কোন এক শঙ্খ ঘোষ ও মূলধারার বাঙালি
বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়
শ্রীশুভ্র
‘যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই প্রীতি নেই করুণার আলোড়োন নেই পৃথিবী অচল আজ তাদের
সুপরামর্শ ছাড়া।‘ বলা ভালো এইরাজ্য অচল আজ
তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। কথাগুলি বহুল প্রচলিত বহু ব্যবহৃত। কিন্তু তা সত্বেও
প্রতিদিনকার জীবনে এটাই সত্য। সমাজ এবং সভ্যতায়। কারণটিও জীবনানন্দই বলে দিয়ে
গিয়েছিলেন, ‘যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশী আজ চোখে দেখে তারা।‘ আবার তারাই যে শুধু চোখ দেখে তাই নয়, তারা যা দেখাবে, যতটুকু দেখাবে, দেখতে
হবে শুধু সেইটুকুই। তার বেশি দেখতে গেলেই বিপদ বাড়বে বই কমবে না। আর ঠিক সেটাই ঘটেছে
সম্প্রতি।
নেহাৎ তিনি কবি শঙ্খ ঘোষ, তাই বিপদের ভয় করলে তাঁর চলে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি নিজের চোখে দেখতে গিয়েই এমনই বিপদ বাঁধিয়ে ফেললেন, যে তাঁর নামেরই তিনি যোগ্য কিনা আদৌ, উঠে গেল সেই প্রশ্নই। তিরস্কৃত হতে হলো, তাঁর দেখার চোখ নিয়েই। শুনতে হলো তিনি কে, যে এত বড়ো বড়ো কথা বলছেন? সত্য়ই তো অনেক বড়ো বড়ো কথা বলে ফেলেছেন কবি। এত বড়ো বড়ো কথা বলার সময় কি এখন? হলে সেই কথা তো আরও অনেকেই বলতে পারতেন। কই তাঁরা তো কিছুই বলছেন না। মুখে স্পিকটিনট লিকোপ্লাস্টার সেঁটে দিব্যি শীতঘুম দিচ্ছেন। কারণ তাঁরা জানেন কখন কোন কথাটি ঠিক কার কাছে কিভাবে বলতে হয়। সত্যই কবি সেকথা যদি জানতেন, তবে নিরর্থক এত জলঘোলা হয় না। সকলেই কবির মতো নয়। তাই তাঁদের সময়জ্ঞান টনটনে। ঠিক সময় মতোই তাঁরা শীতঘুম থেকে গাঝাড়া দিয়ে উঠবেন নিশ্চয়। ঠিক যেমন গাঝাড়া দিয়ে উঠেছিল তাদের মুখগুলি পরিবর্তন চাই হোর্ডিংয়ে। নাগরিক রাজপথ ছয়লাপ হয়ে গিয়েছিল একদিন সেই সিংহনাদে। তখন তাদের শীতঘুম ভেঙ্গেছিল একেবারে সঠিক মাহেন্দ্রক্ষণেই। পরিবর্তনের পদধ্বনি টের পেয়ে গিয়েছিলন তাঁরা অনেকটা দূর থেকেই। আশ্চর্য্য তাদের ঘ্রাণশক্তি। আশ্চর্য্য তাদের সময়জ্ঞান। নির্ভুল তাঁদের হিসাব। তাই এক পক্ষের হাত ছেড়ে দিয়ে অন্য পক্ষের হাত ধরে ক্ষমতার শিবির বদলাতে তাঁদের দুবার ভাবতে হয় নি। সাম্রাজ্যের ভগ্নাবশেষের পরে ওঁরা সাম্রাজ্য পাল্টিয়ে নিতে জানেন। তাই তাঁদের এখনকার শীতঘুম দেখে বিচলিত হওয়ার কিছু নাই। সময় মতোই ঘুম ভাঙ্গবে তাঁদের। শুকনো আঁটি চাটা আহাম্মক তাঁরা নন। আঁটি শুকানোর অপেক্ষা শুধু। ততদিন জমিয়ে চলুক না শীতঘুম ক্ষতি কি?
নেহাৎ তিনি কবি শঙ্খ ঘোষ, তাই বিপদের ভয় করলে তাঁর চলে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি নিজের চোখে দেখতে গিয়েই এমনই বিপদ বাঁধিয়ে ফেললেন, যে তাঁর নামেরই তিনি যোগ্য কিনা আদৌ, উঠে গেল সেই প্রশ্নই। তিরস্কৃত হতে হলো, তাঁর দেখার চোখ নিয়েই। শুনতে হলো তিনি কে, যে এত বড়ো বড়ো কথা বলছেন? সত্য়ই তো অনেক বড়ো বড়ো কথা বলে ফেলেছেন কবি। এত বড়ো বড়ো কথা বলার সময় কি এখন? হলে সেই কথা তো আরও অনেকেই বলতে পারতেন। কই তাঁরা তো কিছুই বলছেন না। মুখে স্পিকটিনট লিকোপ্লাস্টার সেঁটে দিব্যি শীতঘুম দিচ্ছেন। কারণ তাঁরা জানেন কখন কোন কথাটি ঠিক কার কাছে কিভাবে বলতে হয়। সত্যই কবি সেকথা যদি জানতেন, তবে নিরর্থক এত জলঘোলা হয় না। সকলেই কবির মতো নয়। তাই তাঁদের সময়জ্ঞান টনটনে। ঠিক সময় মতোই তাঁরা শীতঘুম থেকে গাঝাড়া দিয়ে উঠবেন নিশ্চয়। ঠিক যেমন গাঝাড়া দিয়ে উঠেছিল তাদের মুখগুলি পরিবর্তন চাই হোর্ডিংয়ে। নাগরিক রাজপথ ছয়লাপ হয়ে গিয়েছিল একদিন সেই সিংহনাদে। তখন তাদের শীতঘুম ভেঙ্গেছিল একেবারে সঠিক মাহেন্দ্রক্ষণেই। পরিবর্তনের পদধ্বনি টের পেয়ে গিয়েছিলন তাঁরা অনেকটা দূর থেকেই। আশ্চর্য্য তাদের ঘ্রাণশক্তি। আশ্চর্য্য তাদের সময়জ্ঞান। নির্ভুল তাঁদের হিসাব। তাই এক পক্ষের হাত ছেড়ে দিয়ে অন্য পক্ষের হাত ধরে ক্ষমতার শিবির বদলাতে তাঁদের দুবার ভাবতে হয় নি। সাম্রাজ্যের ভগ্নাবশেষের পরে ওঁরা সাম্রাজ্য পাল্টিয়ে নিতে জানেন। তাই তাঁদের এখনকার শীতঘুম দেখে বিচলিত হওয়ার কিছু নাই। সময় মতোই ঘুম ভাঙ্গবে তাঁদের। শুকনো আঁটি চাটা আহাম্মক তাঁরা নন। আঁটি শুকানোর অপেক্ষা শুধু। ততদিন জমিয়ে চলুক না শীতঘুম ক্ষতি কি?
কিন্তু তিনি শঙ্খ ঘোষ, শীতঘুম দেওয়া ধাতে নাই তার। সময়জ্ঞানও বুদ্ধিজীবীদের
মতো ততটা প্রখর নয় কোনদিন। তাঁর ঘড়ি চলে তাঁর নিজের সময় অনুসারে। যে সময়কে অনেক
সাধনায় অনেক অধ্যাবসায়ে প্রখর জীবনবোধের বিস্তারে এবং অভিজ্ঞতার প্রজ্ঞায় অর্জন
করেছেন তিনি আপন উৎকর্ষতায়। সেই সময়জ্ঞানই চালিত করে তাঁকে। প্রাণিত করে অসত্য়ের সাথে অসভ্যতার সাথে দুর্নীতির সাথে আপোস না করে চলতে। যে
কথা বলে গিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধ, তাঁর অন্তিম সময়ে; ‘আত্মদীপভব’। সেই দর্শনেরই
সার্থক উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন আমাদের কবি। তাই তাঁর সময়জ্ঞান বাকিদের থেকে আলাদা
তো হবেই। আর সেই জন্যেই ‘শকুন আর শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়; এখনো যাদের কাছে
স্বাভাবিক বলে মনে হয়, মহৎ সত্য বা রীতি’। কতো আগেই না বলে গিয়েছিলেন আরও এক
মহাকবি জীবনানন্দ দাশ। এঁরাই এই বাংলা ও বাঙালির সার্থক উত্তরাধিকারী। এঁরাই বাংলা
ও বাঙালির আবহমান ঐতিহ্যের চিরায়ত শিকড়। কিন্তু সেই তাঁদেরই হৃদয় যদি খাদ্য হয়ে
ওঠে শকুন আর শেয়ালের তখন মেজাজ ঠিক রাখাই দায়।
পরিবর্তন চাই বলে হোর্ডিংভরে প্রসিদ্ধ মুখছবিগুলি দেখে আহাম্মকের মতো আমরা
সেদিন উর্দ্ধবাহু হয়ে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম সত্যই দেখ ধর্মের কল কেমন
বাতাসে নড়ে। নিশ্চিত হবার দুরন্ত তাগিদে চোখবুঁজেই বিশ্বাস করে বসেছিলাম, যা
দেখাচ্ছে তাকেই। তাই সেদিন আমরা যারা আশ্বস্ত হয়েছিলম, বাংলার বুদ্ধিজীবীদের
জাগ্রত বিবেকের বরাভয়ে, আজকে তাঁদের সেই জাগ্রত বিবেকের শীতঘুম দেওয়ার পরিবর্তনটাই
সকলের থেকে বড়ো বেশি পীড়া দেয় মনকে। বোধকে। বিশ্বাসকে। বিশ্বকবি বলেছিলেন ‘মানুষের
প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। না সাময়িক ভাবে হতচকিত হয়ে বিশ্বাস হারিয়ে ফেললেও, আজ
আমরা বিশ্বাসের নতুন তীরভুমি খুঁজে পাচ্ছি অনেকেই। সেদিন বিশ্বাস করে বসেছিলাম যা
সত্য নয় তাকেই। তাই মোহভঙ্গ হতে সময় লাগেনি বেশি। কিন্তু আজকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে
যা সত্য তাকেই। তাই বিশ্বাস হারায়নি আমাদেরও। শুধুমাত্র দিক বদলিয়েছে বলা যায়। তাই
কবি শঙ্খ ঘোষের অসম্মানেও নাগরিক বিবেকের শীতঘুম যে ভাঙবে না, সে কথা আজ আর
বিস্ময়ের বিষয় নয় আমাদের কাছে। আসলে আজ আমাদের চোখ খুলেছে বই কি কিছুটা হলেও।
শীতঘুম ভাঙার টাইমিংটা ধরতে পারাটাই আসল। সেটি সত্য বা ন্যায়, নীতি বা বিবেকের উপর
নির্ভর করে না আদৌ। নির্ভর করে রাজনৈতিক পালাবদলের সময়জ্ঞানের উপরেই। আর সেই কারণেই
শিবির বদলানো বুদ্ধিজীবীরা জানেন পরিবর্তনের মাস্টার স্ট্রোক কখন কিভাবে একজিকিউট
করতে হয়। তাই আমাদেরও বিশ্বাস হারানোর ভয় নাই আর কবি।
বাংলার বুদ্ধিজীবী মহলেরও আছে এক সুমহান ঐতিহ্য। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার
ঐতিহ্য। রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির সাথে সহাবস্থানের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। ঠিক যে
কারণে, ব্রিটিশের নীল নকশায় ভারতীয় দালালশ্রেণীর তত্বাবধানে যেদিন অখণ্ড বাংলাকে
খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলা হলো, সেদিনও অযথা শীতঘুম ভেঙ্গে সময়ের মুখোমুখি মোকাবিলায়
উঠে দাঁড়ায়নি বুদ্ধিজীবী মহল। বরং শতসহস্র বছরের অখণ্ড জাতিসত্ত্বা ও স্বদেশের
মৃত্যুঘন্টাকেই সময়ের দাবি বলে মেনে নিতে দুবার ভাবতে হয় নি তাঁদের অধিকাংশেরই।
নিজের নিজের সাম্প্রদায়িক বর্ণকেই স্বতঃসিদ্ধ ও শেষ কথা মেনে নিয়ে সীমানা
নির্ধারণে সহমত হতে দেরি করেননি তাঁরা কেউই। এটাই বাঙালি বুদ্ধিজীবী মহলের আবহমান
ঐতিহ্য। সত্যই এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না আর। দেশ খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাক।
জাতির শিরদাঁড়া দুমরে মুচড়ে যাক, পরজাতির অধীনস্ত হতে হোক, বাঙালি বুদ্ধিজীবী
মহলের এসবে কিছু যায় আসে না। সে জানে সময়ের কাজ কখন কিভাবে করে নিতে হয়। কিভাবে
ক্ষমতার কেন্দ্রাভিমুখে লক্ষ্য স্থির রেখে ক্ষমতার পাশাপাশি হাঁটতে হয়। কিভাবে
আখের গুছিয়ে নিতে হয়। ১৯৪৭ এ দেশভাগ, বাংলার জনজীবনে যে প্রলয় নিয়ে এসেছিল, তাতে
সেদিনও বুদ্ধিজীবী মহলের কাজে কর্মে সৃষ্টি বেদনায় বিশেষ কোন প্রভাবই পড়েনি। পড়ে
নি বলেই পঞ্চাশের দশক ষাটের দশক জুড়ে টালিগঞ্জের সিনেমার সবচেয়ে হিট জুটি উত্তম
সুচিত্রার উত্থান। গল্পে গানে আবেগে কোথাও বিভক্ত দেশ বিপর্যস্ত সময় বিদ্ধস্ত জনজীবনের
কোন ছবি দেখা যায় না। একজন বিদেশীর পক্ষে সম্ভবও সম্ভব হবে না পঞ্চাশের দশক ষাটের
দশকের বাঙালির সমাজজীবনের মূল ছবিটা উদ্ধার করা। স্বর্ণযুগের যে বাংলা সঙ্গীত নিয়ে
আমাদের এত শ্লাঘা, এত তৃপ্তি, এত শান্তি, তার সাথে সেই সময়ের কোনরকম স্বরসঙ্গতিই
যে নেই, সেই সত্যই বা আমরা কজন টের পাই? একই কথা কি খাটে না বঙ্গসংস্কৃতির
অন্য়ান্য শাখার ক্ষেত্রেও? সেদিনের জনপ্রিয় সাহিত্যে, সেদিনের জনপ্রিয় থিয়েটারে? না
একজন মানিক বন্দ্যোপাধ্য়ায়, একজন বিজন ভট্টাচার্য্য একজন ঋত্বিক ঘটক কি মৃণাল সেন
দিয়ে সেদিনের বুদ্ধিজীবী মহলের দিকনির্দেশ হয় না। সেদিনের রেখাচিত্রে বাঙালি
বুদ্ধিজীবীদের যে স্বাক্ষর, তার সাথে স্বদেশ স্বজাতির সংশ্রব ছিল কতটুকু? আজ সময়
এসেছে নতুন করে ইতিহাস খুঁড়ে সত্যকে নিয়ে সঠিক পথে ভাবনা চিন্তা করার। তাহলেই
বাঙালি বুদ্ধিজীবী মহলের আবহমান ভাঁড়ামির চিত্রটা সুস্পষ্ট বোঝা যাবে। দেখা যাবে,
ক্ষমতার তালে তাল দিয়ে শীতঘুমের সংস্কৃতি একেবারেই হাল আমলের বিষয় নয় কোন।
এটাই বাঙালির কালচার। এটাই বাঙালিত্ব। চোখকান বুঁজে নীতি নৈতিকতার সব কয়টি দরজা
জানলা বন্ধ করে দিয়ে সময়ের তালে তাল দিয়ে গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে চলাই বুদ্ধিজীবী
কালচার। সেই চিত্র কংগ্রেস আমলেও যেমন ছিল, বামফ্রন্ট্রের আমলেও তদরুপ। হালের
পরিবর্তনের ঢক্কা নিনাদেও তার এতটুকু পরিবর্তন হয় নি। ব্যাপ্তি ও বিস্তারে বেড়েছে
বই কমেনি এতটুকু। সত্তরের উত্তাল সময়ের দিনগুলিতেও বুদ্ধিজীবী মহল ঠিক আজকের মতোই
ক্ষমতার গা ছুঁয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতেই ব্যস্ত ছিল। সব রকমের রাজনৈতিক
ধান্দাবাজির সাথে নিজেদের নৈতিকতাকে ঠিকঠাক টিউনিং করিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কেই বা
পিছিয়ে ছিল কতটুকু? গুটিকয়েক ব্যাতিক্রমী মানুষ ছাড়া? তাই আজ যখন বেআব্রু
বুদ্ধিজীবীদের নির্ভেজাল মুখচ্ছবিগুলি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এক একটি ঘটনার অভিঘাতে
সময়ের প্রতিবিম্বে, তখন বিস্মিত হওয়ারও কোন উপায় অবিশিষ্ট থাকে না আর। এটাই তাদের
আসল মুখচ্ছবি। এটাই তাদের ডিএনএ। কেবলই নিজের অবস্থানটুকু পাকা করে নেওয়ারই
ধান্দা। সেই ধান্দায় আর কাউকে চেনার দরকারই বা কি? দায়ই বা কার? সরকারী খেতাবের
মোহ, সরকারী অনুদানের ভাগ পাওয়ার লোভ, এদেরকে খর্ব করে রাখে। যে যার শিরদাঁড়া
বন্ধক রেখেই স্তবকতার প্রতিযোগিতায় পরস্পর গুঁতোগুঁতি করে ক্ষমতার নেক নজরে থাকাতে
চায়। জীবনানন্দের ভাষায়, ‘কেবলই আসন থেকে বড়ো নবতর সিংহাসনে যাওয়া ছাড়া গতি নেই
কোন’। সেই গতির অভিমুখেই পড়েছিল পরিবর্তন চাই-এর সেই গগন বিদারী পোস্টার। পড়েছিল
আমাদেরকেই বেকুব বানানোর পরিকল্পনায়।
স্বভাবতঃই ইতিহাস বিস্মৃত জাতি হিসাবে আমরা চোখের দেখাটুকুকেই অন্ধ
বিশ্বাসে ভরসা করে ফেলে ছিলাম। আমরা চোখবুঁজেই দেখেছিলাম।
চোখ তো আমাদের বন্ধই ছিল। ছিল বলেই, কবি সেই চোখকেই খোলাতে লিখেছেন, ‘দেখ খুলে
তোর তিন নয়ন’। দুচোখের সাধ্যেও না হলে বিবেক নৈতিকতার দৃষ্টিকেও খোলাতে হবে। নয়তো
কত ধানে কত চাল বোঝা যাবেই বা কি করে। কিন্তু মুশকিল হলো, আমাদের চোখের উপরেই যারা
অধিকারের ঠিকা নিয়ে নিয়েছে, পরিবর্তনের রায়কে হাতিয়ার করে; তারাও তো আর চুপচাপ বসে
বসে দেখতে থাকবে না ঘটনার গতিপ্রকৃতির জল মাপতে মাপতে। তাই তাদেরও ভাতঘুম ছুটে
গিয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে হম্বিতম্বি। তর্জন গর্জন। এই কোলাহল যতটা না কবির জন্যে,
তার থেকে অনেক বেশি করেই আমাদের মতো সাধারণ জনসাধারণের জন্যেই। এক আধজন কবি কি
দেখলেন, সেটা তত বড়ো কথা নয় ক্ষমতার অধিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করে রাখতে চাওয়ার
শক্তিগুলির কাছে। অনেক বড়ো হলো তিনি কি দেখাতে চাইলেন। কাদেরকে দেখাতে চাইলেন,
সেটাই। কারা সব দেখে ফেললে আখেরে আম ও বস্তা দুইই খোয়ানোর ষোলআনা সম্ভবানা, সেটাই।
এইটাই এত হম্বিতম্বির আসল রহস্য। তাই খুব সঠিক অর্থেই গর্জন শোনা গিয়েছে, এ কোন
শঙ্খ ঘোষ উঠে এলো বলে। কোন এক শঙ্খ ঘোষের উঠে আসাটাও বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা পেটেন্ট
নেওয়া উন্নয়নের উপর কথা বলার স্পর্ধিত উচ্চারণটাই। যেখানে উন্নয়ন ও তার প্রচারই
শেষ সত্য। তার উপরে থাকতে পারে না কোন উচ্চারণই। কবি সেখানে গৌণ। আরও গৌণ সেই কোন এক শঙ্খ ঘোষ। কারণ তাঁরা তো
চিরকালই একা। একলাসেরে। ভয় তাই তাঁদেরকে নিয়ে নয়। ভয় জনমতকেই। আর সেই জনমতকেই
ক্রমাগত ধারাবাহিক ভাবে বিভ্রান্ত করে রাখার উদ্দেশ্যেই দেশের বুদ্ধিজীবীদের এতটাই
প্রয়োজন ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে থাকা বা থাকতে চাওয়া শক্তিগুলির কাছে। এত সরকারী খেতাবের
মহোৎসব, এত সরকারী অনুদানের দানধ্য়ান, এত উপঢৌকেনের ছড়াছড়ি কোনকিছুই এমনি এমনি তো
নয়। জনগণের টাকাতেই জনগণকে বিভ্রান্ত করে রাখার প্রকল্পে ব্যায় অকাতরে। ফলে
বুদ্ধিজীবীদের চিরকালই পৌষমাস। রাজা আসে রাজা যায়, বুদ্ধিজীবীদের পৌষমাস চলতেই
থাকে চলতেই থাকে। আবার সেই পৌষমাসের উপরেই নির্ভর করে কতটা মসৃণ ভাবে চলতে থাকবে
রাজনৈতিক ক্ষমতার জয়রথ। সেই জয়রথের দুর্বার গতিকেই থমকে দিতে পারে এমন কোন
কার্যক্রমই অনুমোদন যোগ্য নয়। নয় বলেই বুদ্ধিজীবীদের উপরেও অলিখিত নির্দেশ বর্তায়,
জনগণকে বিভ্রান্ত করার। শঙ্খ ঘোষেদেরও তখন একলা একা চলতেই হয়। আশে পাশের ভিড়গুলোও
ক্রমশ পাতলা হতে হতে একসময় হারিয়ে যায়। যেতে থাকে। এটাই রাজনীতি। এটাই বুদ্ধিজীবী
সংস্কৃতি। এই বাংলায়।
না মূলধারার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের এই সংস্কৃতি আদৌ জনবিচ্ছিন্নও নয়। অর্থাৎ
বাঙালির জাতিগত চরিত্রের বিপরীত কোন ধরণ নয়। বরং আমাদের জাতীয় চরিত্রেরই
পরিমার্জিত এক্সেটেনশন বলা যেতে পারে। হয়তো এর পিছনে নৃতাত্বিক কোন কারণও থাকতে
পারে। সেটা বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনার বিষয়। আমাদের প্রচলিত প্রবাদেই আছে, শক্তের
ভক্ত নরমের যম। কথাটা আদৌ কথার কথাও নয়। সত্যই আমাদের জাতিগত প্রকৃতিই হলো শক্তের
ভক্ত হয়ে ওঠা। শক্তির ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের কাছে নিজেকে অতি সহজেই নত করার এই
প্রবৃত্তি ও প্রকৃতির কারণেই বাঙালি বহুবার বিদেশী শক্তির পদানত হয়েছে। এটাই
বাঙালির ধর্ম। স্বভাবতঃই ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকারের পেছনে সহজে নানান রকমের নৈতিক
অনৈতিক সুযোগসুবিধা অর্জনের ধান্দা থাকাই স্বাভাবিক। অন্তত মূলধারার বাঙালি
বুদ্ধিজীবীদের জীবন ও প্রকৃতি, কর্ম ও ধর্ম ঠিকমত পর্যালোচনা করলে সেই সত্যই উঠে
আসে না কি? এই প্রবণতা সাধারণ বাঙালি মাত্রেই সত্য়। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন
প্রণালীর পরতে পরতেই এই ধান্দাবাজির সূত্রগুলি সুপ্ত থাকে। সুযোগ ও সুবিধা মতো
সেগুলি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এবং ওঠার এই বিষয়টিও, মূলধারার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের
সময়জ্ঞানের মতোই ঠিকঠাক ঘটে থাকে অধিকাংশ সময়েই। সেই ঘটার মধ্যেই আমদের
ব্যক্তিজীবনের সাফল্য নির্ভর করে অধিকাংশ সময়েই। অর্থাৎ পূর্বেই যে সময়জ্ঞানের
প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়েছিল প্রবন্ধের শুরুতেই। এ সেই সময়জ্ঞান। কখন শীতঘুম দেবো।
আর কখন জেগে উঠবো।
তাই মূলধারার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের শীতঘুম দেখে, বিস্ময়েরও কিছু নাই। হা হুতাশ
করারও কিছু নাই। কারণ বুদ্ধিজীবীদের সাথে আমাদের পার্থক্য, প্রকৃতিগত নয়।
বিদ্য়াবুদ্ধি জনিত কলানৈপুণ্যগত মাত্র। পরিবর্তনের হোর্ডিং ভরা সেই মুখচ্ছবিগুলি
যেমন ক্ষমতা বদলের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন সময়মত, সময় মতোই শীতঘুম থেকে গা ঝাড়া
দিয়ে উঠে একটি হাত ছেড়ে দিয়ে আরেকটি হাত ধরে ফেলেছিলেন অতি সূক্ষ্ম ভাবে, ঠিক
তেমনই একবার নতুনতর হাতের নাগাল পেয়ে গেলেই আবারও তাদের শীতঘুম ভেঙ্গে যাবে। যাবেই
এবং সময় মতোই। হ্যাঁ সেদিনই তাঁরা সেই কোন
এক শঙ্খ ঘোষের পাশে এসেই আবারও ভিড় বাড়াবেন। বাড়াবেন সেই জনগনকেই নতুন দিশায়
বিভ্রান্ত করতে। ঠিক যেমনটি সেকালের নিয়মে করেছিলেন এক মীরজাফর। পলাশীর প্রান্তরে।
সিরাজের হাত ছেড়ে বিদেশী বণিকের হাত ধরার তাগিদে। কেননা দিন বদলের গন্ধ এঁরাই আগে
পান। সেখানেই এঁদের আসল বৈশিষ্ট।
কিন্তু এসবে কিছুই এসে যায় না কবি শঙ্খ ঘোষদের। তাঁরা নিজের নিজের সীমিত
সাধ্যের মধ্যে দিয়েই চিরকালই অসাধ্যকে সাধন করার সাধনায় অক্লান্ত। সেখানেই তাঁদের
জীবনবোধের ভরকেন্দ্র। যে আলো হাতে সীমাহীন অন্ধকারের বুকচিরে সত্যকে তুলে আনেন
তাঁরা নিজেদের অনন্যতায়, মহাকালে নির্ধারিত হয় তার আসল মূল্য। সেখানেই ভবিষ্যতের
প্রজন্ম তাঁদেরকে সঠিক আসনেই খুঁজে পায়। যে আসনের নাগাল পায় না কোন যুগেরই
মূলধারার বুদ্ধিজীবীকুল। এইভাবেই নির্ধারিত হয় মহতের আসল পরিচয়। এইভাবেই ধরা পড়ে
যায় ক্ষুদ্রের সকল দূর্বলতা। যেখানে কোন রাজনৈতিক ক্ষমতারই আর খবরদারি চলে না।
সত্যকে নিজেদের স্বার্থে দুমরেচুড়ে নেওয়ার। এই কারণেই বলে বিদ্যান সর্বত্র
পুজ্যতে। কিন্তু রাজার পুজো তার চামচাদের কাছেই। আজকে যারা কোন শঙ্খ ঘোষ বলে চোখ
পাকিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছেন, আর যারা সেই হুঙ্কারেও নিজেদের শীতঘুমের কোনরকম ব্যাঘাৎ
ঘটাচ্ছেন না, এই দুই পক্ষই মহাকালের নিয়মে অতিদ্রুত অতীত হয়ে যাবেন। মিলিয়ে যাবেন
ঘটমান বর্তমান থেকেই। কিন্তু ভবিষ্যৎ এসে বাঁচিয়ে রাখবে শুধুমাত্র সেই শঙ্খ
ঘোষদেরকেই, যারা সময় মতো নিঃশঙ্কায় নির্দিধায় নিঃসঙ্কোচে সমমত মতো উচ্চারণ করতে
পারেন, রাজা তোর কাপড় কোথায়?
শ্রীশুভ্র
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন