ওরাও মানুষ - শ্রাবণী সিংহ



ওরাও মানুষ
শ্রাবণী সিংহ

আমি তখন স্কুলে পড়ি, ক্লাস ফোরে লখ্‌নৌ-এর এক আত্মীয় বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে অভাবনীয় অভিজ্ঞতা হল বৌভাতের পরদিন বাড়ির সবাই তটস্থ, হিজড়েদের ভয়াল ছায়া কখন পড়বে  বাড়িতে বাচ্চা হলে বা বিয়ের পর নতুন বৌ আসা উপলক্ষ্যে জবরদস্তি ওরা বাড়ি ঢুকে টাকা আদায় করে ১০/ ১২ হাজার কখনও লাখ টাকাও হতে পারে, যা চাইবে দিতেই হবে না দিলেই অভিশাপ বর্ষণ-সপরিবারে নাশ হবি, বাচ্চা মরবে বৌ মরবেইত্যাদি ইত্যাদি প্রত্যক্ষদর্শী যারা, তারা তা ভালোই জানেন

যথারীতি ওরা এল বৌ দেখতে চাইল সাথে চাঁদা নতুন বৌ তো অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম  টাকা নিয়ে ততক্ষণে দর-কষাকষি শুরু হল বাড়ির বয়স্কদের সাথে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সাহস করে যেই না তাকালাম, অমনি দেখি নীচের ক্যাম্পাসে ওদের দঙ্গলের একজন ঝপ্‌ করে শাড়ি উঠিয়ে গোপন জায়গাটা দেখিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করছে কিছুক্ষণ বাক্‌-বিতন্ডার পর কিছু দিয়ে তখন তখন তাদের বিদেয় করা হলকিন্তু বাচ্চারা সবাই ভয়ে কাঁপছিলাম সেই থেকেই হিজড়ে নামক এই শব্দটির সাথে আমার ভয়ংকর পরিচিতি

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এরা, মহাভারতের শিখন্ডী অর্থাৎ প্রচলিত অর্থে হিজড়া ভারতে এরা পনেরো লক্ষের মত কিন্তু প্রকৃত সংখ্যাটা এর চেয়ে অনেক বেশিই হয়তো সামাজিক লজ্জার ভয়ে অনেকেই নিজের আইডেন্টিটি লুকিয়ে রাখে হ্যাঁ, তারাও কারোর না কারোর বৈধ সন্তান কিন্তু সংস্কারাচ্ছন্ন আমরা মানুষেরা তাঁদের স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে ভয় পাই আজও ধর্মান্ধদের ব্যাখ্যায়  পুর্বজন্মের পাপের ফল ইত্যাদি দোষে দুষ্ট ওরা অথচ পুরাকালে প্রাচীন দেবদেবীদের মধ্যেও এরা ছিল, আছে,পুজোও হত  হরি ও শিবের মিলনে আয়াপ্পা, মহাভারতের বৃহন্নলা, শিখণ্ডী গ্রীক দেবতা হার্মেস ও দেবী আফ্রোদিতির সন্তান হার্মাফ্রোদিতাস এদের মধ্যে  উল্লেখ্য

হার্মাফ্রোডাইট বলে  শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল হিজড়ে বা হিজড়া রাজকুমারী অম্বার চেতনা দিয়ে শিখন্ডির অবতারনা করেছেন বেদব্যাস, যাকে ভীষ্ম ছাড়া কেউ অবজ্ঞা করে নি সম্ভবত মেসোপটেমিয়া প্রাচীন মিশর,সুমেরীয় ও গ্রীক রোমান সভ্যতায় তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয়ের স্বীকৃতি আছে অধিকাংশ সমাজেই এরা অবহেলিত হলেও কিছু কিছু সমাজে এরা খানিকটা মর্যাদাও পেয়েছে ব্যবিলন সুমের ও অ্যাসিরিয়ায় পবিত্র গণিকা হিসেবে ব্যবহার করা হততাদের কাজ ছিল দেবসেবা, নাচ-গান ও নাটকে অভিনয় করা সিসিলির পুরোহিতরাও নারীবেশ ধারণ করে থাকতেন

মহাভারতে শিখন্ডীকে একজন যোদ্ধা হিসেবে দেখানো হয়েছে, যাকে সামনে রেখে বলশালী ভীষ্মকে একের পর এক তীর ছুঁড়ে শরশয্যায় শায়িত করলেন মহাবীর অর্জুন সেও শিখন্ডীর জন্যনাহলে হয়তো মহাকাব্য অন্যভাবে লেখা হতএর মূল্যও দিতে হল,কাপুরুষের মত দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা রাতগভীরে তাকে এসে হত্যা করল  পান্ডবদের নাবালকপুত্রদের সাথে উর্বশীর অভিশাপে  অর্জুনের আবার শাপে বর হল, বিরাটরাজার কন্যা উত্তরার নাচ-গানের শিক্ষাগুরু হয়ে বৃহন্নলা সেজে  সসম্মানে একবছর বেশ পারদর্শিতা দেখালেন

কতকাল আগে ঘটে যাওয়া মহাকাব্যের এই চরিত্রগুলো আজও আমাদের দিক্‌ দর্শায় আজও শিখণ্ডীদের মূল্যবোধের নিয়ত নিধন চলছে অশ্বত্থামাদের হাতে

ভারতীয় পুরাণে যেমন কিন্নরগণ, সম্মানিত গায়ক ও নর্তক আজও তাই বৃহন্নলারা ঢোল বাজিয়ে নাচ-গানের মাধ্যমে শারীরিক অঙ্গভঙ্গি করে পয়সা রোজগার করছে শুধু ভাগ্যে জোটে অশ্লীল খিস্তি আর বিড়ম্বনা আয়ের সবটাই তুলে দিতে হয় গুরুমার কাছে পুলিশকেও মাসে মাসে ভাগ দিতে হয় সভ্যসমাজ থেকে উপেক্ষিত ও আলাদা হয়ে নিজেই বেছে নেয় জীবনযাত্রার মান,চরম হতাশা বিকৃত মানসিকতায় বেড়ে ওঠা অনেকে পা বাড়ায় অপরাধজগতে কেন? এদেরকে ভালোবেসে সুস্থ জীবনে ফেরানো খূব কঠিন কী? স্বাবলম্বী হওয়ার কর্ম- কৌশল বিভিন্ন সামাজিক রাষ্ট্রীয় না ধার্মিক কর্মকান্ডে যদি এদের সম্পৃক্ত করা যায়, তবে এদের মধ্যেও তৈরী হবে দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেমের মত সচেতনতা

ইউরোপ সহ বিভিন্ন পাশ্চাত্ত্য দেশসমূহে তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারীরা নিজের পরিবারের সাথেই থাকে মানুষ তো ওরাও , আমাদের মতই দৈনন্দিন শ্বাসক্রিয়া, শোয়াবসা- আনন্দ অনুভূতি-বেদনা-ক্লান্তি-মৈথুনাদি অভ্যাসে অভ্যস্ত তবু বৈষম্য! সমাজ থেকেই তৈরী হিজড়ে শব্দটা, মানুষ-সৃষ্ট ট্যাবুর ভাষা, ছোট থেকেই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার প্রবণতা আমাদের অথচ দোষ তাদের নয়, এমনকি বাবা-মায়েরাও স্বাভাবিক থাকে তাদের শুধুমাত্র বাবা-মায়ের জিনঘটিত সমস্যার কারণেই এই যৌন প্রতিবন্ধকতা যা অল্প বয়সে ধরা পড়লে হরমোন চিকিৎসার মাধ্যমে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব  কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই মহাদেশে অনেকেই তা জানে না উচ্চ-মধ্য ও নিম্ন যেকোনো পরিবারেই এদের জন্ম হতে পারে উপযুক্ত সাপোর্ট ও চিকিৎসার মাধ্যমে এদের নির্ভরতার দিকে টেনে আনলেও সামাজিক টিট্‌কারি ও মন্তব্যের শিকার হতে হতে ততদিনে ঘরছাড়া হয় পরিণত বয়সে পৌছানোর আগেই

ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হিজড়েরা একই ধারায় গড়ে ওঠেঅবহেলিত ওরা ওদের মত নতুন কাউকে পেলে আঁকড়ে ধরেভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসে ও গুরুমার আশ্রয়ে ওদের সমাজ গড়ে তুলে, সেখানেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে

নতুন দিল্লীর মোনা আহমেদ ২০১৪ তে ভারত সরকার স্বীকৃতি প্রদানের  ঐতিহাসিক রায়টি পাবার পর সভ্যজীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু খাপ খাওয়াতে পারে নি নিজেকে কোনোভাবেই ফিরে এসে তাই আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয় মেহদিয়ান এলাকার কবরস্থান কিছু যৌনকর্মী, কবর-খোদক আর ভিক্ষুক এখন তার সঙ্গী  একাকীত্ব থেকে ওরা

সরকারী নথিপত্রে, ভোটারকার্ডে পাসপোর্টে এরা আজ স্বীকৃতি পেয়েছে নিজেদের ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়া বলে চিহ্নিত করার, পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই এখন থার্ড জেন্ডারের পরিচয়পত্র বহন করছে এই শিখণ্ডীরা  অনেক ক্ষেত্রেই যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছে তারাও থাইল্যান্ডে  এই ক্যাথোস বা লেডিবয়দের নিয়ে থাইসরকার বেশ তৎপর  বিনোদন, ট্যুরিষ্টদের অভ্যর্থনা, সেলস ও ফ্যাশন হাউস থেকে নানা ব্যবসা দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছে এরা দেশের উৎপাদন ও অর্থনীতির মূলস্রোতে যদি এদের মিলিয়ে দেওয়া যায়, তবেই কর্মসংস্থান, নিজস্ব আবাসন ছাড়াও মিলবে আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মত বাঁচার অধিকার

নিরাপত্তা, স্নেহ- ভালোবাসার অভাবেই হয়তো শাপ-শাপান্ত (ফলুক্‌ আর না-ই ফলুক্‌) অকথ্য গালি-গালাজ করতে থাকে পথচারীদের উদ্দেশ্যে বা গৃহস্থের বাড়ি গিয়ে কোন অনুষ্ঠান চলাকালীন এদের উপস্থিতি  আজকের দিনেও ভয়াবহ এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, হিন্দুশাস্ত্রে এই হিজড়েদেরকেই একদিন ভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করা হত প্রচলিত সময়ে এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে বিয়ে বা সন্তানের আগমনে বা অন্য অন্য সুখের মুহুর্ত্তে তাদের ডেকে একে আশীর্বাদ নেওয়া হত কালের পরিহাসে সেটাই জবরদস্তি জুলুমে পরিণত হয় এদের মধ্যে অনেক প্রতিভাধর হয়েও সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন শুধুমাত্র পরিচয়গত কারণে প্রকৃতির নির্মম পরিহাসে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া সন্তানটি শুধুমাত্র নারী বা পুরুষ হরমোনের তারতম্যের কারণেই না-নারী না-পুরুষ এমন একটি লৈঙ্গিক অবস্থানে পৌছাচ্ছে যাকে সমাজ  ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করে, ধর্ম তার অপব্যাখ্যা দেয় মানসিক কারণও কিছুটা হতে পারে,অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়

প্রতিভাধর নির্মাতা নির্দেশক ঋতুপর্ণ ঘোষ কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম , নিজেকে লুকিয়ে রাখেননি এমন আছেন আরো অনেকেই যারা এখন সিনেমা ও ফ্যাশন মডেলিং জগতে বিখ্যাত হয়েছেন

সুখের বিষয় এই যে, কোচি মেট্রো রেল ভারতের মধ্যে এই প্রথম  সরকারি সংস্থায়  ২৩ জন তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থীকে চাকরি দেওয়া হয়ভারতের অন্য রাজ্যের তুলনায় তামিলনাড়ুতে ওদের অবস্থা অনেকটাই ভালো এন,জিওরা সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে অনেকটাইপাশাপাশি কিছু সহৃদয় মানুষও এগিয়ে এসেছেন

এই দ্বৈতসত্ত্বা (two spirits)আমাদের অনেকের মধ্যেই লুকিয়ে আছেচাইছি বিজ্ঞানসম্মতভাবেই এদের পরিচিতি আসুক হিজড়ে শুধুমাত্র একটা গালি বা পেশা  নয়,ওরাও ভাবতে শিখুক ওরাও মানুষ

বাঁচুক সামাজিক সম্মান নিয়ে, দুর্গতের ইতিহাস যেন আর না লেখা হয় 

শ্রাবণী সিংহ


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন