড়ে, আবার ভাঙে,ও মানুষই ইতিহাস রচনা করতে পারে। " মানুষের
অশ্রুফুলে ঝিকিমিকি রাত / মানুষের রক্তে রাঙা পূজার গোলাপ।"
অন্ধকার ভেদ করে আলো প্রজ্বলিত হয়, --" রক্তাক্ত চৈতন্য ঘিরে নামে অন্ধঘোর"--সেই অন্ধকার কাটিয়ে কবিদের নামতে হয়,-বাজীর মাঠে,
সংগ্রামের ময়দানে, যুদ্ধের
সাজে হাতে থাকে খোলা কবিতা তরবারি --উলঙ্গ তরবারি দিয়ে কুসংস্কার, আবর্জনা,
নোংরা, গ্লানি দূর করার অভিলাষে যদি
কবিতা প্রসবিত না হয়, তবে কবির জীবন বৃথা হয়ে যাবে। আবেগ নিয়ে,
প্রত্যাশা নিয়ে, সংকল্প হয়ে কবি বলেন, --" যাব,যাব যেতেই হবে / মাথার উপর বিশল্যমেঘ/মনময়ূর জেগে উঠেছে /নূপুর পরে নিচ্ছে
আবেগ।" মুখোশ সমাজের পর্দা ছিঁড়ে দিতে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে কবিতা --
সমাজসিন্ধু পার হয়ে যাবে পথের কবিতাগুলো। কবির সহজ কলম পাঠকের মনে বুনে চলেছে এক
আত্মিক সম্পর্ক। কবির ব্যক্তিগত জীবনের জ্বালা যন্ত্রণাগুলো
আজ তার প্রতিচ্ছবি হয়ে ফুটে উঠেছে কবিতার ক্যানভাসে।কবির কবিতায় ঈশ্বরানুভূতির ব্যগ্রতা ও বিনম্রতা যতখানি দেখি তারচেয়ে বেশি দেখি
আবেগবর্জিত বিশুষ্কতা, জনজীবনের, মানবজীবনের
ছায়াবাজি,
যে আলোছায়ার মধ্যদিয়ে কবির মনের ভেতরের দ্বিধা-দ্বন্দ্বগুলো
ভেঙে চুরে মানবপ্রেম ঈশ্বরপ্রেমে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে। ' জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর '-- প্রাত্যহিক জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা, প্রকৃতির বুকে সেজে ওঠা
চিত্রলিপি মানবিক ও নিঃশর্ত সমর্পণ-এর দর্শন ছাপিয়ে কবি হৃদয়ের আবেগের রসঘন
প্রকাশ কালোত্তীর্ণ আকর্ষণে একালের পাঠকের মনে উৎসাহবোধ জাগিয়ে তুলবে এই প্রত্যাশা
করতেই পারি।
কবি তৈমুর খান এ সময়ের একজন
প্রতিষ্ঠিত কবি নিঃসন্দেহে। নয়ের দশকের কবিদের
মধ্যে এক অন্যতম বৃক্ষ সদৃশ -- যার সুশীতল ছায়াতলে পাঠক একটু জিরিয়ে নিতে চাইছে।
সদ্য প্রকাশিত দুখানি কাব্যগ্রন্থ-- " জোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা
"-- প্রকাশক মধুসূদন রায়, বার্ণিক প্রকাশন-- পূর্ব
বর্ধমান, প্রচ্ছদ - নচিকেতা মাহাতো, বিনিময়--১০০
টাকা,
এবং " উন্মাদ বিকেলের জংশন " -- প্রকাশক-- প্রিয়
শিল্প প্রকাশন-- মনোজ বন্দ্যোপাধ্যায়,যাদবপুর, কলকাতা -৩২,প্রচ্ছদ ও বিন্যাস - নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়,বিনিময়--
৮০ টাকা।বোর্ড বাঁধাই,সুন্দর
মননশীল,প্রচ্ছদ ও মুদ্রণ নিখুঁত। আলোচনা
এই দুখানি কাব্যগ্রন্থ ঘিরে, পাঠকের ভালো লাগলে, আমাদেরও ভালো লাগবে।
-----------
নাসির ওয়াদেন
ভাল বিষয়। সমৃদ্ধ হওয়া যায় ।
উত্তরমুছুন