গরীব মানুষ ফড়িং খাই - পার্থ বসু



গরীব মানুষ ফড়িং খাই
পার্থ বসু
      ষাটের দশকের মাঝামাঝি। তখন আমার হস্টেল জীবন। থাকতাম কোলকাতা মাণিকতলার একটি হস্টেলে। বিবেকানন্দ রোড আর কর্নওয়ালিস স্ট্রীট ( এখন বিধান সরণী) এর মোড়ে। অক্সফোর্ড মিশন হস্টেল। কোলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন প্রাইভেট হস্টেল। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর  মহাস্থবির জাতকে এর উল্লেখ আছে।  ইংরেজি ইউ আকারে বিন্যস্ত প্রতি তলায় ১৫ টি ঘর। সম্ভবত ৪০ টির মত ঘর আবাসিকদের জন্য। নীচের তলায় দারওয়ানের ঘর। হোস্টেলের ওড়িয়া রাঁধুনি বামুন আর কর্মচারীদের ঘর। তিনতলায় ফাদারের অফিস। ছাত্রদের জন্য প্রতি ফ্লোরে দুটি করে টয়লেট। নীচের তলায় ডাইনিং হল আর তার পিছনে আয়তাকার একটি একটানা বিশাল চৌবাচ্চা। দড়ি বাঁধা বেশ কয়েকটি বালতি।

   ১৯৯৬ র কোলকাতায় এই হস্টেলে জায়গা পেতে হত মেধার ভিত্তিতে। মার্কস শিট জমা দিয়ে অপেক্ষা করতে হত যদি কপালে শিকে ছেঁড়ে। প্রতিটি ঘর সিঙ্গল সীটেড। থাকা খাওয়া নিয়ে সে যুগে খরচ ছিল মাসে  ৬৬ টাকা। মনে আছে বছরে ১২০০ টাকার একটা বৃত্তি পেতাম। ১২০০ মানে বিশাল টাকা। ভাবা যায় না। চেকটি নিয়ে একটি বিদেশী ব্যাঙ্কে খাতা খুলেছিলাম। গরীব মানুষ। ১২০০ মানে আমার কাছে ব্যাঙের আধুলি। ভারতীয় ব্যাঙ্কে খাতা খোলা আমাকে মানায় না।

  বছরে ১২০০ মানে মাসে ১০০ টাকা। হস্টেলে ৬৬ গেলে হাতে থাকছে তখনও ৩৪।একটি গেঞ্জির দাম পড়ত  ৩ টাকা। তো মাসে চারটে গেঞ্জি কিনলে নিয়মিত কাচার হ্যাপা থাকে না। তাতে গেল আরও বারো। এখনও ২২ বাকি !আমায় পায় কে ? বাবাকে না বলে একটি টিউশনি করতাম। ধরা পড়ে গেছিলাম। ছুটিতে বাড়ি গেছি। বিরহ সয় নি। শ্রীমান গিয়ে হাজির।

   প্রফুল্ল সেন মশাই তখনও মসনদে। তীব্র খদ্য সংকট। সেন মশাই কাঁচ কলা খাওয়ার নিদান দিয়েছেন। আর চাল চলাচলের উপর কর্ডন। একদম থানা স্তরে।

   আমাদের কিছু ধানজমি ছিল। অন্য থানা এলাকায়। আমড়দহ, দানপাতিয়া, পিপুল্যান , --- কয়েকশ ' বিঘা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাবা চাষবাসে সংসার চালাতেন। পেশায় ছিলেন হোমিওপাথি ডাক্তার। কোয়াক নন। বেঙ্গল অ্যালেন থেকে এম এইচ এম এস। কিন্তু আমাদের পাঁচ ভাইবোনের সংসার , আত্মীয়- কুটুম্বিতা সব সামলে, এখন বুঝি , হিমসিম খেতেন।

কর্ডনে কাল হল। অর্থকৃচ্ছতা ছিল। বাবার নিয়মিত চাকরির আয় ছিল না। ভাতের অভাব হত না ক্ষেতির কল্যাণে। কর্ডনে আমাদের জমি থেকে চাল আসা বন্ধ হয়ে গেল। বাবার অনেক ধারদেনা হয়ে গেল। সে এক সময় গেছে আমাদের !

   গরীব মানুষ। অগত্যা ফড়িং খাই।

   এই ফড়িং খাওয়ার পর্ব সম্ভবত ৬৫ র। অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছিল। হস্টেলে ভাতে টান পড়ল। ভারতে তখন পি এল ৪৮০ র মাইলো। মেদিনীপুরের বোর্ডার যারা মাথায় হাত। আমি , কল্যাণ আর বিদ্যুৎ ভাতের বিকল্পে রুটি শুরু করলাম ওদের স্বার্থে। এই সহমর্মিতা হস্টেল জীবনের শিক্ষা।

   আমার ঘরটি ছিল দোতলার প্রান্তিক ঘরটি। রুম নং ১৫। বিবেকানন্দ রোডের দিকে , দক্ষিণে একটি জানালা। আর একটি পূর্বে মানিকতলার দিকে। কোণের ঘর বলেই বাড়তি জানালা। পুবের জানালা অবশ্য খোলার জো ছিল না। মুখোমুখি  খিড়কি থেকে আওয়াজ দিত পঞ্চকন্যা। প্রথম দিনেই প্যাঁক খেয়েছি। পড়ার টেবিলে ভালো ছেলেটি, গালে সদ্য ব্রণ এবং ছুলি,  বই খুলেছি । কানে এল--
    এক ছিল মোটা কেঁদো বাঘ
    গালে তার সাদা সাদা দাগ ।

   কবি জীবনানন্দ দাস এই হোস্টেলের বোর্ডার ছিলেন। তিনি কোন দশ মহাবিদ্যার খপ্পরে পড়েছিলেন কে জানে !
                                                           
 

  নামে তালপুকুর। ঘটি ডোবে না। রেশন কার্ডে আমরা ক। সুতরাং সস্তায় রেশন আমাদের জন্য নয়। ইস্কুলে , বনগাঁয়ের শেয়াল রাজা, ক্লাসের ফার্স্ট বয়। কিন্তু মাইনে ফ্রি নয়। নিয়মে আটকাত। উচ্চ মাধ্যমিকে পরীক্ষার ফি হেড মাস্টারমশাই ভবানী শঙ্কর দে মশাই কি ভাবে যেন যোগাড় করে দিয়েছিলেন। ভালো রেজাল্টের জন্য কোচিং এর এক বছরের বকেয়া মাইনে মকুব হয়েছিল। চশমার ডাঁটি ভেঙে ওইভাবেই  ক্লাস করেছি। হাফ প্যান্ট পরে উচ্চ মাধ্যমিক। কলেজে গিয়ে নিজের রোজগারে মাসিক কিস্তিতে  টেরিলিনের প্যান্ট, শার্ট । না , আমার কোন ক্ষোভ ছিল না। অনুযোগ ছিল না। আমার সৌভাগ্য আমি , সেনবাবুর কল্যাণে , অভাবের মুখব্যাদান টের পেয়েছি। কিন্তু আমার পড়াশুনা , বইপত্র জে কোন প্রয়োজন বাবা মা কিভাবে যেন জুগিয়ে যেতেন। নিজেদের জমি থাকতেও চাল কিনে খেতে হচ্ছে। তারই মধ্যে  গৃহশিক্ষক। আমাদের বাড়ির অতিথি। আবাসিক। মায়ের শাড়িটি ছেঁড়া। মাস্টারমশায়ের আদর যত্নে ত্রুটি নেই। কাঁচা পয়সা হাতে নেই। বাবা হিমসিম খাচ্ছেন সব দিক সামলাতে। আমি কি বুঝছি না ?

   তবু যেদিন বড় হয়ে গেলাম সেদিনের গল্পটি বলে নিই।

   বিধানবাবু ই এস আই প্রকল্প চালু করেছেন কারখানার শ্রমিকদের জন্য। বাবার অনেক রুগি মজুর চাষি ঘরের। এক ধাক্কায় বাবার রুগিতে টান পড়ল। রুজিতেও। তখন আমাদের সত্যিই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আমি সব বুঝেও সেদিন কেন যে বায়না করে বসলাম ! তখন সবে ক্লাস এইট। বলে ফেললাম এবার সারা বছরে একবারও ইলিশ এল না বাবা।

 বিকেলে বাবার হাতে কিছু টাকা এসে গেল। বাবার আকাশবৃত্তি। পেলেই দিলদার। আদেশ হল-- খোকন, বাজারে গিয়ে ইলিশ কিনে আন।

  যা টাকা তাতে একটা খোকা ইলিশ কেনা গেল। প্রায় নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ির সামনের ঘরটি বাবার ডাক্তারখানা। ভাড়াবাড়ি। এক চিলতে উঠান পেরিয়ে দু কামরা , রান্নাঘর, বারান্দা, সিঁড়ি নিয়ে টিনের চালার বাসা। ডাক্তারখানায় বাবাকে দেখতে পেলাম না। ভিতরের ঘর থেকে বাবা মা-র কথাবার্তা কানে এল। মা বলছেন-- মাছ তো কিনতে পাঠালে ? সর্ষের তেল ?

  মরমে মরে গেলাম। ছিঃ। আমার বোঝা উচিত ছিল আগেই। বাবা দেখি বাইরের ঘরে আসছেন।
  --- এসে গেছিস ?  বাবার গলায় উল্লাসের খামতি নেই। কিন্তু আমি ছিটকে ঘুরে দাঁড়ালাম। বাবাকে আপনি বলে কথা বলতে শিখিয়েছিলেন মা ।
 ---- একদম ঠকে গেছি বাবা। গন্ধ পাচ্ছেন ? মাছটা পচা।

  বাবাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ছুটলাম। মাছটা আমায় ফেরত দিতেই হবে।
  আমি বড় হয়ে গেছি কিনা।
                                                      
 

  গল্পটি বহরমপুরে থাকার সময় ঝড় পত্রিকায় দিয়েছিলাম। উত্তম পুরুষে বলি নি কেবল। সম্পাদক রবীন বিশ্বাস মশাই আমাকে দিয়ে অনেক গল্প লিখিয়ে নিয়েছিলেন। উনি পড়ে বললেন-- ইলিশ কিন্তু গরীবের মাছ। তেল লাগবে কেন ? মাছের তেলেই তো মাছ ভাজা যায়। অকাট্য যুক্তি। মা হয়তো ভাপাই রাঁধতেন।

  কিন্তু আমার বড় হওয়া পিছিয়ে যেত।
  গল্পটি আজ বললাম আপনাদের। মা বাবাকেও বলি নি কখনও।

পার্থ বসু


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন