অপারেশন মৌলবাদ
সৌমিত্র চক্রবর্তী
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই চব্বিশ বছর পাকিস্তান শাসনে ছিল বিভক্ত বাংলার টুকরো। পূর্ব
ও পশ্চিম নামকরণেই ছিল বিচ্ছিন্নতার আভাস। আসলে পাকিস্তানের শাসকেরা কখনোই
পূর্বপ্রান্তের এই ভূমিকে তাদের উপনিবেশের বেশী কিছুই ভাবতে পারত না। আর এর কারনও
ছিল বহুমুখী। ভাষাগত, খাদ্যাভ্যাসগত, সংস্কৃতিগত পার্থক্য কোনোদিনই দুই প্রান্তকে কাছে তো আনেইনি, উল্টে শাসকের অহমিকায় দূরে ঠেলে দিয়েছিল।
আপাদমস্তক গরীব এই অঞ্চল থেকেই চব্বিশ বছর পাকিস্তান লুঠ করে তাদের রাজধানীতে নিয়ে যেত শষ্যসম্পদ থেকে জাত বিপুল পরিমাণে কর। অথচ উন্নয়ণের জন্য ফেরত আসত না কিছুই। সাম্রাজ্যবাদী শাসকের শাসনযন্ত্রের নিয়মে পূর্ব পাকিস্তানে তখন বাসা বেঁধেছিল মূল পাকিস্তান ভূখণ্ডের কিছু লোক আর সাতচল্লিশে দেশভাগের সময়ে ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশের কিছু মানুষ। কিন্তু পূর্বপ্রান্ততে বাসা বাঁধলেও, তারা উর্দু, আরবী বা ফার্সি না জানা বা বলা বাঙালিদের মানুষ বলে মনেই করত না। তারা ছিল মূল শাসকদের এজেন্ট। এরাই পরবর্তীতে রাজাকার, আলবদর এর মত কুখ্যাত হত্যাকারী সংগঠনগুলির স্রষ্টা। মৌলানা ভাসানী, শেখ মুজিবরের নেতৃত্বেই যে প্রথম ওপারের বাঙালি মাথা তুলেছিল তা নয়। তাদের শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ছিল ভাষা আন্দোলন। এরপরও ছোটখাটো কিছু আন্দোলন দানা বাঁধলেও বিস্ফোরণ ঘটলো ১৯৭০ এ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রায় কে গায়ের জোরে পাকিস্তানি শাসকেরা রদ করতে চাওয়ায়।
আপাদমস্তক গরীব এই অঞ্চল থেকেই চব্বিশ বছর পাকিস্তান লুঠ করে তাদের রাজধানীতে নিয়ে যেত শষ্যসম্পদ থেকে জাত বিপুল পরিমাণে কর। অথচ উন্নয়ণের জন্য ফেরত আসত না কিছুই। সাম্রাজ্যবাদী শাসকের শাসনযন্ত্রের নিয়মে পূর্ব পাকিস্তানে তখন বাসা বেঁধেছিল মূল পাকিস্তান ভূখণ্ডের কিছু লোক আর সাতচল্লিশে দেশভাগের সময়ে ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশের কিছু মানুষ। কিন্তু পূর্বপ্রান্ততে বাসা বাঁধলেও, তারা উর্দু, আরবী বা ফার্সি না জানা বা বলা বাঙালিদের মানুষ বলে মনেই করত না। তারা ছিল মূল শাসকদের এজেন্ট। এরাই পরবর্তীতে রাজাকার, আলবদর এর মত কুখ্যাত হত্যাকারী সংগঠনগুলির স্রষ্টা। মৌলানা ভাসানী, শেখ মুজিবরের নেতৃত্বেই যে প্রথম ওপারের বাঙালি মাথা তুলেছিল তা নয়। তাদের শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ছিল ভাষা আন্দোলন। এরপরও ছোটখাটো কিছু আন্দোলন দানা বাঁধলেও বিস্ফোরণ ঘটলো ১৯৭০ এ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রায় কে গায়ের জোরে পাকিস্তানি শাসকেরা রদ করতে চাওয়ায়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিম্বা তার আগের ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য নিয়ে
গবেষণার উদ্দেশ্য এই প্রতিবেদন নয়। ইতিহাস সবার জানা, বহু চর্চিত। আমরা শুধু প্রেক্ষাপট বুঝতে বেশ কিছুটা পেছনে একটু অনুসন্ধানে
যাই। উনবিংশ শতকে অনেকগুলি ঘটনা ইংরেজ শাসকদের চিন্তিত করেছিল। একের পর এক বিদ্রোহ
আর তার ফলস্বরূপ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে রাজশক্তির ভারত অধিগ্রহণ। এই
বিক্ষোভের মাত্রা কমানোর উদ্দেশ্যেই ১৮৮৫ তে অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম কে দিয়ে তৈরী
করা হল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নামে ধামাধরা সংগঠনের। সশস্ত্র বিপ্লবের প্রশমনের
উদ্দেশ্যে এই সংগঠন কাজ করবে নরম পন্থায় তা ধরেই নেওয়া হয়েছিল। আর কার্যত হয়েছিল
তাই। বলতে কি এই কংগ্রেস কোনোদিনই সংগঠিত দল ছিলনা, আদতে এ এক মঞ্চ। আর শাসকের কাছে অগ্রাধিকার পাওয়ায় বেশ কিছুটা ক্ষমতা সম্পন্ন।
তাই এর মারফত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়ার জন্য শীর্ষ স্তরের নেতৃত্বে ছিল
তীব্র প্রতিযোগিতা ও হরেক বৈধ বা অবৈধ কৌশল।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই বোঝা গেছিল ইংরেজ আর তাদের এই ব্যায়বহুল উপনিবেশ
ধরে রাখবে না। তাহলে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে কার হাতে? স্বাভাবিকভাবেই প্রিয়পাত্র কংগ্রেস ই দৌড়ে এগিয়ে। কিন্তু গোল বাঁধলো এখানেই। গান্ধীর পরেই সবচেয়ে সিনিয়র নেতা ছিলেন মহম্মদ আলি
জিন্নাহ্। আর এই জিন্নাহ্ থাকলে নতুন দেশের প্রধানমন্ত্রী যে তিনিই হবেন তা বুঝেই
দিল্লীর মসনদ দখলে শুরু হলো চিরাচরিত ষড়যন্ত্রের খেলা।
স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার সময়েই রীতিমতো প্রস্তাব পাস করিয়ে জিন্নাহ্ কে অর্থদপ্তর
দেওয়ার কৌশল, সুভাষচন্দ্র কে কংগ্রেস থেকে
তাড়ানোর কৌশল, এই খেলারই শাখাপ্রশাখা।
স্বভাবতই মর্যাদায় আহত জিন্নাহ্ বেরিয়ে গিয়ে তৈরী করলেন মুসলিম লীগ। কিন্তু মজার ব্যাপার জিন্নাহ্ বা তাঁর দল প্রথমেই স্বতন্ত্র ভূমিখন্ডের দাবী
তোলেন নি। কংগ্রেসের শীর্ষ ক্ষমতালোভীরা একের পর এক বৈষম্যমূলক আচরণ করে যাওয়ার
পরে জিন্নাহ্ দাবী তুললেন পাক - ই - স্তান এর। নিজে জিন্নাহ্ উদারমনস্ক পাশ্চাত্য শিক্ষার মানুষ ছিলেন। ধর্মীয় আচার তিনি
নিজে প্রায় পালনই করতেন না। অপরদিকে হিন্দু মৌলবাদ তখন শিকড় ছড়াতে শুরু করেছে।
বিভিন্ন ভাবে বিপর্যস্ত আমজনতাকে দলের সমর্থনে টানতে গেলে সবচেয়ে সহজ উপায় ধর্মীয়
মেরুকরণ। অথচ হিন্দু মৌলবাদীরা সেটা করতে শুরু করে দিয়েছে, অতএব মরীয়া কংগ্রেস নিজেকে পুরো সেদিকে ঝুঁকিয়ে দিল। মুসলিম লীগ বুদ্ধিমানের
মত সে কাজটা সেরেই ফেলেছিল। ফলতঃ সবচেয়ে সহজ রাস্তায় হাঁটল দুই দলই। আনঅফিসিয়ালি
দুই দলের গায়ে দুই ধর্মের তকমা পড়ে গেল। ভারত বা পাকিস্তান দুই দেশই জন্মলগ্ন থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেয়ে অন্য
বৃহৎ ক্ষমতাশালীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে শুরু করেছিল। পাকিস্তান আমেরিকার আর
ভারত রাশিয়ার। অথচ প্রায় সমসাময়িক স্বাধীনতা লাভের পরেই চীন বা জাপান অনেক এগিয়ে
যাচ্ছিল শুধুমাত্র নিজস্ব ভাবনা আর উদ্যোগে। বৃহৎ রাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বার্থেই এই দুই নবগঠিত দেশ কে মদত দিতে শুরু করল, কারন ভৌগলিক অবস্থানের সুবাদে দুই দেশই অর্থনৈতিক ও সামরিক
দিক দিয়ে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। বড় দেশের দাদাগিরি বা স্বার্থ বজায় রাখতে যেকোনো
একটা দেশ তাদের হাতে রাখা অবশ্যম্ভাবী ছিল। আর এখানেই শুরু হল ধর্মীয় মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত। নেহরু বা জিন্নাহ্ দুজনের কেউই
আর যাইহোক মৌলবাদী ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের চারপাশে আবর্তিত মৌলবাদ ঠেকানোর কোনো
চেষ্টাই তাঁরা বা তাঁদের দল করেনি ভোটের মুখের দিকে তাকিয়ে। অশিক্ষিত, হতদরিদ্র দুদেশের মানুষগুলোকে যে শুধু ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে
এক ছাতার তলায় এনে নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার পথ প্রশস্ত হয়, তা তাঁদের দুই দলই ততদিনে বুঝে গেছিল। আর এরা ক্ষমতায় থাকলে
বৃহৎ শক্তিরও এই অঞ্চলে ছড়ি ঘোরাতে সুবিধা হয় বলে তারাও এতে হয় চোখ বুজে ছিল নয়তো
অর্থ, সরঞ্জাম দিয়ে বাড়তে সাহায্য করে
চলেছিল। সাধারণ জনতা এই কূটকথা বুঝতেই পারেনি।
পুরাকালে ভারতবর্ষের পরিধি ছিল আফগানিস্তানের কাবুল (গান্ধার প্রদেশ) থেকে
নাগপ্রদেশ (বর্তমানের অরুনাচল)। এখনকার মায়ানমার ছিল অন্য দেশ, আর উত্তরে ছিল ইলাবৃতবর্ষ (বর্তমানে তিব্বত)। এই বিশাল এলাকা
ভারতবর্ষের অন্তর্গত হলেও বিভিন্ন স্বাধীন শাসকের শাসনে থাকত। এই এলাকা থেকে মুঘল
আমলে বিচ্ছিন্ন হয়ে গান্ধার প্রদেশ হয়ে গেল পাঠান ভূমি। ইংরেজ আমলে ক্রমাগত
বিদ্রোহে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন দেশ হয়ে গেল তরাই অঞ্চল। রাজনীতির কান্ডারীরা যাই করুন না কেন, এই বিশাল ভূমিখন্ডের সাধারণ মানুষ কিন্তু এসবে মাথা ঘামাত না, সত্যি কথা বলতে তারা এত বিভেদের বৃত্তান্ত জানতোও না। রুটি
রুজির জোগাড়ে সীমান্ত অতিক্রম করা তখন অন্যায় ছিল না। ৪৭ পরবর্তী দেশগুলোতে শাসকেরা ছিল উচ্চবর্ণের এবং রীতিমতো ধনী সম্প্রদায়ভূক্ত।
এরা প্রায় সকলেই ছিল বিদেশে উচ্চশিক্ষিত। আমজনতার শিকড়ের সমস্যা সম্পর্কে এরা কেউই
খুব একটা ওয়াকিবহাল ছিল না। রাজতন্ত্র নামেই বিদায় নিয়েছিল। রাজা মন্ত্রী নবাব
উজির নাজিরের দল ক্ষমতা ভোগ করছিল নিজেদের মধ্যে গোপণ আঁতাত এবং প্রকাশ্যে
পারস্পরিক বিদ্বেষ ছড়ানোর কূট খেলা খেলে। ভারতে নেহরু আর পাকিস্তানে জিন্নাহ্ র নরম নীতির কাল ফুরিয়ে এল খুব দ্রুত।
পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব মুখে আলোচনায় বসার কথা বললেও কার্যত উগ্র আক্রমণ করে
স্ব স্ব দেশে নিজের জনপ্রিয়তা বজায় রাখা বা বাড়িয়ে মূলতঃ ভোট বৈতরণী পেরনোর চেষ্টা
করতে শুরু করেছিল।
এই সহজ রাস্তার সন্ধান তারা পেয়েছিল ৪৬ - ৪৭ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েই।
নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে এতে ইন্ধন যুগিয়ে ছিল অপসৃয়মান ইংরেজ
শাসক। এদিকে দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসনের ছায়ায় থাকতে থাকতে ঔপনিবেশিক শাসকের সমস্ত
খারাপ ধ্যানধারণা মজ্জায় মজ্জায় ঢুকেছিল ওই উঁচুতলার শাসকদের মধ্যেও। দুই স্বতন্ত্র দেশ ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের আলাদা বৃত্ত গড়ে নিল। অথচ একটু
চেষ্টা করলেই বিভাজনের কষ্ট ভুলে সৌহার্দ্য বাড়ানো যেত অনায়াসে। ভারতে বাড়ছিল হিন্দু মৌলবাদ। আর পাকিস্তানকে ততদিনে গ্রাস করতে শুরু করেছে
অন্ধ মৌলবাদ। প্রাদেশিকতায় আচ্ছন্ন পাকিস্তানের উচ্চসম্প্রদায় ভারত থেকে আসা
উদবাস্তুদের গায়ে ছাপ মেরে তাদের করে দিল স্বতন্ত্র দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক
মোহাজির। সিন্ধপ্রদেশের বালুচিস্তান অবহেলিত রয়ে গেল। আর পূর্ব পাকিস্তান হল
উপনিবেশ। ভারতেও সর্বাধিক গুরুত্ব পেল উত্তর ও পশ্চিমের প্রদেশগুলো। উত্তর পূর্বের
প্রদেশগুলোর জন্য বরাদ্দ হল চরম অবহেলা। বঞ্চনা আনলো চরম দারিদ্র্য, দারিদ্র্য
আনলো ক্ষোভ। ক্ষুব্ধ প্রজন্ম আবেদন নিবেদনের রাস্তা ছেড়ে হাতে তুলে নিল অস্ত্র।
অশিক্ষিত এইসব বিদ্রোহীরা খুব সহজেই ধর্মের নামে মিথ্যা প্রচার করা ক্ষমতালোভীদের
খপ্পরে পড়ে গেল। দুই দেশেই প্রথম দিকে মৌলবাদকে মদত দিয়েছিল শাসকগোষ্ঠী। পাকিস্তানের প্রয়োজন
ছিল উপনিবেশ পূর্বঅংশকে তাঁবে রাখা, আর
এপারে ভোটের রাজনীতি। ফলে উত্তর বা পশ্চিমের পাক অঞ্চলে বিষবৃক্ষ হয়ে বাড়ছিল
উগ্রবাদ। ভারতের পূর্বাঞ্চলে। নিরীহ বাঙালি বহুদিন চুপ করেই ছিল। আগেই বলেছি, ভাষাআন্দোলনের মত কিছু অরাজনৈতিক ক্ষোভ ছাড়া তারা মোটামুটি মেনেই নিয়েছিল
বঞ্চনার ইতিবৃত্ত। তলেতলে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল কিন্তু বিস্ফোরণের স্তরে পৌঁছে
যায়নি।
সেই ৪৭ এ অনেক স্বপ্ন দেখেছিল মানুষ। ভেবেছিল ইংরেজ গেলে স্বর্গরাজ্য হবে।
প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা ছুটেছিল। মানুষকে বোঝানো হয়েছিল স্বাধীনতা মানেই দুর্নীতির
অবসান, স্বাধীনতা মানেই দারিদ্র্য
মুক্তি। অথচ বাস্তবে দেখা গেল, ইংরেজ
আমলে তাদের চাটুকারবৃত্তি করে যারা রীতিমতো পরাক্রমশালী আর ধনশালী হয়ে উঠেছিল, তারাই মাছির মত শাসন মধুর চারপাশে ভীড় জমালো। আর আশ্চর্যজনক
ভাবে তারাই ক্ষমতার চাবিকাঠি পেতে শুরু করল। এতে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের আখেরে লাভ হলেও দ্রুত বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে শুরু করল
শাসক দলগুলো। একের পর এক দুর্নীতির ছবি ফাঁস হয়ে যাচ্ছিল। এপারে জীপ কেলেংকারীর
দায়ে পদত্যাগ করলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণমেনন। বিশ্বাস হারিয়ে মানুষ খুঁজতে
লাগলো বিকল্প। প্রশাসনিক স্তর ক্রমশঃ আমলা নির্ভর হয়ে উঠলো। আর যেহেতু শীর্ষ আমলারা প্রায়
সকলেই সমাজের উচ্চশ্রেণীর তাই স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছিল তাদেরই। মধ্যবিত্ত উচ্চের
পদলেহন করে উপরে ওঠার মসৃণ চেষ্টা একমনে করছিল। আর নিম্ন মধ্যবিত্ত, দরিদ্র আর দরিদ্রেতর অসহনীয় যন্ত্রণায় দিনাতিপাত করার
ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই ছোটোখাটো ইস্যু থেকে জ্বলে উঠছিল আগুন। দাবানলের শক্তি কব্জা করে
ছড়িয়ে পড়ছিল। অভুক্ত মানুষ সামিল হচ্ছিল তেভাগা আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, এক
পয়সার ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলনে।
এর মধ্যেই নরমপন্থী কংগ্রেসের দিক থেকে মানুষ ঝুঁকে পড়ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত
মেরুর দলগুলোর দিকে। এদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি বেড়ে উঠছিল তরতর করে। নীচুতলার
সমাজ থেকে উঠে আসা কিছু যুবক যুবতী সমাজ পাল্টে বিভেদ অবসানের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল।
অন্যদিকে বিষগাছের মত সংগোপনে ছড়াচ্ছিল ধর্মের নামে বেসাতি করা মৌলবাদের শিকড়। একটা সময় এল, যখন আম
মানুষ কংগ্রেসের নামই শুনতে চাইত না। তবুও ভিভিআইপিদের বিভিন্ন দেবস্থানে ভোট নদী
পার হওয়ার জন্য মাথা ঠোকার ছবি ফলাও করে খবরের কাগজে ছাপা হলেই সবাই হুমড়ি খেয়ে
দেখত, কারন ভেতরে ছিল আজন্মলালিত
হাজার কুসংস্কার। আর দুর্নীতির দুর্গন্ধ আড়াল করতে নেতারাও বেশী করে প্রচারের
শিরোনামে থাকার জন্য এরকম ছবির পোজ দিতে লাগলো। মজার ব্যাপার হলো, চরম
দক্ষিণপন্থার মৌলবাদকে প্রতিরোধ করতে পারত যে বামপন্থী কমিউনিস্ট দল, তারাই জন্মলগ্ন থেকেই অদ্ভুত মতাদর্শগত দ্বন্দ্বে সর্বদাই
লিপ্ত থাকত, আর কিছু সময় অন্তরই টুকরো হতে
থাকত। নরম কমিউনিস্ট, মধ্যপন্থী
কমিউনিস্ট, চরমপন্থী কমিউনিস্ট। আবার এক
জাতীয় মতাদর্শেও বহু আলাদা আলাদা আণুবীক্ষণিক দল। অথচ, ধর্মীয় ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দলগুলো টুকরো হওয়া তো দূরের কথা বিভিন্ন শাখা প্রশাখা
ছড়িয়ে বেড়েই চলছিল। এর আরেক কারন হলো, মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও, বহু বামপন্থী দলও সেই ভোটবাদী হয়ে ধর্মীয় ওড়নায় মাঝেমধ্যে মাথা ঢাকতে শুরু
করেছিল। মানুষ এটাও ভালোভাবে মেনে নেয়নি। ফলতঃ বাড়বাড়ন্ত মৌলবাদের। ওপারের দেশ পাকিস্তানের অবস্থা প্রায় কাছাকাছি হয়েও স্বতন্ত্র কারনে বিভাজিত
হচ্ছিল।
সীমানার ওপারে বিভাজনের সমস্যা বুঝতে আরোও পিছিয়ে যেতে হয়। পৃথিবীর প্রথম ধর্ম
ভিত্তিক দ্বেষ এবং তার আধারে যুদ্ধ ছিল ক্রুশেড। খ্রীস্টান ও ইসলাম ধর্মের এই
বিবাদও আধারিত ছিল সাম্রাজ্য কেন্দ্রিক মূলতঃ ভূমি দখলের লড়াই। আসলে তখন ওই জাতীয়
বিদ্বেষ ছড়িয়ে যুদ্ধে পরস্পর বিবাদমান প্রতিবেশী দেশগুলোকে একত্রিত করে মুসলমান
শাসকদের সাম্রাজ্য দখলের ফন্দির হোতা ছিল ইউরোপ। ধর্মীয় জিগির তুলে কার্যসিদ্ধির
চেষ্টা সেই শুরু।চারশো বছর অতিক্রান্ত তবু সেই অপচেষ্টা সমানে অব্যাহত। ইউরোপের সাম্রাজ্য সূর্য
অস্তমিত হলে আসরে নামলো আমেরিকা। পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বহাল রাখার
জন্য তারা যেকোনো কুকাজ করতে পিছপা হলো না। ধর্মীয় জিগির তুলে হোক কিম্বা
সুশিক্ষিতের ছদ্মবেশে হোক দুনিয়ায় তাদের থাবা কায়েম হচ্ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তর সময়ে পরমানু শক্তিধর আমেরিকা নিজের স্বার্থে বিভিন্ন
দেশে নিজের প্রতিনিধি বসানোর চেষ্টা করছিল। ফলস্বরূপ তেলসমৃদ্ধ মধ্য এশিয়া আর
দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে দ্রুত বিভিন্ন উপায়ে শাসক পরিবর্তন ঘটছিল। আগেই বলেছি
ভারতীয় উপমহাদেশ সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এর চতুর্দিকে
শক্তির আকর এর খনি। তাই ইরান, ইরাক, তুরস্ক, সৌদি
আরব, লেবানন, আরব আমীরশাহী, ইজরায়েল
সমেত মধ্য এশিয়া করায়ত্ত করার পরেও তাদের দরকার ছিল উপমহাদেশের মালিকানা। একদিকে
রাশিয়া অন্যদিকে চীন হয়ে উঠছিল প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি।
ভারত নিজেকে জোট নিরপেক্ষ ঘোষণা করেও রাশিয়ার মিত্রজোটে সামিল হয়ে গেল। অতএব
পাকিস্তান কে যেন তেন উপায়ে নিজের দিকে টানতেই তার আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে
লাগলো আমেরিকা। সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক সবরকম সাহায্য অবাধে আসতে লাগলো। মধ্য এশিয়ায়
অবাধ্যদের শায়েস্তা আর রাশিয়াকে সহবত শেখানোর জন্য তৈরী হল ফ্রাঙ্কেস্টাইন সাদ্দাম
হোসেন, বিন লাদেন ইত্যাদি এবং তাদের
সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী। পাকিস্তানেও গণতন্ত্র ভন্ডুল করে নিজের জোহুজুর কে বসানোর
জন্যই এভাবেই সাদ্দাম বা লাদেন যুগের কয়েক দশক আগেই হয়েছিল আমেরিকার প্রচ্ছন্ন
মদতে সেনা অভ্যুত্থান। জিন্নাহ্ যুগ যে পাকিস্তানের স্বর্ণযুগ ছিল, তা বলব না। কিন্তু এই সময়ে অন্তত সেই দেশের নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক ধর্মীয়
শাখার বিবাদ ছিলনা। ছিল গণতন্ত্র। ছিলনা আমেরিকা বা কোনো বৃহৎ শক্তির
চাটুকারবৃত্তি। উচ্চশিক্ষিত এই মানুষটির সম্পর্কে বিরোধী মৌলবাদীরা যাই প্রচার
করুক, কিম্বা শাসক হিসেবে তাঁর সাফল্য
অসাফল্যের যতই চুলচেরা বিচার হোক, মানুষ
হিসেবে জিন্নাহ্ সাহেব ছিলেন সাচ্চা। নরমপন্থী চিহ্নিত করে জিন্নাহ্ কে গান্ধীর
মতোই ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে ক্ষমতাহীন করার কাজ তলেতলে শুরু হয়ে গেছিল তাঁর
জীবিতকালেই। জিন্নাহ্ শাসনের অন্তকেই ধরা যেতে পারে উপমহাদেশের কালো অধ্যায়ের সূচনা।
জেনারেল আইয়ুবের সময় থেকেই পারস্পরিক দ্বেষে বিভাজিত হতে থাকল প্রাচীন ঐতিহ্যের
সুসভ্য সমাজ।
পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী জুটি ইস্কান্দার মির্জা ও
লিয়াকত আলি খানের শাসনকাল ছিল গণতান্ত্রিক। যদিও রাষ্ট্রের ঘোষিত নাম ছিল ইসলামিক
স্টেট অব পাকিস্তান। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত এক অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে
গণতন্ত্রকে যেতে হয়েছিল। এই সময়ে ছয় জন প্রধানমন্ত্রী পদ পেয়েছেন এবং দুর্ভাগ্যজনক
ভাবে অপসৃত হয়েছেন। গণতন্ত্রের এই দুরবস্থা সৃষ্টির জন্য আপাতদৃষ্টিতে সেখানকার ভঙ্গুর শাসনকাঠামো
কে দায়ী করা হলেও আসলে এর পেছনে ছিল আমেরিকার আগ্রাসনের ইচ্ছা। পাকিস্তানে
গণতন্ত্র কায়েম থাকলে সেখানকার সিস্টেম কে দিয়ে নিজের স্বার্থে কাজ করানো সম্ভব নয়
জেনেই ১৯৫৮ তে জেনারেল আইয়ুব খান কে দিয়ে ক্যু ঘটিয়ে শাসনযন্ত্র দখল করানো হলো।
কিন্তু মিলিটারি স্বৈরশাসনের ওপরে ভরসা রাখলেও সেখানে মৌলবাদকে কাজে লাগানোর
প্রয়োজন তখনো পড়েনি। ধর্মপালন সব দেশেই সাধারণ মানুষের এক অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের
মধ্যেই পড়ে এই ধারণা সেই প্রাচীন কাল থেকেই মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। কিন্তু
ধর্মপ্রচারকরা সব ধর্মেই কখনো হানাহানির কথা বলেননি। সর্বদাই শান্তির কথা, পবিত্রতার কথা, সৌহার্দ্যের কথা বলেছেন। অথচ সেই মহাপুরুষদের বাণী বিকৃত করে একদল কুচক্রী সেই
সময়েই সক্রিয় হচ্ছিল ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাষ্ট্র তখনো তাদের কাজে
লাগায়নি।
আইয়ুবের দেখানো রাস্তা ধরেই ক্ষমতায় এলেন ইয়াহিয়া খান - জুলফিকার আলি ভুট্টো
জুটি। আর ক্ষমতায় এসেই উপনিবেশ পূর্বের ওপরে শোষনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন তাঁরা।
এদিকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে প্রতিবাদের সামনে সংসদ নির্বাচনের
সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু চালে একটু ভুল হয়ে গেল।
আয়তন অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের সাংসদ সংখ্যা যে নীতিনির্ধারক হয়ে উঠতে পারে
এই গণনা সম্ভবত স্বৈরশাসকরা করেন নি। দেশের দুই অঞ্চলেই তখন পাকিস্তান মুসলিম
লীগের বিরুদ্ধে কুশাসনের জন্য জমেছে ব্যাপক ক্ষোভ। তরতর করে বাড়ছে আওয়ামী লিগের
জনপ্রিয়তা। মুসলিম লীগের বিরোধী সব দলই তখন গ্রহণযোগ্য। আর এই অগ্নিগর্ভ
পরিস্থিতির মধ্যেই হলো নির্বাচন। হরেকরকম দুর্নীতির আশ্রয় নিলেও শেষরক্ষা হলোনা। ক্ষমতা হস্তান্তর অবশ্যম্ভাবী
জেনে সক্রিয় হয়ে উঠলো গণতন্ত্র বিরোধী সবকটি অশুভ শক্তি। যেনতেনপ্রকারে নির্বাচনে
বিপুলসংখ্যক সাংসদপদ বিজয়ী আওয়ামী লিগ এবং বিরোধী জোটকে ক্ষমতায় আসা আটকাতে তড়িঘড়ি
কারারুদ্ধ করা হলো শেখ মুজিবর রহমান সহ প্রথম সারির নেতাদের। আলোচনার সব প্রয়াস
ভেস্তে দেওয়া হলো ইচ্ছাকৃত ভাবে। পূর্বের উপনিবেশে পাকিস্তানের যেসব এজেন্সি তাদের
স্বার্থরক্ষায় নিযুক্ত ছিলো, যেমন
আলবদর, রাজাকার ইত্যাদি এই সংগঠনগুলোর
শক্তিবর্ধন করে দেশব্যাপী বিক্ষোভ প্রতিরোধের কাজে সামিল করা হল। আর নামানো হল
সেনাবাহিনী।
এদিকে ভারত রাষ্ট্রে তখন রাজনৈতিক ঝড়ের আসন্ন পূর্বাভাস। স্বাধীনতার পরে যখন
একেএকে স্বপ্ন ঝরে পড়তে শুরু করলো স্বভাবতই মানুষ বিমুখ হতে শুরু করলো শাসকদের
থেকে। বহু প্রতিশ্রুতি দেখা গেল শুধুই মিথ্যাচার। ল্যাম্পপোষ্টে একজনও মজুতদারকে ঝোলানো হলো না, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস হাতছাড়া হতে শুরু হলো, সম্পদ জমতে শুরু করলো চরম ধনীদের সিন্দুকে। সুভষের মতো নিবেদিতপ্রাণ বিপ্লবীকে
দেশে ফিরলে ইংরেজের হাতে তুলে দেওয়ার ঘৃণ্য মুচলেকা দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে এসে গেল।
অপুষ্টি, দারিদ্র্য, অশিক্ষা বাড়তে লাগলো হু হু করে। ষাটের দশকে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত ঘা মারলো দু দুখানা যুদ্ধ। পাকিস্তানের
সঙ্গে জিতলেও চীনের কাছে হেরে ভারতখন্ড তাদের হাতে তুলে দিয়ে মাথা নীচু করে পিছিয়ে
আসতে হলো। যুদ্ধ পরবর্তী যাপনচিত্র হয়ে উঠলো ক্রমশঃ ঘন কালো।
মারা গেলেন দুজন খ্যাতনামা প্রধানমন্ত্রী। জওহরলাল নেহরু এবং লালবাহাদুর
শাস্ত্রী। কংগ্রেসের মধ্যে ক্ষমতা দখলের উদগ্র লোভ আবার প্রকাশ্যে এসে গেল।
দিল্লীর মসনদ দখলের চেষ্টায় সব দুষ্কর্ম বৈধতা পাচ্ছিল। সমস্ত বাধা সরিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের পিছু হটিয়ে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতা দখল
করলেও পরিস্থিতির বিশেষ পরিবর্তন না হয়ে আরো অধগামী হতে থাকলো। ঠিক এই সময়েই পরপর দুবার ভাগ হয়ে গেল কমিউনিস্ট পার্টি শুধুমাত্র আদর্শগত
বিরোধের মাশুল দিয়ে। নরম, মধ্য ও
চরমপন্থার বিরোধের সুযোগে শাসক কংগ্রেস তাদের ধ্বংস করতে উদ্যত হলো। কিন্তু মানুষ
অপ্রত্যাশিত ভাবে মধ্যপন্থী কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে শুরু করলো।
৬৮ র বর্দ্ধমান প্লেনামে বিকল্প দলিল পেশ করে চারু মজুমদারের চরমপন্থী গোষ্ঠী হাতে
অস্ত্র তুলে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলো। অন্যরা তাদের এই কাজকে হঠকারিতা আখ্যা দিলেও
যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে গেল এই মতাদর্শ। আগুন জ্বলার আগে বাতাস
তখন থমকে দাঁড়িয়ে।
অবস্থা সামাল দিয়ে নিজের অপ্রতিহত শাসনদন্ড প্রতিষ্ঠার জন্য ইন্দিরার তখন
দরকার ছিল একটা ঝড়ের। অথচ সমগ্র উপমহাদেশ তখন কাঁপছে স্থিতিশীল সুশাসনের অভাবে। এই
প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই ৭০ এর নির্বাচন হলো পাকিস্তানে। জনরায়ে ব্যাপক হার সেখানকার
শাসকেরা মেনে না নিয়ে নির্বাচনের রায় ভন্ডুল করে পূর্ব অংশে সর্বার্থে মিলিটারি
শাসন জারীর কুচেষ্টা করে লেলিয়ে দিল আলবদর, রাজাকার ও আর্মি। তছনছ হয়ে গেল সামাজিক, অর্থনৈতিক বন্ধন। কাতারে কাতারে শরনার্থী পালিয়ে আসতে শুরু করলো এপারে। এমনিতেই এপার বাংলার অর্থনীতি ভারতের সাথে জুড়েই তখন বিপর্যস্ত। তার ওপর এত
বিপুল পরিমাণে শরনার্থীর চাপে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলো। এপারের বাঙালি কিন্তু অসীম সহ্যশক্তি নিয়ে জায়গা ছেড়ে দিতে লাগলো তাদের।
কমিউনিস্ট পার্টিরা তাদের সমর্থনে পাশে দাঁড়াল। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে শিবির
গুলোতে হানা দিতে লাগলো মহামারী, ক্ষুধা।
প্রচুর মানুষ মারা গেল এপারে এসেও। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এতদিন চুপ করে
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল, নড়েচড়ে
বসতেই হলো তাদের এবার।
ক্ষমতার নেশা সবচেয়ে মারাত্মক। যার মধ্যে এ নেশা বাসা বাঁধবে, সে মঙ্গলের পথ ছেড়ে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য
যেকোনো পথ গ্রহণ করতে একটুও দ্বিধাগ্রস্ত হবে না, হোক তা অমানবিক কিম্বা অসাংবিধানিক। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, ক্ষমতা
ধরে রাখার জন্য, নিজের অপদার্থতা ও কুশাসনের
ক্ষোভ আড়াল করার জন্য ক্ষমতার কারবারীদের প্রধান রাস্তা দুটি। যুদ্ধ এবং অকারণ
ধর্মীয় উন্মাদনার বেড়াজালে মানুষকে জড়িয়ে মত্ত করে দেওয়া।
৬০ এর দশকে বা তার আগের কুশাসনের গলিত কুষ্ঠ তখন দগদগে ঘা হয়ে ফুটে উঠছে দু
দেশেরই গায়ে। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় দানা বাঁধার চেষ্টা করছে নকশাল আন্দোলন সহ
অন্যান্য ক্ষুব্ধ আন্দোলন। অন্ধ্রপ্রদেশে কিছুদিন আগে হয়ে গেছে তেলেঙ্গানার কৃষক
বিদ্রোহ। বাংলায় তেভাগা। এই পরিস্থিতিতে ক্ষীয়মান আয়ু নিয়ে রাতারাতি বিখ্যাত হওয়ার
জন্য বেশ কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে চারু মজুমদার বেরিয়ে এলেন সিপিআইএম থেকে, গড়লেন এমএল। দলে দলে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্র
ছাত্রীরা কম বয়সের বিপ্লবী নেশায় সেই দলে যোগ দিল। অথচ একটা এত বড় রাষ্ট্রশক্তির
বিরুদ্ধে কোনো জনভিত্তি ছাড়াই যে বিপ্লব সম্ভব নয়, তা সেই দলের শীর্ষ. নেতৃত্ব বলেন নি। যে চীন কিছুদিন আগেই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে
জড়িয়েছিল, তার চেয়ারম্যান কেন আমাদের
চেয়ারম্যান হবেন তা বোঝেনি সাধারণ জনতা। অথবা চীন, চেয়ারম্যান, বুর্জোয়া, পাতিবুর্জোয়া, শ্রেনী শত্রু ইত্যাদি বহু নতুন শব্দে তখন তারা বিভ্রান্ত। শহুরে কিছু মানুষের
কথায় তারা যে বিপ্লবে সামিল হবেনা তা জলের মত পরিস্কার। অথচ সব জেনেশুনেও
নকশালবাড়ী থেকে স্ফুলিঙ্গ তৈরী হলো অসময়ে। মজার ব্যাপার ঘটাল অন্য কমিউনিস্ট দলগুলি। মুখে বিরোধিতার কথা বললেও তাদের
মতাদর্শ থেকে সরে এসে অন্য দল গড়ে তুলে আগুনচুমু খাওয়া ছেলেমেয়েগুলোর সব তথ্য তারা
তুলে দিতে শুরু করলো শাসক দলের হাতে। একদিকে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পরবর্তী অধ্যায়ের ক্ষমতা দখলের খামচা খামচি, অন্যদিকে কুশাসনের ফলে জনগনের দুর্বিষহ অবস্থা। ইন্দিরার
দলগত ভিত্তি তখনো শক্ত নয়। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে দরকার ছিল একটা গণউন্মাদনার, যাতে সাময়িক ভাবে হলেও মানুষের নজর অন্যদিকে ঘোরানো যায়।
গণ হিস্টিরিয়া। ব্যাপারটা যদি সপক্ষে ঘটে, তাহলে যেকোনো দেশের শাসকদের খুবই পছন্দের। কিন্তু বিপরীতে গেলেই তার রূপ
মারাত্মক। দেশের বৃহত্তম অংশের মানুষ কোনো কারনে কোনো ইস্যুতে অংশগ্রহণ করলে
সেখানে আর যুক্তিতর্ক বা ইস্যুর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না। সাধারণত
ক্রমক্ষীয়মান জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য বা সাদা কথায় বলা ভালো, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজের অপদার্থতা থেকে নজর ঘুরিয়ে
দেবার জন্য শাসকদল এটা করে থাকে। ১৯৬২র চীন যুদ্ধ বা ৬৫র পাকিস্তান যুদ্ধের অহমিকা তখন অস্তমিত। লালবাহাদুর
শাস্ত্রীর অকস্মাৎ মৃত্যুর পরে দিল্লীর ক্ষমতার অলিন্দে ষড়যন্ত্রের কালো ছায়া।
একপক্ষ ভাবলো নেহরুর সাদাসিধে সুন্দর মেয়েটাকে নাম কা ওয়াস্তে প্রধানমন্ত্রী করে
দেশ শাসন করবে। বাদ সাধল অন্যপক্ষ। তারা সরাসরি ক্ষমতা ভোগের সপক্ষে। ৬৬তে সরাসরি
লড়াই হয়ে গেল মোরারজী দেশাই এর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর, প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবীদারত্ব নিয়ে। দেশাইকে হারিয়ে ইন্দিরা হলেন অস্থায়ী
প্রধানমন্ত্রী।
১৯৬৭র ফেব্রুয়ারীর শেষে সাধারণ নির্বাচনে ২৮৩ আসন জিতে ইন্দিরা যখন সরাসরি
ক্ষমতায় এলেন, তখন দেশের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র
২.৪ শতাংশ। অথচ উন্নয়ণের দিকে নজর না দিয়ে নিজেরই দলের ক্ষমতালিপ্সুদের সামলাতেই
সময় চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকার সমর্থন পেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে
পাকিস্তান। তাসখন্দের বিষম চুক্তির ফলে জম্মু কাশ্মীরের বড় অংশ হাতছাড়া। তার ক্ষোভ
কাজে লাগাচ্ছে দেশের বিরোধী দলগুলো। আর্থিক উন্নয়ন থেমে থাকার জন্য দেখা দিচ্ছে
খাদ্যাভাব। বেকার সমস্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। শিল্পবিপ্লবের প্রতিশ্রুতি আকাশ
কুসুম কল্পনা। মাত্র দুবছরের মধ্যেই ইন্দিরার জনপ্রিয়তা তলানিতে। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে
একটাই দাওয়াই তখনো জানা, আর
সেটা হলো যুদ্ধ। মৌলবাদের বিষ ছড়িয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখার কৌশল যদিও ৪৬ এই জানা
গেছিল, কিন্তু সঠিক চর্চার অভাবে তার
যথাযথ উন্নতি হয়নি, অথচ
পাকিস্তান তখন এব্যাপারে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে।
এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই মেঘ না চাইতেই জল। ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেললো
উদ্বাস্তু সমস্যা। তারচেয়েও বড় উদ্বেগের কারন ছিলো, ঘরের পাশে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর এর ঘাঁটি
গাড়ার হুমকি। এটা হলে উপমহাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ভারসাম্য যে নষ্ট হয়ে যাবে তা
বুঝতে সময় লাগেনি ঝানু রাজনীতিবিদদের। ঠিক ওই অবস্থায় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের প্রহসন অন্তে মুজিব গ্রেপ্তার।
আর্মি ও হন্তারক দালালদের দাপাদাপি। আর একঝাঁক মুক্তিকামী গ্রেপ্তার এড়িয়ে পালিয়ে
এলেন এপারে। গড়লেন স্বাধীন সরকার। যুদ্ধের ঠিক আগে ইন্দিরা, উদ্বাস্তু
সমস্যা এবং উদ্ভুত রাজনৈতিক ও মানবাধিকার হত্যার পরিস্থিতি নিয়ে দরবার করলেন স্বয়ং
আমেরিকায় গিয়ে। কিন্তু হোয়াইট হাউসের কাছে তখন সুবর্ণসুযোগ উপমহাদেশ করায়ত্ত করার।
ইন্দিরাকে দেখা করার সময়ই দিলেন না তৎকালীন ইউএস প্রেসিডেন্ট। অপমানিত, ক্ষুব্ধ ইন্দিরা দেশে ফিরেই
যুদ্ধ ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।
নিজের শিকড় যদি অজানা থাকে, তাহলে
বর্তমানের সংকটের স্বরূপ বোঝা যায়না। আমজনতা এমনিতেই এতরকম সমস্যায় জর্জরিত যে
জন্মের আগের ঘটনা সম্পর্কে আগ্রহী হয়না। কিন্তু অসুখ যখন দুরারোগ্য আকার নেয়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ড জানা জরুরী হয়ে পড়ে নাহলে সঠিক চিকিৎসা
জোটে না।
ইন্দিরা গান্ধী যেদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন সে দিনটা ছিল
৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১। ঠিক তার পেছনের বছরে ১৯৭০
থেকে সমস্যার শুরু হয়েছিল, যখন
পাকিস্তানের নিম্ন পার্লামেন্ট কক্ষ মজলিস ই শুরা র ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৯ টিই জিতে
নিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লিগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে তারা যেই শাসন ক্ষমতার
দাবীদারত্ব পেশ করল, ওমনি
বেঁকে বসল হেরে যাওয়া জুলফিকার আলি ভুট্টো র নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি।
পাকিস্তানকে তারা কিছুতেই নাপাক বাঙালিদের হাতে তুলে দেবেনা।
ভাবুন একবার, ভোটে
এতদিন লড়াইয়ের সময়ে, শোষনের
সময়ে যারা নাপাক ছিল না, ক্ষমতা
হস্তান্তরিত করার পরিস্থিতি আসতেই তারা অপবিত্র অধার্মিক হয়ে গেল! আসলে, পশ্চিমীদের এছাড়া অন্য উপায় ছিলো না। গণতন্ত্রের নিয়ম মেনে
তারা পরাজিত। পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া বিশেষ গর্হিত নয় এটা শিশুও জানে।
তাহলে?
পাকিস্তান তখন নিজেই দুখানা বৃহৎ দুষ্কর্মে জড়িয়ে ছিল। প্রথম যেনতেনপ্রকারে
পুর্বকে শোষণ আর তার নানা কৃৎকৌশল, ফন্দিফিকির।
আপাত নিরীহ পূর্ব এটা জেনে গেলে বিপদ এতদিনের শাসকদের। তাই আপত্তি। আর দ্বিতীয়
আপত্তি আরোও জোরালো কারনে, যার
পেছনে আমেরিকা।
রাশিয়া সহ পেট্রোলিয়াম উৎপাদনকারী দেশগুলোকে তাঁবে আনা আমেরিকার ব্যবসায়ী
মহলের কাছে ছিল জরুরী এজেন্ডা। অথচ ক্রমাগত আরব ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্তি
সঞ্চয় করে চলেছিল রাশিয়া। ধর্মীয় ছদ্মবেশে গেরিলা বাহিনী তৈরির জন্য পাকিস্তানকে
ব্যবহার করলো উদ্বিগ্ন আমেরিকা। জঙ্গীবাদের জন্ম সেই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানেই হলো।
বার্থ সার্টিফিকেটে বাবা আমেরিকা, মা পাকিস্তান।
এখন এই হাই প্রোফাইল গোপন তথ্য পূর্ব জেনে ফেললে সব পন্ড হবে এই আশঙ্কায় গড়ালো
গভীর ষড়যন্ত্র। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্বতে সৈন্য পাঠালেন, অস্বীকার করলেন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে।
নিত্য বনধ, আইন অমান্যের মধ্যেই ২৫শে মার্চ
মাঝরাতে মুজিব কে গ্রেপ্তার করে উড়িয়ে আনা হল মূল পাকিস্তানের জেলে। ঘোষণা হল
জরুরী অবস্থা। বিপুল সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো নিরীহ জনতার ওপরে। একদল আওয়ামী লিগ নেতা
পালিয়ে এলেন ভারতে। ভারত থেকেই তাঁরা গঠন করলেন মুক্তি যোদ্ধা নিয়মিত এবং গেরিলা
বাহিনী। ত্বড়িৎ গতিতে কিছু পাক এজেন্ট ছাড়া প্রায় আপামর পূর্বীয় মানুষ এই
স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিলেন। সরকারি হিসেবে শুধু নিয়মিত যোদ্ধাই ছিলেন ১৭৬০০০।
ভারতে থেকেই গঠিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। এইসব ঘটনাক্রমে ভারত পাকিস্তানের
চক্ষুশূল হয়ে উঠলো। অন্যদিকে প্রায় ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন শরনার্থী পালিয়ে এল ভারতে। এই বিপুল
শরনার্থীর ঢল সহ্য করার ক্ষমতা তখন নড়বড়ে ভারতীয় অর্থনীতির ছিল না। স্বভাবতই ভারত
সাহায্য চাইল বিশ্বের। কিন্তু আমেরিকার চাপে একমাত্র রাশিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশ
সাহায্যে রাজী হলো না। পাক সেনা, আলবদর, রাজাকার যৌথ অত্যাচারে ও সরাসরি যুদ্ধে মারা গেল প্রায় ৩০০০০০০ বাংলাদেশী।
প্রায় ন মাস পরে অধৈর্য পাকিস্তান ভারতের সেনাঘাঁটির ওপরে হামলা চালালো। বাধ্য হয়ে
৩৬৫০০০ পাক আর্মির বিরুদ্ধে ৫০০০০০ সৈন্য নামিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করলো ভারত। ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ মাত্র তেরো দিন স্থায়ী হলো দুই
প্রতিবেশীর লড়াই, যা
গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুযায়ী পৃথিবীর হ্রস্বতম যুদ্ধ। অসংখ্য ক্ষয়ক্ষতির
পরে নতি স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তান। বাঙাল দেশে নামলো একচোখে স্বজন
হারানোর জলের ধারা, অন্যচোখে
স্বাধীনতার আনন্দের উচ্ছাস। মুজিব কে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো স্বৈরশাসক। কিন্তু
নতুন ইতিহাস সূচনার মধ্যেও রয়ে গেল ভয়ংকর দানবের জন্মের বীজ।
৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ন মাস, আর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ মাত্র ১৩ দিন। মুখে যতই লম্ফঝম্প
করুক, পাকিস্তানের সামরিক পরিকাঠামো
যথেষ্ট মজবুত ছিল না। অন্যদিকে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ ক্ষোভের বিস্ফোরণে
ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিকামীতায়। মুক্তিবাহিনীর যে দ্বিতীয় শাখা গেরিলা বাহিনী তারা
তৈরী করেছিল, তা মূলত ছিল কিশোরদের নিয়ে।
রাস্তায়, গলিতে, গ্রামের শুঁড়িপথে, পাহাড়ী
এলাকায়, জঙ্গলে পাকিস্তান আর্মিকে আচমকা
আক্রমণ করে তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি সাধণই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। আর সামনে পেছনে
আক্রমণ সামলানোর মত অভিজ্ঞতা পাকিস্তানী সেনার ছিল না। এছাড়া পাক শুষ্ক জলবায়ু তে
অভ্যস্ত পাঠান ও পাঞ্জাবীরা বঙ্গীয় জলীয় আবহাওয়া বরদাস্ত না করতে পেরে প্রায়ই
অসুস্থ হয়ে পড়ত। আর এর ওপর ছিল ভারতের বেসরকারী বিরোধিতা। ফল যুদ্ধ অচিরেই তাদের
হাতছাড়া।
৭১ এর মার্চে যখন পাক সেনা ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিম্বা অত্যাচার চালাতে শুরু করল, তখন স্বাভাবিকভাবেই ভারত প্রথমে সরকারীভাবে নাক গলায় নি। আমেরিকা হুমকি দিয়ে
রেখেছিল, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন বিষয়ে
কেউ যেন নাক না গলায়, বিদ্রোহীদের
(গণতন্ত্রের পীঠস্থান ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা ভোটে জেতাদের বিদ্রোহী আখ্যাই
দিয়েছিল।) কেউ যেন সাহায্য না করে। কিন্তু সরকারীভাবে সাহায্য না করতে পারলেও
তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ চলছিলই। এই সময়ে পাক সেনা ও তাদের সহযোগীদের অত্যাচারে হু হু
করে আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পেরিয়ে আসতে শুরু করল বিপুল পরিমাণে
শরণার্থী।
এপারের মানুষের সঙ্গে ওপারের বাঙালির আত্মীয়তা কোনোদিনই কোনো সীমানা মানেনি।
তাই সবচেয়ে বেশী বাস্তুহারা এলো আসাম আর পশ্চিমবঙ্গে। স্বাধীণতার পরবর্তী
বিপর্যস্ত আর্থিক অবস্থার প্রভাব এ বঙ্গেও পড়েছিল। বেকার সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি, শিল্পসমস্যা, ভূমিসমস্যায় এপারের বাঙালির দৈনন্দিন কাঠামো নাজেহাল। তবুও
স্বজনের ওপর অত্যাচার দেখে দুহাত বাড়িয়ে তারা ঠাই দিল ঘরহারাদের। এপারের অতিরিক্ত
জমিতে তারা বাসা বাঁধতে শুরু করল। মুজিব গ্রেপ্তারের পরে বেশ কিছু প্রথম সারির
রাজনৈতিক নেতা এপারে পালিয়ে এসেছিলেন। এখান থেকেই ঘোষিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীণ বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল কলকাতাতেই। সব জেনেও
মানবতার খাতিরে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এপারের বামপন্থী
দলগুলো তো সক্রিয় সাহায্যে নেমে পড়েছিল অসহায় সেই মানুষুগুলোর পাশে। ভারতের এই ইনডাইরেক্ট সমর্থন পাক সরকার বা তার গুরু ইয়াংকি সরকার ভালোভাবে
মেনে নেয় নি। তাই ডিসেম্বরে পাকিস্তান ভারতের সেনাঘাটিতে আক্রমণ করার পরে ভারত
যুদ্ধ ঘোষণা করলে আমেরিকা তার সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে ভারতকে শায়েস্তা করার কথা ঘোষণা
করে দিল। এই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোজা তারা আমেরিকাকে হুমকি দিল, যদি আমেরিকা উপসাগরীয় অঞ্চলে বা ভারত মহাসাগর অঞ্চলে নৌবহর
পাঠিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করে তাহলে রাশিয়াও তাই করবে এবং ফলশ্রুতিতে
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব দায়ভার আমেরিকার ওপরেই বর্তাবে। হুমকিতে কাজ হল এবং ইউএসএ
পিছিয়ে গেল। দুর্বল পাকিস্তান তেরদিনের বেশী যুদ্ধ টানতে পারল না। কিন্তু নাছোড়
আমেরিকা তখন হাতে না মারতে পেরে ভাতে মারার পরিকল্পনা করে ভারত ও সদ্য ভূমিষ্ঠ
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধের প্রাচীর তৈরী করল সহযোগী দেশদের নিয়ে। ফলত
যুদ্ধ পরবর্তী এই দুই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠল। আগে থেকেই ভারত বিভিন্ন সমস্যায় বিব্রত ছিল। তার ওপরে এই যুদ্ধ স্থায়ী প্রভাব
ফেলল। কিন্তু সদ্যগত যুদ্ধের ফল ঠিক তখনই বোঝা যায়নি। ১৯৭১ এর বিপুল ভোটে জেতা
ইন্দিরার অসম্ভব তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা এই জেতার ক্যারিশমাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭২ এর
বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন এর প্রক্রিয়া শুরু করে দিল।
১৯৭২। সমগ্র ভারতের ক্ষেত্রে এই বছরের আর কোনো প্রভাব এখন আর নেই। কিন্তু
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখনো চমকে ওঠেন এই সালের কথা মনে পড়লেই। সদ্য পাকিস্তানকে
হারিয়ে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর মনোবল তখন তুঙ্গে। আর সেই গর্বিতচারণ তারা চারিয়ে
দিচ্ছে আম জনতার মধ্যে। আসলে এই কৌশল সারা পৃথিবীর সব দেশেই রাজনৈতিক দলেরা কাজে
লাগায়। যখনই দেশের অবস্থা টলোমলো হয়, ক্ষোভ ঘনিয়ে ওঠে তখনই দুটো কৌশল কাজে লাগানো হয়। এক, জাতীয় আবেগ, দুই, খেলা। মজার ব্যাপার, এই দুই
কৌশলেই আমাদের উপমহাদেশের পেটেন্ট নেওয়া। অতীতে বারবার দেখা গেছে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলেরা ভারত জুজু, ভারতের রাজনৈতিক দলেরা পাক জুজু আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক
দলেরা ভারত জুজু বা পাক জুজুর ভয় দেখিয়ে মানুষের স্বাভাবিক ক্ষোভকে অন্যদিকে চালিত
করে তাৎক্ষণিক ভোলানোর চেষ্টা করেন। আর এই জুজুর ভয়ের ওপরের মোড়কটাই হলো ধর্মীয়
বিকৃত ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভুত ভয়। অশিক্ষিত নিরক্ষর মানুষ বিদেশী ভাষায় লিখিত
ধর্মগ্রন্থের সদভাবটুকু আত্মস্থ করতে পারেন না না জানার ফলে, আর সেখানেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধি ও ক্ষমতা দখলের জন্য
চলে কিছু অসৎ মানুষের বিকৃত ব্যাখ্যা। সম্প্রতি খেলার মত নির্দোষ আমোদেও এই
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থর চেষ্টা লক্ষিত হয়েছে। কিন্তু এই তিনদেশের সাধারণ
মানুষ ধান্দাবাজ নন। তারা সহজ, সরল, অমায়িক, অতিথিবৎসল।
এক দেশের মানুষ নয় দেশের মানুষকে কাছে পেলে বুকে জড়িয়ে ধরেন আত্মীয়স্বভাবে। তাদের
মধ্যে বিদ্বেষের লেশমাত্রও পরিলক্ষিত হয়না।
৭২ এর নির্বাচন হয়েছিল সমগ্র ভারত ও বঙ্গের সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে। আগেই বলেছি সদ্য পাকিস্তান যুদ্ধ জয় হয়েছে।
ভারতের আম মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে যুদ্ধজয়ের উন্মাদনা এবং আত্মপ্রসাদ। স্বয়ং
বিরোধী দলের নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী সংসদে প্রধাণমন্ত্রী ইন্দিরাকে আখ্যা দিলেন ‘দেবী দুর্গা’। অথচ এই জনসংঘী বাজপেয়ীরই জনক দলের নাথুরাম গডসে একদিন গুলি করে হত্যা করেছিল
ইন্দিরার ধর্মপিতা মোহনদাস করমচন্দ গাঁধিকে। যুদ্ধজয়ের উন্মাদনাকে কিসুন্দর কাজে
লাগানো যায় এই ঘটনা তার উৎকৃষ্ট প্রমান।
যাইহোক,১৯৭২ এর জুলাইএর সিমলা চুক্তির
আগেই সমগ্র ভারত যখন উত্তেজনায় ফুটছে, সেই স্বর্ণসময় কাজে লাগিয়ে ইন্দিরা রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচনের ডাক দিলেন।
আজকের মত তখনকার নির্বাচন কমিশন এত স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত না। তখন কেন্দ্রের
শাসকের অঙ্গুলিহেলনেই তারা কাজ করতে বাধ্য হত। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগালেন
ইন্দিরা। ইতিমধ্যেই সারা ভারতে মাথাচাড়া দিয়েছে গরীবি, বেকারী, মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারী, ভূমির
অনৈতিক বন্টন প্রমুখ সমস্যা। আর এর বিরুদ্ধে পূর্ব ভারতে দানা বেঁধেছে যে ক্ষোভ তা
অচিরেই সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা। সব মিলে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে খানিক অনুকূল
করার প্রয়াস।
১৯৬৭ তে যখন ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বর্দ্ধমান প্লেনামে পাল্টা
দলিল পেশ হয়েছিল, তখনই
ঘনীভূত হয়েছিল আশংকা। মাত্র কয়েক বছর আগে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে বেরিয়ে আসা নেতারা
এই ঔদ্ধত্য সহ্য করতে পারেন নি। যে তরুনেরা এই পাল্টা দলিল পেশ করে বলতে চেয়েছিল
যে তখনকার আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ধনীদের করায়ত্ত, তাদের কথা না শুনেই, তাদের পার্টি থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। পরিণামে চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতালের নেতৃত্বে তরুনেরা ভুল পথে পা বাড়াল। আগুন জ্বললো পশ্চিমবঙ্গ
সহ পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব ভারতে। বাংলার উত্তরভাগের এক গ্রাম নক্সালবাড়ীতে সামান্য
এক জমির লড়াই ছড়িয়ে পড়ল সারা প্রদেশে। ১৯৬৯ সাল, সিপিআই-এম তখন যুক্তফ্রন্টের ক্ষমতায়, সে সময়েই কেন্দ্রে জেএফআর জেকব এর নেতৃত্বে পরিকল্পনা হল “Operation Steeplechase” এর। নীল নক্সা অনুযায়ী সেনাকেই কাজে লাগানোর সবকিছু ঠিকঠাক।
যদিও তখনও তরুনদের আন্দোলন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছয়নি। কিন্তু ’৬৯ এ হিড়িক পড়ে গেল বহু সাংবিধানিক দলত্যাগের। নক্সালবাড়ীর
নামে সাধারণ মানুষ পুরো দলটার নামই দিয়ে ফেললো ‘নক্সাল’।
নিরপেক্ষ বিচারে দেখলে বোঝা যায়, নক্সালাইট মুভমেন্ট প্রতিষ্ঠিতই ছিল ভুল ভিত্তির ওপরে। মাওজেদং এর চীনের
বিপ্লব কে অন্ধভাবে অনুসরণ, মাও কে
নিজেদের চেয়ারম্যান ঘোষণা, চীনের
তত্ব এই জলা জংলা ভূমিতে ইমপ্লিন্টের চেষ্টা, বন্দুকের নলই শক্তির উৎস বলার মত ভ্রান্ত ধারণা পোষণ, সাধারণের শ্রদ্ধার পাত্র মনীষীদের মূর্তি ভাঙা, স্কুল কলেজে ভাঙচুর এবং সর্বোপরি অতি সাধারণ মানুষ, যারা রাষ্ট্রশক্তির নীচু তলায় কর্মরত, যেমন- নীচুতলার পুলিশ, অধ্যাপক, রাজনৈতিক কর্মীদের অকারণ হত্যা তাদের মানুষ থেকে ক্রমাগতই
বিচ্ছিন্ন করছিল। ভারতের মত বিশাল দেশের সংগঠিত রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে তাদের লড়াই
যে সম্পূর্ণ অসংগঠিত সম্ভবত তারা তা বুঝতে পারেনি বা বুঝতে চায়নি। অথচ ঐ নেতাদের
তত্বে আকৃষ্ট হয়ে সেই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে হাজার হাজার মেধাবী ছাত্র ছাত্রী, যাঁদের বড় অংশই শহরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন ছিলেন। একটা ভুল তত্ত্বের ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে নক্সালাইট মুভমেন্ট শুধুমাত্র একটা
আলোড়নের সৃষ্টি করা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করতে পারল না। দিশাহীনভাবে তারা শুধু
হত্যার রাজনীতিই করে গেল, আর এতে
সুবিধা হয়ে গেল রাষ্ট্রযন্ত্রের। পরবর্তীতেও দেখা গেছে নক্সালোত্তর মাওয়িস্টরা সেই
একই হত্যার রাজনীতির কুম্ভপাকেই আটকে থাকল। অথচ এই বৃহৎ দেশের মূল যে সমস্যাগুলো-
শোষণ, দুর্নীতি, স্বজন পোষণ, সন্ত্রাসের
মাধ্যমে ক্ষমতা দখল, মূল্যবৃদ্ধির
ফলে আমজনতার নাভিশ্বাস সবই সেই একই জায়গায় থেকে গেল। এমনকি টিকে থাকার রাজনীতি
করতে গিয়ে মাওবাদীরা সেই দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেই হাত মেলালো কোথাও
কোথাও। তাদেরও নেতৃত্বের মধ্যে ঢুকে গেল বিলাসিতা, দুর্নীতির বিষ। মাত্র কয়েকটা রাজ্যে স্রেফ তোলাবাজ হয়েই থাকতে থাকতে আস্তে
আস্তে নিঃশেষতারা। হতে থাকল
৭২ এ এই টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যেই অন্য রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে
পশ্চিমবঙ্গেরও নির্বাচন ঘোষিত হল। অথচ অন্য রাজ্যে যখন পাকিস্তানকে হারানোর
আনন্দরেশ, এখানে তখন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার
ঢেউ। কেন্দ্রে তখন ইন্দিরার বিশ্বস্ততম মানুষটি এক বাঙালি, সিদ্ধার্থ শংকর রায়। পশ্চিমবঙ্গ শাসনের জন্য তাঁকেই পাঠালেন ইন্দিরা। সেই
নির্বাচন স্তম্ভিত করে দিল তাবৎ গণতন্ত্রের প্রবক্তাদের। ভারতও প্রথম দেখল, শুধুমাত্র ক্ষমতা দখলের জন্য সর্বাত্মক ফ্যাসিস্ট শক্তির
প্রয়োগ। প্রচার থেকে ফলঘোষণা পর্যন্ত বিরোধী দলগুলিকে মাথা তুলতে দেওয়া হল না।
সামান্যতম বিরোধিতার আভাষ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছিল প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের
লুম্পেনরা। নিগ্রহ, হত্যার
বন্যা বয়ে গেল রাজ্য জুড়ে। নির্বাচনের দিন অবাধে বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, বিরোধীদের শারীরিক নিগ্রহ চললো।
অবধারিত ভাবেই ফল গেল কংগ্রেসের পক্ষে। মুখ্যমন্ত্রী হলেন সেই সিদ্ধার্থ। ইতিহাসের
পাতায় বাহাত্তর এক জ্বলজ্বলে কালো দাগ হয়ে রয়ে গেল।
বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর, এই তিন
বছর ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকল দমন পীড়ন। ব্যারিস্টার বাবার সন্তান নিজেও প্রখ্যাত
ব্যারিস্টার এই নবাগত সদ্য প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন
শরণার্থী সমস্যা সহ অন্যান্য মূল সমস্যা মোকাবিলার চেয়ে মন দিলেন বিরোধী দমনে। আর
বিরোধী স্বর বন্ধ করার এই মহতী প্রচেষ্টায় প্রাণ দিলেন হাজার হাজার নিরীহ মানুষ।
শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, নাট্যকার, অভিনেতা, কবি সমেত সাধারণ বাড়ীর অতি সাধারণ ছেলেমেয়েরা কেউই রেহাই
পেলোনা শাসনদন্ডের প্রহার থেকে। এপার বঙ্গব্যাপী ছেয়ে গেল আতংকের কালো অন্ধকার।
ঠিক এই সময়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক ঐতিহাসিক রায় বদলে দিল গণতন্ত্রের গতিপথ।
১২ই জুন ১৯৭৫ জনৈক রাজনারায়নের দাখিলিকৃত মামলার রায়ে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ঘোষণা করল, ইন্দিরা অবৈধভাবে দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে ১৯৭১ এর
নির্বাচনে রায়বেরিলী থেকে জয়লাভ করেছিলেন। তাই শাস্তিস্বরূপ তাঁর সংসদীয় সদস্যপদ
বাতিল সহ ছবছর নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ হল। ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল কংগ্রেসে।
কারন তখনকার কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়ার “ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া” বিশ্বাস
করতে শুরু করেছিল দলের আপামর সদস্য। ত্বড়িৎ ডাক পড়ল আইনজ্ঞ সিদ্ধার্থর। আইনের নথি
ঘেঁটে সিদ্ধার্থ যে নিদান দিলেন, ইন্দিরা
বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে তার প্রয়োগ করলেন। ভারতবর্ষ ডুবে গেল গণতন্ত্রের গভীর
লজ্জার অধ্যায়ে- জারী হল জরুরী অবস্থা; এমারজেন্সি।
ভূমি ভাগ হয় না। মানুষই তাঁকে বিভিন্ন দাগ টেনে বিভক্ত করে নিজের কুমতলব
চরিতার্থের উদ্দেশ্যে। কিন্তু চরিত্রগত মিল থেকে যায় সব টুকরোর মধ্যেই। ভারত যখন
অন্ধকারে ডুবছে, তখন তার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন
হওয়া অন্যদেশও তলিয়ে যেতে বসেছে সেই একই কালোয়। বলা যায় প্রায় একই সময়ে ভারতে
ইন্দিরা, পাকিস্তানে জুলফিকার আলি ভুট্টো
এবং বাংলাদেশে মুজিবর রহমান তাঁদের রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরু করেন। ভাগ্যের পরিহাস
তাঁদের তিনজনকেই মিলিয়ে দিয়েছে অস্বাভাবিক অকাল প্রয়াণে। আশ্চর্যজনক ভাবে তিনজনকেই
হত্যার পিছনে কারন হিসেবে কাজ করেছে ক্ষমতা দখলের অত্যাধিক লোভ।
যখন থেকে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরে মিলিটারী স্বৈরশাসন আমদানি হলো, তখনই উপমহাদেশের স্থায়ী অস্থিরতার ভবিষ্যত জন্ম নিয়েছিল।
আয়ুব খান জমানা শেষে ইয়াহিয়া খান জমানা এবং বাংলাদেশের জন্মকে কাজে লাগিয়ে সেদেশে
তৎপর হয়ে উঠলো কট্টরপন্থী ধর্মীয় দল জামাত-ই-ইসলামী। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ ভেঙে
বেরিয়ে আসার আসল কারন চিহ্নিত করার কোনো চেষ্টাই দেখা গেলনা সেখানে। পাকিস্তানী
শাসকদের অকর্মণ্যতা, শোষণ, ঔপনিবেশিক আচরণ ও জবরদস্তি ইত্যাকার মূল কারনের অভিঘাত আড়াল
করে দায় চাপানো হল, ইসলামিক
পথ থেকে বিচ্যুতি এবং ইয়াহিয়া খানের মদ্যপানে আসক্তি। অথচ এই দুই কারনই যে
সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও হাস্যকর তা বোঝার ক্ষমতা সে দেশের সাধারণ মানুষের ছিলনা
অশিক্ষার জন্য।
১৯৭১ এ যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয়ের পরে প্রধাণমন্ত্রীর আসনে বসলেন জুলফিকার আলি
ভুট্টো। ক্ষমতায় বসেই তিনি শ্লোগান তুললেন, “Islam is our faith, democracy is our polity, socialism is our economy” । যদি সত্যিই এই নীতি কার্যকর করা যেত তাহলে হয়তো শু পাকিস্তান নয়, সমগ্র উপমহাদেশ আজকের এই ভয়ংকর অস্থিরতার হাত থেকে রেহাই
পেয়ে সত্যিকারের উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারত। কিন্তু ভুট্টোর এই প্রতিশ্রুতির
অন্তরালে ইতিহাসের অট্টহাসি সেদিন শোনা যায়নি।
আগেই বলা বাংলাদেশ বিভক্তিকরনের দায় হিসেবে দুই অযৌক্তিক কারন কিন্তু রীতিমত
পাকা ভিত গড়ে তুললো মৌলবাদের। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে
মান্যতা পেতে শুরু করলো ঐ তত্ত্ব। বিদ্রোহ ছড়িয়ে গেল এমনকি সেনার মধ্যেও। ১৯৬৫ র
পরে সমাজের নিম্নস্তর থেকে নিযুক্ত কিছু জুনিয়ার অফিসার এই ইস্যুতে প্রকাশ্য
বিদ্রোহ ঘোষণা করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করল। পর্দার আড়ালে সেই প্রথম জামাতের
ক্ষমতা দখলের প্রয়াস। কিন্তু তখনো সেনার সর্বস্তরে জামাতের সেরকম প্রভাব না থাকায়
অচিরেই বিদ্রোহ দমিত হলো।
ক্ষমতা দখলের মরীয়া প্রচেষ্টায় জামাত এবার অন্য চাল দিল। সেনাবাহিনীর
উচ্চস্তরে তারা তাদের উগ্র ধর্মীয় মতবাদ ছড়িয়ে প্রভাব বিস্তার করায় মন দিলো আর
সফলও হলো। এই পর্বে জামাতের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন স্বঘোষিত উগ্র ধর্মগুরু মউদুদি।
তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দাবার প্রথম চালেই তিনি মাত করে দিলেন মধ্যপন্থার ভুট্টোকে।
ক্ষমতার নেশা ধরিয়ে নিজের দিকে টেনে আনতে সমর্থ হলেন সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তা
জেনারেল মুহম্মদ জিয়া উল হক কে। তলে তলে সেনাবাহিনীর ধর্মীয়করন শুরু করে দিলেন
জিয়া। ১৯৭৬ এর জুলাইয়ে সেনার এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় জয়ীরা পুরস্কার পেলেন মউদুদির
লেখা প্রচার পুস্তিকা তাফহিমু-ই-কুরান। শুধু তাই নয়, সেই অন্ধ প্রচার পুস্তিকা, যা
কিনা কোরানের মহতী আদর্শ থেকে যোজন দূরে এবং শুধুমাত্র যেনতেন উপায়ে ক্ষমতা দখলের
উদ্দেশ্যে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই লিখিত, সুপারিশ করা হলো সেনার ক্যাপ্টেন ও মেজর পদের প্রোমোশনের পরীক্ষার পাঠ্যপুস্তক
হিসাবে। ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর পরিবর্তে পাকসেনা পরিবর্তিত হতে থাকলো অন্ধ ধর্মীয় হানাদলে।
এবার চোখ ফেরানো যাক আরো একবার পূর্বে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরেই বাংলাদেশের
চেহারা ছিল ধর্ষিতা জননীর মতো। আমেরিকার টাইম ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ বুলালে দেখতে
পাই, Time Magazine USA 17-January -1972 : "In the aftermath of the
Pakistani army’s rampage last March, a special team of inspectors from the
World Bank observed that some cities looked “like the morning after a nuclear
at tack.” Since then, the destruction has only been magnified. An estimated
6,000,000 homes have been destroyed, and nearly 1,400,000 farm families have
been left without tools or animals to work their lands. Transportation and
communications systems are totally disrupted. Roads are damaged, bridges out
and inland waterways blocked.The rape of the country continued right up until
the Pakistani army surrendered a month ago. In the last days of the war, West
Pakistani-owned businesses—which included nearly every commercial enterprise in
the country—remitted virtually all their funds to the West. Pakistan
International Airlines left exactly 117 rupees ($16) in its account at the port
city of Chittagong. The army also destroyed bank notes and coins, so that many
areas now suffer from a severe shortage of ready cash. Private cars were picked
up off the streets or confiscated from auto dealers and shipped to the West
before the ports were closed."
এই ছন্নছাড়া অবস্থা থেকে সুস্থ দেশ গড়ে তোলা ছিল সেই সময়কার নেতৃত্বের কাছে
চ্যালেঞ্জ। দেশ চালানোর ভার হাতে পেয়েই তাঁরা প্রথম খাদ্য এবং চিকিৎসা এই দুই
প্রাথমিক চাহিদার ওপরেই প্রাধান্য ন্যস্ত করলেন। কিন্তু ভাঁড়ার সম্পূর্ণ শূন্য। এ
অবস্থায় সাহায্য চাওয়ার আর অন্য কোনো বিকল্পই সামনে খোলা ছিল না। স্বভাবতই
সাহায্যের জন্য শেখ মুজিবর রহমান আবেদন জানালেন রাষ্ট্রসংঘ, ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা, ইউনাইটেড কিংডম সহ ইউরোপের ধনী দেশগুলির কাছে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে গড়ে তুললেন সখ্য। প্রতিবেশী অন্য দেশগুলির সঙ্গেও সদ্ভাব
বজায় রাখার নীতি গৃহীত হলো। পশ্চিম পাকিস্তানের এতদিনের ঔপনিবেশিক নীতি থেকে দেশ
কে বার করে আনার জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলো।
জাতীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র এই চার স্তম্ভের ওপর গড়ে তোলা হলো
নতুন সংবিধান, যা অন্য দেশে মুজিবিসম নামে
খ্যাতি পেয়ে গেল। ১৯৭৩ সালে স্বাধীণতা পরবর্তী বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম
সাধারণ নির্বাচন। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করল আওয়ামি লীগ।
প্রধানমন্ত্রী হলেন মুজিব। খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জল, বিদ্যুৎ, নিকাশী
ব্যবস্থা, ১০ লক্ষ উদাস্তুর পুনর্বাসন
লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য পদক্ষেপ নিল নতুন
সরকার। প্রায় ৯০ শতাংশ দরিদ্র এবং দরিদ্রেতর মানুষের দেশ কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এই
পরিকল্পনা খুব ভালোভাবে মেনে নিতে পারছিল না সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।
তলেতলে দানা বাঁধল ষড়যন্ত্র। পরাজিত পাকিস্তানের বেশ কিছু এজেন্ট রয়ে গেছিল
ছদ্মবেশে। এছাড়া ছিল পাকিস্তানপন্থী জামাত ই ইসলামীর মতো কট্টর মৌলবাদী দল। তাদের
মদত দিল আমেরিকা। ১৫ই আগষ্ট, ১৯৭৫, আমেরিকার সেন্ট্রাল ইন্টালিজেন্স এজেন্সি এবং পাকিস্তানের
প্রত্যক্ষ আর্থিক ও অন্যান্য মদতে এবং ঢাকাতে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ইউজিন
বুস্টারের উপস্থিতিতে খোন্দকার মোস্তাক আহমেদের প্ররোচনা এবং নেতৃত্বে একদল
ধর্মোন্মাদ তরুন মিলিটারী অফিসার ট্যাংক ও সবরকম অস্ত্র নিয়ে ঘিরে ফেললো ঢাকায়
ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ী। মুজিব সহ তাঁর পরিবারের উপস্থিত সমস্ত সদস্য কে হত্যা
করল উন্মাদের দল। বেঁচে গেলেন শুধু পশ্চিম জার্মানিতে প্রবাসী দুই কন্যা শেখ
হাসিনা ওয়াজেদ ও শেখ রেহানা। বাংলাদেশে তাঁদের ফেরা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে সামরিক
অভ্যুথানের নায়ক পাকিস্তানপন্তী খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ হলেন স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট
অব বাংলাদেশ।
আশ্চর্য ইতিহাসের পরিহাস, একই
সময়ে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ ডুবে গেল গভীর
অন্ধকারে। পিছিয়ে পড়লো উন্নয়নের শুভ প্রচেষ্টা ও ইচ্ছা। খুন হল গণতন্ত্র তিন
দেশেই।
ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জোর গলায় গণতন্ত্রের কথা বলে
এসেছেন অথচ তারপরেই ধর্ষিত হয়েছে সেই গণের জন্য, গণের দ্বারা, গণের
কৃত তন্ত্র। পীড়িত নাগরিকের কাছে মূলত ক্ষমতা থেকে ক্ষমতার পরিবর্তনের সময়েই
গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তিত হয়েছে। আর গণতন্ত্রের ছত্রছায়াতে নিঃশব্দে রোপিত হয়েছে
বিষবৃক্ষ। মানুষকে ভুল বুঝিয়ে স্ব উদ্দেশ্য সিদ্ধির মারপ্যাঁচ এতটাই জটীল অঙ্ক যে
তার জট খুলতে তাবড় চিন্তাবিদও হিমসিম খেয়ে যান।
১৯১০, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেরও আগে, মহারাষ্ট্রের নাগপুর থেকে এক তরুন কলকাতায় এলেন
চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য। কলকাতায় তিনি থাকতে শুরু করলেন
শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী নামে জনৈক তরুনের বাসায়। এই শ্যামসুন্দর ছিলেন তৎকালীন
সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির সদস্য। স্বভাবতই মারাঠী আকৃষ্ট হলেন সশস্ত্র
বিপ্লবের আদর্শে। সান্নিধ্যে এলেন বিখ্যাত বিপ্লবী রামপ্রসাদ বিসমিলের। ডাক্তারী
পড়া শেষে নাগপুরে ফিরে যাওয়ার পরে কিছুদিন সশস্ত্র বিপ্লবের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে
ইস্তফা দিয়ে ২৭শে সেপ্টেম্বর, ১৯২৫
বিজয়া দশমীর দিন রোপণ করলেন এক চারাগাছ, পরবর্তীতে যা মহীরুহ হয়ে ঘন অন্ধকারের সৃষ্টি করল। সেদিনের সেই মারাঠী তরুনের
নাম কেশব বলীরাম হেডগেওয়ার, আর সেই
চারাগাছটি হল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।
ভয়ংকর অদ্ভুত উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রচারক এই দল, প্রথম থেকেই নিজেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে মান্যতা দিতে অস্বীকৃত হয়েছে। অথচ
প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই কংগ্রেসের বিভিন্ন কর্মসূচীকে সমর্থন এবং অংশগ্রহণ ছিল
সঙ্ঘের অন্যতম কাজ। অর্থাৎ এই সময়ে এই সংগঠনের ভয়ংকর উগ্র হিন্দুত্ববাদকে কাজে
লাগিয়ে নিজেকে প্রসারিত করছিল কংগ্রেস। অপরদিকে মুখে রাজনৈতিক অচ্ছুত বললেও কং
রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম কে কাজে লাগিয়ে বড় হচ্ছিল বিষবৃক্ষ। মধুচন্দ্রিমা শেষ হল
১৯৩৯ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই সরাসরি অ্যাডলফ হিটলারকে সমর্থন করে বসল
সঙ্ঘ। হিটলারের বিশুদ্ধ রক্তের তত্ত্ব প্রচার করতে শুরু করল তারা। মজার ব্যাপারটা
হল, এই সঙ্ঘই আবার অপরদিকে ছিল প্রবল
ইহুদী সমর্থক, যারা আবার কিনা ছিল হিটলারের
শত্রু। এই দ্বিচারিতার মধ্যেই প্রথমবার নিষিদ্ধ হল এই সংগঠন।
দ্বিতীয়বার এই সংগঠন নিষিদ্ধ হল ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮ এ, বহু মহারথীর পরিকল্পিত
ষড়যন্ত্রে সঙ্ঘের এক সদস্য নাথুরাম গডসে প্রকাশ্য প্রার্থনা সভায় যখন গুলি চালিয়ে
খুন করলেন মোহনদাস করমচন্দ গাঁধি কে। এই হত্যার পেছনে প্রকাশ্যে যে মত প্রচারিত
হয়েছিল, তা হল গাঁধির মুসলমান তোষণ, কিন্তু প্রচ্ছন্নে ছিল আরো মস্তবড় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের
খেলা, যা বোঝার ক্ষমতা নাথুরাম সমেত
বিরাট অংশের ক্যাডারদের তথা অশিক্ষিত ভারতবাসীর ছিল না।
এই উগ্র সঙ্ঘ কেই ভারত সরকার বারবার ডেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব
সঁপেছে। ১৯৬২, ১৯৬৩, ১৯৬৫, ১৯৭১ বারংবার কখনো আইন শৃঙ্খলা
নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, কখনো
রাজধানীর যান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, কখনো
গুরুত্বপূর্ণ প্যারেডে অংশগ্রহণ করার জন্য সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছে এঁদের। আবার
মতের অমিল হলে নিষিদ্ধকরণও হয়েছে বারবার। তৃতীয় দফায় সঙ্ঘ নিষিদ্ধ হল জরুরী
অবস্থার সময়ে অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একসারিতে। আর চতুর্থতম
নিষিদ্ধকরণ তো এখন ইতিহাস।
কালো ছায়া ঘনিয়ে উঠছিল এক ভয়াবহ বিতর্কে। সেই প্রাগৈতিহাসিক রামের জন্মের
স্থান নিয়ে ইচ্ছাকৃত বিতর্ক তুলে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় জানপ্রাণ লড়িয়ে
দিল সঙ্ঘ ও তার সহযোগী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ
এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক মুখ ভারতীয় জনতা পার্টি। হিন্দু সমর্থন হারানোর আশংকায়
ধৃতরাষ্ট্রের ভূমিকা নিল তৎকালীন কংগ্রেসী নরসীমা রাও সরকার। প্রচার তুঙ্গে তুলে
৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯২ সকালেই হামলা হল
উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের ওপর। বাবরের আমলের ঐতিহাসিক স্থাপত্য ভেঙে
গুঁড়িয়ে গেল অন্ধ মৌলবাদের হাতুড়ির আঘাতে। আজকের সিরিয়ায় বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপত্যের
ওপরে মৌলবাদী সংগঠন যে অন্ধ আঘাত করে চলেছে, সেদিনের বাবরি মসজিদ ভাঙার সঙ্গে তার কোনো পার্থক্যই ছিল না। সমগ্র উপমহাদেশে
সেদিন সূর্য ওঠেনি, সকাল
হয়নি, মানুষ পিছিয়ে গেছিল ফের অন্ধকার
যুগে। লজ্জায় মুখ ঢেকে ছিল সভ্যতা।
“After giving careful and serious consideration
to all the materials that are on record,the Commission is of the view that the
RSS with its extensive organisation in jamshedpur and which had close links
with the Bharatiya Janata Party and the Bharatiya Mazdoor Sangh had a positive
hand in creating a climate which was most propitious for the outbreak of
communal disturbances. In the first instance, the speech of
Shri Deoras (delivered just five days before the Ram Navami festival) tended to
encourage the Hindu extremists to be unyielding in their demands regarding Road
No. 14. Secondly, his speech amounted to communal propaganda. Thirdly, the
shakhas and the camps that were held during the divisional conference presented
a militant atmosphere to the Hindu public. In the circumstances, the commission
cannot but hold the RSS responsible for creating a climate for the disturbances
that took place on the 11th of April, 1979
— Jitendra Narayan in a report on
Jamshedpur riots of 1979”
সভ্যতা এগিয়ে চলার গর্ব করেছে, আর
পাশাপাশি সভ্যতাকে নগ্ন করার চেষ্টা হয়েছে বারবার। ওপরে উদ্ধৃত ১৯৭৯ সালে
জামশেদপুরে ঘটিত দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত কমিশনের রিপোর্টের একটি অংশ। বারবার
দেখা গেছে উস্কানি কখনো দেওয়া হয়েছে, আবার কখনো উস্কানি দেবার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। ভারতের প্রধান দুই
সম্প্রদায়ের মানুষ সাধারণত মিলেমিশেই থাকেন। বহু জায়গায় মুসলমানেরা দুর্গাপুজো
করেন যেহেতু এটা একটা অন্যতম বৃহৎ উৎসব। আবার মুসলিমদের বিভিন্ন পরবে অন্য ধর্মের
মানুষ দাওয়াত রক্ষার জন্য যান। রাষ্ট্র শাসনের তাগিদে ইংরেজের ডিভাইড এন্ড রুলের
শিকার হয়ে প্রাক স্বাধীণতা যুগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই দুই সম্প্রদায়
প্রথম বিবাদে জড়িয়ে গেছিল। অথচ এর জন্য সাধারণ মানুষকে কোনোভাবেই দায়ী করা যায় না।
স্বাধীণতার হাত ধরেই এসেছিল সাম্প্রয়ায়িকতা। এসেই সে পাকাপাকি মৌরসিপাট্টা গেড়ে
বসল।
বিহারে জামশেদপুর রায়ট, ভাগলপুর
রায়ট, ২০০২ এ গুজরাত রায়ট, একের পর এক সন্দেহ, অবিশ্বাস, নরমেধযজ্ঞ। আর বারবার প্রমাণিত
হয়েছে এর পেছনে আছে মৌলবাদী আর এস এস এর পাকা মাথারা। অসংখ্য শিকড় ছড়িয়ে রাষ্ট্রীয়
স্বয়ং সেবক সংঘের। মুখ্য রাজনৈতিক মুখ হলো ভারতীয় জনতা পার্টি। এছাড়া, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ভারতীয় কিষাণ সঙ্ঘ, ভারতীয়
মজদুর সঙ্ঘ, ভারতীয় রেলওয়ে সঙ্ঘ, ফিশারম্যানস কো অপারেটিভ সোসাইটি, সংস্কার ভারতী, অধিভক্তা
পরিষদ, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, অখিল ভারতীয় শৈক্ষিক মহাসংঘ, ন্যাশনাল মেডিকোস অর্গানাইজেশন, অখিল
ভারতীয় পূর্ব সৈনিক পরিষদ, স্বদেশী
জাগরণ মঞ্চ, ভিত সলাহকার পরিষদ, লঘু উদ্যোগ ভারতী, সহকার ভারতী, দীনদয়াল
শোধ সংস্থান, ভারতীয় বিকাশ পরিষদ, বিবেকানন্দ মেডিক্যাল মিশন, সেবা ভারতী, সক্ষম, নীলে, হিন্দু সেবা প্রতিষ্ঠান, লোক ভারতী, সীমা
সুরক্ষা পরিষদ, রাষ্ট্রীয় সেবা সমিতি, শিক্ষা ভারতী, বজরং দল, ধর্ম জাগরণ সমিতি, মুসলিম রাষ্টীয় মঞ্চ, হিন্দু মুন্নানি, হিন্দু
রাষ্ট্র সেনা, একাল বিদ্যালয়, সরস্বতী শিশু মন্দির, বিদ্যা ভারতী, বিজ্ঞান
ভারতী, বারানসী কল্যান আশ্রম, অনুসূচিত জাতি জমাটি আরক্ষণ বাঁচাও পরিষদ, ভারত-তিব্বত মৈত্রী সঙ্ঘ, বিশ্ব সংবাদ কেন্দ্র, হিন্দুস্তান
সমাচার, ভারতীয় বিচার কেব্দ্র, হিন্দু বিবেক কেন্দ্র, বিবেকানন্দ কেন্দ্র, ইন্ডিয়া
পলিসি ফাউন্ডেশন, ভারতীয়
শিক্ষণ মন্ডল, অখিল ভারতীয় ইতিহাস সংকলন যোজনা
ইত্যাদি শাখা সংগঠন মাটির তলায় শিকড়ের মত ভারতের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে। একযোগে
যখন গোয়েবলসীয় কায়দায় এই এতগুলি সংগঠন কোনো প্রচার চালায়, তখন আম অশিক্ষিত আদমির মাথায় তার গ্রহনযোগ্যতা বিচারের কথা মাথায় আসেনা। ফলে
দাঙ্গার আগুন জ্বালানো এখানে খুবই সহজ কাজ, যা উপমহাদেশের সব দেশেই বারবার দেখা গেছে।
২০০২ এর গুজরাত দাঙ্গা সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য কখনোই বাইরে আসেনি। শুধু সরকারি
পরিসংখ্যান থেকেই যা জানা যায় তাতে মেরুদন্ডে বরফের স্রোত বইয়ে দিতে যথেষ্ট। ২৭শে
ফেব্রুয়ারী অযোধ্যা থেকে আগত করসেবক ভর্তি ট্রেনে আগুন লাগায় পুড়ে মারা যান ৫৮ জন
নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা করসেবক। আগুন জ্বলে ওঠে সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে
ইন্ধন যোগানে। দাঙ্গা লাগে, মারা
যান দুই সম্প্রদায়ের ১০৩৪ জন, আগত
২৫০০, নিখোঁজ ২২৩। অন্যান্য সূত্রের
খবর শুধু মারাই গেছিলেন প্রায় ২৫০০ মানুষ। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল শিশুদের, হয়েছিল অসংখ্য ধর্ষণ। এই রায়টের পরিপ্রেক্ষিতে অসংখ্য মামলা
হয়েছিল। যার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মামলা হল, বেস্ট বেকারি মামলা, বিলকিস
বানু মামলা, অবধূতনগর মামলা, দানিলিমদা মামলা, এরাল মামলা, প্রভাগড় ও ধিকভা মানলা, গোধরা ট্রেন মামলা, দীপদা দরওয়াজা মামলা, নারোদা
পাটিয়া মামলা, পেরজুরি মামলা, কৌশরবানু গণ ধর্ষণ মামলা ইত্যাদি।
২২শে জানুয়ারি, ১৯৯৯, উড়িষ্যার কন্ধমাল জেলা। সূর্যোদয়ের সময়েই স্টেশন ওয়াগনে
ঘুমন্ত অবস্থায় ১০ বছরের বালক ফিলিপ আর ছয় বছরের বালিকা কন্যা টিমোথি সমেত
সস্ত্রীক পুড়িয়ে মারা হলো খ্রীষ্টান
ধর্মপ্রচারকঅস্ট্রেলিয় গ্রাহাম স্টেইনস কে। বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠায় বাধ্য
হয়ে তৎকালীন উড়িষ্যা সরকার গ্রেপ্তার করল উত্তর প্রদেশের এটওয়ার বাসিন্দা বজরঙ্গ
দলের সদস্য দারাসিং কে। কিন্তু ততক্ষণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে কন্ধমাল
জেলায়। একদিকে মাওবাদী অন্য দিকে সঙ্ঘ পরিবারের উস্কানিতে আক্রান্ত আদিবাসী জন
সমাজ। আর এভাবেই ২০০৭, ২০০৮
বারবার উড়িষ্যা আক্রান্ত হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।
কিন্তু সম্ভবত স্বাধীণতা পরবর্তীতে ভারতের সবচেয়ে শিহরণকারী ঘটনা অযোধ্যার
বাবরি মসজিদ ধ্বংস। ধ্বংসের ১০ মাস আগেই তৈরী হয়েছিল ব্লুপ্রিন্ট। কোনো যে সে
লোকের অভিযোগ নয়, একথা
বলছেন খোদ ভারতের ইন্টালিজেন্স ব্যুরোর জয়েন্ট ডিরেক্টর মলয় কৃষ্ণ ধর। “Babri Masjid demolition was planned 10
months in advance by top leaders of RSS, BJP and VHP and raised questions over
the way the then prime minister P V Narasimha Rao, had handled the issue. I was
directed to arrange the coverage of a key meeting of the BJP/Sangh Parivar and
that the meeting proved beyond doubt that they (RSS, BJP, VHP) had drawn up the
blueprint of the Hindutva assault in the coming months and choreographed the
'pralaya nritya' (dance of destruction) at Ayodhya in December 1992... The RSS,
BJP, VHP and the Bajrang Dal leaders present in the meeting amply agreed to
work in a well-orchestrated manner. The tapes of the meeting were personally
handed over by me to my boss, I have no doubt that my boss had shared the
contents with the prime minister (Rao) and the Home Minister (S B Chavan).There
was silent agreement that Ayodhya offered "a unique opportunity to take
the Hindutva wave to the peak for deriving political benefit.” ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২, তিন
শীর্ষ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানী, মুরলী
মনোহর যোশী এবং বিনয় কাটিয়ারের উপস্থিতিতে বিতর্কিত পরিকাঠামোর ভেতরে সীমিত সংখ্যক
পুলিশের উপস্থিতিতে ঢুকে পড়ল কয়েক হাজার উন্মত্ত করসেবক। ধূলোয় গুঁড়িয়ে গেল
প্রাচীন ঐতিহাসিক গর্বের স্থাপত্য। করসেবকদের প্রকাশ্যে সেদিন অভিনন্দন
জানিয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের সরকার। মৌলবাদ মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসলো আরো একবার
উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ভারতেও।
********
সৌমিত্র
চক্রবর্তী
ধন্যবাদ রংরুট।
উত্তরমুছুন