উড়ান - সোনালি পুপু



উড়ান
সোনালি পুপু


কি সুন্দর যে মুর্তিটা! দু দিন ধরে হাজার দুয়ারি দেখে চলেছে তিতলিদের গ্রুপ। দেখে দেখে আশ মেটে না কত সুন্দর জিনিষ, কত মহার্ঘ্য বস্তু মানুষের সামনে সাজানো রয়েছে অনায়াসে। দেশটা কত ধনী ছিল আমাদের? বিদেশী তোষণ আর বিদেশীদের শোষণ, এই দুয়ের পর এখন বুঝি আর ছিবড়েটুকু ছাড়া কিছু বাকি নেই তাই এত দারিদ্র্য চারপাশে প্রথম দিন এসেই দোতলার এক শোকেশের কোনায় চোখ আটকে গিয়েছিল তিতলির।
এত জিনিষের ভিড়ে সবার চোখে পড়েই না হয়ত কিন্তু কি অপরূপ ভাস্কর্য! তিতলি ভাবে, আহা, একে এমন ভাবে কেউ রাখে? পৃথিবীর যে কোন মিউজিয়াম একে পেলে বর্তে যেত, আই এম শিওর কি ডিটেলের কাজ! ঘোড়ার সামনের দু পা ওপরে তার গতির প্রানোচ্ছ্বাস কি নিপুণ ভাবে ফুটেছে প্রতিটি পেশীতে পাশে এক জন মানুষ পায়ের চটিতে ডানা লাগানো রোমান দেবতা? মার্কারি? সবচেয়ে পুলকিত হবার কারন; ঘোড়ার পিঠ থেকে মেলে দেওয়া দুটি পাখারোজ এর সামনে দাঁড়ালেই তিতলির হার্টটা ঠক করে লাফিয়ে গলার কাছে চলে আসছে।” পেগেশাস!!! আহা, ছোট বেলার থেকে কত স্বপ্ন এই উড়ন্ত আশ্চর্যকে নিয়ে! সে আজ এমন চোখের সামনে, হাতের কাছে? আর কি সুন্দর; মনে হচ্ছে জীবন্ত কেউ খেলতে খেলতে স্ট্যাচু বলে দিয়েছে তাই উড়বার মাঝখানে থেমে গেল। এই কাঁচটুকু সরালেই এখুনি চিঁ হিহি করে উড়ে যাবে দ্বিতীয় দিনও তাই এসে দাঁড়িয়ে ছিল এর সামনে কি কাঠ দিয়ে বানানো কে জানে? শিল্পীর হাতের পালিশের জাদুতে একেবারে জীবন্ত মনে হচ্ছে। ইঞ্চি তিনেক হবে, তার মধ্যেই এত নিখুঁত

  এক জায়গায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলে লোকের ধাক্কা, কৌতূহলী নজর ইত্যাদি এসে পড়ে, তাই একটু পরে অন্য শোকেশের দিকেও একটু এগিয়ে গেলো তিতলি আস্তে আস্তে সময় শেষ হবার ঘণ্টা বাজা সুরু হল সব লোক যখন বেরিয়ে যেতে সুরু করল একটু একটু করে, তিতলি অবাক হয়ে দেখল আরেকটা লোকও চুপ করে সেই পেগেশাসের সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে বিরক্ত লাগছিল। ও আরেকবারটি দেখবে ভেবেছিল কিন্তু দেখাটা শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে না লম্বা হলের অন্য দিকে আস্তে আস্তে হাঁটে তিতলি ঘণ্টি বাজার পরেও চার পাঁচ মিনিট সময় দেয় দারোয়ানরা সবাইকে বেরোনোর জন্যে। লোকটা সরে গেলে আর একবার দেখে তিতলি বেরিয়ে যাবে একটা হাতির দাঁতের নৌকো দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল দু মিনিট তারপর মুখ ঘোরাতেই দেখল ঘরের ও দিকটা ফাঁকা চলে গেছে লোকটা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে শো কেশের সামনে এসেই আর্তনাদ করে উঠল তিতলি,পেগেশাস?

শো কেশের সেই কোনটা তো ফাঁকা! দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়েই দেখল সেই লোকটা দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি ওকে ধরতে পারবে না বুঝে, চটপট পকেট থেকে মোবাইল বের করে তিতলি। টিমের বাকিদের জানাতে থাকে লোকটার চেহারার ডিটেইল আর সম্ভাব্য বেরোনোর রাস্তা তারপর এই ফ্লোরের সিকিওরিটির সংগে কথা বলতে এগোয়। সাধারন মানুষের ফোন নিয়ে হাজার দুয়ারির ভিতরে ঢোকা নিষেধ তিতলিরা পুলিশ বলেই ছাড় পেয়েছে তিতলির সংগে আসা বাকি পুলিশ টিম লোকটাকে দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু এদিকে মুশকিলে পড়ল তিতলি নিজে। তার সঙ্গে কথা বলতে থাকা সিকিওরিটীর ভদ্রলোক জোরের সংগে জানাল, ম্যাডাম ভুল বলছেন, অমন কোন মুর্তি ছিলই না ওখানে। কাঁচ ও ইনট্যাক্ট আছে দেখতেই পাচ্ছেন আমরা কেউ তালার চাবি না খুললে কোন শোকেশ থেকেই কিচ্ছু বের করা যায় না তিতলি আবার টীম লিডার শান্তনুদাকে ফোন লাগাতে, তিনি বললেন,কথা বাড়াস না বেরিয়ে আয় রাগে লাল, দুঃখে প্রায় কান্নামাখা তিতলি নীচে নেমে চেঁচাতে যাচ্ছিল। চাপা ধমকে থামিয়ে দিলেন টীম লিডারচুপচাপ হোটেলে চল। লোকটাকে ট্র্যাক করা হচ্ছে তিতলিদের টীমটা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নিরাপত্তার জন্যে এসেছে মুর্শিদাবাদদু তিন জন হেভিওয়েট মন্ত্রী দিল্লী থেকে এসেছেন একটা পলিটিকাল মিটে। টীমের সবাই একটু ওপরের দিকের পুলিশ অফিসার তিতলিও খুব ছোট অফিসার নয় হোটেলের ঘরে সবাইকে উত্তেজিত হয়ে পুরো ঘটনাটা বলতেই, বেশি সিনিয়াররা গম্ভীর হয়ে গেলেনতার মানে ভিতরের কেউ বেচে দিয়েছে জেনে শুনেই আন্তর্জাতিক বাজারে কোটি ইউরোর ব্যবস্থা করা আছে ছটফট করে ওঠে তিতলি, বললেন যে লোকটাকে ট্র্যাক করা হচ্ছে? হ্যাঁ কোন হোটেলে আছে, কি নামধাম দিয়েছে সেখানে সবই জানি আমরা। তবে? তবে কি? তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই তিতলি দেবী আকুল শোনায় তিতলির গলা, এত বড় চুরি সহ্য করে যাবেন শান্তনুদা? কিচ্ছু করব না? আমার পেগেশাস ---ভি আই পিদের সামলাতে এসেছি তিতলি বিনা প্রমানে কাউকে হ্যারাস করে ব্যাড প্রেস ইনভাইট করা যাবে নাফুঁসতে থাকা তিতলিকে হাত তুলে থামিয়ে দেন শান্তনুতুমি বড্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছ তোমায় ছুটি দিলাম মিনিস্ট্রী টীমে সেনসিটিভ মহিলারা আছেন, সুতরাং মেয়েদের অন্য কাউকে আনিয়ে নিচ্ছি বাড়ি যাও।


সেই থেকে সাদা পোশাকে পেগেশাস হাতানো লোকটার পিছনে ছায়ার মত সেঁটে আছে তিতলি অফিসিয়ালি ছুটিতে আছে সে ব্যক্তিগত কাজে ব্যস্ত আছে তবে এটুকু জানে, বিপদে পড়লে ডিপার্টমেন্ট ঠিক ঝাঁপাবে তাকে বাঁচাতে কলকাতা থেকে ফ্লাইটে দিল্লী এসেছে লোকটা তিতলিকে আনঅফিসিয়ালি খবরপত্র জানাচ্ছে বন্ধুরা সব। তাই একই ফ্লাইটে তিতলিও দিল্লী এয়ারপোর্ট এখান থেকে আমেরিকা যাবার প্লেন ধরবে লোকটা ছটফট করছে তিতলি কি দিয়ে আটকাই? কি করে আটকাই? আমেরিকা চলে গেলে আর ধরা, নেক্সট টু ইম্পসিবল আহ! পেগেশাস! পাগলের মত আমেরিকা ফ্লাইটেরও টিকিট কেটে নিয়েছে তিতলি। যদিও আমেরিকা পৌঁছে গেলে ও আর কিছুই করতে পারবে না তবু হাতের এত কাছ ঠেকে কিছুতেই ছেড়ে দিতে পারছে না পেগেশাসকে বাড়িতে জানে সান্দাকফুতে ট্রেকে আছে, মোবাইলে পাবে না দিল্লীর এয়ারপোর্টে সিকিওরিটী চেকের লাইনে দাঁড়িয়ে তিতলি লোকটা এরমধ্যে কারো সংগে দেখা করেনি সংগে একটা ব্যাকপ্যাক আছে শুধু, হ্যান্ডলাগেজ হিসেবে আর কিছু নেই তার মানে পেগেশাস ঐ ব্যাকপ্যাকেই হাত নিশপিশ করে তিতলির ইসস, এক বার যদি সার্চ করতে দিত কেউ!ছেলেদের সিকিওরিটি চেকের লাইনটা অনেক লম্বা মেয়েরা আজকের ফ্লাইটে সংখ্যায় কম। তিতলির আগেই হয়ে গেছে চেক করানো একটা নেভি ব্লু জিন্স আর সাদা টি শার্ট পরে আছে সে এক্সরে মেশিনে মোবাইল আর বড় ভ্যানিটী ব্যাগটা ট্রেতে স্ক্যান হয়ে আসছে বলে অপেক্ষা করছিল সিকিয়োরিটি টেবিলের এপারে। দেখল ওর ট্রেটার পরেই আরেকটা ট্রে বেরিয়ে এল তাতে ঐ লোকটার ব্যাকপ্যাকটা স্ক্যান হয়ে চলে এসেছে। লোকটা সিকিওরিটী রুমে চেকিং এ ঢুকছে এখানে সবাই যে যার মোবাইল, ওয়ালেট, বেল্ট টূলে নিতে ব্যস্ত কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না ক্যাজুয়ালি ব্যাকপ্যাকটা তুলে কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে তিতলি পা চালাল টয়লেটের দিকে। এদিকটা চোখের আড়াল হতেই স্পিড বাড়িয়ে সোজা লেডিজ টয়লেট। ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বাবা, চোরদের কি টেনশান ফ্লাশের ওপর ব্যাকপ্যাকটা রেখে দ্রুত হাতে সার্চ করতেই একটা এলুমিনিয়ামের বাক্স হাতে এল ইঞ্চি পাঁচেক মাপ। আর বড় কিছুটি নেই ভিতরে। জিপ টেনে ওখানেই রেখে দিল ব্যাগটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে যেতে হবে, এখন খুলে দেখার সময় নেই বাক্সটা ভ্যানিটী ব্যাগে ঢুকিয়ে, ব্যাগের ভেতর থেকে একটা কালো সিল্কের বোরখায় নিজেকে ঢেকে নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে এরাইভ্যালের গেটের দিকে পা চালায় তিতলি কানে মোবাইল সিকোয়রিটির থেকে এদিকটা বেশ দূর আর আড়ালেও ওদিকে খোঁজাখুঁজি সুরু হলেও সেটা এই অব্ধি এক্ষুনি এসে পৌঁছবে না আশা করা যাক টীম পার্টনার দিব্যেন্দু গাড়ী নিয়ে তিন নম্বর গেটে আসছে ব্যাকপ্যাকটা বাথরুমেই রইল একটু পরে ক্লিনাররা কেউ খুঁজে পাবে নিশ্চই


শান্তনুবাবু হোহো করে হাসেন নিজের অফিসের রুমে বসেতা হলে আমার জুনিয়ররা চোরের ওপর বাটপাড়? কি তিতলি? পেগেশাসকে কি করবে? এর মুর্শিদাবাদের মালিকরা ত এ খোয়া গেছে বলেই স্বীকার করেনি। আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে অফিশিয়ালি ইন্ডিয়ান মিউজিউয়ামকে গিফট করা যায় না দাদা? মৃদু গলায় বলে তিতলিঅফ কোর্স, অফ কোর্স এয়ারপোর্ট থেকে দিল্লীর বন্ধুদের হেল্প নিয়ে খুব সাবধানে কলকাতায়ে ফিরেছে তিতলি দেশ কত সহজে বিকিয়ে যাচ্ছে এখনও, প্রতি দিন, হাতে নাতে বুঝতে পেরে দমবন্ধ লাগছে ওর এয়ারপোর্টে ওইটুকু জায়গায়ে সিকিওরিটির ফাঁকটুকু না থাকলে, পেগেশাস এতক্ষনে কোথায় উড়ে যেত কে জানে?
    কলকাতায় তবু মাঝে মাঝেই মিউজিয়ামে গিয়ে দেখে আসা যাবে

সোনালি পুপু


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন