সম্পাদকের কলমে


বাংলা বাঙালি ও বইমেলা


ফেব্রুয়ারী ভাষার মাস। ফেব্রুয়ারী মেলার মাস। ফেব্রুয়ারী বইয়ের মাস। এইমুহূর্ত্তেই কাঁটাতারের উভয় পারেরই চলছে বিশ্ব বিখ্যাত দুইটি বই মেলা। কলিকাতা পুস্তকমেলা ও অমর একুশে গ্রন্থমেলা। আমরা বাঙালিরা বই পাগল হই আর না হই মেলা পাগল জাতি। তাই যেখানেই মেলা, সেখানেই আমরা। বই পড়ি আর নাই পড়ি, বই কিনি কিংবা নাই কিনি বইমেলায় আমরা হাজির। বই মেলাকে বন্ধুমেলায় উত্তীর্ণ করে দিয়ে গল্প আর হুল্লোর ছবি আর সেল্ফীর মৌতাতে পরিপূর্ণ করে ঘরে ফেরা। না অনেকেই প্রতিবাদ করে উঠবেন জানি। বইমেলায় তবে এত এত কোটি টাকার বই বিক্রী হয় কি করে? অবশ্যই বিক্রী হয়। শুধু বইমেলা কেন, সারা বছরভর সারা বাংলায় বই বিক্রীও নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু একটু পরিসংখ্যান নিতে পারলে হয়ত দেখা যাবে চিত্রটি ততটা আশাপ্রদ নয়, যতটা ওপর থেকে মনে হয়। দুই বাংলা মিলিয়ে মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ শিক্ষিত, আর সেই শিক্ষিত জনসাধারণের কত শতাংশ বই কিনতে অভ্যস্ত। একটু সঠিক ভাবে এই হিসাবটি নিতে পারলেই আমরা প্রকৃত চিত্রটি বুঝতে পারতাম।  এবং মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ সিলেবাসের পাঠ্যবইয়ের বাইরে  নিয়মিত বই কেনে সেই হিসাবটি যদি উন্নত বিশ্বের যে কোন দেশের হিসাবের সাথে তুলনা করে দেখা যেত তবে নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, আমাদের অনেকেরই চোখ কপালে উঠে যেত। আর তখনই বোঝা যেত উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই কেন বইমেলার কোন রেওয়াজ নাই। সেখানে সারা বছর ধরে প্রকাশকরা যে পরিমাণে বই বিক্রী করতে পারেন, তাতে আর আলাদা করে বইমেলায় গিয়ে ক্রেতা ধরার আয়োজন করতে হয় না। এইখানেই আমাদের বাংলায় কাঁটাতারের উভয় পারেই বইমেলার গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা। মূলত বইমেলাকে কেন্দ্র করেই বাংলার প্রকাশকরা তাঁদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের লাভের করির হিসাবটা জারি রাখতে পারেন। নয়ত কবেই অন্য ব্যবসায়ে অর্থ লগ্নী করতে হতো।

একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখতে পাবো সার্বিক এই চিত্রের মধ্যে লেখকদের অবস্থান কতটা শোচনীয়। খুব জনপ্রিয় হাতেগোনা মুষ্টিমেয় কয়েকজন কথাসাহিত্যিক ছাড়া বাকি কোন লেখকদেরই পেশা নয় লেখা। এমনকি সব জনপ্রিয় লেখকেরও মূল পেশা লেখালিখি নয়। অর্থাৎ কেবল মাত্র লেখালিখি করেই গ্রাসাচ্ছাদনের বন্দোবস্ত সম্ভব নয়। অধিকাংশ লেখকই কষ্টার্জিত অর্থেই বই প্রকাশ করতে বাধ্য হন। কিংবা প্রায় বিনামূল্যেই প্রকাশকের হাতে তুলে দিতে হয় পাণ্ডুলিপি। তারপরেও অধিকাংশ বইই রয়ে যায় অবিক্রীত। অর্থাৎ লেখক আছে। লেখাও আছে কিন্তু পাঠক নাই। আর ঠিক সেইকারণেই বইমেলার মতো একটি উৎসবের হুজুগ তৈরী করে পাঠকের কাছে গিয়ে পৌঁছাতে হয় প্রকাশক ও লেখককে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সমাজবাস্তবাতা আমাদের বাংলায়। বৃটিশ চলে যাওয়ার পরে সাত সাতটি দশক কেটে গেলেও আমাদের বাংলায় সেই অর্থে পাঠক তৈরী হয় নি আজও।

এখন জনসংখ্যার সঠিক অনুপাতে আমরা পাঠক তৈরী করতে কেন পারি নি সেটি অবশ্যই রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। সে আলেচনার ক্ষেত্রও নয় এইটি। কিন্তু তবু একথা স্বীকার করতেই হবে জনসাধারণকে জনসম্পদে উত্তীর্ণ করতে না পারলে পাঠক তৈরী সম্ভব নয়। বস্তুত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে প্রশাসকদের মূল লক্ষ্যই থাকে জনসাধারণকে স্বাধীন চিন্তা চেতনার উদ্বোধন থেকে যতটা দূরবর্তী রাখা যায়। আর সেই কারণেই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে জনসম্পদ তৈরীর মেকানিজমগুলিকে যতটা সম্ভব ভোঁতা করে রাখা হয়। যার ফলস্বরূপ প্রকৃত পাঠকের সংখ্যাটিও জনসংখ্যার তুলনায় ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। সেই কারণেই কপাল পোড়ে প্রকৃত লেখকেরও। পাঠকের আনুকুল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকতে হয় তাঁদের অধিকাংশ সৃষ্টিকেই।

এতো গেল পাঠকের সংখ্যাল্পতার দিক। বইমেলা যদি বই প্রকাশের উৎসব বলেও ধরা যায়, তাহলেও আরও একটি গভীর বিষয়ের সামনাসামনি হতে হবে আমাদের। বই প্রকাশ স্বাধীন মত প্রকাশের অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। কিন্তু সেই মাধ্যমকেই যদি সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রেণর মধ্যে পড়তে হয় তবে সে একা ভয়াবহ পরিণতি। কাঁটাতারের পূর্ব পারে যদি একটু চোখ ফেরানো যায়, তাহলেই বোঝা যাবে পরিস্থিতির ভয়াবহতা। বই প্রকাশ তো কেবলমাত্র শব্দের কঙ্কালকে দুই মলাটের মধ্যে সাজিয়ে পরিবেশন করা নয়! বই মেধা ও মননের ধারক ও বাহক। বই চিন্তা ও চেতনার সমৃদ্ধির ভিত। বই সুস্পষ্ট জীবনবোধের প্রকাশ মাধ্যম। সেই জীবনবোধের প্রকাশকেই বলে মুক্তচিন্তার পরিসর। একটি জাতি ঠিক ততটাই উন্নত, যতটা উন্নত তার মুক্তচিন্তার পরিসর। একুশের চেতনায় আজ যদি সেই সত্যই ধামাচাপা পড়ে গিয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশের আজ সত্যই বড়ো দুর্দিন! যে দুর্দিনের সূত্রপাত তসলিমা নাসরিনকে দেশছাড়া করার মধ্যে দিয়ে। বস্তুত তারপর থেকেই ওপার বাংলায় মুক্তচিন্তার পরিসর ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসতে থাকে। বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী হুমায়ুণ আজাদের উপর বর্বর আক্রমণের পথ ধরে আজ বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার পরিসরটিই পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। পরপর ব্লগার হত্যা, লেখক বুদ্ধিজীবিদের উপর প্রাণনাশের হুমকি ও হত্যালীলায় আজকের বাংলাদেশে কেউই আর স্বাধীন লেখক বুদ্ধিজীবি হিসাবে থাকতে পারছেন না। হয় তাদের দেশ ছাড়তে হচ্ছে তসলিমার মতো, নয়তো তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেদেরকে। আর বুদ্ধিমানেরা সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে পাল্টে ফেলছেন নিজেদের গায়েরই রং। একটি দেশের পক্ষে এ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। একটি জাতির জীবনে এ এক অন্ধকার যুগ। যে অমর একুশ নিয়ে বাংলাদেশের গর্ব করার কথা, সেই অমর একুশের ঐতিহ্যবাহী একুশের বইমেলাতেই একের পর এক ঘটে গিয়েছে মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে চাপাতির আস্ফালন। গড়িয়ে পড়েছে বাংলার মনীষার তাজা তরুণ রক্ত। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে বিবেকী কণ্ঠের প্রত্যয়ী উচ্চারণগুলি। যেগুলি সমাজ ও জাতিকে পথ দেখাতে জরুরী ছিল সবচেয়ে বেশি। একদিকে মেধানিস্ক্রমণ, একদিকে স্বাধীন মেধাগুলিকে চিহ্নিত করে একে একে হত্যা করা, একদিকে মুক্তচিন্তার সমস্ত পরিসরগুলিকে হুমকি দিয়ে ভয় দেখিয়ে অবরুদ্ধ করে দেওয়া এই সবের মধ্যে দিয়ে আর যাই হোক না কেন, কোন জাতির মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটে না। জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি মুখ থুবড়ে পড়ার দিকে এগিয়ে চলে দ্রুতগতিতে। আবার সেই সাথে শুরু হয়েছে বাংলাভাষার ধর্মীয়করণের এক ষড়যন্ত্র। স্কুলপাঠ্য সিলেবাসে হাত পড়েছে সবার আগে। সেখান থেকেই সাম্প্রদায়িক মানসিকতার অভিশপ্ত বীজ বপনের চেষ্টা চলছে পুরোদমে। যাতে করে একটি পঙ্গু ও খর্ব প্রজন্ম তৈরী করে তোলা যায়। যাদেরকে ধর্মীয় আবেগে সহজে বশ করে ব্যবহার করা যাবে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে। বলি হবে জাতির বিবেক। অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে জনসত্ত্বার স্বাভাবিক বিকাশ। 

এমনকি অমর একুশের গ্রন্থমেলাতেও কোন বই প্রকাশিত হবে আর হবে না তাও ঠিক করে দেওয়ার ভার নিয়ে নিয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রই, বাংলা একাডেমীর বকলমে। এই অমর একুশের গ্রন্থমেলাতেই বিশেষ বিশেষ বই প্রকাশের অভিযোগে বদ্বীপ প্রকাশনীর মতো প্রকাশনীর বই বাজেয়াপ্ত করে গ্রেফতার করাও হয়েছিল প্রকাশক তথা স্বাধীন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞা শামসুজ্জোহা মানিক ও তাঁর ভাইকেও। দীর্ঘদিন কারাবাসে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল যাঁদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেই। এই অমর একুশে গ্রন্থমেলাতেই বাংলা একাডেমীর সেন্সরের মধ্যে দিয়েই বই প্রকাশের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। যে কারণে অনেক প্রকাশকই বর্তমান মেলা থেকে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেদেরকেই।

কাঁটাতারের ওপর পারের এই ভয়াবহ পরিণতি দেখে এপারের মানুষ যদি নিশ্চিন্তে থাকতে চান, তবে সেটি জেগে ঘুমানোর মতোই বিষয় হবে। এপারের বুদ্ধিজীবী লেখকদের অধিকাংশই সেল্ফ সেনসরের কাঁচিতে নিজেদের লেখালিখিকেই বেঁধে ফেলেছেন সুনিপুন দক্ষতায়। কারণ তাঁরা জানেন ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরা করতে গেলে কোনটা লেখা যাবে আর যাবে না। কে আর সাধ করে শাসকের রক্তচক্ষুর সামনে পড়তে চায়। ফলে এপারের লেখালেখির জগতে এই সেল্ফ সেনসরের পরিমণ্ডলে মধ্যমেধার চাষ হয়ে চলেছে ব্যাপক ভাবে। এবং নিরন্তর ভাবেই। আর এই প্রবণতার শুরু হয়েছিল প্রধানত নকশাল আন্দোলনের সামূহিক ব্যার্থতার হাত ধরেই। এরপর থেকেই লেখক বুদ্ধিজীবী ও প্রশাসকদের মিউচ্যুয়াল আন্ডারস্ট্যাণ্ডিং প্রায় শিল্পের পর্যায় পৌঁছিয়ে গিয়েছে এই বঙ্গে। পরিবর্তনের হাত ধরেও যে ধারা আজও অপরিবর্তিত!

ফেব্রুয়ারীর এই মেলাময় মাসের বই বই কোলাহলের তলায় এই যে জমাট অন্ধকার দিনে দিনে ক্রমেই পাকাপোক্ত হয়ে প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে চলেছে, কোন জাতির পক্ষেই সে বড়ো সুখের সময় নয়। আর ঠিক এই রংরুট ধরে এগিয়ে চলা জাতির সম্বিত ফেরানোর স্বপ্ন নিয়ই রংরুটের পথচলা শুরু হয়েছিল বিগত পঁচিশে বৈশাখ। একটি বছর সম্পূর্ণ করতেই রংরুটের এই বর্ষশেষ সংখ্যা।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন