উত্তরের নির্বাচিত লিটিল ম্যাগঃ
আমাদের অর্জন ও অহংকার
সুবীর সরকার
লিটিল ম্যাগাজিন। ছোট কাগজ। আপাতঅর্থে। কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে এগুলো কিন্তু
ছোট নয়। সাহিত্যের যথার্থ আঁতুরঘর হল লিটিল ম্যাগ। তার চরিত্র, তার কর্মকান্ড, তার সততা নিয়ে লিটিল ম্যাগ সাহিত্যের মুল ভরকেন্দ্র। একটা নিরীক্ষাধর্মী লেখা
প্রকাশের সাহস তো লিটিল ম্যাগই দেখাতে পারে। প্রবল ভাঙচুর, তোলপাড় করা জীবনের গল্প অকপটভাবে লিটিল ম্যাগেই স্বছন্দে প্রকাশের জায়গা পায়।
লিটিল ম্যাগ প্রকৃত লেখকের বিচরণক্ষেত্র। লিটিল ম্যাগ আসলে বহুবর্ণ এক নকশিকাঁথা।
অবিরাম চলতে থাকা আবহমানের তাঁতকল। সে সাহসী এবং সত। বাণিজ্যের কারণে, বেষ্ট সেলারের উল্টোপিঠে তার অবস্থান। লিটিল ম্যাগ আসলে এক
লড়াইয়ের নাম। যুদ্ধের গল্পে জড়িয়ে যাওয়া অনবদ্য স্বীকারোক্তি। লিটিল ম্যাগাজিনই
পারে রৌদ্র কিংবা ছায়ায় মাইলের পর মাইলের হেঁটে যেতে।
সারা বিশ্ব জুড়ে চিরদিনই কিছু লিটিল ম্যাগ তাদের কাজ করে গেছেন। এখনো যাছেন।
আগামীদিনেও কাজ করবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর ভালো লেখা বরাবরই লিটিল ম্যাগেই
প্রথম পড়েছি। প্রকৃত লেখাকে চিনে নেওয়া, খাঁটি লেখককে আবিষ্কার করা লিটিল ম্যাগের বরাবরের কাজ।
এই উত্তরবাংলায় প্রচুর ছোট পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। অতীতেও। বর্তমানেও। তবে
সমস্যা হচ্ছে সব পত্রিকা লিটিল ম্যাগ নয়। বেশীর ভাগ পত্রিকাই জাস্ট প্রকাশ করতে হয়
বলে করা। সম্পাদকদের না আছে সম্পাদনার দক্ষতা। না আছে পড়াশোনা। বেশিরভাগ সম্পাদকই
সংকলক মাত্র। তাই পাঠক বিভ্রান্ত হন। শক্তিশালী লেখক কে পাঠকের কাছে আর পৌঁছে
দেওয়া যায় না। আর ক্ষতিটা হয় বাংলা সংস্কৃতির।
তবে আমাদের আলোচনার বিষয় সেটা নয়। আমরা লিটিল ম্যাগাজিন নিয়েই কথা বলি বরং। এই
উত্তরবাংলা থেকে বরাবরই বেশ কিছু ভালো লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। আজো
প্রকাশিত হচ্ছে। অতীতের পত্রিকাগুলি নিয়ে কিছু বলব না। এখানে উত্তরের কিছু
নির্বাচিত শক্তিশালী কাগজ নিয়েই কথা বলবো, যেগুলো এখনো প্রকাশ হয়ে চলেছে। নিজস্ব স্বাক্ষর ও স্বতন্ত্রতা নিয়েই।
প্রায় ৩৯ বছর ধরে জলপাইগুড়ি থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ‘দ্যোতনা’। এই মূল্যবান পত্রিকাটি
সম্পাদনা করেন কবি, প্রাবন্ধিক, মুক্তচিন্তার শ্রদ্ধেও ব্যক্তিত্ব গৌতম গুহ রায়। প্রতিটি
সংখ্যাতেই নুতন কিছু ভাবনাকে নিয়ে কাজ করে ‘দ্যোতনা’। গৌতম একজন সৎ ও পরিশ্রমী
সম্পাদক। মুল্যবান প্রবন্ধ এই পত্রিকার সম্পদ। ‘ভাষা ও সংবেদন’ সংখ্যাটি
রীতিমত আন্তর্জাতিক মননকে ছুঁয়ে দিয়েছে। পাশাপাশী নুতন প্রতিভাকে তুলে ধরা হয়
প্রায় সব সংখ্যাতেই। কবিতা, প্রবন্ধ, গদ্য সব বিভাগেই নুতনেরা সুযোগ পান। এই বাংলা কেবল নয়, অসম ত্রিপুরা ও বাংলাদেশেও রয়েছে দ্যোতনা-র নিজস্ব
পাঠকগোষ্ঠী।
শিলিগুড়ি থেকে গল্পকার শুভময় সরকার সম্পাদনা করেন সাহিত্য ও সাহিত্য বিষয়ক
পত্রিকা ‘মল্লার’। ১৮ বছর ধরে। গর্ব করবার মতন একটি পত্রিকা। শুভময় সরকার শক্তিশালী গল্পকার।
কঠোর সম্পাদক। তার দেখার চোখ ও তীব্র এক খোঁজ দিয়ে ‘মল্লার’ কে প্রতি সংখ্যাতেই তিনি
নির্মান ও বিনির্মান করে তোলেন। বিষয়ভাবনায়, উপস্থাপনায় অনবদ্য সম্পাদনা। জহুরির মতন তিনি তুলে আনেন মূল্যবান সব
লেখাপত্তর। প্রবন্ধচর্চা ও ছোটগল্প কে প্রাধ্যান্য দেয় ‘মল্লার’। এবং অবশ্যই কবিতা। নুতন
মুখের সাথে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেয়। নানান ব্যতক্রমী ভাবনার প্রবন্ধ এখানে প্রকাশ
করা হয়। পাশাপাশী গুণী ব্যক্তিত্বের সাথে কথাবার্তা। অনবদ্য আয়োজন বটে।
‘তিতির’। কোচবিহারের নদীঘেরা দ্বীপশহর মাথাভাঙ্গা থেকে ১৭ বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত
হচ্ছে। সম্পাদক কবি সঞ্জয় সাহা। ‘তিতির’ ইতিমধ্যে দুই বাংলাতেই পাঠকমান্যতা অর্জন করেছে। এপারের
তথ্য সংস্কৃতি বিভাগের ‘লিটিল
ম্যাগাজিন স্মারক সম্মানের’ পাশাপাশী
বাংলাদেশের রাজশাহীতে অর্জন করেছে ‘চিহ্ন
সম্মাননা’। তিতির তার জাত চিনিয়ে
দিয়েছে এভাবেই। প্রতিটি সংখ্যাতেই নুতন নুতন ভাবনাকে বিষয় হিসেবে বেছে নেন
সম্পাদক। তিতির-এর লুপ্তপ্রায় সংখ্যা, চা বাগানের সাহিত্য সংস্কৃতি সংখ্যা, ভাষা নিয়ে করা কাজ, ডায়েরি
সংখ্যা, ওপার বাংলা নিয়ে সংখ্যা, মানসাই সুটুঙ্গার কবিতা সংখ্যা ভীষণ জরুরী ও মূল্যবান কাজ।
দাঁতে দাঁত চেপে সঞ্জয় তার তিতির কে নিয়ে নুতনতর এক লড়াইয়ের দিকেই।
উত্তরের আর একটি কাগজ ‘প্রবাহ
তিস্তা তোর্ষা’। যে শহরে কবি পূণ্যশ্লোক
দাসগুপ্ত থাকতেন, সেই
ডুয়ার্সের ধুপগুড়ি শহর থেকে ড.কৃষ্ণ দেবের সম্পাদনায় ২২ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে।
প্রবন্ধকে গুরুত্ব দিলেও, ছোট
গল্পের ও কবিতার নিরীক্ষার একটা দুরন্ত পরিসর রয়েছে এখানে। সম্পাদক নিজেও গবেষণা ও
লেখার জগতেরই মানুষ। অমিয়ভূষন মজুমদার বেশ কয়েকবার এই পত্রিকাতে লিখেছিলেন।
উত্তরের অনেক বিখ্যাত সাহিত্যকর্মী এখানে নিয়মিত লিখেছেন। এখনো লেখেন কেউ কেউ। এ
এক আশ্রয়ভূমি।
কবি রিমি দে। কবি হিসেবে বাংলা কবিতায় সে তার নিজস্বতায় স্বতন্ত্র। রিমি
সম্পাদনা করে আসছেন কবিতা ও কবিতা বিষয়ক পত্রিকা ‘পদ্য’.১৭ বছর ধরে একদম নিয়মিত।
প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন কবির কবিতাকে পাঠকের দরবারে সাবলীলভাবে পৌঁছে দেন তিনি। কবিতার
পাশাপাশী নানান দিক নিয়ে আলোচনা ও কবিতা বিষয়ক গদ্য প্রকাশ হয়। লড়াকু রিমির ‘পদ্য’ এক
মূল্যবান সংযোজন।
দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট থেকে কবি ও গল্পলেখক মৃণাল চক্রবর্তীর সম্পাদনায়
২৩ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে ‘দধিচী’। পাশাপাশী গড়ে তুলেছেন
প্রকাশনাও। ‘দধিচী’ প্রবন্ধচর্চাকে তুলে ধরে গুরুত্ব দিয়ে। পাশাপাশী লোকসংস্কৃতি বিষয়ক নানান লেখা
প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকাও নিয়েছে। আর ছোট গল্প ও কবিতা তো আছেই। আড়ম্বরহীন অথচ
গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছে ‘দধিচী’।
উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর থেকে মনোনীতা চক্রবর্তী ৭ বছর ধরে সম্পাদনা করে
আসছেন ‘দাগ’। এ এক বহুবর্ণ শব্দ শিল্পের নান্দনিক আয়োজন। মনোনীতা নিজে শক্তিশালী কবি, সুগায়িকা, বাচিক
শিল্পী। সাহিত্যে নিবেদিত। সাহিত্যের প্রতিটি বিষয় নিয়ে মূল্যবান সব লেখা সংগ্রহ
করে ‘দাগ’ কে সুসজ্জিত করেন তিনি। চমৎকার এই লিটিল ম্যাগটি গুনিজনমান্যতা আদায় করে
নিয়েছে ইতিমধ্যে।
কবি অতনু বন্দোপাধ্যায় জলপাইগুড়ি শহর থেকে ১৫ বছর ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ‘এখন বাংলা কবিতার কাগজ’ নিয়ে। এই পত্রিকার মুখ্য বৈশিষ্ট তরুন কবিদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেওয়া। অজস্র
তরুন কবিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এই পত্রিকা। পাশাপাশী প্রকাশনাও গড়ে তুলেছে অতনু।
এবং প্রচুর তরুনের বই সেখান থেকে প্রকাশ পেয়েছে। প্রবীর রায় বিজয় দের পাশাপাশী
রয়েছে সত্যম ভট্টাচার্য জয়শীলা গুহ বাগচী অমিত দে
মানিক সাহার বইগুলি। বাংলা কবিতা নিয়ে এমন নিরলস কাজ আমাদের বিষ্মিত করে
তোলে অবশ্যই।
শিলিগুড়ি থেকে সুমন সুভান পঙ্কজ শুভ্রদীপ এই চার তরুন কবির উন্মাদনার সুফসল ‘উত্তরের কবিমন’। এই পত্রিকাটি অত্যন্ত সিরিয়াসভাবে বিষয়ভিত্তিক কাজের আয়োজন করে। যেমন বৃহন্নলা
সংখ্যা। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে প্রয়াত কবি পূণ্যশ্লোক দাসগুপ্ত সংখ্যা।
তারুণ্যের আঁতুড়ঘর এই পত্রিকার আগামী কাজের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহী আমরা।
উত্তরের বিভিন্ন জেলায় আরো কিছু লিটিল ম্যাগ তাদের স্বতন্ত্রতা নিয়ে কাজ করে
চলেছে। কিন্তু আপাতত এটুকুই। ভবিষ্যতে অবশ্যি তাদের নিয়ে কথা বলবো।
সুবীর
সরকার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন